সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
“তিনি রোযা না-রেখে প্রতিদিনের পরিবর্তে যে ফিদিয়া আদায় করেছিলেন সেটাই তাঁর জন্য যথেষ্ট। সেই মাসগুলোর রোযা কাজা করা তাঁর উপর ওয়াজিব নয়। কারণ তিনি শরিয়ত অনুমোদিত ওজরগ্রস্ত (মাযুর)। সে সময় তাঁর উপর যা ওয়াজিব ছিল তিনি তা পালন করেছেন।
আল্লাহই তাওফিক দাতা। আল্লাহ্ আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণের উপর রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন। ” সমাপ্ত
গবেষণা ও ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটি। সদস্য: শাইখ আবদুল আযিয ইবনে আব্দুল্লাহ্ ইবনে বায, শাইখ আবদুর রায্যাক্ব আফীফী, শাইখ আব্দুল্লাহ্ ইবনে গুদাইয়্যান ও শাইখ আবদুল্লাহ্ ইবনে ক্বু‘ঊদ।
http://islamqa.info/bn/106478
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
এক:
আশুরার রোজা বিগত বছরের গুনাহ মোচন করে। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী: “আমি আল্লাহর নিকট প্রতিদান প্রত্যাশা করছি আরাফার রোজা বিগত বছর ও আগত বছরের গুনাহ মার্জনা করবে। আরও প্রত্যাশা করছি আশুরার রোজা বিগত বছরের গুনাহ মার্জনা করবে।”[সহিহ মুসলিম (১১৬২)] এটি আমাদের উপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ একদিনের রোজার মাধ্যমে বিগত বছরের সব গুনাহ মার্জনা হয়ে যাবে। নিশ্চয় আল্লাহ মহান অনুগ্রহকারী।
আশুরার রোজার মহান মর্যাদার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি এ রোজার ব্যাপারে খুব আগ্রহী থাকতেন। ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “ফজিলতপূর্ণ দিন হিসেবে আশুরার রোজা ও এ মাসের রোজা অর্থাৎ রমজানের রোজার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যত বেশি আগ্রহী দেখেছি অন্য রোজার ব্যাপারে তদ্রূপ দেখিনি।”[সহিহ বুখারি (১৮৬৭)]
হাদিসে يتحرى শব্দের অর্থ- সওয়াব প্রাপ্তি ও আগ্রহের কারণে তিনি এ রোজার প্রতীক্ষায় থাকতেন।
দুই:
আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক আশুরার রোজা রাখা ও এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামকে উদ্বুদ্ধ করার কারণ হচ্ছে বুখারির বর্ণিত হাদিস (১৮৬৫) ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় এলেন তখন দেখলেন ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে। তখন তিনি বললেন: কেন তোমরা রোজা রাখ? তারা বলল: এটি উত্তম দিন। এ দিনে আল্লাহ বনি ইসরাঈলকে তাদের শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করেছেন; তাই মুসা আলাইহিস সালাম এ দিনে রোজা রাখতেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: তোমাদের চেয়ে আমি মুসার অধিক নিকটবর্তী। ফলে তিনি এ দিন রোজা রাখলেন এবং অন্যদেরকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন।”
হাদিসের উদ্ধৃতি: “এটি উত্তম দিন” মুসলিমের রেওয়ায়েতে এসেছে- “এটি মহান দিন। এদিনে আল্লাহ মুসাকে ও তাঁর কওমকে মুক্ত করেছেন এবং ফেরাউন ও তার কওমকে ডুবিয়ে মেরেছেন।”
হাদিসের উদ্ধৃতি: “তাই মুসা আলাইহিস সালাম এদিনে রোজা রাখতেন” সহিহ মুসলিমে আরেকটু বেশি আছে যে “...আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ; তাই আমরা এ দিনে রোজা রাখি”।
বুখারির অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে- “এ দিনের মহান মর্যাদার কারণে আমরা রোজা রাখি”।
হাদিসের উদ্ধৃতি: “অন্যদেরকেও রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন” বুখারির অন্য রেওয়ায়েতে এসেছে- “তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে বললেন: তোমরা তাদের চেয়ে মুসার অধিক নিকটবর্তী। সুতরাং তোমরা রোজা রাখ”।
তিন:
আশুরার রোজা দ্বারা শুধু সগিরা গুনাহ মার্জনা হবে। কবিরা গুনাহ বিশেষ তওবা ছাড়া মোচন হয় না। ইমাম নববী (রহঃ) বলেন: আশুরার রোজা সকল সগিরা গুনাহ মোচন করে। হাদিসের বাণীর মর্ম রূপ হচ্ছে- কবিরা গুনাহ ছাড়া সকল গুনাহ মোচন করে দেয়। এরপর তিনি আরও বলেন: আরাফার রোজা দুই বছরের গুনাহ মোচন করে। আর আশুরার রোজা এক বছরের গুনাহ মোচন করে। মুক্তাদির আমীন বলা যদি ফেরেশতাদের আমীন বলার সাথে মিলে যায় তাহলে পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়... উল্লেখিত আমলগুলোর মাধ্যমে পাপ মোচন হয়। যদি বান্দার সগিরা গুনাহ থাকে তাহলে সগিরা গুনাহ মোচন করে। যদি সগিরা বা কবিরা কোন গুনাহ না থাকে তাহলে তার আমলনামায় নেকি লেখা হয় এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। ... যদি কবিরা গুনাহ থাকে, সগিরা গুনাহ না থাকে তাহলে কবিরা গুনাহকে কিছুটা হালকা করার আশা করতে পারি।[আল-মাজমু শারহুল মুহাযযাব, খণ্ড-৬]
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহঃ) বলেন: পবিত্রতা অর্জন, নামায আদায়, রমজানের রোজা রাখা, আরাফার দিন রোজা রাখা, আশুরার দিন রোজা রাখা ইত্যাদির মাধ্যমে শুধু সগিরা গুনাহ মোচন হয়।[আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা, খণ্ড-৫]
আলহামদুলিল্লাহ।
এক:
যে ব্যক্তির এলাকার মসজিদে কোন বিদআতপন্থী ইমাম ইমামতি করেন: তার বিদআত হয়তো কুফরি বিদআত হবে অথবা সাধারণ কোন বিদআত হবে। যদি কুফরি বিদআত হয় তাহলে ঐ ইমামের পিছনে সাধারণ নামায কিংবা জুমার নামায কোনটা পড়া জায়েয হবে না। আর যদি ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় এমন কোন বিদআত না হয় তাহলে অগ্রগণ্য মতানুযায়ী- তার পিছনে জুমা পড়া ও জামাতে নামায পড়া জায়েয। এ হুকুমটি এত বেশি প্রচার পেয়েছে যে, এটা এখন সুন্নাহ অনুসারীদের নিদর্শনে পরিণত হয়েছে। বিশুদ্ধ মতানুযায়ী, যদি কেউ এমন ইমামের পিছনে নামায আদায় করে ফেলে তাহলে তাকে সে নামায শোধরাতে হবে না। এ বিষয়ক নীতি হচ্ছে- “যে ব্যক্তির নিজের নামায শুদ্ধ; সে ব্যক্তির ইমামতিও শুদ্ধ”।
আর যদি সেই বিদআতী ইমামকে বাদ দিয়ে অন্য কোন ইমামের পিছনে নামায পড়ার সুযোগ থাকে তাহলে সেটাই করতে হবে। বিশেষতঃ আলেম শ্রেণী ও তালিবুল ইলমকে সেটা করতে হবে। তা করা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ তুল্য। কিন্তু এ ইমামের পিছনে নামায বর্জন করতে গিয়ে ঘরে নামায পড়া জামাতযুক্ত নামাযের ক্ষেত্রে জায়েয নেই। সুতরাং জুমার ক্ষেত্রে জায়েয না হওয়া আরও বেশি যুক্তিযুক্ত।
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেন: যদি মোক্তাদি জানে যে, ইমাম বিদআতি, বিদআতের দিকে আহ্বান করে অথবা এমন ফাসেক (কবিরা-গুনাহগার) যার মধ্যে গুনাহর আলামত প্রকাশ্য এবং সেই-ই নির্ধারিত ইমাম; নামায পড়লে তার পিছনেই পড়তে হবে যেমন- জুমার ইমাম, ঈদের ইমাম, আরাফাতে হজ্জের নামাযের ইমাম ইত্যাদি এক্ষেত্রে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল আলেমের অভিমত হচ্ছে- মোক্তাদিকে তার পিছনেই নামায আদায় করতে হবে। এটি ইমাম আহমাদ, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আবু হানিফা ও অন্যান্য আলেমের অভিমত।
এ কারণে আলেমগণ আকিদার কিতাবে লিখেন যে, ইমাম নেককার হোক কিংবা পাপাচারী হোক তিনি ইমামের পিছনে জুমার নামায ও ঈদের নামায আদায় করেন। অনুরূপভাবে এলাকাতে যদি শুধু একজন ইমাম থাকে তাহলে তার পিছনেই জামাতে নামাযগুলো আদায় করতে হবে। কেননা জামাতে নামায আদায় করা, একাকী নামায আদায় করার চেয়ে উত্তম; এমনকি ইমাম ফাসেক (কবিরা-গুনাতেলিপ্ত) হলেও। এটি অধিকাংশ আলেম: আহমাদ ইবনে হাম্বল, শাফেয়ী ও অন্যান্যদের অভিমত। বরং ইমাম আহমাদের প্রকাশ্য অভিমত হচ্ছে- জামাতে নামায আদায় করা ফরজে আইন। ইমাম ফাসেক হওয়ার কারণে যে ব্যক্তি জুমার নামায ও জামাতে নামায পড়ে না সে ইমাম আহমাদ ও আহলে সুন্নাহর অন্যান্য ইমামের মতে- বিদআতী; আব্দুস, ইবনে মালেক ও আত্তারের ‘রিসালা’ তে এভাবে এসেছে।
সঠিক মতানুযায়ী: সে ব্যক্তি নামায পড়ে নিবে; তাকে এ নামাযকে পুনরায় আদায় করতে হবে না। কারণ সাহাবায়ে কেরাম জুমার নামায, জামাতে নামায ফাসেক ইমামদের পিছনেও আদায় করেছেন; তাঁরা তাদের পিছনে আদায়কৃত নামায পুনরায় আদায় করতেন না। যেমন- ইবনে উমর হাজ্জাজের পিছনে নামায পড়তেন। ইবনে মাসউদ ও অন্যান্য সাহাবী ওয়ালিদ ইবনে উকবার পিছনে নামায পড়তেন। ওয়ালিদ বিন উকবা মদ্যপ ছিল। একবার ফজরের নামায চার রাকাত পড়িয়েছে। এরপর বলল: আরো বাড়াব নাকি? তখন ইবনে মাসউদ বললেন: আজ তো আপনি বেশিই পড়িয়েছেন! এরপর তাঁরা তার বিরুদ্ধে ওসমান (রাঃ) এর নিকট অভিযোগ করেন।
সহিহ বুখারিতে এসেছে- ওসমান (রাঃ) যখন অবরুদ্ধ হলেন এবং জনৈক লোক এগিয়ে গিয়ে নামাযের ইমামতি করল তখন এক ব্যক্তি ওসমান (রাঃ) কে প্রশ্ন করল: নিঃসন্দেহে আপনি সর্বসাধারণের ইমাম। আর যে ব্যক্তি এগিয়ে এসে ইমামতি করল সে ফিতনার ইমাম। তখন ওসমান (রাঃ) বললেন: ভাতিস্পুত্র শুন, নামায হচ্ছে- ব্যক্তির সবচেয়ে উত্তম কাজ। যদি লোকেরা ঠিকভাবে নামায আদায় করে তাদের সাথে ভাল ব্যবহার কর। আর যদি তারা মন্দ আচরণ করে তাদের সে মন্দ আচরণকে এড়িয়ে চল। এ ধরণের বাণী অনেক আছে।
ফাসেক বা বিদআতীর নামায সহিহ। অতএব, মোক্তাদি যদি তার পিছনে নামায পড়ে তাহলে তার নামায বাতিল হবে না। তবে, যারা বিদআতির পিছনে নামায পড়াকে মাকরুহ বলেছেন তারা দিক থেকে বলেছেন: সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ ওয়াজিব। যে ব্যক্তি প্রকাশ্য বিদআত করে তাকে ইমাম হিসেবে নির্ধারণ না করাটা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের অন্তর্গত। কেননা সে শাস্তিযোগ্য যতক্ষণ না তওবা করে। যদি তাকে এড়িয়ে চলা যায় যাতে করে সে তওবা করে সেটা— ভাল। যদি কোন কোন লোক তার পিছনে নামায পড়া ছেড়ে দিলে, অন্যেরা নামায পড়লে সেটা তার উপরে প্রভাব ফেলে যাতে করে সে তওবা করে অথবা বরখাস্ত হয় অথবা মানুষ এ জাতীয় গুনাহ থেকে দূরে সরে আসে এবং সে মোক্তাদির জুমা বা জামাত ছুটে না যায় যদি এমন হয় তাহলে এ ধরণের লোকের তার পিছনে নামায বর্জন করাতে কল্যাণ আছে।
পক্ষান্তরে মোক্তাদির যদি জুমা ও জামাত ছুটে যাওয়ার আশংকা থাকে তাহলে তার পিছনে নামায বর্জন করাটা বিদআত এবং সাহাবায়ে কেরামের আমলের পরিপন্থী।[আল-ফাতাওয়া আল-কুবরা (২/৩০৭-৩০৮)]।
দুই:
ইতিপূর্বের আলোচনা থেকে জানা যায় যে, যদি কেউ কোন খতীবকে বিদআতের দিকে ডাকে (যেমন যে বিদআতগুলোর কথা আপনি প্রশ্নে উল্লেখ করেছেন) অথবা বিদআতের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করে অথবা দুর্বল ও বানোয়াট হাদিসগুলো উদ্ধৃত করতে শুনে তদুপরি তার জন্য মসজিদ ত্যাগ করা, খোতবা না-শুনা জায়েয হবে না। তবে যদি প্রভাবশালী আলেম হন এবং তিনি অন্য কোন খতীবের পিছনে নামায পড়বেন তাছাড়া ইতিপূর্বে ঐ খতীবকে নসিহত করেছেন, সত্যকে তার নিকট সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন- তিনি তার পিছনে নামায বর্জন করতে পারেন। যদি তিনি ইতিপূর্বে তাকে নসিহত না করে থাকেন অথবা অন্য কোন মসজিদে তার নামায পড়ার সুযোগ না থাকে তাহলে অগ্রগণ্য মত হচ্ছে- খোতবাকালে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাওয়া জায়েয হবে না। তবে যদি এমন হয় যে, এ খতীবের পিছনে নামায পড়া জায়েয হবে না এমন পর্যায়ের তাহলে বেরিয়ে যেতে পারেন।
6366 নং প্রশ্নের জবাবে আমরা উল্লেখ করেছি জুমার নামাযের খতীব যদি কোন বিভ্রান্তির কথা বলে অথবা কোন বিদআত সাব্যস্ত করে অথবা শিরকের দিকে আহ্বান করে আমরা সে প্রশ্নের জবাবে খোতবার মাঝখানে প্রতিবাদ করাকে বৈধ উল্লেখ করেছি। তবে শর্ত হচ্ছে- মানুষের মাঝে বিশৃংখলা সৃষ্টি হতে পারবে না এবং জুমার নামায নষ্ট করা যাবে না। যে ব্যক্তি প্রতিবাদ করতে চায় তিনি খোতবা শেষে দাঁড়িয়ে মানুষের কাছে খতীবের ভুল তুলে ধরবেন।
যে ব্যক্তি প্রতিবাদ করতে চায় তার উচিৎ সত্য তুলে ধরা ও সে খতীবের সমালোচনার ক্ষেত্রে কোমল হওয়া। যাতে করে মন্দের প্রতিবাদ ফলপ্রসু হয়।
স্থায়ী কমিটির আলেমগণকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে-
যে খতীব তার খোতবার মাঝে অথবা গোটা খোতবা জুড়ে শুধু ইসরাইলী বর্ণনা ও দুর্বল হাদিস উল্লেখ করে এর মাধ্যমে মানুষকে চমকে দিতে চান ইসলামে এর হুকুম কী?
তাঁরা জবাবে বলেন: যদি আপনি সুনিশ্চিতভাবে (ইয়াকীনসহ) জানেন যে, খতীব খোতবার মধ্যে যে ইসরাইলী বর্ণনাগুলো উল্লেখ করেছেন সেগুলো ভিত্তিহীন অথবা হাদিসগুলো দুর্বল তাহলে আপনি তাকে নসিহত করুন যেন অন্য সহিহ হাদিসগুলো উল্লেখ করে, আয়াতে কারীমাগুলো নিয়ে আসে। আর যে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে জানেন না সেটাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে সম্পৃক্ত করবে না। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “দ্বীন হচ্ছে- নসিহত”। হাদিসটি ইমাম মুসলিম তাঁর সহিহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। তবে নসিহত হতে হবে উত্তম পন্থায়; কর্কশ ও কঠিন আচরণের মাধ্যমে নয়। আল্লাহ আপনাকে তাওফিক দিন ও আপনাকে কল্যাণের ধারক বানান।
শাইখ আব্দুল আযিয বিন বায, শাইখ আব্দুর রাজ্জাক আফিফি, শাইখ আব্দুল্লাহ গাদইয়ান।
ফাতাওয়াল লাজনাহ দায়িমা (৮/২২৯-২৩০)
সার কথা হচ্ছে- যদি আপনি এমন কোন মসজিদে যেতে পারেন যেখানে বিদআত নেই, যে মসজিদের খতীব বিদআতের দিকে আহ্বান করে না সেটা ভাল। যদি না যেতে পারেন অথবা আপনাদের নিকটে অন্য কোন মসজিদ না থাকে তাহলে উল্লেখিত কারণে জামাত ও জুমা ত্যাগ করা আপনাদের জন্য জায়েয হবে না। আপনাদের কর্তব্য হচ্ছে- নসিহত করা ও আল্লাহর দিকে আহ্বান করা। দাওয়াতের ভাষা যেন কোমল হয় এবং পদ্ধতি যেন সুন্দর হয় সে ব্যাপারে সচেষ্ট থাকা।
আল্লাহই ভাল জানেন।
কোন বিষয়ে ইজতিহাদ করার কিছু শর্ত রয়েছে। যে কোন ব্যক্তির যে কোন বিষয়ে ফতোয়া দেয়া ও কথা বলার অধিকার নেই। কোন বিষয়ে ফতোয়া দিতে ও কথা বলতে হলে যথাযথ ইলম ও যোগ্যতা থাকতে হবে। দলিল জানার ক্ষমতা থাকতে হবে। দলিলের মধ্যে কোনটি নস (প্রত্যক্ষ), কোনটি যাহের (প্রকাশ্য), কোনটি সহিহ (বিশুদ্ধ), কোনটি জয়িফ (দুর্বল), কোনটি নাসেখ (রহিতকারী), কোনটি মানসুখ (রহিত), কোনটি মানতুক (শব্দ-ভিত্তিক), কোনটি মাফহুম (ভাব-ভিত্তিক), কোনটি খাস (বিশেষ), কোনটি আম (সাধারণ), কোনটি মুতলাক (শর্তহীন), কোনটি মুকাইয়্যাদ (শর্তযুক্ত), কোনটি মুজমাল (অ-বিস্তারিত), কোনটি মুবাইয়্যান (বিস্তারিত) তা জানতে হবে। সাথে সাথে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এছাড়া ফিকাহর প্রকারভেদ, গবেষণাযোগ্য বিষয়গুলো, পূর্ববর্তী আলেম ও ফকীহদের মতামত জানা থাকতে হবে এবং দলিল-প্রমাণ মুখস্থ থাকতে হবে অথবা বুঝার ক্ষমতা থাকতে হবে।
কোন সন্দেহ নেই যথাযথ যোগ্যতা ছাড়া ফতোয়া দিতে নেমে পড়া বড় ধরনের গুনাহ এবং ইলম ছাড়া মতপ্রকাশের নামান্তর। আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন: “আর তোমাদের জিহ্বা দ্বারা বানানো মিথ্যার উপর নির্ভর করে বলো না যে- এটা হালাল এবং এটা হারাম, আল্লাহর উপর মিথ্যা রটানোর জন্য। নিশ্চয় যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটায়, তারা সফল হবে না।”[সূরা আন্-নাহল, আয়াত: ১১৬] হাদিসে এসেছে- “যে ব্যক্তিকে যথাযথ দলিল ছাড়া কোন ফতোয়া দেয়া হয়েছে তার পাপ ফতোয়াদানকারীর (মুফতি) উপর বর্তাবে।” [সহিহ; মুসনাদে আহমাদ (২/৩২১)] তালিবে ইলমের কর্তব্য ফতোয়া দানের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করা। কোন বিষয়ে কথা বলার আগে এর উৎস, দলিল এবং তার পূর্বে এ অভিমত আর কে ব্যক্ত করেছেন ইত্যাদি জেনে তারপর কথা বলা। যদি তার সে যোগ্যতা না থাকে তাহলে তার উচিৎ এ দায়িত্ব উপযুক্ত ব্যক্তির জন্য ছেড়ে দেয়া। সে যে বিষয়গুলো জানে সেগুলোর মধ্যে তাকে সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ এবং সে যা অর্জন করেছে সেটার উপর তার আমল করা উচিৎ এবং ইলম অর্জন চালিয়ে যাওয়া উচিৎ। যাতে সে ইজতিহাদ করার যোগ্যতায় পৌঁছতে পারে। আল্লাহই সঠিক পথে পরিচালনাকারী।
শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
এক:
মিলাদুন্নবী বা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিবস পালন একটি বিদআত। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অথবা তাঁর সাহাবীগণ অথবা তাবেয়ীগণ হতে এই দিবস পালনের অনুমোদনমূলক কোন উদ্ধৃতি পাওয়া যায় না। বরং এর উদ্ভব করেছে- উবাইদি শাসকগণ (এরা ফাতেমী নামে পরিচিত)। যারা আরো অনেক ভ্রান্ত আমল ও বিদআত চালু করেছিল। এই দিন পালন করা যে, বিদআত সে ব্যাপারে (10070) ও (70317) নং প্রশ্নের জবাবে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
দুই:
যে মিষ্টান্ন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়, এমন মিষ্টান্ন খাওয়া ও ক্রয় করা ইসলামি আইনে জায়েয; যদি না এর মধ্যে শরিয়ত গর্হিত কোন কাজে সহযোগিতা করা, এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা বা প্রসার করার বিষয় না থাকে। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, মিলাদুন্নবীর মৌসুমে এই মিষ্টান্ন ক্রয় করা মিলাদুন্নবী পালনকে সহযোগিতা করা ও প্রসার করার নামান্তর। বরং এই মিষ্টান্ন ক্রয় এ দিবসকে ঈদ (উৎসব) হিসেবে পালনতুল্য। কেননা উৎসব হচ্ছে- প্রথাগতভাবে মানুষ কোন কিছু পালন করে আসা। সুতরাং মানুষ যদি শুধু ঈদ উপলক্ষে এ মিষ্টান্ন তৈরী করে থাকে এবং খেয়ে থাকে অন্য দিনগুলোতে না-করে থাকে তাহলে এই মিষ্টান্ন ক্রয়বিক্রয় করা, খাওয়া বা হাদিয়া পাঠানো ইত্যাদি এ দিবসকে ঈদ হিসেবে পালনের নামান্তর। এ কারণে এগুলো পরিহার করাই বাঞ্ছনীয়।
ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়া সংকলনে ভালবাসা দিবস পালন, ভালবাসা দিবসে ভালবাসা চিহ্ন অংকিত লাল রঙের মিষ্টান্ন ক্রয়ের বিধান সম্পর্কে এসেছে- “কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট দলিল ও মুসলমানদের ইজমার ভিত্তিতে জানা যায় যে, ইসলামে উৎসব শুধু দুটি- ঈদুল ফিতর (রোযা ভঙ্গের উৎসব) ও ঈদুল আযহা (পশু উৎসর্গের উৎসব)। এ দুটি ছাড়া আর যত উৎসব আছে সেটা কোন ব্যক্তির সাথে, কোন গোষ্ঠীর সাথে, কোন ঘটনার সাথে বা বিশেষ কোন ভাবাবেগের সাথে সংশ্লিষ্ট হোক না কেন সেটা বিদআতি (নবউদ্ভাবিত) উৎসব। এ ধরনের কোন উৎসব পালন করা, পালনে সম্মতি দেয়া বা কোনভাবে সহযোগিতা করা অথবা সেই দিনে খুশি প্রকাশ করা কোন মুসলমানের জন্য জায়েয নয়। কেননা এটি আল্লাহর সীমারেখার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমারেখা লঙ্ঘন করে সে নিজের উপর নিজেই জুলুমকারী। এই উৎসবে অথবা এ ধরনের অন্য কোন হারাম উৎসবে কোনভাবে সহযোগিতা করা মুসলমানদের জন্য হারাম। সেটা যে ধরনের সহযোগিতা হোক না কেন; যেমন খাবার বা পানীয় গ্রহণ করা, ক্রয়বিক্রয় করা, জিনিসপত্র প্রস্তুত করা, উপঢৌকন প্রদান করা, পত্র বিনিময় করা, প্রচার-প্রচারণা চালানো ইত্যাদি। কারণ এ ধরনের সহযোগিতা পাপ-কাজে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতার ক্ষেত্রে সহযোগিতার মধ্যে গণ্য। “সৎকর্ম ও আল্লাহভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা কঠোর শাস্তিদাতা।”[সূরা মায়েদা, আয়াত: ০২]” সমাপ্ত।
আল্লাহই ভাল জানেন।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
যদি কোন ক্ষতির আশংকা না থাকে তবে নারীর সাজ-সজ্জা হিসেবে নখে পলিশ করা বৈধ এবং এ পলিশ নিয়ে নামায পড়তেও দোষের কিছু নেই। তবে হ্যাঁ, পলিশের মধ্যে যদি এমন কোন ধাতু থাকে যার ফলে পলিশের নীচে পানি না পৌঁছে তাহলে পলিশ তুলে ফেলা ছাড়া ওজু ও গোসল শুদ্ধ হবে না। ওজু-গোসল শুদ্ধ না হলে নামাযও শুদ্ধ হবে না।
ফতোয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ফতোয়া সংকলন (৫/২১৮) তে এসেছে-
যদি পলিশ নখের ওপর প্রলেপ তৈরী করে তাহলে ওজুর আগে এই প্রলেপ তুলে ফেলা ছাড়া ওজু শুদ্ধ হবে না। আর যদি মেহেদির মত পলিশের কোন প্রলেপ না থাকে তাহলে ওজু শুদ্ধ হবে।
আল্লাহই ভাল জানেন।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
স্বামী তার স্ত্রীর সাথে সহবাস করার পর ফরজ গোসল করার আগেই যদি মাসিক শুরু হয়ে যায় তাহলে মাসিক থেকে পবিত্র হওয়ার পূর্বে গোসল করা তার জন্য ফরজ (আবশ্যকীয়) নয়। কিন্তু তিনি যদি কুরআন শরিফ পড়তে চান তাহলে ফরজ গোসল করে নেয়া ওয়াজিব। কারণ আলেমগণের অগ্রগণ্য মতানুযায়ী সহবাসের পর গোসল করা ছাড়া কুরআন পড়া জায়েয নয়।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত দুইটি বিষয়ের কোন একটি পাওয়া গেলে গোসল ফরজ হবে।
১. খতনার স্থানদ্বয় তথা যৌনাঙ্গদ্বয় একত্রিত হওয়া। অর্থাৎ প্রবেশ-করানো সংঘটিত হওয়া। এটাই সঙ্গম বা সহবাস। বীর্যপাত হওয়া শর্ত নয়। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যদি খতনার স্থানদ্বয় মিলিত হয় এবং পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগ ভিতরে ডুবে যায় তাহলে বীর্যপাত হোক বা না-হোক গোসল ফরজ হবে।” [সুনানে আবু দাউদ, সহিহ আবু দাউদ (২০৯)]
২. বীর্যপাত হওয়া। এমনকি সেটা যদি যৌনাঙ্গদ্বয় একত্রিত হওয়া ব্যতিরেকে হাত দিয়ে সম্ভোগ করার কারণে সংঘটিত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রেও গোসল ফরজ হবে। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “পানির কারণে পানি অপরিহার্য।” [সহিহ মুসলিম, ১৫১]। পানি তথা বীর্য নির্গত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গোসল ফরজ হয়।
পক্ষান্তরে রোজার বিষয়টি হচ্ছে- রোজার শুদ্ধতার জন্য সুবহে সাদিক শুরু হওয়ার আগে ফরজ গোসল করে নেয়া আবশ্যকীয় নয়। এমনকি যদি জুনুবি (গোসল ফরজ) অবস্থায় কেউ রোজা শুরু করে তাতেও রোজা শুদ্ধ হবে।[দেখুন রোজার ৭০টি মাসয়ালা] তবে ফজরের নামাজ যেন ঠিক সময়ে পড়া যায় সে জন্য দেরি না করে গোসল করে নেয়া কর্তব্য।
আল্লাহই ভাল জানেন। আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক।
শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
এক:
হুসনুল খাতিমা বা ভাল মৃত্যু...
ভাল মৃত্যু মানে- মৃত্যুর পূর্বে আল্লাহর ক্রোধ উদ্রেককারী গুনাহ হতে বিরত থাকতে পারা, পাপ হতে তওবা করতে পারা, নেকীর কাজ ও ভাল কাজ বেশি বেশি করার তাওফিক পাওয়া এবং এ অবস্থায় মৃত্যু হওয়া। এই মর্মে আনাস বিন মালিক (রাঃ) হতে সহিহ হাদিসে এসেছে তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- “আল্লাহ যদি কোন বান্দার কল্যাণ চান তখন তাকে (ভাল) কাজে লাগান।” সাহাবায়ে কেরাম বললেন: কিভাবে আল্লাহ বান্দাকে (ভাল) কাজে লাগান? তিনি বলেন: “মৃত্যুর পূর্বে তাকে ভাল কাজ করার তাওফিক দেন।” [মুসনাদে আহমাদ (১১৬২৫), তিরমিযি (২১৪২), আলবানি ‘সিলসিলা সহিহা’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ সাব্যস্ত করেছেন (১৩৩৪)।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “আল্লাহ তাআলা যদি কোন বান্দার কল্যাণ চান তখন সে বান্দাকে ‘আসাল’ করেন। সাহাবায়ে কেরাম বলেন: আসাল কি? তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা বান্দাকে বিশেষ একটি ভাল কাজ করার তাওফিক দেন এবং এই আমলের উপর তার মৃত্যু ঘটান।[সহিহ আহমাদ (১৭৩৩০), আলবানি সিলসিলা সহিহা গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ ঘোষণা করেছেন (১১১৪)।
ভাল মৃত্যুর বেশ কিছু আলামত আছে। এর মধ্যে কোন কোন আলামত শুধু মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তি নিজে বুঝতে পারে এবং কোন কোন আলামত অন্যান্য মানুষও জানতে পারে।
দুই:
মৃত্যুকালে বান্দার নিকট তার ভাল মৃত্যুর যে আলামত প্রকাশ পায় সেটা হচ্ছে- বান্দাকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও অনুগ্রহ লাভের সুসংবাদ দেয়া হয়। এই মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-“নিশ্চয় যারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, অতঃপর তাতেই অবিচল থাকে, তাদের কাছে ফেরেশতা অবতীর্ণ হয় এবং বলে, তোমরা ভয় পেও না, চিন্তিত হইও না এবং তোমরা প্রতিশ্রুত জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর।”[সূরা ফুসসিলত, আয়াত: ৩০] মৃত্যুকালে মুমিন বান্দাদেরকে এই সুসংবাদ দেয়া হয়। দেখুন: তাফসিরে সাদী, পৃষ্ঠা- ১২৫৬।
এই মর্মে সহিহ বুখারী ও সহিহ মুসলিমে এসেছে- যা আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাক্ষাতকে ভালবাসে আল্লাহও তার সাক্ষাতকে ভালবাসেন। যে ব্যক্তির কাছে আল্লাহর সাক্ষাত প্রিয়, আল্লাহর নিকটও তার সাক্ষাত প্রিয়। আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! আপনি কি মৃত্যুর কথা বুঝাতে চাচ্ছেন? আমরা তো সবাই মৃত্যুকে অপছন্দ করি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন: না, সেটা না। মুমিন বান্দাকে যখন আল্লাহর রহমত, তাঁর সন্তুষ্টি, তাঁর জান্নাতের সুসংবাদ দেয়া হয় তখন তিনি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করাকে ভালবাসেন। আর কাফের বান্দাকে যখন আল্লাহর শাস্তি, তাঁর অসন্তুষ্টির সংবাদ দেয়া হয় তখন সে আল্লাহর সাক্ষাতকে অপছন্দ করে এবং আল্লাহও তার সাক্ষাতকে অপছন্দ করেন।”
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন: “হাদিসের অর্থ হচ্ছে- যখন মানুষের মৃত্যুর গড়গড়া শুরু হয়ে যায়, যে অবস্থায় আর তওবা কবুল হয় না, সে অবস্থার পছন্দ-অপছন্দকে এখানে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। মুমূর্ষু ব্যক্তির কাছে সবকিছু স্পষ্ট হয়ে পড়ে, তার পরিণতি কী হতে যাচ্ছে সেটা তার সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়।
ভাল মৃত্যুর আলামত অনেক। আলেমগণ কুরআন-হাদিস খুঁজে এই আলামতগুলো বের করার চেষ্টা করেছেন। এই আলামতগুলোর মধ্যে রয়েছে-
১. মৃত্যুর সময় ‘কালেমা’ পাঠ করতে পারা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তির সর্বশেষ কথা হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তিনি জান্নাতে প্রবেশ করবেন।” [সুনানে আবু দাউদ, ৩১১৬], সহিহ আবু দাউদ গ্রন্থে (২৬৭৩) আলবানি এই হাদিসকে সহিহ বলেছেন।
২. মৃত্যুর সময় কপালে ঘাম বের হওয়া। বুরাইদা বিন হাছিব (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন: আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন: “মুমিন কপালের ঘাম নিয়ে মৃত্যুবরণ করে।”[মুসনাদে আহমাদ (২২৫১৩), জামে তিরমিযি (৯৮০), সুনানে নাসায়ি (১৮২৮) এবং আলবানি সহিহ তিরমিযি গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
৩. জুমার রাতে বা দিনে মৃত্যুবরণ করা। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি জুমার দিনে বা রাতে মৃত্যুবরণ করেন আল্লাহ তাকে কবরের আযাব থেকে নাজাত দেন।”[মুসনাদে আহমাদ (৬৫৪৬), জামে তিরমিযি (১০৭৪), আলবানি বলেছেন: সনদের সবগুলো ধারা মিলালে হাদিসটি সহিহ]
৪. আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা। দলিল হচ্ছে আল্লাহ তাআলার বাণী:“আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়,তাদেরকে তুমি কখনো মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের পালনকর্তার নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত। আল্লাহ নিজের অনুগ্রহ থেকে যা দান করেছেন তার প্রেক্ষিতে তারা আনন্দ উদযাপন করছে। আর যারা এখনও তাদের কাছে এসে পৌঁছেনি তাদের পেছনে তাদের জন্যে আনন্দ প্রকাশ করে। কারণ, তাদের কোন ভয় ভীতিও নেই এবং কোন চিন্তা ভাবনাও নেই। আল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহের জন্যে তারা আনন্দ প্রকাশ করে এবং তা এভাবে যে, আল্লাহ, ঈমানদারদের শ্রমফল বিনষ্ট করেন না।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬৯-১৭১] এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি আল্লাহর রাহে নিহত হয় সে শহিদ এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর রাহে মারা যায় সেও শহিদ।”[সহিহ মুসলিম, ১৯১৫]
৫. প্লেগ রোগে মারা যাওয়া। দলীল হচ্ছে নবী আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “প্লেগ রোগে মৃত্যু প্রত্যেক ঈমানদারের জন্য শাহাদাত।”[সহিহ বুখারী (২৮৩০) ও সহিহ মুসলিম (১৯১৬)] এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্ত্রী আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্লেগ রোগ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি তখন তিনি আমাকে জানান যে, “এটি হচ্ছে- আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব। আল্লাহ যাদেরকে শাস্তি দিতে চান তাদের উপর এই রোগ নাযিল করেন। আর আল্লাহ এই রোগ মুমিনদের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছেন। যে মুমিন প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে নিজ এলাকাতে অবস্থান করবে, ধৈর্যধারণ করবে, সওয়াবের প্রত্যাশা করবে এবং এই একীন রাখবে যে, আল্লাহ তার জন্য যা লিখে রেখেছেন সেটাই ঘটবে সে ব্যক্তি শহিদের সমান সওয়াব পাবে।” [সহিহ বুখারি (৩৪৭৪)]
৬. যে কোন পেটের পীড়াতে মৃত্যুবরণ করা। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি পেটের পীড়াতে মৃত্যুবরণ করবে সে শহিদ।” [সহিহ মুসলিম (১৯১৫)]
৭. কোন কিছু ধ্বসে পড়ে অথবা পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করা। দলিল হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “পাঁচ ধরনের মৃত্যু শাহাদাত হিসেবে গণ্য। প্লেগ রোগে মৃত্যু, পেটের পীড়ায় মৃত্যু, পানি ডুবে মৃত্যু, কোন কিছু ধ্বসে পড়ে মৃত্যু এবং আল্লাহর রাস্তায় শহিদ হওয়া।” [সহিহ বুখারি (২৮২৯) ও সহিহ মুসলিম (১৯১৫)]
৮. প্রসবউত্তর প্রসূতির মৃত্যু অথবা গর্ভবতী অবস্থায় নারীর মৃত্যু। এর দলিল হচ্ছে আবু দাউদ (৩১১১) কর্তৃক বর্ণিত হাদিস; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে নারী জুমা (বাচ্চা) নিয়ে মারা যায় তিনি শহিদ।”। ইমাম খাত্তাবি বলেন: এ হাদিসের অর্থ হচ্ছে- যে নারী পেটে বাচ্চা নিয়ে মারা যায়।[আওনুল মাবুদ] ইমাম আহমাদ উবাদা বিন সামেত (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শহিদের শ্রেণীগুলো উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন: “যে নারী তার গর্ভস্থিত সন্তানের কারণে মারা যায় তিনি শহিদ। সে নারীকে তার সন্তান সুরার (নাভিরজ্জু) ধরে টেনে জান্নাতে নিয়ে যাবে।”[আলবানি ‘জানায়িয’ গ্রন্থে (৩৯) হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন] সুররা (নাভি): নবজাতকের জন্মের পর ধাত্রী নাড়ী কাটেন এবং সামান্য কিছু অংশ রেখে দেন। যে অংশটুকু রেখে দেন সেটাকে সুররা বা নাভি বলে। আর যে অংশটুকু কেটে ফেলেন সেটাকে সুরার (নাভিরজ্জু) বলা হয়।
৯. আগুনে পুড়ে, প্লুরিসি (ফুসফুসের আবরক ঝিল্লির প্রদাহজনিত রোগবিশেষ) এবং যক্ষ্মা রোগে মৃত্যু। দলিল হচ্ছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহর রাহে নিহত হওয়া শাহাদাত, প্লেগ রোগে মারা যাওয়া শাহাদাত, পানি ডুবে মারা যাওয়া শাহাদাত, পেটের পীড়ায় মারা যাওয়া শাহাদাত, সন্তান প্রবসের পর মারা গেলে নবজাতক তার মাকে নাভিরজ্জু ধরে টেনে জান্নাতে নিয়ে যাবে। (সংকলক বলেন, এই হাদিসের জনৈক বর্ণনাকারী বায়তুল মোকাদ্দাসের খাদেম আবুল আওয়াম হাদিসটির অংশ হিসেবে “আগুনে পুড়ে মৃত্যু ও যক্ষ্মা রোগ” এর কথাও বর্ণনা করেছেন।) আলবানি বলেছেন: হাদিসটি হাসান-সহিহ।[সহিহুত তারগিব ওয়াত তারহিব (১৩৯৬)]
১০. নিজের ধর্ম, সম্পদ ও জীবন রক্ষা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করা। দলিল হচ্ছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: “যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষা গিয়ে মারা যায় সে শহিদ। যে ব্যক্তি তার ধর্ম (ইসলাম) রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহিদ। যে ব্যক্তি তার জীবন রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহিদ।”[জামে তিরমিযি (১৪২১)] সহিহ বুখারি (২৪৮০) ও সহিহ মুসলিমে (১৪১) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে তিনি বলেন: আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি- “যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষা করতে গিয়ে মারা যায় সে শহিদ।”
১১. আল্লাহর রাস্তায় প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যে ব্যক্তি মারা যায় সেও শহিদ। দলিল হচ্ছে সহিহ মুসলিমের হাদিস (১৯১৩): সালমান আলফারেসি (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “একদিন, একরাত পাহারা দেয়া একমাস দিনে রোজা রাখা ও রাতে নামায পড়ার চেয়ে উত্তম। আর যদি পাহারারত অবস্থায় সে ব্যক্তি মারা যায় তাহলে তার জীবদ্দশায় সে যে আমলগুলো করত সেগুলোর সওয়াব তার জন্য চলমান থাকবে, তার রিযিকও চলমান থাকবে এবং কবরের ফিতনা থেকে সে মুক্ত থাকবে।”
১২. ভাল মৃত্যুর আরো একটি আলামত হলো- নেক আমলরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলল এবং এ অবস্থায় তার মৃত্যু হলো সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি কোন একটি সদকা করল এবং এ অবস্থায় তার মৃত্যু হলো সেও জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [মুসনাদে আহমাদ (২২৮১৩), আলবানি জানায়িয গ্রন্থে পৃষ্ঠা-৪৩ এ হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন। দেখুন কিতাবুল জানায়িয, পৃষ্ঠা- ৩৪।
এই আলামতগুলো ব্যক্তির ভাল মৃত্যুর সুসংবাদ দেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা নির্দিষ্টভাবে কোন ব্যক্তির ব্যাপারে এ নিশ্চয়তা দিব না যে, তিনি জান্নাতি। শুধু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাদের ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন তারা ছাড়া। যেমন চার খলিফার ব্যাপারে তিনি নিশ্চয়তা প্রদান করেছেন।
আল্লাহ আমাদের সকলকে ভাল মৃত্যু দান করুন।
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য।
যদি তারা মুসলমান হয় তাহলে তো সমবেদনা জানাতে কোন অসুবিধা নেই। কারণ তারা বিপদগ্রস্ত মুসলমান এবং তাদের এটা অধিকার।
“আর তারা যদি কাফের হয় তাহলে কল্যাণের দিক কোনটি সেটা দেখতে হবে। যদি এই সমবেদনা জানানোর মাধ্যমে এই কাফেরকে মুসলমানদের প্রতি আকৃষ্ট করা যায়, সম্প্রীতি গড়ে তোলা যায় তাহলে সমবেদনা জানাতে কোন অসুবিধা নেই। আর যদি এ সমবেদনা জানানোর মধ্যে কোন ফায়দা না থাকে তাহলে এর কোন প্রয়োজন নেই।” উদ্ধৃতি সমাপ্ত।
শাইখ উছাইমীন (রহঃ)
আল ইজাবাত আল আসইলাতিল জালিআত (কম্যুনিটি বিষয়ক প্রশ্নোত্তর) ১/১৪, ১৫