সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য, যিনি সৃষ্টিকুলের রব্ব। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, তার কোনো শরীক নেই। আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তার বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তার ওপর সালাত ও সালাম প্রেরণ করুন।
অতঃপর, বক্ষ্যমাণ পুস্তিকায় সবচেয়ে বরকতময়, মহান, শ্রেষ্ঠ ও কল্যাণকর কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এর ফযীলত, মূলবক্তব্য, শর্ত ও পরিপন্থী বিষয়ক অতীব জরুরি সারসংক্ষেপকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পুস্তিকাটি মূলত আমার লিখা(فقه الأدعية والأذكار) গ্রন্থের একটি অধ্যায়। কতক বন্ধুর আগ্রহে বইটি স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশ করা হলো, যেন তার ফায়েদা ব্যাপক হয় ও তা থেকে উপকৃত হওয়া সবার জন্য সহজ হয়। আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি এতে বরকত দান করুন এবং স্বীয় বান্দাদের থেকে যার জন্য ইচ্ছা করেন অত্র পুস্তিকাকে হিদায়াতের উসিলা করুন। আমাদের সবাইকে তিনি সঠিক সোজা পথ প্রদান করুন, তাদের পথ যাদের ওপর নি‘আমত দান করেছেন। যেমন, নবী, সিদ্দিক, শহীদ ও নেককার বান্দাগণ। বন্ধু হিসেবে তারাই সর্বোত্তম, আল্লাহ যথেষ্ট এবং তিনিই সর্বোত্তম অভিভাবক। আমাদের নবী মুহাম্মাদ, তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর সকল সাথীদের ওপর আল্লাহ সালাত ও সালাম প্রেরণ করুন।
আব্দুর রাযযাক ইবন আব্দুল মুহসিন আল-বদর
সন্দেহ নেই তাওহীদের কালেমার রয়েছে মহান ফযীলত, অনেক মর্যাদা ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যা কারো পক্ষেই অনুসন্ধান করে শেষ করা সম্ভব নয়। কারণ, এ কালেমা সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে মহান। এ কালেমার জন্যই মখলুক সৃষ্টি, রাসূলদের প্রেরণ ও কিতাব নাযিল করা। এ কালেমার জন্য মানুষ কাফির ও মুমিন দু’ভাগে বিভক্ত, কেউ সৌভাগ্যবান জান্নাতি, কেউ হতভাগা জাহান্নামি। এটাই মজবুত রশি ও তাকওয়ার কালেমা, দীনের মহান রুকন ও ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এ কালেমার দ্বারা জান্নাত লাভ হয় ও জাহান্নাম থেকে মুক্তি মিলে। এ কালেমা জান্নাতের চাবি, দীনের মূল শিক্ষা, মৌলিক স্তম্ভ ও প্রধান শিরোনাম। এ কালেমার ফযীলত ও মর্যাদা যেভাবে মূল্যায়ন করা হোক, জ্ঞানীরা তা থেকে যত জ্ঞান আহরণ করুক, কারো পক্ষেই তা পূর্ণরূপে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿شَهِدَ ٱللَّهُ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَأُوْلُواْ ٱلۡعِلۡمِ قَآئِمَۢا بِٱلۡقِسۡطِۚ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ١٨﴾ [ال عمران: ١٨]
“আল্লাহ সাক্ষ্য দেন যে, তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই, আর মালায়েকা ও জ্ঞানীগণও (সাক্ষ্য দেন) ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে। তিনি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই, তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৮]
তাওহীদের কালেমা, তথা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’কে আল্লাহ তা‘আলা সকল নবীর দাওয়াতের নির্যাস ও তাদের রিসালাতের সারাংশ বলেছেন, যা তার বিশেষ ফযীলত সন্দেহ নেই। যেমন, তিনি বলেন,
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ ٢٥﴾ [الانبياء: ٢٥]
“আর তোমার পূর্বে আমরা যে রাসূলই পাঠিয়েছি, তার প্রতি আমরা এ ওহী নাযিল করি যে, ‘আমি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই’। সুতরাং তোমরা আমারই ইবাদত কর”। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৫]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ ٣٦﴾ [النحل: ٣٦]
“আর আমরা অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং পরিহার কর তাগুতকে”। [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]
সূরা আন-নাহালের শুরুতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يُنَزِّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ بِٱلرُّوحِ مِنۡ أَمۡرِهِۦ عَلَىٰ مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦٓ أَنۡ أَنذِرُوٓاْ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱتَّقُونِ ٢ ﴾ [النحل: ٢]
“তিনি মালায়েকাদের আপন নির্দেশে রূহ দিয়ে নাযিল করেন তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তার প্রতি, যেন তোমরা সতর্ক কর যে, আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নই। অতএব, তোমরা আমাকে ভয় কর”। [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ২]
অত্র সূরার শুরুতে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাদের ওপর একাধিক নিয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন, তন্মধ্যে لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ (অর্থাৎ আমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই) সংবলিত আয়াত সর্বপ্রথম। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তাওহীদের কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সবচেয়ে বড় নি‘আমত। এ নি‘আমতই স্বীয় বান্দাদের ওপর পূর্ণরূপে দান করেছেন আল্লাহ, যেমন তিনি বলেছেন:
﴿وَأَسۡبَغَ عَلَيۡكُمۡ نِعَمَهُۥ ظَٰهِرَةٗ وَبَاطِنَةٗۗ ٢٠﴾ [لقمان: ٢٠]
“আর তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নি‘আমত পূর্ণরূপে দিয়েছেন”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ২০]
মুজাহিদ রহ. বলেন, এখানে নি‘আমত দ্বারা উদ্দেশ্য ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।[1]
সুফিয়ান ইবন ‘উইয়াইনাহ রহ. বলেন, আল্লাহ তার কোনো বান্দাকে এমন নি‘আমত দেন নি, যা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ-জ্ঞান থেকে বড়”![2]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: আল্লাহ তা‘আলা এ কালেমাকে কুরআনুল কারীমে তায়্যিবাহ বা পবিত্র বলে গুণান্বিত করেছেন। যেমন, তিনি বলেন,
﴿أَلَمۡ تَرَ كَيۡفَ ضَرَبَ ٱللَّهُ مَثَلٗا كَلِمَةٗ طَيِّبَةٗ كَشَجَرَةٖ طَيِّبَةٍ أَصۡلُهَا ثَابِتٞ وَفَرۡعُهَا فِي ٱلسَّمَآءِ ٢٤ تُؤۡتِيٓ أُكُلَهَا كُلَّ حِينِۢ بِإِذۡنِ رَبِّهَاۗ وَيَضۡرِبُ ٱللَّهُ ٱلۡأَمۡثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَتَذَكَّرُونَ ٢٥﴾ [ابراهيم: ٢٤، ٢٥]
“তুমি কি দেখ না, আল্লাহ কীভাবে উপমা পেশ করেছেন? কালেমা তাইয়্যেবাহ, যা একটি ভালো বৃক্ষের ন্যায়, যার মূল সুস্থির আর শাখা-প্রশাখা আকাশে। সেটি তার রবের অনুমতিতে সব সময় ফল দান করে, আর আল্লাহ মানুষের জন্য নানা দৃষ্টান্ত প্রদান করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে”। [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ২৪-২৫]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: আল্লাহ তা‘আলা এ কালেমাকে কুরআনুল কারীমে সুদৃঢ় বাণী বলেছেন। যেমন, তিনি বলেন,
﴿يُثَبِّتُ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱلۡقَوۡلِ ٱلثَّابِتِ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَا وَفِي ٱلۡأٓخِرَةِۖ وَيُضِلُّ ٱللَّهُ ٱلظَّٰلِمِينَۚ وَيَفۡعَلُ ٱللَّهُ مَا يَشَآءُ ٢٧﴾ [ابراهيم: ٢٧]
“আল্লাহ অবিচল রাখেন ইমানদারদেরকে সুদৃঢ় বাণী দ্বারা দুনিয়ার জীবনে ও আখিরাতে। আর আল্লাহ যালিমদের পথভ্রষ্ট করেন এবং আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন”। [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ২৭]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা সেই আদি ও পুরনো ওয়াদা, যার উল্লেখ করেছেন আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমের নিম্নের আয়াতে:
﴿لَّا يَمۡلِكُونَ ٱلشَّفَٰعَةَ إِلَّا مَنِ ٱتَّخَذَ عِندَ ٱلرَّحۡمَٰنِ عَهۡدٗا ٨٧﴾ [مريم: ٨٧]
“যারা পরম করুণাময়ের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিয়েছে তারা ছাড়া অন্য কেউ সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখবে না”। [সূরা মারইয়াম, আয়াত: ৮৭]
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “এখানে ‘আহদ’ বা প্রতিশ্রুতি অর্থ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষী প্রদান করা, আর সকল শক্তি ও সামর্থ্যের ওপর ভরসা ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করা, এটাই সকল তাকওয়ার মূল”।[3]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা মজবুত রশি, যে আঁকড়ে ধরবে নাজাত পাবে, আর যে আঁকড়ে ধরবে না ধ্বংস হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰ ٢٥٦﴾ [البقرة: ٢٥٦]
“অতএব, যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৬]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَمَن يُسۡلِمۡ وَجۡهَهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِ وَهُوَ مُحۡسِنٞ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰۗ ٢٢﴾ [لقمان: ٢٢]
“আর যে ব্যক্তি একনিষ্ঠ ও বিশুদ্ধ চিত্তে আল্লাহর কাছে নিজকে সমর্পণ করে, সে তো শক্ত রশি আঁকড়ে ধরে”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ২২]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা চিরন্তন বাক্য, যা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার পরবর্তী প্রজন্মের ভেতর রেখে গেছেন, যেন তারা শির্ক থেকে ফিরে আসে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوۡمِهِۦٓ إِنَّنِي بَرَآءٞ مِّمَّا تَعۡبُدُونَ ٢٦ إِلَّا ٱلَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُۥ سَيَهۡدِينِ ٢٧ وَجَعَلَهَا كَلِمَةَۢ بَاقِيَةٗ فِي عَقِبِهِۦ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ ٢٨﴾ [الزخرف: ٢٦، ٢٨]
“আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম স্বীয় পিতা ও তার কওমকে বলেছিল, ‘তোমরা যেগুলোর ইবাদাত কর, নিশ্চয় আমি তাদের থেকে সম্পর্কমুক্ত, তবে (তিনি ছাড়া) যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর নিশ্চয় তিনি আমাকে শীঘ্রই হিদায়াত দিবেন। আর এটিকে সে তার উত্তরসূরিদের মধ্যে এক চিরন্তন বাণী বানিয়ে রেখে গেল, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করতে পারে”। [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ২৬-২৮]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এটা তাকওয়ার কালেমা। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথীদের ওপর এ কালেমাই আল্লাহ অবধারিত করেছেন, তারাই এর অধিক হকদার ও উপযুক্ত ছিল, আল্লাহ বলেন,
﴿إِذۡ جَعَلَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فِي قُلُوبِهِمُ ٱلۡحَمِيَّةَ حَمِيَّةَ ٱلۡجَٰهِلِيَّةِ فَأَنزَلَ ٱللَّهُ سَكِينَتَهُۥ عَلَىٰ رَسُولِهِۦ وَعَلَى ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَأَلۡزَمَهُمۡ كَلِمَةَ ٱلتَّقۡوَىٰ وَكَانُوٓاْ أَحَقَّ بِهَا وَأَهۡلَهَاۚ وَكَانَ ٱللَّهُ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٗا ٢٦﴾ [الفتح: ٢٦]
“যখন কাফিররা তাদের অন্তরে আত্ম-অহমিকা পোষণ করেছিল, জাহেলী যুগের অহমিকা। তখন আল্লাহ তার রাসূল ও মুমিনদের ওপর স্বীয় প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং তাকওয়ার বাণী তাদের জন্য অপরিহার্য করলেন, আর তারাই ছিল এর সর্বাধিক উপযুক্ত ও এর অধিকারী। আর আল্লাহ হলেন প্রত্যেক বিষয়ে সর্বজ্ঞ”। [সূরা আল-ফাতহ, আয়াত: ২৬]
আবু ইসহাক সুবাই‘ঈ বর্ণনা করেন, আমর ইবন মায়মুন বলেছেন: “মানুষ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ থেকে উত্তম কোনো বাক্য উচ্চারণ করে নি। সা‘দ ইবন ইয়াদ বলেন, হে আবু আব্দুল্লাহ, জান এ কালেমা কী? আল্লাহর কসম, এটিই তাকওয়ার কালেমা, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের ওপর আল্লাহ যা আবশ্যক করে দিয়েছেন, বস্তুত তারাই এর বেশি হকদার ও উপযুক্ত ছিল”।[4]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা চির সত্য ও চূড়ান্ত বাস্তব কথা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَوۡمَ يَقُومُ ٱلرُّوحُ وَٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ صَفّٗاۖ لَّا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَقَالَ صَوَابٗا ٣٨﴾ [النبا: ٣٨]
“সেদিন রূহ ও মালায়েকাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবে, যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দেবেন সে ছাড়া অন্যরা কোনো কথা বলবে না, আর সে ঠিক কথাই বলবে”। [সূরা আন-নাবা, আয়াত: ৩৮]
আলি ইবন আবু তালহা সাহাবী ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে আল্লাহ তা‘আলার বাণী: إِلَّا مَنۡ أَذِنَ لَهُ ٱلرَّحۡمَٰنُ وَقَالَ صَوَابٗا প্রসঙ্গে বলেন, “তবে আল্লাহ যাকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষী দিতে বলবেন, একমাত্র সে-ই কথা বলবে। এটাই চূড়ান্ত ও সর্বশেষ সত্য-কথা”।[5]
ইকরিমা রহ. বলেন, “চূড়ান্ত সত্য হচ্ছে: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ”।[6]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা সত্যের দাওয়াত, নিম্নের বাণীতে আল্লাহ তা‘আলা সত্যের দাওয়াত বলে এটিই উদ্দেশ্য করেছেন:
﴿لَهُۥ دَعۡوَةُ ٱلۡحَقِّۚ وَٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ لَا يَسۡتَجِيبُونَ لَهُم بِشَيۡءٍ إِلَّا كَبَٰسِطِ كَفَّيۡهِ إِلَى ٱلۡمَآءِ لِيَبۡلُغَ فَاهُ وَمَا هُوَ بِبَٰلِغِهِۦۚ وَمَا دُعَآءُ ٱلۡكَٰفِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَٰلٖ ١٤﴾ [الرعد: ١٤]
“সত্যের আহ্বান তাঁরই, আর যারা তাকে ছাড়া অন্যদেরকে ডাকে, তারা তাদের ডাকে সামান্যও সাড়া দিতে পারে না, বরং (তাদের দৃষ্টান্ত) ঐ ব্যক্তির মত, যে পানির দিকে তার দু’হাত বাড়িয়ে দেয় যেন তার মুখে তা পৌঁছে অথচ তার কাছে তা পৌঁছোবার নয়, আর কাফেরদের ডাক তো শুধু ভ্রষ্টতায় পর্যবসিত হয়”। [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ১৪]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা সত্যিকার বন্ধন, এর ভিত্তিতে ইসলামের অনুসারীরা এক কাতারে ঐক্যবদ্ধ হয়। এ কালেমা তাদের নিকট বন্ধুত্ব ও শত্রুতা এবং মহব্বত ও বিদ্বেষের মানদণ্ড। এ কালেমার কারণে মুসলিম উম্মাহ এক শরীর ও শীশা-গালা প্রাচীরের ন্যায়, যার এক অংশ অপর অংশ দ্বারা শক্তিশালী হয়। শাইখ মুহাম্মাদ আমিন শানকিতী রহ. (আদওয়াউল বায়ান) গ্রন্থে বলেন, “মোদ্দাকথা: মুসলিম উম্মাহর প্রকৃত বন্ধন, যা বিভিন্ন প্রকার মানুষকে এক করে এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে মহব্বত সৃষ্টি করে, সেটি হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর বন্ধন। তুমি কি লক্ষ্য কর নি, এ কালেমা মুসলিম উম্মাহকে এক শরীর ও এক দেয়ালের ন্যায় করে দিয়েছে, যার এক অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে। এ কালেমা আসমানের ধারক ও তার আশপাশে অবস্থানকারী মালায়েকাদের অন্তরসমূহকে জমিনে বসবাসকারী আদম সন্তানের ওপর হিতাকাঙ্ক্ষী করে দিয়েছে, অথচ আসমান ও জমিনের দূরত্ব অনেক, এসব তুমি ভেবে দেখ নি?!
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلَّذِينَ يَحۡمِلُونَ ٱلۡعَرۡشَ وَمَنۡ حَوۡلَهُۥ يُسَبِّحُونَ بِحَمۡدِ رَبِّهِمۡ وَيُؤۡمِنُونَ بِهِۦ وَيَسۡتَغۡفِرُونَ لِلَّذِينَ ءَامَنُواْۖ رَبَّنَا وَسِعۡتَ كُلَّ شَيۡءٖ رَّحۡمَةٗ وَعِلۡمٗا فَٱغۡفِرۡ لِلَّذِينَ تَابُواْ وَٱتَّبَعُواْ سَبِيلَكَ وَقِهِمۡ عَذَابَ ٱلۡجَحِيمِ ٧ رَبَّنَا وَأَدۡخِلۡهُمۡ جَنَّٰتِ عَدۡنٍ ٱلَّتِي وَعَدتَّهُمۡ وَمَن صَلَحَ مِنۡ ءَابَآئِهِمۡ وَأَزۡوَٰجِهِمۡ وَذُرِّيَّٰتِهِمۡۚ إِنَّكَ أَنتَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٨ وَقِهِمُ ٱلسَّئَِّاتِۚ وَمَن تَقِ ٱلسَّئَِّاتِ يَوۡمَئِذٖ فَقَدۡ رَحِمۡتَهُۥۚ وَذَٰلِكَ هُوَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ ٩﴾ [غافر: ٧، ٩]
“যারা আরশকে ধারণ করে এবং যারা তার চারপাশে রয়েছে, তারা তাদের রবের প্রশংসাসহ তাসবীহ পাঠ করে এবং তার প্রতি ঈমান রাখে, আর মুমিনদের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলে, ‘হে আমাদের রব, আপনি রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সব কিছুকে পরিব্যাপ্ত করে রয়েছেন। অতএব, যারা তাওবা করে এবং আপনার পথ অনুসরণ করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আর জাহান্নামের আযাব থেকে আপনি তাদেরকে রক্ষা করুন”। [সূরা গাফির, আয়াত: ৭-৯]
এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ইঙ্গিত করেছেন, আরশ বহনকারী ও তার পাশে যারা রয়েছে তাদের মাঝে ও জমিনে থাকা আদম সন্তানের মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছে আল্লাহর প্রতি ঈমান, যে কারণে তারা জমিনবাসীর জন্য মহান ও কল্যাণময় এরূপ দো‘আ করেছে”।
অতঃপর শানকিতী বলেন, “মোদ্দাকথা: এতে কোনো মুসলিমের দ্বিমত নেই যে, জমিনবাসীর পরস্পর সেতুবন্ধন এবং আসমান ও জমিনে অবস্থানকারীদের সেতুবন্ধন এক ও অভিন্ন কালেমা: ‘লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ। অতএব এ কালেমা ব্যতীত দ্বিতীয় কোনো বস্তুকে (যেমন বংশ, ভাষা, স্থান, দেশ ও মতবাদ তথা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ ইত্যাদিকে) সেতুবন্ধন বানিয়ে তার দিকে আহ্বান করা কিংবা তার আদর্শে ঐক্যবদ্ধ হওয়া বৈধ নয়”।[7]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা সবচেয়ে বড় নেকী বা হাসানাহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُۥ خَيۡرٞ مِّنۡهَاۖ ٨٤﴾ [القصص: ٨٤]
“কেউ হাসানাহ নিয়ে আসলে তার জন্য থাকবে তা থেকে উত্তম প্রতিদান”। [সূরা আল-কাসাস, আয়াত: ৮৪]
ইবন মাসউদ, ইবন আব্বাস ও আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম থেকে বর্ণিত, আয়াতে হাসানাহ অর্থ: ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’।[8]
ইকরিমাহ রহ. আল্লাহর বাণী (مَن جَآءَ بِٱلۡحَسَنَةِ فَلَهُۥ خَيۡرٞ مِّنۡهَاۖ) প্রসঙ্গে বলেন, অর্থাৎ যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ নিয়ে আসবে, সে তার কল্যাণ অর্জন করবে, কারণ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ অপেক্ষা উত্তম কোনো কল্যাণ নেই।[9]মুসনাদ-এ আহমদ ও অন্যান্য গ্রন্থে এসেছে, আবু যর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, আমাকে একটি আমল শিক্ষা দিন, যা আমাকে জান্নাতের কাছে ও জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে, তিনি বললেন: “যখন মন্দ কিছু কর, তার বিপরীতে ভালো কিছুও কর। কারণ, প্রত্যেক ভালো তার দশগুণ”। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ কি হাসানাহ বা নেকীর অন্তর্ভুক্ত? তিনি বললেন: “হ্যাঁ, সবচেয়ে বড় হাসানাহ এটিই”।[10]
[2] ‘কালিমাতুল ইখলাস’ গ্রন্থে ইবন রজব উল্লেখ করেছেন: (পৃ. ৫৩)
[3] তাবরানী, আদ-দো‘আ: (৩/১৫১৮)
[4] তাবরানী, ফিদ দো‘আ: (৩/১৫৩৩)
[5] তাবরানী, ফিদ দো‘আ: (৩/১৫২০)
[6] তাবরানী, ফিদ দো‘আ: (৩/১৫২০)
[7] আদওয়াউল বায়ান: (৩/৪৪৭) ও (৩/৪৪৮)
[8] আদ-দো‘আ লিত তাবরানী: (৩/১৪৯৭,১৪৯৮)
[9] ইবন আবিদ দুনিয়া রচিত: ‘ফাদলুত তাহলীল ওয়া সাওয়াবুহুল জালীল’: (পৃ. ৭৪)
[10] আল-মুসনাদ: (৫/১৬৯); আদ-দো‘আ লিত-তাবরানী: (১৪৯৮)
পূর্বে আমরা তাওহীদের কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ফযীলত সম্পর্কে আলোচনা করেছি কুরআনুল কারীমের আলোকে। কারণ, এটিই সেই মহান কালেমা, যার জন্য অস্তিত্বে এসেছে আসমান ও জমিন; সৃজিত হয়েছে সকল মখলুক এবং প্রেরিত হয়েছেন রাসূলগণ। এ কালেমা প্রতিষ্ঠা করার জন্যই শরী‘আত প্রদান ও কিতাব নাযিল করা হয়েছে। আবার এ কালেমার জন্যই দাঁড়ি-পাল্লা স্থাপন, হিসেবের খাতা খোলা এবং জান্নাত ও জাহান্নামের বাজার বসবে। মানুষ মুমিন ও কাফির, নেককার ও বদকার দু’ভাগে বিভক্ত এ কালেমার জন্য। আল্লাহর সৃষ্টি ও আদেশ, সাওয়াব ও শাস্তির মূল রহস্য এ কালেমা। এটি সে সত্য বাণী, যার ওপর দীন প্রতিষ্ঠিত ও কিবলা নির্ধারিত। কিয়ামতের দিন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবাইকে এ কালেমা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।
বান্দার পা আল্লাহর সম্মুখ থেকে হটবে না, যতক্ষণ না তাদেরকে দু’টি মাসআলা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে:
১. তোমরা কার ইবাদাত করেছ?
২. রাসূলদের কী উত্তর দিয়েছ?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ জানা, তার স্বীকৃতি প্রদান করা ও তার ওপর আমল করে কালেমা বাস্তবায়ন করা।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর: মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লার অর্থ জানা, তাকে আল্লাহর রাসূল হিসেবে স্বীকার করা, তার বশ্যতা মেনে নেওয়া ও তার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে তার রিসালাহ বাস্তবায়ন করা।[1]
সন্দেহ নেই, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ফযীলত কারো পক্ষে গণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়, কারণ তার ওপর নির্ভর করে দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা, প্রতিদান ও সাওয়াব, তাই তার সব অর্থ কারো অন্তরে উদয় হওয়া বা কল্পনায় আসা সম্ভব নয়। এখানে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস থেকে কয়েকটি ফযীলত লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করব।
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ফযীলত: এ কালেমার আমল সর্বোত্তম, তার সাওয়াব অনেক বেশি ও অনেক গোলাম আজাদ করার সমান। এ কালেমা তার পাঠকারীর জন্য শয়তান থেকে ঢালস্বরূপ হয়। যেমন, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ قَالَ: لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، فِي يَوْمٍ مِائَةَ مَرَّةٍ، كَانَتْ لَهُ عَدْلَ عَشْرِ رِقَابٍ، وَكُتِبَتْ لَهُ مِائَةُ حَسَنَةٍ، وَمُحِيَتْ عَنْهُ مِائَةُ سَيِّئَةٍ، وَكَانَتْ لَهُ حِرْزًا مِنَ الشَّيْطَانِ يَوْمَهُ ذَلِكَ حَتَّى يُمْسِيَ، وَلَمْ يَأْتِ أَحَدٌ بِأَفْضَلَ مِمَّا جَاءَ بِهِ، إِلَّا أَحَدٌ عَمِلَ أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ»
“যে ব্যক্তি প্রত্যেক দিন একশত বার পাঠ করবে: «لاَ إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ المُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ» (অর্থ: আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তিনি এক তার কোনো শরীক নেই, তার জন্যই সকল রাজত্ব এবং তিনি সকল প্রশংসার মালিক, আর তিনিই সকল বস্তুর ওপর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী) এটি তার জন্য দশটি গোলাম আযাদ করার সমান হবে, তার আমলনামায় এক শত নেকী লিখা হবে এবং তার আমলনামা থেকে এক শত পাপ মোচন করা হবে। এ কালেমা সে দিন তার জন্য শয়তান থেকে ঢালস্বরূপ হবে, যতক্ষণ না সে সন্ধ্যায় উপনীত হয়। আর সে যা নিয়ে উপস্থিত হবে তার চেয়ে উত্তম কিছু নিয়ে কেউ উপস্থিত হবে না, তবে যে এ কালেমা তার চেয়ে বেশি পাঠ করবে সে ব্যতীত”।[2]
ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ قَالَهَا عَشْرَ مِرّاتٍ كَانَ كَمَنْ أَعْتَقَ أَرْبَعَةَ أَنْفُسٍ مِنْ وَلَدِ إِسْمَاعِيلَ»
“যে ব্যক্তি উক্ত দো‘আ দশবার বলবে, সে যেন ইসমাঈলের বংশধর থেকে চার ব্যক্তিকে মুক্ত করল”।[3]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: নবীগণ যত অযীফা পাঠ করেছেন তার মধ্যে সবচেয়ে উত্তম অযীফা এ কালেমা। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আরাফাতের সন্ধ্যায় আমি এবং আমার পূর্বে নবীগণ যা বলেছি, তন্মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে[4]:
«لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَحْدَهُ، لا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ»
অপর বর্ণনায় এসেছে: সর্বোত্তম দো‘আ ‘আরাফাতের দিনের দো‘আ। আমি ও আমার পূর্বে নবীগণ যা বলেছি, তন্মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে:[5]
«لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ»
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: কিয়ামতের দিন এটি পাপের দফতরের বিপরীত ভারী হয়ে নুয়ে পড়বে। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«يُصَاحُ بِرَجُلٍ مِنْ أُمَّتِي عَلَى رُءُوسِ الْخَلائِقِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، فَيُنْشَرُ لَهُ تِسْعَةٌ وَتِسْعُونَ سِجِلا، كُلُّ سِجِلٍّ مِنْهَا مَدُّ الْبَصَرِ، ثُمَّ يَقُولُ اللَّهُ عز وجل لَهُ: " أَتُنْكِرُ مِنْ هَذَا شَيْئًا؟ " فَيَقُولُ: لا يَا رَبِّ، فَيَقُولُ عز وجل: أَلَكَ عُذْرٌ أَوْ حَسَنَةٌ؟ " فَيَهَابُ الرَّجُلُ، فَيَقُولُ: لا يَا رَبِّ، فَيَقُولُ عز وجل: بَلَى إِنَّ لَكَ عِنْدَنَا حَسَنَاتٍ، وَإِنَّهُ لا ظُلْمَ عَلَيْكَ "، فَتُخْرَجُ لَهُ بِطَاقَةٌ فِيهَا: أَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، فَيَقُولُ: يَا رَبِّ مَا هَذِهِ الْبِطَاقَةُ مَعَ هَذِهِ السِّجِلاتِ؟ فَيَقُولُ: إِنَّكَ لا تُظْلَمُ ".قَالَ: فَتُوضَعُ السِّجِلاتُ فِي كِفَّةٍ وَالْبِطَاقَةُ فِي كِفَّةٍ، فَطَاشَتِ السِّجِلاتُ وَثَقُلَتِ الْبِطَاقَةُ»
“কিয়ামতের দিন সকল মানুষের সামনে আমার উম্মত থেকে এক ব্যক্তিকে চিৎকার করে ডাকা হবে, অতঃপর তার নিরানব্বইটি দফতর পেশ করা হবে, প্রত্যেক দফতরের দৈর্ঘ্য হবে চোখের দৃষ্টি সমপরিমাণ, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বললেন: এসব থেকে কোনোও একটি তুমি অস্বীকার কর? সে বলবে: না, হে আমার রব। আল্লাহ বলবেন: তোমার কোনো অজুহাত অথবা কোনো নেকী আছে কি? লোকটি ভয় পেয়ে যাবে এবং বলবে, হে আমার রব্ব, না কোনো নেকী নেই। আল্লাহ বলবেন: অবশ্যই, আমাদের কাছে তোমার একটি নেকী আছে, আর নিশ্চিত থাক তোমার ওপর যুলুম করা হবে না, এরপর একটি কার্ড পেশ করা হবে, যেখানে থাকবে:
«أَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ»
লোকটি বলবে: হে আমার রব, এসব দফতরের বিপরীতে এ কার্ডের মূল্য কী? আল্লাহ বলবেন: তুমি যুলমের শিকার হবে না। তিনি বলেন, অতঃপর সকল দফতর এক পাল্লায় আর কার্ডটি রাখা হবে অপর পাল্লায়, তখন দফতরগুলো উপরে উঠে যাবে আর কালেমার কার্ড ভারী হয়ে নুয়ে পড়বে”।[6]
এতে সন্দেহ নেই যে, উক্ত ব্যক্তি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে, সে জন্যই তার কার্ডটি সকল দফতরকে হালকা করে নিজে ভারী হয়ে নুয়ে পড়েছে। কারণ মানুষের অন্তরে থাকা ঈমানের তারতম্যের ফলে আমলও তারতম্য হয়, অন্যথায় সে ময়দানে এরূপ লোক অনেক থাকবে, যারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে, কিন্তু তার মত তাদের সাওয়াব হাসিল হবে না। কারণ, তাদের অন্তরে কালেমার ঈমান দুর্বল ছিল। ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু সূত্রে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«يَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ شَعِيرَةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ بُرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ، وَيَخْرُجُ مِنَ النَّارِ مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَفِي قَلْبِهِ وَزْنُ ذَرَّةٍ مِنْ خَيْرٍ»
“যে لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ বলেছে এবং তার অন্তরে যবের ওজন পরিমাণ কল্যাণ রয়েছে সে জাহান্নাম থেকে বের হবে। জাহান্নাম থেকে সেও বের হবে, যে لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ বলেছে এবং তার অন্তরে গম পরিমাণ কল্যাণ রয়েছে। আবার জাহান্নাম থেকে সেও বের হবে, যে لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ বলেছে এবং তার অন্তরে অণু পরিমাণ ঈমান রয়েছে”।[7]
এ থেকে সাব্যস্ত হয় ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা সবাই সমান নয়, সমানভাবে সবাই তার ঈমান ধারণ করে নি।
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: যদি আসমান ও জমিনকে এ কালেমার বিপরীতে ওজন করা হয়, তবুও তা নুয়ে পড়বে। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন,
«أنَّ نُوحًا قَالَ لِابْنِهِ عند موته: آمُرُكَ بِلَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، فَإِنَّ السَّمَوَاتِ السَّبْعَ، وَالْأَرْضِينَ السَّبْعَ، لَوْ وُضِعَتْ فِي كِفَّةٍ، وَوُضِعَتْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ فِي كِفَّةٍ، رَجَحَتْ بِهِنَّ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَلَوْ أَنَّ السَّمَوَاتِ السَّبْعَ كُنَّ حَلْقَةً مُبْهَمَةً، لقَصَمَتْهُنَّ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ»
“নূহ আলাহিস সালাম মৃত্যুর সময় স্বীয় সন্তানকে বলেছেন: আমি তোমাকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর নির্দেশ দিচ্ছি। কারণ, যদি সাত আসমান ও সাত জমিন এক পাল্লায় রাখা হয় আর লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহকে অপর পাল্লায় রাখা হয়, তবুও লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ তাদের বিপরীত নুয়ে পড়বে। আর যদি সাত আসমান এক বৃত্তে পরিণত হয় তবুও ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তাকে হালকা করে দিবে।[8]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: আল্লাহর সাথে এ কালেমার কোনো পর্দা নেই, বরং সকল পর্দা ভেদ করে সে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। তিরমিযি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَا قَالَ عَبْدٌ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ قَطُّ مُخْلِصًا إِلَّا فُتِحَتْ لَهُ أَبْوَابُ السَّمَاءِ حَتَّى تُفْضِيَ إِلَى الْعَرْشِ مَا اجْتَنَبَ الْكَبَائِرَ»
“কোন বান্দা যখনি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে «لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ» বলেছে, তখনি অবশ্যই তার জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হয়েছে, যেন তা আরশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, যাবত সে কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকে”।[9]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা যে বলবে তার জন্য তা নাজাতস্বরূপ হবে। সহীহ মুসলিমে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক মুয়াযযিনকে বলতে শুনলেন: «أشهد أن لاإله إلاالله» (আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনো ইলাহ নেই)। তিনি বললেন: «خَرَجَ مِنَ النَّارِ» “সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেল”।[10]
ইতবান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ: لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ، يَبْتَغِي بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ»
“নিশ্চয় যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার উদ্দেশ্যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে, আল্লাহ তাকে আগুনের ওপর হারাম করে দিবেন”।[11]
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অপর ফযীলত: এ কালেমাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের সর্বোত্তম শাখা বলেছেন। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ شُعْبَةً، أعلاها قَوْلُ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الأَذَى عَنِ الطَّرِيقِ»
“ঈমান সত্তরের অধিক শাখা সংবলিত। সর্বোত্তম শাখা হলো লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা, আর তার সর্বনিম্ন শাখা রাস্তা থেকে কষ্ট দূর করা”।[12]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোত্তম যিকির বলেছেন, যেমন ইমাম তিরমিযী প্রমুখগণ জাবির ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন:
«أَفْضَلُ الذِّكْرِ: لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ، وأَفْضَلَ الدُّعَاءِ: الْحَمْدُ لِلَّهِ»
“সর্বোত্তম যিকির: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও সর্বোত্তম দো‘আ: আল-হামদুলিল্লাহ”।[13]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অপর ফযীলত: এ কালেমা যে অন্তর থেকে বলবে, কিয়ামতের দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশ লাভ করে সবচেয়ে বেশি সেই ধন্য হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল, কিয়ামতের দিন আপনার সুপারিশ লাভ করে সবচেয়ে বেশি ধন্য কে হবে? তিনি বললেন:
«لَقَدْ ظَنَنْتُ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ، أَنْ لَا يَسْأَلَنِي عَنْ هَذَا الْحَدِيثِ أَحَدٌ أَوَّلُ مِنْكَ لِمَا رَأَيْتُ مِنْ حِرْصِكَ عَلَى الْحَدِيثِ، أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ»
“হে আবু হুরায়রা, আমি ধারণা করেছি, এ হাদীস সম্পর্কে তোমার চেয়ে আগে কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করবে না। কারণ, হাদীসের ওপর আমি তোমার আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। কিয়ামতের দিন আমার সুপারিশ লাভ করে সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবান সে হবে, যে নিজের অন্তর অথবা নফস থেকে খালিসভাবে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে”।[14]
অত্র হাদীসে তিনি বলেছেন: «مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ» এ কথা প্রমাণ করে, মুখে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা যথেষ্ট নয়, বরং কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত কালেমার শর্তসমূহ ও তার জরুরি বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা আবশ্যক, অন্যথায় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মূল্যহীন।
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৪০৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬৯১
[3] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৪০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৬৯৩
[4] তাবরানী, দো‘আ: (৮৭৪)
[5] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৮৫; সিলসিলাহ সহীহাহ: (৪/৭ ও ৮)
[6] আল-মুসনাদ: (২/২১৩); তিরমিযী, হাদীস নং ২৬৩৯; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৪৩০০; সহীহ আল-জামে‘, হাদীস নং ৮০৯৫
[7] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৩, ৩২৫
[8] মুসনাদ: (২/১৭০); সিলসিলাহ সহীহাহ, লিল আলবানী: (১৩৪)
[9] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৫৯০; সহীহ আল-জামে‘ (হাদীস নং ৫৬৪৮) গ্রন্থে আলবানী হাসান বলেছেন।
[10] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৮২
[11] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৯৩৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৩, ২৬৩
[12] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৫
[13] তিরমিযী, হাদীস নং ৩৩৮৩; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৮০০; সহীহ আল-জামে‘ (হাদীস নং ১১০৪) গ্রন্থে আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
[14] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯৯
ইতোপূর্বে আমরা সর্বোচ্চ, সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর কতক ফযীলত জেনেছি। আরও জেনেছি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর বদৌলতে দুনিয়া ও আখিরাতে অনেক ফযীলত, উপকার ও কল্যাণ হাসিল হয়, তবে মুসলিম হিসেবে প্রত্যেকের জানা উচিৎ যে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুখে উচ্চারণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং তার হক ও ফরযসমূহ আদায় করা এবং তার শর্তসমূহ পূর্ণ করা জরুরি, যা কুরআন ও সুন্নাহয় রয়েছে। একটি বিষয় প্রত্যেক মুসলিম জানে যে, যেসব ইবাদত দ্বারা আমরা আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করি সেসব ইবাদাতের নিজস্ব কিছু শর্ত রয়েছে, যা ব্যতীত সংশ্লিষ্ট ইবাদাত গ্রহণ করা হয় না। যেমন, সালাত অযু ব্যতীত গ্রহণ করা হয় না, অনুরূপ হজ তার শর্ত ব্যতীত গ্রহণ করা হয় না, অনুরূপ সকল ইবাদাত নির্ধারিত শর্ত ব্যতীত গ্রহণ করা হয় না, যেসব শর্ত কুরআন ও সন্নাহয় বিধৃত হয়েছে। অনুরূপ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ গ্রহণ করা হয় না, যতক্ষণ না বান্দা তার শর্তসমূহ পূরণ করবে, যার বর্ণনা কুরআন ও হাদীসে এসেছে।
আমাদের আদর্শ পূর্বসূরিগণ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর শর্তের ওপর জোর তাগিদ করেছেন। কারণ, শর্ত বাস্তবায়ন করা ব্যতীত লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ গ্রহণযোগ্য নয়। যেমন, হাসান বসরী রহ. থেকে বর্ণিত, তাকে জিজ্ঞেস করা হলো: “কতক লোক বলে: যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে সে জান্নাতে যাবে। তিনি বললেন: যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং তার হক ও ফরযসমূহ আদায় করবে সে জান্নাতে যাবে”।
প্রসিদ্ধ আরবি কবি ফারাযদাক স্বীয় স্ত্রীকে দাফন করছিলেন, তখন হাসান বসরী তাকে বলেন, এ দিনের জন্য কী প্রস্তুত করেছ? সে বলল: সত্তর বছর যাবৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সাক্ষীকে প্রস্তুত করছি। হাসান বসরী বললেন: তোমার প্রস্তুতি খুব সুন্দর; কিন্তু লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর কতিপয় শর্ত রয়েছে। খবরদার সতী-সাধ্বী নারীকে কখনো অপবাদ দিবে না”।
ওহাব ইবন মুনাব্বিহ জনৈক ব্যক্তিকে বলেন, যে তাকে প্রশ্ন করে ছিল: “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ কি জান্নাতের চাবি নয়? তিনি বললেন: অবশ্যই, তবে প্রত্যেক চাবির দাঁত রয়েছে, তুমি যদি দাঁত বিশিষ্ট চাবি নিয়ে আস তোমার জন্য খোলা হবে, অন্যথায় খোলা হবে না। তিনি দাঁত বলে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর শর্তের দিকে ইশারা করেছেন”।[1]
কুরআন ও সুন্নাহ অনুসন্ধান শেষে আহলে ইলমদের নিকট স্পষ্ট হয়েছে যে, সাতটি শর্ত ব্যতীত লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ গ্রহণযোগ্য নয়, সেগুলো হচ্ছে:
১. কালেমার অর্থ জানা, অর্থাৎ কালেমার ভেতর কী অস্বীকার ও কী সাব্যস্ত করা হয়েছে তা জানা জরুরি, যা তার অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞতার বিপরীত।
২. কালেমার ভেতর যা সাব্যস্ত করা হয়েছে তা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করা জরুরি, যা কালেমা সম্পর্কে সংশয় ও সন্দেহ পোষণ করার বিপরীত।
৩. কালেমার প্রতি পূর্ণ ইখলাস প্রদর্শন করা জরুরি, যা তার অর্থ ও দাবি বাস্তবায়ন করার সময় শির্ক ও রিয়াকে প্রশ্রয় দেওয়ার বিপরীত।
৪. কালেমাকে মনে-প্রাণে সত্য জানা জরুরি, যা তার প্রতি মিথ্যারোপ করার বিপরীত।
৫. কালেমায় সাব্যস্ত সত্তাকে (আল্লাহকে) মহব্বত করা জরুরি, যা তার প্রতি কোনো প্রকার বিদ্বেষ ও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করার বিপরীত।
৬. কালেমার অর্থ ও দাবির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা জরুরি, যা তার অর্থ ও দাবিকে ত্যাগ করার বিপরীত।
৭. কালেমার অর্থ ও দাবি মনে-প্রাণে গ্রহণ করা জরুরি, যা তার অর্থ ও দাবির বাস্তবায়নকে প্রতিরোধ করার বিপরীত।
সাতটি শর্তকে জনৈক আহলে-ইলম এক কবিতায় একত্র করেছেন, যেমন:
علم يقين وإخلاص وصدقك مع محبة وانقياد والقبول لها
১. ‘ইলম’ অর্থাৎ অর্থ ও দাবি জানা, ২. ‘ইয়াকিন’ অর্থাৎ অর্থ ও দাবিকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা, ৩. ‘ইখলাস’ অর্থাৎ অর্থ ও দাবিকে বাস্তবায়ন করার সময় রিয়া ও শির্কে লিপ্ত না হওয়া। ৪. ‘সিদক’ অর্থাৎ কালেমার অর্থ ও দাবির প্রতি সত্যারোপ করা। ৫. ‘মহব্বত’ অর্থাৎ কালেমায় সাব্যস্ত সত্তাকে মহব্বত করা, ৬. ‘ইনকিয়াদ’ অর্থাৎ কালেমায় সাব্যস্ত সত্তার প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য প্রদর্শন করা, ও ৭. ‘কবুল’ অর্থাৎ কালেমার অর্থ ও দাবিকে সানন্দে গ্রহণ করা।
নিম্নে আমরা কুরআন ও সুন্নার আলোকে এসব শর্তের অর্থ ও দাবি সংক্ষেপে আলোচনা করছি, যেন প্রত্যেক শর্ত সবার নিকট পরিষ্কারভাবে স্পষ্ট হয়।[2]
প্রথম শর্ত: এ কালেমায় কী অস্বীকার আর কী সাব্যস্ত করা হয়েছে তার অর্থ জানা জরুরি, যা কালেমা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার বিপরীত। অর্থাৎ যে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে, সে সকল প্রকার ইবাদাত আল্লাহকে উৎসর্গ করবে, তিনি ব্যতীত অন্যান্য মা‘বুদকে অস্বীকার করবে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿إِيَّاكَ نَعۡبُدُ وَإِيَّاكَ نَسۡتَعِينُ ٥﴾ [الفاتحة: ٥]
“নিশ্চয় আমরা আপনারই ইবাদাত করি এবং আপনার নিকট সাহায্য চাই”। [সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত: ৫] অর্থাৎ আমরা আপনার ইবাদাত করি, আপনি ব্যতীত কারো ইবাদত করি না, আপনার নিকট সাহায্য চাই, আপনি ব্যতীত কারো নিকট সাহায্য চাই না।
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿فَٱعۡلَمۡ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ ١٩﴾ [محمد : ١٩]
“জেনে রাখ যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই”। [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ১৯]
অপর আয়াতে বলেন,
﴿ إِلَّا مَن شَهِدَ بِٱلۡحَقِّ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٨٦ ﴾ [الزخرف: ٨٦]
“তবে তারা ছাড়া যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয়”। [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮৬]
এ আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মুফাসসিরগণ বলেছেন: যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ জেনে সাক্ষী দিবে তারাই এখানে উদ্দেশ্য। অর্থাৎ মুখ ও অন্তরের সমন্বয় যে সাক্ষী তারা প্রদান করেছে তার অর্থ তারা জানে। উসমান ইবন আফফান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ مَاتَ وَهُوَ يَعْلَمُ أَنَّهُ، لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، دَخَلَ الْجَنَّةَ»
“যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ জানা অবস্থায় মারা গেল সে জান্নাতে যাবে”।[3] এখানে তিনি ইলম তথা কালেমার অর্থ জানার শর্তারোপ করেছেন।
দ্বিতীয় শর্ত: কালেমার অর্থ ও দাবির প্রতি প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস লালন করা, তাতে কোনো প্রকার সন্দেহ ও সংশয়কে আশ্রয় না দেওয়া। অর্থাৎ কালেমা উচ্চারণকারী তার অর্থ ও দাবিকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবে, যেন তাতে সন্দেহ ও সংশয় না থাকে, তবে এ জাতীয় দৃঢ় বিশ্বাস বা ইয়াকীন হাসিল করার জন্য পূর্ণ জ্ঞান থাকা জরুরি। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের গুণাবলির আলোচনায় বলেন,
﴿إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمۡ يَرۡتَابُواْ وَجَٰهَدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ ١٥﴾ [الحجرات: ١٥]
“মুমিন কেবল তারাই যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারপর সন্দেহ পোষণ করে নি। আর নিজেদের সম্পদ ও নিজদের জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে। এরাই সত্যনিষ্ঠ”। [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৫]
আল্লাহর বাণী: ثُمَّ لَمۡ يَرۡتَابُواْ অর্থ তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছে, সন্দেহ পোষণ করে নি।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنِّي رَسُولُ اللَّهِ، لَا يَلْقَى اللَّهَ بِهِمَا عَبْدٌ غَيْرَ شَاكٍّ فِيهِمَا، إِلَّا دَخَلَ الْجَنَّةَ»
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি তার রাসূল। যে কোনো বান্দা এ দু’টি বিষয় সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা ব্যতীত আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবে সে জান্নাতে যাবে”।[4]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে ইমাম মুসলিম আরেকটি হাদীস বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَنْ لَقِيتَ مِنْ وَرَاءِ هذا الْحَائِطِ يَشْهَدُ أَنْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ مُسْتَيْقِنًا بِهَا قَلْبُهُ، فَبَشِّرْهُ بِالْجَنَّةِ»
“এ দেয়ালের পশ্চাতে তুমি যাকে পাবে, সে যদি নিজের অন্তর থেকে দৃঢ় বিশ্বাসসহ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাক্ষ্য প্রদান করে, তাকে জান্নাতের সুসংবাদ প্রদান কর”।[5]
এ হাদীসে তিনি কালেমার জন্য ইয়াকীন বা দৃঢ় বিশ্বাস শর্তারোপ করেছেন।
তৃতীয় শর্ত: কালেমার অর্থ ও দাবি পূর্ণ ইখলাসসহ গ্রহণ করা, যেন তাতে শির্ক ও রিয়ার অংশ না থাকে। অর্থাৎ প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল প্রকার শির্ক থেকে আমলকে মুক্ত রাখা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَا لِلَّهِ ٱلدِّينُ ٱلۡخَالِصُۚ ٣﴾ [الزمر: ٣]
“জেনে রেখ, আল্লাহর জন্যই একনিষ্ঠ ইবাদাত”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ ٥﴾ [البينة: ٥]
“আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদত করে তারই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে”। [সূরা আল-বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ৫]
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«أَسْعَدُ النَّاسِ بِشَفَاعَتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ، مَنْ قَالَ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ خَالِصًا مِنْ قَلْبِهِ أَوْ نَفْسِهِ»
“আমার সুপারিশ দ্বারা ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান হবে, যে ইখলাসের সাথে অন্তর থেকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে”।[6] এ হাদীসে তিনি কালেমার জন্য ইখলাস শর্ত করেছেন।
চতুর্থ শর্ত: কালেমার অর্থ ও দাবিকে সত্য জানা, মিথ্যারোপ না করা অর্থাৎ সততার সাথে বান্দার অন্তর থেকে এ কালেমা উচ্চারণ করা। সততার অর্থ, মুখের সাথে অন্তরের মিল থাকা। এ সততা না থাকায় অর্থাৎ অন্তরের সাথে মুখের মিল না থাকায় মুনাফিকদের দুর্নাম করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِذَا جَآءَكَ ٱلۡمُنَٰفِقُونَ قَالُواْ نَشۡهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ ٱللَّهِۗ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُۥ وَٱللَّهُ يَشۡهَدُ إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ لَكَٰذِبُونَ ١﴾ [المنافقون: ١]
“যখন তোমার কাছে মুনাফিকরা আসে, তখন বলে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয় আপনি আল্লাহর রাসূল এবং আল্লাহ জানেন যে, অবশ্যই তুমি তার রাসূল। আর আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, অবশ্যই মুনাফিকরা মিথ্যাবাদী”। [সূরা আল-মুনাফিকূন, আয়াত: ১]
অত্র আয়াতে আল্লাহ তাদের মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করেছেন, কারণ তারা মুখে যা বলেছে তাদের অন্তরে সেটি ছিল না।
অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَحَسِبَ ٱلنَّاسُ أَن يُتۡرَكُوٓاْ أَن يَقُولُوٓاْ ءَامَنَّا وَهُمۡ لَا يُفۡتَنُونَ ٢ وَلَقَدۡ فَتَنَّا ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِمۡۖ فَلَيَعۡلَمَنَّ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ صَدَقُواْ وَلَيَعۡلَمَنَّ ٱلۡكَٰذِبِينَ ٣﴾ [العنكبوت: ٢، ٣]
“মানুষ কি মনে করে যে, আমরা ঈমান এনেছি বললেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে, আর তাদের পরীক্ষা করা হবে না। আর আমরা তো তাদের পূর্ববর্তীদের পরীক্ষা করেছি। ফলে আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন, কারা সত্য বলে এবং অবশ্যই তিনি জেনে নেবেন, কারা মিথ্যাবাদী”? [সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ২-৩]
ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. মু‘আয ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«مَا مِنْ أَحَدٍ يَشْهَدُ أَنَّ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ صَادِقًا مِنْ قَلْبِهِ، إِلا حَرَّمَهُ اللَّهُ عَلَى النَّارِ»
“এমন কেউ যে অন্তরের সততা থেকে সাক্ষ্য দিবে আল্লাহ ছাড়া কোনো মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ তার বান্দা ও রাসূল, অবশ্যই আল্লাহ তার ওপর জাহান্নাম হারাম করে দিবেন”।[7] এ হাদীসে তিনি কালেমার ভেতর সততার শর্তারোপ করেছেন।
পঞ্চম শর্ত: এ কালেমায় সাব্যস্ত সত্তাকে মহব্বত করা, যেন তার প্রতি বিদ্বেষ ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি না হয়, যেমন কালেমা উচ্চারণকারী আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল, দীন ইসলাম ও মুসলিমদের মহব্বত করবে, যেসব মুসলিম আল্লাহর নির্দেশ বাস্তবায়ন করে ও তাতে সীমালঙ্ঘন করে না। পক্ষান্তরে যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর বিরোধিতা করে এবং তার বিপরীত বস্তুতে লিপ্ত হয়, যেমন শির্ক ও কুফর, তাদেরকে অপছন্দ করে। অতএব, কালেমার ঈমানের জন্য মহব্বত জরুরি। দলীল, আল্লাহর বাণী:
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَندَادٗا يُحِبُّونَهُمۡ كَحُبِّ ٱللَّهِۖ ١٦٥﴾ [البقرة: ١٦٥]
“আর মানুষের মধ্যে এমনও আছে, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে, তাদেরকে আল্লাহকে ভালোবাসার মতো ভালোবাসে”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৫]
হাদীসে এসেছে:
«أَوْثَقُ عُرَى الإِيمَانِ، الْحَبُّ فِي اللَّهِ، وَالْبُغْضُ فِي اللَّهِ»
“ঈমানের সবচেয়ে মজবুত রশি আল্লাহর জন্য মহব্বত করা ও আল্লাহর জন্য বিদ্বেষ পোষণ করা”।[8]
ষষ্ঠ শর্ত: কালেমার অর্থ ও দাবি মনে-প্রাণে গ্রহণ করা, যা প্রত্যাখ্যান করার বিপরীত। সত্যিকারভাবে কালেমার অর্থ ও দাবিকে গ্রহণ করা জরুরি। যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ গ্রহণ করবে আল্লাহ তা‘আলা তাদের মুক্তি দিবেন। পক্ষান্তরে, যারা কালেমা গ্রহণ করবে না, বরং প্রত্যাখ্যান করবে তাদের থেকে তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ ও তাদেরকে ধ্বংস করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ثُمَّ نُنَجِّي رُسُلَنَا وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْۚ كَذَٰلِكَ حَقًّا عَلَيۡنَا نُنجِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ ١٠٣﴾ [يونس : ١٠٣]
“অতঃপর, আমি নাজাত দেই আমার রাসূলদেরকে এবং তাদেরকেও যারা ঈমান এনেছে। এটা আমার দায়িত্ব যে, মুমিনদের নাজাত দেই”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১০৩]
অপর আয়াতে তিনি মুশরিকদের সম্পর্কে বলেন,
﴿إِنَّهُمۡ كَانُوٓاْ إِذَا قِيلَ لَهُمۡ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ يَسۡتَكۡبِرُونَ ٣٥ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوٓاْ ءَالِهَتِنَا لِشَاعِرٖ مَّجۡنُونِۢ ٣٦﴾ [الصافات : ٣٥، ٣٦]
“তাদেরকে যখন বলা হত, ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই’ তখন নিশ্চয় তারা অহংকার করত। আর তারা বলত, আমরা কি এক পাগল কবির জন্য আমাদের উপাস্যদের ছেড়ে দেব”। [সূরা আস-সাফফাত, আয়াত: ৩৫-৩৬]
সপ্তম শর্ত: কালেমার অর্থ ও দাবির সামনে বশ্যতা স্বীকার করা, যা কালেমা ত্যাগ করার বিপরীত। কারণ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করার অর্থ আল্লাহর শরী‘আতের সামনে পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করা, তার বিধানকে মেনে নেওয়া এবং স্বীয় চেহারাকে আল্লাহর দিকে ধাবিত করা জরুরি, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থকে আঁকড়ে ধরার অর্থ এটাই। এ জন্য আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَمَن يُسۡلِمۡ وَجۡهَهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِ وَهُوَ مُحۡسِنٞ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰۗ ٢٢﴾ [لقمان: ٢٢]
“আর যে ব্যক্তি একনিষ্ঠ ও বিশুদ্ধচিত্তে আল্লাহর কাছে নিজকে সমর্পণ করে, সে তো শক্ত রশি আঁকড়ে ধরল”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ২২] অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহকে আঁকড়ে ধরা। এখানে আল্লাহ তা‘আলা কালেমার সাথে শরী‘আতের প্রতি আনুগত্য প্রদানকে শর্ত করেছেন, অর্থাৎ আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণ করা। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর জন্য এসব শর্ত জরুরি। কালেমার উদ্দেশ্য কখনো শব্দ গণনা ও বাক্য মুখস্থ করা নয়। এমন অনেক সাধারণ লোক আছে, যার ভেতর কালেমার সবক’টি শর্ত বিদ্যমান এবং সে তা আঁকড়ে ধরেছে, যদি তাকে বলা হয়: গণনা কর সে ভালো করে তা গণনা করতে পারবে না, পক্ষান্তরে কালেমার শব্দ মুখস্থকারী অনেক আছে, যে তীরের মত কালেমা উচ্চারণ করতে সক্ষম, তবে তাদের অনেকে কালেমা পরিপন্থী বস্তুতে লিপ্ত। অতএব কালেমার জন্য ইলম ও আমল উভয় জরুরি, তবেই ব্যক্তি সত্যিকারভাবে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বা তাওহীদের কালেমার পরিবারভুক্ত হবে, যার তাওফীক দাতা ও সাহায্যকারী সত্তা একমাত্র আল্লাহ তাআলা। আমরা তার নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন আমাদেরকে তার তাওফিক দান করেন, সকল প্রশংসা একমাত্র তাঁর জন্যই নিবেদিত।
[2] এসব শর্তসমূহ আরো বিস্তারিত দেখুন (মা‘আরিজিল কবুল) গ্রন্থে: (১/৩৭৭)
[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩৬
[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭
[5] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩১
[6] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৯৯
[7] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৩২
[8] আহমদ ফিল মুসনাদ: (৪/২৮৬); সিলসিলাহ সহীহাহ: (১৭২৮)
সন্দেহ নেই, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে পরিপূর্ণ যিকির, যা আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য মুখে উচ্চারণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং তার প্রকৃত অর্থ ও মৌলিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করা জরুরি, যেমন শির্ক প্রত্যাখ্যান করা, সকল ইবাদতের মালিকানা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা, কালেমার সংশ্লিষ্ট বিষয়কে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা। এভাবে বান্দা প্রকৃত মুসলিম ও লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর পরিবারভুক্ত হয়।
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ, আল্লাহ ব্যতীত কোনো বস্তু ও সত্তা ইলাহ হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। তিনি ব্যতীত সকল বস্তুর উপাসনা পথভ্রষ্টতা, বড় যুলুম ও চূড়ান্ত পর্যায়ের গোমরাহী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنۡ أَضَلُّ مِمَّن يَدۡعُواْ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَن لَّا يَسۡتَجِيبُ لَهُۥٓ إِلَىٰ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ وَهُمۡ عَن دُعَآئِهِمۡ غَٰفِلُونَ ٥ وَإِذَا حُشِرَ ٱلنَّاسُ كَانُواْ لَهُمۡ أَعۡدَآءٗ وَكَانُواْ بِعِبَادَتِهِمۡ كَٰفِرِينَ ٦﴾ [الاحقاف: ٥، ٦]
“তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে, যে আল্লাহর পরিবর্তে এমন কাউকে ডাকে, যে কিয়ামত দিবস পর্যন্তও তার ডাকে সাড়া দেবে না? আর তারা তাদের আহ্বান সম্পর্কে উদাসীন। আর যখন মানুষকে একত্র করা হবে, তখন এ উপাস্যগুলো তাদের শত্রু হবে এবং তারা তাদের ইবাদাত অস্বীকার করবে”। [সূরা আল-আহকাফ, আয়াত: ৫-৬]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿ ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ هُوَ ٱلۡبَٰطِلُ وَأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡكَبِيرُ ٦٢ ﴾ [الحج : ٦٢]
“আর এটা এ জন্য যে, নিশ্চয় আল্লাহই সত্য এবং তার পরিবর্তে যাকে তারা ডাকে, অবশ্যই তা বাতিল। আর নিশ্চয় আল্লাহ তো সমুচ্চ, সুমহান”। [সূরা আল-হাজ, আয়াত: ৬২]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿ إِنَّ ٱلشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيمٞ ١٣ ﴾ [لقمان: ١٣]
“নিশ্চয় শির্ক হলো বড় যুলুম”। [সূরা লুকমান, আয়াত: ১৩]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَٱلۡكَٰفِرُونَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ٢٥٤ ﴾ [البقرة: ٢٥٤]
“আর কাফিররাই যালিম”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৫৪]
যুলুম অর্থ কোনো বস্তুকে তার উপযুক্ত জায়গায় না রাখা। ইবাদাতের উপযুক্ত হকদার আল্লাহ তা‘আলা, তাই তাকে ত্যাগ করে গায়রুল্লাহকে ইবাদাত সোপর্দ করা সবচেয়ে বড় যুলুম বা কুফুরী। কারণ, গায়রুল্লাহকে ইবাদাত সোপর্দ করলে ইবাদাত সঠিক স্থান থেকে বিচ্যুত হয়, যার থেকে বড় যুলুম আর নেই।
এতে সন্দেহ নেই যে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ বুঝা ও আয়ত্ত করা জরুরি। কারণ, সকল আলেম একমত যে, কালেমার অর্থ বুঝা ও তার দাবির ওপর আমল করা ছাড়া শুধু তার উচ্চারণ কারো জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا يَمۡلِكُ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِهِ ٱلشَّفَٰعَةَ إِلَّا مَن شَهِدَ بِٱلۡحَقِّ وَهُمۡ يَعۡلَمُونَ ٨٦﴾ [الزخرف: ٨٦]
“আর তিনি ছাড়া যাদেরকে তারা আহ্বান করে তারা সুপারিশের মালিক হবে না, তবে তারা ছাড়া যারা জেনে-শুনে সত্য সাক্ষ্য দেয়”। [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ৮৬]
মুফাসসিরদের মতে আয়াতের অর্থ: যে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ জেনে-বুঝে অন্তর থেকে তার সাক্ষ্য দিবে ও মুখে উচ্চারণ করবে এখানে তার কথাই বলা হয়েছে। কারণ সাক্ষ্য প্রদান করার অর্থ হচ্ছে, সাক্ষীদাতা তার সাক্ষ্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞাত, যদি মূর্খতা থেকে সাক্ষ্য দেয়, তাহলে এটা সাক্ষ্যই নয়। অনুরূপ সাক্ষ্য ঘটনার সত্যতা ও আমল দাবি করে। এ থেকে স্পষ্ট হয় যে, কালেমার জ্ঞানার্জনের সাথে বাহ্যিক আমল ও অন্তরের সত্যতা জরুরি, তবেই কালেমা উচ্চারণকারী বান্দা খৃস্টানদের নীতি থেকে পরিত্রাণ পাবে, যারা ইলম ব্যতীত আমল করে। অনুরূপ মুক্ত হবে ইয়াহূদীদের তরিকা থেকে, যারা জানা সত্ত্বেও তার ওপর আমল করে না। আর কালেমার প্রতি অন্তরের সত্যতা প্রকাশ করে মুনাফিকদের তরিকা থেকে মুক্ত হবে, যারা অন্তর দিয়ে কালেমা বিশ্বাস করে না। তবেই বান্দা সিরাতে মুস্তাকীমের পরিবারভুক্ত হবে, যাদের ওপর আল্লাহ নি‘আমত দান করেছেন এবং যারা অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট নয়।
মোদ্দাকথা: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ তাকেই উপকৃত করবে, যে জানে কালেমা কি প্রমাণ করে আর কি প্রত্যাখ্যান করে এবং তা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে ও তার ওপর আমল করে; পক্ষান্তরে অন্তরের বিশ্বাস ব্যতীত যে কালেমা বলে ও তার ওপর আমল করে সে মুনাফিক। আর যে কালেমা উচ্চারণ করে তার পরিপন্থী বস্তু শির্কে লিপ্ত হয় সে কাফির। অনুরূপ কেউ যদি কালেমা উচ্চারণ করে মুরতাদ হয়, বা তার অবশ্য জরুরি কোনো বিষয় বা দাবি অস্বীকার করে, তাকেও কালেমা উপকৃত করবে না, যদিও সে কালেমা হাজার বার উচ্চারণ করে। অনুরূপ কেউ যদি কালেমার সাক্ষ্য প্রদান করে কোনো প্রকার ইবাদাত গায়রুল্লাকে প্রদান করে। যেমন, দো‘আ, জবেহ, মান্নত, ফরিয়াদ, তাওয়াক্কুল, প্রত্যাবর্তন, আশা, ভয়, মহব্বত এবং এ জাতীয় অন্যান্য ইবাদাত, যা আল্লাহ ব্যতীত কারো জন্য প্রযোজ্য নয়, তার কোনোটি যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য প্রদান করে, তবে সে আল্লাহর সাথে শির্ককারী মুশরিক, যদিও সে মুখে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করে। কারণ, সে কালেমার দাবি তাওহীদ ও ইখলাসের ওপর আমল করে নি, যা কালেমার মূল ও মৌলিক শিক্ষা।[1]
লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ: এক ইলাহ ব্যতীত সত্যিকার কোনো মা‘বুদ নেই, তিনি এক তার কোনো শরীক নেই। অভিধানগত ইলাহ অর্থ: মা‘বুদ। আর লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থ আল্লাহ ব্যতীত সত্য কোনো মা‘বুদ নেই। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ ٢٥﴾ [الانبياء: ٢٥]
“আর তোমার পূর্বে এমন যে রাসূলই আমরা পাঠিয়েছি, যার প্রতি আমরা এই ওহী নাযিল করেছি যে, ‘আমি ছাড়া কোনো (সত্য) ইলাহ নেই। সুতরাং তোমরা কেবল আমারই ইবাদাত কর”। [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ২৫]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ ٣٦﴾ [النحل: ٣٦]
“আর আমরা অবশ্যই প্রত্যেক জাতিতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং পরিহার কর তাগুতকে”। [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৩৬]
এ থেকে স্পষ্ট হল, ইলাহ অর্থ মা‘বুদ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থ, একনিষ্ঠভাবে সকল ইবাদাত আল্লাহকে সোপর্দ করা এবং তাগুতের ইবাদাত প্রত্যাখ্যান করা। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কার কাফেরদের বলেছেন, তোমরা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বল, তখন তারা বলেছিল:
﴿أَجَعَلَ ٱلۡأٓلِهَةَ إِلَٰهٗا وَٰحِدًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيۡءٌ عُجَابٞ ٥﴾ [ص : ٥]
“সে কি সকল উপাস্যকে এক উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে? নিশ্চয় এ তো এক আশ্চর্য বিষয়”। [সূরা সাদ, আয়াত: ৫]
অনুরূপ হূদ আলাইহিস সালামের কাওম তাদের নবীকে বলেছিল, যখন তিনি বলেছেন: তোমরা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বল:
﴿قَالُوٓاْ أَجِئۡتَنَا لِنَعۡبُدَ ٱللَّهَ وَحۡدَهُۥ وَنَذَرَ مَا كَانَ يَعۡبُدُ ءَابَآؤُنَا ٧٠﴾ [الاعراف: ٦٩]
“তারা বলল, ‘তুমি কি আমাদের নিকট এ জন্য এসেছ যে, আমরা এক আল্লাহর ইবাদাত করি এবং ত্যাগ করি আমাদের পিতৃপুরুষগণ যার ইবাদাত করত”? [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৭০]
নবীগণ যখন কওমকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর দাওয়াত দিয়েছেন, তখন কওম এসব উত্তর দিয়েছে। কারণ, তারা জানত কালেমার অর্থ, আল্লাহ ব্যতীত সকল সত্তার উপাসনা ত্যাগ করা, যিনি ইবাদাতের হকদার তার জন্যই সকল ইবাদাত সাব্যস্ত করা। অতএব, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ দু’টি অর্থকে অন্তর্ভুক্ত করে: অস্বীকার করা ও সাব্যস্ত করা, অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত সকল ইলাহের ইবাদত অস্বীকার করা। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া যেসব মালায়েকা ও নবীগণ রয়েছেন (অন্যদের কথা তো বাদ) তারা কেউ ইলাহ নয়, কোনো ইবাদাতে তাদের অধিকার নেই। আর আল্লাহর জন্য সকল ইবাদত সাব্যস্ত করা, অর্থাৎ বান্দা আল্লাহ ব্যতীত কারো সাথে যুক্ত হবে না, তিনি ব্যতীত কোনো বস্তুর প্রতি একনিষ্ঠভাবে মনোযোগী হবে না। এটাই অন্তরের মনোযোগ, কোনো বস্তু বা সত্তার প্রতি এ জাতীয় মনোযোগ থেকে বান্দা ইবাদত উৎসর্গে প্রলুব্ধ হয়, যেমন দো‘আ, জবেহ ও মান্নত ইত্যাদি।
কুরআনুল কারীমের বহু জায়গায় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ, দাবি ও উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِلَٰهُكُمۡ إِلَٰهٞ وَٰحِدٞۖ لَّآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلرَّحۡمَٰنُ ٱلرَّحِيمُ ١٦٣﴾ [البقرة: ١٦٣]
“আর তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ। তিনি ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনি অতি দয়াময়, পরম দয়ালু”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৩]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ ٥﴾ [البينة: ٥]
“আর তাদেরকে কেবল এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, তারা যেন আল্লাহর ইবাদাত করে তারই জন্য দীনকে একনিষ্ঠ করে”। [সূরা আল-বাইয়্যিনাহ, আয়াত: ৫]
অপর আয়াতে বলেন,
﴿وَإِذۡ قَالَ إِبۡرَٰهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوۡمِهِۦٓ إِنَّنِي بَرَآءٞ مِّمَّا تَعۡبُدُونَ ٢٦ إِلَّا ٱلَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُۥ سَيَهۡدِينِ ٢٧ وَجَعَلَهَا كَلِمَةَۢ بَاقِيَةٗ فِي عَقِبِهِۦ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ ٢٨﴾ [الزخرف: ٢٦، ٢٨]
“আর স্মরণ কর, যখন ইবরাহীম স্বীয় পিতা ও তার কাওমকে বলেছিল, ‘তোমরা যেগুলোর ইবাদাত কর, নিশ্চয় আমি তাদের থেকে সম্পর্কমুক্ত। তবে (তিনি ছাড়া) যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর নিশ্চয় তিনি আমাকে শীঘ্রই হিদায়াত দিবেন। আর এটিকে সে তার উত্তরসূরিদের মধ্যে এক চিরন্তন বাণী বানিয়ে রেখে গেল, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করতে পারে”। [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ২৮]
সূরা ইয়াসীনে এক মুমিন ব্যক্তির কথা উদ্ধৃত করে আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَا لِيَ لَآ أَعۡبُدُ ٱلَّذِي فَطَرَنِي وَإِلَيۡهِ تُرۡجَعُونَ ٢٢ ءَأَتَّخِذُ مِن دُونِهِۦٓ ءَالِهَةً إِن يُرِدۡنِ ٱلرَّحۡمَٰنُ بِضُرّٖ لَّا تُغۡنِ عَنِّي شَفَٰعَتُهُمۡ شَيۡٔٗا وَلَا يُنقِذُونِ ٢٣ إِنِّيٓ إِذٗا لَّفِي ضَلَٰلٖ مُّبِينٍ ٢٤﴾ [يس: ٢٢، ٢٤]
“আর আমি কেন তার ইবাদাত করব না যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন? আর তার কাছেই তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। আমি কি তার পরিবর্তে অন্য ইলাহ গ্রহণ করব? যদি পরম করুণাময় আমার কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছা করেন, তাহলে তাদের সুপারিশ আমার কোনো কাজে আসবে না এবং তারা আমাকে উদ্ধারও করতে পারবে না। এরূপ করলে নিশ্চয় আমি স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পতিত হব”। [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ২২-২৪]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿قُلۡ إِنِّيٓ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ ٱلدِّينَ ١١ وَأُمِرۡتُ لِأَنۡ أَكُونَ أَوَّلَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ١٢ قُلۡ إِنِّيٓ أَخَافُ إِنۡ عَصَيۡتُ رَبِّي عَذَابَ يَوۡمٍ عَظِيمٖ ١٣ قُلِ ٱللَّهَ أَعۡبُدُ مُخۡلِصٗا لَّهُۥ دِينِي ١٤﴾ [الزمر: ١١، ١٤]
“বল, নিশ্চয় আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আমি যেন আল্লাহর ইবাদাত করি তারই জন্য আনুগত্যকে একনিষ্ঠ করে। আমাকে আরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন আমি প্রথম মুসলিম হই। বল, আমি যদি আমার রবের অবাধ্য হই তবে আমি এক মহা-দিবসের আজাবের আশঙ্কা করি। বল, আমি আল্লাহরই ইবাদত করি, তারই জন্য আমার আনুগত্য একনিষ্ঠ করে”। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ১১-১৪]
ফির‘আউনের পরিবারের মুমিন ব্যক্তির কথা উদ্ধৃত করে আল্লাহ বলেন,
﴿وَيَٰقَوۡمِ مَا لِيٓ أَدۡعُوكُمۡ إِلَى ٱلنَّجَوٰةِ وَتَدۡعُونَنِيٓ إِلَى ٱلنَّارِ ٤١ تَدۡعُونَنِي لِأَكۡفُرَ بِٱللَّهِ وَأُشۡرِكَ بِهِۦ مَا لَيۡسَ لِي بِهِۦ عِلۡمٞ وَأَنَا۠ أَدۡعُوكُمۡ إِلَى ٱلۡعَزِيزِ ٱلۡغَفَّٰرِ ٤٢ لَا جَرَمَ أَنَّمَا تَدۡعُونَنِيٓ إِلَيۡهِ لَيۡسَ لَهُۥ دَعۡوَةٞ فِي ٱلدُّنۡيَا وَلَا فِي ٱلۡأٓخِرَةِ وَأَنَّ مَرَدَّنَآ إِلَى ٱللَّهِ وَأَنَّ ٱلۡمُسۡرِفِينَ هُمۡ أَصۡحَٰبُ ٱلنَّارِ ٤٣﴾ [غافر: ٤١، ٤٣]
“আর হে আমার কাওম, আমার কী হলো যে, আমি তোমাদেরকে মুক্তির দিকে ডাকছি আর তোমরা আমাকে ডাকছ আগুনের দিকে! তোমরা আমাকে ডাকছ আমি যেন আল্লাহর সাথে কুফুরী করি, তার সাথে শরীক করি যে ব্যাপারে আমার কোনো জ্ঞান নেই, আর আমি তোমাদেরকে ডাকছি মহা-পরাক্রমশালী পরম ক্ষমাশীলের দিকে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, যার দিকে তোমরা আমাকে ডাকছ, সে দুনিয়া বা আখিরাতে কারো ডাকের যোগ্য নয়। আর আমাদের প্রত্যাবর্তন হবে আল্লাহর দিকে এবং নিশ্চয় সীমালংঘনকারীরা হবে আগুনের সাথী”। [সূরা গাফির, আয়াত: ৪১-৪৩]
এরূপ অর্থ প্রদানকারী আয়াত অনেক রয়েছে, যা থেকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ স্পষ্ট হয়, অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত সকল সুপারিশকারী ও অংশীদারদের ইবাদত ত্যাগ করা, একমাত্র আল্লাহকে সকল ইবাদত সোপর্দ করা। এটাই হচ্ছে হিদায়াত ও সত্য দীন, যা দিয়ে আল্লাহ রাসূলদের প্রেরণ ও কিতাব নাযিল করেছেন। আর যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ না জেনে ও তার দাবি মোতাবেক আমল না করে মুখে কালেমা উচ্চারণ করে, বরং কতক সময় গায়রুল্লাহকে কতিপয় ইবাদত সোপর্দ করে। যেমন, দো‘আ, ভয়, জবেহ, মান্নত ও অন্যান্য ইবাদাত, কালেমার এ জাতীয় উচ্চারণ তাদেরকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর পরিবারভুক্ত করবে না এবং কিয়ামতের দিন তারা আল্লাহর শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে না।[2]
অতএব, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ অর্থহীন কোনো নাম নয় কিংবা বাস্তবতাহীন কোনো কথা নয় অথবা এমন বাক্য নয়, যার সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়বস্তু নেই, যেমন কতক লোকের ধারণা। তাদের ধারণা, কালেমার মূল উদ্দেশ্য মুখে উচ্চারণ করা, অন্তরে তার বিশ্বাস থাকা জরুরি নয় অথবা শুধু উচ্চারণ করাই যথেষ্ট, তার নীতি ও অর্থ বাস্তবায়ন করা জরুরি নয়। তাদের ধারণা সঠিক নয়, এটা কখনো কালেমার প্রকৃতি নয়, বরং এ কালেমা মহান অর্থের ধারক, বিরাট অর্থপূর্ণ বাক্য, যা সকল বাক্যের অর্থ থেকে বড়।
পূর্বের আলোচনার সারাংশ: আল্লাহ ব্যতীত সকল কিছুর ইবাদাত থেকে মুক্ত হওয়া এবং আনুগত্য, বিনয়, আশা, প্রত্যাশা, মনোযোগ, তাওয়াক্কুল, দো‘আ ও প্রার্থনাসহ আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা, সুতরাং লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ধারক আল্লাহ ব্যতীত কারো নিকট প্রার্থনা করে না, ফরিয়াদ করে না, তিনি ব্যতীত কারো ওপর তাওয়াক্কুল করে না, কারো কাছে আশা করে না, কারো জন্য জবেহ করে না এবং তিনি ব্যতীত কাউকে কোনো প্রকার ইবাদত উৎসর্গ করে না, বরং আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদাত করা হয়, তাদের সবাইকে অস্বীকার করে এবং একমাত্র আল্লাহর দিকে প্রত্যর্পণ করে।লক্ষ্য করুন! লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ কী মহান, কী স্পষ্ট, কী দ্ব্যর্থহীন, তবে আল্লাহ তাআলার তাওফীক ব্যতীত তা অর্জন করা সম্ভব নয়। একমাত্র তিনিই তাওফীক দাতা।
>[2] দেখুন: ‘তাইসীরুল আযীযিল হামীদ’: (পৃ. ১৪০)
আমরা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর অর্থ জানলাম, যা বান্দার ভেতর অবশ্যই থাকা জরুরি, তবেই আল্লাহর নিকট এ কালেমা গ্রহণযোগ্য হবে। কালেমার এসব অর্থ ও শর্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ, যা লালন করা প্রত্যেক মুসলিমের অতীব জরুরি। কালেমা প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয় গুরুত্বের সাথে জানা জরুরি, যা কালেমা পরিপন্থী বা ইসলাম ভঙ্গকারী বিষয় হিসেবে পরিচিত, তাহলে কালেমার অর্থ ও দাবি সম্পর্কে সতর্ক ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কিতাবে মুমিনদের পথ, যারা কালেমার অর্থ ও দাবিকে বাস্তবায়ন করেছে, স্পষ্ট করেছেন। আবার তাদের পথও স্পষ্ট করেছেন, যারা তার বিরোধিতা করেছে। অতঃপর জানিয়ে দিয়েছেন তাদের পরিণতি ও এদের পরিণতি, তাদের আমল ও এদের আমল। আরও বর্ণনা করেছেন সেসব উপকরণ, যে কারণে তারা সৌভাগ্যবান হয়েছে, আর এরা হয়েছে হতভাগা। আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কিতাবে দু’টি পথই স্পষ্ট করেছেন, যেমন তিনি বলেছেন,
﴿وَكَذَٰلِكَ نُفَصِّلُ ٱلۡأٓيَٰتِ وَلِتَسۡتَبِينَ سَبِيلُ ٱلۡمُجۡرِمِينَ ٥٥﴾ [الانعام: ٥٥]
“আর এভাবেই আমরা আয়াতসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করি। আর যাতে অপরাধীদের পথ স্পষ্ট হয়ে যায়”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৫৫]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥﴾ [النساء : ١١٥]
“আর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে, তার জন্য হিদায়াত প্রকাশ পাওয়ার পর এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমরা তাকে ফিরাব যে দিকে সে ফিরে এবং তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর আবাস হিসেবে তা খুবই মন্দ”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১৫]
পাপীদের পথ যে জানে না, যার নিকট তাদের পথ স্পষ্ট নয়, খুব সম্ভব সে তাদের গোমরাহিতে পতিত হবে। এ জন্য আমিরুল মুমিনীন উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
«إنما تنقض عرى الإسلام عروة عروة، إذا نشأ في الإسلام من لم يعرف الجاهلية»
“ইসলামের এক একটি রশি তখন ভাঙ্গা হবে, যখন ইসলামের ভেতর তাদের জন্ম হবে, যারা জাহেলিয়াত কী জিনিস তা জানবে না”।
কুরআন ও সুন্নাহয় অনেক আয়াত ও হাদীস রয়েছে, যা কঠিনভাবে সতর্ক করেছে মুরতাদ তথা ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কর্মকাণ্ড, সকল প্রকার শির্ক ও তাওহীদের কালেমা ভঙ্গকারী উপকরণ থেকে। আহলে ইলমগণ ফিকহের কিতাবে মুরতাদ অধ্যায় বলেছেন: মুসলিম যদি ঈমান ভঙ্গকারী একটি বা সবকটি বস্তুতে লিপ্ত হয়, তবে সে দীন থেকে বের হয়ে যাবে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর উচ্চারণ তাকে কোনো উপকার করবে না। কারণ, এ কালেমা, যা সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির, ব্যক্তিকে তখন উপকার করবে, যখন সে তার শর্তসমূহ বাস্তবায়ন ও তার ভঙ্গকারী বিষয় থেকে বেঁচে থাকবে।
এতে সন্দেহ নেই যে, কালেমা ভঙ্গকারী বিষয় জানার কল্যাণ অনেক, যদি তার জানার উদ্দেশ্য হয় এসব অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকা ও তার মুসীবত থেকে সুরক্ষা লাভ করা। বস্তুতঃ শির্ক, কুফর, বাতিল ও তার তরিকাসমূহ যে জানে, তার পক্ষে সেসব থেকে সতর্ক থাকা ও অপরকে সতর্ক করা সহজ হয়, কোনোভাবেই স্বীয় ঈমান ক্ষতিগ্রস্ত করার সুযোগ সে শয়তানকে দেয় না, বরং সত্যের প্রতি ঈমান ও মহব্বত বর্ধিত হয়, ভঙ্গকারী বস্তুর প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা তীব্র হয়। এ ছাড়া আরও অনেক উপকার হাসিল হয়, যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না।
আল্লাহ চান সত্য পথ স্পষ্ট হোক, যেন সেটি পছন্দকারীরা পছন্দ করে ও তার অনুসারী হয়। আবার মিথ্যা পথও স্পষ্ট হোক, যেন সেটাকে ঘৃণাকারীরা তা ঘৃণা করে ও তার থেকে বিরত থাকে। কল্যাণের পথ জানা ও তা বাস্তবায়ন করা যেরূপ জরুরি, তেমন জরুরি খারাপের পথ জানা ও তা থেকে বিরত থাকা। ইমাম বুখারী ও মুসলিম রহ. বর্ণনা করেন, হুযাইফাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত, কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করতাম অকল্যাণ সম্পর্কে, যাতে তা আমাকে পেয়ে না বসে সে ভয়ে”।[1] এ জন্য বলা হয়:
ومن لايعرف الشر من الناس يقع فيه عرفت الشر لا للشر لكن لتوقِّيه
“আমি খারাপকে চিনেছি খারাপের জন্য নয়, বরং তার থেক বেঁচে থাকার জন্য, আর যেসব মানুষ খারাপ জানে না, তারা তাতে পতিত হয়”।
কালেমার পরিপন্থী বিষয় জানার অবস্থা যখন এরূপ এবং তার গুরুত্ব যখন এতো বেশি, তখন প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ওয়াজিব এ কালেমা বিনষ্টকারী বস্তুগুলো আত্মস্থ করা, যেন তার থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়।
কয়েকটি কারণে কালেমা ভঙ্গ হয়, যার বর্ণনা পূর্বে অতিবাহিত হয়েছে, তবে এসব ভঙ্গকারী থেকে আরো ভয়ঙ্কর ও বেশি ঘটমান কারণ দশটি, যা আহলে ইলমগণ বর্ণনা করেছেন।[2] নিম্নে সংক্ষেপে তা উল্লেখ করছি, যেন তার থেকে নিরাপদ থাকা ও অন্যকে নিরাপদ রাখা সম্ভব হয়।
প্রথম কারণ: ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা ঈমান ভঙ্গের কারণ। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ ١١٦﴾ [النساء : ١١٦]
“নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করেন না তার সাথে শরীক করাকে এবং এ ছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১১৬]
অপর আয়াতে তিনি বলেন,
﴿إِنَّهُۥ مَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدۡ حَرَّمَ ٱللَّهُ عَلَيۡهِ ٱلۡجَنَّةَ وَمَأۡوَىٰهُ ٱلنَّارُۖ وَمَا لِلظَّٰلِمِينَ مِنۡ أَنصَارٖ ٧٢﴾ [المائدة: ٧٢]
“নিশ্চয় যে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার ওপর অবশ্যই আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিয়েছেন এবং তার ঠিকানা আগুন। আর যালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই”। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৭২]
কয়েকটি শির্কী ইবাদাত, যেমন মৃতদের নিকট দো‘আ করা, তাদের নিকট ফরিয়াদ করা, কিছু তলব করা এবং তাদের জন্য মান্নত ও জবেহ করা ইত্যাদি।
দ্বিতীয় কারণ: আল্লাহ ও বান্দার মাঝে মধ্যস্থতাকারী নির্ধারণ করা, তাদেরকে আহ্বান করা, তাদের নিকট সুপারিশ তলব করা ও তাদের ওপর তাওয়াক্কুল করা ঈমান ভঙ্গের কারণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡ وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ قُلۡ أَتُنَبُِّٔونَ ٱللَّهَ بِمَا لَا يَعۡلَمُ فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَلَا فِي ٱلۡأَرۡضِۚ سُبۡحَٰنَهُۥ وَتَعَٰلَىٰ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ١٨﴾ [يونس : ١٨]
“আর তারা আল্লাহ ছাড়া এমন কিছুর ইবাদাত করছে, যা তাদের ক্ষতি করতে পারে না এবং উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে, ‘এরা আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী’। আপনি বলুন, ‘তোমরা কি আল্লাহকে আসমানসমূহ ও জমিনে থাকা এমন বিষয়ে সংবাদ দিচ্ছ, যা তিনি অবগত নন’? তিনি পবিত্র এবং তারা যা শরীক করে, তা থেকে তিনি অনেক ঊর্ধ্বে”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ১৮]
তৃতীয় কারণ: মুশরিকদের কাফির না বলা ও তাদের কুফুরী সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করা ঈমান ভঙ্গের কারণ।
চতুর্থ কারণ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অপেক্ষা অন্য কারো আদর্শকে পরিপূর্ণ বলে বিশ্বাস করা অথবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ফয়সালা থেকে অন্য কারো ফয়সালা উত্তম জানা ঈমান ভঙ্গের কারণ, যারা তাগুতের ফয়সালাকে প্রাধান্য দেয় তারা এ শ্রেণিভুক্ত।
পঞ্চম কারণ: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনিত দীনের কোনো বিধানকে অপছন্দ করা ঈমান ভঙ্গের কারণ, যদিও সে তার ওপর আমল করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَرِهُواْ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأَحۡبَطَ أَعۡمَٰلَهُمۡ ٩﴾ [محمد : ٩]
“তা এ জন্য যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তারা তা অপছন্দ করে, অতএব তিনি তাদের আমলসমূহ বিনষ্ট করে দিয়েছেন”। [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ৯]
ষষ্ঠ কারণ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আনিত দীনের কোনো বিধান অথবা তাতে প্রমাণিত সাওয়াব বা শাস্তি নিয়ে ব্যঙ্গ করা ঈমান ভঙ্গের কারণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُمۡ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلۡعَبُۚ قُلۡ أَبِٱللَّهِ وَءَايَٰتِهِۦ وَرَسُولِهِۦ كُنتُمۡ تَسۡتَهۡزِءُونَ ٦٥ لَا تَعۡتَذِرُواْ قَدۡ كَفَرۡتُم بَعۡدَ إِيمَٰنِكُمۡۚ ٦٦﴾ [التوبة : 66]
“আর যদি তুমি তাদেরকে প্রশ্ন কর, অবশ্যই তারা বলবে, ‘আমরা আলাপচারিতা ও খেল-তামাশা করছিলাম। আপনি বলুন, ‘আল্লাহ, তার আয়াতসমূহ ও তার রাসূলের সাথে কি তোমরা বিদ্রূপ করছিলে? তোমরা ওজর পেশ করো না, তোমরা তোমাদের ঈমানের পর অবশ্যই কুফুরী করেছ”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ৬৫-৬৬]
সপ্তম কারণ: জাদু ও জাদুর অন্তর্ভুক্ত সারফ (আাকর্ষণ কিংবা বিকর্ষণ) ও ‘আতফ ঈমান ভঙ্গের কারণ। যে জাদু করে বা জাদুর প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে সে কাফির। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنۡ أَحَدٍ حَتَّىٰ يَقُولَآ إِنَّمَا نَحۡنُ فِتۡنَةٞ فَلَا تَكۡفُرۡۖ ١٠٢﴾ [البقرة: ١٠٢]
“আর তারা কাউকে শেখাত না যে পর্যন্ত না বলত যে, ‘আমরা তো পরীক্ষা। সুতরাং তোমরা কুফুরী কর না”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১০২]
অষ্টম কারণ: মুশরিকদের পক্ষ গ্রহণ করা ও মুসলিমদের বিপক্ষে তাদেরকে সাহায্য করা ঈমান ভঙ্গের কারণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمۡ فَإِنَّهُۥ مِنۡهُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَهۡدِي ٱلۡقَوۡمَ ٱلظَّٰلِمِينَ ٥١ ﴾ [المائدة: ٥١]
“যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে নিশ্চয় তাদের একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম কাওমকে হিদায়াত দেন না”। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৫১]
নবম কারণ: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দীন পালন না করার অবকাশ কতক মানুষের রয়েছে বিশ্বাস করা ঈমান ভঙ্গের কারণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٨٥﴾ [ال عمران: ٨٥]
“আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন চায় তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৮৫]
দশম কারণ: আল্লাহর দীন থেকে বিমুখ থাকা কুফুরী, ঈমান ভঙ্গের কারণ। যে আল্লাহর দীন শিখে না ও তার ওপর আমল করে না সে কাফির। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَنۡ أَظۡلَمُ مِمَّن ذُكِّرَ بَِٔايَٰتِ رَبِّهِۦ ثُمَّ أَعۡرَضَ عَنۡهَآۚ إِنَّا مِنَ ٱلۡمُجۡرِمِينَ مُنتَقِمُونَ ٢٢﴾ [السجدة : ٢٢]
“আর তার চেয়ে বড় যালিম কে, যাকে স্বীয় রবের আয়াতসমূহের মাধ্যমে উপদেশ দেওয়ার পর তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নিশ্চয় আমরা অপরাধীদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণকারী”। [সূরা আস-সাজদাহ, আয়াত: ২২] এ দশটি বিষয় লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, অর্থাৎ তাওহীদের কালেমা ভঙ্গকারী। যে কেউ এ দশটি থেকে কোনো একটিতে পতিত হল তার ঈমান শেষ। এরূপ ব্যক্তি লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ দ্বারা উপকৃত হবে না। আহলে-ইলমগণ আরও স্পষ্ট বলেছেন, এসব কাজ হাসি ঠাট্টায় করুক, ইচ্ছায় করুক বা ভয়ে করুক কোনো পার্থক্য নেই, তবে যাকে বাধ্য করা হয় সে ব্যতীত। ঈমান ভঙ্গকারী প্রত্যেকটি বস্তু খুব ভয়ানক, আমাদের সমাজে যা সচরাচর সংঘটিত হয়। মুসলিমদের এসব থেকে দূরে থাকা ও কুফরের আশঙ্কায় ভীত থাকা জরুরি। আমরা আল্লাহর নিকট তার গোস্বা ও শাস্তির উপকরণ থেকে পানাহ চাই, তিনি আমাদের সবাইকে তার পছন্দনীয় বস্তুর তাওফিক দিন, আমাদেরকে ও সকল মুসলিমকে তার সঠিক পথের হিদায়াত দান করুন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, কবুলকারী ও অতি নিকটবর্তী।
>[2] দেখুন: দুরারুস সানিয়্যাহ ফিল আজওয়াবাতিন নাজদিয়্যাহ: (২/২৩২)
আমরা পূর্বে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর ফযীলত সম্পর্কে জেনেছি। আরও জেনেছি যিকিরকারীগণ যেসব শব্দ দিয়ে যিকির করে তন্মধ্যে এটাই সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ যিকির। এর শব্দ কম তবে অর্থ বেশি, মানুষ তার মুখাপেক্ষী, বরং খাবার, পানীয়, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু থেকে তার প্রয়োজন অনেক বেশি। পুরো দুনিয়ার জন্যই তার প্রয়োজন, যার কোনো শেষ নেই, তাই কালেমার যিকির সবচেয়ে বেশি হয়। তার যিকির সবচেয়ে সহজ, অর্থের দিক থেকে মহান, মর্যাদার বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ! এদত সত্ত্বেও কতক জাহিল কালেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বিদআতি যিকিরে প্রত্যাবর্তন করে, মানুষের তৈরি করা যিকিরে মগ্ন হয়, যার প্রমাণ কুরআন ও সুন্নাহয় নেই, পূর্বসূরি কোনো মনীষী থেকেও নেই”।[1]
একটি উদাহরণ: সূফীদের কতক তরিকায় যিকিরের সময় শুধু একটি নাম বা বিশেষ্য উচ্চারণ করা হয়। যেমন, (الله الله), আল্লাহ আল্লাহ বারবার বলা। আবার তাদের কেউ আল্লাহ নাম বা বিশেষ্যের পরিবর্তে সর্বনাম দিয়ে যিকির করে। যেমন, (هو) বারবার বলে। তাদের কেউ আরও সীমালঙ্ঘন করে বলে: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ সাধারণ লোকের যিকির, আর এক শব্দ অর্থাৎ শুধু আল্লাহ বিশেষ ব্যক্তির যিকির, আর বিশেষ থেকে বিশেষ ব্যক্তির যিকির (هو) সর্বনাম। আবার তাদের কেউ এরূপও বলে: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুমিনের যিকির, আর (الله) নাম ‘আরিফ অর্থাৎ আল্লাহর পরিচয় অর্জনকারীর যিকির, আর (هو) তাদের থেকেও উন্নতি সাধনকারী মুহাক্কিকের যিকির। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বোত্তম যে যিকিরের কথা বলেছেন, সেই তাওহীদের কালেমার ওপর তারা এক শব্দের যিকির অথবা সর্বনামের যিকিরকে প্রাধান্য দেয়, অথচ শুধু আমাদের নবী নয়, পূর্ববর্তী নবীগণও যে যিকির করেছেন তার ভেতর কালেমার যিকির সর্বোত্তম যিকির। এ সম্পর্কে কতক হাদীস আমরা পূর্বে জেনেছি। অধিকন্তু এক শব্দ বিশেষ্য হোক বা সর্বনাম কুরআন ও সুন্নাহয় তার যিকির উল্লেখ নেই, আর না পূর্বসূরি কোনো আলেম থেকে বর্ণিত আছে, তবে পরবর্তী কতক গোমরাহ লোক তার প্রচলন করেছে দলীল প্রমাণ ছাড়াই।
শাখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়াহ রহ. বিদ‘আতী যিকিরকারীদের দলীল চরমভাবে খণ্ডন করেছেন। যিকিরের এ বিদ ‘আতকে প্রচার ও প্রমাণ করার জন্য তারা যা পেশ করে তার বাতুলতা তিনি প্রমাণ করেছেন। তিনি বলেন, “তরিকতপন্থী কতক লেখক লিখেছেন ‘আল্লাহ’ শব্দের যিকির অতীব মহান। তার দলীল হিসেবে পেশ করেছে কখনো অনুভূতি, কখনো নিজস্ব মত বা কখনো মিথ্যা বর্ণনা। যেমন, তাদের কেউ বলেন, আলী ইবন আবু তালিবকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (‘আল্লাহ, আল্লাহ, আল্লাহ’ বল। তিনি আল্লাহ তিনবার উচ্চারণ করলেন, অতঃপর আলীকে তার নির্দেশ দিলেন, আলীও তা তিনবার বলল)। এটি সকল আলেমের নিকটই বানোয়াট হাদীস, পক্ষান্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে যিকিরের নির্দেশ দিতেন, তার শীর্ষে রয়েছে: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ যিকির। চাচা আবু তালিবের মৃত্যুর সময় তিনি এ কালেমাই পেশ করেছেন, তিনি বলেছেন:
«يَا عَمِّ، قُلْ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ كَلِمَةً أَشْهَدُ لَكَ بِهَا عِنْدَ اللَّهِ»
“হে আমার চাচা, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ একটি বাক্য বলুন, এটা দিয়ে আমি আল্লাহর সামনে আপনার জন্য সুপারিশ করব”।[2]
অপর হাদীসে বলেন,
«إِنِّي لأَعْلَمُ كَلِمَةً لا يَقُولُهَا عَبْدٌ عِنْدَ مَوْتِهِ إِلا وَجَدَ رُوحًهُ لَهَا رَوْحًا»
“আমি একটি বাক্য জানি, মৃত্যুর সময় কোনো বান্দা বলবে না, তবে অবশ্যই তার অন্তর সেটার (প্রশান্তি) সুঘ্রাণ পাবে”।[3]
অপর হাদীসে তিনি বলেন,
«مَنْ كَانَ آخِرُ كَلَامِهِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، دَخَلَ الْجَنَّةَ»
“যার সর্বশেষ বাক্য হবে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে”।[4]
অপর হাদীসে তিনি বলেন,
«أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ، فَإِذَا فَعَلُوا ذَلِكَ، عَصَمُوا مِنِّي دِمَاءَهُمْ، وَأَمْوَالَهُمْ إِلَّا بِحَقِّهَا، وَحِسَابُهُمْ عَلَى اللَّهِ»
“আমাকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে যে, আমি মানুষের সাথে যুদ্ধ করব, যতক্ষণ না তারা বলে: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ (আল্লাহ ছাড়া কোনো হক্ব মা‘বুদ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল) যখন এটা তারা বাস্তবায়ন করবে, আমার থেকে তাদের রক্ত ও সম্পদ নিরাপদ করে নিবে, তবে কালেমার হক ব্যতীত এবং তাদের হিসেব আল্লাহর ওপর”।[5]
এ বিষয়ে একাধিক হাদীস রয়েছে”।
ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. আরও বলেন, “এক শব্দের যিকির কোনো অবস্থাতেই বৈধ নয়, শরী‘আতে এমন কোনো দলীল নেই যার দ্বারা এক শব্দের যিকির মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়। কতক মূর্খ আবেদের ধারণা, আল্লাহ তা‘আলার বাণী: قُلِ ٱللَّهُۖ ثُمَّ ذَرۡهُمۡ “বল, আল্লাহ, অতঃপর তাদেরকে ত্যাগ কর”[6] এতে উদ্দেশ্য আল্লাহ নাম বা বিশেষ্য। এটা তাদের স্পষ্ট ভুল, যদি তারা আয়াতের পূর্বের অংশসহ চিন্তা করে অবশ্যই তাদের নিকট ভুলটি স্পষ্ট হবে। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿وَمَا قَدَرُواْ ٱللَّهَ حَقَّ قَدۡرِهِۦٓ إِذۡ قَالُواْ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ عَلَىٰ بَشَرٖ مِّن شَيۡءٖۗ قُلۡ مَنۡ أَنزَلَ ٱلۡكِتَٰبَ ٱلَّذِي جَآءَ بِهِۦ مُوسَىٰ نُورٗا وَهُدٗى لِّلنَّاسِۖ تَجۡعَلُونَهُۥ قَرَاطِيسَ تُبۡدُونَهَا وَتُخۡفُونَ كَثِيرٗاۖ وَعُلِّمۡتُم مَّا لَمۡ تَعۡلَمُوٓاْ أَنتُمۡ وَلَآ ءَابَآؤُكُمۡۖ قُلِ ٱللَّهُۖ ثُمَّ ذَرۡهُمۡ فِي خَوۡضِهِمۡ يَلۡعَبُونَ ٩١﴾ [الانعام: ٩١]
“আর তারা আল্লাহকে যথার্থ সম্মান দেয় নি, যখন তারা বলছে, আল্লাহ কোনো মানুষের ওপর কিছুই নাযিল করেন নি। বল, কে নাযিল করেছে সে কিতাব, যা মুসা নিয়ে এসেছে মানুষের জন্য আলো ও পথ নির্দেশস্বরূপ, তোমরা তা বিভিন্ন কাগজে লিখে রাখতে, তোমরা তা প্রকাশ করতে আর অনেক অংশ গোপন রাখতে, আর তোমাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল যা জানতে না তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষ’? বল, আল্লাহ। তারপর তাদেরকে ছেড়ে দাও, তারা তাদের অযাচিত সমালোচনায় খেলতে থাকুক”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৯১]
অর্থাৎ বল: (“আল্লাহ”, সেই কিতাব নাযিল করেছেন যা মুসা নিয়ে এসেছেন)। এটি উদ্দেশ্য (মুবতাদা) ও বিধেয় (খবর) দু’টি অংশ মিলে বিশেষ্যবাচক পূর্ণবাক্য। এখানে উদ্দেশ্য বা মুবতাদা হচ্ছে ‘আল্লাহ’ শব্দ আর বিধেয় বা খবর হচ্ছে ‘সেই কিতাব নাযিল করেছেন যা মুসা নিয়ে এসেছেন’ উহ্য বাক্য। উহ্য খবরটি পূর্বের প্রশ্ন থেকেই বুঝে আসে। এরূপ উহ্য বাক্য আরবি ও অন্যান্য ভাষায় সচরাচর ব্যবহার হয়, যদি বাক্যের অপর অংশ সেই অংশ বুঝাতে যথেষ্ট হয়”।
ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. এরূপ অনেক উদাহরণ পেশ করেছেন, এক পর্যায়ে তিনি বলেন, “শরী‘আতের দলিল থেকে প্রমাণিত হলো যে, শুধু আল্লাহ আল্লাহ যিকির মুস্তাহাব নয়, অর্থাৎ এক শব্দের যিকির, যা পূর্ণ অর্থ প্রকাশে যথেষ্ট নয়। অনুরূপ বিবেকের নিকটও এ জাতীয় যিকির প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ একটি নাম ঈমান ও কুফর কিছুই প্রমাণ করে না। আর না প্রমাণ করে হিদায়াত ও গোমরাহী, ইলম ও মূর্খতা...”।
ইবন তাইমিয়্যাহ আরও বলেন, “এ জন্য আরবি ও অন্যান্য ভাষার সকল পণ্ডিতগণ একমত যে, এক শব্দ বলে চুপ থাকা সুন্দর নয়, যা পূর্ণ বাক্য ও উপকারী কথা নয়। এ জন্য জনৈক আরব যখন কোনো মুয়াযযিনকে বলতে শুনলেন: أشهد أن محمدا رسولَ اللهِ তিনি বললেন: সে কী করল?
কারণ, মুয়াযযিন যখন رسولَ শব্দে ফাতাহ (জবর) দিল, তখন সেটা পূর্বের বিশেষ্যের বিশেষণ হলো, আর বিশেষণ বিশেষ্যকে পূর্ণ করে, বাক্যের দ্বিতীয় অংশ পূর্ণ করে না, যা ব্যতীত বাক্য পূর্ণ হয় না। এ জন্য তিনি পরবর্তী বাক্য (বিধেয়) অনুসন্ধান করছেন। কারণ, মুয়াযযিন মুবতাদা (উদ্দেশ্য) বলেছে, খবর (বিধেয়) বলেনি, তাই বাক্যটি পূর্ণ হয় নি। অতএব, একজন ব্যক্তি যদি আল্লাহ শব্দ হাজার বারও পড়ে তবুও সে মুমিন হবে না, কোনো সাওয়াবেরও হকদার হবে না, আর না হকদার হবে জান্নাতের। কারণ, প্রত্যেক ধর্মের লোক আল্লাহ শব্দ উচ্চারণ করে, তার তাওহীদ স্বীকার করুক বা না করুক। আল্লাহ আমাদেরকে তার নাম স্মরণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
﴿فَكُلُواْ مِمَّآ أَمۡسَكۡنَ عَلَيۡكُمۡ وَٱذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ عَلَيۡهِۖ ٤﴾ [المائدة: ٤]
“সুতরাং তোমরা তা থেকে খাও, যা তোমাদের জন্য ধরে এনেছে এবং তাতে তোমরা আল্লাহর নাম স্মরণ কর”। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৪]
অপর আয়াতে বলেন,
﴿وَلَا تَأۡكُلُواْ مِمَّا لَمۡ يُذۡكَرِ ٱسۡمُ ٱللَّهِ عَلَيۡهِ ١٢١﴾ [الانعام: ١٢١]
“আর তোমরা তা থেকে আহার করো না, যার ওপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয় নি”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১২১]
অপর আয়াতে বলেন,
﴿سَبِّحِ ٱسۡمَ رَبِّكَ ٱلۡأَعۡلَى ١﴾ [الاعلى: ١]
“তুমি তোমার সুমহান রবের তাসবীহ পাঠ কর”। [সূরা আল-‘আলা, আয়াত: ১]
অপর আয়াতে বলেন,
﴿ فَسَبِّحۡ بِٱسۡمِ رَبِّكَ ٱلۡعَظِيمِ ٧٤ ﴾ [الواقعة: ٧٤]
“অতএব, তোমার মহান রবের নামে তাসবীহ পাঠ কর”। [সূরা আল-ওয়াকি‘য়াহ, আয়াত: ৭৪] ইত্যাদি আয়াতে আল্লাহর নাম পূর্ণ বাক্য দ্বারা স্মরণ করার কথা বলা হয়েছে। যেমন, বলবে بسم الله অথবা বলবে سبحان ربي الأعلى অথবা বলবে سبحان ربي العظيم ইত্যাদি বাক্য। কখনো এক শব্দ উচ্চারণ করার বৈধতা প্রদান করা হয় নি, এভাবে কোনো নির্দেশ পালন করা হয় না। আল্লাহ শব্দ দ্বারা শিকার করলে শিকার হালাল হয় না, আর না হালাল হয় জবেহকৃত প্রাণী, আর না কোনো বস্তু”।
অতঃপর ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. বলেন, “এ থেকে প্রমাণ হলো যে, এক শব্দ উচ্চারণ করা মুস্তাহাব নয়, কীভাবে সেটা বিশেষ ব্যক্তির যিকির হয়? তার থেকেও বহু দূরে সর্বনাম (هو هو) যিকির করার বৈধতা। কারণ, শুধু সর্বনাম নিজস্ব কোনো অর্থই প্রকাশ করে না, বরং সর্বনাম যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয় সেটা তার অর্থই প্রকাশ করে। অতএব, বক্তার ইচ্ছা ও নিয়তের ওপর সর্বনাম নির্ভরশীল”।[7]
ইবন তাইমিয়্যাহ রহ. আরও বলেন, “এক শব্দের যিকির সুন্নাহ মোতাবিক নয়, বরং বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত এবং শয়তানী গোমরাহীর কাছাকাছি...”।
অতঃপর ইবন তাইমিয়্যাহ বলেন, “আল্লাহর যিকিরের ক্ষেত্রে বৈধ হচ্ছে পূর্ণ বাক্য বলা, যার নাম কালাম বা বাক্য, কালামের একবচন কালেমা বা শব্দ। পূর্ণ বাক্য দ্বারা অন্তর উপকৃত হয়, তার দ্বারাই সাওয়াব, বিনিময় ও আল্লাহর নৈকট্য হাসিল হয়, হাসিল হয় তার মহব্বত, ভয় ও পরিচয়সহ ইত্যাদি মহান সাফল্য ও সুউচ্চ মর্যাদা। পক্ষান্তরে (বাক্যের একাংশ) এক শব্দ বলে বাক্য শেষ করার কোনো ভিত্তি নেই, কবে সেটা বিশেষ কিংবা বিশেষ থেকে বিশেষ যিকির হল? বরং তা বিদ‘আত ও গোমরাহী এবং যিন্দিক ও নাস্তিকদের বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। দীনের প্রধান দু’টি মূলনীতি: ১. আল্লাহ ব্যতীত কারো ইবাদাত করব না এবং ২. তিনি যেভাবে ইবাদাত করতে বলেছেন ঠিক সেভাবে তার ইবাদত করব, বিদ‘আতী পন্থায় তাঁর ইবাদাত করব না”।[8] ইবন তাইমিয়্যার কথা শেষ হলো। এখানে রয়েছে গবেষণামূলক স্পষ্ট বর্ণনা, যাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই, হক সর্বদাই এভাবেই স্পষ্ট হয়।
এসব বিদ‘আতীদের নতুন যিকিরে হুমড়ি খাওয়ার ফলে মুসলিমদের মাঝে কতক প্রশ্ন ও ভাবনার জন্ম দিয়েছে: আল্লাহর দীনে যার কোনো ভিত্তি নেই, শরী‘আতের পক্ষ থেকে যার পক্ষে কোনো দলীল নেই, তাতে হুমড়ি খাওয়ার অর্থ কী? বরং তার মোকাবিলায় বিশুদ্ধ সুন্নাহ ও যিকির ত্যাগ করার রহস্য কী? কিসের জন্য তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হিদায়াত থেকে দূরে সরছে এবং তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? আর মনোনিবেশ করছে এমন কতিপয় যিকিরে, যার সম্পর্কে আল্লাহ কোনো দলীল নাযিল করেন নি! অধিকন্তু বিদ‘আতী যিকিরকে মহান জানা, তাকে চূড়ান্ত পর্যায়ের সম্মান দেওয়া, তার বিপরীত সুন্নাহ ও শরঈ‘ যিকিরের সম্মান নষ্ট করার কারণ কী, যে যিকির সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ?! আল্লাহ তার ওপর ও তার বংশের ওপর এবং তার সকল সাথীদের ওপর সালাত ও সালাম প্রেরণ করুন।
>[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৮৮৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৪
[3] আহমদ: (১/২৮); ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৭৯৫)
[4] আহমদ: (৫/২৪৭); আবু দাউদ, হাদীস নং ৩১১৬; ইরওয়াউল গালিল (হাদীস নং ৬৮৭) গ্রন্থে আলবানী হাদীসটিকে হাসান বলেছেন।
[5] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২২
[6] সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৯১
[7] মাজমুউল ফাতাওয়া: (১০/৫৫৬-৫৬৫)
[8] মাজমুউল ফাতাওয়া: (১০/১৩৪-২২৭)