উত্তর: আলহামদুলিল্লাহ।
এক: রমজান মাসে রোজা পালন ইসলামের অন্যতম একটি ভিত্তি। যে ভিত্তিগুলোর উপর ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইবনে উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
( بُنِيَ الإِسْلامُ عَلَى خَمْسٍ : شَهَادَةِ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ ، وَإِقَامِ الصَّلاةِ ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ ، وَالْحَجِّ ، وَصَوْمِ رَمَضَان )
“ইসলাম পাঁচটি রোকনের উপর প্রতিষ্ঠিত: এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহর রাসূল, নামায কায়েম করা, যাকাত দেওয়া, হজ্জ আদায় করা এবং রমজান মাসে রোজা পালন করা।”
সুতরাং যে ব্যক্তি রোজা ত্যাগ করল সে ইসলামের একটি রোকন ত্যাগ করল এবং কবিরা গুনাতে লিপ্ত হল। বরঞ্চ সলফে সালেহিনদের কেউ কেউ এ ধরণের ব্যক্তিকে কাফির ও মুরতাদ মনে করতেন। আমরা এ ধরনের গুনাহ থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
ইমাম যাহাবী তার ‘আল-কাবায়ের’ গ্রন্থে (পৃঃ ৬৪) বলেছেন:
“মুমিনদের মাঝে স্বীকৃত যে, যে ব্যক্তি কোন রোগ বা কারণ ছাড়া রমজান মাসে রোজা ত্যাগ করে সে ব্যক্তি যিনাকারী ও মদ্যপ মাতালের চেয়ে নিকৃষ্ট। বরং তাঁরা তার ইসলামের ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করেন এবং তার মাঝে ইসলামদ্রোহিতা ও বিমুখতার ধারণা করেন।” সমাপ্ত
দুই: পরীক্ষার কারণে রোজা না-রাখার ব্যাপারে শাইখ বিন বায রাহিমাহুল্লাহ কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি বলেন: “একজন মুকাল্লাফ (শরয়ি দায়িত্বপ্রাপ্ত) ব্যক্তির জন্য রমজান মাসে পরীক্ষার কারণে রোজা না-রাখা জায়েয নয়। কারণ এটি শরিয়ত অনুমোদিত ওজর নয়। বরং তার উপর রোজা পালন করা ওয়াজিব। দিনের বেলায় পড়াশোনা করা তার জন্য কষ্টকর হলে সে রাতের বেলায় পড়াশুনা করতে পারে। আর পরীক্ষা-নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের উচিত ছাত্রদের প্রতি সহমর্মী হওয়া এবং রমজান মাসের পরিবর্তে অন্য সময়ে পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা। এর ফলে দুইটি সুবিধার মধ্যে সমন্বয় করা যায়। ছাত্রদের সিয়াম পালন ও পরীক্ষায় প্রস্তুতির জন্য অবসর সময় পাওয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে সহিহ হাদিসে এসেছে তিনি বলেন:
( اللهم من ولي من أمر أمتي شيئاً فرفق بهم فارفق به ، ومن ولي من أمر أمتي شيئاً فشقّ عليهم فاشقق عليه ) أخرجه مسلم في صحيحه
“হে আল্লাহ! যে ব্যক্তি আমার উম্মতের যে কোন পর্যায়ের কর্তৃত্ব লাভ করে তাদের সাথে কোমল হয় আপনিও তার প্রতি কোমল হন। আর যে ব্যক্তি আমার উম্মতের কর্তৃত্ব পেয়ে তাদের সাথে কঠোর হয় আপনিও তার সাথে কঠোর হন।”[সহিহ মুসলিম]
তাই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ-কর্তৃপক্ষের প্রতি আমার উপদেশ হল- তাঁরা যেন ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সহমর্মী হন। রমজান মাসে পরীক্ষা না দিয়ে রমজানের আগে বা পরে পরীক্ষার সময়সূচী নির্ধারণ করেন। আমরা আল্লাহর কাছে সবার জন্য তাওফিক প্রার্থনা করি।” সমাপ্ত [ফাতাওয়া আশ-শাইখ ইবনে বায (৪/২২৩)]
‘ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি’ কে প্রশ্ন করা হয়েছিল:
আমি রমজান মাসে একটানা সাড়ে ৬ ঘণ্টা পরীক্ষা দিব। মাঝে ৪৫ মিনিটের বিরতি আছে। একই পরীক্ষায় আমি গত বছরও অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু সিয়াম পালনের কারণে ভালোভাবে মনোযোগ দিতে পারিনি। তাই পরীক্ষার দিনে কি আমার রোজা না-রাখা জায়েয হবে?
তাঁরা উত্তরে বলেন:
“উল্লেখিত কারণে রোজা না-রাখা জায়েয নয়; বরং তা হারাম। কারণ রমজানে রোজা না-রাখার বৈধ ওজরের মধ্যে এটি পড়ে না।” সমাপ্ত
[ফাতাওয়াল লাজ্নাদ্ দায়িমা (ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়া সমগ্র (১০/২৪০)]
তিন:
না-রাখা রোজাগুলো কাযা করার ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা প্রয়োজন:
আপনি যদি এই ভেবে রোজা না-রেখে থাকেন যে পরীক্ষার কারণে রোজা না-রাখা জায়েয, তবে আপনার উপর শুধু কাযা করা ওয়াজিব। আপনার যেহেতু ভুল ধারণা ছিল এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আপনি হারামে লিপ্ত হননি তাই আপনার ওজুহাত গ্রহণযোগ্য। আর আপনি যদি তা হারাম জেনে রোজা না-রাখেন তবে আপনার উপর অনুতপ্ত হওয়া, তওবা করা এবং পাপ কাজে পুনরায় ফিরে না আসার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা ওয়াজিব। কাযা করার ক্ষেত্রে যদি আপনি রোজা শুরু করে দিনের বেলায় রোজা ভেঙ্গে ফেলেন তাহলে আপনাকে এর কাযা পালন করতে হবে। আর যদি আপনি শুরু থেকেই রোজা না-রেখে থাকেন তাহলে আপনার উপর কোন কাযা নেই। এর জন্য আল্লাহ চাহেত ‘সত্যিকার তওবা’ (তওবায়ে নাসুহ)-ই যথেষ্ট। আপনার উচিত বেশি বেশি ভাল কাজ করা, নফল রোজা রাখা; যাতে করে ছুটে যাওয়া ফরজ ইবাদতের ঘাটতি পূরণ করে নিতে পারেন।
শাইখ ইবনে উছাইমীন রাহিমাহুল্লাহকে রমজানে দিনের বেলায় বিনা ওজরে পানাহারের হুকুম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তিনি বলেন:
রমজানে দিনের বেলায় বিনা ওজরে পানাহার করা মারাত্মক কবিরা গুনাহ। এতে করে ব্যক্তি ফাসেক হয়ে যায়। তার উপর ওয়াজিব হচ্ছে- আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং রোজা না-রাখা দিনগুলোর কাযা রোজা পালন করা। অর্থাৎ সে যদি রোজা শুরু করে বিনা ওজরে দিনের বেলায় রোজা ভেঙ্গে ফেলে তাহলে তার গুনাহ হবে এবং তাকে সে দিনের রোজা কাযা করতে হবে। কারণ সে রোজাটি শুরু করেছে, সেটি তার উপর অনিবার্য হয়েছে এবং সে ফরজ জেনে সে আমলটি শুরু করেছে। তাই মান্নতের ন্যায় এর কাযা করা তার উপর আবশ্যক। আর যদি শুরু থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিনা ওজরে রোজা ত্যাগ করে তবে অগ্রগণ্য মত হল তার উপর কাযা আবশ্যক নয়। কারণ কাযা করলেও সেটি তার কোন কাজে আসবে না। যেহেতু তা কবুল হবে না।
শরয়ি কায়েদা হল: নির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পৃক্ত কোন ইবাদত যখন বিনা ওজরে সে নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করা হয় না সেটা আর কবুল করা হয় না। কারণ নবী সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
( من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد )
“যে ব্যক্তি এমন কোন কাজ করল যা আমাদের দ্বীনে নেই তা প্রত্যাখ্যাত।” [সহিহ বুখারী (২০৩৫), সহিহ মুসলিম (১৭১৮)]
তাছাড়া এটি আল্লাহর নির্ধারিত সীমারেখা লঙ্ঘন। আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত সীমানা লঙ্ঘন করা জুলুম বা অন্যায়। জালিমের আমল কবুল হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
( وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ ٱللَّهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ ٱلظَّلِمُونَ )
“যারা আল্লাহর (নির্ধারিত) সীমারেখা লঙ্ঘন করে তারা জালিম (অবিচারী)।”[২ আল-বাক্বারাহ: ২২৯]
এছাড়া সে ব্যক্তি যদি এই ইবাদতটি নির্দিষ্ট সময়ের আগে পালন করত তবে তা তার কাছ থেকে কবুল করা হতো না, অনুরূপভাবে কোন ওজর ছাড়া সে যদি নির্দিষ্ট সময়ের পরে তা আদায় করে তবে সেটাও তার কাছ থেকে কবুল করা হবে না। সমাপ্ত
[মাজমূ ফাতাওয়াশ শাইখ ইবনে উছাইমীন (১৯/প্রশ্ন নং ৪৫) ]
চার:
কাযা পালনে এই কয়েক বছর দেরী করার কারণে আপনার উপর তওবা করা আবশ্যক। যে ব্যক্তির উপর রমজানের কাযা রোজা রয়েছে পরবর্তী রমজান আসার আগে তা পালন করে নেয়া ওয়াজিব। যদি সে এর চেয়ে বেশি দেরী করে তবে সে গুনাহগার হবে। এই বিলম্ব করার কারণে তার উপর কাফ্ফারা (প্রতি দিনের পরিবর্তে একজন মিসকীন খাওয়ানো) ওয়াজিব হবে কিনা- এ ব্যাপারে আলেমদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। নির্বাচিত মত হল- তার উপর কাফ্ফারা আদায় ওয়াজিব হবে না। তবে সাবধানতাবশতঃ আপনি যদি কাফফারা আদায় করেন তবে তা ভাল। আরও জানতে দেখুন (26865) নং প্রশ্নের উত্তর।
জবাবের সারাংশ হল:
আপনি যদি পরীক্ষার কারণে রোজা না-রাখা জায়েয মনে করে রোজা না-রেখে থাকেন অথবা রোজা শুরু করে দিনে ভেঙ্গে ফেলেন তাহলে আপনাকে কাযা পালন করতে হবে; কাফফারা আদায় করতে হবে না। আমরা দোয়া করছি যাতে আল্লাহ আপনার তওবা কবুল করেন।
আল্লাহই ভাল জানেন।