সংক্ষিপ্ত জীবনী
তিনি হলেন আবু জা’ফর আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সালামা আল আজদী আত্-ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ। তিনি ছিলেন হাদীছের হাফেয, ইমাম, ফকীহ, প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ এবং মিশরের হানাফী ফকীহদের মধ্যে সবচেয়ে বড় আলেম। ঐতিহাসিকদের বিশুদ্ধ মতে ২৩৯ হিজরী মোতাবেক ৮৫৩ খৃস্টাব্দে তিনি মিশরের ত্বহা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ব-পুরুষগণ যেহেতু ইয়ামানের প্রখ্যাত আজদ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন, তাই তাকে আজদী বলা হয়। আর তিনি যেহেতু মিশরের ত্বহা নামক গ্রামে জন্ম-গ্রহণ করেন, তাই তার জন্মস্থানের দিকে সম্বন্ধ করে তাকে ত্বহাবী বলা হয়।
জন্ম ও শৈশব
তিনি দ্বীনদার ও আলেম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন, সে হিসাবে শিশুকাল থেকে তিনি দ্বীনি পরিবেশে প্রতিপালিত হন। শৈশবকাল থেকেই তার মধ্যে ইলম অর্জনের প্রতি অসাধারণ অনুরাগ পরিলক্ষিত হয়। প্রথমত তিনি তার পিতা মুহাম্মাদ ইবনে সালামার নিকট থেকে শাফেঈ ফিকহ এর মূলনীতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করেন। সে সময় তার মামা আবু ইবরাহীম আল-মুযানী ইমাম শাফেঈর সবচেয়ে বড় শিষ্য এবং শাফেঈ মাযহাবের সবচেয়ে বিচক্ষণ ফকীহ ছিলেন। তার পরিবারের অন্যরাও শাফেঈ ফিক্হ এর অনুসারী ছিলেন। তাই তিনিও প্রথম জীবনে শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি শাফেঈ মাযহাব পরিত্যাগ করে হানাফী মাযহাবের অনুসারী হয়ে যান।
শিক্ষালাভ
লেখা-পড়ার বয়সে উপনীত হওয়ার সাথে সাথে তিনি জ্ঞানার্জন শুরু করেন। তার শিক্ষা জীবনের সূচনা হয় তার মামা আবু ইবরাহীম ইসমাঈল ইবনে ইয়াহইয়া আল-মুযানী রহিমাহুল্লাহ এর নিকট। তার মামা আবু ইবরাহীম ছিলেন ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহর ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ এবং ইমাম শাফেঈর ইলমের ভান্ডার। তার মামার নিকট থেকে সর্বপ্রথম জ্ঞান চর্চা শুরু করলেও জ্ঞান পিপাসা নিবারণ করার মানসে স্বীয় আবাসস্থল থেকে মিশরে আসেন। এ ছাড়াও তিনি জ্ঞান আহরণের জন্য অনেক জায়গা সফর করেন। যেখানেই কোনো জ্ঞান তাপসের সন্ধান পেতেন, তিনি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেন এবং জ্ঞান পিপাসা নিবৃত করতেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি ২৬৮ হিজরীতে সিরিয়া গমন করেন। তা ছাড়া বাইতুল মুকাদ্দাস, আসকালান ইত্যাদি স্থানে সফর করে বিভিন্ন মনীষী থেকে হাদীছ ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন।
ফিকহ শাস্ত্রে তার জ্ঞানের সীমা প্রশস্ত হওয়ার সাথে সাথে তিনি অনেক ফিকহী মাস‘আলার ক্ষেত্রে দিশেহারা হতে লাগলেন। তার মামার নিকট এসব মাস‘আলার কোনো সমাধান খুঁজে পেতেন না। এসব মাস‘আলার সমাধানের ক্ষেত্রে তিনি তার মামার আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। তিনি দেখলেন, তার মামা শাফেঈ মাযহাবের দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে এসবের কোনো সমাধান না পেয়ে ইমাম আবু হানীফার ছাত্রদের কিতাবসমূহের প্রতি প্রায়ই ইঙ্গিত করেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রেই তিনি ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর মতকে প্রাধান্য দিতে লাগলেন। তার মামা ইসমাঈল আল-মুযানী হানাফী মাযহাবের যেসব মাস‘আলা গ্রহণ করেছেন, তা তিনি مختصر المزني (মুখতাসারুল মুযনী) নামক কিতাবে সংকলন করে করেছেন।
ইমাম ত্বহাবীর মাযহাব পরিবর্তন
প্রথম জীবনে তিনি শাফেঈ মাযহাবের অনুসারী ছিলেন। কিন্তু তার বোধশক্তি বৃদ্ধি যতই বাড়তে থাকে তার সামনে জ্ঞানার্জন ও গবেষণার দ্বার ততই উন্মুক্ত হতে থাকে। এ সময় হানাফী মাযহাবের প্রতি তার মামার আগ্রহ দেখে ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ হানাফী মাযহাবের কিতাবগুলোর প্রতি গভীর দৃষ্টি দিতে লাগলেন এবং দ্বীনের মূলনীতি ও শাখা মাস‘আলাসমূহের ক্ষেত্রে তাদের পদ্ধতিগুলো অধ্যায়ন করতে লাগলেন।
বলা হয়ে থাকে যে, তাকে যখন মাযহাব পরিবর্তন করার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলো, জবাবে তিনি বলেছেন, আমার মামা মুযানী হানাফী মাযহাবের গ্রন্থসমূহ অধিক অধ্যায়ন করতেন। তাই আমিও মামার অনুসরণ করে হানাফী মাযহাবের কিতাবগুলো অধ্যায়ন শুরু করি। আমার কাছে শাফেঈ মাযহাবের তুলনায় হানাফীদের দলীল-প্রমাণগুলো অধিক মজবুত ও অকাট্য মনে হলো। তাই আমি শাফেঈ মাযহাব ছেড়ে হানাফী মাযহাব গ্রহণ করি।
অতএব ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর মাযহাব সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানার্জন করার পর তিনি তার মাযহাব পরিবর্তন করলেন এবং শাফিঈ মাযহাব ছেড়ে হানাফী মাযহাবের অনুসারী হলেন। তবে হানাফী মাযহাব গ্রহণ তাকে কতিপয় মাস‘আলায় ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহর মতের বিরোধিতা করতে এবং অন্যান্য ইমামের মতকে প্রাধান্য দিতে মোটেই বাধা দিতে পারেনি। মূলতঃ তিনি ইমাম আবু হানীফার অন্ধ অনুসরণকারী ছিলেন না। অন্যান্য গবেষক আলিমের মতোই তিনি সুস্পষ্ট দলীলের অনুসরণ এবং ইমামের কথার বিপরীত হলেও তিনি দলীলকেই প্রাধান্য দিতেন। তিনি শুধু মনে করতেন যে, ফিক্বহের ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ এর পদ্ধতিই সর্বোত্তম। তাই তিনি এ ধারাতেই চলতেন এবং তাকে অনুসরণ করতেন। এ জন্যই আপনি দেখবেন যে, তার হাদীছের কিতাব: شرح معاني الأثر ‘শারহু মা‘আনিল আছার’ এর অনেক স্থানেই ইমাম আবু হানীফার মতের বিপরীত মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
ইবনে যাওলাক রহিমাহুল্লাহ এর উক্তিতে আমাদের কথার সমর্থন রয়েছে। তিনি বলেন, আমি শাইখের পুত্র আবুল হাসান আলী ইবনে আবু জা’ফর ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, কাযী আবু উবাইদ হারবুওয়াই এর ফযীলত ও বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আলোচনা করার সময় আমার পিতাকে বলতে শুনেছি, কাযী আবু উবাইদ আমাকে বিভিন্ন মাস‘আলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেন। একদা তিনি আমাকে একটি মাস‘আলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে আমি তার জবাব দিলাম। আবু উবাইদ হারবুওয়াই বললেন, এটি ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ এর মত নয়। আমি তাকে বললাম, হে কাযী আবু উবাইদ! আবু হানীফা যা বলেছেন, আমিও কি তা বলতে বাধ্য? তিনি বললেন, আমি তো তোমাকে ইমামের মুকাল্লিদ মনে করতাম। আমি বললাম, গোঁড়া ও পক্ষপাতী লোক ব্যতীত অন্য কেউ তাকলীদ করতে পারে না। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, নির্বোধ লোকেরাও তাকলীদ করে। অতঃপর কাযী আবু উবাইদ ও ইমাম ত্বহাবীর মধ্যকার এ বিতর্কটি মিশরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লো এবং একটি দৃষ্টান্ত স্বরূপ হয়ে গেলো। পরবর্তীতে লোকেরা এটি মুখস্ত করে রেখেছে। এ বিতর্কটি ইমাম ত্বহাবীর সত্যান্বেষী হওয়ার প্রমাণ করে।
ইমাম আবু হানীফার মাযহাব গ্রহণ এবং তার মাযহাব বর্জন সম্পর্কে ইবনে খাল্লিকান বলেন, একদা তার মামা মুযানী সম্ভবত রাগান্বিত হয়ে তাকে বললেন, আল্লাহর কসম! তোমার মধ্যে আমি ভালো কিছু দেখছি না। এতে ইমাম ত্বহাবী রাগান্বিত হয়ে মামার মজলিস ত্যাগ করে আবু জা’ফর ইবনে আবু ইমরান হানাফীর দারসে যোগদান করে হানাফী ফিকহে পান্ডিত্য অর্জন করলেন এবং সমসাময়িক আলেমদের চেয়েও উচ্চ আসনে উন্নীত হলেন।
শাইখের আক্বীদা-বিশ্বাস
যদিও তিনি ফিক্বহী মাস‘আলায় হানাফী ছিলেন, কিন্তু আক্বীদার মাস‘আলায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত, আহলে হাদীছ ও আছারের অনুসারী ছিলেন। তবে আক্বীদাহর কতিপয় মাস‘আলায় মুরজি‘আ ফকীহদের মত পোষণ করেছেন। তার রচিত ‘আল আক্বীদা আত-ত্বহাবীয়া’ এর মধ্যে তিনি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাগুলো অত্যন্ত সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। সকল মাযহাবের মুসলিমদের নিকট আক্বীদা সংক্রান্ত এটি একটি প্রামাণ্য পুস্তিকা। এর রয়েছে ছোট-বড় অনেক ব্যাখ্যা। আমরা সেগুলো থেকে আল্লামা ইমাম ইবনে আবীল ইয রহিমাহুল্লাহ কর্তৃক সংকলিত شرح العقيدة الطحاوية নামক ব্যাখ্যা গ্রন্থটি অনুবাদ করছি।
শাইখের উস্তাদগণ
তার মামা মুযানী এবং আবু জা’ফর আল-হানাফী ছাড়াও আরো অনেক উস্তাদের নিকট থেকে তিনি জ্ঞানার্জন করেন। ২৬৮ হিজরীতে সিরিয়ায় তিনি কাযী আবু হাযেমের সাথে সাক্ষাৎ করেন তার ও সেখানকার অন্যান্য আলেমের নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বলা হয়েছে যে, তার তিন শতাধিক উস্তাদ ছিল। ছাত্র জীবনের শুরু থেকেই ইলম অর্জনের প্রতি তার অত্যধিক আগ্রহ ছিল। মিশরের উস্তাদদের নিকট থেকে ইলম অর্জনের পাশাপাশি সেসময় বিভিন্ন ইসলামী অঞ্চল থেকে মিশরে কোনো আলেমের আগমনের সংবাদ শুনলেই তিনি তার সার্বক্ষণিক শিষ্যত্ব গ্রহণ করতেন এবং তার ইলমী ভান্ডারের সাথে অন্যান্য আলেমদের ইলম একত্রিত করতেন। তার উস্তাদদের মধ্যে রয়েছেন,
(১) হাদীছের ইমাম আহমাদ ইবনে শুআইব ইবনে আলী আন্ নাসাঈ (মৃত: ৩০৩ হি:)
(২) নির্ভরযোগ্য বিশিষ্ট আলেম আহমাদ ইবনে আবু ইমরান আল-কাযী (মৃত: ২৮০ হি:)
(৩) ইসহাক ইবনে ইবরাহীম ইবনে ইউনুস আল-বাগদাদী (মৃত: ৩০৪ হি:)
(৪) তার মামা প্রখ্যাত ফকীহ ইসমাঈল ইবনে ইয়াহইয়া আল-মুযানী (মৃত: ২৬০ হি:)
(৫) ইমাম শাফেঈর প্রসিদ্ধ ছাত্র বাহার ইবনে নসর আল-খাওলানী (মৃত: ২৬৭ হি:)
ইমাম ত্বহাবীর ছাত্রগণ
ইমাম ত্বহাবী তার যুগে ইলমের বিভিন্ন শাখায় পান্ডিত্য অর্জনে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেন। বিভিন্ন মাস‘আলার তাহকীক (বিশ্লেষণ) ও দলীলের সুক্ষ্ম মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মধ্যে তার সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাই তার ইলমের ভান্ডার থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য বিভিন্ন ইসলামী অঞ্চল থেকে ছাত্রগণ দলে দলে এসে তার মজলিসে ভিড় জমাতে থাকে। ছাত্রগণ তাকে অত্যন্ত সম্মান দিতেন। তার সুযোগ্য ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন,
(১) মিশরের কাযী আহমাদ ইবনে ইবরাহীম ইবনে হাম্মাদ (মৃত: ৩২৯ হি:)
(২) ঐতিহাসিক আব্দুর রহমান ইবনে আহমাদ (মৃত: ৩৪৭ হি:)
(৩) সুলায়মান ইবনে আহমাদ ইবনে আইয়্যুব আত্-তাবারী (মৃত: ৩৬০ হি:)
(৪) الكامل في الجرح والتعديل গ্রন্থকার আব্দুল্লাহ বিন আদী আল-জুরজানী (মৃত: ৩৬৫ হি:)
আলেমদের দৃষ্টিতে ইমাম ত্বহাবী
অনেক আলেম ইমাম ত্বহাবীর প্রশংসা করেছেন। তারা বলেছেন, তিনি ছিলেন
ثقة ثبت فيقه عاقل حافظ دين له اليد الطولى في الفقه والحديث
অর্থাৎ নির্ভরযোগ্য, সুদৃঢ়, ফকীহ, বিচক্ষণ, হাদীছের হাফেয এবং ধর্মভীরু আলেম। ফিকহ এবং হাদীছ শাস্ত্রে তার গভীর জ্ঞান ছিল।
ইবনে ইউনূস বলেন, ইমাম ত্বহাবী ছিলেন নির্ভরযোগ্য, জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত, সুদৃঢ়, ফকীহ এবং বিচক্ষণ আলেম। তার যামানায় তার সমকক্ষ আর কেউ ছিল না।
ইমাম ইবনে কাছীর রহিমাহুল্লাহ বেদায়া ও নেহায়া গ্রন্থে বলেন, তিনি ছিলেন নির্ভরযোগ্য, জ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং হাদীছের সুদক্ষ হাফেযদের অন্যতম। ইমাম ইবনে কাছীর রহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, তিনি ছিলেন হানাফী ফকীহ, প্রচুর কল্যাণকর ও মূল্যবান গ্রন্থের লেখক।
জামাল উদ্দীন আবুল মাহাসিন ইউসুফ ইবনুল আমীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, তিনি ছিলেন ফিকহ, হাদীছ, আলেমদের মতভেদ, আরবী ভাষা, নাহু-সরফ, ব্যাকরণ ইত্যাদি শাস্ত্রের ইমাম।
তার ইলমী খেদমত
সঠিক তথ্য উদঘাটন, সংকলন, সংগ্রহ, সুন্দর ও সাবলীল উপস্থাপনার দিক থেকে তার লেখনীগুলো অনন্য। তিনি যেসব মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন, তার মধ্য রয়েছে,
(১) আহকামুল কুরআনিল কারীম
(২) ইখতেলাফুল উলামা
(৩) শারহু মা‘আনিল আছার। এতে তিনি দলীলসহ ফিক্হ এর মাস‘আলাসমূহ আলোচনা করেছেন। এতে তিনি মতভেদপূর্ণ ফিকহী মাস‘আলাগুলো উল্লেখ করার সাথে সাথে দলীলগুলোও উল্লেখ করেছেন। মাস‘আলা ও দলীলগুলো উল্লেখ করার পর সেগুলো পর্যালোচনা ও যাচাই-বাছাই করে তার কাছে যেটি সুস্পষ্ট হয়েছে, সেটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কিতাবটি ছাত্রদেরকে গভীর জ্ঞান অর্জনের প্রশিক্ষণ দেয়, ফিকহী মাস‘আলাগুলোতে আলেমদের মতভেদের কারণ সম্পর্কেও অবগত করে এবং দলীল থেকে হুকুম-আহকাম নির্গত করার যোগ্যতা বৃদ্ধি করে। এর মাধ্যমে ছাত্রদের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও যোগ্যতাও বৃদ্ধি পায়।
(৪) ছহীহুল আছার
(৫) আস্ সুনানুল মাছুরাহ
(৬) মুশকিলুল আছার। যেসব হাদীছ বাহ্যিক দৃষ্টিতে পরস্পর সাংঘর্ষিক মনে হয়, মুশকিলুল আছার গ্রন্থে তিনি সেসব হাদীছ উল্লেখ করে বৈপরীত্ব ও অসংগতি দূর করেছেন এবং তা থেকে বিভিন্ন হুকুম-আহকাম নির্গত করেছেন।
(৭) আল-আক্বীদাতুত ত্বহাবীয়া। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাগুলো এতে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এটি আলেমদের নিকট আক্বীদার একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব। এর বহু ব্যাখ্যা রয়েছে। মূল পুস্তিকাটি যেভাবে সকল মাযহাবের অনুসারীগণ কবুল করে নিয়েছেন, ঠিক তেমনি এর ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোও সেভাবে গৃহীত হয়েছে। আমরা যে ব্যাখ্যাটির অনুবাদ করতে যাচ্ছি, তা আলেমদের নিকট অত্যন্ত মূল্যবান একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে এটি বিশেষভাবে সমাদৃত হয়ে আসছে।
(৮) শারহুল জামে আল-কাবীর
(৯) শারহুল জামে আস-সাগীর
(১০) কিতাবুশ শুরুত
(১১) আন্ নাওয়াদের আল ফিকহীয়াহ
(১২) الرد على أبي عبيد (মুতাযেলী ইমাম আবু উবাইদের প্রতিবাদ)
(১৩) الرد على عيسى بن أبان (ঈসা বিন আবানের প্রতিবাদ)।
(১৪) المختصر في الفقه । এ ছাড়া রয়েছে তার আরো অনেক মূল্যবান গ্রন্থ, যা দ্বারা মুসলিম জাতি কিয়ামত পর্যন্ত উপকৃত হতে থাকবে।
ইমামের মৃত্যু
ইবনে খাল্লিকান وفيات الاعيان গ্রন্থে ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ এর ওফাত প্রসঙ্গে বলেন যে, যুগ শ্রেষ্ঠ ফকীহ, সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী জ্ঞান তাপস আল্লামা আবু জাফর ত্বহাবী ৩২১ হিজরী মোতাবেক ৯৩৩ খৃস্টাব্দে ৮২ বছর বয়সে যিলকদ মাসের বৃহস্পতিবার রাতে মিসরে ইন্তিকাল করেন। সেখানকার গোরস্থানেই তাকে দাফন করা হয়। হে আল্লাহ! তুমি তাকে নাবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎ কর্মশীলদের সাথে জান্নাতুল ফেরদাউছে স্থান দাও। আমাদের সকলকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করো। আমীন!
بِسْمِ الله الرَّحْمَنِ الرَّحِيْم
الْحَمْدُ لله [نَحْمَدُهُ ، وَ] نَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُوذُ بِاللَّهِ مِنْ شُرُورِ أَنْفُسِنَا وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَهْدِهِ اللَّهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُضْلِلِ فَلَا هَادِيَ لَهُ. وَأَشْهَدُ أن لا إله إلا الله وحده لا شَرِيكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ سَيِّدَنَا مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَعَلَى آلِهِ وَصَحْبِهِ وَسَلَّمَ تَسْلِيمًا كَثِيرًا.
সমস্ত ইলমের মধ্যে দীনের মূলনীতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাই সর্বোত্তম ইলম। কারণ যে বিষয় সম্পর্কে ইলম অর্জন করা হয়, সে বিষয়ের মর্যাদা অনুপাতেই সে সম্পর্কে অর্জিত ইলমের মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ অন্যান্য বিষয়ের তুলনায় দীনের মূলনীতির গুরুত্ব ও মর্যাদা যেহেতু সর্বাধিক, তাই সে সম্পর্কে অর্জিত ইলমও সর্বোত্তম। দীনের শাখা-মাস‘আলা সম্পর্কিত ফিক্বহ এর জ্ঞানার্জনের তুলনায় তার মূলনীতি সম্পর্কে ইলম অর্জন করাই হচ্ছে ফিকহুল আকবার। এ জন্যই ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ দীনের মূলনীতিগুলো একত্র করে যে কিতাব লিখেছেন, তার নাম দিয়েছেন الفقه الأكبر আল-ফিকহুল আকবার।
মানুষের যত প্রয়োজন রয়েছে, তার মধ্যে সঠিক আক্বীদা গ্রহণের প্রয়োজনই সর্বাধিক। তাই তাদের প্রয়োজনাদির উপর দীনের মৌলিক বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করাকেই প্রাধান্য দেয়া আবশ্যক। কেননা মানুষের অন্তর ততোক্ষণ পর্যন্ত জীবিত হয় না এবং তা পরিপূর্ণ প্রশান্তি ও স্বস্তি লাভ করে না, যতক্ষণ না সে তার মাবুদের পরিচয় লাভ করে এবং তার স্রষ্টার সুন্দরতম নামসমূহ, সুউচ্চ গুণাবলী ও তার সকল কর্মসহ চিনতে পারে। সে সাথে উপরোক্ত বিষয়গুলো বান্দার অন্তরে সর্বাধিক প্রিয় হওয়া জরুরী। আর বান্দা এ-প্রাণ উজাড় করে কেবল ঐসব আমল করার প্রচেষ্টা চালাবে, যা সকল সৃষ্টির পরিবর্তে তাকে তার রবের সান্নিধ্যে পৌঁছিয়ে দিবে।
মানুষ তার বিবেক ও বোধশক্তির দ্বারা তার প্রভুর অতি সুন্দর নাম, তার সুউচ্চ গুণাবলী ও ক্রিয়া-কর্মসমূহ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জ্ঞান অর্জন করতে সম্পূর্ণ অক্ষম।[1] এ জন্যই দয়াবান ও পরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলার হিকমতের দাবি অনুসারে যুগে যুগে অনেক নাবী-রসূল প্রেরিত হয়েছেন। তারা সকল সৃষ্টিকে তাদের প্রভুর পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের মাবুদের ইবাদতের দিকেই আহবান করেছেন। যারা নাবী-রসূলদের ডাকে সাড়া দিয়েছে, তারা তাদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। আর যারা তাদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদেরকে তারা জাহান্নামের শাস্তির ভীতি প্রদর্শন করেছেন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তার অতি সুন্দর নাম, সুউচ্চ গুণাবলী ও কার্যাদির পরিচয় লাভ এবং তার তাওহীদ বাস্তবায়ন করাকেই নাবী-রসূলগণের দাওয়াতের চাবিকাঠি ও মূল বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। প্রভুর পরিচয় সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া ও তার তাওহীদকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার আহবানই ছিল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল নাবী-রাসূলের রিসালাতের একমাত্র উদ্দেশ্য। এ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমেই বান্দাদের পক্ষে তাদের প্রভুর সান্নিধ্যে পৌঁছা সম্ভব।
উপরোক্ত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রসূলদের মাধ্যমে মানুষকে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি প্রদান করেছেন।
(১) সৃষ্টিকে আল্লাহ তা‘আলা তার সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি অর্জনের পথের সন্ধান দিয়েছেন। এটিই হলো আল্লাহ তা‘আলার ঐ শরী‘আত, যাতে রয়েছে তার আদেশ ও নিষেধসমূহ এবং যা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই তারা আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছাতে পারবে।
(২) যারা এ শরী‘আতের পথ অনুসরণ করার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে, তাদের জন্য আখেরাতে কী পরিমাণ চিরস্থায়ী ও চক্ষু শীতলকারী নিয়ামত রয়েছে, তাও বলে দিয়েছেন।
সুতরাং যারা আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের পথ অনুসরণ করে তারাই আল্লাহ তা‘আলার পরিচয় সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত এবং তার সান্নিধ্য লাভকারীদের অবস্থা সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত। এ জন্যই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর অবতীর্ণ অহীকে রূহ বা প্রকৃত জীবন বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কেননা অহীর জ্ঞানার্জন করার উপরই প্রকৃত ও শান্তিময় জীবন লাভ নির্ভরশীল। সে সাথে তিনি তার নাবীর উপর অবতীর্ণ শরী‘আতকে নূর হিসাবে উল্লেখ করেছেন। কারণ সে অহী ও শরী‘আতের অনুসরণ ব্যতীত হিদায়াতের আলো অর্জন করা অসম্ভব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿رَفِيعُ الدَّرَجَاتِ ذُو الْعَرْشِ يُلْقِي الرُّوحَ مِنْ أَمْرِهِ عَلَىٰ مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ لِيُنْذِرَ يَوْمَ التَّلَاقِ﴾
‘‘তিনি মর্যাদা উন্নীতকারী, আরশের অধিপতি। তার বান্দাদের মধ্য থেকে যার কাছে ইচ্ছা নিজের হুকুমে রূহ নাযিল করেন যাতে সে সাক্ষাতের দিন সম্পর্কে সাবধান করে দেয়’’ (সূরা গাফের: ১৫)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَكَذَٰلِكَ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ رُوحًا مِنْ أَمْرِنَا مَا كُنْتَ تَدْرِي مَا الْكِتَابُ وَلَا الْإِيمَانُ وَلَٰكِنْ جَعَلْنَاهُ نُورًا نَهْدِي بِهِ مَنْ نَشَاءُ مِنْ عِبَادِنَا وَإِنَّكَ لَتَهْدِي إِلَىٰ صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ صِرَاطِ اللَّهِ الَّذِي لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ أَلَا إِلَى اللَّهِ تَصِيرُ الْأُمُورُ﴾
‘‘এভাবেই আমি আমার নির্দেশে তোমার কাছে এক রূহ অহী করেছি। তুমি আদৌ জানতে না কিতাব এবং ঈমান কী? কিন্তু সে রূহকে আমি একটি আলো বানিয়েছি যা দিয়ে আমি আমার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পথ দেখিয়ে থাকি। নিশ্চয় আমি তোমাকে সোজা পথের নির্দেশনা প্রদান করেছি। সেই আল্লাহর পথের দিকে যিনি যমীন ও আসমানের সব কিছুর মালিক। সাবধান! সবকিছু আল্লাহর দিকেই ফিরে যায়’’ (সূরা শুরা: ৫২-৫৩)।
সুতরাং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তাতেই রূহের প্রকৃত জীবন, শান্তি এবং তা আলোকিত হওয়াতেই প্রকৃত আলো।
এমনি নাবী-রসূলদের প্রতি প্রেরিত অহীকে আল্লাহ তা‘আলা শিফা বা আরোগ্য লাভের মাধ্যম হিসাবেও নামকরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ هُوَ لِلَّذِينَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ﴾
বলো, এ কুরআন মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও শিফা স্বরূপ (সূরা ফুসসিলাত: ৪৪)।
কুরআন সকলের জন্য হেদায়াত ও শিফা হলেও এর দ্বারা কেবল যেহেতু মুমিনরাই উপকৃত হয়, তাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে হিদায়াত ও সত্য দীনসহ প্রেরণ করেছেন। সুতরাং তিনি যা নিয়ে এসেছেন, তা ব্যতীত অন্য কিছুতে হেদায়াত নেই।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সত্য দীন নিয়ে আগমন করেছেন, সে দীনের সকল বিষয়ের প্রতি প্রত্যেক মানুষের ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। আর দীনের খুটিনাটি সকল বিষয় বিস্তারিতভাবে জানা উম্মতের সকলের উপর ফরযে আইন নয়; বরং তা ফরযে কিফায়া, যা কিছু লোক আদায় করলে অন্যদের পক্ষ হতে আদায় হয়ে যায়।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন, তা প্রচার করা, কুরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা, বোধশক্তি দিয়ে তা উপলব্ধি করা, ভালভাবে উহা বুঝা, কিতাব ও হিকমাতের জ্ঞান অর্জন করা, তার হেফাযত করা, কল্যাণের দিকে আহবান করা, সৎ কাজের আদেশ করা, অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করা, হিকমাত ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে প্রভুর পথে আহবান করা এবং উত্তম পদ্ধতিতে তর্ক-বিতর্ক করা ফরযে কেফায়ার অন্তর্ভুক্ত। এগুলো ঐসব বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত, যা আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের উপর ওয়াজিব করেছেন। তবে এটি বিস্তারিতভাবে বুঝা এবং তার সকল শাখার জ্ঞান অর্জন করা উম্মাতের লোকদের উপর ফরযে কিফায়া হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। যা কতিপয় লোক আদায় করলে অন্যদের পক্ষ হতে আদায় হয়ে যাবে।
আর তাদের প্রত্যেক ব্যক্তির উপর যা আবশ্যক ও উম্মতের প্রত্যেক ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে যেসব আদেশ করা হয়েছে, ক্ষমতা, সামর্থ, প্রয়োজন এবং জ্ঞান-বুদ্ধি অনুযায়ী বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে তা বিভিন্ন রকম হতে পারে। ইসলামী জ্ঞানের কিছু অংশ শ্রবণ করতে কিংবা উহার সুক্ষ্ম বিষয়গুলো বুঝতে যারা অক্ষম, তাদের উপর তা আবশ্যক নয়। কিন্তু যারা তা বুঝতে ও শিখতে সক্ষম তাদের উপরই কেবল তা আবশ্যক। ঠিক এমনি যে ব্যক্তি শরী‘আতের দলীল-প্রমাণ বিস্তারিতভাবে শুনতে পায় এবং তা বুঝতে সক্ষম হয় তার উপর তা থেকে এমন কিছু আবশ্যক হয়, যা ঐসব লোকদের উপর আবশ্যক নয়, যারা তা শুনতে পায়নি। সে সাথে মুফতী, মুহাদ্দিছ এবং বিচারক-শাসকের উপর যা আবশ্যক, অন্যদের উপর তা আবশ্যক নয়।
এখানে জেনে রাখা আবশ্যক যে, দীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে যারা ব্যর্থ হয়েছে অথবা যারা তা থেকে মূল সত্যটি জানতে অক্ষম হয়েছে রাসূলের দীনের অনুসরণের ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন করা, দীন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা পরিত্যাগ করা এবং সত্যের প্রতি নির্দেশক দলীল-প্রমাণ সংগ্রহ না করাই তাদের ব্যর্থতার প্রধান কারণ। তারা যখন আল্লাহর কিতাব থেকে বিমুখ হয়েছে, তখনই তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُم مِّنِّي هُدًى فَمَنِ اتَّبَعَ هُدَايَ فَلَا يَضِلُّ وَلَا يَشْقَىٰ وَمَنْ أَعْرَضَ عَن ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْتَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا قَالَ كَذَٰلِكَ أَتَتْكَ آيَاتُنَا فَنَسِيتَهَا وَكَذَٰلِكَ الْيَوْمَ تُنسَىٰ﴾
‘‘আমার পক্ষ হতে তোমাদের কাছে সৎপথের নির্দেশ আসলে যে ব্যক্তি আমার সে নির্দেশ মেনে চলবে সে বিভ্রান্ত হবে না এবং দুঃখ কষ্ট পাবে না। আর যে ব্যক্তি আমার যিকির থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার জন্য হবে দুনিয়ায় সংকীর্ণ জীবন এবং ক্বিয়ামতের দিন আমি তাকে উঠাবো অন্ধ অবস্থায়। সে বলবে, হে আমার রব! কেন আমাকে অন্ধ অবস্থায় উঠালেন? দুনিয়ায় আমি তো ছিলাম চক্ষুষ্মান। তিনি বলবেন, এভাবেই তো আমার আয়াত তোমার কাছে এসেছিল। কিন্তু তুমি তা ভুলে গিয়েছিলে। এভাবেই আজ তোমাকেও ভুলে যাওয়া হচ্ছে’’। (সূরা ত্বহা: ১২৩-১২৬) আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন,
تَكَفَّلَ اللَّهُ لِمَنْ قَرَأَ الْقُرْآنَ وَعَمِلَ بِمَا فِيهِ، [أَنْ] لَا يَضِلَّ فِي الدُّنْيَا، وَلَا يشقى في الآخرة ثم قرأ هذه الآيات
যে ব্যক্তি কুরআন পড়বে এবং কুরআন অনুযায়ী আমল করবে, তার ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা যিম্মাদার হয়েছেন যে, সে দুনিয়াতে বিভ্রান্ত হবে না এবং আখেরাতে হতভাগ্য হবে না। অতঃপর ইবনে আববাস উপরোক্ত আয়াতগুলো পাঠ করলেন।
আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে ইমাম তিরমিযী এবং অন্যরা যে হাদীছ বর্ণনা করেছেন, তাতে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
"إِنَّهَا سَتَكُونُ فِتَنٌ" قُلْتُ: فَمَا الْمَخْرَجُ مِنْهَا يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ: "كِتَابُ اللَّهِ، فِيهِ نَبَأُ مَا قَبْلَكُمْ، وَخَبَرُ مَا بَعْدَكُمْ، وَحُكْمُ مَا بَيْنَكُمْ، هُوَ الْفَصْلُ، لَيْسَ بِالْهَزْلِ، مَنْ تَرَكَهُ مِنْ جَبَّارٍ قَصَمَهُ اللَّهُ، وَمَنِ ابْتَغَى الْهُدَى فِي غَيْرِهِ أَضَلَّهُ اللَّهُ، وَهُوَ حَبْلُ اللَّهِ الْمَتِينُ، وَهُوَ الذِّكْرُ الْحَكِيمُ، وَهُوَ الصِّرَاطُ الْمُسْتَقِيمُ، وهو الذي لا تزيع بِهِ الْأَهْوَاءُ، وَلَا تَلْتَبِسُ بِهِ الْأَلْسُنُ، وَلَا تنقضي عجائبه، ولا تشبع مِنْهُ الْعُلَمَاءُ، مَنْ قَالَ بِهِ صَدَقَ، وَمَنْ عَمِلَ بِهِ أُجِرَ، وَمَنْ حَكَمَ بِهِ عَدَلَ، وَمَنْ دَعَا إِلَيْهِ هُدِيَ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ"
অচিরেই বড় বড় অনেক ফিতনার আবির্ভাব হবে। আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রসূলাল্লাহ! এ থেকে বাঁচার উপায় কী? তিনি বললেন, আল্লাহর কিতাবকে আকঁড়ে ধরার মাধ্যমে এ থেকে বাঁচা সম্ভব। কেননা তাতে রয়েছে তোমাদের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তীদের খবর। ইহাই তোমাদের মধ্যে ফায়ছালাকারী এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়কারী। এটি কোনো হাসি-ঠাট্টার বিষয় নয়। যে ব্যক্তি অহংকার বশতঃ এ কুরআনের উপর আমল বর্জন করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে ধ্বংস করবেন। যে ব্যক্তি এর বাইরে অন্য কিছুতে হিদায়াত অন্বেষণ করবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে পথভ্রষ্ট করবেন। এটি আল্লাহর মজবুত রশি, প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশ এবং সীরাতুল মুস্তাকীম। এটি এমন সত্য কিতাব, যার অনুসারীকে নফসের প্রবৃত্তি সত্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। মুমিনদের জবান দ্বারা তা পাঠ করাতে মোটেই কষ্ট অনুভব হয় না। এর বিস্ময়কর বিষয়গুলোর পরিসমাপ্তি ঘটবে না এবং আলেমগণ এ থেকে জ্ঞান অর্জন করে পরিতৃপ্ত হবে না। যে ব্যক্তি কুরআন দ্বারা কথা বলবে, তার কথা সত্য হবে, যে কুরআন অনুযায়ী আমল করবে, সে বিনিময় পাবে, কুরআন দিয়ে যে বিচারক মানুষের মাঝে ফায়ছালা করবে, সে ন্যায় বিচার করতে সক্ষম হবে এবং যে ব্যক্তি কুরআনের দিকে আহবান করবে, সে সীরাতুল মুস্তাকীমের সন্ধান পাবে।[2] এ ছাড়াও এ বিষয়ে আরো অনেক আয়াত ও হাদীছ রয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা তার নাবী-রসূলদের মাধ্যমে মানব জাতির জন্য যে সত্য-সঠিক দ্বীন নির্ধারণ করেছেন, তা ব্যতীত পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের থেকে এমন কোনো দ্বীন তিনি কবুল করবেন না, যার দ্বারা তারা আল্লাহর ইবাদত করতে পারে।
আর রসূলগণ আল্লাহ তা‘আলাকে যেসব সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করেছেন, তা ব্যতীত মানুষেরা আল্লাহ তা‘আলাকে যেসব বিশেষণে বিশেষিত করে, তিনি নিজের সত্তাকে তা থেকে পবিত্র করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ وَسَلامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ﴾
‘‘কাফের-মুশরেকরা তোমার রব সম্পর্কে যেসব কথা তৈরি করছে তা থেকে তোমার রব পবিত্র, তিনি ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী। আর সালাম আল্লাহর রসূলদের প্রতি এবং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ রাববুল আলামীনের জন্যই’’। (সূরা সাফফাত: ১৮০-১৮২)
সুতরাং কাফেররা আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে যেসব অশোভনীয় কথা বলেছে, তা থেকে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ পবিত্র বলে ঘোষণা করেছেন। সে সাথে রসূলদের উপরও তিনি সালাম পেশ করেছেন। কেননা রসূলগণ আল্লাহ তা‘আলার যেসব সুউচ্চ গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, তা সকল প্রকার দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত ও পবিত্র। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তার ঐসব গুণাবলীর কারণে নিজের সত্তার প্রশংসা করেছেন, যা দ্বারা কেবল তিনি একাই বিশেষিত এবং যার কারণে তিনি পূর্ণ প্রশংসা পাওয়ার হকদার।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের যে মূলনীতির উপর ছিলেন, তারই উপর ছিলেন এ উম্মতের সর্বোত্তম ব্যক্তিগণ। তারা হলেন ছাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসারীগণ। তাদের একজন অন্যজনকে এরই উপদেশ দিতেন এবং উত্তরসূরীগণ পূর্বসূরীদের অনুসরণ করতেন। এর মাধ্যমে তারা সকলেই তাদের নাবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হুবহু অনুসরণ করতেন এবং তার দেখানো পথেই চলতেন। আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে বলেন,
﴿قُلْ هَذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللَّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَا وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾
‘‘তুমি বলো, এটিই আমার পথ। পূর্ণ প্রজ্ঞার সাথে আমি আল্লাহর দিকে আহবান জানাই আমি এবং আমার অনুসারীরা। আল্লাহ্ পবিত্র। আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’’। (সূরা ইউসুফ: ১০৮)
এ আয়াতে وَمَنِ اتَّبَعَنِي বাক্যটিকে যদি أدعو এর মধ্যকার أنا সর্বনামের উপর সম্পর্ক করা হয়, তাহলে এতে দলীল রয়েছে যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছাহাবীগণও ছিলেন আল্লাহর দ্বীনের দাঈ। আর যদি তাকে ضمير منفصل এর উপর অর্থাৎ أنا যমীরের উপর সম্পর্ক করা হয়, তাহলে এ কথা সুস্পষ্ট যে, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে যে সত্য দীন নিয়ে এসেছেন, তিনি এবং তার ছাহাবীগণই ছিলেন সে সম্পর্কে অন্যদের তুলনায় অধিক প্রজ্ঞাবান। তবে উভয় অর্থই যথাযথ।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুস্পষ্ট করেই আল্লাহর দীনের প্রচার করেছেন এবং সত্যান্বেষীদের জন্য তার দলীল-প্রমাণগুলো সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করেছেন। তার উম্মতের সর্বোত্তম মানুষগুলো এ সুস্পষ্ট দীনের উপর অটল থেকেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
অতঃপর এমনসব অপদার্থরা আগমন করলো, যারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করেছে এবং বহুদলে বিভক্ত হয়েছে। পরবর্তী যুগসমূহে দীনের মূলনীতিগুলোর ব্যাপারে যখন লোকেরা মতভেদ শুরু করলো তখন আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য এমনসব লোক পাঠালেন, যারা সে মূলনীতিগুলোকে সংরক্ষণ করেছেন। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظاهرين عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُم مَنْ خَذَلَهُمْ»
‘‘আমার উম্মাতের একটি দল সবসময় হকের উপর বিজয়ী থাকবে। যেসব লোক তাদের বিরোধীতা করবে কিংবা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে তারা সে দলটির কোনো ক্ষতি করতে পারবে না’’।[3]
যুগে যুগে যেসব আলেম দীনের মূলনীতিগুলোর সংরক্ষণ এবং তার প্রচার ও প্রসারের পথে আত্মনিয়োগ করেছেন, তাদের মধ্যে দু’শত হিজরীর পরে জন্ম গ্রহণকারী আল্লামা ইমাম আবু জা’ফর আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে সালামা আল আযদী আত্ ত্বহাবী অন্যতম। তিনি ২৩৯ হিজরী সনে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ৩২১ হিজরী সনে ৮২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। হে আল্লাহ! তোমার রহমত দ্বারা তাকে আচ্ছাদিত করো। আমীন
উম্মতের সালাফে সালেহীনগণ দীনের যেসব মূলনীতির উপর ছিলেন, ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ সে সম্পর্কে আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন। ইমাম আবু হানীফা নু’মান বিন ছাবিত আল-কুফী এবং তার দু’সুযোগ্য শিষ্য আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইবরাহীম আল-হিময়ারী আল আনসারী ও মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশ-শায়বানী রহিমাহুমুল্লাহ দীনের মূলনীতিগুলোর ক্ষেত্রে যে সুদৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতেন ও যেসব মূলনীতির মাধ্যমে তারা আল্লাহ রাববুল আলামীনের সন্তুষ্টি কামনা করতেন, ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ সেগুলো বর্ণনা করেছেন।
তবে নবুওয়াতে মুহাম্মাদীর যুগ এবং পরবর্তী যুগসমূহের মধ্যে দীর্ঘ ব্যবধানের সাথে সাথে দীনের মূলনীতিগুলোর মধ্যে বহু বিদ‘আতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং এমন বিকৃতি ঢুকে পড়েছে, যাকে এর উদ্ভাবনকারীরা তাবীল (অপব্যাখ্যা) হিসাবে নাম দিয়েছে, যাতে সাধারণ লোকেরা এগুলোকে সহজেই গ্রহণ করে। তাদের তাহরীফ (বিকৃতি) ও তাবীলের মধ্যে খুব কম সংখ্যক লোকই পার্থক্য করতে সক্ষম। কেননা কখনো কখনো শব্দকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে অন্য এমন এক সম্ভাব্য অর্থের দিকে ফিরিয়ে নেয়াকে তাবীল বলা হয়, যে সম্ভাব্য অর্থে ঐ শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে। যদিও সম্ভাব্য অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হওয়ার কোনো লক্ষণ ও দলীল না থাকে। বিনা কারণে ও বিনা দলীলে শব্দকে আসল অর্থ থেকে অন্য অর্থে ব্যবহার করা থেকেই দীনের মূলনীতির ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সূচনা হয়েছে। অতঃপর যখন তারা দীনের মূলনীতি ও আল্লাহ তা‘আলার সিফাত সংক্রান্ত আয়াতগুলোর বিকৃতি করে ব্যাখ্যা হিসাবে তার নাম দিলো, তখন তা গৃহীত হলো এবং যেসব মুসলিম তাহরীফ ও তাবীলের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম নয়, তাদের মধ্যে তার প্রসার ঘটলো।
এরপর থেকেই মুসলিমগণ দীনের মূলনীতি সংক্রান্ত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা করা এবং তার উপর উত্থাপিত সন্দেহগুলো দূর করার প্রয়োজন অনুভব করলো। এতে করে অনেক তর্ক-বিতর্ক ও শোরগোল হলো। বাতিলপন্থীদের সন্দেহগুলোর প্রতি মুসলিমদের কর্ণপাত করা, তর্কশাস্ত্রবিদদের নিকৃষ্ট যুক্তি-তর্কের পিছনে পড়াই ছিল এর একমাত্র কারণ। অথচ সালাফগণ এ কালাম শাস্ত্রের যথেষ্ট দোষারোপ করেছেন এবং তার প্রতি দৃষ্টি দেয়া, তা নিয়ে মশগুল হওয়া ও তার প্রতি কর্ণপাত করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলার আদেশ পালন করতে গিয়েই তারা তা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِذَا رَأَيْتَ الَّذِينَ يَخُوضُونَ فِي آيَاتِنَا فَأَعْرِضْ عَنْهُمْ حَتَّىٰ يَخُوضُوا فِي حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنسِيَنَّكَ الشَّيْطَانُ فَلَا تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرَىٰ مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ﴾
‘‘তুমি যখন দেখবে, লোকেরা আমার আয়াতের মধ্যে দোষ খুঁজে বেড়াচ্ছে তখন তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাও, যে পর্যন্ত না তারা এ আলোচনা বাদ দিয়ে অন্য প্রসংঙ্গে লিপ্ত হয়। আর শয়তান কখনো যদি তোমাকে ভুলিয়ে দেয়, তাহলে স্মরণ হওয়ার পর এ যালেম সম্প্রদায়ের কাছে বসো না’’ (সূরা আল আনআম: ৬৮)। আয়াতের মর্মার্থ কালাম শাস্ত্রবিদদেরকেও শামিল করে।
আল্লাহর কালাম বিকৃত করা এবং তা থেকে বিচ্যুত হওয়ার একাধিক স্তর রয়েছে। কখনো তা কুফরীর স্তরে পৌঁছতে পারে, কখনো পাপাচার আবার কখনো সীমা লংঘন আবার কখনো ভুল করার কারণেও আল্লাহর কালামের তাহরীফ (বিকৃতি) ও বিচ্যুতি হয়ে যেতে পারে।
[2]. হাদীছের অর্থ সুন্দর, তবে সনদ যঈফ।
[3]. ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিম হা/১৯২০।
আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাধ্যমে নাবী-রসূলদের আগমনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন এবং তাকে আখেরী নাবী হিসাবে মনোনিত করেছেন। তার উপর অবতীর্ণ কিতাবকে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের সংরক্ষণকারী হিসাবে নির্ধারণ করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা তার সর্বশেষ নাবীর উপর কিতাব ও হিকমাত নাযিল করেছেন এবং তার দাওয়াতকে কবুল করা মানুষ ও জিন সকলের জন্য আবশ্যক করেছেন। তার দাওয়াত কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। এ দাওয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর উপর মানুষের পক্ষ হতে নাবী-রসূল ও দলীল-প্রমাণ না পাঠানোর অভিযোগ পেশ করার সুযোগ নিঃশেষ হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের জন্য নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে সবকিছুই বর্ণনা করেছেন ও সমগ্র উম্মতের জন্য দ্বীনের সমস্ত সংবাদ ও হুকুম-আহকাম পূর্ণ করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা তার নাবীর আনুগত্য করা তারই আনুগত্য এবং নাবীর নাফরমানীকে তারই নাফরমানী হিসাবে গণ্য করেছেন।
তিনি নিজে কসম করে বলেছেন, তারা তাদের নিজেদের পারস্পরিক বিবাদের ক্ষেত্রে তাকে একমাত্র ফায়ছালাকারী হিসাবে মেনে না নেয়া পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না।
তিনি আরো সংবাদ দিয়েছেন যে, মুনাফেকরা তাকে বাদ দিয়ে অন্যকে ফায়ছালাকারী বানাতে চায়। আর তাদেরকে যখন আল্লাহ, তার রসূল, তার কিতাব এবং রসূলের সুন্নাতের দিকে আহবান করা হয়, তখন মুনাফেকরা আল্লাহ এবং তার রসূল থেকে মুখ ফিরিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়। তারা আরো দাবি করে যে, তাদের কার্যকলাপের পিছনে সৎ উদ্দেশ্য এবং সমন্বয় সাধনই লক্ষ্য ছিল।
অনেক তর্কশাস্ত্রবিদ, দার্শনিক এবং অন্যরা মুনাফেকদের মতোই বলে থাকে। তারা বলে, আমরা কেবল বিষয়গুলোর আসল অবস্থা উপলব্ধি করতে চাই। অর্থাৎ ভালভাবে আয়ত্ত করা ও জানার ইচ্ছা পোষণ করি। যেগুলোকে তারা আকলী বা জ্ঞানগত দলীল হিসাবে নাম দিয়েছে, যদিও সেগুলো জাহেলিয়াত ছাড়া আর কিছু নয়, সেগুলো এবং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যেসব দলীল এসেছে, দার্শনিক ও কালামশাস্ত্রবিদরা উভয় বিষয়ের ক্ষেত্রে বলে যে, আমরা শরী‘আত ও দর্শনের মধ্যে সমন্বয় করতে চাই।[1]
অনুরূপ অনেক বিদ‘আতী, সন্ন্যাসী ও সূফী বলে যে, আমরা আমলগুলোকে সুন্দর করতে চাই। আর শরী‘আত এবং যে বাতিলের দিকে তারা আহবান করে উভয়ের মাঝে সমন্বয় সাধন করতে চায়। এসব বাতিল বিষয়কে তারা হাকীকত (বাস্তবসম্মত) বলে দাবী করে, সেগুলো প্রকৃত পক্ষে মুর্খতা ও ভ্রষ্টতা ছাড়া আর কিছু নয়।
অনুরূপ অনেক কালামশাস্ত্রবিদ এবং তাদের দ্বারা প্রভাবিত অনেক লোক বলে থাকে আমরা কার্যাবলীকে অতি সুন্দর করতে চাই এবং শরী‘আত ও রাজনীতির মধ্যে সমন্বয় করতে চাই। এমনি তারা আরো অনেক কথাই বলে থাকে।
>সুতরাং যে ব্যক্তিই দীনের কোনো বিষয়াদিতে রাসূলের আনীত বিষয়কে বাদ দিয়ে অন্য কিছুকে ফায়ছালাকারী বানাতে চাইবে ও ধারণা করবে সেটিই উত্তম এবং মনে করবে, এতেই রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আনীত বিধান এবং তার বিরোধী বিষয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধন হবে, সে বিভ্রান্ত ও মূর্খ হিসাবে গণ্য হবে।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তা পরিপূর্ণ এবং উম্মতের জন্য তা যথেষ্ট। তাতেই রয়েছে সকল সত্য বিষয়।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সত্য দ্বীন নিয়ে আগমন করেছেন, যারা নিজেদেরকে তার এ সত্য দ্বীনের অনুসারী বলে দাবি করেছে তাদের অনেকের দ্বারাই ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে। তিনি দ্বীনের যেসব মূলনীতি আনয়ন করেছেন, যেসব বিষয়কে ইবাদত হিসাবে সাব্যস্ত করেছেন এবং যেসব রাজনৈতিক নের্তৃত্বের বিষয় নিয়ে এসেছেন, তারা সেগুলোর অনেকাংশই জানতে ও বুঝতে পারেনি। অথবা তারা ধারণার বশবর্তী হয়ে ও অন্যের অন্ধ অনুসরণ করে রাসূলের শরীয়াতের মধ্যে এমন কিছু বৃদ্ধি করেছে, যা শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং তা থেকে এমন অনেক কিছু বের করে দিয়েছে, যা তার শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুতরাং এসব লোকের অজ্ঞতা, গোমরাহী ও শৈথিল্যের কারণেই এবং ঐসব লোকের সীমালংঘন, মূর্খতা ও নিফাকের কারণে বহু নিফাকীর উৎপত্তি হয়েছে এবং নাবী-রসূলদের রেসালাতের অনেকাংশই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
সুতরাং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সত্য দ্বীন নিয়ে এসেছেন, তার পরিপূর্ণ অনুসন্ধান করা উচিত, তাতে সুক্ষ্ম দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক এবং তা অর্জনে প্রচুর পরিশ্রম করা আবশ্যক। যাতে করে তা অবগত হওয়া যায়, তাতে বিশ্বাস পোষণ করা যায় এবং প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সে অনুযায়ী আমলও করা যায়। এর মাধ্যমে রাসূলের উপর অবতীর্ণ কিতাবের যথাযথ তেলাওয়াত করা সম্ভব হবে এবং তার কোন কিছুর প্রতিই অবহেলা করা হবে না।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা নিয়ে এসেছেন, তার কিছু অংশ জানতে অথবা তার প্রতি আমল করতে যদি কেউ অপারগ হয়, তাহলে সে অপারগ ব্যক্তি অন্যকে তার প্রতি আমল করতে নিষেধ করবে না; বরং তার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, অপারগতার কারণে নিজে আমল না করতে পারলে তাকে দোষারোপ করা হবে না। তবে অন্যরা সে অনুযায়ী আমল করার কারণে তার খুশি হওয়া উচিত। সে সাথে সে নিজে তা পালন করার আকাঙ্খা করবে। এমনটি যেন না হয় যে, সে রাসূলের দ্বীনের কিছু অংশে বিশ্বাস করবে এবং তার কিয়দাংশ বর্জন করবে। বরং সম্পূর্ণ কিতাবের উপর বিশ্বাস করবে এবং তার সাথে এমন কোনো বর্ণনা অথবা মতামত সংযোজন করা হতে দূরে থাকবে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়।
অথবা আক্বীদা ও আমলের ক্ষেত্রে সে এমন কিছুর অনুসরণ করা থেকে দূরে থাকবে, যা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে আগত নয়। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ﴾
তোমরা মিথ্যার সাথে সত্যকে মিলিয়ে সত্যকে সন্দেহযুক্ত করো না এবং জেনে বুঝে সত্যকে গোপন করো না। (সূরা আল বাকারা: ৪২)
এ ছিল সর্বপ্রথম ইসলাম কবুলকারী ছাহাবীদের তরীকা বা পথ। এটিই কিয়ামত দিবস পর্যন্ত উত্তমভাবে ছাহাবীদের অনুসরণকারীগণের পদ্ধতি হওয়া চাই। প্রথম শ্রেণীর তাবেঈগণই ছাহাবীদের অনুসরণ করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ছিলেন। অতঃপর যারা তাবেঈদের পরে আগমন করেছেন। এদের মধ্যেই রয়েছেন দ্বীনের ঐসব সম্মানিত ইমামগণ, যারা মধ্যমপন্থী উম্মতের নিকট ইমাম হিসাবে স্বীকৃত।
ইমাম আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি মুতাযেলা ইমাম বিশর আল-মুরাইসীকে একদা বলেছিলেন, কালামশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করাই হলো প্রকৃত মূর্খতা এবং তা সম্পর্কে অজ্ঞতাই হলো প্রকৃত ইলম। কোনো মানুষ যখন কালামশাস্ত্রে সর্বোচ্চ পান্ডিত্য অর্জন করবে, সে নাস্তিকে পরিণত হবে অথবা তার উপর নাস্তিক্যের অভিযোগ উত্থাপিত হবে। এখানে কালামশাস্ত্র সম্পর্কে অজ্ঞতা অর্থ হলো তা বিশুদ্ধ না হওয়ার আক্বীদাহ রাখা। এটিই উপকারী ইলম। অথবা তা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো কালামশাস্ত্র থেকে সম্পূর্ণরূপে মুখ ফিরিয়ে নেয়া অথবা তার প্রতি দৃষ্টি না দেয়া। এতে করেই মানুষের জ্ঞান ও বোধশক্তি সংরক্ষিত হবে। এ দৃষ্টিকোন থেকে ইলমে কালাম সম্পর্কে অজ্ঞতাকেই ইলম হিসাবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।
ইমাম আবু ইউসুফ রহিমাহুল্লাহ থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি কালামশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করবে সে নাস্তিকে পরিণত হবে, যে ব্যক্তি মাটিকে স্বর্ণ বানিয়ে ধনী হওয়ার চেষ্টা করবে, সে হবে সর্বহারা এবং যে ব্যক্তি বিরল ও বিস্ময়কর ঘটনা অনুসন্ধান করতে যাবে, সে মিথ্যুকে পরিণত হবে।
ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ বলেছেন, কালামশাস্ত্রবিদদের ব্যাপারে আমার মত হলো তাদেরকে খেজুর গাছের ডাল ও জুতা দিয়ে পেটানো হবে, মহল্লায় মহল্লায় তাদেরকে ঘুরানো হবে এবং বলা হবে, এ হলো ঐসব লোকদের শাস্তি যারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাত পরিহার করে কালামশাস্ত্রের প্রতি ঝুকে পড়ে।
ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহ কবিতা আকারে আরো বলেন,
كُلُّ الْعُلُومِ سِوَى الْقُرْآنِ مَشْغَلَةٌ ... إِلَّا الْحَدِيثَ وَإِلَّا الْفِقْهَ فِي الدِّينِ
الْعِلْمُ مَا كَانَ فِيهِ قَالَ حَدَّثَنَا ... وَمَا سِوَى ذَاكَ وَسْوَاسُ الشَّيَاطِينِ
কুরআন, হাদীছ এবং দ্বীনের গভীর জ্ঞান ব্যতীত যতো ইলম রয়েছে, তা সবই মূল্যহীন। রাসূলের হাদীছেই রয়েছে প্রকৃত ইলম। এ ছাড়া যতো ইলম রয়েছে, তার সবই শয়তানের কুমন্ত্রনা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
আলেমগণ ফতোয়ায় বলেছেন, রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্রের আওকাফ মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বশীল যদি শহরের আলেমদের জন্য ধন-সম্পদ বন্টন করার ফরমান জারী করে তাহলে উক্ত শহরে বসবাসকারী কালামশাস্ত্রবিদরা তা থেকে কিছুই পাবে না।[1]
এমনিভাবে কোনো আলেম যদি অসীয়ত করে, তার কিতাবগুলো থেকে দ্বীনি কিতাবগুলো যেন ওয়াক্ফ করে দেয়া হয়, তাহলে সালাফগণের ফতোয়া রয়েছে যে, তার মধ্যকার কালামশাস্ত্রীয় কিতাবগুলো বিক্রি করে দিতে হবে। অনুরূপ কথা যাহেরীয়া ফতোয়াতেও উল্লেখিত হয়েছে।
সুতরাং ব্যাপারটি যেহেতু এরকম, তাই রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা ব্যতীত দ্বীনের মূলনীতিগুলোর জ্ঞান কিভাবে অর্জন করা যেতে পারে! কবি কতই না সুন্দর বলেছেন,
أَيُّهَا الْمُغْتَدِي لِيَطْلُبَ عِلْمًا ... كُلُّ عِلْمٍ عَبْدٌ لِعِلْمِ الرَّسُولِ
تَطْلُبُ الْفَرْعَ كَيْ تُصَحِّحَ أَصْلًا ... كَيْفَ أَغْفَلْتَ عِلْمَ أَصْلِ الْأُصُولِ
ওহে জ্ঞানার্জনের পথে প্রত্যুষে গমণকারী! জেনে রাখো! সমস্ত ইলম রাসূলের ইলমের অনুগত। তুমি দ্বীনের মাসায়েল সম্পর্কে ইলম অর্জন করবে, যাতে তার মূলনীতিকে ঠিক করতে পারো? সকল মূলনীতির মূল সম্পর্কে তুমি উদাসীন হলে কিভাবে?
নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমন বাণী প্রদান করা হয়েছে, যাতে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত কালামের সুন্দর সূচনা ও সর্বোত্তম পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সে সাথে তাকে দেয়া হয়েছে এমন সংক্ষিপ্ত কালাম, যার শব্দ কম, কিন্তু তার ব্যাখ্যা অত্যন্ত ব্যাপক, পরিপূর্ণ, সংক্ষিপ্ত এবং উত্তম পদ্ধতিতে পূর্ববতী ও পরবর্তীদের সকল প্রকার ইলমসহ নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীকালে বিদ‘আতীরা যখনই একটি বিদআত তৈরী করেছে, আলেমগণ বিস্তারিতভাবে তার জবাব দিয়েছেন। এ জন্যই পরবর্তী যুগের আলেমদের বক্তব্য হয়েছে অনেক দীর্ঘ, কিন্তু তাতে বরকত হয়েছে কম। কিন্তু পূর্ববর্তীদের কথা ছিল তার বিপরীত। তাদের কথা ছিল অল্প, কিন্তু তাতে বরকত হয়েছে প্রচুর।
কালামশাস্ত্রবিদদের বিভ্রান্ত ও মূর্খদের কথা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা বলে থাকে সালাফদের পথ ও পদ্ধতি অধিক নিরাপদ। আর আমাদের পদ্ধতি হচ্ছে অধিক শক্তিশালী এবং অধিক প্রজ্ঞা ভিত্তিক!! পরবর্তীদের মধ্য হতে যারা নিজেদেরকে ফকীহ বলে দাবি করে, তাদের কথাও এর বিপরীত। তারা বলে থাকে ছাহাবীগণ যেহেতু জিহাদ এবং ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমানা পাহারা দেয়ার কাজে ব্যস্ত ছিলেন, তাই তারা কুরআন ও হাদীছ থেকে ফিকহী মাসায়েল নির্গত করা, তার মূলনীতি ও হুকুম-আহকাম সংরক্ষণ করার সুযোগ পাননি। আর পরবর্তীরা যেহেতু সে কাজের সুযোগ পেয়েছেন, তাই তারা ফিকহী মাসায়েলের ক্ষেত্রে ছাহাবীদের তুলনায় অধিক জ্ঞানী হতে পেরেছেন![2]
সালাফদের মর্যাদার পরিমাণ, তাদের ইলমের গভীরতা, গুরুত্বহীন কাজের প্রতি তাদের আগ্রহের স্বল্পতা এবং তাদের পরিপূর্ণ দূরদর্শিতা ও বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে এ লোকেরা অবগত নয়। আল্লাহর কসম! পূর্ববর্তীদের তুলনায় পরবর্তীদের বৈশিষ্ট্য শুধু এখানেই যে, তারা কেবল গুরুত্বহীন কাজে শ্রম ব্যয় করেছে এবং এমনসব দিকে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, যার মূলনীতিগুলোর প্রতি যত্মবান হওয়া, নিয়ম-কানুন সংরক্ষণ করা এবং তার বন্ধনকে মজবুত করার কাজেই সালাফগণ ব্যস্ত ছিলেন। প্রত্যেক বিষয়ের সুউচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যাওয়াই ছিল সালাফদের একমাত্র প্রচেষ্টা। সুতরাং পরবর্তীরা ব্যস্ত হয়েছে একটি বিষয় নিয়ে এবং পূর্ববর্তীরা ব্যস্ত ছিলেন অন্য একটি বিষয় নিয়ে। আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক জিনিসের জন্য একটি পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন।
আল্লামা ইমাম ইবনে আবীল ইয রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমার পূর্বে অনেকেই আল-আকীদাতুত্ ত্বহাবীয়াহ এর ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু দেখেছি যে, তাদের কতিপয় ব্যাখ্যাকারী এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কালামশাস্ত্রবিদদের নিন্দনীয় কথার প্রতি কর্ণপাত করেছেন, তাদের থেকে শিক্ষা নিয়েছেন এবং তাদের পরিভাষাগুলো ব্যবহার করেছে। সালাফগণ জাওহার, জিসিম, আরায এবং সঠিক অর্থে অনুরূপ অন্যান্য নতুন পরিভাষা ব্যবহার করে কথা বলা অপছন্দ করতেন। যেমন সঠিক ইলমকে ব্যাখ্যা করার জন্য বিভিন্ন পরিভাষা ব্যবহার করা হয়। ঠিক তেমনি সত্যের উপর ঐ শব্দগুলোর নির্দেশনা প্রদান এবং বাতিলপন্থীদের সাথে তর্ক-বিতর্ক করার সময় ঐ শব্দগুলো ব্যবহার করতেন না। কিন্তু এ শব্দগুলো মিথ্যা, বানোয়াট ও সত্যের বিপরীত বিষয় সাব্যস্ত করার জন্য ব্যবহার করাকেই অপছন্দ করেছেন। তাদের শব্দগুলো আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহয় ব্যবহার না হওয়াও তাদের অপছন্দের অন্যতম কারণ। এ জন্যই আপনি সাধারণ মুমিনগণ, বিশেষ করে আলেমদের নিকট যে সুদৃঢ় ইয়াকীন, ঈমান ও মারেফত উপলব্ধি করবেন, কালামশাস্ত্র বিদদের নিকট তা খুঁজে পাবেন না।
কালামশাস্ত্র বিদরা যেসব পরিভাষা ও ভূমিকা পেশ করেছে, তাতে হক-বাতিলের সংমিশ্রণের কারণে অনেক তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, অন্যায় ঝগড়া-বিবাদ হয়েছে এবং অহেতুক সমালোচনা ও অর্থহীন কথা-বার্তা ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে তারা নির্ভেজাল শরীয়াত ও সুস্পষ্ট বোধশক্তির বিপরীত এমন সব কথার উৎপত্তি করেছে, যা এ সংক্ষিপ্ত কিতাবে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।
ইমাম ত্বহাবীর উক্তি, فَمَنْ رَامَ عِلْمَ مَا حُظِرَ عَنْهُ عِلْمُه...الخ এ অংশের ব্যাখ্যা করার সময় উপরোক্ত বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা হবে, ইনশা-আল্লাহ। সালাফদের পথ অনুসরণ করে এবং তাদের বক্তব্য দ্বারাই আমি এ কিতাবটি ব্যাখ্যা করতে চাই। এর মাধ্যমে আমি তাদের পথের পথিক এবং তাদের কাতারে শামিল হতে চাই। যদিও আমাকে তাদের সাথে যোগদান করার আহবান করা হয়নি। আমি ঐসব লোকদের মধ্যে শামিল হতে চাই এবং ঐসব লোকদের সাথে হাশরের দিন উপস্থিত হতে চাই, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقًا﴾
আর যারা আল্লাহ্ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা ঐ সমস্ত লোকের সাথে থাকবে, যাদের উপর আল্লাহ্ অনুগ্রহ করেছেন; তারা হলেন নাবীগণ, সত্যবাদীগণ, শহীদগণ এবং সৎ কর্মশীলগণ। কতই না উত্তম বন্ধু তারা (সূরা আন নিসা, ৪:৬৯)।
এসব লোকদের দলে থাকার সুবাদে আমি পরকালীন সৌভাগ্য অর্জন করতে চাই। মানুষের মনে সংক্ষিপ্ত বিষয়ের প্রতিই আগ্রহ বেশি, এটা আমার দৃষ্টিগোচর হলো, তাই এর ব্যাখ্যা লম্বা না করে সংক্ষিপ্ত করাকেই আমি প্রাধান্য দিলাম।
﴿ وَمَا تَوْفِيقِي إِلَّا بِاللَّهِ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْهِ أُنِيبُ﴾
‘‘যা কিছু আমি করতে চাই তা সবই আল্লাহর তাওফীকের উপর নির্ভর করে। তার উপর আমি ভরসা করেছি এবং সব ব্যাপারে তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করছি’’ (সূরা হুদ ১১:৮৮)। আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি সর্বোত্তম কার্য সম্পাদনকারী।
[হুজ্জাতুল ইসলাম আল্লামা আবু জাফর ওয়ার্রাক আত্-ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ মিসরে অবস্থানকালে বলেছেন:
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টিকুলের রব’।
هَذَا ذِكْرُ بَيَانِ عَقِيدَةِ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ عَلَى مَذْهَبِ فُقَهَاءِ الْمِلَّةِ: أَبِي حَنِيفَةَ النُّعْمَانِ بْنِ ثَابِتٍ الْكُوفِيِّ وَأَبِي يُوسُفَ يَعْقُوبَ بْنِ إِبْرَاهِيمَ الْأَنْصَارِيِّ، وَأَبِي عَبْدِ اللَّهِ مُحَمَّدِ بْنِ الْحَسَنِ الشَّيْبَانِيِّ رِضْوَانُ اللَّهِ عَلَيْهِمْ أَجْمَعِينَ وَمَا يَعْتَقِدُونَ مِنْ أُصُولِ الدِّينِ وَيَدِينُونَ بِهِ رَبَّ الْعَالَمِينَ
ফুকাহায়ে মিল্লাত আবূ হানীফা নুমান বিন সাবেত আল কুফী, আবু ইউসুফ ইয়াকুব ইবনে ইবরাহীম আল-আনসারী এবং আবু আব্দুল্লাহ ইবনুল হাসান শায়বানীর মাযহাব অনুসারে এ পুস্তিকায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আক্বীদাহসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে (আল্লাহ তা‘আলা তাদের সকলের উপর সন্তুষ্ট থাকুন)। দ্বীনের মূলনীতিসমূহের ক্ষেত্রে তারা যে সুদৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করতেন ও যেসব মূলনীতির মাধ্যমে তারা আল্লাহ রাববুল আলামীনের সন্তুষ্টি কামনা করতেন, তা এ কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে।]
>[2]. কোনো কোনো ফিকহী মাযহাবের মুকাল্লিদগণ বলে থাকেন, ছাহাবীদের মধ্যে অনেকেই মুহাদ্দিছ ছিলেন ঠিকই; কিন্তু তারা ফকীহ ছিলেন না। তাদের মাযহাবের যেসব কথা হাদীছের বিপরীত হয়, ঐ হাদীছের রাবী (ছাহাবী) সম্পর্কে তারা বলে যে, তিনি ফকীহ ছিলেন না! তাই এ মাস‘আলায় তার থেকে বর্ণিত হাদীছ গ্রহণযোগ্য নয়; তাদের ইমাম যেহেতু ফকীহ ছিলেন, তাই হাদীছের বিপরীত হলেও ইমামের কথাই আমলযোগ্য। উদাহরণ স্বরূপ তারা আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে বলে থাকে যে, তিনি ফকীহ ছিলেন না!! তাই তারা তাদের কতিপয় মাস‘আলা আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছের বিপরীত হলেও মাযহাবের কথাকেই প্রাধান্য দেয়। মাযহাবী গোঁড়ামির কারণেই তারা এমনটি করে থাকে বলে আমরা মনে করি।
ছাহাবীদের প্রতি পরবর্তীদের এরূপ ধারণা করা ঠিক নয়। ছাহাবীরাই ছিলেন পরবর্তীদের তুলনায় জ্ঞানে ও আমলে সর্বাধিক পরিপূর্ণ। কুরআন ও হাদীছে এর যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাহাবীদের ইলম ও আমলের প্রশংসা করেছেন এবং তাদের পথে চলার উপদেশ দিয়েছেন। সুতরাং পরবর্তীতে যত আলেম ও ফকীহ আগমন করবেন, তাদের কেউই ইলম, ফিকহ এবং অন্যান্য গুণাবলীতে ছাহাবীদের ধারেকাছেও পৌঁছতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত।
(১) ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
نَقُولُ فِي تَوْحِيدِ اللَّهِ مُعْتَقِدِينَ بِتَوْفِيقِ اللَّهِ: إِنَّ اللَّهَ وَاحِدٌ لَا شَرِيكَ لَهُ
মহান আল্লাহর তাওফীকের[1] প্রতি অন্তর দিয়ে একান্ত বিশ্বাস রেখে তার তাওহীদ সম্পর্কে আমরা বলছি যে, নিশ্চয় আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, তার কোনো শরীক নেই।
ব্যাখ্যা: প্রিয় পাঠক! আপনি জেনে রাখবেন যে, তাওহীদই ছিল নাবী-রসূলদের সর্বপ্রথম দাওয়াত, দুনিয়া ও আখেরাতের সাফল্যের পথে অগ্রসর হওয়ার সর্বপ্রথম সোপান এবং আল্লাহ তা‘আলার সান্নিধ্যে পৌঁছার জন্য বান্দার সর্বপ্রথম ধাপ। সূরা আল আরাফের ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ﴾
‘নিশ্চয় আমি ‘নুহ’কে তার সম্প্রদায়ের প্রতি পাঠিয়েছি। তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই। তা না করলে আমি তোমাদের উপর একটি মহা দিবসের শাস্তির আশঙ্কা করছি’। একই সূরার ৬৫ নং আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
﴿وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ أَفَلَا تَتَّقُونَ﴾
‘আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদেরই ভাই ‘হুদ’কে। তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই। আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَإِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ﴾
‘আর সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদেরই ভাই ‘সালেহকে। তিনি বললেন, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই’ (সূরা আল আরাফ ৭:৭৩)। আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ﴾
‘আমি মাদায়েনের প্রতি তাদের ভাই ‘শুআইব’কে প্রেরণ করেছি। সে বললো হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্র ইবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোনো সত্য উপাস্য নেই’ (সূরা আল আরাফ: ৮৫)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ﴾
‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল পাঠিয়েছি। তার মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুত থেকে দূরে থাকো’ (সূরা আন নাহল ১৬:৩৬)।
নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ»
‘আমাকে মানুষের সাথে ততোক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ করার আদেশ দেয়া হয়েছে যতোক্ষণ না তারা এ কথার স্বীকৃতি দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রসূল’।[2]
সুতরাং সঠিক কথা হচ্ছে প্রাপ্ত বয়স্কের উপর সর্বপ্রথম ফরয হলো লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর সাক্ষ্য প্রদান করা। স্রষ্টার পরিচয় লাভ করার জন্য কিংবা প্রভুর মারেফত হাসিলের উদ্দেশ্য চিন্তা-গবেষণা করা অথবা স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দে থাকা মোটেই বৈধ নয়।[3]
বরং সালাফদের সকল ইমামের ঐক্যমতে বান্দার উপর সর্বপ্রথম আবশ্যক হলো তাওহীদ ও রেসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করা। তারা আরো ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, কোন মানুষ প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগে উহার সাক্ষ্য প্রদান করে থাকলে, বালেগ হওয়ার পর তাকে ঐ সাক্ষ্য নবায়ন করার আদেশ প্রদান করা হবে না।
বরং প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর অথবা ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করার বোধশক্তি অর্জন করার পরপরই তাকে পবিত্রতা অর্জন, ছলাতের মাসায়েল শিক্ষা এবং তা বাস্তবায়ন করার আদেশ দেয়া হবে। কোনো ইমাম এটি আবশ্যক করেননি যে, সন্তান প্রাপ্ত বয়স্ক হলে অভিভাবক তার সন্তানকে তাওহীদ ও রেসালাতের সাক্ষ্য নবায়ন করার আদেশ করবে। যদিও তার স্বীকারোক্তি প্রদান করা সকল ইমামের ঐকমত্যে মুসলিম হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম ওয়াজিব এবং ছলাত আবশ্যক হওয়ার পূর্বেই তার স্বীকারোক্তি প্রদান করা জরুরী।
কিন্তু সে যেহেতু ছলাত ফরয হওয়ার বয়সে উপনীত হওয়ার আগেই তাওহীদ ও রেসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করেছে, তাই এখন তার পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন নেই।
এখানে এমন কিছু মাস‘আলা রয়েছে, যা ফকীহগণ তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন। যেমন প্রকাশ্যে তাওহীদ ও রেসালাতের সাক্ষ্য প্রদান করার পূর্বেই কেউ ছ্বলাত কায়েম করল কিংবা ইসলামের অন্য কোনো কাজ সম্পন্ন করলো, কিন্তু প্রকাশ্যে তাওহীদ ও রেসালাতের সাক্ষ্য দিলো না, সে মুসলিম হিসাবে গণ্য হবে কি না?
এ ক্ষেত্রে সঠিক কথা হলো ইসলামের কাজগুলো সম্পাদন করার মাধ্যমে সে মুসলিম হিসাবে গণ্য হবে। সুতরাং তাওহীদই হলো এমন বিষয়, যার মাধ্যমে মানুষ ইসলামে প্রবেশ করে এবং তাওহীদই শেষ বিষয়, যা নিয়ে বান্দা দুনিয়া থেকে বের হয়ে যায়। যেমন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ كَانَ آخِرُ كَلَامِهِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ دَخَلَ الْجَنَّةَ»
‘‘দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার সময় যার শেষ বাক্য হবে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’।[4]
সুতরাং লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ সর্বপ্রথম ওয়াজিব এবং এটিই সর্বশেষ ওয়াজিব।
">জানা উচিত, যে তাওহীদসহ আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলগণকে পাঠিয়েছেন এবং যাসহ সমস্ত আসমানী কিতাব নাযিল হয়েছে, তার তিনটি অংশ রয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহর ভাষ্যসমূহ যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই তা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রথম অংশ হলো তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ: আর তা হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলাকে তার মহান কর্মগুলোতে একক সত্তা হিসাবে বিশ্বাস করা এবং ঈমান রাখা যে, মহান আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা, রিযিকদাতা, সৃষ্টিজগতের সকলের কার্যাবলী পরিচালনাকারী, তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণকারী। এগুলোতে তার কোনো শরীক নেই। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, (اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ ) ‘আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা’ (সূরা যুমার: ৬২)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ
‘নিশ্চয়ই তোমাদের রব আল্লাহ, যিনি ছয়দিনে আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন, তিনি সবকিছু পরিচালনা করেন। এমন কোন শাফায়াতকারী নেই, যে তার অনুমতি ছাড়া শাফায়াত করতে পারে। আল্লাহই হচ্ছেন তোমাদের রব। কাজেই তোমরা তারই ইবাদত করো। এরপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?’ (সূরা ইউনুস: ৩)।
তাওহীদের এ অংশে আরবের মুর্তিপূজারী মুশরিকরা ঈমান রাখতো, যদিও তাদের অধিকাংশই পুনরুত্থান ও হাশর-নাশর অস্বীকার করত। কিন্তু এ ঈমান তাদেরকে ইসলামে প্রবেশ করায়নি। কারণ তারা আল্লাহর সাথে অন্যান্য বাতিল মাবুদকে শরীক করতো, তার ইবাদতের সাথে মূর্তি ও অন্যান্য বস্তুরও ইবাদত করতো এবং তারা রসূল মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর ঈমান আনয়ন করেনি।
দ্বিতীয় অংশ হচ্ছে তাওহীদুল ইবাদাহ: যাকে তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ বলেও নামকরণ করা হয়ে থাকে। আর উলুহিয়্যাহ অর্থই ইবাদত। তাওহীদের এ অংশটিই মুশরিকরা অস্বীকার করেছিল, যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা তাদের থেকে উল্লেখ করেছেন, তার নিমেণাক্ত বাণীতে,
وَعَجِبُوا أَنْ جَاءَهُمْ مُنْذِرٌ مِنْهُمْ وَقَالَ الْكَافِرُونَ هَذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ
‘আর কাফেররা আশ্চর্য হলো যে, তাদের কাছে তাদের মধ্য থেকেই একজন ভীতি প্রদর্শনকারী আসলো এবং কাফেররা বললো, এ তো যাদুকর, মিথ্যাবাদী। সে কি সব ইলাহকে এক ইলাহ বানিয়ে দিয়েছে? নিশ্চয় এটি এক আশ্চর্য বিষয়’ (সূরা সোয়াদ: ৪-৫)। অনুরূপ আরও বহু আয়াত রয়েছে।
তাওহীদের এ অংশ ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য হওয়া, তিনিই একমাত্র ইবাদতের যোগ্য সত্তা হওয়া এবং তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত বাতিল হওয়া সাব্যস্ত করে। এটিই কালেমা লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ এর প্রকৃত অর্থ। কেননা এ কালেমার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ذَٰلِكَ بِأَنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦ هُوَ ٱلباطِلُ
‘এটা এজন্য যে, আল্লাহই একমাত্র সত্য মাবুদ, তাকে ছাড়া তারা অন্য যাকেই আহবান করে সে সবই বাতিল’। (সূরা আল-হাজ্জ: ৬২)
তৃতীয় অংশ হলো তাওহীদুল আসমা ওয়াস সিফাত: আর তা হচ্ছে, আল্লাহ তা‘আলার কিতাবে এবং রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ছহীহ সুন্নাহতে আল্লাহ তা‘আলার যেসব অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণ সেগুলোর উপর ঈমান আনয়ন করা, সেগুলোকে মহান আল্লাহর জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতে সাব্যস্ত করা এবং কোনো প্রকার বিকৃতি কিংবা অস্বীকার অথবা কোনো প্রকার ধরণ নির্ধারণ বা সাদৃশ্য নির্ণয় ব্যতীত তাতে বিশ্বাস করা। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু বলেন,
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ (1) اللَّهُ الصَّمَدُ (2) لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ (3) وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
‘বলো, তিনি আল্লাহ, এক ও অদ্বিতীয়। আল্লাহ অমূখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং তাকেও জন্ম দেয়া হয়নি এবং তার সমতুল্য কেউই নেই’। (সূরা আল-ইখলাস: ১-৪) তিনি আরও বলেন,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِير
‘তার সদৃশ কোনো কিছু নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা’। (সূরা আশ-শূরা: ১১)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন,
وَلِلَّهِ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ فَادْعُوهُ بِهَا وَذَرُوا الَّذِينَ يُلْحِدُونَ فِي أَسْمَائِهِ ۚ سَيُجْزَوْنَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘আর আল্লাহর জন্যই রয়েছে অতি সুন্দর নামসমূহ। সুতরাং তোমরা তাকে সেগুলো দিয়েই আহবান করো এবং তার নামের ব্যাপারে যারা সত্য থেকে বিচ্যুত, তাদেরকে বর্জন করো। তারা যা কিছু করছে তার ফল অবশ্যই পাবে’। (সূরা আল-আরাফ: ১৮০)
অনুরূপ আল্লাহ সুবহানাহু সূরা আন-নাহলের ৬০ নং আয়াতে বলেন,
وَلِلَّهِ الْمَثَلُ الْأَعْلَىٰ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
‘আর আল্লাহর জন্যই উত্তম উদাহরণ, আর তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়’’ এ অর্থে আরও অনেক আয়াত রয়েছে। এখানে উত্তম উদাহরণ বলতে এমন সুউচ্চ গুণাগুণ বুঝানো হয়েছে, যাতে কোনো অপূর্ণতা নেই। আর এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত তথা রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সকল ছাহাবী, উত্তমভাবে তাদের অনুসরণকারী তাবেঈগণের অভিমত যে, তারা আল্লাহর সিফাত তথা গুণাগুণ সম্পন্ন আয়াত ও হাদীছসমূহকে যেভাবে এসেছে সেভাবে ছেড়ে দিতেন, সেগুলোর অর্থকে মহান আল্লাহ সুবহানাহুর জন্য সদৃশ নির্ধারণ ছাড়াই সাব্যস্ত করতেন।
অনুরূপভাবে তারা মহান আল্লাহ সুবহানাহুকে তার সৃষ্টির কারও সাথে তুলনা করা থেকে পবিত্র করতেন। কিন্তু সেগুলোকে (কুরআন ও হাদীছে) উল্লেখিত গুণাগুণ সম্পন্ন ভাষ্যসমূহকে তারা অর্থহীন করতেন না। আর তারা যা বলেছেন সেটার মাধ্যমেই কুরআন ও সুন্নাহর দলীলসমূহ একই সূত্রে গাঁথা সম্ভব এবং এর মাধ্যমেই যারা তাদের বিরোধিতা করবে তাদের বিরুদ্ধে দলীল-প্রমাণাদি উপস্থাপন ও প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আর মহান আল্লাহর নিমেণাক্ত বাণীতে তাদেরকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে:
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
আর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা প্রথম অগ্রগামী এবং যারা ইহসানের সাথে তাদের অনুসরণ করে আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তার উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর তিনি তাদের জন্য তৈরী করেছেন জান্নাত, যার নিচে নদী প্রবাহিত, সেখানে তারা চিরস্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য। (সূরা আত-তাওবা: ১০০)
মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা, তিনি যেন তার একান্ত অনুগ্রহে আমাদেরকে তাদের অন্তর্ভুক্ত করেন। আল্লাহই সাহায্যকারী।
--------------
[1]. শাইখের এ কথার মধ্যে যুক্তিবিদ, দার্শনিক ও কালামশাস্ত্রবিদ এবং আহলে সুন্নাতের আলেমদের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। যুক্তিবিদ ও দার্শনিকরা স্রষ্টার পরিচয় এবং অন্যান্য বিষয় সাব্যস্ত করতে গিয়ে বিবেক-বোধশক্তি ও যুক্তির উপর নির্ভর করে থাকে। কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের লোকেরা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা আল্লাহর পরিচয় এবং অন্যান্য যেসব গায়েবী বিষয়ের ক্ষেত্রে সঠিক আক্বীদাহ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন, তা কেবল আল্লাহ তা‘আলার তাওফীক এবং তার অশেষ অনুগ্রহের কারণেই তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। মূলতঃ তারা অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও আল্লাহর তাওফীকের উপর নির্ভর করেন।
[2]. ছহীহ বুখারী হা/২৫ ও ছহীহ মুসলিম হা/২০, আবূ দাউদ হা/২৬৪১, তিরমিযী হা/২৬০৮।
[3]. মুতাযেলা এবং অন্যান্য বিদ‘আতীদের মতে ঈমান ও গায়েবী বিষয়সমূহের ব্যাপারে চিন্তা-গবেষণা করাই প্রাপ্ত বয়স্কের উপর সর্বপ্রথম আবশ্যক। নাউযুবিল্লাহ
[4]. ছহীহ: সুনানে আবু দাউদ, হা/৩১১৬।
তাওহীদ ইসলামের সর্বপ্রথম বিষয় এবং তাওহীদই ইসলামের সর্বশেষ বিষয়। এখানে তাওহীদ দ্বারা তাওহীদুল উলুহীয়াহ উদ্দেশ্য। কেননা সাধারণভাবে তাওহীদ শব্দটি ব্যবহার করলে তা দ্বারা তাওহীদুল উলুহিয়াকেই বুঝায়। অথচ সালাফগণ কুরআন এবং হাদীছ অনুসন্ধান ও গবেষণা করে মোট তিন প্রকার তাওহীদের সন্ধান পেয়েছেন।
(১) আল্লাহ তা‘আলার সু্উচ্চ গুণাবলী সম্পর্কিত তাওহীদ
(২) আল্লাহর রুবুবীয়াত সম্পর্কিত তাওহীদ। রুবুবীয়াতের মর্মার্থ হলো, আল্লাহ তা‘আলাই প্রত্যেক জিনিসের একমাত্র স্রষ্টা, প্রভু এবং
(৩) তাওহীদুল উলুহীয়াহ। আর তা হলো এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাই ইবাদতের একমাত্র হকদার। তার এবাদতে অন্য কোনো শরীক নেই।
প্রথম প্রকার তাওহীদ সম্পর্কে কথা হলো আল্লাহর সিফাতসমূহে অবিশ্বাসীরা তার সুউচ্চ সিফাতগুলোকে অস্বীকার করাকেই তাওহীদ হিসাবে নামকরণ করেছে। যেমন জাহাম বিন সাফওয়ান এবং তার অনুসারীরা আল্লাহ তা‘আলার সুউচ্চ গুণাবলীকে অস্বীকার করাকেই তাওহীদ হিসাবে নাম দিয়েছে। তারা বলেছে, আল্লাহ তা‘আলার জন্য একাধিক সিফাত সাব্যস্ত করা হলে একাধিক চিরস্থায়ী এবং অবিনশ্বর সত্তার অস্তিত্ব আবশ্যক হয়। বোধশক্তির দলীল জাহামের কথাটিকে বাতিল সাব্যস্ত করে। কেননা সিফাত ছাড়া মস্তিস্কের বাইরে কোনো সত্তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।[1] মস্তিস্ক কখনো কখনো অসম্ভব এবং অবাস্তব বস্তু সাব্যস্ত ও কল্পনা করে। কিন্তু বাস্তবে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।
আল্লাহর সিফাতসমূহ সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে জাহমীয়াদের কথা খুবই ক্ষতিকর। কারণ স্রষ্টার সিফাতকে অস্বীকার করার মাযহাব থেকেই সর্বেশ্বরবাদের জন্ম নিয়েছে। আর এ মাযহাব দু’টি খৃষ্টানদের কুফরীর চেয়েও অধিক নিকৃষ্ট। কেননা খৃষ্টানরা শুধু ঈসা আলাইহিস সালামের মধ্যে আল্লাহর অবতরণের আক্বীদাহ পোষণ করে। আর এরা বলে সবকিছুর মধ্যেই আল্লাহ তা‘আলা অবতরণ করেন। জাহমীয়াদের তাওহীদের সমর্থন করার অর্থ এ দাঁড়ায় যে, ফেরাউন এবং তার সম্প্রদায়ের সকল লোকই ছিল পূর্ণ ঈমানদার এবং তাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার প্রকৃত মারেফত হাসিল হয়েছিল। তারা মারেফতের সাগরেই ডুবে মরেছিল। নাউযুবিল্লাহ
জাহমীয়ারা যে ধরণের তাওহীদে বিশ্বাসী, তার মধ্যে এও রয়েছে যে, মূর্তিপূজকরাও হকের উপর আছে। তারা মূর্তির ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করছে; অন্য কারো নয়।[2]
জাহমীয়াদের তাওহীদের মাসআলা সমূহের মধ্যে এও রয়েছে যে, মা কিংবা বোন এবং দূরের মহিলাদেরকে বিবাহ করার ব্যাপারে হালাল-হারামের কোনো পার্থক্য নেই। এমনি পানি ও মদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই এবং বিবাহের মাধ্যমে স্ত্রীসহবাস করা কিংবা যেনা করার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এসব কিছুকেই এক চোখে দেখতে হবে; শুধু তাই নয়, সবই এক। তাদের তাওহীদের অংশ এটিও যে, নাবীগণ প্রশস্ত বিষয়গুলো মানুষের উপর সংকীর্ণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাদের কথার সম্পূর্ণ উর্ধ্বে।
দ্বিতীয় প্রকার তাওহীদ হলো আল্লাহর রুবুবীয়াত সম্পর্কিত তাওহীদ। আর তা হলো, এ স্বীকারোক্তি প্রদান করা যে, আল্লাহ তা‘আলাই সবকিছুর স্রষ্টা। সৃষ্টিজগতের এমন একাধিক স্রষ্টা নেই, যারা গুণাবলী ও কর্মসমূহে পরস্পর সমপর্যায়ের। এ প্রকার তাওহীদ সত্য। এতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক কালামশাস্ত্রবিদ, যুক্তিবিদ এবং একদল সুফীর নিকট এ প্রকার তাওহীদই মূল উদ্দেশ্য। বনী আদমের মধ্যে প্রসিদ্ধ কোনো দল এ প্রকার তাওহীদকে অস্বীকার করেনি। বরং আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য সৃষ্টির অস্তিত্বকে মানুষের অন্তর-এ যেভাবে স্বীক…ৃত দেয়, তার চেয়ে আরো বেশী স্বীকৃতি প্রদান করে তাওহীদে রুবুবীয়াহ এর প্রতি।
আল্লাহ তা‘আলা তার রসূলদের সম্পর্কে সূরা ইবরাহীমের ১০ নং আয়াতে বলেন,
﴿قَالَتْ رُسُلُهُمْ أَفِي اللَّهِ شَكٌّ فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ﴾
‘‘তাদের রসূলগণ বলেছেন, আল্লাহর ব্যাপারে কোনো সন্দেহ আছে কি, যিনি আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা?’’
স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে যারা অজ্ঞ ছিল এবং যারা প্রকাশ্যে তা অস্বীকার করেছিল, তাদের মধ্যে ফেরআউনের নাম সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। তবে সেও গোপনে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো। যেমন মুসা আলাইহিস সালাম ফেরআউনকে বলেছিল,
﴿ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنزَلَ هَٰؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ وَإِنِّي لَأَظُنُّكَ يَا فِرْعَوْنُ مَثْبُورًا﴾
‘‘তুমি অবশ্যই জানো এ প্রজ্ঞাময় নিদর্শনগুলো আকাশ ও পৃথিবীর রব ছাড়া আর কেউ নাযিল করেননি। হে ফেরাউন! আমার মনে হয় তুমি নিশ্চয় একজন হতভাগ্য ব্যক্তি’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ১০২) আল্লাহ তা‘আলা ফেরআউন এবং তার সম্পর্কে আরো বলেন,
﴿وَجَحَدُوا بِهَا وَاسْتَيْقَنَتْهَا أَنفُسُهُمْ ظُلْمًا وَعُلُوًّا ۚ فَانظُرْ كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الْمُفْسِدِينَ﴾
‘‘তারা একেবারেই অন্যায়ভাবে এবং অহংকারের সাথে নিদর্শনগুলো অস্বীকার করলো অথচ তাদের এ মগজ সেগুলোর সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল। বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদের পরিণাম কী হয়েছিল, তা দেখে নাও’’। (সূরা আন নামাল ২৭:১৪)
এ জন্যই ফেরাউন যখন স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে জেনেও না জানার ভান করে অস্বীকারের সুরে বলেছিল, وما رب العالمين؟ ‘‘কে সেই সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক?’’ তবে সে গোপনে আল্লাহর রুবুবীয়াতের প্রতি ঈমান রাখতো। যেমন মুসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনকে বলেছিল,
﴿قَالَ رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا إِن كُنتُم مُّوقِنِينَ قَالَ لِمَنْ حَوْلَهُ أَلَا تَسْتَمِعُونَ قَالَ رَبُّكُمْ وَرَبُّ آبَائِكُمُ الْأَوَّلِينَ قَالَ إِنَّ رَسُولَكُمُ الَّذِي أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ لَمَجْنُونٌ قَالَ رَبُّ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَمَا بَيْنَهُمَا إِن كُنتُمْ تَعْقِلُونَ﴾
‘‘মূসা জবাব দিল, তিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর রব এবং আকাশ ও পৃথিবীর মাঝখানে যা কিছু আছে সেগুলোর রব, যদি তোমরা নিশ্চিত বিশ্বাস স্থাপনকারী হও। ফেরাউন তার আশপাশের লোকদের বললো, তোমরা শুনছো তো? মূসা বললো, তোমাদেরও রব এবং তোমাদের ঐসব বাপ-দাদারও রব, যারা অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ফেরাউন বললো, তোমাদের কাছে প্রেরিত রসূল তো দেখছি একেবারেই পাগল। মূসা বললো, পূর্ব ও পশ্চিম এবং যা কিছু তার মাঝখানে আছে তিনি সবার রব, যদি তোমরা কিছু বুদ্ধি-জ্ঞানের অধিকারী হতে’’। (সূরা আশ শূরা ৪২:২৪-২৮)
এক শ্রেণীর লোক মনে করেছে যে, ফেরাউন মুসাকে স্রষ্টার হাকীকত, সিফাত ও প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিল। আর স্রষ্টার যেহেতু কোনো সিফাত, হাকীকত ও প্রকৃত অবস্থা ছিল না, তাই মুসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনের সামনে স্রষ্টার সিফাত ও প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করতে অক্ষম হয়েছিলেন।
তাদের এ কথা সম্পূর্ণ ভুল। মূলতঃ ফেরাউন সত্য প্রত্যাখ্যান ও তা কবুল করতে অস্বীকার করার জন্যই মুসা আলাইহিস সালামকে প্রশ্ন করেছিল। কুরআনের আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, ফেরাউন আল্লাহর প্রতি কুফরী করেছিল এবং তার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ছিল। সে আল্লাহর অস্তিত্ব সাব্যস্ত করতো না যে, সে আল্লাহর সিফাত ও প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানার আবেদন করতে পারে। এ জন্যই মুসা আলাইহিস সালাম ফেরাউন এবং তার সম্প্রদায়ের লোকদেরকে বলেছিল, আল্লাহ তা‘আলার পরিচয় খুবই সুস্পষ্ট। আল্লাহর আয়াতসমূহ এবং তার রুবুবীয়াতের প্রমাণাদি এত সুস্পষ্ট যে, তার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করার কোন দরকার নেই। বরং আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এতই পরিচিত, প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট যে, তার সম্পর্কে অজ্ঞতার কোনো স্থান নেই। প্রত্যেক পরিচিত ও সুস্পষ্ট বিষয়ের তুলনায় স্রষ্টার মারেফতই সৃষ্টির প্রকৃতি ও স্বভাবের মধ্যে সর্বাধিক প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।
কোনো সম্প্রদায় সম্পর্কেই জানা যায়নি যে, সৃষ্টিজগতের জন্য পরস্পর সমান গুণাবলী ও কার্যাবলী সম্পন্ন দু’জন স্রষ্টা রয়েছে। অগ্নিপূজকদের ‘ছানুবীয়া’ এবং মানুবীয়া সম্প্রদায় দু’স্রষ্টায় বিশ্বাসী। তারা আলো এবং অন্ধকারকে স্রষ্টা মনে করে। তারা আরো বলে এ দু’স্রষ্টার দ্বারা সৃষ্টিজগতের সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে। তবে তারা সকলেই একমত যে, আলো অন্ধকারের চেয়ে ভালো। আলোই প্রশংসিত মাবুদ। আর অন্ধকার হলো নিকৃষ্ট ও নিন্দনীয়। তবে তারা অন্ধকারের ব্যাপারে মতভেদ করেছে। সেটিও আলোর মত অবিনশ্বর ও চিরন্তন সত্তা কি না, এ ব্যাপারে পরস্পর মতভেদ করেছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে তারা সমান মর্যাদাসম্পন্ন দু’জন রবের অস্তিত্ব সাব্যস্ত করেনি।
যেসব খ্রিষ্টান তিন মাবুদের অস্তিত্বে এবং তিন মাবুদের ইবাদতে বিশ্বাসী, তারা সৃষ্টিজগতের জন্য এমন তিন প্রভুর অস্তিত্ব সাব্যস্ত করে না, যাদের প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র-স্বনির্ভর ও পরস্পর আলাদা। বরং তারা সকলেই একমত যে, সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা একজন মাত্র। তাই তারা কাজ-কর্ম শুরু করার পূর্বে বলে থাকে, পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মার নামে শুরু করছি। উপাস্য মাত্র একক সত্তা। তৃত্ববাদ সম্পর্কে তাদের কথা মূলতঃই পরস্পর সাংঘর্ষিক।
ঈসা আলাইহিস সালামের মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা অবতীর্ণ হওয়া সম্পর্কে তাদের কথা আরো বেশি ভ্রান্ত। এ জন্যই স্রষ্টা সম্পর্কে তাদের বুঝ এলোমেলো। স্রষ্টার পরিচয় তুলে ধরতেও তারা এলোমেলো কথা বলে থাকে। তাদের কেউ স্রষ্টা সম্পর্কে এমন কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করে না, যার অর্থ বোধগম্য এবং খৃষ্টানদের দুইজন এক কথায় একমতও হতে পারে না। তারা বলে, তিনি স্বীয় সত্তায় এক, মূলে তিন। তারা কখনো কখনো মূলনীতিগুলোকে বিশেষ বিশেষ স্বভাব, কখনো স্রষ্টার বিভিন্ন গুণাবলী এবং কখনো বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা ব্যাখ্যা করে থাকে। ভালোভাবে চিন্তা-গবেষণা করলে দেখা যায়, আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে এ কথাগুলো ভুল হওয়ার বিষয়টি উপলব্ধি করার যোগ্যতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। মোটকথা তারা পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ দুই স্রষ্টা সাব্যস্ত করে না।
এখানে উদ্দেশ্য হলো, কোনো সম্প্রদায়ই সৃষ্টিজগতের জন্য পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ দুই স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না। অথচ অনেক কালামশাস্ত্রবিদ, যুক্তিবিদ এবং দার্শনিক এক স্রষ্টার অস্তিত্ব সাব্যস্ত করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। তাদের কেউ কেউ বোধশক্তির দ্বারা একক স্রষ্টা সাব্যস্ত করার প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে নিজের অক্ষমতার স্বীকৃতি দিয়েছে। পরিশেষে সে ধারণা করেছে যে, আসমানী কিতাবের দলীল থেকেই স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে হবে।
তবে যুক্তিবিদ ও কালামশাস্ত্র বিদগণের প্রসিদ্ধ মত এ যে, বোধশক্তির দলীল দ্বারাই এক আল্লাহর অস্তিত্ব সাব্যস্ত করতে হবে। আর তা এ যে, সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা যদি দুই হয়ে থাকে, তাহলে তাদের মধ্যে মতভেদ হওয়ার সময় তাদের এক স্রষ্টা কোনো একটি সৃষ্টিকে নড়াতে চাইলে এবং অন্য স্রষ্টা সে সৃষ্টিকে স্থীর রাখতে চাইলে অথবা তাদের এক স্রষ্টা তাকে জীবিত রাখতে চাইলে এবং অপর স্রষ্টা তাকে মেরে ফেলতে চাইলে সম্ভবত দুই মাবুদের ইচ্ছাই জয়ী হবে অথবা তাদের এক স্রষ্টার উদ্দেশ্য সফল হবে কিংবা কারো ইচ্ছাই পূরণ হবে না।
প্রথমটি অসম্ভব। কেননা এতে পরস্পর বিপরীতমূখী দু’টি বিষয় একসাথে মিলিত হওয়া আবশ্যক হয়। তৃতীয়টিও অসম্ভব। কেননা তাতে মানুষের শরীর নড়াচড়া করা এবং স্থির হওয়া থেকেও মুক্ত হওয়া আবশ্যক করে। আর এটি অসম্ভব। সেই সাথে প্রত্যেক স্রষ্টার অক্ষমতাও প্রমাণিত হয়। অক্ষম কখনো মাবুদ হতে পারে না।
আর যখন দুই স্রষ্টার মধ্যকার এক স্রষ্টার ইচ্ছা বাস্তবায়িত হবে এবং অন্যটির উদ্দেশ্য পূরণ হবে না, তখন সক্ষম স্রষ্টাই মাবুদ হিসাবে গণ্য হবেন এবং অন্য অক্ষম স্রষ্টা উলুহীয়াতের হকদার হওয়ার অযোগ্য হবে। উপরোক্ত মূলনীতিটি সম্পর্কে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। অনেক যুক্তিবিদ ধারণা করে যে, আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর অর্থই হলো বোধশক্তির দলীল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَوْ كَانَ فِيهِمَا آَلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ﴾
‘‘যদি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্য থাকতো, তবে আসমান-যমীন বিধ্বস্ত হয়ে যেতো। অতএব তারা যা বলে, তা থেকে আরশের অধিপতি আল্লাহ্ পবিত্র’’। (সূরা আল আম্বীয়া ২১:২২)
কেননা তাদের বিশ্বাস হলো, তারা যেই তাওহীদে রুবুবীয়াত সাব্যস্ত করেছে তা হলো সেই তাওহীদে উলুহীয়াহ, যার বর্ণনা রয়েছে কুরআনে। রসূলগণ এ তাওহীদের দিকেই আহবান জানিয়েছেন। মূলত বিষয়টি এ রকম নয়। বরং রসূলগণ যে প্রকার তাওহীদের দিকে আহবান জানিয়েছেন এবং যে বিষয়ের দাওয়াতসহ আসমানী কিতাবগুলো নাযিল হয়েছে, তা হলো তাওহীদুল উলুহীয়াহ। তবে ইহা তাওহীদে রুবুবীয়াকেও আবশ্যক করে।
তাওহীদে উলুহীয়াতের অর্থ হলো এককভাবে আল্লাহর ইবাদত করা, তার কোনো শরীক নেই। আরবের মুশরিকরা তাওহীদে রুবুবীয়াকে স্বীকার করতো। এ বিশ্বাস করাও তাওহীদে রুবুবীয়াতের অন্তর্ভুক্ত যে, আসমান ও যমীনের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ﴾
‘‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তবে অবশ্যই তারা বলবে, আল্লাহ্। (সূরা লুকমান: ২৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قُل لِّمَنِ الْأَرْضُ وَمَن فِيهَا إِن كُنتُمْ تَعْلَمُونَ سَيَقُولُونَ لِلَّهِ قُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ﴾
‘‘তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, যদি তোমরা জানো তাহলে বলো এ পৃথিবী এবং এর মধ্যে যা বাস করে তা কার? তারা নিশ্চয়ই বলবে, আল্লাহর। বলো, তাহলে তোমরা ভয় করছো না কেন?’’ (সূরা মুমিনুন: ৮৪-৮৫)
এ রকম আয়াত কুরআনে অনেক রয়েছে। মক্কার মুশরিকরা এ বিশ্বাস করতো না যে, তাদের মূর্তিগুলো সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি করার কাজে আল্লাহর অংশীদার। বরং তাদের অবস্থা ভারতীয়, তুর্কী, বারবার এবং অন্যান্য মুশরিক জাতির মতোই ছিল। তারা কখনো কখনো মনে করতো তাদের মূর্তিগুলো নাবী-রসূল এবং সৎ লোকদের ছবি ছাড়া অন্য কিছু নয়। তারা এগুলোকে আল্লাহর নিকট সুপারিশকারী এবং আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছিল। এটিই ছিল আরবদের শির্কের মূল বিষয়। আল্লাহ তা‘আলা নূহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায়ের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
﴿وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا﴾
‘‘তারা বলেছে: তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করো না এবং পরিত্যাগ করো না ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নসরকে’’ (সূরা নূহ: ২৩)।
ছহীহ বুখারী এবং তাফসীরের কিতাবসমূহ, নাবীদের ঘটনাসমূহ এবং অন্যান্য কিতাবসমূহে ছহীহ সূত্রে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এবং অন্যান্য সালাফ হতে বর্ণিত হয়েছে, উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় তারা বলেছেন, এগুলো হচ্ছে নূহ আলাইহিস সালামের জাতির সৎ লোকদের নাম। এ সৎব্যক্তিগণ যখন মারা গেল তখন তাদের অনুসারীরা তাদের কবরের উপর অবস্থান করতে লাগলো। অতঃপর তাদের মূর্তি নির্মাণ করল। এভাবে যখন দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলো, তখন তারা এ মূর্তিগুলোর ইবাদত শুরু করে দিলো। এ মূর্তিগুলো হুবহু আরব গোত্রগুলোর কাছে পৌঁছেছিল। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একটি একটি করে গোত্রগুলোর নাম উল্লেখ করেছেন।
ছহীহ মুসলিমে আবুল হাইয়াজ আল-আসাদী হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু একদা আমাকে বললেন,
أَلَا أَبْعَثُكَ عَلَى مَا بَعَثَنِي عَلَيْهِ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أمرني أن لا أدع صُورَةً إِلَّا طَمَسْتَهَا و لَا تَدَعَنَّ قَبْرًا مُشْرِفًا إِلَّا سَوَّيْتَهُ
‘আমি কি তোমাকে এমন কাজে পাঠাবো না, যে কাজে স্বয়ং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে পাঠিয়েছিলেন? তিনি আমাকে আদেশ দিয়েছিলেন, কোন প্রাণীর ছবি দেখলেই তা বিলুপ্ত না করে ছাড়বে না। আর কোনো উচু কবরকে মাটির সমান না করে ছাড়বে না’’।[3]
ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি মৃত্যু শয্যায় থাকা অবস্থায় বলেছেন,
لَعْنَةُ اللَّهِ عَلَى الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ» يُحَذِّرُ مَا صَنَعُوا قالت عائشة لَوْلاَ ذَلِكَ لأُبْرِزَ قَبْرُهُ ولكن كره أَنْ يُتَّخَذَ مَسْجِدًا
‘‘ইহুদী-খৃষ্টানদের প্রতি আল্লাহর লা’নত। তারা তাদের নাবীদের কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করেছে। ইহুদী-নাসারাদের শির্কী কাজ থেকে মুমিনদেরকে সতর্ক করাই ছিল এ কথার উদ্দেশ্য। আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, কবরকে ইবাদতখানায় পরিণত করার আশঙ্কা না থাকলে তার কবরকে উঁচু স্থানে উন্মুক্ত রাখা হতো। কিন্তু তার কবরকে মসজিদে পরিণত করা হবে, এটি তিনি অপছন্দ করেছেন’’।[4]
ছহীহ বুখারীতে আরো বর্ণিত হয়েছে যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন অন্তিম শয্যায় শায়িত ছিলেন, তখন হাবশার একটি গীর্জার কথা তার সামনে বর্ণনা করা হলো। গীর্জাটির সৌন্দর্য এবং তাতে যেসব ছবি ছিল সেগুলোর কথা উল্লেখ করা হলে তিনি বললেন,
إن أُولَئِكَ قَوْمٌ إِذَا مَاتَ فِيهِمُ الْعَبْدُ الصَّالِحُ أَوِ الرَّجُلُ الصَّالِحُ بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا وَصَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصُّوَرَ أُولَئِكَ شِرَارُ الْخَلْقِ عِنْدَ اللَّهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
‘‘তারা এমন লোক, তাদের মধ্যে যখন কোনো নেককার ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করতো, তখন তারা তার কবরের উপর মসজিদ তৈরী করতো এবং মসজিদে ঐগুলো স্থাপন করতো। এরাই হচ্ছে কিয়ামতের দিন আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক নিকৃষ্ট লোক।
ছহীহ মুসলিমে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আরো বর্ণিত আছে যে, তিনি মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে বলেছেন,
إِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ أَلاَ فَلاَ تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ إِنِّى أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ
‘‘সাবধান, তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিগুলো তাদের নাবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে। সাবধান! তোমরা কবরগুলোকে মসজিদে পরিণত করো না। আমি তোমাদেরকে এ কাজ করতে নিষেধ করছি’’।[5]
যেসব কারণে পৃথিবীতে শির্ক এসেছে, তার মধ্যে তারকা পূজা এবং তারকা সমূহের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যমীনে সেগুলোর নামে মূর্তি তৈরী করা। বলা হয়ে থাকে, ইবরাহীম আলাইহিস সালামের গোত্রের শির্ক ছিল এ প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। এমনি ফেরেশতা ও জিনদেরকেও তারা আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করতো এবং তাদের নামে মূর্তি বানাতো।
এ সব মুশরিক স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করতো এবং তারা কখনোই এ কথা বলতো না যে, সৃষ্টিজগতের দু’স্রষ্টা রয়েছে। কিন্তু তারা আল্লাহর মাঝে এবং তাদের নিজেদের মাঝে মধ্যস্থতাকারী নির্ধারণ করে নিয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى﴾
‘‘যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অপরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছে তারা বলে, আমরা তাদের ইবাদত এ জন্যই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়’’। (সূরা যুমার: ৩) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَيَعْبُدُونَ مِن دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَٰؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِندَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَىٰ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾
এ লোকেরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের ইবাদত করছে তারা তাদের ক্ষতিও করতে পারে না, উপকারও করতে পারে না। আর তারা বলে এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী। হে মুহাম্মাদ! ওদেরকে বলে দাও, তোমরা কি আল্লাহকে এমন বিষয়ের খবর দিচ্ছো যার কথা তিনি আকাশেও জানেন না এবং যমীনেও না! তারা যে শির্ক করে তা থেকে তিনি পবিত্র এবং তার বহু উর্ধ্বে (সূরা ইউনুস: ১৮)।
এমনি অবস্থা ছিল পূর্বের ঐসব মুশরিক জাতির যারা রসূলদেরকে মিথ্যায়ন করেছিল। আল্লাহ তা‘আলা সালেহ আলাইহিস সালামের ঘটনায় তাদের সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন যে, তাদের নয়জন শক্তিশালী লোক শপথ করে বলেছিল, আমরা রাতের বেলায় অতর্কিত হামলা করে সালেহ এবং তার পরিবারের লোকদেরকে হত্যা করে ফেলবো। এ ফাসাদ সৃষ্টিকারী মুশরিকরা তাদের নাবী এবং নাবীর পরিবারকে হত্যা করার জন্য শপথ করেছিল। এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তারা বর্তমান সময়ের মুশরিকদের ঈমানের মতই আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনয়ন করতো।
>[2]. স্রষ্টার বড়ত্ব, মহত্ত্ব, তার অসীম জ্ঞান, সকল সৃষ্টির উপর তার ক্ষমতা, মাখলুকের প্রতি তার অমূখাপেক্ষীতা এবং সকল দিক থেকে সৃষ্টির উপরে হওয়া ইত্যাদি সুউচ্চ সিফাতকে অস্বীকার করার কারণেই তারা স্রষ্টাকে নগণ্য সৃষ্টির মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে একাকার করে ফেলেছে।
[3]. ছহীহ মুসলিম হা/৯৬৯, নাসায়ী, অধ্যায়: কবর মাটির সাথে সমান করে দেয়ার আদেশ, হা/ ২০৩১।
[4]. ছহীহ বুখারী হা/৪৩৫, ছহীহ মুসলিম হা/৫৩১। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর অসুস্থতা ও তার মৃত্যু।
[5]. ছহীহ মুসলিম হা/৫৩২, অধ্যায়: কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করা নিষেধ।
সুতরাং জানা গেল, নাবী-রসূলগণ যেই তাওহীদের প্রতি আহবান করেছেন তা হলো তাওহীদুল উলুহীয়াহ। তবে এটি তাওহীদে রবুবীয়াকেও অন্তর্ভুক্ত করে। আল্লাহ তা‘আলা সূরা রূমের ৩০ নং আয়াতে বলেন,
﴿فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لَا تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ مُنِيبِينَ إِلَيْهِ وَاتَّقُوهُ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ (30) وَإِذَا مَسَّ النَّاسَ ضُرٌّ دَعَوْا رَبَّهُمْ مُنِيبِينَ إِلَيْهِ ثُمَّ إِذَا أَذَاقَهُمْ مِنْهُ رَحْمَةً إِذَا فَرِيقٌ مِنْهُمْ بِرَبِّهِمْ يُشْرِكُونَ (33) لِيَكْفُرُوا بِمَا آَتَيْنَاهُمْ فَتَمَتَّعُوا فَسَوْفَ تَعْلَمُونَ (34) أَمْ أَنْزَلْنَا عَلَيْهِمْ سُلْطَانًا فَهُوَ يَتَكَلَّمُ بِمَا كَانُوا بِهِ يُشْرِكُونَ (35) وَإِذَا أَذَقْنَا النَّاسَ رَحْمَةً فَرِحُوا بِهَا وَإِنْ تُصِبْهُمْ سَيِّئَةٌ بِمَا قَدَّمَتْ أَيْدِيهِمْ إِذَا هُمْ يَقْنَطُونَ﴾
‘‘হে নাবী! তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজের চেহারাকে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখো। এটাই আল্লাহর ফিতরাত[1] (প্রকৃতি), যার উপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই। এটাই প্রতিষ্ঠিত দ্বীন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই তা জানে না। হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহ অভিমুখী হয়ে তাকেই ভয় করো, ছলাত কায়েম করো এবং মুশরিকদের অন্তরর্ভুক্ত হয়ো না। লোকদের অবস্থা হচ্ছে, যখন তারা কোনো কষ্ট পায় তখন নিজেদের রবের দিকে ফিরে তাকে ডাকতে থাকে তারপর যখন তিনি নিজের দয়ার কিছু স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান তখন সহসা তাদের মধ্য থেকে কিছু লোক শির্কে লিপ্ত হয়ে যায়। যাতে আমার অনুগ্রহের প্রতি অকৃতজ্ঞ হয়। আচ্ছা তোমরা ভোগ করে নাও, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে। আমি কি তাদের কাছে কোনো দলীল অবতীর্ণ করেছি, যা তাদের শির্কের সত্যতার সাক্ষ্য দেয়? আর যখন লোকদের দয়ার স্বাদ আস্বাদন করাই তখন তারা তাতে আনন্দে উৎফুলস্ন হয়ে উঠে এবং যখন তাদের নিজেদের কৃতকর্মের ফলে তাদের উপর কোনো বিপদ এসে পড়ে তখন সহসা তারা হতাশ হয়ে যায়’’ (সূরা রূম ৩০:৩০-৩৬)
আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইবরাহীমের ১০ নং আয়াতে বলেন,
﴿قَالَتْ رُسُلُهُمْ أَفِي اللّهِ شَكٌّ فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ﴾
‘‘তাদের রসূলগণ বলেছিলেন, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের স্রষ্টা আল্লাহ্ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ আছে কি?’’ রসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«كل مَوْلُودٍ إِلاَّ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، وَيُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ، كَمَا تُنْتَجُ الْبَهِيمَةُ بَهِيمَةً جَمْعَاءَ، هَلْ تُحِسُّونَ فِيهَا مِنْ جَدْعَاءَ» (بخارى:1359)
‘‘প্রতিটি শিশু ফিতরাতের উপর জন্ম গ্রহণ করে। তার পিতা-মাতা ইহুদী হলে তাকে ইহুদী বানিয়ে দেয় অথবা খৃষ্টান হলে তাকে খৃষ্টান বানিয়ে দেয় অথবা অগ্নি পূজক হলে তাকে অগ্নি পূজক বানিয়ে দেয়। যেমন চতুষ্পদ জন্তু নিখুঁত একটি চতুষ্পদ জন্তু হিসাবেই ভূমিষ্ঠ হয়। তোমরা তার নাক-কান কাটা দেখতে পাও কি?’’
এটা বলা যাবে না যে, এখানে অর্থ হলো শিশু এমন সাদাসিধে অবস্থায় জন্ম গ্রহণ করে যে, সে না জানে তাওহীদ এবং না জানে শির্ক কী জিনিস। কেউ কেউ এ কথা বলে থাকে। তাদের কথা ঠিক নয়। তার দলীল হলো উপরোক্ত আয়াতগুলো। হাদীছে কুদসীর মধ্যে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
«إِنِّي خَلَقْتُ عِبَادِي حُنَفَاءَ كُلَّهُمْ فَاجْتَالَتْهُمْ الشَّيَاطِينُ عَنْ دِينِهِمْ»
‘‘নিশ্চয়ই আমি আমার বান্দাদেরকে তাওহীদে বিশ্বাসী করেই সৃষ্টি করেছি। অতঃপর শয়তান তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে সরিয়ে ফেলেছে’’।[2]
একটু পূর্বে যে হাদীছ অতিক্রান্ত হয়েছে, তা এ কথাই প্রমাণ করে। তাতে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، وَيُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ،
‘‘তার পিতা-মাতা তাকে ইহুদী বানিয়ে দেয় অথবা তাকে খৃষ্টান বানিয়ে দেয় অথবা তাকে অগ্নি পূজক বানিয়ে দেয়’’।
এখানে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেননি যে, ويسلمانه ‘‘অথবা তারা তাকে মুসলিম বানিয়ে দেয়’’। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, প্রত্যেক শিশুই মিল্লাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। আরেক বর্ণনায় এসেছে, এ মিল্লাতের উপর জন্মগ্রহণ করে।
নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ সংবাদই প্রদান করেছেন। বিবেক ও জ্ঞানগত দলীলসমূহ এ কথারই সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করে। জ্ঞানগত দলীলসমূহ নিম্নরূপ:
(১) কোনো সন্দেহ নেই যে, মানুষ এমনসব আক্বীদাহ, ধারণা ও পরিকল্পনা অর্জন করে, যা কখনো সত্য হয় আবার কখনো মিথ্যা হয়। আর মানুষ তো ইচ্ছাশক্তি দ্বারা চলমান সংবেদনশীল সৃষ্টি। তার মধ্যে হক বা বাতিলের যে কোনো একটি থাকবেই। সেই সাথে দু’টির একটিকে অগ্রাধিকার প্রদানকারী বিষয় মানুষের স্বভাবের মধ্যে থাকা আবশ্যক। আমরা সকলেই অবগত আছি যে, যখন প্রত্যেক মানুষের নিকট স্রষ্টার অস্তিত্বকে সত্যায়ন করা ও তা থেকে উপকৃত হওয়ার বিষয়টি পেশ করা হয় এবং তাকে মিথ্যায়ন ও তার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়টি পেশ করা হয়, তখন সে স্বীয় সৃষ্টিগত স্বভাবের দ্বারাই সত্যায়ন করা ও উপকৃত হওয়ার দিকেই ধাবিত হবে। বিষয়টি যখন ঠিক এ রকম, তাই স্রষ্টার অস্তিত্বের স্বীকৃতি প্রদান করা এবং তার প্রতি ঈমান আনয়ন করাই সঠিক অথবা সঠিকের বিপরীত। এখানে দ্বিতীয় কথাটি অকাট্যভাবেই বাতিল।
সুতরাং সন্দেহাতীতভাবে প্রথমটিই সুসাব্যস্ত হয়েছে। অতএব মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাবের মধ্যে এমন বিষয় রয়েছে, যা স্রষ্টার পরিচয় সম্পর্কে জানা এবং তার প্রতি ঈমান আনয়নের দাবি জানায়। তারপর দেখতে হবে বান্দার ফিতরাতের মধ্যে কি এমন বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে, যা বান্দার জন্য উপকারী? না কি উপকারী জিনিসের প্রতি তার অন্তরে কোনো আগ্রহ ও ভালোবাসা নেই? এখানে দ্বিতীয় কথাটি নিঃসন্দেহে বাতিল। সুতরাং সাব্যস্ত হলো যে, বান্দার ফিতরাতের মধ্যে এমন বিষয়ের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে, যা তার জন্য উপকারী।
(২) মানুষকে সৃষ্টিগতভাবে তার নিজের জন্য কল্যাণ অর্জন এবং অকল্যাণ প্রতিরোধের স্বভাব দিয়েই সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং সে তার বোধশক্তি ও পঞ্চইন্দ্রিয় দ্বারাই তা করে থাকে। তবে প্রত্যেক মানুষের ফিতরাত নিজের জন্য কল্যাণ অর্জন কিংবা নিজ থেকে অকল্যাণ দূর করতে স্বয়ং সম্পন্ন নয়। সুতরাং ফিতরাত দ্বারা মানুষ তার নিজের জন্য কল্যাণকর জিনিসকে বেছে নিতে পারে এবং তার জন্য যা ক্ষতিকর, তা চিহ্নিত করতে পারে ও তা থেকে সাবধান হতে পারে। তবে প্রত্যেক মানুষের ফিতরাত নিজস্ব ক্ষমতা বলে তা অর্জন করতে পারে না। বরং তার জন্য সহায়ক বস্তুর প্রয়োজন রয়েছে। যেমন ফিতরাতকে সঠিক শিক্ষা প্রদান করা ও সঠিক পথে পরিচালিত করা অথবা অনুরূপ অন্য কিছু দিয়ে ফিতরাতকে সাহায্য করার প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং যখন ফিতরাতের জন্য সহায়ক বস্তু পাওয়া যাবে এবং তার থেকে প্রতিবন্ধক দূর হবে, তখনই ফিতরাতের মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করার যে দাবী রয়েছে, সে দাবি পূরণের পক্ষেই সাড়া প্রদান করবে।
(৩) এটা জানা কথা যে, প্রত্যেক মানুষই ইলম অর্জন এবং সত্য সম্পর্কে জানার ইচ্ছা পোষণ করার যোগ্যতা রাখে। তবে মানুষকে শিক্ষা প্রদান করা এবং সত্য সম্পর্কে জানার উৎসাহ প্রদান করা জ্ঞান অর্জনের জন্য যথেষ্ট নয়; সত্য সম্পর্কে জানার জন্যও যথেষ্ট নয়। মানুষের হৃদয়ে যদি সত্য কবুল করার মত শক্তি এবং তার প্রতি অন্তরের ঝোক না থাকে, তাহলে সে কখনোই সত্য কবুল করতে পারবে না। কেননা নির্বোধ ও পশুকে জ্ঞান শিক্ষা দিলে এবং তার প্রতি উৎসাহ দিলেও কোনো কাজ হয় না। আর এ কথাও জানা যে, বাইরে থেকে আলাদা কোনো শিক্ষা ও সহায়ক বস্তু ছাড়াই মানুষের নফ্স স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করতে পারে এবং স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে জানার জন্য মানুষের নিজের সত্তাই যথেষ্ট। সুতরাং নফসের মধ্যে যখন এ দাবী থাকে এবং তা যখন বিরোধমুক্ত হয় তখন বিরোধমুক্ত দাবি তার চাহিদা মোতাবেক বিষয় হাসিল হওয়া আবশ্যক করে। সুতরাং সন্দেহাতীতভাবে জানা গেল যে, বিরোধমুক্ত ও পরিশুদ্ধ ফিতরাতকে যদি বাইরের কোন জিনিস দ্বারা বিপর্যস্ত না করা হয়, তাহলে সেটা স্রষ্টার অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং তার ইবাদতকারীতে পরিণত হয়।
(৪) এটা বলা যেতে পারে যে, ফিতরাতের জন্য যখন বাইরের কোনো নষ্টকারী কিংবা সংশোধনকারী না থাকে, তখন তা সংশোধিত ও আসল অবস্থায় থাকার দাবি রাখে। কেননা তাতে ইলম অর্জন এবং সত্য সম্পর্কে জানার ইচ্ছা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সেই সঙ্গে তার কোনো বিরোধীও বিদ্যমান নেই।
ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ থেকে বর্ণনা করা হয় যে, যুক্তিবাদী ও কালামশাস্ত্রবিদদের একদল লোক স্রষ্টার অস্তিত্ব ও তাওহীদে রুবুবীয়াত সাব্যস্ত করার ব্যাপারে যুক্তি-তর্ক পেশ করার জন্য তার সাথে আলোচনায় বসার ইচ্ছা প্রকাশ করলো। তখন তাদেরকে তিনি বললেন, এ মাসআলার ব্যাপারে আলোচনায় বসার আগে আমাকে বলো, এটি কি সম্ভব যে, ইরাকের দিজলা নদীতে নৌকা একাই চলাচল করে? নৌকা কি নিজে নিজেই খাদ্যদ্রব্য, পণ্য সামগ্রী ইত্যাদি একাই বোঝাই করে? একাই যাত্রা করে এবং একাই ফিরে আসে ও ঘাটে থেমে যায়? মালপত্র নামিয়ে এটি কি আবার একাই ফিরে যায়? কারো পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা ও তদারকি ছাড়াই নৌকার পক্ষে কি এসব কাজ করা সম্ভব? তারা সকলেই বললো, এটা অসম্ভব। নৌকার পক্ষে কখনোই তা করা সম্ভব নয়।
এবার ইমাম তাদেরকে বললেন, একটি নৌকার পক্ষে যখন পরিচালক ছাড়া চলাচল করা সম্ভব নয়, তাহলে এ বিশাল সৃষ্টিজগতের উর্ধ্বজগৎ ও নিমণজগতের সবকিছুর পক্ষে কী করে একাই সুশৃঙ্খলভাবে চলাচল করা সম্ভব হতে পারে!! ইমাম আবু হানীফা রহিমাহুল্লাহ ছাড়া অন্যদের থেকেও এ ঘটনা বর্ণনা করা হয়ে থাকে।
সুতরাং কোনো লোক যদি তাওহীদে রুবুবীয়াতের স্বীকৃতি প্রদান করে, যার স্বীকৃতি দিয়ে থাকে এ যুক্তিবাদীরা, সুফীদের অনেকেই যাতে একাকার হয়ে যাচ্ছে, তরীকাপন্থীরা যাকে একমাত্র লক্ষ্য-উদ্দেশ্য হিসাবে ঠিক করে নিয়েছে এবং যা উল্লেখ করেছেন, مَنَازِلِ السَّائِرِين গ্রন্থকার এবং অন্যরা, তা সত্ত্বেও সে যদি এককভাবে আল্লাহর ইবাদত না করে এবং তার ইবাদত ব্যতীত অন্যান্যদের ইবাদত বর্জন না করে তাহলে সে অন্যান্য মুশরিকদের ন্যায় মুশরিক হিসাবেই থেকে যাবে।
কুরআনে রয়েছে তাওহীদে রুবুবীয়াতের বিস্তারিত আলোচনা, তার বিশদ বর্ণনা এবং তার বহু উপমা, উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত। কুরআন তাওহীদে রুবুবীয়াহ সাব্যস্ত করতে গিয়ে বলেছে যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো স্রষ্টা নেই। যেহেতু আল্লাহ ছাড়া আর কোনো স্রষ্টা নেই, তাই সাব্যস্ত হয়ে গেল যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্য নয়। সুতরাং আল্লাহর রুবুবীয়াতই তার উলুহীয়াতের দলীল। কেননা তারা যেহেতু রুবুবীয়াতকে মেনে নিয়েছে এবং উলুহীয়াতের ব্যাপারে মতভেদ করেছে, তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাদের জন্য বর্ণনা করেছেন যে, তোমরা যখন মেনে নিয়েছো যে, এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো স্রষ্টা নেই, তিনিই যেহেতু তার বান্দাদের উপকার করা এবং তাদের থেকে অকল্যাণ প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখেন, এসব বিষয়ে যেহেতু তার কোনো শরীক নেই বলে তোমরা স্বীকার করে নিয়েছো, তাহলে কেন তোমরা তাকে বাদ দিয়ে অন্যের ইবাদত করছো এবং তার সাথে অন্যান্য মাবুদ নির্ধারণ করছো?
আল্লাহ তা‘আলা সূরা নামলের ৫৯-৬৪ নং আয়াতে বলেন,
﴿قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ وَسَلَامٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِينَ اصْطَفَى آَللَّهُ خَيْرٌ أَمَّا يُشْرِكُونَ (59) أَمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَأَنْزَلَ لَكُمْ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَنْبَتْنَا بِهِ حَدَائِقَ ذَاتَ بَهْجَةٍ مَا كَانَ لَكُمْ أَنْ تُنْبِتُوا شَجَرَهَا أَإِلَهٌ مَعَ اللَّهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ يَعْدِلُونَ (60) أَمْ مَنْ جَعَلَ الْأَرْضَ قَرَارًا وَجَعَلَ خِلَالَهَا أَنْهَارًا وَجَعَلَ لَهَا رَوَاسِيَ وَجَعَلَ بَيْنَ الْبَحْرَيْنِ حَاجِزًا أَإلَهٌ مَعَ اللَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ (61) أَمْ مَنْ يُجِيبُ الْمُضْطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكْشِفُ السُّوءَ وَيَجْعَلُكُمْ خُلَفَاءَ الْأَرْضِ أَإِلَهٌ مَعَ اللَّهِ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ (62) أَمْ مَنْ يَهْدِيكُمْ فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَنْ يُرْسِلُ الرِّيَاحَ بُشْرًا بَيْنَ يَدَيْ رَحْمَتِهِ أَإلَهٌ مَعَ اللَّهِ تَعَالَى اللَّهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ أَمَّن يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ وَمَن يَرْزُقُكُم مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَإِلَٰهٌ مَّعَ اللَّهِ ۚ قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
‘‘হে নাবী! বলো, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং সালাম তার এমন সব বান্দাদের প্রতি যাদেরকে তিনি নির্বাচিত করেছেন। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো আল্লাহ উত্তম? না কি সেই সব মাবুদ যাদেরকে তারা তার শরীক করেছে? কে তিনি যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের জন্য আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করছেন তারপর তার সাহায্যে এমন মনোরম বাগ-বাগিচা সৃষ্টি করেছেন, যার গাছপালা উদগত করা তোমাদের আয়ত্তাধীন ছিল না? আল্লাহর সাথে অন্য কোনো ইলাহ আছে কি? বরং এরাই সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে এগিয়ে চলেছে। আর তিনি কে যিনি পৃথিবীকে করেছেন বসবাসের উপযোগী এবং তার মধ্যে প্রবাহিত করেছেন নদ-নদী ও তার মধ্যেই গড়ে দিয়েছেন পর্বত মালার পেরেক, আর দু’সাগরের মাঝখানে অন্তরাল সৃষ্টি করেছেন? আল্লাহর সাথে এসব কাজের শরীক অন্য কোনো ইলাহ আছে কি? বরং এদের অধিকাংশই অজ্ঞ। কে তিনি যিনি আর্তের ডাক শুনেন যখন সে তাকে আহবান করে কাতরভাবে এবং কে তার দুঃখ দূর করেন? আর কে তোমাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেন? আল্লাহর সাথে আর কোনো ইলাহ আছে কি? তোমরা সামান্যই চিন্তা করে থাকো। আর কে জল ও স্থলে অন্ধকারে তোমাদের পথ দেখান এবং কে নিজের অনুগ্রহের পূর্বাহ্নে বাতাস কে সুসংবাদ দিয়ে পাঠান? আল্লাহর সাথে কি অন্য কোনো ইলাহ আছে? আল্লাহ অনেক উর্ধ্বে এ শির্ক থেকে যা এরা করে থাকে। আর তিনি কে যিনি সৃষ্টির সূচনা করেন এবং তারপর আবার এর পূনরাবৃত্তি করেন? আর কে তোমাদের জীবিকা দেন আকাশ ও পৃথিবী থেকে? আল্লাহর সাথে অন্য কোনো ইলাহ আছে কি? বলো, তোমরা যদি সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে প্রমাণ করো’’।
উপরোক্ত আয়াতগুলোর প্রত্যেকটির শেষে আল্লাহ তা‘আলা এ প্রশ্ন করেছেন, أَإِلَهٌ مَعَ الله؟ ‘‘আল্লাহর সাথে অন্য কোনো ইলাহ আছে কি?’’ অর্থাৎ আল্লাহর সাথে অন্য এমন কোনো ইলাহ আছে কি যে এগুলোতে আল্লাহর শরীক থাকে? এটি হচ্ছে অস্বীকারের প্রশ্ন। জানার জন্য এ প্রশ্ন করা হয়নি। এ প্রশ্নটি আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন স্রষ্টা, প্রভু এবং ইলাহ থাকাকে অস্বীকার করেছে। বাস্তবেই মক্কার মুশরিকরা এ কথা স্বীকার করেছিল যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ উপরোক্ত কাজগুলো করেনি। সুতরাং তাদের স্বীকারোক্তি দ্বারাই আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিরুদ্ধে দলীল-প্রমাণ কায়েম করেছেন। এখানে প্রশ্ন করার অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তা‘আলা তাদের কাছে জানতে চেয়েছেন, আল্লাহর সাথে অন্য কোন ইলাহ আছে কি না? যেমন কেউ কেউ ধারণা করে থাকে। কেননা এ অর্থ আয়াতের বর্ণনা প্রসঙ্গের সাথে খাপ খায় না। বিশেষ করে যখন জানা গেল, সে সময়ের আরবের মুশরিকরা আল্লাহর ইবাদতের সাথে বহু মাবুদের ইবাদত করতো। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ أَيُّ شَيْءٍ أَكْبَرُ شَهَادَةً قُلِ اللَّهُ شَهِيدٌ بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَٰذَا الْقُرْآنُ لِأُنذِرَكُم بِهِ وَمَن بَلَغَ أَئِنَّكُمْ لَتَشْهَدُونَ أَنَّ مَعَ اللَّهِ آلِهَةً أُخْرَىٰ قُل لَّا أَشْهَدُ قُلْ إِنَّمَا هُوَ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ وَإِنَّنِي بَرِيءٌ مِّمَّا تُشْرِكُونَ﴾
‘‘এদেরকে জিজ্ঞাসা করো, কার সাক্ষ্য সবচেয়ে বড়? বলো, আল্লাহ আমার ও তোমাদের মধ্যে সাক্ষী। আর এ কুরআন আমার কাছে পাঠানো হয়েছে অহীর মাধ্যমে, যাতে তোমাদের এবং আর যার কাছে এটি পৌঁছে যায় তাদের সবাইকে আমি সতর্ক করি। সত্যিই কি তোমরা এমন সাক্ষ্য দিচ্ছো যে, আল্লাহর সাথে আরো অনেক ইলাহ আছে? বলো, আমি তো কখনোই এমন সাক্ষ্য দিতে পারি না। বলো, আল্লাহ তো মাত্র এক এবং তোমরা যে শির্কে লিপ্ত রয়েছো আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত’’ (সূরা আল আন‘আম: ১৯)। মক্কার মুশরিকরা বলতো,
﴿أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهاً وَاحِداً إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ﴾
‘‘সে কি বহু উপাস্যের পরিবর্তে এক উপাস্যের উপাসনা সাব্যস্ত করে দিয়েছে? নিশ্চয় এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার! (সূরা সোয়াদ: ৫)
কিন্তু তারা এ কথা বলতো না যে, আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে এমন কোনো মাবুদের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিল না, যিনি পৃথিবীকে করেছেন বসবাসের উপযোগী এবং তার মধ্যে প্রবাহিত করেছেন নদ-নদী এবং তার মধ্যেই গড়ে দিয়েছেন পর্বত মালার পেরেক, আর দুই সাগরের মাঝখানে অন্তরায় সৃষ্টি করে দিয়েছেন। (সূরা নামল: ৬১) বরং তারা এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিল যে, আল্লাহ তা‘আলা একাই এ কাজগুলো করেছেন। অন্যান্য আয়াতগুলোর অর্থও অনুরূপ। অনুরূপ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ﴾
‘‘হে লোক সকল! ইবাদাত করো তোমাদের রবের, যিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন। এর মাধ্যমে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে’’। (সূরা আল বাকারা: ২১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قُلْ أَرَأَيْتُمْ إِنْ أَخَذَ اللَّهُ سَمْعَكُمْ وَأَبْصَارَكُمْ وَخَتَمَ عَلَىٰ قُلُوبِكُم مَّنْ إِلَٰهٌ غَيْرُ اللَّهِ يَأْتِيكُم بِهِ انظُرْ كَيْفَ نُصَرِّفُ الْآيَاتِ ثُمَّ هُمْ يَصْدِفُونَ﴾
‘‘হে মুহাম্মাদ! তাদেরকে বলো, তোমরা কি কখনো এ কথা ভেবে দেখেছো, যদি আল্লাহ তোমাদের থেকে তোমাদের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তি ছিনিয়ে নেন এবং তোমাদের হৃদয়ে মোহর মেরে দেন তাহলে আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ আছে যে এগুলো তোমাদের ফিরিয়ে দিতে পারে? দেখো, কিভাবে আমরা বারবার আমাদের নিদর্শনগুলো তাদের সামনে পেশ করি? এরপরও তারা কিভাবে এগুলো থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়’’। (সূরা আল আনআম: ৪৬) অনুরূপ আয়াত আরো অনেক রয়েছে।
তাওহীদুর রুবুবীয়াকেই এসব যুক্তিবিদ ও কালামশাস্ত্রবিদ এবং তাদের অনুসারী সুফীরা সর্বোচ্চ তাওহীদ হিসাবে তাদের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে নিয়েছে। অথচ এটি সেই তাওহীদুল উলুহীয়ারই অন্তর্ভুক্ত, যা নিয়ে আগমন করেছেন নাবী-রসূলগণ এবং যা সহ নাযিল হয়েছে সমস্ত আসমানী কিতাব।
সুতরাং যখন জানা গেলো যে, তাওহীদুর রুবুবীয়াহ যেহেতু তাদের উপর অবতীর্ণ কিতাবে আলোচিত তাওহীদেরই অন্তর্ভুক্ত, তখন সকলের জন্য জেনে রাখা আবশ্যক যে, নাবী-রসূলগণ যে তাওহীদের আহবান জানিয়েছেন, তার অসংখ্য দলীল রয়েছে। তার মধ্যে স্রষ্টার অস্তিত্ব সাব্যস্তের দলীলসমূহ এবং রসূলদের সত্যতার প্রমাণসমূহ অন্যতম। কেননা মানুষ স্রষ্টার পরিচয় সম্পর্কে জানা এবং তার প্রতি ঈমান আনয়নের প্রতি যত বেশী প্রয়োজন অনুভব করবে, তার রুবুবীয়াত ও উলুহীয়াতের দলীলগুলো তাদের কাছে ততোই সুস্পষ্ট হবে। সৃষ্টির উপর রহমত স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলা নিজেই এগুলো মানুষের সামনে সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বিষয়ের দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন। এগুলো নিছক বিবেক-বুদ্ধির মূল্যায়নে উপকারী দৃষ্টান্ত হলেও তা দ্বারা দ্বীনি উদ্দেশ্য হাসিল হয়। কিন্তু কুরআন বিভিন্ন হুকুম-আহকাম ও দলীল-প্রমাণ পেশ করতে গিয়ে সত্য ছাড়া অন্য কিছু বর্ণনা করে না। সুতরাং সত্য সুস্পষ্ট হওয়ার পর গোমরাহী ছাড়া আর কী থাকতে পারে? কোনো ব্বিরণ থেকে বিবেক ও বোধশক্তি যখন এমন কোনো প্রমাণিত তথ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়, যা সর্ব সমর্থিত তখন তা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা এবং তার পক্ষে অন্য কোনো দলীল পেশ করার প্রয়োজন পড়ে না।
স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে বিবেক ও জ্ঞানগত দলীল-প্রমাণগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে, কাট-ছাঁট ও পরিপাটি করে এবং সংক্ষিপ্ত করে তুলে ধরতে হবে। এটিই কুরআনের পদ্ধতি। কিন্তু এতে ঐসব মূর্খের দল দ্বিমত পোষণ করে, যারা ধারণা করে যে, কুরআনে বিবেক ও বুদ্ধিভিত্তিক যুক্তি-প্রমাণ নেই। তবে যেসব বিষয় কখনো কখনো অস্পষ্ট থাকতে পারে এবং যাতে মতভেদ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, কুরআন তা খোলাখুলি বর্ণনা করেছে এবং সে বিষয়ে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়েছে।
রুবুবীয়াতের মধ্যে শির্ক সংঘটিত না হওয়ার বিষয়টি সকল মানুষেরই জানা ছিল। তারা কখনো এমন দু’স্রষ্টার অস্তিত্ব সাব্যস্ত করেনি, যাদের উভয়ের সিফাতসমূহ ও কর্মসমূহ পরস্পর সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে কতেক মুশরিক মনে করেছে যে, এমন এক স্রষ্টার অস্তিত্ব রয়েছে, যে কতিপয় মাখলুক সৃষ্টি করেছে। যেমন ছানুবীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা অন্ধকারকে মন্দের স্রষ্টা মনে করে, কাদেরীয়ারা মনে করে মানুষ এবং প্রাণীর কাজ-কর্ম সে নিজেই সৃষ্টি করে এবং মহাকালের প্রভাবে বিশ্বাসী দার্শনিকরা তারকার চলাচল অথবা প্রাণীর আত্মার স্পন্দনকে অথবা প্রাকৃতিক ঘটনাগুলোকে স্রষ্টা মনে করে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এরা এমন কিছু সৃষ্টির অস্তিত্ব সাব্যস্ত করছে, তাদের ধারণায় যাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি করেননি। তারা রুবুবীয়াতের কিছু কিছু বিষয়ে মুশরিক হিসাবে গণ্য। আরব মুশরিকদের কিছু লোক তাদের মাবুদদের মধ্যে কিছু কল্যাণ করার ক্ষমতা থাকা এবং কিছু ক্ষতি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আছে বলে ধারণা করতো। তারা আরো বিশ্বাস করতো যে, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত তাদের মাবুদরাই কিছু কল্যাণ সাধন কিংবা ক্ষতি প্রতিহত করতে পারে।[3]
সুতরাং কিছু সংখ্যক মানুষ যেহেতু রুবুবীয়াতের মধ্যে শির্কে লিপ্ত হয়েছিল, তাই কুরআন তা বাতিল সাব্যস্ত করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَا اتَّخَذَ اللَّهُ مِن وَلَدٍ وَمَا كَانَ مَعَهُ مِنْ إِلَٰهٍ إِذًا لَّذَهَبَ كُلُّ إِلَٰهٍ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعْضُهُمْ عَلَىٰ بَعْضٍ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يَصِفُونَ﴾
‘‘আল্লাহ কাউকে নিজের সন্তান হিসাবে গ্রহণ করেননি এবং তার সাথে অন্য কোনো ইলাহ নেই। যদি থাকতো তাহলে প্রত্যেক মাবুদই নিজের সৃষ্টি নিয়ে আলাদা হয়ে যেতো এবং একজন অন্যজনের উপর চড়াও হতো। এরা যেসব কথা তৈরী করে তা থেকে আল্লাহ পাক-পবিত্র’’। (সূরা আল মুমিনুন: ৯১)
এখানে খুব সংক্ষিপ্ত ও সুস্পষ্ট বাক্যের মাধ্যমে যে উজ্জল প্রমাণটি পেশ করা হয়েছে, তার ব্যাপারে আপনি চিন্তা করুন। কেননা সত্য ইলাহ যিনি হবেন, তাকে অবশ্যই সৃষ্টি করা ও কর্ম সম্পাদন করার গুণাবলী সম্পন্ন হতে হবে এবং সৃষ্টির কল্যাণ করার ক্ষমতা সম্পন্ন হতে হবে ও তাদের থেকে অকল্যাণ দূর করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
অতএব, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সাথে যদি অন্য এমন কোনো ইলাহ থাকতো, যে আল্লাহর রাজত্বের অংশীদার, তাহলে তার জন্যও সৃষ্টি করা ও কর্ম সম্পাদন করার ক্ষমতা থাকা আবশ্যক হতো। তখন আল্লাহ তা‘আলা কখনোই সেই অংশীদারিত্বের প্রতি সন্তুষ্ট থাকতেন না। বরং সেই শরীককে পরাজিত করার ক্ষমতা থাকা এবং তার নিকট থেকে রাজত্ব ও ইলাহিয়াত ছিনিয়ে নেয়ার ক্ষমতা থাকার কারণে অবশ্যই তা করতেন। যেমন দুনিয়ার রাজাদের একজন অন্যজন থেকে রাজ্য ছিনিয়ে নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে তাদের কেউ যদি অন্যকে পরাজিত করতে পারে এবং অন্যের উপর চড়াও হওয়ার সামর্থ না রাখে, তাহলে তিন অবস্থার যে কোনো একটি হতে পারে।
(১) প্রত্যেক ইলাহ তার সৃষ্টি ও রাজ্য নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে অথবা
(২) এক ইলাহ অন্য ইলাহর উপর চড়াও হবে।
(৩) অথবা সকলেই এক রাজার ক্ষমতাধীন থাকবে। তিনি যেভাবে ইচ্ছা বাকী সকলকে পরিচালনা করবেন। কিন্তু তারা সেই সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর সত্তার উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। বরং তিনি একাই হবেন ইলাহ আর বাকীরা সকলেই হবে সকল দিক থেকেই তার অধীনস্ত ও প্রতিপালিত বান্দা।
সৃষ্টিজগতের সকল বিষয় সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হওয়া এবং তার নিয়ম-কানুন সুদৃঢ় হওয়াই প্রমাণ করে যে, সৃষ্টিজগতের ব্যবস্থাপক ও পরিচালক হলেন একক ও অদ্বিতীয় ইলাহ। তিনিই প্রকৃত বাদশাহ, একমাত্র প্রভু, তিনি ছাড়া সৃষ্টিজগতের অন্য কোনো ইলাহ নেই এবং তিনি ছাড়া তাদের আর কোনো রবও নেই। সুতরাং বিবেক ও বোধশক্তির দলীল প্রমাণ করে যে, সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা হলেন মাত্র একজন, তিনি ছাড়া আর কোনো রব নেই এবং তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদও নেই। সুতরাং সকল সৃষ্টি ও সৃষ্টির কাজ-কর্মের স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ। তাই ইবাদত এবং ইলাহীয়াতও একমাত্র আল্লাহর। সৃষ্টিজগতের জন্য পরস্পর সমান যোগ্যতা সম্পন্ন দু’স্রষ্টা ও দু’জন রব থাকা যেমন অসম্ভব, ঠিক তেমনি তাদের জন্য দু’জন মাবুদ থাকাও অসম্ভব।
সুতরাং পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ গুণাবলীর অধিকারী দু’জন স্রষ্টার দ্বারা এ সৃষ্টিজগৎ অস্তিত্বে এসেছে, -এ বিশ্বাস করা মূলতঃই অবাস্তব। মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাবের মধ্যে দ’জন স্রষ্টা দ্বারা সৃষ্টিজগৎ সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি অবাস্তব হওয়ার বিশ্বাসই বদ্ধমূল হয়ে আছে এবং বিবেক ও বোধশক্তির সুস্পষ্ট দলীল দ্বারাও ঐ ধারণা বাতিল হয়েছে। অতএব এভাবেই দ’জন মাবুদের উলুহীয়াত বাতিল সাব্যস্ত হলো।
সুতরাং সৃষ্টিগত স্বভাব ও বোধশক্তির মধ্যে যে তাওহীদে রুবুবীয়াত বদ্ধমূল, স্থির ও স্থায়ী হয়ে আছে, কুরআনের উপরোক্ত আয়াতটি তাকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করছে। একই সঙ্গে মানুষের প্রকৃতি ও সৃষ্টিগত স্বভাব একদিক থেকে যেমন আল্লাহর রুবুবীয়াত সাব্যস্ত করছে, অন্যদিকে তাওহীদুল উলুহীয়াতকেও আবশ্যক করছে।
নিমেণর আয়াতটিও উপরোক্ত আয়াতের সমর্থ জ্ঞাপক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿لَوْ كَانَ فِيهِمَا آَلِهَةٌ إِلَّا اللَّهُ لَفَسَدَتَا فَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَرْشِ عَمَّا يَصِفُونَ﴾
‘‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যদি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য মাবুদ থাকত, তবে আসমান-যমীন বিধ্বস্ত হয়ে যেত। অতএব তারা যা বলে, তা থেকে আরশের অধিপতি আল্লাহ্ পবিত্র’’। (সূরা আল আম্বীয়া: ২২)
কোনো কোনো সম্প্রদায় মনে করেছে যে, এটিই হলো বোধশক্তির সে দলীল যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো সৃষ্টিজগতের জন্য পরস্পর সমান যোগ্যতা সম্পন্ন দু’জন স্রষ্টা থাকা অসম্ভব। তারা আসলে আয়াতের অর্থ বুঝতে পারেনি। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে, আসমান-যমীনে যদি তিনি ব্যতীত অন্যান্য উপাস্য থাকতো.....। তিনি তো এটি বলেননি যে, যদি আসমান ও যমীনে একাধিক রব থাকতো......।
আসমান যমীন-সৃষ্টি হওয়ার পর এ কথা বলা হয়েছে। আসমান-যমীন থাকা অবস্থায় যদি উহাতে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য মাবুদ থাকতো, তাহলে তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি হতো। আর আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,لفسدتا আসমান-যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি হতো। তিনি এ কথা বলেননি যে, তা সৃষ্টিই হতো না। মোটকথা আয়াত প্রমাণ করছে যে, আসমান-যমীনে একাধিক ইলাহ থাকা অবৈধ। শুধু তাই নয়; এক ইলাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ থাকা সম্ভবই নয়। আর এ এক ইলাহ হলেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা। আসমান-যমীনে বহু ইলাহ হওয়া মানেই তাতে বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়া, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া সে এক ইলাহ যদি অন্য কেউ হয় তাতেও আসমান-যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আসমান ও যমীনের একমাত্র মাবুদ বলেই তা সংশোধিত অবস্থায় রয়েছে। সৃষ্টিজগতের জন্য যদি দু’জন মাবুদ থাকতো, তাহলে সৃষ্টিজগতের শৃংখলা নষ্ট হয়ে যেত। সুতরাং এক আল্লাহর ইনসাফের বদৌলতেই সৃষ্টিজগতের শৃংখলা টিকে আছে এবং তার আদলের কারণেই আসমান-যমীন সুশৃংখল সু-নিপুন অবস্থায় রয়েছে। শির্ক হলো সর্বাধিক বড় যুলুম আর তাওহীদ হলো সর্ববৃহৎ ইনসাফ।
তাওহীদুল উলুহীয়াহ তাওহীদুর রুবুবীয়াতকেও শামিল করে। কিন্তু তাওহীদুর রুবুবীয়াত সাব্যস্ত করলেই তাওহীদুল উলুহীয়াহর বাস্তবায়ন হয় না। যে সৃষ্টি করতে পারে না, সে অক্ষম। আর অক্ষম কখনো ইলাহ হওয়ার যোগ্যতা রাখে না।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَيُشْرِكُونَ مَا لَا يَخْلُقُ شَيْئًا وَهُمْ يُخْلَقُونَ﴾
‘‘তারা কি এমন জিনিসকে আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত করে, যারা কোন জিনিস সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে না বরং নিজেরাই সৃষ্ট?’’। (সূরা আল আরাফ: ১৯১) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أَفَمَن يَخْلُقُ كَمَن لَّا يَخْلُقُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ﴾
‘‘যিনি সৃষ্টি করেন এবং যে কিছুই সৃষ্টি করে না তারা উভয় কি সমান? তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না?’’ (সূরা আন নাহাল: ১৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿قُل لَّوْ كَانَ مَعَهُ آلِهَةٌ كَمَا يَقُولُونَ إِذًا لَّابْتَغَوْا إِلَىٰ ذِي الْعَرْشِ سَبِيلًا﴾
‘‘হে মুহাম্মদ! এদেরকে বলো, যদি আল্লাহর সাথে অন্যান্য ইলাহ থাকতো যেমন এরা বলে থাকে, তাহলে সে আরশের মালিকের জায়গায় পৌঁছে যাবার জন্য নিশ্চয়ই চেষ্টা করতো’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ৪২)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় পরবর্তী যুগের আলেমদের দু’টি মত রয়েছে।
(১) আরশের মালিককে পরাজিত করার চেষ্টা করতো।
(২) তার নৈকট্য লাভের চেষ্টা করতো। কাতাদাহ এবং অন্যান্য সালাফ থেকে এ কথা বর্ণিত হয়েছে। এটিই সঠিক মত। ইমাম ইবনে জারীর এ মতটি ছাড়া অন্য কোন মত উল্লেখ করেননি। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ هَٰذِهِ تَذْكِرَةٌ فَمَن شَاءَ اتَّخَذَ إِلَىٰ رَبِّهِ سَبِيلًا﴾
‘‘এটি একটি উপদেশ বাণী। এখন কেউ চাইলে তার রবের দিকে যাওয়ার পথ অবলম্বন করতে পারে’’। (সূরা দাহর: ২৯) দ্বিতীয় মতটি সঠিক হওয়ার কারণ হলো, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, لَوْ كَانَ مَعَهُ آلِهَةٌ كَمَا يَقُولُونَ ‘‘যদি আল্লাহর সাথে অন্যান্য ইলাহ থাকতো যেমন এরা বলে থাকে’’। কিন্তু তারা এটি বলতো না যে, সৃষ্টিজগতের জন্য দু’জন স্রষ্টা রয়েছে। বরং তারা আল্লাহর সাথে এমনসব মাবুদ গ্রহণ করেছিল, যাদেরকে তারা আল্লাহর নিকট সুপারিশকারী মনে করতো। তারা বলেছিল,
﴿مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَىٰ ﴾
‘‘আমরা তো তাদের এবাদাত করি শুধু এ কারণে যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেবে’’। (সূরা যুমার: ৩) এটি প্রথমোক্ত আয়াতের বিপরীত।
[2]. মুসলিম হা/২৮৬৫ অধ্যায়: জান্নাত এবং তার সুখণ্ডস্বাচ্ছন্দ ও অধিবাসীদের বর্ণনা, অনুচ্ছেদ যে সমস্ত গুণাবলী দ্বারা দুনিয়াতে জান্নাতের অধিবাসী ও জাহান্নামের অধিবাসীদেরকে জানা যায়।
[3]. তবে এ শ্রেণীর লোকের সংখ্যা সর্বদাই কম ছিল, যা গণনার আওতায় পড়ে না।
রসূলগণ যে তাওহীদের প্রতি তাদের উম্মতদেরকে আহবান জানিয়েছেন এবং আল্লাহর কিতাবসমূহে যে তাওহীদের বর্ণনা রয়েছে তা দু‘প্রকার।
(১) আল্লাহর পরিচয় ও তার সিফাত সম্পর্কিত তাওহীদ এবং
(২) আবেদন-নিবেদন, উদ্দেশ্য ও নিয়ত সম্পর্কিত তাওহীদ।[1]
প্রথম প্রকার হলো, মহান প্রভুর সত্তার বাস্তবতা, তার গুণাবলী, কার্যাবলী এবং তার নামসমূহ সাব্যস্ত করা। উপরোক্ত বিষয়াবলীর কোনটিতেই তার সদৃশ নেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সম্পর্কে এ খবর দিয়েছেন এবং তার রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও অনুরূপ সংবাদ দিয়েছেন। কুরআন অত্যন্ত খোলাখুলিভাবে এ প্রকার তাওহীদ সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছে।
সূরা হাদীদের প্রথম দিকে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿سَبَّحَ لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآَخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ هُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يَعْلَمُ مَا يَلِجُ فِي الْأَرْضِ وَمَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمَا يَنْزِلُ مِنَ السَّمَاءِ وَمَا يَعْرُجُ فِيهَا وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنْتُمْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِلَى اللَّهِ تُرْجَعُ الْأُمُورُ يُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَيُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَهُوَ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُور﴾
‘‘আসমান ও যমীনসমূহের প্রতিটি জিনিসই আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করেছে। তিনি মহা পরাক্রমশালী ও অতিশয় বিজ্ঞ। পৃথিবী ও আকাশ সাম্রাজ্যের সার্বভৌম মালিক তিনিই। তিনিই জীবন দান করেন ও মৃত্যু ঘটান। তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান। তিনিই প্রথম তিনিই শেষ, তিনিই প্রকাশিত, তিনিই অপ্রকাশ্য[2] এবং তিনিই সব বিষয়ে অবহিত। তিনিই আসমান ও যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন এবং তারপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন। যা কিছু মাটির মধ্যে প্রবেশ করে, যা কিছু তা থেকে বেরিয়ে আসে এবং যা কিছু আসমান থেকে অবতীর্ণ হয় আর যা কিছু আসমানে উঠে তা তিনি জানেন। তোমরা যেখানেই থাক না কেন তিনি তোমাদের সাথে আছেন। তোমরা যা করছো আল্লাহ তা দেখছেন। আসমান ও যমীনের নিরংকুশ সার্বভৌম মালিকানা একমাত্র তারই। সব ব্যাপারের ফায়সালার জন্য তার কাছেই ফিরে যেতে হয়। তিনিই রাতকে দিনের মধ্যে এবং দিনকে রাতের মধ্যে প্রবিষ্ট করেন। তিনি অন্তরের গোপন বিষয় সম্পর্কেও অবহিত’’।
সূরা ত্বহার প্রথম দিকে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿تَنزِيلًا مِّمَّنْ خَلَقَ الْأَرْضَ وَالسَّمَاوَاتِ الْعُلَى الرَّحْمَٰنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَىٰ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ الثَّرَى وَإِنْ تَجْهَرْ بِالْقَوْلِ فَإِنَّهُ يَعْلَمُ السِّرَّ وَأَخْفَى اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى﴾
‘‘যেই সত্তা পৃথিবী ও সুউচ্চ আকাশমন্ডলী সৃষ্টি করেছেন তার পক্ষ থেকে এটি নাযিল করা হয়েছে। পরম দয়াবান আল্লাহ আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন। পৃথিবী ও আকাশে যা কিছু আছে, পৃথিবী ও আকাশের মাঝখানে যা আছে এবং যা কিছু ভূগর্ভে আছে, সবকিছুর মালিক তিনিই। তুমি যদি নিজের কথা উচ্চকন্ঠে বলো, তবে তিনি তো চুপিসারে বলা কথা বরং তার চেয়েও গোপনে বলা কথাও জানেন। তিনি আল্লাহ, তিনি ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ নেই, তার জন্য রয়েছে সর্বোত্তম নামসমূহ’’। (সূরা ত্বহা: ৩-৮) সূরা হাশরের শেষাংশে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَٰنُ الرَّحِيمُ هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَىٰ يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾
‘‘তিনিই আল্লাহ, যিনি ব্যতীত আর কোনো সত্য মাবুদ নেই। তিনি عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ (অদৃশ্য ও প্রকাশ্য সবকিছু সম্পর্কে অবগত), তিনি رحْمَنُ (পরম করুনাময়) এবং رَحِيمُ (অসীম দয়ালু)। তিনিই আল্লাহ, যিনি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই। তিনি مَلِك (মালিক), قُدُّوس (অতি পবিত্র) سَلَام (শান্তিদাতা), مؤْمِن (নিরাপত্তা দানকারী), مُهَيْمن (রক্ষাকারী), عَزِيز (পরাক্রমশালী), جَبَّار (প্রতাপশালী), مُتَكَبِّر (মহিমান্বিত)। তারা যাকে আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত করে আল্লাহ তা‘আলা তা থেকে পবিত্র। তিনিই আল্লাহ, خَالِق (সৃষ্টিকারী), بَارِي (উদ্ভাবক) এবং مُصَوِّر (রূপদাতা), তার জন্য রয়েছে অনেক সুন্দরতম নাম। আর তিনিই عَزِيز (মহাপরাক্রমশালী) ও حَكِيم(প্রজ্ঞাবান)’’।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা সেজদার প্রথম দিকে বলেন,
﴿اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ مَا لَكُمْ مِنْ دُونِهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا شَفِيعٍ أَفَلَا تَتَذَكَّرُونَ (4) يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مِنَ السَّمَاءِ إِلَى الْأَرْضِ ثُمَّ يَعْرُجُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ أَلْفَ سَنَةٍ مِمَّا تَعُدُّونَ (5) ذَلِكَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ (6) الَّذِي أَحْسَنَ كُلَّ شَيْءٍ خَلَقَهُ وَبَدَأَ خَلْقَ الْإِنْسَانِ مِنْ طِينٍ (7) ثُمَّ جَعَلَ نَسْلَهُ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ مَاءٍ مَهِينٍ (8) ثُمَّ سَوَّاهُ وَنَفَخَ فِيهِ مِنْ رُوحِهِ وَجَعَلَ لَكُمُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَالْأَفْئِدَةَ قَلِيلًا مَا تَشْكُرُونَ﴾
‘‘আল্লাহই আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী এবং এদের মাঝখানে যা কিছু আছে সব সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। অতঃপর আরশে সমুন্নত হয়েছেন। তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো সাহায্যকারী নেই এবং নেই তার সামনে সুপারিশকারী। তারপরও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না? তিনি আকাশ থেকে পৃথিবী পর্যন্ত দুনিয়ার যাবতীয় বিষয় পরিচালনা করেন এবং এ পরিচালনার বৃত্তান্ত উপরে তার কাছে যায় এমন একদিনে যার পরিমাপ তোমাদের গণনায় এক হাজার বছর। তিনিই প্রত্যেকটি অদৃশ্য ও দৃশ্যমান বস্তু সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। তিনি মহাপরাক্রমশালী ও দয়াময়। যিনি সৃষ্টি করেছেন উত্তম রূপে এবং তিনি মানুষ সৃষ্টির সূচনা করেছেন কাদামাটি থেকে, তারপর তার বংশধর সৃষ্টি করেছেন তুচ্ছ পানির সংমিশ্রণ থেকে। তারপর তাকে সুঠাম সুন্দর করেছেন এবং তার মধ্যে নিজের রূহ ফুঁকে দিয়েছেন আর তোমাদের কান, চোখ ও হৃদয় স্থাপন করে দিয়েছেন। তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো’’। (সূরা হা-মীম আস-সাজদাহ:৪-৯)
সূরা আল-ইমরানের শুরুর দিকে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ﴾
‘‘আল্লাহ একক সত্তা, তিনি ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব এবং সৃষ্টিজগতের সবকিছুর ব্যবস্থাপক ও ধারক’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১)
আল্লাহ তা‘আলা একই সূরায় আরো বলেন,
﴿إِنَّ اللَّهَ لَا يَخْفَىٰ عَلَيْهِ شَيْءٌ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي السَّمَاءِ هُوَ الَّذِي يُصَوِّرُكُمْ فِي الْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَاءُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ﴾
‘‘পৃথিবী ও আকাশের কোনো কিছুই আল্লাহর কাছে গোপন নেই। তিনি মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় যেভাবে ইচ্ছা তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। এ প্রবল পরাক্রান্ত মহাজ্ঞানের অধিকারী সত্তা ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ নেই’’। (সূরা আলে ইমরান: ৫-৬)
সূরা ইখলাসের পুরোটাই আল্লাহর পরিচয় ও গুণাবলী বর্ণনা করছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ﴾
‘‘হে নাবী তুমি বলো, তিনি আল্লাহ্ একক। আল্লাহ্ অমুখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেননি, কারো থেকে জন্ম নেননি এবং তার সমতুল্য কেউ নেই’’।
এমনি আরো বহু আয়াতে এ প্রকার তাওহীদের ব্বিরণ এসেছে।[3]
আর কুরআন মাজীদের সূরা কাফিরূনে দ্বিতীয় প্রকার তাওহীদ তথা বান্দার আবেদন-নিবেদন, উদ্দেশ্য ও নিয়ত সম্পর্কিত তাওহীদের ব্বিরণ এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ يَا أَيُّهَا الْكَافِرُونَ (1) لَا أَعْبُدُ مَا تَعْبُدُونَ (2) وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ (3) وَلَا أَنَا عَابِدٌ مَا عَبَدْتُمْ (4) وَلَا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ (5) لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ﴾
‘‘হে নাবী বলো, হে কাফেররা! আমি তাদের ইবাদত করি না যাদের ইবাদত তোমরা করো। আর না তোমরা তার ইবাদত করো, যার ইবাদত আমি করি। আর না আমি তাদের ইবাদত করবো, যাদের ইবাদত তোমরা করে আসছো। আর না তোমরা তার ইবাদত করবে, যার ইবাদত আমি করি তোমাদের দীন তোমাদের জন্য এবং আমার দ্বীন আমার জন্য’’।
আল্লাহ্ তা‘আলা সূরা আলে ইমরানের ৬৪ নং আয়াতে বলেন,
﴿قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْاْ إِلَى كَلَمَةٍ سَوَاء بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلاَّ نَعْبُدَ إِلاَّ اللّهَ وَلاَ نُشْرِكَ بِهِ شَيْئاً وَلاَ يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضاً أَرْبَاباً مِّن دُونِ اللّهِ فَإِن تَوَلَّوْاْ فَقُولُواْ اشْهَدُواْ بِأَنَّا مُسْلِمُونَ﴾
‘‘হে নাবী বলো, হে আহলে-কিতাবগণ! এসো এমন একটি কথার দিকে, যা আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান। তা এ যে, আমরা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবো না, তার সাথে কাউকে শরীক করবো না এবং আমাদের কেউ একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে নিজের রব হিসাবে গ্রহণ করবে না। তারপরও যদি তারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে, তাহলে বলে দাও যে, সাক্ষী থাকো আমরা অবশ্যই মুসলিম’’।
সূরা যুমারের প্রথম দিকে ও শেষ দিকে তাওহীদুল উলুহীয়াহ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّينَ أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ﴾
‘‘অতএব, তুমি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করো। জেনে রাখো! নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত কেবল আল্লাহর জন্যই। যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অপরকে মাবুদরূপে গ্রহণ করেছে এবং বলে যে, আমরা তাদের ইবাদত এ জন্যই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়। নিশ্চয় আল্লাহ্ তাদের মধ্যে তাদের পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ের ফায়ছালা করে দেবেন। আল্লাহ্ মিথ্যাবাদী কাফেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না’’। (সূরা যুমার: ২-৩) একই সূরার শেষের দিকে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ، بَلِ اللَّهَ فَاعْبُدْ وَكُن مِّنْ الشَّاكِرِينَ﴾
‘‘তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি প্রত্যাদেশ হয়েছে, যদি আল্লাহর শরীক স্থির করো, তবে তোমার কর্ম নিস্ফল হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। বরং আল্লাহর ইবাদত করো এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত থাকো’’। (সূরা যুমার: ৬৫-৬৬)
সূরা ইউনুসের প্রথম দিকে, মাঝামাঝি এবং শেষের দিকেও একই বিষয়ের আলোচনা এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইউনূসের ৩ নং আয়াতে বলেন,
﴿يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ﴾
‘‘তিনি সকল কার্য পরিচালনা করেন। তার অনুমতি ব্যতীত কেউ সুপারিশ করতে পারবে না। তিনিই আল্লাহ্ তোমাদের প্রতিপালক। অতএব তোমরা তারই ইবাদত করো। তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবে না?’’ আল্লাহ তা‘আলা এ সূরার শেষের দিকে বলেন,
﴿قُلْ يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنْتُمْ فِي شَكٍّ مِنْ دِينِي فَلَا أَعْبُدُ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ وَلَكِنْ أَعْبُدُ اللَّهَ الَّذِي يَتَوَفَّاكُمْ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَأَنْ أَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفًا وَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُشْرِكِينَ وَلَا تَدْعُ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَنْفَعُكَ وَلَا يَضُرُّكَ فَإِنْ فَعَلْتَ فَإِنَّكَ إِذًا مِنَ الظَّالِمِينَ﴾
‘‘হে নাবী! বলো, হে লোকেরা! তোমরা যদি আমার দ্বীনের ব্যাপারে কোনো সন্দেহের মধ্যে থাকো তাহলে শুনে রাখো, তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের ইবাদত করো আমি তাদের ইবাদত করি না। বরং আমি কেবল সেই আল্লাহর ইবাদত করি, যার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তোমাদের মৃত্যু। আমাকে মুমিনদের অন্তরর্ভুক্ত হবার জন্য হুকুম দেয়া হয়েছে। আর আমাকে বলা হয়েছে, তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে সঠিকভাবে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখো এবং কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। আর আল্লাহকে বাদ দিয়ে এমন কোনো সত্তাকে ডেকো না, যে তোমার না কোনো উপকার করতে পারে, না পারে ক্ষতি করতে। যদি তুমি এএটি করো তাহলে যালেমদের দলভুক্ত হবে’’।
সূরা আরাফের শুরুতে বলেন,
﴿اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ﴾
‘‘হে লোক সকল! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের উপর যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তার অনুসরণ করো এবং নিজেদের রবকে বাদ দিয়ে অন্যান্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। কিন্তু তোমরা খুব কমই উপদেশ মেনে থাকো’’। (সূরা আল আরাফ: ২) একই সূরার শেষের দিকে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ عِبَادٌ أَمْثَالُكُمْ فَادْعُوهُمْ فَلْيَسْتَجِيبُوا لَكُمْ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ﴾
‘‘তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে ডাকো তারা তো তোমাদের মতই বান্দা। তোমরা তাদেরকে ডাকতে থাকো। তাদের সম্পর্কে তোমাদের ধারণা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে তারা তোমাদের আহবানে সাড়া দিক’’। (সূরা আল ‘আরাফ: ১৯৪) আল্লাহ তা‘আলা একই সূরার সর্বশেষ আয়াতে বলেন,
﴿إِنَّ الَّذِينَ عِنْدَ رَبِّكَ لَا يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيُسَبِّحُونَهُ وَلَهُ يَسْجُدُونَ﴾
‘‘তোমার রবের সান্নিধ্যে অবস্থানকারী ফেরেশতাগণ কখনো নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহংকারে তার ইবাদতে বিরত হয় না, বরং তারা তারই মহিমা ঘোষণা করে এবং তার সামনে সিজদাবনত হয়’’।
সূরা আন‘আমের সর্বত্রই তাওহীদুল উলুহীয়ার বিশদ ব্বিরণ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيفاً وَمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾
‘‘আমি একনিষ্ঠ হয়ে স্বীয় চেহারা ঐ সত্তার দিকে ফিরাচ্ছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অমর্ত্মভুক্ত নই’’ (সূরা আল আন‘আম: ৭৯)।
মোটকথা কুরআনের অধিকাংশ সূরাতেই উপরোক্ত দু’প্রকার তাওহীদের আলোচনা রয়েছে। বরং প্রত্যেক সূরাতেই রয়েছে তাওহীদের আলোচনা। কেননা কুরআনে যা রয়েছে, তা হয়ত আল্লাহ এবং তার অতি সুন্দর নাম ও সুমহান গুণাবলী সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছে, আর এটি হলো আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কিত তাওহীদ। অথবা তাতে রয়েছে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান, তার কোনো শরীক নেই এবং আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য যেসব জিনিসের ইবাদত করা হয়, তা বর্জনের আদেশ। আর এটি হলো আল্লাহর নিকট প্রার্থনা, চাওয়া ও আবেদন-নিবেদন সংক্রান্ত তাওহীদ।
অথবা কুরআনে রয়েছে আল্লাহর আদেশ, নিষেধ এবং তার আনুগত্য করার বাধ্যবাধকতা। আর এগুলো হলো তাওহীদের হক ও পরিপূরক বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত। অথবা তাতে রয়েছে তাওহীদপন্থীদেরকে আল্লাহর পক্ষ হতে সম্মানিত করা, দুনিয়াতে তাদেরকে প্রতিষ্ঠা দান করা এবং আখেরাতে তিনি তাদেরকে যা দিয়ে সম্মান করবেন তদসংক্রান্ত বিষয়াদি। আর এটি হলো তাওহীদ বাস্তবায়নের বিনিময় স্বরূপ।
অথবা কুরআনে রয়েছে মুশরিকদের খবরাদি এবং দুনিয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক কী পরিমাণ শাস্তি দিয়েছিলেন এবং আখেরাতে তাদের জন্য কী ধরণের আযাব অপেক্ষা করছে, তার বর্ণনা। আর এটি হলো ঐসব লোকের পরিণাম, যারা তাওহীদের বিধান ও হুকুম বর্জন করেছিল।
সুতরাং সম্পূর্ণ কুরআনই তাওহীদ এবং তার হকসমূহ বাস্তবায়ন করার সুফল সম্পর্কে বিশদ বর্ণনায় ভরপুর। একই সঙ্গে তাতে রয়েছে শির্ক এবং শির্ককারীদের ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কিত আলোচনা। আমরা যদি সূরা ফাতিহার দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাই,
﴿الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ﴾
‘‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা’’। এতে রয়েছে তাওহীদ।
﴿الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ﴾
‘‘তিনি অতি মেহেরবান ও পরম দয়ালু’’। এতেও রয়েছে তাওহীদ।
﴿مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ﴾
‘‘তিনি প্রতিদান দিবসের মালিক’’। এতেও রয়েছে তাওহীদ।
﴿إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ﴾
‘‘আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি ও শুধু তোমার কাছেই সাহায্য চাই’’। এতেও রয়েছে তাওহীদ।
﴿اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ﴾
‘‘আমাদেরকে সরল সঠিক পথ দেখাও’’। এটি হলো সেই তাওহীদ, যাতে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদপন্থীদের পথের সন্ধান চাওয়া হয়েছে।
﴿صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ﴾
‘‘সে সমস্ত লোকের পথ যাদেরকে তুমি নেয়ামত দান করেছ’’। এখানে তাওহীদ বাস্তবায়নকারীদের অবস্থার ব্বিরণ রয়েছে।
﴿غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ﴾
‘‘তাদের পথ নয়, যাদের উপর তোমার গযব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে’’। এখানে রয়েছে, তাওহীদ বর্জনকারীদের পরিণামের বর্ণনা।
এমনি আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার জন্য তাওহীদের সাক্ষ্য দিয়েছেন, তার ফেরেশতারাও তাওহীদের সাক্ষ্য দিয়েছেন, তার নাবী-রসূলগণও একই সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿شَهِدَ اللّهُ أَنَّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ وَالْمَلاَئِكَةُ وَأُوْلُواْ الْعِلْمِ قَآئِمَاً بِالْقِسْطِ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ إِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللَّهِ الإِسْلاَمُ﴾
‘‘আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই। ফেরেশতাগণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ্ নেই। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহর নিকট ইসলাম হচ্ছে একমাত্র মনোনীত দ্বীন’’। (সূরা আলে-ইমরান: ১৮-১৯)
উপরোক্ত আয়াতটি তাওহীদের প্রকৃত স্বরূপ বর্ণনা করেছে এবং তাওহীদ সম্পর্কে সমস্ত গোমরাহ সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ করেছে। সর্বাধিক মহান সাক্ষ্যদাতা সর্ববৃহৎ বিষয়ের সাক্ষ্য দিয়েছেন। সুতরাং এটি সুমহান, সর্ববৃহৎ, সর্বাধিক ন্যায়নিষ্ঠ এবং সর্বাধিক সত্য সাক্ষ্য।
সালাফগণ شهد শব্দের যেসব অর্থ বর্ণনা করেছেন তা হলো, হুকুম করেছেন, ফায়ছালা করেছেন, জানিয়ে দিয়েছেন, বর্ণনা করেছেন এবং সংবাদ দিয়েছেন। شهد শব্দটি ঘুরেফিরে এ কয়টি অর্থই প্রদান করে। সবগুলো অর্থই সঠিক। তার মধ্যে কোনো পারস্পরিক বৈপরিত্য নেই। কেননা شهادة শব্দটি সাক্ষ্যদানকারীর বক্তব্য ও তার খবরকে শামিল করে। সেই সাথে জানিয়ে দেয়া, সংবাদ দেয়া এবং বর্ণনা করাও এর অন্তর্ভুক্ত।
সাক্ষ্য দেয়ার চারটি স্তর রয়েছে।
(১) যে বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়া হবে, সে সম্পর্কে জানা আবশ্যক এবং তার বিশুদ্ধতা ও সত্যতা সম্পর্কে সুদৃঢ় বিশ্বাস থাকা জরুরী।
(২) জবানের দ্বারা তা উচ্চারণ করা। যদিও উচ্চারণের মাধ্যমে কাউকে তার বিষয় সম্পর্কে জানানো সম্ভব না হয়। বরং সাক্ষ্যের বিষয়ে নিজের নফ্সের সাথে কথা বলা, তা স্মরণ করা, উচ্চারণ করা অথবা লিখে রাখাই যথেষ্ট।
(৩) সাক্ষ্যের বিষয় সম্পর্কে অন্যকে জানিয়ে দেয়া, তা সম্পর্কে সংবাদ দেয়া এবং খোলাখুলি রূপে তার ব্বিরণ দেয়া।
(৪) এর বিষয় বস্তু অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া এবং তার আদেশ প্রদান করা।
সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তার নিজের একত্বের সাক্ষ্য দেয়া এবং ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা এ চারটি স্তরকেই শামিল করে। আল্লাহ সুবহানাহু তার একত্বের যেই সাক্ষ্য দিয়েছেন, সে সম্পর্কে তিনি পূর্ণ অবগত রয়েছেন, তিনি তা দ্বারা কথা বলেছেন, তার সৃষ্টিকে তা জানিয়ে দিয়েছেন ও তার সংবাদ প্রদান করেছেন এবং তা বাস্তবায়নের আদেশ দিয়েছেন ও তার বিষয় বস্তু কার্যকর করার দায়িত্ব সৃষ্টির উপর চাপিয়ে দিয়েছেন।
সাক্ষ্যের বিষয় সম্পর্কে ইলম থাকা জরুরী। অন্যথায় সাক্ষ্যদাতা এমন বিষয়ের সাক্ষ্য দিবে, যে সম্পর্কে তার কোনো জ্ঞান নেই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِلاَّ مَنْ شَهِدَ بِالْحَقِّ وَهُم يَعْلَمُوْنَ﴾
‘‘তবে যারা অবগত হয়ে সত্য স্বীকার করে’’। (সূরা যখরুফ: ৮৬)
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সূর্যের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন,
«عَلَى مِثْلِهَا فَاشْهَدْ» ‘‘এরূপ সুস্পষ্ট বিষয়ের সাক্ষ্য প্রদান করবে’’।
জবান দ্বারা সাক্ষ্যবাণী উচ্চারণ করা এবং তার সংবাদ প্রদান করা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَجَعَلُوا الْمَلَائِكَةَ الَّذِينَ هُمْ عِبَادُ الرَّحْمَنِ إِنَاثًا أَشَهِدُوا خَلْقَهُمْ سَتُكْتَبُ شَهَادَتُهُمْ وَيُسْأَلُونَ﴾
‘‘তারা দয়াবান আল্লাহর বান্দা ফেরেশতাদেরকে নারী গণ্য করেছে। তাদের সৃষ্টির সময় কি এরা উপস্থিত ছিল? এদের সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা হবে এবং এদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে’’ (সূরা যুখরুফ: ১৯)।
আল্লাহ তা‘আলা এখানে তাদের কথাকে সাক্ষ্য হিসাবে নাম দিয়েছেন। যদিও তারা শাহাদাত বা সাক্ষ্য দেয়া শব্দটি উচ্চারণ করেনি এবং অন্যদের নিকট সাক্ষ্য প্রদান করেনি।
সাক্ষ্য প্রদানের তৃতীয় স্তর অর্থাৎ সাক্ষ্যের বিষয় জানিয়ে দেয়া এবং সে ব্যাপারে সংবাদ দেয়া দু‘ প্রকার:
(১) কথার মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া।
(২) কর্মের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া।
আদেশের মাধ্যমে যে ব্যক্তি অন্যকে শিক্ষা দেয়, তার অবস্থা ঠিক এরকম। কখনো কথার মাধ্যমে শিক্ষা দেয় আবার কখনো কাজ-কর্মের মাধ্যমে শিক্ষা দেয়। এ জন্যই যে ব্যক্তি তার ঘরকে মসজিদে রূপান্তরিত করে, তার ঘরের দরজা প্রশস্ত করে এবং মানুষকে সেখানে প্রবেশ করে ছালাত পড়ার অনুমতি দেয় সে মুখ দিয়ে কথা না বললেও তাকে এ ঘোষণাকারী হিসাবে ধরা হবে যে, সে তা মুসলমানদের জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছে। অনুরূপ যাকে দেখা যাবে সে কারো সান্নিধ্যে পৌঁছার জন্য নানা পথ অবলম্বন করছে, তার ব্যাপারে সে মূলতঃ নিজের জন্য এবং অন্যদের জন্য ঘোষণা করছে যে, সে তাকে ভালোবাসে। যদিও সে জবান দিয়ে তা উচ্চারণ না করে। এমনি জবান দিয়ে উচ্চারণ করলেও বুঝা যাবে যে, সে তাকে ভালবাসার ঘোষণা দিচ্ছে।
এমনি আল্লাহ তা‘আলার একত্বতা সম্পর্কে তার নিজের সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হলো তা বর্ণনা করা ও জানিয়ে দেয়া। এটি কথার মাধ্যমে হতে পারে আবার কাজের মাধ্যমেও হতে পারে। তিনি রসূলদেরকে যা দিয়ে পাঠিয়েছেন এবং যা দিয়ে তার আসমানী কিতাবসমূহ নাযিল করেছেন, তা কথার অন্তর্ভুক্ত।
কাজ-কর্মের মাধ্যমে তার একত্বতা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া ও বর্ণনা করার উদাহরণ যেমন ইবনে কাইসান বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা তার বিস্ময়কর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এবং তার অপরিবর্তনীয় আদেশসমূহের দ্বারা সৃষ্টির নিকট সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত আর কোনো সত্য ইলাহ নেই। অন্য একজন বলেছেন,
وَفِي كُلِّ شَيْءٍ لَهُ آيَةٌ... تَدُلُّ عَلَى أَنَّهُ وَاحِد
‘‘প্রত্যেক জিনিসের মধ্যে তার নিদর্শন রয়েছে, যা প্রমাণ করে তিনি এক’’। কাজ-কর্মের মাধ্যমেও সাক্ষ্য দেয়া যায়। তার প্রমাণ হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿مَا كَانَ لِلْمُشْرِكِينَ أَن يَعْمُرُوا مَسَاجِدَ اللَّهِ شَاهِدِينَ عَلَىٰ أَنفُسِهِم بِالْكُفْرِأُولَٰئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ وَفِي النَّارِ هُمْ خَالِدُونَ﴾
‘‘মুশরিকরা যখন নিজেরাই নিজেদের কুফরীর সাক্ষ্য দিচেছ তখন আল্লাহর মসজিদসমূহের রক্ষণা-বেক্ষণকারী ও খাদেম হওয়া তাদের কাজ নয়। তাদের সমস্ত আমল বরবাদ হয়ে গেছে এবং তাদেরকে চিরকাল জাহান্নামে থাকতে হবে’’ (সূরা আত তাওবা: ১৭)।
সুতরাং তারা তাদের কাজের মাধ্যমে তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। মোট কথা আল্লাহ তা‘আলা তার নিদর্শনগুলোকে তার একত্বের দলীল হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা এগুলোকে সৃষ্টি করা ও নির্ধারণ করার দ্বারাই একত্বের দলীল বানিয়েছেন।
আর সাক্ষ্য দেয়ার চতুর্থ স্তর হলো এর বিষয়বস্তু কার্যকর করার আদেশ দেয়া এবং এতে বাধ্য করা। শুধু মুখ দিয়ে সাক্ষ্য উচ্চারণ করা এর বিষয়বস্তু বাস্তবায়ন করাকে আবশ্যক করে না। কিন্তু এখানে আল্লাহ তা‘আলা যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তার বিষয়বস্তু বাস্তবায়ন করার প্রতি নির্দেশনা প্রদান করে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এখানে যে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তা হুকুমকারীর সাক্ষ্যও হুকুমের মতই। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদের ফায়ছালা করেছেন, তার হুকুম করেছেন এবং বান্দাদের উপর তা বাস্তবায়ন করা আবশ্যক করে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا﴾
‘‘তোমার রব এ ফায়ছালা দিয়েছেন যে, তাকে ছাড়া তোমরা অন্য কারো ইবাদত করো না। আর মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো’’ (সূরা বনী ইসরাঈল: ২৩)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَقَالَ اللَّهُ لَا تَتَّخِذُوا إِلَٰهَيْنِ اثْنَيْنِ إِِنَّمَا هُوَ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ فَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ﴾
‘‘আল্লাহর ফরমান হলো, দু’ইলাহ গ্রহণ করো না, ইলাহ তো মাত্র এক, কাজেই তোমরা আমাকেই ভয় করো’’ (সূরা আন নাহাল: ৫১)। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاء وَيُقِيمُوا الصَّلَاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ﴾
‘‘তাদেরকে এ ছাড়া অন্য কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, ছলাত কায়েম করবে এবং যাকাত দেবে। এটাই সঠিক দ্বীন’’ (সূরা আল বায়্যিনাহ: ৫)। আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُواْ إِلاَّ لِيَعْبُدُواْ إِلَـهاً وَاحِداً لاَّ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾
‘‘তারা আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের পন্ডিত ও সংসারত্যাগী-বৈরাগীদিগকে তাদের প্রভু রূপে গ্রহণ করেছে এবং মারইয়ামের পুত্রকেও। অথচ তারা আদিষ্ট ছিল একমাত্র মাবুদের ইবাদতের জন্য। তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই, তারা তার যেসব শরীক সাব্যস্ত করে, তা থেকে তিনি পূত-পবিত্র’’ (সূরা আত তাওবা: ৩১)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿لَّا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ فَتَقْعُدَ مَذْمُومًا مَّخْذُولًا﴾
‘‘আল্লাহর সাথে দ্বিতীয় কাউকে মাবুদে পরিণত করো না। অন্যথায় নিন্দিত ও অসহায় পথহারা হয়ে পড়বে’’ (সূরা বনী ইসরাঈল: ২২)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَا تَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَٰهًا آخَرَ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ لَهُ الْحُكْمُ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ﴾
‘‘আল্লাহর সাথে অন্য মাবুদদেরকে ডেকো না। তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই। সব জিনিসই ধ্বংস হবে কেবলমাত্র তার সত্ত্বা ছাড়া। হুকুম করার অধিকার একমাত্র তারই এবং তারই দিকে তোমাদের সবাইকে ফিরে যেতে হবে’’ (সূরা কাসাস: ৮৮)।
কুরআনের প্রত্যেক স্থানেই তাওহীদের সাক্ষ্য বিদ্যমান। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার সাক্ষ্যের মাধ্যমে তাওহীদ বাস্তবায়ন আবশ্যক হওয়ার কারণ হলো, তিনি যখন এ সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই, তখন তিনি এ খবর, বর্ণনা, ঘোষণা, হুকুম ও ফায়ছালা দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া অন্য কেউ ইলাহ নেই অথবা তিনি ছাড়া অন্যদের ইবাদত বাতিল।
সুতরাং তিনি ব্যতীত অন্য কোনো ইবাদতের হকদার নয় এবং তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতের যোগ্যও নয়। তাই একমাত্র তাকেই ইলাহ হিসাবে গ্রহণ করার আদেশ দেয়া হয়েছে এবং তার সাথে অন্য কাউকে ইলাহ হিসাবে গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। لاإله إلا الله এর মধ্যে যে নফী (নেতীবাচক) ও ইছবাত (সাব্যস্ত করা) রয়েছে, তা থেকে সম্বোধিত ব্যক্তি সহজেই উপরোক্ত অর্থ বুঝতে সক্ষম। আপনি যখন কোনো লোককে দেখবেন, সে এমন একজন লোকের কাছে ফতোয়া জিজ্ঞেস করছে কিংবা সাক্ষ্য তলব করছে অথবা চিকিৎসা করতে বলছে, যে উক্ত কাজগুলোতে পারদর্শী নয় তখন আপনি জিজ্ঞাসাকারীকে সতর্ক করতে গিয়ে অবশ্যই বলবেন যে, এ লোক মুফতী নয়, অমুক ব্যক্তি সাক্ষ্য দানে পারদর্শী নয় এবং অমুক ব্যক্তি ডাক্তার নয়। অতএব এ থেকে বুঝা যায় যে, আপনার পক্ষ হতে এটি আদেশ এবং নিষেধ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
সুতরাং ‘আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য উপাস্য নেই, সূরা আলে ইমরানের এ আয়াতটি প্রমাণ করছে যে, বান্দার ইবাদতের হকদার একমাত্র আল্লাহ। যখন তিনি সংবাদ দিয়েছেন, তিনিই একমাত্র ইবাদতের হকদার, তখন এ সংবাদ ইবাদতের আদেশ করা এবং বান্দার উপর আল্লাহর যেই হক রয়েছে তা আদায় করা আবশ্যক। বান্দাদের উপর আল্লাহর একক অধিকার হলো, তারা কেবল তারই ইবাদত করবে।
حكم এবং قضاء শব্দদ্বয় সংবাদ ও খবর অর্থেও ব্যবহৃত হয়। নিছক সংবাদকেও বিচার এবং হুকুম বলা হয়। বলা হয়ে থাকে, মোকাদ্দমাটিতে এ রকম ফায়ছালা দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَا إِنَّهُمْ مِنْ إِفْكِهِمْ لَيَقُولُونَ وَلَدَ اللَّهُ وَإِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ أَصْطَفَى الْبَنَاتِ عَلَى الْبَنِينَ مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ﴾
‘‘শুনে রাখো, আসলে তারা তো মনগড়া কথা বলে। তারা বলে, আল্লাহর সন্তান রয়েছে এবং যথার্থই তারা মিথ্যাবাদী। আল্লাহ কি নিজের জন্য পুত্রের পরিবর্তে কন্যা পছন্দ করেছেন? তোমাদের কী হলো, কিভাবে এ ফায়সালা করছো?’’ (সূরা সাফফাত: ১৫১-১৫৪)
এখানে আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদের নিছক সংবাদকে ফায়ছালা হিসাবে নাম দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أَفَنَجْعَلُ الْمُسْلِمِينَ كَالْمُجْرِمِينَ مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُونَ﴾
‘আমি কি অনুগতদের অবস্থা অপরাধীদের মতো করবো? কী হয়েছে তোমাদের? এ কেমন বিচার তোমরা করছো?’’ (সূরা কালাম: ৩৫-৩৬) তবে এখানে কাফের পক্ষ হতে যেই সংবাদ দেয়া হয়েছে তাতে কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
(১) তাওহীদুর রুবুবীয়াহ,
(২) তাওহীদুল আসমা ওয়াস্ সিফাত এবং
(৩) তাওহীদুল উলুহীয়াহ।
শাইখ ইবনে আবীল প্রথম দু’টিকে আল্লাহ তাআলার কর্ম ও গুণাবলী সংক্রান্ত তাওহীদকে একই প্রকারের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, তাওহীদের এ প্রকারভেদ কুরআন-হাদীছের কোন প্রকাশ্য দলীল থেকে গ্রহণ করা হয়নি; বরং কুরআন ও হাদীছের সমস্ত বক্তব্য থেকেই তাওহীদের এ প্রকারভেদের ধারণা এসেছে। বিদআতীদের অনেকেই বলে থাকে, ইমাম ইবনে তাইমীয়া রহিমাহুল্লাহ সর্বপ্রথম তাওহীদকে তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছেন। তাদের এ কথা ঠিক নয়; বরং আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস, কাতাদাহ, মুজাহিদ, ইবনে বাত্তা, ইবনে মান্দাসহ আরো অনেক সালাফ থেকেই তাওহীদকে একাধিক শ্রেণীতে বিভক্ত করার প্রমাণ পাওয়া যায়। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রহিমাহুল্লাহ পূর্ববর্তী আলেমদের কথাকে বর্ণনা ও ব্যাখ্যা করেছেন মাত্র। (আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)
[2]. আলেমগণ ও কালাম শাস্ত্রবিদগণ আল্লাহ তাআলার এ নামগুলোর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করেছেন। ছহীহ মুসলিমে বর্ণিত উপরোক্ত ছহীহ হাদীছে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে যেহেতু এগুলোর ব্যাখ্যা এসেছে, তাই এসব ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন ছিল না। আল্লাহ তা‘আলার এ চারটি নাম তথা الأَوَّل (সর্বপ্রথম) ও الآخر (সর্বশেষ) এবং الظَاهِر (সব কিছুর উপরে) ও البَاطِن (অতি নিকটে) প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলা সমস্ত সৃষ্টিকেই সকল দিক থেকে পরিবেষ্টন করে আছেন। الأَوَّل (সর্বপ্রথম) ও الآخر (সর্বশেষ) -এই দু’টি নাম প্রমাণ করে যে, তিনি সমস্ত কাল ও যামানাকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন। অর্থাৎ স্থান, কাল এবং তাতে যত মাখলুক সৃষ্টি করা হয়েছে, তা সৃষ্টি করার পূর্বেও তিনি ছিলেন। স্থান, কাল ও সমস্ত মাখলুক ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরও তিনি অবশিষ্ট থাকবেন। অর্থাৎ যখন কিছুই ছিল না তখনো তিনি ছিলেন এবং যখন কিছুই থাকবেনা তখনো তিনি থাকবেন।
আর আল্লাহ তাআলার الظَاهِر (সবকিছুর উপরে) ও البَاطِن (অতি নিকটে) এ নাম দু’টি প্রমাণ করে যে, তিনি উর্ধ্বজগৎ এবং নিমণজগতের সকল স্থান এবং সেসব স্থানের সব কিছুকেই ঘেরাও করে আছেন।
আল্লাহর যাহের নামটি প্রমাণ করে যে, তিনি সকল মাখলুকের উপরে। আরবী ভাষায় প্রত্যেক বস্তুর উপরের অংশকে যাহের বলা হয়। সকল মাখলুক তার নীচে। তার উপরে কোন মাখলুক নেই।
কেউ কেউ যাহের অর্থ করেছেন যে, তিনি প্রকাশ্য। তাদের মতে الظهور থেকে الظاهر নামটি এসেছে। ظهور অর্থ প্রকাশিত হওয়া। সুতরাং তিনি তার নিদর্শন, দলীল-প্রমাণ এবং কার্যাবলীর মাধ্যমে মানুষের বিবেকের নিকট অত্যন্ত প্রকাশিত। আর তিনি الباطن অপ্রকাশ্য এই হিসাবে যে, দুনিয়ার অন্যান্য দৃশ্যমান জিনিসের মত তাকে দেখা যায় না।
সুতরাং এ চারটি নামের মূল অর্থই হচ্ছে আল্লাহ তাআলা সকল সৃষ্টিকে সকল দিক থেকেই ঘেরাও করে আছেন। সৃষ্টির সূচনার পূর্বেই আল্লাহ তাআলা বিদ্যমান থাকা এবং সব সৃষ্টির শেষেও অনন্তকাল তার অবশিষ্ট থাকা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যেসব বস্তু সৃষ্টি করেছেন এবং সবশেষে যেসব বস্তু সৃষ্টি করবেন, তার সবই তিনি পরিবেষ্টন করে আছেন। তিনি যাহের তথা সবকিছুর উপরে হওয়া এবং বাতেন তথা সবকিছুর নিকটে হওয়ার দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, তিনি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল বস্তুকেই ঘেরাও করে আছেন।
সে হিসাবে আল্লাহ তাআলার الأول নামটি তার সর্বপ্রথম হওয়ার প্রমাণ করে। তার الآخر নামটি তার চিরস্থায়িত্বের প্রমাণ করে। তার الظاهر নামটি প্রমাণ করে যে, তিনি সবকিছুরে উপরে এবং তিনি সর্বাধিক মহান। আর আল্লাহ তাআলার الباطن নামটি প্রমাণ করে যে, তিনি সৃষ্টির অতি নিকটে এবং তাদের সাথে।
আল্লাহ তাআলার الباطن নামটির ব্যাখ্যায় আলেমদের থেকে বিভিন্ন উক্তি পাওয়া যায়। সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ অর্থাৎ তুমি অতি নিকটে, তোমার চেয়ে অধিক নিকটে আর কিছুই নেই। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, الباطن অর্থ নিকটে। সুতরাং আল্লাহ তাআলা মাখলুকের নিকটবর্তী এবং তিনি স্বীয় ইলমের মাধ্যমে তাদেরকে বেষ্টন করে আছেন। তিনি তাদের সকল গোপন এবং অস্পষ্ট বিষয় ও অবস্থা সম্পর্কে জানেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,﴿وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنكُمْ وَلَٰكِن لَّا تُبْصِرُونَ﴾ ‘‘আমি তোমাদের চেয়ে সে মুমূর্ষ ব্যক্তির অধিক নিকটবর্তী, কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না। (সূরা ওয়াকিয়া: ৮৫) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ﴿وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ ۖ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ﴾ ‘‘আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি। আর তাদের মনে যেসব কুমন্ত্রণা উদিত হয় তা আমি জানি। আমি তার ঘাড়ের শাহ রগের চেয়েও অধিক নিকটে আছি’’। (সূরা কাফ: ১৬)
এ আয়াতের তাফসীরে বলা হয়েছে যে, আমার জ্ঞান ও ক্ষমতা ভিতর এবং বাহির থেকে এমনভাবে মানুষকে পরিবেষ্টন করে আছে যে, আমার ক্ষমতা ও জ্ঞান তার তত নিকটে যত নিকটে তার ঘাড়ের শিরাও নয়। তার কথা শোনার জন্য আমাকে কোথাও থেকে আসতে হয় না। তার মনের মধ্যে উদিত কল্পনাসমূহ পর্যন্ত আমি সরাসরি জানি। অনুরূপভাবে তাকে যদি কোন সময় পাকড়াও করতে হয় তখনো আমাকে কোথাও থেকে এসে তাকে পাকড়াও করতে হয় না। সে যেখানেই থাকুক, সর্বদা আমার আয়ত্বাধীনেই আছে যখন ইচ্ছা আমি তাকে বন্দী করবো।
কেউ কেউ বলেছেন, الباطن অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির দৃষ্টিসীমা ও ধারণার অন্তরালে এবং অপ্রকাশ্য। যারা এ কথা বলেছেন, তাদের কেউ কেউ একটু বাড়িয়ে ব্যাখ্যা করেছেন যে, আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু অপ্রকাশ্য, তাই পৃথিবীর কোথাও তাকে খুঁজে বের করা বা তার দেখা পাওয়া যাবে না। তিনি সব গুপ্ত জিনিসের চেয়ে অধিক গুপ্ত। কারণ, ইন্দ্রীয়সমূহ দ্বারা তার সত্তাকে অনুভব ও উপলব্ধি করা তো দূরের কথা বিবেক-বুদ্ধি, চিন্তাভাবনা ও কল্পনা পর্যন্ত তার রহস্য ও বাস্তবতাকে স্পর্শ করতে পারে না।
যারা আল্লাহ তা‘আলার الباطن নামের উপরোক্ত অর্থ বর্ণনা করেছেন, তারা তার الظاهر নামের অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন যে, যাহের অর্থ প্রকাশ্য। তারা উভয় নামের অর্থ এভাবে করেছেন যে, তিনিই প্রকাশ্য, তিনিই অপ্রকাশ্য। তিনি সব প্রকাশ্যের চেয়ে অধিক প্রকাশ্য। কারণ পৃথিবীতে যেসব জিনিস প্রকাশমান তা তারই গুণাবলী, তারই কার্যাবলী এবং তারই নূরের প্রকাশ।
কেউ কেউ বলেছেন, الباطن অর্থ হচ্ছে هو العالم بما بطن يقال بطنت الأمر اذا عرفت باطنهতিনি সকল গুপ্ত বস্তু সম্পর্কে অবগত। যেমন বলা হয়, بطنت الأمر আমি বিষয়টির গোপন অবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এ কথা আপনি ঠিক তখনই বলেন, যখন ঐ বিষয়ের গুপ্ত বিষয় সম্পর্কে জানতে পারেন। দেখুন, শাইখ সিন্দী (রঃ) এর টিকাসহ ইবনে মাজাহ, (৮/২১৭)
এখানে একটি কথা বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, হাদীছে যেহেতু বলা হয়েছে الظاهر অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা সবকিছুর উপরে, তার উপরে আর কিছু নেই, তাই যাহেরের মোকাবেলায় الباطن এর অর্থ এ রকম বলা যাবে না যে, তিনি সবকিছুর নীচে, তার নীচে আর কিছুই নেই, নাউযুবিল্লাহ। সুতরাং আল্লাহ আমাদের নীচে, এটি বলা অবৈধ। কেননা কোন কিছুর নীচে হওয়া ত্রুটিপূর্ণ সিফাত বা বিশেষণ। আল্লাহ তাআলার সত্তা উপরে হওয়ার বিশেষণে বিশেষিত, নীচে হওয়ার বিশেষণে নয়। উপরে হওয়া আল্লাহর সিফাতে যাতীয়া বা সত্তাগত গুণ।
মোটকথা আল্লাহ তা‘আলার উপরোক্ত চারটি নামের ব্যাখ্যায় উপরে বর্ণিত অর্থগুলোর সবগুলোই বা অধিকাংশই সঠিক। তবে ঐ নামগুলোর ব্যাখ্যায় নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন, তাই আমাদের বিশ্বাস করা ও মেনে নেওয়া আবশ্যক। যে অর্থ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তার বিপরীত ছাহাবী, তাবেঈ এবং সালাফে সালেহীন থেকে কিছুই পাওয়া যায়নি। সুতরাং তা গ্রহণ করাই অধিক নিরাপদ।
[3]. আয়াতুল কুরসীতেও আল্লাহ তা‘আলার বেশ কিছু অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী এক সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ لَا تَأْخُذُهُ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيْءٍ مِنْ عِلْمِهِ إِلَّا بِمَا شَاءَ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَلَا يَئُودُهُ حِفْظُهُمَا وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ
‘‘তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি চিরজীবন্ত ও সবকিছুর ধারক। তন্দ্রা ও নিদ্রা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সব তারই। এমন কে আছে যে তার অনুমতি ছাড়া তার নিকট সুপারিশ করতে পারে? তাদের সম্মুখের ও পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেন। তার জ্ঞান থেকে কোন কিছুই তারা পরিবেষ্টন করতে পারে না। কিন্তু তিনি যে জিনিসের জ্ঞান মানুষকে দিতে চান, সেটুকুর কথা ভিন্ন। তার কুরসী আসমান ও যমীন পরিব্যপ্ত হয়ে আছে। আর আসমান ও যমীনকে ধারণ করা তার জন্য মোটেই কঠিন নয়। আর তিনি সমুন্নত, মহান’’। (সূরা আল বাকারা ২:২৫৫)
সুতরাং ‘আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই’ এ হুকুম ও ফায়ছালার মধ্যে এর বিষয়বস্তু বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এখানে যদি শুধু জবানের উচ্চারণ উদ্দেশ্য হতো, তাহলে ইহার ইল্ম অর্জন করা আবশ্যক হতো না, ইহা দ্বারা কোনো উপকার হতো না এবং এর দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে দলীল পেশ করাও সম্ভব হতো না।
সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা যে সাক্ষ্য দিয়েছেন তাতে রয়েছে বান্দার জন্য তাওহীদের বর্ণনা, তাদের জন্য রয়েছে দিক নির্দেশনা এবং এর পরিচিতি। যেমন কোন বান্দার কাছে যখন কোন বিষয়ে সাক্ষ্য থাকবে, সে যদি তা বর্ণনা না করে; বরং তা গোপন করে, তাহলে তার দ্বারা কেউ উপকৃত হবে না এবং এর মাধ্যমে কোনো দলীল-প্রমাণও কায়েম হবে না। সুতরাং তাওহীদের সাক্ষ্য বর্ণনা করা ব্যতীত যেহেতু তার দ্বারা উপকৃত হওয়া সম্ভব নয়, তাই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তা অত্যন্ত পরিস্কারভাবে বর্ণনা করেছেন। মানুষের শ্রবণ, দৃষ্টি এবং বিবেক ও বোধশক্তির নিকট আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদের দলীলগুলো বর্ণনা করেছেন।
আসমানী কিতাব ও নাবী-রসূলদের মাধ্যমে তাওহীদের দলীলগুলোর ব্যাপারে কথা হলো আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে তার পূর্ণতার গুণাবলী, একত্ব এবং অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন এবং ঐগুলোর খোলাখুলি বর্ণনা প্রদান করেছেন। সে সম্পর্কিত সুস্পষ্ট আয়াতগুলোর তেলাওয়াত শুনেই তা দ্বারা উপকৃত হওয়া সম্ভব।
আল্লাহ তা‘আলা তার সম্মানিত কিতাবে নিজের যেসব গুণাবলী বর্ণনা করেছেন এবং তার শ্রেষ্ঠতম রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার প্রভুকে যেসব বিশেষণে বিশেষিত করেছেন, জাহমীয়া, মুতাযেলা এবং কতিপয় সিফাতকে বাতিলকারী আশায়েরা ও মাতুরীদি সম্প্রদায়ের লোকেরা এ ধারণায় ঐ সব সিফাতকে অস্বীকার করে যে, তা বিবেক-বুদ্ধি ও বোধশক্তিকে পরাজিত করে। আল্লাহ তা‘আলা তার কিতাবে এবং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার সুন্নাতে যেসব গুণাবলীর সুস্পষ্ট বর্ণনা প্রদান করেছেন, তা তাদের ধারণার সম্পুর্ণ পরিপন্থী। আল্লাহ তা‘আলা সূরা যুখরুফের শুরুতে বলেন,
حم وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ
‘হা-মীম এ সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ! সূরা ইউসুফের শুরুতে আরো বলেন,
الر تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْمُبِينِ
‘‘আলিফ-লাম-রা! এগুলো সুস্পষ্টরূপে বর্ণনাকারী কিতাবের আয়াত’’। তিনি সূরা হিজরের শুরুতে আরো বলেন,
الر تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ وَقُرْآنٍ مُّبِينٍ
‘‘আলিফ-লাম-রা! এগুলো আল্লাহর কিতাব ও সুস্পষ্টভাষী কুরআনের আয়াত’’। সূরা আল-ইমরানের ১৩৮ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
هَٰذَا بَيَانٌ لِّلنَّاسِ وَهُدًى وَمَوْعِظَةٌ لِّلْمُتَّقِينَ
‘‘এটি মানব জাতির জন্য একটি সুস্পষ্ট বর্ণনা এবং যারা আল্লাহকে ভয় করে তাদের জন্য হেদায়াত ও উপদেশ’’। সূরা মায়েদার ৯২ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَاحْذَرُوا ۚ فَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّمَا عَلَىٰ رَسُولِنَا الْبَلَاغُ الْمُبِينُ
‘‘আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করো এবং নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকো। কিন্তু যদি তোমরা আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও তাহলে জেনে রাখো, সত্য সুস্পষ্টভাবে পৌঁছিয়ে দেয়া ছাড়া আমার রাসূলের আর কোনো দায়িত্ব নেই’’।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা নাহালের ৪৪ নং আয়াতে আরো বলেন,
وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ
‘‘এ উপদেশ বাণী তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পারো যা তাদের জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’’।
এমনিভাবে সুন্নাত কুরআনের অর্থকে সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করে এবং তাকে সাব্যস্ত করে। মহান প্রভু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আমাদের দ্বীনের মূলনীতির ব্যাপারে কারো ব্যক্তিগত মত বা রুচি অথবা আবেগ-অনুভূতির অনুসরণ করার মুখাপেক্ষী করেননি। এ জন্যই আমরা দেখতে পাই, যারা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের বিরোধিতা করেছে, তারা নিজেরাই পরস্পর মতভেদে লিপ্ত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمْ الْإِسْلَامَ دِينًا
‘‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’’ (সূরা আল মায়েদা: ৩)। সুতরাং কুরআন-সুন্নাহ ব্যতীত অন্য কিছু দিয়ে দ্বীনকে পূর্ণ করার কোন প্রয়োজন নেই।
আবু জা’ফর ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহর শাইখের বক্তব্য:
لَا نَدْخُلُ فِي ذَلِكَ مُتَأَوِّلِينَ بِآرَائِنَا وَلَا مُتَوَهِّمِينَ بِأَهْوَائِنَا، فَإِنَّهُ مَا سَلِمَ فِي دِينِهِ إِلَّا مَنْ سَلَّمَ لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَلِرَسُولِهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَرَدَّ عِلْمَ مَا اشْتَبَهَ عَلَيْهِ إِلَى عَالِمِهِ
‘‘এ বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে আমরা আমাদের রায় দ্বারা কথা বলি না এবং প্রবৃত্তির দ্বারা প্ররোচিত হয়ে ধারণার উপর নির্ভর করেও কিছু বলি না। কারণ কোনো ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত তার দ্বীনকে ভ্রষ্টতা ও বক্রতা থেকে নিরাপদ রাখতে পারবে না, যতক্ষণ না সে গায়েবী বিষয়গুলো মহান আল্লাহ এবং তার রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে নিঃশর্তভাবে সমর্পন করবে এবং যে বিষয়গুলো তার কাছে অস্পষ্ট মনে হবে সেটি কেবল আল্লাহর দিকেই ফিরিয়ে দিবে’’এ অংশের ব্যাখ্যা করার সময় উপরোক্ত বিষয়গুলোর আরো বিস্তারিত আলোচনা হবে। ইনশা-আল্লাহ।
সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ সম্পর্কিত দৃশ্যমান যেসব আয়াত রয়েছে, তাতে চিন্তা-গবেষণা করলে এবং তা দ্বারা দলীল গ্রহণ করলে দেখা যায় তাতে কুরআনের আয়াত ও হাদীছের বাণীর মতোই তাওহীদের প্রমাণ রয়েছে। আর বোধশক্তির দলীলসমূহ উভয় প্রকার দলীলকে একত্র করেছে। নাবী-রসূলগণ তাওহীদের যেসব দলীল নিয়ে এসেছেন, বোধশক্তি তার সত্যতাকে সুদৃঢ় করে। সুতরাং কুরআন-সুন্নাহর সাক্ষ্য, দৃষ্টির সামনে দৃশ্যমান সৃষ্টির মধ্যকার নিদর্শনসমূহ, বোধশক্তির দলীলসমূহ এবং ফিতরাতী দলীলগুলো একসাথে মিলিত হয়েছে।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার পরিপূর্ণ আদল, রহমত, অনুগ্রহ এবং হিকমতের কারণে বান্দার অজুহাত কবুল করাকে ভালোবেসেছেন, পছন্দ করেছেন এবং সৃষ্টির নিকট তাওহীদের যুক্তি-প্রমাণ ও অকাট্য দলীল পেশ করার প্রতি খুবই গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এ জন্যই তিনি যতো নাবী-রসূল পাঠিয়েছেন, তাদের সকলকেই এমন নিদর্শন দিয়েছেন, যা তাদের সত্যতার প্রমাণ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ
‘‘আমি আমার রসূলদের সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ এবং হেদায়াত দিয়ে পাঠিয়েছি। তাদের সাথে কিতাব ও মীযান নাযিল করেছি যাতে মানুষ ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে’’ (সূরা হাদীদ: ২৫)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ إِلَّا رِجَالًا نُّوحِي إِلَيْهِمْ فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِوَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ
‘‘হে মুহাম্মাদ! তোমার আগে আমি যখনই রসূল পাঠিয়েছি, মানুষই পাঠিয়েছি, যাদের কাছে আমি নিজের অহী প্রেরণ করতাম। যদি তোমরা নিজেরা না জেনে থাকো তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করো। আগের রসূলদেরকেও আমি উজ্জ্বল নিদর্শন ও কিতাব দিয়ে পাঠিয়েছিলাম এবং এ বাণী তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিতে পারো যা তাদের জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা-গবেষণা করে’’ (সূরা আন নাহল ৪৩-৪৪)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
قُلْ قَدْ جَاءَكُمْ رُسُلٌ مِّن قَبْلِي بِالْبَيِّنَاتِ وَبِالَّذِي قُلْتُمْ فَلِمَ قَتَلْتُمُوهُمْ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ
‘‘হে নাবী! তাদেরকে বলো, আমার আগে তোমাদের কাছে অনেক রসূল এসেছেন, তারা অনেক উজ্জ্বল নিদর্শন এনেছিলেন এবং তোমরা যে নিদর্শনটির কথা বলছো সেটিও তারা এনেছিলেন’’ (সূরা আলে ইমরান: ১৩৮)।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা আলে ইমরানের ১৮৪ নং আয়াতে আরো বলেন,
فَإِن كَذَّبُوكَ فَقَدْ كُذِّبَ رُسُلٌ مِّن قَبْلِكَ جَاءُوا بِالْبَيِّنَاتِ وَالزُّبُرِ وَالْكِتَابِ الْمُنِيرِ
‘‘হে মুহাম্মাদ! এরা যদি তোমার প্রতি মিথ্যা আরোপ করে, তাহলে তোমার পূর্বে বহু রাসূলের প্রতি মিথ্যা আরোপ করা হয়েছে। তারা স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ, সহীফা ও আলোদানকারী কিতাব এনেছিল’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা শুরার ১৭ নং আয়াতে বলেন,
اللَّهُ الَّذِي أَنزَلَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ وَالْمِيزَانَ
‘‘আল্লাহই এ কিতাব ও মীযান যথাযথভাবে নাযিল করেছেন’’।
রসূলদেরকে যেসব নিদর্শন দেয়া হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে কম প্রকাশ্য আয়াত ছিল হুদ আলাইহিস সালামের নিদর্শনসমূহ। এমনকি তার জাতির লোকেরা বলেছিল, হে হুদ! তুমি তো আমাদের কাছে কোনো নিদর্শনই নিয়ে আসোনি। অথচ তিনি যে নিদর্শনগুলো নিয়ে এসেছিলেন, তা ছিল অত্যন্ত সুষ্পষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা যাকে এগুলো নিয়ে গবেষণা করার তাওফীক দিয়েছেন, সে কেবল বুঝতে সক্ষম হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে হুদ আলাইহিস সালামের নিদর্শনগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন,
إِنِّي أُشْهِدُ اللَّهَ وَاشْهَدُوا أَنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ مِنْ دُونِهِ فَكِيدُونِي جَمِيعًا ثُمَّ لَا تُنْظِرُونِ إِنِّي تَوَكَّلْتُ عَلَى اللَّهِ رَبِّي وَرَبِّكُمْ مَا مِنْ دَابَّةٍ إِلَّا هُوَ آَخِذٌ بِنَاصِيَتِهَا إِنَّ رَبِّي عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
‘‘হুদ বললেন, আমি আল্লাহকে সাক্ষী রাখছি। আর তোমরা সাক্ষী থাকো। আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদেরকে তোমরা আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করছো, আমি ঐসব কিছু থেকে মুক্ত। তোমরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাও। অতঃপর তোমরা আমাকে একটুও অবকাশ দিয়ো না। আমি আল্লাহর উপর ভরসা করছি, যিনি আমার রব এবং তোমাদেরও রব। ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী যত প্রাণী রয়েছে, সবারই কপাল তার মুষ্ঠিতে আবদ্ধ। নিশ্চয় আমার প্রতিপালক সরল পথে রয়েছেন’’ (সূরা হুদ: ৫৪-৫৬)।
হুদ আলাইহিস সালামের কথার মধ্যে তাওহীদের অন্যতম বিরাট নিদর্শন রয়েছে। তিনি মাত্র একজন ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও দৃঢ়চিত্তে, নির্ভয়ে এবং বলিষ্ঠ কণ্ঠে বিরাট একটি জাতির সামনে এ ভাষণ তুলে ধরেছেন। তিনি যা বলেছেন, তাতে তিনি ছিলেন পর্বত প্রবল আত্মবিশ্বাসী ও প্রত্যয়ী। তার জাতির লোকেরা যে বাতিলের উপর ছিল, তা থেকে তিনি প্রথমে নিজেকে মুক্ত বলে ঘোষণা করেছেন এবং এর উপর আল্লাহ তা‘আলাকে সাক্ষী রেখেছেন। এমন সাক্ষ্য দিয়েছেন, যাতে তিনি তার উপর সম্পূর্ণ আস্থাবান। তিনি তার জাতিকে সুস্পষ্টভাবে এ কথা জানিয়ে দিলেন যে, আল্লাহ তা‘আলাই তার একমাত্র অভিভাবক ও সাহায্যকারী।
সুতরাং তিনি শত্রুদেরকে তার উপর শক্তিশালী করবেন না। অতঃপর হুদ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বিরোধিতা করে প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন যে, তিনি তাদের দ্বীন ও তাদের ঐসব মাবুদ হতে সম্পূর্ণ মুক্ত যাদের কারণে তারা কাউকে বন্ধু বানায় ও কাউকে শত্রু বানায় এবং জান-মাল ব্যয় করে ও তাদেরকে সাহায্য করে। অতঃপর তিনি প্রকাশ্যভাবে মূর্তিগুলোকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, তারা সকলে মিলে যদি হুদ আলাইহিস সালামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে এবং তাকে হত্যা করে মনের জ্বালা-যন্ত্রণা নিবারণ করতে চায় এবং তারা যদি তাদের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চায় ও কোনো প্রকার অবকাশ না দেয়, তবে তারা কেবল ঐ পরিমাণ ক্ষতিই করতে পারবে, যা আল্লাহ তা‘আলা তার উপর লিখে দিয়েছেন। অতঃপর তিনি তার দাওয়াতকে তাদের কাছে অত্যন্ত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। অতঃপর তিনি বলেছেন, সেই সত্তাই হলেন তার ও তাদের সকলের রব, যার হাতের মুঠোয় রয়েছে সকলের ললাটের কেশ গুচ্ছ। তিনিই তার অভিভাবক এবং নিয়ন্ত্রক। তিনিই তাকে সাহায্য ও শক্তিশালী করবেন। তিনি সঠিক পথে রয়েছেন। সুতরাং যে তার উপর ভরসা করবে, তার ক্ষমতার স্বীকৃতি দিবে, তিনি তাকে অসহায় অবস্থায় ছেড়ে দিবেন না এবং তার বিরুদ্ধে তার শত্রুদেরকে খুশী করবেন না।
নাবী-রসূলগণ আল্লাহর পক্ষ হতে যেসব দলীল-প্রমাণ ও নিদর্শন নিয়ে এসেছেন, তার চেয়ে অধিক উত্তম এবং উজ্জল নিদর্শন আর কী হতে পারে? আর তা হলো আল্লাহ তা‘আলা নাবী-রসূলদের দ্বীনের পক্ষে নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং তার বান্দাদের জন্য তাকে অত্যন্ত পরিস্কারভাবে বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম অতি সুন্দর নাম হলো, তিনি হলেন, المؤمن (নিরাপত্তা দানকারী)। এ নামের দু’টি ব্যাখ্যার মধ্যে একটি ব্যাখ্যা হলো, সত্যায়নকারী, যিনি সত্যবাদীদের সত্যের দলীল-প্রমাণগুলো প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি তার বান্দাদেরকে দিক-দিগমেত্মর এবং তাদের নিজেদের মধ্যকার ঐসব নিদর্শন দেখাবেন, যা তাদের সামনে খোলাখুলি বর্ণনা করে দিবে যে, রসূলগণ যে অহীর বাণী পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, তা সত্য। আল্লাহ তা‘আলা সূরা হামীম সেজদার ৫৩ নং আয়াতে বলেন,
سَنُرِيهِمْ آيَاتِنَا فِي الْآفَاقِ وَفِي أَنفُسِهِمْ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمْ أَنَّهُ الْحَقُّ
‘‘অচিরেই আমি এদেরকে সর্বত্র আমার নিদর্শনসমূহ দেখাবো এবং তাদের নিজেদের মধ্যে যেসব নিদর্শন রয়েছে তাও দেখাবো। যাতে এদের কাছে এ কথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এটাই সত্য’’।
অর্থাৎ কুরআন সত্য। কেননা কুরআন সম্পর্কে আলোচনা পূর্বের আয়াতে অতিক্রান্ত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা সেখানে বলেছেন, হে নাবী, এদের বলো, তোমরা কি কখনো এ কথা ভেবে দেখেছো যে, সত্যিই এ কুরআন যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে থাকে আর তোমরা তা অস্বীকার করতে থাকো তাহলে সেই ব্যক্তির চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হবে, যে এর বিরোধিতায় বহুদূর অগ্রসর হয়েছে’’। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, এটাই কি যথেষ্ট নয় যে, তোমার রব প্রতিটি জিনিস দেখছেন?’’
সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তার রসূল যা নিয়ে এসেছেন, তা সত্য, তিনি ওয়াদা করেছেন যে, বান্দাদেরকে তার সৃষ্টিগত ও কর্মগত নিদর্শনসমূহ থেকে এমন কিছু নিদর্শনও দেখাবেন, যাতে প্রমাণিত হবে যে, কুরআন সত্য। এরপর আল্লাহ তা‘আলা সবচেয়ে বড় ও সুস্পষ্ট আরেকটি বিষয় উল্লেখ করেছেন। তা হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার এ সাক্ষ্য যে, তিনি সবকিছু দেখেন।
সুতরাং আল্লাহর অতি সুন্দর নামসমূহের অন্যতম হলো, الشهيد অর্থাৎ সর্বদ্রষ্টা, যার দৃষ্টির অন্তরালে কোনো কিছুই আড়াল হয় না এবং যার জ্ঞানের বাইরে কোনো কিছুই নেই। বরং তিনি সবকিছু সম্পর্কে অবগত, সর্বদ্রষ্টা এবং প্রত্যেক জিনিসের খুটিনাটি সবকিছুই জানেন। এ হলো তার অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী দ্বারা দলীল গ্রহণের কিছু প্রমাণ। প্রথমে আল্লাহ তা‘আলার কথা ও বাণী দ্বারা দলীল গ্রহণ করা হয়েছে, অতঃপর দিগ-দিগমেত্মর সর্বত্র বিরাজমান নিদর্শন ও মানুষের নিজেদের মধ্যকার নিদর্শন দ্বারা দলীল গ্রহণ করা হয়েছে, অতঃপর আল্লাহ তা‘আলার কর্মসমূহ এবং সৃষ্টির মাধ্যমে দলীল গ্রহণ করা হয়েছে।
আপনি যদি প্রশ্ন করেন, আল্লাহ তা‘আলার নাম ও গুণাবলী দ্বারা কিভাবে দলীল গ্রহণ করা যেতে পারে? অথচ মানুষের পরিভাষায় নাম দ্বারা দলীল গ্রহণ করার বিষয়টি পরিচিত নয়।
এর জবাব হলো, যে ব্যক্তির ফিতরাত বা সৃষ্টিগত স্বভাব স্রষ্টার প্রতি কুফরী করা, তার গুণাবলী অস্বীকার করা কিংবা তার গুণাবলীকে মানুষের গুণাবলীর সাথে তুলনা করার দোষে দূষিত হয়নি, আল্লাহ তা‘আলা সেই ফিতরাতের মধ্যে এ বিশ্বাস স্থাপন করে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা‘আলার সুন্দরতম নাম ও সুমহান গুণাবলী সব দিক থেকেই পরিপূর্ণ। তিনি ঐ সব বিশেষণে বিশেষিত, যা দ্বারা তিনি নিজেকে বিশেষিত করেছেন এবং যা দ্বারা তার রসূলগণ তাকে গুণান্বিত করেছেন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার পূর্ণতার যে গুণাবলী সৃষ্টির নিকট অস্পষ্ট রয়ে গেছে, তা তাদের নিকট পরিচিত গুণাবলীর চেয়ে আরো বহুগুণ বড়। তার পবিত্রত ও পূর্ণতার অন্তর্ভুক্ত হলো, তার এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে, তিনি সবকিছু দেখেন এবং সবকিছু সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। এমন অবগত যে, আসমান-যমীনের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য একটি অণুপরিমাণ জিনিসও তার অবগতি ও দৃষ্টির বাইরে নয়। যে সত্তার অবস্থা এ রকম, তাহলে বান্দাদের জন্য আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করা কিভাবে শোভনীয় হতে পারে? কিভাবেই বা তার ইবাদতের সাথে অন্যকে শরীক করা যেতে পারে এবং তার সাথে অন্যান্য মাবুদ নির্ধারণ করা যেতে পারে?
আল্লাহ তা‘আলার পূর্ণতার বিষয়ে কিভাবে এটি শোভনীয় হতে পারে যে, যারা তার উপর মহা মিথ্যা রচনা করবে, তাদেরকে সমর্থন করবেন এবং তাদের সম্পর্কে এমন খবর দিবেন, যা বাস্তবতার সম্পূর্ণ বিপরীত। এমন নয় যে, বাতিলের উপর থাকা সত্ত্বেও তিনি বাতিলপন্থীকে সাহায্য করবেন, তার কাজকে সমুন্নত করবেন, তার আহবান শুনবেন, তার শত্রুকে ধ্বংস করবেন এবং বাতিলপন্থীর দ্বীনকে এমন দলীল-প্রমাণ ও নিদর্শন দিয়ে সাহায্য করবেন, যা আনয়ন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অথচ সে আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপকারী এবং তার নামে বানোয়াট কথা রচনাকারী।
আর এটি সকলের জানা যে, প্রত্যেক জিনিসের উপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার দৃষ্টি, তার ক্ষমতা, তার হিকমত, মর্যাদা এবং সকল দোষ-ত্রুটি থেকে তার পরিপূর্ণ পবিত্রতা উপরোক্ত ধারণাকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে। যারা এটিকে জায়েয মনে করবে, তারা আল্লাহর মারেফত থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে।
আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামগুলোর মাধ্যমে তার জন্য কার্যাদি সাব্যস্ত করার দলীলে কুরআন মজীদ পরিপূর্ণ। আল্লাহ তা‘আলার খাঁটি বান্দাগণ এ পদ্ধতিতেই আল্লাহ তা‘আলার কার্যাদি সাব্যস্ত করেন। তারা আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহ দ্বারা তার কর্মের পক্ষে দলীল গ্রহণ করে থাকেন। এর মাধ্যমে তারা আরো দলীল গ্রহণ করেন যে, আল্লাহর জন্য কী করা শোভনীয় এবং কী করা শোভনীয় নয়? আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ (44) لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ (45) ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ (46) فَمَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ عَنْهُ حَاجِزِينَ
‘‘যদি এ নাবী নিজে কোনো কথা বানিয়ে আমার কথা বলে চালিয়ে দিতো তাহলে আমি তার ডান হাত ধরে ফেলতাম এবং ঘাড়ের রগ কেটে দিতাম। তোমাদের কেউ আমাকে এ কাজ থেকে বিরত রাখতে পারতো না’’। (সূরা আল-হাক্কাহ: ৪৪-৪৭)
সামনে এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইনশা-আল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামসমূহ এবং সুউচ্চ গুণাবলী দ্বারাও আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ সাব্যস্ত ও শির্ক বাতিল হওয়ার উপর দলীল পেশ করা হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘তিনিই আল্লাহ, যিনি ব্যতীত অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই। তিনি مَلِك (মালিক), قُدُّوس (অতি পবিত্র) سَلَام (শান্তিদাতা), مؤْمِن (নিরাপত্তা দানকারী), مُهَيْمن (রক্ষাকারী), عَزِيز (পরাক্রমশালী), جَبَّار (প্রতাপশালী) এবং مُتَكَبِّر (মহিমান্বিত)। তারা যাকে আল্লাহর শরীক সাব্যস্ত করে আল্লাহ তা‘আলা তা থেকে পবিত্র’’ (সূরা আল হাশর: ২৩)।
কুরআনে অনুরূপ আয়াত অনেক রয়েছে। তবে অল্প সংখ্যক লোকই এ পথ অনুসরণ করে। খাঁটি লোকেরাই এ পথের সন্ধান পেয়ে থাকে। সাধারণ লোকেরা কেবল বাহ্যিক নিদর্শন দ্বারাই তাওহীদের দলীল গ্রহণ করে থাকে। কেননা এ পদ্ধতি অধিক সহজ এবং অধিক প্রশস্ত। আর আল্লাহ তা‘আলা তার কতক সৃষ্টিকে অন্য কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে থাকেন।
কুরআন মজীদে তাওহীদের এমনসব দলীল-প্রমাণ ও নিদর্শনের সমাবেশ ঘটেছে, যা অন্য কোনো কিতাবে ঘটেনি। কুরআন একদিকে যেমন স্বতন্ত্র একটি দলীল অন্যদিকে দলীল-প্রমাণ দ্বারা উহার সত্যতা সুসাব্যস্ত ও সুপ্রমাণিত। সে সঙ্গে তা সাক্ষী স্বরূপ এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা তার বিশুদ্ধতা ও সত্যতা সুসাব্যস্ত। যে ব্যক্তি রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্যতার নিদর্শন অনুসন্ধান করতে চায়, তার উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أَوَلَمْ يَكْفِهِمْ أَنَّا أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ يُتْلَىٰ عَلَيْهِمْ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَرَحْمَةً وَذِكْرَىٰ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
‘‘আর এদের জন্য কি এ নিদর্শন যথেষ্ঠ নয় যে, আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদেরকে পড়ে শুনানো হয়? আসলে যারা ঈমান আনে তাদের জন্য এর মধ্যে রয়েছে রহমত ও নসীহত’’ (সূরা আল আনকাবুত: ৫১)।
সুতরাং যখন জানা গেল যে, তাওহীদে উলুহীয়াহ হলো ঐ তাওহীদ, যা দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তার নাবী-রসূলগণকে পাঠিয়েছেন এবং যাসহ আসমানী কিতবসমূহ নাযিল করা হয়েছে, যেমন ইতিপূর্বে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
তাই যারা তাওহীদকে নিমেণাক্ত তিনভাগে বিভক্ত করেছে, তাদের কথার প্রতি কর্ণপাত করা হবে না। যারা তাওহীদকে অভিনব পদ্ধতিতে তিনভাগে বিভক্ত করেছে, তারা নাবী-রসূলদের নিয়ে আসা এ তাওহীদুল উলুহীয়াকে নাম দিয়েছেتوحيد العامة তথা সাধারণ মানুষের তাওহীদ হিসেবে।
তাদের নিকট দ্বিতীয় প্রকার তাওহীদ হলো توحيد الخاصة তথা বিশেষ ব্যক্তিদের তাওহীদ।
হাকীকতের মাধ্যমে এ প্রকার তাওহীদ সাব্যস্ত হবে। অর্থাৎ সুফীদের ধারণায় তাদের কেউ হাকীকতের স্তরে পৌঁছতে পারলে আন্তরিকভাবে আল্লাহর প্রেমের স্বাদ লাভ করতে পারে ও পরমাত্মার সাথে তার যোগাযোগ হয়। এটা হচ্ছে সুফী সাধনার চুড়ান্ত স্তর। এ স্তরে উন্নীত হলে সুফী ধ্যানের মাধ্যমে নিজস্ব অস্তিত্ব আল্লাহর নিকট বিলীন করে দেয় এবং তাদের জন্য যেই প্রকার তাওহীদ অর্জিত হয়, তাকেই সম্ভবত তারা তাওহীদুল খাসসাহ হিসাবে নাম দিয়েছে।
আর তৃতীয় প্রকারকে তারা এমন তাওহীদ হিসাবে নাম দিয়েছে, যা চিরন্তন ও অবিনশ্বর সত্তার সাথে প্রতিষ্ঠিত। এটি হলো توحيد خاصة الخاصة অর্থাৎ বিশেষ ব্যক্তিদের মধ্যে যারা বিশেষ স্থানের অধিকারী তাদের তাওহীদ।[1]
মানুষের মধ্যে নাবী-রসূলগণই তাওহীদের ক্ষেত্রে সর্বাধিক পরিপূর্ণ ছিলেন। আর রসূলগণ তাতে নাবীদের চেয়েও অধিক পূর্ণতায় পৌঁছেছিলেন। রসূলদের মধ্যে উলুল আযমগণ ছিলেন তাওহীদের ক্ষেত্রে সর্বাধিক পরিপূর্ণ। তারা হলেন, নুহ, ইবরাহীম, মুসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাদের মধ্যে আবার আল্লাহর দুই বন্ধু ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তাওহীদ ছিল উলুল আযম অন্যান্য নাবীদের চেয়ে আরো বেশী পরিপূর্ণ। তারা ইলম, মারেফত, আমল, অবস্থা, দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে যেভাবে তাওহীদ বাস্তবায়ন করেছেন, অন্যরা সেভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
সুতরাং রসূলগণ যেভাবে তাওহীদকে পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করেছেন, তাদের চেয়ে অধিক পূর্ণরূপে অন্য কেউ বাস্তবায়ন করতে পারেনি, তারা যেভাবে তাওহীদের প্রতি আহবান করেছেন, অন্যরা সেভাবে করতে পারেনি এবং তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যেভাবে নিজ নিজ কাওমের লোকদের সাথে সংগ্রাম করেছেন, অন্যরা সেভাবে সংগ্রাম করতে পারেননি। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা তার নাবীকে তাওহীদের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী নাবীদের অনুসরণ করার আদেশ দিয়েছেন। যেমন শির্কের অসারতা বর্ণনা এবং তাওহীদের বিশুদ্ধতা সাব্যস্ত করতে গিয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার গোত্রীয় লোকদের সাথে যেই তর্ক-বিতর্ক করেছেন, তা উল্লেখ করার পর এবং তার বংশধরদের হতে যারা নাবী হয়েছিলেন, তাদের কথা উল্লেখ করার পর আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
أُولَٰئِكَ الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ قُل لَّا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرًا إِنْ هُوَ إِلَّا ذِكْرَىٰ لِلْعَالَمِينَ
‘‘তারাই আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত প্রাপ্ত ছিল, অতএব তাদের পথেই তুমি চলো এবং বলো, এ কাজে আমি তোমাদের কাছ থেকে কোনো বিনিময় চাই না। এটি সমগ্র সৃষ্টির জন্য একটি উপদেশমালা’’ (সূরা আনআম: ৯০)।
সুতরাং রসূলকে যাদের অনুসরণ করতে বলা হয়েছে, তাদের তাওহীদের চেয়ে অধিক পূর্ণ তাওহীদ কারো নিকট থাকতে পারে না।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার ছাহাবীদেরকে শিক্ষা দিতেন, তারা যেন সকালে ঘুম থেকে উঠে এ দু‘আটি পাঠ করে,
أصْبَحْناَ على فِطْرَةِ الإسْلَامِ وَ عَلَى كَلِمَةِ الإِخْلَاصِ وعلى دِيْنِ نَبِيِّناَ مُحَمَّدٍ وَعَلَى مِلَّةِ أبِيْناَ إبْرَاهِيمَ حَنِيْفاَ مُسْلِماً وماَ كاَنَ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ
‘‘আমাদের সকাল হলো ইসলামের ফিতরাতের উপর, একনিষ্ঠতার বাণীর উপর, আমাদের নাবী মুহাম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দ্বীনের উপর এবং আমাদের পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মিল্লাতের উপর। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না’’।
ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দ্বীন ছিল তাওহীদ। মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দ্বীন বলতে তিনি আল্লাহর পক্ষ হতে যে আদেশ-নিষেধ, আমল ও আক্বীদাহ-বিশ্বাস নিয়ে এসেছেন, তা উদ্দেশ্য।
কালিমাতুল ইখলাস বলতে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ উদ্দেশ্য।
ইসলামের ফিতরাত বলতে আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদেরকে সৃষ্টি করার সময় তাদের মধ্যে তার প্রতি যে ভালোবাসা, এককভাবে তার ইবাদতের প্রতি যে আগ্রহ, তার সাথে কাউকে শরীক না করার যে স্বভাব এবং তার দাসত্ব ও বশ্যতা স্বীকার করা, অনুগত হওয়া ও তার দিকে ফিরে যাওয়ার যে স্বভাব-প্রকৃতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তা উদ্দেশ্য।
এটিই হলো আল্লাহর খাঁটি বান্দাদের তাওহীদ। যে ব্যক্তি এ প্রকার তাওহীদ থেকে বিমুখ হবে, সে সর্বাধিক অজ্ঞ হিসাবে গণ্য হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَن يَرْغَبُ عَن مِّلَّةِ إِبْرَاهِيمَ إِلَّا مَن سَفِهَ نَفْسَهُ وَلَقَدِ اصْطَفَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِين إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ
‘‘যে ব্যক্তি নিজেকে মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতায় আচ্ছন্ন করেছে সে ছাড়া আর কে ইবরাহীমের দ্বীন থেকে বিমুখ হতে পারে? আমি তো দুনিয়াতে তাকে নির্বাচিত করেছি, আখেরাতে সে সৎকর্মশীলদের মধ্যে গণ্য হবে। তার অবস্থা এ যে, যখন তার রব তাকে বললো, মুসলিম হয়ে যাও তখনই সে বলে উঠলো, আমি সমগ্র সৃষ্টির প্রভুর জন্য মুসলিম হয়ে গেলাম’’ (সূরা আল বাকারা: ১৩১-১৩২)।
যার নিকট সুস্থ অনুভূতি এবং ভালো-মন্দের মধ্যে পার্থক্যকারী বোধশক্তি রয়েছে, সে তাওহীদ সাব্যস্ত করতে গিয়ে কালামশাস্ত্রবিদদের যুক্তি-তর্ক, তাদের পরিভাষা এবং তাদের পদ্ধতির প্রতি কখনোই মুখাপেক্ষী হবে না। বরং কখনো কখনো কালামশাস্ত্রবিদদের যুক্তি-তর্কের প্রতি ঝুকে পড়ার কারণে এমন সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়তে পারে, যাতে সে হয়রান, গোমরাহ এবং সন্দিহান হয়ে পড়তে পারে।[2]
উপকারী তাওহীদ হলো তাই, যার ধারক ও বাহকের অন্তর সকল প্রকার সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব হতে মুক্ত ও পরিশুদ্ধ থাকে। এ পরিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে আগমন করবে, সে হবে সফল। কোনো সন্দেহ নেই যে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকার যে তাওহীদের দাবী তারা করেছে এবং যাকে তারা তাওহীদুল খাস্সা এবং তাওহীদু খাস্সাতিল খাস্সা বলে নাম দিয়েছে, তা ‘ফানা ফিল্লাতে[3] গিয়ে শেষ হয়।
অধিকাংশ সুফীই ‘ফানা ফিল্লাহ’ এর স্তরে পৌঁছার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। এটি একটি বিপদজনক পথ। ইহা মানুষকে ওয়াহদাতুল উজুদের (সর্বেশ্বরবাদ) দিকে নিয়ে যায়।
শাইখুল ইসলাম আবু ইসমাঈল আনসারী আল-হেরাবী রহিমাহুল্লাহ ‘‘মানাযিলুস্ সায়িরীন’’ গ্রন্থে যা আবৃত্তি করেছেন, তার প্রতি একটু নযর দিন। তিনি বলেছেন,
مَا وَحَّدَ الْوَاحِدَ مِنْ وَاحِدٍ ....إِذْ كُلُّ مَنْ وَحَّدَهُ جَاحِدُ
تَوْحِيدُ مَنْ يَنْطِقُ عَنْ نَعْتِهِ........ عَارِيَّةٌ أَبْطَلَهَا الْوَاحِدُ
تَوْحِيدُهُ إِيَّاهُ تَوْحِيدُهُ... وَنَعْتُ مَنْ يَنْعَتُهُ لَاحِدُ
১) কোনো মাখলুকই আল্লাহর প্রকৃত তাওহীদ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। যে কেউ আল্লাহকে এক বলে ঘোষণা করবে, সে মূলতঃ অবিশ্বাসী নাস্তিক বলেই বিবেচিত হবে। (নাউযুবিল্লাহ)
২) যারা আল্লাহর তাওহীদ এবং তার সিফাত বর্ণনা করে, তাদের তাওহীদ প্রত্যাখ্যাত হবে। স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলাই তাকে বাতিল করে দিয়েছেন। সুতরাং তাদের তাওহীদের কোনো বাস্তবতা নেই। (নাউযুবিল্লাহ)
৩) আল্লাহ নিজেই নিজের যে তাওহীদ বর্ণনা করেছেন, তাই হলো তার প্রকৃত তাওহীদ। তিনি ছাড়া অন্যরা তার তাওহীদের যে বর্ণনা দেয়, তা ইলহাদ তথা তাওহীদ থেকে বিচ্যুতি ছাড়া অন্য কিছু নয়। (নাউযুবিল্লাহ)
ইমাম হেরাবী রহিমাহুল্লাহ যদিও ফানা বা ওয়াহদাতুল উজুদের সমর্থক ছিলেন না, কিন্তু এ কবিতার মধ্যে তিনি এমন সংক্ষিপ্ত কথা বলেছেন, যার কারণেই ওয়াদাতুল উজুদে বিশ্বাসী লোকেরা তাকে নিজেদের দিকে টেনে নিয়েছে। কেউ কেউ দৃঢ় শপথ করেই বলেছে যে, তিনি তাদের সাথেই রয়েছেন। তবে কথা হলো তিনি যেহেতু তাদের মতে সমর্থক ছিলেন না, তাই তিনি যদি শরীয়াত সম্মত শব্দমালা দিয়ে তার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতেন, তাহলেই তার কথা অধিকতর সঠিক ও গ্রহণযোগ্য হতো। তা সত্ত্বেও বলা যেতে পারে যে, তিনি যে অর্থ নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছেন, তা বাস্তবায়ন করা যদি আমাদের আবশ্যক হতো এবং শরীয়াতে মুহাম্মাদীর উদ্দেশ্য যদি তাই হতো, তাহলে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে সেদিকে সতর্ক করতেন, মানুষকে সেদিকে আহবান করতেন এবং তা স্পষ্ট করে বর্ণনা করতেন। কেননা সুস্পষ্ট করে বর্ণনা করাই রাসূলের উপর আবশ্যক ছিল।
রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোথায় এ কথা বলেছেন যে, এটি হলো সাধারণ লোকের তাওহীদ, এটি হলো খাস লোকদের তাওহীদ আর অমুকটি খাস লোকদের মধ্যে অধিকতর খাস লোকদের তাওহীদ অথবা তিনি এ অর্থের কাছাকাছি কোন বাক্য উচ্চারণ করেছেন? অথবা তিনি কি এ কথাগুলোর প্রতি কোন ইঙ্গিত করেছেন?
সঠিক কথা হলো আমাদের কাছে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের যেসব দলীল রয়েছে এবং আমাদের যে বোধশক্তি ও বিবেক রয়েছে, তা এ কথাকে বাতিল বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেদেয়।
আল্লাহ তা‘আলা যে কালাম নাযিল করেছেন, তা আমাদের সামনে রয়েছে, আমাদের সামনে রাসূলের সুন্নাত সংরক্ষিত রয়েছে, রাসূলের পরে সর্বোত্তম মানুষদের কথা ও আচার-আচরণ লিখিত রয়েছে এবং আল্লাহ তা‘আলার পরিচয় হাসিলকারী ইমামদের বক্তব্যসমূহ সংরক্ষিত হয়েছে। যারা তাওহীদকে উপরোক্ত তিনভাবে বিভক্ত করেছে, তাদের কাছে প্রশ্ন হলো এভাবে তাওহীদকে ভাগ করা কিংবা ‘ফানা’ শব্দটি কুরআন-সুন্নাহ্র কোথাও কি উল্লেখ করা হয়েছে? উপরোক্ত কথাগুলো ছাহাবী কিংবা তাবেঈ অথবা অনুসরণীয় ইমামদের কারো পক্ষ হতে এসেছে কি?
বরং দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন করার কারণেই এসব পরিভাষার উৎপত্তি হয়েছে। যা খারেজীদের বাড়াবাড়ির মতই। শুধু তাই নয়; খ্রিস্টানরা তাদের দ্বীনের ব্যাপারে যেমন বাড়াবাড়ি করেছিল, এ সুফীদের বাড়াবাড়ি সে পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। আল্লাহ তা‘আলা দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করার নিন্দা করেছেন এবং তা থেকে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
(يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلَا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلَّا الْحَقَّ)
হে কিতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহ সম্পর্কে সত্য ছাড়া বলো না (সূরা আন নিসা :১৭১)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعُوا أَهْوَاءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِنْ قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرًا وَضَلُّوا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ﴾
‘‘হে নাবী! তুমি বলো হে আহলে কিতাবগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করো না এবং এতে ঐ সম্প্রদায়ের প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না, যারা ইতিপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে। তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে’’ (সূরা আল মায়েদা: ৭৭)। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন,
«لَا تُشَدِّدُوا فَيُشَدِّدَ اللَّهُ عَلَيْكُمْ، فَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ شَدَّدُوا فَشَدَّدَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ فَتِلْكَ بَقَايَاهُمْ فِي الصَّوَامِعِ وَالدِّيَارَاتِ رَهْبَانِيَّةٌ ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ»
‘‘তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে নিজেদের উপর কঠোরতা আরোপ করো না। তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের উপর কঠিন করে দিবেন। তোমাদের পূর্বে যারা ছিল, তারা নিজেদের উপর কঠোরতা আরোপ করেছিল। ফলে আল্লাহ তা‘আলাও তাদের উপর কঠিন কঠিন বিধান চাপিয়ে দিয়েছেন। ঐ তো তাদের পরবর্তীরা এখনো গীর্জা এবং উপাসনালয়গুলোতে রয়ে গেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, বৈরাগ্যবাদ তো তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করে নিয়েছে। আমি ওটা তাদের উপর চাপিয়ে দেইনি’’।[4] ইমাম আবু দাউদ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।
সুফীরা তাওহীদকে যে তিন প্রকারে বিভক্ত করেছে, তাদের ধারণায় তার দ্বিতীয় প্রকারের স্বরূপ হলো, সকল বস্তুর হাকীকত তথা আসল অবস্থায় পৌঁছার মাধ্যমে উহা অর্জিত হয়। তাদের ধারণায় আসমানী কিতাবসমূহে আল্লাহ তা‘আলা যেসব দলীল-প্রমাণ নাযিল করেছেন, আসমান-যমীনের দিক-দিগমেত্ম যেসব নিদর্শন রয়েছে এবং মানুষের নিজের মধ্যে যেসব নিদর্শন রয়েছে, তার মাধ্যমে এ প্রকার তাওহীদের স্তরে পৌঁছা সম্ভব নয়। বস্তুসমূহের হাকীকত উপলব্ধি করার মাধ্যমেই কেবল তা অর্জিত হয়। তবে প্রশ্ন হলো কে এ স্তরে পৌঁছতে পারে? তাদের ধারণায় শুধু একজন শাইখ দ্বারাই এ প্রকার তাওহীদের পরিচয় হাসিল অর্জন করা সম্ভব। তার পরে সে যাকে তা দান করবে, সে কেবল তা অর্জন করতে পারবে। এটি তাদের বাতিল ধারণা। কেননা আল্লাহ তা‘আলা সকল মানুষের উপর একই তাওহীদের তথা তাওহীদে উলুহীয়াতের জ্ঞান অর্জন করা এবং তা বাস্তবায়ন করা ফরয করেছেন। তাতে মানুষের মাঝে কোন পার্থক্য করেননি।
আর সুফীদের তৃতীয় প্রকার তাওহীদ হলো, এমন তাওহীদ যা সৃষ্টির পূর্ব থেকেই রয়েছে। তাদের মতে সৃষ্টিজগতের মধ্যে এমন কোনো মাখলুক নেই যার নিজস্ব কোনো অস্তিত্ব রয়েছে। বরং অনাদি, অবিনশ্বর ও চিরন্তন সত্তার অস্তিত্ব থেকেই সকল সৃষ্টি অস্তিত্ব লাভ করেছে। এটিকে তারা তাওহীদুল খাস্সাতিল খাস্সা নাম দিলেও এটি ওয়াহদাতুল উজুদের (সর্বেশ্বরবাদ) কুফুরী ছাড়া অন্য কিছু নয়। এ প্রকার তাওহীদের মধ্যেই সুফীদের সর্বোচ্চ শাইখগণ রয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের নিকট এটিই হলো সর্বাধিক নিকৃষ্ট কুফুরী।
[2]. ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী রহিমাহুল্লাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি শেষ জীবনে স্বীকার করেছেন, সারাজীবন তর্কশাস্ত্রের পিছনে শেষ করে মানসিকভাবে স্বস্তিবোধ করতে পারেননি। পরিশেষে তিনি কুরআন-সুন্নাহর পদ্ধতির দিকেই ফিরে এসেছেন। ইমাম গাযালী সম্পর্কেও একই কথা বর্ণিত হয়েছে। শেষ জীবনে তিনিও দর্শন, সুফীবাদ ও তর্কশাস্ত্র পরিত্যাগ করে কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফদের মানহাজে ফিরে এসেছেন। আরো বলা হয়েছে যে, তিনি বুকের উপর ছহীহ বুখারী নিয়ে মৃত্যু বরণ করেছেন। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া গাযালীর ছাত্রদের থেকে বর্ণনা করেছেন যে, গাযালী শেষ জীবনে উপনীত হয়ে সুফীবাদ ও কালামশাস্ত্র বর্জন করে ইলমে হাদীছের দিকে ফিরে এসেছিলেন। কালামশাস্ত্রের অন্যতম ভিত্তি নির্মাণকারী ফখরুদ্দীন রাযির ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, তিনি শেষ জীবনে কালাম শাস্ত্র থেকে তাওবা করেছেন এবং সালাফদের পথে ফিরে এসেছেন।
[3]. সুফীবাদের পরিভাষায় فناء في الله এর পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সুফীগণ এ স্তরে পৌঁছে সৃষ্টি ও স্রষ্টার মধ্যে কোনো রূপ ব্যবধান দেখতে পায় না। অর্থাৎ সুফীর চোখের সামনে তখন সৃষ্টি ও স্রষ্টা, -এ দু’য়ের মাঝখানে কোনো সীমারেখা পরিলক্ষিত হয় না। সে শুধু একটি অস্তিত্বকেই চোখে দেখে এবং সে নিজেও আল্লাহর অস্তিত্বের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। এক কথায় সুফী সাধক এ পর্যায়ে পৌঁছে দুই এর পরিবর্তে পৃথিবীতে শুধু একক স্রষ্টা আল্লাহর হাকীকতকেই দেখতে পায়। অর্থাৎ সবকিছুকেই সে স্রষ্টা মনে করে। এটি মূলত ওয়াহদাতুল উজুদের (সর্বেশ্বরবাদ) বিশ্বাস ছাড়া অন্য কিছু নয়।
সুফীদের কেউ কেউ ফানা ফিল্লাহর ব্যাখ্যায় বলেছে, তা হলো এমন স্তর, যেখানে পৌঁছে মুমিন ব্যক্তি তার নিজের নফসের অস্তিত্ব অনুভব করে না এবং মানবিক প্রয়োজনাদিও অনুভব করে না। সে শুধু তার নফসের মধ্যে আল্লাহর অস্তিত্বকেই উপস্থিত মনে করে।
ইবনে আরাবী ফানা ফিল্লাহ এর ব্যাখ্যায় বলেন, زوال الصفات المذمومة وثبوت الصفات المحمودة هو অর্থাৎ ফানা ফিল্লাহ হলো, মানবীয় গুণাবলী দূর হয়ে যাওয়া এবং স্রষ্টার প্রশংসিত গুণাবলী স্থায়ী হওয়া। এ কথার সারমর্ম হলো, ফানা ফিল্লাহ এর স্তরে পৌঁছে সুফী সাধকের মানবীয় গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং তদস্থলে স্রষ্টার গুণাবলী চলে আসে। ফলে সে পানাহার, ঘুম বা দুনিয়ার অন্য কোনো বস্তুর প্রতি মোটেই প্রয়োজন অনুভব করে না; ইবনে আরাবী ফতুহাতুল মক্কীয়ায় আরো বলেন,غاية الفناء أنه لا يرى إلا الله ولايعلم إالله অর্থাৎ ফানার সর্বোচ্চ স্তর হলো, সে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুই দেখে না এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুই জানে না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, সুফীরা ফানা ফিল্লাহ এর স্তরে পৌঁছে সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুই দেখে না। পৃথিবীতে যা কিছু দেখে সবই আল্লাহ, যা কিছু আছে বলে জানা যায়, তার সবকিছুই আল্লাহ। এটিই হলো ওয়াহদাতুল উজুদের কুফুরী, যাকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা সর্ববৃহৎ কুফুরী বলে আখ্যায়িত করেছেন। সুফীদের সকল মাশায়েখই ওয়াহদাতুল উজুদের প্রবক্তা। মানসুর হাল্লাজও এ কথাই বলেছে। সে বলেছে, ما في الجبة إلا الله ‘‘আমার জুব্বার মধ্যে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুই নেই’’। (নাউযুবিল্লাহ)
[4]. যঈফ: সুনানে আবু দাউদ হা/৪৯০৪। ইমাম আলবানী রহিমাহুল্লাহ হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন, দেখুন, সিলসিলা যঈফা হ/ ৩৪৬৮।