আবদুল্লাহ ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরের উদ্দেশ্যে উটের পিঠে আরোহণ করতেন, তখন বলতেন,
«اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، اللهُ أَكْبَرُ، سُبْحانَ الذِيْ سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِينْ، وإِنَّا إِلَى ربِّنَا لَمُنْقَلِبُون، الَّلهُمَّ إِنَّا نَسْألُكَ فِيْ سَفَرِِنا هَذَا البِرَّ والتَّقْوى، ومِنَ الْعَمَلِ ما تَرْضَى، الَّلهُمَّ هوِّن عَلَيْنا سَفَرَنا هَذَا واطْوِعنَّا بُعدَه، الَّلهُمَّ أنْتَ الصَّاحِبُ في السَّفَرِ، وَالْخَلِيْفَةُ فِي الأَهْلِ، الَّلهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ مِنْ وَعْثَاءِ السَّفَرِ وَكَآبَةِ الْمَنْظَر، وَسُوءِ المُنْقَلَبِ فِيْ الْمَالِ والأَهْلِ».
(আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। সুবহানাল্লাযী ছাখ্খারা লানা হাযা ওয়ামা কুন্না লাহূ মুকরিনীন; ওয়া ইন্না ইলা রবিবনা লামুনকালিবুন। আল্লাহুম্মা ইন্না নাসআলুকা ফি সাফারিনা হাযাল-বির্রা ওয়াত-তাকওয়া, ওয়া মিনাল আমালি মা-তারদা। আললাহুম্মা হাওয়িন ‘আলাইনা সাফারানা হাযা ওয়াতবি ‘আন্না বু‘দাহু। আল্লাহুম্মা আনতাস সাহেবু ফিস-সাফারি, ওয়াল খালীফাতু ফিল আহলি। আল্লাহুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিন ওয়া‘ছাইস সাফারি ওয়া কাআবাতিল মানযারি ওয়া সূইল মুনকালাবি ফিল মালি ওয়াল আহলি।)
‘আল্লাহ মহান। আল্লাহ মহান। আল্লাহ মহান। পবিত্র সেই মহান সত্তা যিনি আমাদের জন্য একে বশীভূত করেছেন, যদিও আমরা একে বশীভূত করতে সক্ষম ছিলাম না। আর আমরা অবশ্যই ফিরে যাব আমাদের রবের নিকট। হে আল্লাহ, আমাদের এ সফরে আমরা আপনার নিকট প্রার্থনা জানাই সৎকাজ ও তাকওয়ার এবং এমন আমলের যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন। হে আল্লাহ, আমাদের জন্য এ সফর সহজ করুন এবং এর দূরত্ব কমিয়ে দিন। হে আল্লাহ, এ সফরে আপনিই আমাদের সাথী এবং পরিবার-পরিজনের আপনিই তত্ত্বাবধানকারী। হে আল্লাহ, আমরা আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি সফরের কষ্ট ও অবাঞ্ছিত দৃশ্য থেকে এবং সম্পদ ও পরিজনের মধ্যে মন্দ প্রত্যাবর্তন থেকে।’
আর সফর থেকে ফিরেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপরোক্ত দো‘আগুলো পড়তেন এবং সাথে এ অংশটি যোগ করতেন-
«آئِبُوْنَ، تَائِبُوْنَ، عَابِدُوْنَ، لِرَِبِنَا حَامِدُوْنَ».
(আয়েবূনা, তায়েবূনা, আবেদূনা, লি রাবিবনা হামিদূন।)
‘আমরা আমাদের রবের উদ্দেশ্যে প্রত্যাবর্তনকারী, তওবাকারী, ইবাদতকারী ও আমাদের রবের প্রশংসাকারী।’[1]
প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা ফরয। আর প্রয়োজনীয় মুহূর্তের জ্ঞান অর্জন করা বিশেষভাবে ফরয। ব্যবসায়ীর জন্য ব্যবসা সংক্রান্ত ইসলামী বিধি-বিধান জানা ফরয। কৃষকের জন্য কৃষি সংক্রান্ত ইসলামের যাবতীয় নির্দেশনা জানা ফরয। তেমনি ইবাদতের ক্ষেত্রেও সালাত কায়েমকারির জন্য সালাতের যাবতীয় মাসআলা জানা ফরয। হজ পালনকারির জন্য হজ সংক্রান্ত যাবতীয় মাসআলা জানা ফরয।
প্রচুর অর্থ ব্যয় ও শারীরিক কষ্ট সহ্য করে হজ থেকে ফেরার পর যদি আলেমের কাছে গিয়ে বলতে হয়, ‘আমি এই ভুল করেছি, দেখুন তো কোন পথ করা যায় কি-না’, তবে তা দুঃখজনক বৈ কি। অথচ তার ওপর ফরয ছিল, হজের সফরের পূর্বেই এ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করা। ইমাম বুখারী রহ. তাঁর রচিত সহীহ গ্রন্থের একটি পরিচ্ছেদ-শিরোনাম করেছেন এভাবে :
باب الْعِلْمُ قَبْلَ الْقَوْلِ وَالْعَمَلِ.لِقَوْلِ اللهِ تَعَالَى : (فَاعْلَمْ أَنَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ)
(এ অধ্যায় ‘কথা ও কাজের আগে জ্ঞান লাভ করার বিষয়ে’; কারণ আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘সুতরাং তুমি ‘জান’ যে, তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই)। ইমাম বুখারী রহ. এখানে কথা ও কাজের আগে ইলম তথা জ্ঞানকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে :
«خُذُوْا عَنِّيْ مَنَاسِكَكُم»
‘তোমরা আমার কাছ থেকে তোমাদের হজ ও উমরার বিধি-বিধান শিখে নাও।’[1] এ হাদীস থেকে প্রমাণিত হয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে হজ ও উমরা পালনের আগেই হজ সংক্রান্ত যাবতীয় আহকাম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
অতএব আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, হজ-উমরা পালনকারী প্রত্যেক নর-নারীর জন্য যথাযথভাবে হজ ও উমরার বিষয়াদি জানা ফরয। হজ ও উমরা পালনের বিধি-বিধান জানার পাশাপাশি প্রত্যেক হজ ও উমরাকারীকে অতি গুরুত্বের সাথে হজ ও উমরার শিক্ষণীয় দিকগুলো অধ্যয়ন ও অনুধাবন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজের সফরে বা হজের দিনগুলোতে কিভাবে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক নিবিড় করার চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন, উম্মত ও পরিবার-পরিজন এবং স্বজনদের সাথে উঠাবসায় কী ধরনের আচার-আচরণ করেছেন তা রপ্ত করতে হবে। নিঃসন্দেহে এ বিষয়টির অধ্যয়ন, অনুধাবন ও রপ্তকরণ হজ-উমরার তাৎপর্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে চেতনা সৃষ্টি করবে।
আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে সঠিকভাবে হজ-উমরার বিধি-বিধান জানা, এর শিক্ষণীয় দিকগুলো অনুধাবন করা এবং সহীহভাবে হজ-উমরা পালন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
হজ :
হজের আভিধানিক অর্থ ইচ্ছা করা।[1] শরীয়তের পরিভাষায় হজ অর্থ নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট কিছু জায়গায়, নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক নির্দিষ্ট কিছু কর্ম সম্পাদন করা।[2]
উমরা :
উমরার আভিধানিক অর্থ : যিয়ারত করা। শরীয়তের পরিভাষায় উমরা অর্থ, নির্দিষ্ট কিছু কর্ম অর্থাৎ ইহরাম, তাওয়াফ, সাঈ ও মাথা মুণ্ডন বা চুল ছোট করার মাধ্যমে বায়তুল্লাহ শরীফের যিয়ারত করা।[3]
[2]. ইবন কুদামা, আল-মুগনী : ৫/৫।
[3]. ড. সাঈদ আল-কাহতানী, আল-উমরাতু ওয়াল হাজ্জ ওয়ায যিয়ারাহ, পৃ. ৯।
১. হজ ইসলামের পাঁচ রুকন বা স্তম্ভের অন্যতম, যা আল্লাহ তা‘আলা সামর্থবান মানুষের ওপর ফরয করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٧ ﴾ [ال عمران: ٩٧]
‘এবং সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য বাইতুল্লাহ্র হজ করা ফরয। আর যে কুফরী করে, তবে আল্লাহ তো নিশ্চয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী।’[1]
ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«بُنِيَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَالْحَجِّ ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ».
‘ইসলামের ভিত রাখা হয়েছে পাঁচটি বস্তুর ওপর : এ মর্মে সাক্ষ্য প্রদান করা যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল; সালাত কায়েম করা; যাকাত প্রদান করা; হজ করা এবং রমযানের সিয়াম পালন করা।’[2]
সুতরাং হজ ফরয হওয়ার বিধান কুরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলীল দ্বারা প্রমাণিত। এ ব্যাপারে সকল মুসলিম একমত।
২. হজ সামর্থবান ব্যক্তির ওপর সারা জীবনে একবার ফরয। ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«خَطَبَنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ : يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ اللَّهَ كَتَبَ عَلَيْكُمُ الْحَجَّ.فَقَامَ الأَقْرَعُ بْنُ حَابِسٍ فَقَالَ : أَفِى كُلِّ عَامٍ يَا رَسُولَ اللَّهِ؟ قَالَ : لَوْ قُلْتُهَا لَوَجَبَتْ ، وَلَوْ وَجَبَتْ لَمْ تَعْمَلُوا بِهَا ، وَلَمْ تَسْتَطِيعُوا أَنْ تَعْمَلُوا بِهَا. الْحَجُّ مَرَّةٌ فَمَنْ زَادَ فَتَطَوُّعٌ».
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সম্বোধন করে বললেন, ‘হে লোক সকল, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ওপর হজ ফরয করেছেন।’ তখন আকরা‘ ইবন হাবিস রা. দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, প্রত্যেক বছর? তিনি বললেন, ‘আমি বললে অবশ্যই তা ফরয হয়ে যাবে। আর যদি ফরয হয়ে যায়, তবে তোমরা তার ওপর আমল করবে না এবং তোমরা তার ওপর আমল করতে সক্ষমও হবে না। হজ একবার ফরয। যে অতিরিক্ত আদায় করবে, সেটা হবে নফল।’[3]
৩. সক্ষম ব্যক্তির ওপর বিলম্ব না করে হজ করা জরুরী। কালক্ষেপণ করা মোটেই উচিত নয়। এটা মূলত শিথিলতা ও সময়ের অপচয় মাত্র। ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«تَعَجَّلُوا إِلَى الْحَجِّ - يَعْنِي : الْفَرِيضَةَ - فَإِنَّ أَحَدَكُمْ لاَ يَدْرِي مَا يَعْرِضُ لَهُ».
‘তোমরা বিলম্ব না করে ফরয হজ আদায় কর। কারণ তোমাদের কেউ জানে না, কী বিপদাপদ তার সামনে আসবে।’[4] উমর ইবনুল খাত্তাব রা. বলেন,
لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ أَبْعَثَ رِجَالًا إلَى هَذِهِ الْأَمْصَارِ فَيَنْظُرُوا كُلَّ مَنْ لَهُ جَدَةٌ وَلَمْ يَحُجَّ فَيَضْرِبُوا عَلَيْهِ الْجِزْيَةَ مَا هُمْ بِمُسْلِمِينَ مَا هُمْ بِمُسْلِمِينَ.
‘আমার ইচ্ছা হয়, এসব শহরে আমি লোক প্রেরণ করি, তারা যেন দেখে কে সামর্থবান হওয়ার পরও হজ করেনি। অতপর তারা তার ওপর জিযিয়া[5] আরোপ করবে। কারণ, তারা মুসলিম নয়, তারা মুসলিম নয়।’[6] উমর রা. আরো বলেন :
لِيَمُتْ يَهُودِيًّا أَوْ نَصْرَانِيًّا- يَقُولُهَا ثَلَاثَ مَرَّات-ٍ رَجُلٌ مَاتَ وَلَمْ يَحُجَّ وَوَجَدَ لِذَلِكَ سَعَةً .
‘ইহূদী হয়ে মারা যাক বা খ্রিস্টান হয়ে -তিনি কথাটি তিনবার বললেন- সেই ব্যক্তি যে আর্থিক স্বচ্ছলতা সত্ত্বেও হজ না করে মারা গেল।’[7]
[2]. বুখারী : ০৮; মুসলিম : ৬১।
[3]. মুসনাদে আহমদ : ৪০২২; আবূ দাউদ : ১২৭১; ইবন মাজাহ্ : ৬৮৮২।
[4]. মুসনাদে আহমদ : ৭৬৮২; ইবন মাজাহ্ : ৩৮৮২।
[5]. কর বা ট্যাক্স।
[6]. ইবন হাজার, আত-তালখীসুল হাবীর : ২/২২৩।
[7]. বাইহাকী : ৪/৩৩৪।
হজের ফরযসমূহ :
১. ইহরাম তথা হজের নিয়ত করা। যে ব্যক্তি হজের নিয়ত করবে না তার হজ হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى».
‘নিশ্চয় আমলসমূহ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেকের জন্য তাই হবে, যা সে নিয়ত করে।’[1]
২. উকূফে আরাফা বা আরাফায় অবস্থান।[2] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الْحَجُّ عَرَفَةُ».
‘হজ হচ্ছে আরাফা’[3]
৩. তাওয়াফে ইফাযা বা তাওয়াফে যিয়ারা (বাইতুল্লাহ্র ফরয তাওয়াফ)। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
«وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ»
‘আর তারা যেন প্রাচীন ঘরের[4] তাওয়াফ করে।’[5]
সাফিয়্যা রা. যখন ঋতুবতী হলেন, তখন নবীজী বললেন, ‘সে কি আমাদেরকে আটকিয়ে রাখবে?। আয়েশা রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, সে তো ইফাযা অর্থাৎ বায়তুল্লাহ্র তাওয়াফ করেছে। তাওয়াফে ইফাযার পর সে ঋতুবতী হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তাহলে এখন যাত্রা কর।[6] এ থেকে বুঝা যায়, তাওয়াফে ইফাযা ফরয।
৪. সাফা ও মারওয়ায় সাঈ করা।[7] অধিকাংশ সাহাবী, তাবিঈ ও ইমামের মতে এটা ফরয।[8] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«اسْعَوْا فَإِنَّ اللَّهَ كَتَبَ عَلَيْكُمُ السَّعْي».
‘তোমরা সাঈ কর, কেননা আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ওপর সাঈ ফরয করেছেন।’[9] আয়েশা রা. বলেন,
فَلَعَمْرِى مَا أَتَمَّ اللَّهُ حَجَّ مَنْ لَمْ يَطُفْ بَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ.
‘আমার জীবনের কসম! আল্লাহ কখনো সে ব্যক্তির হজ পরিপূর্ণ করবেন না যে সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করে না।’[10]
মনে রাখবেন, যে ব্যক্তি কোন একটি ফরয ছেড়ে দেবে, তার হজ হবে না।
হজের ওয়াজিবসমূহ :
১. মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা। অর্থাৎ মীকাত অতিক্রমের আগেই ইহরাম বাঁধা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মীকাতগুলো নির্ধারণ করার সময় বলেন,
«هُنَّ لَهُنَّ وَلِمَنْ أَتَى عَلَيْهِنَّ مِنْ غَيْرِ أَهْلِهِنَّ لِمَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَجَّ وَالْعُمْرَة».
‘এগুলো তাদের জন্য এবং যারা অন্যত্র থেকে ওই পথে আসে হজ ও উমরা আদায়ের ইচ্ছা নিয়ে তাদের জন্যও।’[11]
২. সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফায় অবস্থান করা।
যে ব্যক্তি আরাফার ময়দানে দিনে উকূফ করবে, তার ওপর ওয়াজিব হচ্ছে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থান করা। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার ময়দানে দিনে উকূফ করেছেন এবং সূর্যাস্ত পর্যস্ত সেখানে অবস্থান করেছেন। মিসওয়ার ইবন মাখরামা রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফায় আমাদের উদ্দেশে বক্তৃতা করার সময় বললেন, মুশরিক ও পৌত্তলিকরা সূর্যাস্তের সময় এখান থেকে প্রস্থান করত, যখন সূর্য পাহাড়ের মাথায় পুরুষের মাথায় পাগড়ির মতই অবস্থান করত। অতএব আমাদের আদর্শ তাদের আদর্শ থেকে ভিন্ন’।[12] সুতরাং সূর্যাস্তের পর আরাফা থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রস্থান মুশরিকদের আচারের সাথে ভিন্নতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই ছিল।
৩. মুযদালিফায় রাত যাপন।
ক. কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় রাত যাপন করেছেন এবং বলেছেন,
«لِتَأْخُذْ أُمَّتِي نُسُكَهَا ، فَإِنِّي لاَ أَدْرِي لَعَلِّي لاَ أَلْقَاهُمْ بَعْدَ عَامِي هَذَا».
‘আমার উম্মত যেন হজের বিধান শিখে নেয়। কারণ আমি জানি না, এ বছরের পর সম্ভবত তাদের সাথে আমার আর সাক্ষাত হবে না।’
খ. তিনি অর্ধরাতের পর দুর্বলদেরকে মুযদালিফা প্রস্থানের অনুমতি দিয়েছেন। এ থেকে বুঝা যায়, মুযদালিফায় রাত যাপন ওয়াজিব। কারণ অনুমতি তখনই প্রয়োজন হয় যখন বিষয়টি গুরুত্বের দাবী রাখে।
গ. আল্লাহ তা‘আলা মাশ‘আরে হারামের নিকট তাঁর যিকর করার আদেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
فَإِذَآ أَفَضۡتُم مِّنۡ عَرَفَٰتٖ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ عِندَ ٱلۡمَشۡعَرِ ٱلۡحَرَامِۖ [البقرة: ١٩٨]
‘সুতরাং যখন তোমরা আরাফা থেকে বের হয়ে আসবে, তখন মাশ‘আরে হারামের নিকট আল্লাহকে স্মরণ কর।’[13]
৪. তাশরীকের রাতগুলো মিনায় যাপন।
১০ তারিখ দিবাগত রাত ও ১১ তারিখ দিবাগত রাত মিনায় যাপন করতে হবে। ১২ তারিখ যদি মিনায় থাকা অবস্থায় সূর্য ডুবে যায় তাহলে ১২ তারিখ দিবাগত রাতও মিনায় যাপন করতে হবে। ১৩ তারিখ কঙ্কর মেরে তারপর মিনা ত্যাগ করতে হবে।
আয়েশা রা. বলেন,
أَفَاضَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ آخِرِ يَوْمِهِ حِينَ صَلَّى الظُّهْرَ ثُمَّ رَجَعَ إِلَى مِنًى فَمَكَثَ بِهَا لَيَالِىَ أَيَّامِ التَّشْرِيقِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যোহরের সালাত মসজিদুল হারামে আদায় ও তাওয়াফে যিয়ারত শেষ করে মিনায় ফিরে এসেছেন এবং তাশরীকের রাতগুলো মিনায় কাটিয়েছেন।’[14]
হাজীদেরকে যমযমের পানি পান করানোর জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিনার রাতগুলো মক্কাতে যাপনের অনুমতি দিয়েছেন এবং উটের দায়িত্বশীলদেরকে মিনার বাইরে রাতযাপনের অনুমতি দিয়েছেন। এই অনুমতি প্রদান থেকে প্রতীয়মান হয়, মিনার রাতগুলোতে মিনাতে যাপন করা ওয়াজিব।
৫. জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা।
১০ যিলহজ জামরাতুল আকাবায় (বড় জমারায়) কঙ্কর নিক্ষেপ করা। তাশরীকের দিনসমূহ যথা, ১২, ১২ এবং যারা ১৩ তারিখ মিনায় থাকবেন, তাদের জন্য ১৩ তারিখেও। যথাক্রমে ছোট, মধ্য ও বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে জামরাতে কঙ্কর নিক্ষেপ করেছেন। জাবের রা. বলেন,
رَأَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَرْمِى عَلَى رَاحِلَتِهِ يَوْمَ النَّحْرِ وَيَقُولُ «لِتَأْخُذُوا مَنَاسِكَكُمْ فَإِنِّى لاَ أَدْرِى لَعَلِّى لاَ أَحُجُّ بَعْدَ حَجَّتِى هَذِهِ ».
‘আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেছি কুরবানীর দিন তিনি তাঁর বাহনের ওপর বসে কঙ্কর নিক্ষেপ করছেন এবং বলেছেন, তোমরা তোমাদের হজের বিধান জেনে নাও। কারণ আমি জানি না, সম্ভবত আমার এ হজের পর আমি আর হজ করতে পারব না।’[15]
৬. মাথা মুন্ডান বা চুল ছোট করা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা মুণ্ডানো বা চুল ছোট করার আদেশ দিয়ে বলেন, وَلْيُقْصِرْ ، وَلْيُحِلل অর্থাৎ সে যেন মাথার চুল ছোট করে এবং হালাল হয়ে যায়।[16] আর তিনি মাথা মুণ্ডনকারিদের জন্য তিনবার মাগফিরাতের দো‘আ করেছেন এবং চুল ছোটকারিদের জন্য একবার মাগফিরাতের দো‘আ করেছেন।
৭. বিদায়ী তাওয়াফ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায়ী তাওয়াফের আদেশ দিয়ে বলেন,
«لاَ يَنْفِرَنَّ أَحَدٌ حَتَّى يَكُونَ آخِرُ عَهْدِهِ بِالْبَيْت».
‘বাইতুল্লাহ্র সাথে তার শেষ সাক্ষাত না হওয়া পর্যন্ত কেউ যেন না যায়।’[17]
ইবন আব্বাস রা. বলেন,
أُمِرَ النَّاسُ أَنْ يَكُونَ آخِرُ عَهْدِهِمْ بِالْبَيْتِ إِلاَّ أَنَّهُ خُفِّفَ عَنِ الْمَرْأَةِ الْحَائِضِ.
‘লোকদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাদের শেষ কাজ যেন হয় বাইতুল্লাহ্র সাক্ষাত। তবে তিনি ঋতুবতী মহিলার জন্য ছাড় দিয়েছেন।’[18]
উল্লেখ্য, যে এসবের একটিও ছেড়ে দেবে, তার ওপর দম ওয়াজিব হবে অর্থাৎ একটি পশু যবেহ করতে হবে।
ইবন আব্বাস রা. বলেন,
مَنْ نَسِىَ شَيْئًا مِنْ نُسُكِهِ أَوْ تَرَكَهُ فَلْيُهْرِقْ دَمًا.
‘যে ব্যক্তি তার হজের কোন কাজ করতে ভুলে যায় অথবা ছেড়ে দেয় সে যেন একটি পশু যবেহ করে।’[19]
[2]. হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবরাহীম আ. এর আদর্শের অনুকরণ করেছেন। তিনি মুশরিকদের ব্যাপারে মুসলমানদেরকে বলছেন, ‘هَدْيُنَا مُخَالِفٌ لِهَدْيِهِمْ ‘আমাদের আদর্শ তাদের আদর্শ থেকে ভিন্ন’। সুতরাং তিনি মুসলমানদেরকে নিয়ে আরাফার ময়দানে অবস্থান করলেন এবং এ-ক্ষেত্রেও কুরাইশদের বিপরীত করলেন। কেননা কুরাইশরা মুযদালিফা অতিক্রম করত না; বরং মুযদালিফাতেই অবস্থান করত এবং বলত, আমরা হারাম এলাকা ছাড়া অন্য জায়গা থেকে প্রস্থান করব না। উল্লেখ্য, আরাফা হারামের সীমারেখার বাইরে। (বায়হাকী : আস-সুনানুল-কুবরা : ৫/১২৫)।
[3]. এরওয়াউল গালীল। ৪/২৫৬।
[4] الْبَيْتِ الْعَتِيق বা পুরাতন ঘর বলতে আল্লাহর ইবাদাতের জন্য তৈরিকৃত সবচাইতে পুরাতন ঘর তথা কা‘বা ঘরকে বুঝানো হয়েছে। কারণ ইবাদাতের জন্য নির্মিত এটাই যমীনের বুকে সর্বপ্রথম ঘর।
[5]. হজ : ২৯।
[6]. বুখারী : ৪২৮।
[7]. জাহেলী যুগে আনসারদের কিছু লোক মূর্তির উদ্দেশে হজ পালন করত এবং মনে করত যে, সাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করা বৈধ নয়। তাঁরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে হজ করতে আসল, তখন বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে উপস্থাপন করল। তিনি বললেন, ‘সাঈ কর, কেননা আল্লাহ তোমাদের ওপর সাঈ ফরয করেছেন।’ (বিস্তারিত দেখুন বুখারী : ১৬৪৩ )
[8]. ইমাম আবূ হানীফা রহ. এর মতে এটি ওয়াজিব।
[9]. মুসনাদে আহমদ : ৪২১।
[10]. মুসলিম : ৯২৮।
[11]. বুখারী : ১৫২৪; মুসলিম : ১১৮১।
[12]. বায়হাকী, আস-সুনানুল-কুবরা : ৫/১২৫।
[13]. বাকারা : ১৯৮।
[14]. আবূ দাউদ: ১৬৮৩।
[15]. মুসলিম : ১২৯৭; আবূ দাউদ : ১৯৭০।
[16]. বুখারী : ১৬৯১; মুসলিম : ১২২৭।
[17]. মুসলিম : ২৩৫০।
[18]. মুসলিম : ২৩৫১।
[19]. মুআত্তা মালেক : ৮৯০; দারাকুতনী : ২/২৪৪।
বিশুদ্ধ মতানুসারে উমরা করা ওয়াজিব।[1] আর তা জীবনে একবার। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الإِسْلاَمُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ وَأَنْ تُقِيمَ الصَّلاَةَ وَتُؤْتِيَ الزَّكَاةَ وَتَحُجَّ وَتَعْتَمِرَ وَتَغْتَسِلَ مِنَ الْجَنَابَةِ وَتُتِمَّ الْوُضُوءَ وَتَصُومَ رَمَضَانَ».
‘ইসলাম হচ্ছে তোমার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল; সালাত কায়েম করা; যাকাত প্রদান করা; হজ করা ও উমরা করা; নাপাকি থেকে পবিত্র হওয়ার গোসল করা; পূর্ণরূপে উযু করা এবং রমযানের সিয়াম পালন করা।’[2]
আয়েশা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জিজ্ঞাসা করলেন, মহিলাদের কি জিহাদ আছে? উত্তরে তিনি বললেন,
«نَعَمْ ، عَلَيْهِنَّ جِهَادٌ ، لاَ قِتَالَ فِيهِ : الْحَجُّ وَالْعُمْرَةُ».
‘হ্যাঁ, তাদেরও জিহাদ[3] আছে, তাতে কোন লড়াই নেই। তা হলো, হজ ও উমরা।’[4]
ইবন উমর রা. বলেন,
لَيْسَ مِنْ أَحَدٍ إِلاَّ وَعَلَيْهِ حَجَّةٌ وَعُمْرَةٌ وَاجِبَتَانِ لاَ بُدَّ مِنْهُمَا فَمَنْ زَادَ بَعْدَ ذَلِكَ خَيْرٌ وَتَطَوُّعٌ.
‘প্রত্যেকের ওপর একবার হজ ও একবার উমরা ওয়াজিব,[5] যা অবশ্যই আদায় করতে হবে। যে এরপর অতিরিক্ত করবে, তা হবে উত্তম ও নফল।’[6]
জাবের রা. বলেন,
لَيْسَ مِنْ خَلْقِ اللَّهِ أَحَدٌ إِلاَّ وَعَلَيْهِ عُمْرَةٌ وَاجِبَةٌ.
‘আল্লাহর প্রতিটি মাখলূক (সামর্থবান মানুষ)-এর ওপর অবশ্যই উমরা ওয়াজিব।’[7]
ইবন আব্বাস রা. বলেন,
الْحَجُّ وَالْعُمْرَة وَاجِبَتَانِ.
হজ ও উমরা উভয়টা ওয়াজিব।’[8]
[2]. ইবন খুযাইমা : ৩০৬৫; ইবনে হিববান : ১৭৩।
[3]. জিহাদ খুবই কষ্টসাধ্য আমল। মহিলাদের জন্য হজ (পুরুষদের তুলনায়) অধিক কষ্টসাধ্য কাজ। সেহেতু তা মহিলাদের জিহাদ। মহিলাদের অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়। তাছাড়া শারীরিকভাবেও অনেক কাজ কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া আরো অনেক ব্যাখ্যা রয়েছে।
[4]. মুসনাদে আহমদ : ২২২৫২; ইবন মাজাহ্হ : ১০৯২; ইবন খুযাইমা : ৩০৪৭।
[5]. সুন্নাহের পরিভাষায় ফরয ও ওয়াজিব উভয়টির জন্য ওয়াজিব শব্দ ব্যবহার করা হয়।
[6]. ইবন খুযাইমাহ : ৩০৬৬; হাকেম : ২৩৭১; বুখারী, তা‘লিকাহ।
[7]. ইবন খুযাইমা : ৩০৭৬।
[8]. মুহাল্লা : ৫/৮।
উমরার ফরয :
১। ইহরাম বাঁধার নিয়ত করা। যে ব্যক্তি উমরার নিয়ত করবে না তার উমরা হবে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى».
‘নিশ্চয় আমলসমূহ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেকের জন্য তাই হবে, যা সে নিয়ত করে।’[1]
২। বাইতুল্লাহ্র তাওয়াফ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلۡيَطَّوَّفُواْ بِٱلۡبَيۡتِ ٱلۡعَتِيقِ ٢٩ [الحج: ٢٩]
‘আর তারা যেন প্রাচীন ঘরের তাওয়াফ করে’।[2]
সাফা ও মারওয়ার মাঝে সাঈ করা। (অধিকাংশ সাহাবী, তাবিঈ ও ইমামের মতে)। ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর মতে এটি ওয়াজিব। সাফা ও মারওয়ায় সাঈ ফরয হওয়া সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَمَنْ لَمْ يَكُنْ مِنْكُمْ أَهْدَى فَلْيَطُفْ بِالْبَيْتِ وَبِالصَّفَا وَالْمَرْوَة»
‘আর তোমাদের মধ্যে যে হাদী নিয়ে আসেনি সে যেন বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করে এবং সাফা ও মারওয়ার সাঈ করে।’[3] তাছাড়া তিনি সাঈ সম্পর্কে আরো বলেন,
اسْعَوْا فَإِنَّ اللَّهَ كَتَبَ عَلَيْكُمُ السَّعْي.
‘তোমরা সাঈ করো, কেননা আল্লাহ তোমাদের ওপর সাঈ ফরয করেছেন।’[4]
সুতরাং যদি কেউ ইহরাম বাঁধার নিয়ত না করে, তবে তার উমরা আদায় হবে না। যদিও সে তাওয়াফ, সাঈ সম্পাদন করে। তেমনি যদি কেউ তাওয়াফ বা সাঈ না করে, তাহলে তার উমরা আদায় হবে না। তাওয়াফ ও সাঈ আদায় না করা পর্যন্ত সে ইহরাম অবস্থায় থাকবে। এমতাবস্থায় তাকে চুল ছোট বা মাথা মুণ্ডন না করে ইহরাম অবস্থায় থাকতে হবে।
উমরার ওয়াজিব :
১। মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধা।
ক. মীকাতের বাইরে অবস্থানকারিদের জন্য যে মীকাত দিয়ে তিনি প্রবেশ করবেন সেখান থেকেই ইহরাম বাঁধা। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মীকাতগুলো নির্ধারণ করার সময় বলেন,
«هُنَّ لَهُنَّ وَلِمَنْ أَتَى عَلَيْهِنَّ مِنْ غَيْرِ أَهْلِهِنَّ لِمَنْ كَانَ يُرِيدُ الْحَجَّ وَالْعُمْرَة».
‘এগুলো তাদের জন্য এবং যারা অন্যত্র থেকে ঐ পথে আসে হজ ও উমরা আদায়ের ইচ্ছা নিয়ে তাদের জন্যও।’[5]
খ. মক্কায় অবস্থানকারিদের জন্য হিল্ল অর্থাৎ হারাম এলাকার বাইরে থেকে ইহরাম বাঁধা। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রা. কে তানঈম থেকে ইহরাম বাঁধার আদেশ দিয়েছেন।[6] তানঈম হারামের সীমার বাইরে অবস্থিত। মক্কায় অবস্থানকারী উমরাকারিদের জন্য এটি সবচে’ কাছের মীকাত অর্থাৎ উমরার ইহরাম বাঁধার স্থান।
গ. যারা মীকাতের ভেতরে অথচ হারাম এলাকার বাইরে অবস্থান করেন তারা নিজ নিজ অবস্থানস্থল থেকেই উমরার ইহরাম বাঁধবেন। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَمَنْ كَانَ دُونَ ذَلِكَ فَمِنْ حَيْثُ أَنْشَأَ»
‘আর যারা মীকাতের ভেতরে অবস্থানকারী তারা যেখান থেকে (হজ বা উমরার) ইচ্ছা করে সেখান থেকেই ইহরাম বাঁধবে।’[7]
২। মাথা মুণ্ডন করা অথবা চুল ছোট করা।
কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাথা মুণ্ডন অথবা চুল ছোট করার আদেশ দিয়ে বলেন, وَلْيُقْصِرْ ، وَلْيُحِلل অর্থাৎ সে যেন মাথার চুল ছোট করে এবং হালাল হয়ে যায়।[8]
সাফা ও মারওয়ার সাঈ করা। ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর মতে সাফা ও মারওয়ার সাঈ করা ওয়াজিব। তবে বিশুদ্ধ মত হল, এটি ফরয।
[2]. হজ : ২৯।
[3]. বুখারী : ১৬৯১; মুসলিম ১২২৭।
[4]. মুসনাদ আহমাদ : ৬/৪২১; মুস্তাদরাক হাকেম : ৪/৭০।
[5]. বুখারী : ১৫২৪; মুসলিম : ১১৮১।
[6]. বুখারী : ১৫৬১; মুসলিম : ১২১১।
[7]. বুখারী : ১৫২৪; মুসলিম : ১১৮১।
[8]. বুখারী : ১৬৯১; মুসলিম : ১২২৭।
‘যার অন্তর আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্ব ও মহত্ত্বের চেতনায় পূর্ণ, তার পক্ষে স্রষ্টার বিরুদ্ধাচরণ করা অসম্ভব। কারণ এ মহান সত্তার বিরুদ্ধাচরণ আর অন্যদের আদেশ লঙ্ঘন সমান নয়। যে নিজকে চিনতে পেরেছে, নিজের প্রকৃত অবস্থা জানতে পেরেছে এবং প্রতিটি মুহূর্তে ও প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে স্বীয় দৈন্যতা আর তাঁর প্রতি তীব্র মুখাপেক্ষিতার বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরেছে, তার পক্ষে সেই মহান সত্তার বিরুদ্ধাচরণ এবং তাঁর নির্দেশ লঙ্ঘন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। নিজের করুণ দশা আর রবের অসীম ক্ষমতার উপলব্ধিই তাকে যাবতীয় পাপাচার ও স্রষ্টার বিরুদ্ধাচরণ থেকে ফিরিয়ে রাখে। ফলে সে যেকোনো মূল্যে প্রভুর বিরুদ্ধাচরণ থেকে বেঁচে থাকতে সচেষ্ট হয়। শাস্তির সতর্কবাণীতে তার বিশ্বাস যত দৃঢ় হয়, শাস্তি থেকে বাঁচতে তার চেষ্টাও তত প্রাণান্তকর হয়।’[1]
-ইমাম ইবনুল কায়্যিম রহ.
হজ-উমরা সহীহ হওয়ার জন্য ব্যক্তিকে অবশ্যই মুসলিম ও জ্ঞানসম্পন্ন হতে হবে। আর তার ওপর হজ-উমরা আবশ্যক হওয়ার জন্য তাকে প্রাপ্ত বয়স্ক ও সামর্থবান হতে হবে। মহিলা হলে হজের সফরে তার সাথে মাহরাম থাকতে হবে। নিচে এর বিবরণ তুলে ধরা হল :
হজ ও উমরা সহীহ হওয়ার শর্ত :
১. মুসলিম হওয়া।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡمُشۡرِكُونَ نَجَسٞ فَلَا يَقۡرَبُواْ ٱلۡمَسۡجِدَ ٱلۡحَرَامَ بَعۡدَ عَامِهِمۡ هَٰذَاۚ ﴾ [التوبة: ٢٨]
‘হে ঈমানদারগণ, নিশ্চয় মুশরিকরা নাপাক, সুতরাং তারা যেন মসজিদুল হারামের নিকটবর্তী না হয় তাদের এ বছরের পর।’[1] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَمَا مَنَعَهُمۡ أَن تُقۡبَلَ مِنۡهُمۡ نَفَقَٰتُهُمۡ إِلَّآ أَنَّهُمۡ كَفَرُواْ بِٱللَّهِ وَبِرَسُولِهِۦ﴾ [التوبة: ٥٤]
‘আর তাদের দান কবুল থেকে একমাত্র বাধা এই ছিল যে, তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অস্বীকার করেছে।’[2] আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবূ বকর সিদ্দীক রা. আমাকে বিদায় হজের পূর্বের বছর, যে হজে তাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজের আমীর নিযুক্ত করেছিলেন- এমন এক দলের সদস্য করে পাঠালেন যারা কুরবানীর দিন মিনায় ঘোষণা দিচ্ছিল,
لاَ يَحُجُّ بَعْدَ الْعَامِ مُشْرِكٌ وَلاَ يَطُوفُ بِالْبَيْتِ عُرْيَانٌ.
‘এবছরের পর আর কোন মুশিরক হজ করবে না এবং কোন উলঙ্গ ব্যক্তি বাইতুল্লাহ্র তাওয়াফ করবে না।’[3] বুঝা গেল, এতে যেকোনো ইবাদত সহীহ ও কবুল হওয়ার জন্য মুসলিম হওয়া পূর্বশর্ত।
২. আকল বা বিবেকসম্পন্ন হওয়া।
তাই বিবেকশূন্য ব্যক্তির ওপর হজ-উমরা জরুরী নয়। কারণ সে ইসলামের বিধি-বিধান জানা এবং আল্লাহর আদেশ বুঝার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং সে দায়িত্ব পালনে অক্ষম। তাই আল্লাহর নির্দেশ পালনে সে আদিষ্ট নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«يُرْفَع الْقَلَم عَنْ الصَّغِير وَعَنْ الْمَجْنُون وَعَنْ النَّائِم».
‘বাচ্চা, পাগল ও ঘুমন্ত ব্যক্তির ওপর থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়।’[4] যদি কেউ ইহরাম বাঁধার পূর্বেই বেহুঁশ বা অজ্ঞান হয়, তার জন্য বেহুঁশ অবস্থায় ইহরাম বাঁধার অবকাশ নেই। কেননা, হজে বা উমরা আদায়ের জন্য নিয়ত করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। যদি সে ইহরাম বাঁধার পর বেহুঁশ হয় তাহলে তার ইহরাম শুদ্ধ হবে। বেহুঁশ হওয়ার কারণে তার ইহরামের কোন ক্ষতি হবে না। এমতাবস্থায় তার সফরসঙ্গীদের উচিত তাকে বহন করে নিয়ে যাওয়া, সে যেন সময়মত আরাফাতে অবস্থান করতে পারে।
হজ ও উমরা আবশ্যক হওয়ার শর্ত :
১. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া।
অপ্রাপ্ত বয়স্ক বাচ্চা-যদিও সে বুঝার মত বা ভালো-মন্দ পার্থক্য করার মত জ্ঞান রাখে- তার জন্য হজ-উমরা আবশ্যক নয়। কেননা তার জ্ঞান ও শক্তি এখনো পূর্ণতা পায়নি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلاَثَةٍ :- وَفِيهِ - وَعَنِ الصَّبِيِّ حَتَّى يَشِبَّ. وَفِى رِوَايَةِ: وَعَنِ الصَّبِىِّ حَتَّى يَحْتَلِمَ».
‘তিনজন থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে : (তন্মধ্যে) শিশু থেকে, যতক্ষণ না সে যৌবনে উপনীত হয়।’[5] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘এবং শিশু থেকে যতক্ষণ না সে বালেগ হয়।’[6]
তবে বাচ্চারা যদি হজ বা উমরা আদায় করে, তবে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে। ইবন আব্বাস রা. বলেন, ‘একজন মহিলা একটি শিশুকে উঁচু ধরে জানতে চাইল, ‘হে আল্লাহর রাসূল, এর জন্য কি হজ রয়েছে?’ তিনি বললেন,
«نَعَمْ ، وَلكِ أجْر».
‘হ্যাঁ, আর সওয়াব হবে তোমার।’[7]
প্রাপ্ত বয়স্কদের মতো শিশুও ইহরাম অবস্থায় নিষিদ্ধ সব বিষয় থেকে দূরে থাকবে। তবে তার ইচ্ছাকৃত ভুলগুলোকে অনিচ্ছাকৃত ভুল হিসেবে গণ্য করা হবে। ভুলের কারণে তার ওপর কিংবা তার অভিভাবকের ওপর ফিদ্য়া ওয়াজিব হবে না। এ-হজ তার জন্য নফল হবে। সামর্থবান হলে বালেগ হওয়ার পর তাকে ফরয হজ করতে হবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَيُّما صَبِيٍّ حَجَّ ثُمَّ بَلَغَ الْحِنْثَ فَعَلَيْهِ أَنْ يَحُجَّ حِجَّةٌ أُخْرَى».
‘কোন বাচ্চা যদি হজ করে, অতঃপর সে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়, তবে পরবর্তীকালে সামর্থবান হলে তাকে আরেকটি হজ করতে হবে।’[8]
অনেক ফিকহবিদ বলেন, ‘শিশু যদি বালেগ হওয়ার আগে ইহরাম বাঁধে এবং ইহরাম অবস্থায় বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে আরাফায় অবস্থান করে, তাহলে তার ফরয হজ আদায় হয়ে যাবে।’
২. সামর্থবান হওয়া।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ وَمَن كَفَرَ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ ٱلۡعَٰلَمِينَ ٩٧ ﴾ [ال عمران: ٩٧]
‘এবং সামর্থবান মানুষের ওপর আল্লাহর জন্য বাইতুল্লাহ্র হজ করা ফরয। আর যে কুফরী করে, তবে আল্লাহ তো নিশ্চয় সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী।’[9]
আপনার কোন ঋণ থেকে থাকলে হজ করার পূর্বেই তা পরিশোধ করে নিন। যাকাত, কাফফারা ও মানত ইত্যাদি পরিশোধ না করে থাকলে তাও আদায় করে নিন। কেননা এগুলো আল্লাহর ঋণ। মানুষের ঋণও পরিশোধ করে নিন। মনে রাখবেন, যাবতীয় ঋণ পরিশোধ ও হজের সফরকালীন সময়ে পরিবারের ব্যয় মেটানোর ব্যবস্থা করে হজের কার্যাদি সম্পন্ন করার মত অর্থ-কড়ি বা সামর্থ যদি আপনার থাকে তাহলে হজে যেতে আপনি আর্থিকভাবে সামর্থবান। আপনার ওপর হজ ফরয। তবে আপনি যদি এমন ধরনের বড় ব্যবসায়ী হন, বিভিন্ন প্রয়োজনে যার বড় ধরনের ঋণ করতেই হয়, তাহলে আপনার গোটা ঋণের ব্যাপারে একটা আলাদা অসিয়ত নামা তৈরি করুন। আপনার ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী যারা হবেন তাদেরকে এ বিষয়ে দায়িত্ব অর্পণ করে যান।
আপনি হালাল রিযিক উপার্জন করে হজে যাওয়ার মতো টাকা জোগাড় করার চেষ্টা করুন। কখনো হারাম টাকায় হজ করার পরিকল্পনা করবেন না। যদি এমন হয় যে, আপনার সমগ্র সম্পদই হারাম, তাহলে আপনি তওবা করুন। হারাম পথ বর্জন করে হালাল পথে সম্পদ উপার্জন শুরু করুন। আর কোনদিন হারাম পথে যাবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করুন।
আপনি যদি দৈহিকভাবে সুস্থ হোন। অর্থাৎ শারীরিক দুর্বলতা, বার্ধক্য বা দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে হজের সফর বা হজের রুকন আদায় করতে অক্ষম না হোন, তাহলে আপনি হজে যেতে শারীরিকভাবে সামর্থবান বিবেচিত হবেন।
আপনি যদি আর্থিক ও শারীরিকভাবে সামর্থবান হোন, তাহলে আপনার ওপর সশরীরে হজ করা ফরয। আর যদি আর্থিকভাবে সামর্থবান কিন্তু শারীরিকভাবে সামর্থবান না হোন, তাহলে আপনি প্রতিনিধি নির্ধারণ করবেন, যিনি আপনার পক্ষ থেকে হজ ও উমরা আদায় করবেন। ‘বদলী হজ’ অধ্যায়ে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা আসছে।
৩. হজের সফরে মহিলার সাথে মাহরাম পুরুষ থাকা।
ইমাম আবূ হানীফা ও ইমাম আহমদ রহ.-এর মতে সফরের দূরত্বে গিয়ে হজ করতে হলে মাহরাম সাথে থাকা শর্ত। যে মহিলার মাহরাম নেই তার ওপর হজ ফরয নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ تُسَافِرِ الْمَرْأَةُ إِلاَّ مَعَ ذِي مَحْرَمٍ ، وَلاَ يَدْخُلُ عَلَيْهَا رَجُلٌ إِلاَّ وَمَعَهَا مَحْرَمٌ فَقَالَ رَجُلٌ يَا رَسُولَ اللهِ إِنِّي أُرِيدُ أَنْ أَخْرُجَ فِي جَيْشِ كَذَا وَكَذَا وَامْرَأَتِي تُرِيدُ الْحَجَّ فَقَالَ اخْرُجْ مَعَهَا».
‘কোন মহিলা যেন মাহরাম ছাড়া সফর না করে আর কোন পুরুষ যেন কোন মহিলার সাথে মাহরাম থাকা ছাড়া তার কাছে না যায়।’এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি অমুক অমুক যুদ্ধে যাবার ইচ্ছা করেছি। এদিকে আমার স্ত্রী হজের ইচ্ছা করেছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি তোমার স্ত্রীর সাথে যাও।’[10]
ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لا تَحُجَّنَّ امْرَأةٌ إِلا وَمَعَهَا ذُوْ مَحْرَمٍ».
‘কোন মহিলা যেন মাহরাম ছাড়া কখনো হজ না করে।’[11]
মহিলার মাহরাম
যাদের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া স্থায়ীভাবে হারাম, তারাই শরীয়তের পরিভাষায় মাহরাম। মাহরাম কয়েক ধরনের হয়ে থাকে।
এক. বংশগত মাহরাম।
বংশগত মাহরাম মোট সাত প্রকার :
মহিলার পিতৃকূল : যেমন পিতা, দাদা, নানা, পর-দাদা, পর-নানা এবং তদুর্ধ পিতৃপুরুষ।
মহিলার ছেলে-সন্তান : যেমন পুত্র, পুত্রের পুত্র, কন্যার পুত্র ও তাদের অধস্তন পুরুষ।
মহিলার ভাই : সহোদর তথা আপন ভাই বা বৈপিত্রেয় ভাই অথবা বৈমাত্রেয় ভাই।
মহিলার চাচা : আপন চাচা বা বৈপিত্রেয় চাচা অথবা বৈমাত্রেয় চাচা। অথবা পিতা বা মাতার চাচা।
মহিলার মামা : আপন মামা বা বৈপিত্রেয় মামা অথবা বৈমাত্রেয় মামা। অথবা পিতা বা মাতার মামা।
মহিলার ভাইয়ের ছেলে : ভাইয়ের ছেলে, ভাইয়ের ছেলের ছেলে, ভাইয়ের ছেলের কন্যাদের ছেলে ও তাদের অধস্তন পুরুষ।
মহিলার বোনের ছেলে : বোনের ছেলে, বোনের ছেলের ছেলে, বোনের ছেলের কন্যাদের ছেলে ও তাদের অধস্তন পুরুষ।
দুই. দুগ্ধপানজনিত মাহরাম।
দুগ্ধপানজনিত মাহরামও বংশগত মাহরামের ন্যায় সাত প্রকার, যার বিবরণ ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে।
তিন. বৈবাহিক সম্পর্কজাত মাহরাম।
বৈবাহিক সম্পর্কজাত মাহরাম পাঁচ ধরনের :
- স্বামী।
- স্বামীর পুত্র, তার পুত্রের পুত্র, কন্যার পুত্র এবং তাদের অধস্তন পুরুষ।
- স্বামীর পিতা, দাদা, নানা এবং তদূর্ধ্ব পুরুষ।
- কন্যার স্বামী, পুত্রসন্তানের মেয়ের স্বামী, কন্যাসন্তানের মেয়ের স্বামী এবং তাদের অধস্তন কন্যাদের স্বামী।
- মায়ের স্বামী এবং দাদী বা নানীর স্বামী।
মাহরাম বিষয়ক শর্ত
মাহরাম পুরুষ অবশ্যই মুসলিম, বিবেকবান ও প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে। কেননা, মাহরাম সাথে নেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে হজের কার্যাদি সম্পাদনে মহিলার সার্বিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মাহরাম যদি অমুসলিম হয় অথবা ভালো-মন্দ বিচার-ক্ষমতা না রাখে অথবা বালক কিংবা শিশু হয় কিংবা পাগল হয়, তবে তার দ্বারা মহিলার সার্বিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না।
যদি কোন মহিলা মাহরাম ছাড়া হজ করে, তাহলে তা আদায় হবে বটে। কিন্তু মাহরাম ছাড়া সফরের কারণে সে গুনাহগার হবে। কেননা মহিলাদের সাথে মাহরাম থাকা হজ ফরয হওয়ার শর্ত। আদায় হওয়ার শর্ত নয়।
[2]. তাওবা : ৫৪।
[3]. বুখারী : ১/৩৬৯।
[4]. ইবন মাজাহ্ : ২৪০২।
[5]. তিরমিযী : ৩২৪১।
[6]. আবু দাউদ : ৩০৪৪।
[7]. মুসলিম : ২/৪৭৯।
[8]. আল-আওসাত : ২৫৭২; মাজমাউজ যাওয়ায়েদ : ৩/৬০২।
[9]. আলে ইমরান : ৯৭।
[10]. বুখারী : ১৮৬২।
[11]. দারা কুতনী : ২/৩০।
হজ ও উমরার ফযীলত সম্পর্কে অনেক হাদীস রয়েছে। নিম্নে তার কিছু উল্লেখ করা হল :
১. হজ অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল। আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন্ আমলটি সর্বোত্তম?
«فَقَالَ إِيمَانٌ بِاللهِ وَرَسُولِهِ قِيلَ ثُمَّ مَاذَا قَالَ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ قِيلَ ثُمَّ مَاذَا قَالَ حَجٌّ مَبْرُور».
তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান। বলা হল, ‘তারপর কী’? তিনি বললেন, ‘আললাহর পথে জিহাদ করা’। বলা হল ‘তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘কবুল হজ’।’[1] অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সর্বোত্তম আমল কী- এ ব্যাপারে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন। উত্তরে তিনি বললেন,
«الإِيمَانُ بِاللَّهِ وَحْدَهُ، ثُمَّ الْجِهَادُ، ثُمَّ حَجَّةٌ بَرَّةٌ تَفْضُلُ سَائِرَ الْعَمَلِ كَمَا بَيْنَ مَطْلِعِ الشَّمْسِ إِلَى مَغْرِبِهَا».
‘এক আল্লাহর প্রতি ঈমান; অতঃপর মাবরূর হজ, যা সকল আমল থেকে শ্রেষ্ঠ; সূর্য উদয় ও অস্তের মধ্যে যে পার্থক্য ঠিক তারই মত (অন্যান্য আমলের সাথে তার শ্রেষ্ঠত্বের পার্থক্য)।’[2]
২. পাপমুক্ত হজের প্রতিদান জান্নাত। আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَالْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ».
‘আর মাবরূর হজের প্রতিদান জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়’[3]
৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজকে জিহাদ হিসেবে গণ্য করেছেন। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল, জিহাদকে তো সর্বোত্তম আমল হিসেবে মনে করা হয়, আমরা কি জিহাদ করবো না? তিনি বললেন,
«لَكُنَّ أَفْضَلَ الْجِهَادِ حَجٌّ مَبْرُورٌ».
‘তোমাদের জন্য সর্বোত্তম জিহাদ হচ্ছে মাবরূর হজ।’[4] অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আয়েশা রা. বললেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমরা কি আপনাদের সাথে জিহাদে ও অভিযানে যাব না’? তিনি বললেন,
«لَكُنَّ أَحْسَنُ الْجِهَادِ وَأَجْمَلُهُ الْحَجُّ حَجٌّ مَبْرُورٌ».
‘তোমাদের জন্য উত্তম ও সুন্দরতম জিহাদ হল ‘হজ’- মাবরূর হজ।’[5] আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«جِهَادُ الْكَبِيرِ ، وَالصَّغِيرِ ، وَالضَّعِيفِ ، وَالْمَرْأَةِ : الْحَجُّ ، وَالْعُمْرَةُ».
‘বয়োবৃদ্ধ, অপ্রাপ্ত বয়স্ক, দুর্বল ও মহিলার জিহাদ হচ্ছে হজ ও উমরা।’[6]
৪. হজ পাপ মোচন করে। আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ حَجَّ لِلَّهِ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَيَوْمِ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ».
‘যে আল্লাহর জন্য হজ করল, যৌন-স্পর্শ রয়েছে এমন কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকল এবং শরীয়ত অনুমতি দেয় না এমন কাজ থেকে বিরত থাকল, সে তার মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনের মতো পবিত্র হয়ে ফিরে এল।’[7]
এ হাদীসের অর্থ আমর ইবনুল আস রা. থেকে বর্ণিত হাদীস দ্বারা আরো সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেন ,
«أَمَا عَلِمْتَ أَنَّ الإِسْلاَمَ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ وَأَنَّ الْهِجْرَةَ تَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهَا وَأَنَّ الْحَجَّ يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ».
‘তুমি কি জান না, ‘কারো ইসলাম গ্রহণ তার পূর্বের সকল গুনাহ বিলুপ্ত করে দেয়, হিজরত তার পূর্বের সকল গুনাহ বিলুপ্ত করে দেয় এবং হজ তার পূর্বের সকল গুনাহ বিলুপ্ত করে দেয়?’[8]
৫. হজের ন্যায় উমরাও পাপ মোচন করে। আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ أَتَى هَذَا الْبَيْتَ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ كَمَا وَلَدَتْهُ أُمُّهُ».
‘যে ব্যক্তি এই ঘরে এলো, অতঃপর যৌন-স্পর্শ রয়েছে এমন কাজ ও কথা থেকে বিরত থাকল এবং শরীয়ত বহির্ভুত কাজ থেকে বিরত থাকল, সে মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনের মত (নিষ্পাপ) হয়ে ফিরে গেল।’ ইমাম ইবন হাজার আসকালানীর মতানুসারে এখানে হজকারী ও উমরাকারী উভয় ব্যক্তিকেই বুঝানো হয়েছে।[9]
৬. হজ ও উমরা পাপ মোচনের পাশাপাশি হজকারী ও উমরাকারির অভাবও দূর করে দেয়। আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা. কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«تَابِعُوا بَيْنَ الْحَجِّ وَالْعُمْرَةِ، فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الْفَقْرَ وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِي الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ، وَالذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ».
‘তোমরা হজ ও উমরা পরপর করতে থাক, কেননা তা অভাব ও গুনাহ দূর করে দেয়, যেমন দূর করে দেয় কামারের হাপর লোহা, সোনা ও রুপার ময়লাকে।’[10]
৭. হজ ও উমরা পালনকারিগণ আল্লাহর মেহমান বা প্রতিনিধি। ইবন উমর রা. কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الْغَازِي فِي سَبِيلِ اللهِ ، وَالْحَاجُّ وَالْمُعْتَمِرُ ، وَفْدُ اللهِ ، دَعَاهُمْ ، فَأَجَابُوهُ ، وَسَأَلُوهُ ، فَأَعْطَاهُمْ».
‘আল্লাহর পথে যুদ্ধে বিজয়ী, হজকারী ও উমরাকারী আল্লাহর মেহমান বা প্রতিনিধি। আল্লাহ তাদেরকে আহবান করেছেন, তারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। আর তারা তাঁর কাছে চেয়েছেন এবং তিনি তাদেরকে দিয়েছেন।’[11] অন্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الْحُجَّاجُ وَالْعُمَّارُ ، وَفْدُ اللهِ إِنْ دَعَوْهُ أَجَابَهُمْ ، وَإِنِ اسْتَغْفَرُوهُ غَفَرَ لَهُمْ».
‘হজ ও উমরা পালনকারিগণ আল্লাহর মেহমান বা প্রতিনিধি। তারা আল্লাহকে ডাকলে তিনি তাদের ডাকে সাড়া দেন। তারা তাঁর কাছে মাগফিরাত কামনা করলে তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন।’[12]
৮. এক উমরা থেকে আরেক উমরা- মধ্যবর্তী গুনাহ ও পাপের কাফ্ফারা। আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا».
‘এক উমরা থেকে অন্য উমরা- এ দুয়ের মাঝে যা কিছু (পাপ) ঘটবে তা তার জন্য কাফফারা।’[13]
৯. হজের করার নিয়তে বের হয়ে মারা গেলেও হজের সওয়াব পেতে থাকবে। আবূ হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ خَرَجَ حَاجًّا فَمَاتَ كُتِبَ لَهُ أَجْرُ الْحَاجِّ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ خَرَجَ مُعْتَمِرًا فَمَاتَ كُتِبَ لَهُ أَجْرُ الْمُعْتَمِرِ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ».
‘যে ব্যক্তি হজের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে; অতপর সে মারা গেছে, তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত হজের নেকী লেখা হতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি উমরার উদ্দেশে বের হয়ে মারা যাবে, তার জন্য কিয়ামত পর্যন্ত উমরার নেকী লেখা হতে থাকবে।’[14]
১০. আল্লাহ তা‘আলা রমযান মাসে উমরা আদায়কে অনেক মর্যাদাশীল করেছেন, তিনি একে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হজ করার সমতুল্য সওয়াবে ভূষিত করেছেন। ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«فَإِنَّ عُمْرَةً فِي رَمَضَانَ تَقْضِي حَجَّةً أَوْ حَجَّةً مَعِي».
‘নিশ্চয় রমযানে উমরা করা হজ করার সমতুল্য অথবা তিনি বলেছেন, আমার সাথে হজ করার সমতুল্য।’[15]
১১. বাইতুল্লাহর উদ্দেশ্যে বের হলে প্রতি কদমে নেকী লেখা হয় ও গুনাহ মাফ করা হয় এবং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। আবদুল্লাহ ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَمَّا خُرُوجُكَ مِنْ بَيْتِكَ تَؤُمُّ الْبَيْتَ فَإِنَّ لَكَ بِكُلِّ وَطْأَةٍ تَطَأُهَا رَاحِلَتُكَ يَكْتُبُ اللَّهُ لَكَ بِهَا حَسَنَةً وَيَمْحُو عَنْكَ بِهَا سَيِّئَةً».
‘তুমি যখন বাইতুল্লাহ্র উদ্দেশ্যে আপন ঘর থেকে বের হবে, তোমার বাহনের প্রত্যেকবার মাটিতে পা রাখা এবং পা তোলার বিনিময়ে তোমার জন্য একটি করে নেকী লেখা হবে এবং তোমার গুনাহ মাফ করা হবে।’[16]
আনাস ইবন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«فَإِنَّكَ إِذَا خَرَجْتَ مِنْ بَيْتِكَ تَؤُمُّ الْبَيْتَ الْحَرَامِ ، لا تَضَعُ نَاقَتُكَ خُفًّا وَلا تَرْفَعُهُ إِلَّا كَتَبَ اللَّهُ لَكَ بِهِ حَسَنَةً ، وَحَطَّ عَنْكَ بِهِ خَطِيئَةً ، وَرَفَعَكَ دَرَجَةً»
‘কারণ যখন তুমি বাইতুল্লাহ্র উদ্দেশ্যে আপন ঘর থেকে বের হবে, তোমার উটনীর প্রত্যেকবার পায়ের ক্ষুর রাখা এবং ক্ষুর তোলার সাথে সাথে তোমার জন্য একটি করে নেকী লেখা হবে, তোমার একটি করে গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হবে এবং তোমার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে।’[17]
স্মরণ রাখা দরকার, যে কেবল আল্লাহকে রাজী করার জন্য আমল করবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সুন্নাহ মুতাবিক হজ-উমরা সম্পন্ন করবে, সেই এসব ফযীলত অর্জন করবে। যেকোনো আমল আল্লাহর কাছে কবুল হওয়ার জন্য দুটি শর্ত রয়েছে, যা অবশ্যই পূরণ করতে হবে।
প্রথম শর্ত : একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন ,
«إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى»
‘সকল কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। প্রত্যেকে তাই পাবে, যা সে নিয়ত করবে।’[18]
দ্বিতীয় শর্ত : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ মোতাবেক হওয়া। কারণ, তিনি বলেছেন,
«مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهْوَ رَدٌّ».
‘যে এমন আমল করল, যাতে আমাদের অনুমোদন নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।’[19]
অতএব, যার আমল কেবল আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর সুন্নাহ মুতাবিক হবে তার আমলই আল্লাহর নিকট কবুল হবে। পক্ষান্তরে যার আমলে উভয় শর্ত অথবা এর যেকোনো একটি অনুপস্থিত থাকবে, তার আমল প্রত্যাখ্যাত হবে। তাদের আমল সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
﴿ وَقَدِمۡنَآ إِلَىٰ مَا عَمِلُواْ مِنۡ عَمَلٖ فَجَعَلۡنَٰهُ هَبَآءٗ مَّنثُورًا ٢٣ ﴾ [الفرقان: ٢٢]
‘আর তারা যে কাজ করেছে আমি সেদিকে অগ্রসর হব। অতঃপর তাকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণায় পরিণত করে দেব।’[20]
পক্ষান্তরে যার আমলে উভয় শর্ত পূরণ হবে, তার আমল সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
﴿ وَمَنۡ أَحۡسَنُ قَوۡلٗا مِّمَّن دَعَآ إِلَى ٱللَّهِ وَعَمِلَ صَٰلِحٗا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ ٱلۡمُسۡلِمِينَ ٣٣ ﴾ [فصلت: ٣٣]
‘আর দীনের ব্যাপারে তার তুলনায় কে উত্তম, যে সৎকর্মপরায়ণ অবস্থায় আল্লাহর কাছে নিজকে পূর্ণ সমর্পণ করল।’[21] আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ بَلَىٰۚ مَنۡ أَسۡلَمَ وَجۡهَهُۥ لِلَّهِ وَهُوَ مُحۡسِنٞ فَلَهُۥٓ أَجۡرُهُۥ عِندَ رَبِّهِۦ وَلَا خَوۡفٌ عَلَيۡهِمۡ وَلَا هُمۡ يَحۡزَنُونَ ١١٢ ﴾ [البقرة: ١١٢]
‘হ্যাঁ, যে নিজকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করেছে এবং সে সৎকর্মশীলও, তবে তার জন্য রয়েছে তার রবের নিকট প্রতিদান। আর তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’[22]
সুতরাং উমর রা. বর্ণিত, ‘সকল কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল’ হাদীসটি অন্তরের আমলসমূহের মানদণ্ড এবং আয়েশা রা. বর্ণিত ‘যে এমন আমল করল, যাতে আমার অনুমোদন নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’ হাদীসটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলসমূহের মানদণ্ড। হাদীস দু’টি ব্যাপক অর্থবোধক। দীনের মূল বিষয়াদি ও শাখা-প্রশাখাসমূহ এবং অন্তর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলের কোনটিই এর বাইরে নয়। এক কথায় সম্পূর্ণ দীন এর আওতাভুক্ত।
[2]. আহমদ : ৪/৩৪২।
[3]. বুখারী : ৩৭৭১; মুসলিম : ৯৪৩১।
[4]. বুখারী : ৪৮৭২।
[5]. ফাতহুল বারী : ৪/১৮৬১।
[6]. নাসাঈ : ২/৫৫৭।
[7]. বুখারী : ১৫২১; মুসলিম : ১৩৫০।
[8]. মুসলিম : ১২১।
[9]. ফাতহুল বারী : ৩/৩৮২।
[10]. তিরমিযী : ৮১০।
[11]. ইবন মাজাহ্ : ২৮৯৩; ইবন হিব্বান : ৩৪০০; মুসনাদে আহমদ : ১৪৮৯।
[12]. ইবন মাজাহ্ : ২৮৮৩ ।
[13]. বুখারী : ১৭৭৩; মুসলিম : ১৩৯৪।
[14]. সহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব : ১১১৪।
[15]. বুখারী : ১৮৬৩; মুসলিম : ১২৫৬।
[16]. তাবরানী, মু‘জামুল কাবীর : ১১/৫৫।
[17]. সহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব : ১১১২।
[18]. বুখারী : ১/৯; মুসলিম : ৩/১৫১৫।
[19]. মুসলিম : ৩/৩৪৪।
[20]. ফুরকান : ২৩।
[21]. নিসা : ১২৫।
[22]. বাকারা : ১১২।