كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ
এ দুনিয়াতে এমনভাবে থাক যেন তুমি একজন বিদেশী অথবা পথিক।” (অর্থাৎ বিদেশীর মতো বা পথিকের মতো হাল্কা বোঝা নিয়ে জীবনযাপন কর)।
আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ানের প্রাসাদে, হারুনুর রশীদের সেনাবাহিনীতে, ইবনে জাসসাসের অট্টালিকায়, কারূনের ধনভাণ্ডারে অথবা গোলাপের বাগানে সুখ নেই। কল্যাণ ও সুখ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীদের (রাঃ) ভাগ্যে ছিল, যদিও তারা গরীব ছিলেন এবং কঠিন জীবনযাপন করতেন। ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর সুখ ছিল হাদীস সংগ্রহের মাঝে, হাসান বসরীর সুখ ছিল তার সত্যবাদিতার মাঝে, ইমাম শাফীঈ (রহঃ)-এর সুখ ছিল তার অনুসিদ্ধান্তের মাঝে, ইমাম মালেক (রহঃ) এবং ইমাম আহমদের (রহঃ) সুখ ছিল তাদের অন্তদৃষ্টি ও আত্মসংযমের মাঝে এবং ছাবিত আল-বান্নায়ির সুখ ছিল তার ইবাদতে।
ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمْ لَا يُصِيبُهُمْ ظَمَأٌ وَلَا نَصَبٌ وَلَا مَخْمَصَةٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلَا يَطَئُونَ مَوْطِئًا يَغِيظُ الْكُفَّارَ وَلَا يَنَالُونَ مِنْ عَدُوٍّ نَّيْلًا إِلَّا كُتِبَ لَهُم بِهِ عَمَلٌ صَالِحٌ إِنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ
“কেননা, আল্লাহর রাস্তায় তাদের যে পিপাসা, ক্লান্তি ও ক্ষুধা হয়, কাফেরদের ক্রোধ উদ্রেককারী যে পদক্ষেপ তারা নেয় এবং শক্রদের পক্ষ থেকে তারা যে আঘাতপ্রাপ্ত হয় তা তাদের জন্য আমলে সালেহ হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। নিশ্চয় আল্লাহ আমলে সালেহকারীদের প্রতিদান নষ্ট করেন না।” (৯-সূরা তাওবাঃ আয়াত-১২০)
সুখতো আর টাকার চেক, কেনা গাড়ি বা পাম্প করে উঠানো তেল নয়। সুখ হলো সত্যের উপর থাকার ফলে উৎপন্ন শান্তি, সুখ হলো সুযুক্তিপূর্ণ বিচক্ষণ, নির্ভরযোগ্য ও উপকারী নিয়মনীতি অনুযায়ী জীবন-যাপন করার ফলে অর্জিত মনের শান্তি এবং সুখ হলো ভালো জীবনযাপন করার ফলে সৃষ্ট শান্তভাব। আমরা ভাবতাম যে, যদি আমরা আরো বড় একটি বাড়ি কিনতাম। আরো জিনিস-পত্র থাকত, যদি সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি এবং জীবনকে সহজতর করে এমনসব মেশিন-পত্র কিনতাম, তবে আমরা সুখী ও আনন্দিত হতাম। কিন্তু পরে যখন দেখলাম এ জিনিসগুলোই আমাদের জীবনের দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা ও সমস্যার কারণ তখন আমরা এতে বিস্মিত হয়ে গেলাম ।
وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَىٰ مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِّنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ
“দুনিয়ার জীবনের যে জাকজমক ও সৌন্দর্য তাদের কিছু দলকে পরীক্ষা করার জন্য আমি ভোগ করতে দিয়েছি, আপনি কিছুতেই সেদিকে আপনার চোখদ্বয়কে প্রসারিত করবেন না।” (২০-সূরা ত্বাহাঃ আয়াত-১৩১)
হেদায়েতের বার্তাবাহক মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ সংস্কারক। আর্থিকভাবে তিনি ছিলেন দরিদ্য; মাঝে মাঝে ক্ষুধা মিটানোর জন্য একটি নিম্নমানের খেজুরও পেতেন না। এসব সমস্যা, জটিলতা ও কষ্ট সত্ত্বেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন এক অনুপম পর্যায়ের কল্যাণ ও শান্তির জীবনযাপন করতেন, যার প্রসারতা ও বিস্তার মহান আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না।
وَوَضَعْنَا عَنكَ وِزْرَكَ الَّذِي أَنقَضَ ظَهْرَكَ
“আর আমি আপনার থেকে বোঝাকে (দুশ্চিন্তাকে) দূর করে দিয়েছি, যা আপনার পিঠ ভেঙ্গে দিয়েছিল (অর্থাৎ যা আপনার জন্য খুব কষ্টকর ছিল।)”
وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا
“এবং আপনার উপর আল্লাহর অনুগ্রহ খুবই মহান।” (৪-সূরা আন নিসাঃ আয়াত-১১৩)
اللَّهُ أَعْلَمُ حَيْثُ يَجْعَلُ رِسَالَتَهُ
“আল্লাহ ভালোই জানেন কাকে তার রিসালাত দিবেন।” (৬-সূরা আন’আমঃ আয়াত-১২৪)
একটি নির্ভরযোগ্য হাদীসে বর্ণিত আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
الْبِرُّ حُسْنُ الْخُلُقِ وَالْإِثْمُ مَا حَاكَ فِي صَدْرِكَ وَكَرِهْتَ أَنْ يَطَّلِعَ عَلَيْهِ النَّاسُ
“উত্তম চরিত্রই পুণ্য আর তোমার বিবেক যে কাজে বাধা দেয় এবং মানুষ তা জানুক তা তুমি পছন্দ কর না তাই পাপ।”
পুণ্যকর্ম (আমলে সালেহ) বিবেক ও আত্মা উভয়কেই শান্ত করে বা শান্তি দেয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
ألبر طما نينة والاثم ريبة
“পুণ্যকর্ম হল মনের প্রশান্তি আর পাপ হলো মনের অনিশ্চয়তা (সন্দেহ)।”
পুণ্যকর্মকারী সর্বদা শান্তিতে থাকেন আর পাপী তার চারিদিকে কি হচ্ছে তা নিয়ে সর্বদা সতর্ক ও সন্দেহ প্রবণ।
يَحْسَبُونَ كُلَّ صَيْحَةٍ عَلَيْهِمْ
“তারা মনে করে প্রতিটি চিৎকারই (শব্দই) তাদের বিরুদ্ধে (উচ্চারিত হচ্ছে)”। (৬৩-সূরা মুনাফিকূনঃ আয়াত-৪)
অন্যায় অত্যাচার ও পাপকারী উদ্বিগ্নতা থেকে সন্দেহে এবং অবশেষে বুদ্ধি বৈকল্য (নামক) রোগে ভোগে। এক আরব কবি বলেন-
إذا ساءَ فِعْلُ المرْءِ ساءَتْ ظُنُونُهُ ٭ وَصَدَقَ مَا يَعتَادُهُ من تَوَهُّمِ
কেউ মন্দ কাজ করলে সে সন্দেহে ভোগে, আর তার মনে যে কল্পনা আসে সেটাকেই সে বিশ্বাস করে।
যে সুখ তালাশ করে তার জন্য ভালো কাজ করা ও মন্দ কাজ পরিহার করার মাঝেই স্পষ্ট সমাধান আছে।
الَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُم بِظُلْمٍ أُولَٰئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُم مُّهْتَدُونَ
“যারা ঈমান আনে এবং তাদের ঈমানকে জুলুমের সাথে মিশিয়ে ফেলে না তাদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত।” (৬-সূরা আন’আমঃ আয়াত-৮২)
আত্মিকভাবে সুস্থ মুসলিম হওয়া রোম ও পারস্য সাম্রাজ্যের মালিক হওয়ার চেয়েও ভালো (ইংরেজি অনুবাদক এখানে নাম সংক্রান্ত ভুল করেছেন তাই আমি ভাবানুবাদ করলাম। কেননা, এখানে নাম উদ্দেশ্য নয় বরং উদ্দেশ্য হলো একথা বুঝানো যে, পার্থিব বিশাল সম্পদের মালিক হওয়ার চেয়ে মুসলিমের নিকট আত্মার শান্তি বেশি ভালো -অনুবাদক) কেননা, ধর্ম (দ্বীন ইসলাম) আপনি বেহেশতের বাগানে বসতি গড়া পর্যন্ত আপনার সাথে থাকবে। ক্ষমতা ও পদমর্যাদা শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী ও নশ্বর।
إِنَّا نَحْنُ نَرِثُ الْأَرْضَ وَمَنْ عَلَيْهَا وَإِلَيْنَا يُرْجَعُونَ
“নিশ্চয় আমি পৃথিবী ও এর উপর যা কিছু আছে সব কিছুরই মালিক এবং আমার নিকটই সব কিছু ফিরিয়ে আনা হবে।” (১৯-সূরা মারইয়ামঃ আয়াত-৪০)