কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী ফিকাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আত্তুওয়াইজিরী ১৪ টি
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী ফিকাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আত্তুওয়াইজিরী ১৪ টি

নিশ্চয় সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যই। আমরা তারই প্রশংসা করি, তারই নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমাদের প্রবৃত্তির অনীষ্ট ও মন্দ কার্যাদি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করি। আল্লাহ যাকে হেদায়েত দান করেন তার ভ্রষ্টকারী কেউ নেই আর তিনি যাকে ভ্রষ্ট করেন তার হেদায়েতকারী কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য ইলাহ নেই। যিনি একক, তাঁর কোন শরিক নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রসূল।

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ حَقَّ تُقٰتِهٖ وَ لَا تَمُوۡتُنَّ اِلَّا وَ اَنۡتُمۡ مُّسۡلِمُوۡنَ ﴿۱۰۲﴾

হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে যেমন ভয় করা উচিত ঠিক তেমনিভাবে ভয় করতে থাক। আর অবশ্যই মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।’’ [সূরা আল-ইমরান:১০২]

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اتَّقُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ مِّنۡ نَّفۡسٍ وَّاحِدَۃٍ وَّ خَلَقَ مِنۡهَا زَوۡجَهَا وَ بَثَّ مِنۡهُمَا رِجَالًا کَثِیۡرًا وَّ نِسَآءً ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ الَّذِیۡ تَسَآءَلُوۡنَ بِهٖ وَ الۡاَرۡحَامَ ؕ اِنَّ اللّٰهَ کَانَ عَلَیۡکُمۡ رَقِیۡبًا ﴿۱﴾

‘‘হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন, আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। আর আল্লাহকে ভয় কর, যাঁর নামে তোমরা একে অপরের নিকট চেয়ে থাক এবং আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ব্যাপারে সচেতন রয়েছেন।’’ [সূরা নিসা:১]

 

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ قُوۡلُوۡا قَوۡلًا سَدِیۡدًا ﴿ۙ۷۰﴾ یُّصۡلِحۡ لَکُمۡ اَعۡمَالَکُمۡ وَ یَغۡفِرۡ لَکُمۡ ذُنُوۡبَکُمۡ ؕ وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ فَقَدۡ فَازَ فَوۡزًا عَظِیۡمًا ﴿۷۱﴾


‘‘হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল। তিনি তোমাদের আমল-আচরণ সংশোধন করবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করবেন। যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করে, সে অবশ্যই মহাসাফল্য অর্জন করবে।’’ [সূরা আহজাব:৭০-৭১]


অতঃপর সর্বোত্তম হাদীস (বাণী) হলো আল্লাহর কিতাব এবং কল্যাণময় হেদায়েত হলো মুহাম্মদ (সা.)-এর হেদায়েত। আর সবচেয়ে অনীষ্টকর বিষয় হলো (ধর্মের নামে) নব আবিস্কৃত জিনিস এবং প্রতিটি নব আবিস্কৃত জিনিসই হলো বিদ‘আত। আর প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা এবং প্রতিটি ভ্রষ্টতার পরিনাম জাহান্নাম।

সম্মানিত মুসলিম ভাই!

নিঃসন্দেহে দ্বীনের ফিকাহ তথা সঠিক সূক্ষ বুঝ এক উত্তম, পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ জ্ঞান। ইহা আল্লাহর নামসমূহ, গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য, তাঁর কার্যাদি এবং দ্বীন ও শরীয়তকে জানা। এ ছাড়া তাঁর নবী-রসূলগণ (আ:) কে জানা এবং ঈমান-আকীদায়, কথা-কাজে এবং চলাফেরা ও চরিত্রে সে মোতাবেক আমল করা। নিঃসন্দেহে জ্ঞানের চূড়ান্ত হলো আল্লাহর তাওহীদকে জানা এবং আমলের চূড়ান্ত হচ্ছে আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালন করা। আর ইহাই হলো আল্লাহর সবকিছু সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং তাঁর শরিয়তের সমস্ত কল্যাণের সমন্বয়কারী।
 

মু‘আবিয়া (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী (সা.) বলেছেনঃ

‘‘আল্লাহ যে ব্যক্তির কল্যাণ চান তাকে দ্বীনের ফিকাহ তথা সঠিক সূক্ষ্ণ বুঝ দান করেন।’’[1]

এ কথা সন্দেহাতিত, যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ তা‘য়ার প্রতি ঈমান আনবে ও তাঁর মহাবাণী আল-কুরআনের আনুগত্য করবে এবং তাঁর গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ পালন করবে, সেই তাঁর বিরাট সওয়াব অর্জন করবে। এ ছাড়া আরো সত্য কথা হলো, যে ব্যক্তি দুনিয়ার জ্ঞানের জান্নাতে প্রবেশ করবে সেই আখেরাতের সজ্জিত জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর আল্লাহ তা‘য়ালা তার প্রতি সন্তুষ্টি হবেন এবং তাকে সন্তুষ্টি করাবেন যেমন সে আল্লাহকে তাঁর আনুগত্যের দ্বারা রাজি করিয়েছে।

আর যে তার প্রতিপালকের প্রিয় জিনিসসমূহ পূর্ণ করে আল্লাহ তার পছন্দ জিনিসসমূহ আখেরাতে পূর্ণ করবেন। আর যে তার নফসকে অজ্ঞতা এবং প্রবৃত্তির কারাগারে বন্দী করবে আল্লাহ তা‘য়ালা তাকে কিয়ামতে জাহান্নামের কারাগারে বন্দী করবেন। এ ছাড়া সে যেভাবে আল্লাহ তা‘য়ালার নাফরমানি করে তাঁকে নারাজ করিয়েছে অনুরূপ তিনিও তার প্রতি নারাজ হবেন।


(বইটি লিখার কারণ)

একজন মু‘মিন অপর মু‘মিনের জন্য একটি দালান ঘরের মত, যার একটি অংশ অপর অংশকে মজবুত করে। বর্তমানে শিরক ও অজ্ঞতার কালো অন্ধকার সুপ্রসারিত এবং সাধারণ মানুষের মাঝে বিদ‘আত ও নাফরমানির ছড়াছড়ি। আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত, সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজের নিষেধের দায়িত্ব পালনার্থে এবং নিজেকে ও ভাইদেরকে স্মরণ করার নিমিত্বে এ কাজের অবতরণা।


 (কিতাবটি লিখার উদ্দেশ্য)

আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে এই কিতাবের দ্বারা জ্ঞান পিপাসুদের দ্বীনের ফিকাহ শিখানো, অজ্ঞদের জ্ঞান দান করা, গাফেল তথা উদাসীনদের স্মরণ করিয়ে দেয়া, পাপীদের তওবার সুযোগ করে দেয়া, পথভ্রষ্টদের হেদায়েত পাওয়া ও নিষ্ঠুরদের অন্তরে পরশের সুযোগ করে দেয়াই একমাত্র উদ্দেশ্য।

ইহা উল্লেখিত কারণসমূহের জন্য দায়িত্ব মনে করে এবং আমার প্রতি আল্লাহর নেয়ামতসমূহের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ মাত্র। এ ছাড়া আমার ভাইদের সাথে দ্বীনের প্রচার ও প্রসার এবং দা‘ওয়াদের কাজে শরিক হওয়া একান্ত জরুরি মনে করেছি।  

আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর অনুকম্পা, অনুগ্রহ, তওফিক ও সাহায্যের দ্বারা এ কিতাবটি লিখা আমার জন্য সহজ করে দিয়েছেন। এ কিতাবটি প্রস্ত্তত ও বিন্যাস বিভিন্ন ধরনের নির্ভরযোগ্য ইসলামী কিতাব হতে নেয়া হয়েছে। এতে তাওহীদ, ঈমান, আদব-আখলাক, জিকির-আজকার, দোয়া ও প্রয়োজনীয় আহকাম ----- ইত্যাদি বিষয় জমা করা হয়েছে।

আল্লাহর বিশেষ মেহেরবাণী ও অনুকম্পায় কিতাবটিতে কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীস সমন্বিত এক সমাহার ঘটেছে। আর ‘‘ফুরু‘ঈ মাসায়েল’’ তথা দ্বীনের মৌলিক বিষয় ছাড়া শাখা-প্রশাখার ফিকাহ বিষয়ে শুধুমাত্র একটি মত উল্লেখ করেছি।  আল্লাহর নিকট আশা পোষণ করি যে, ইহাই সঠিক মত। যার ফলে হক তথা সঠিক দ্বীন অনুসন্ধানীরা বিশেষ করে নবীণ জ্ঞান পিপাসুরা অতি সহজে তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারে।

কিতাবটি অতি সংক্ষিপ্ত ও সহজভাবে পেশ করা হয়েছে, যাতে করে উলামাগণ ও নবীণরা অল্প সময়ে এবং কষ্ট ছাড়াই উপকৃত হতে পারেন। কিতাবটি একমাত্র আল্লাহর ফজল ও করমে এক জ্ঞান ভান্ডারে পরিণত হয়েছে, যা বহন করতে হালকা ও আকারে মধ্যম।

কিতাবটি থেকে ইবাদতকারী তার ইবাদতে, বক্তা তার ওয়াজ-নসিহতে, মুফতী সাহেব তার ফতোয়া দানে, শিক্ষক তার শিক্ষকতায়, কাজি তথা বিচারক তার বিচার-আচারে, ব্যবসায়ী তার লেনদেনে, দ্বীনের আহবানকারী তার দা‘ওয়াতে ও সাধারণ মুসলিম তার প্রতিটি অবস্থাতে উপকৃত হবেন।

কিতাবটির সাধারণ মূলনীতিমালাগুলো এবং ফুরু‘ঈ তথা শাখা-প্রশাখার মাসায়েলসমূহ ফিকাহ শাস্ত্রের ছোট-বড় নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন কিতাবসমূহ থেকে গ্রহণ করেছি। এর পাশাপাশি অতীত ও বর্তমানের উচ্চ পর্যায়ের উলামাগণের ফতোয়াসমূহ থেকেও গ্রহণ করেছি। আর মহামতি চতুষ্টদয় ইমামগণ: ইমান আবু হানীফা রহ: (মৃত: ১৫০ হি:), ইমাম মালেক রহ: (মৃত:১৭৯ হি:), ইমাম শাফে‘য়ী রহ: (মৃত:২০৪ হি:) ও ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বাল রহ: (মৃত:২৪১ হি:) ও অন্যান্য ইমামগণের কুরআন ও সহীহ হাদীসের শক্তিশালী দলিলের ভিত্তিতে সঠিক মতের উপর নির্ভর করেছি।

কিতাবটির তাওহীদ, ঈমান ও আহকাম ইত্যাদির অধ্যায়সমূহে চেষ্টা করেছি যেন, প্রতিটি মাসলা-মাসায়েল কুরআন ও সহীহ হাদীসের উভয়টি অথবা কোন একটির ভিত্তিতে হয়। আর যে সকল বিষয়ে কুরআন ও সহীহ হাদীস থেকে সুস্পষ্ট কোন সহীহ দলিল উল্লেখ হয়নি সে ব্যাপারে অতীত-বর্তমানের মুজতাহেদ[2] উলামাগণের বাণী ও নির্ভরযোগ্য মতের উপর নির্ভর করেছি।

তাওহীদ, ঈমান, জ্ঞানার্জন, ফাজায়েল, চরিত্র, ইসলামী আদব, জিকির-আজকার ও দোয়ার অধ্যায়গুলোতে শরিয়তের সহীহ দলিলসমূহের সমাহার ঘটিয়েছি; কারণ এগুলো প্রতিটি মুসলিমের বিশেষ প্রয়োজন।

আর ফুরু‘য়ী (শাখা-প্রশাখার) ফিক্হের অধ্যায়গুলোতে শুধুমাত্র হুকুম বর্ণনা করেছি, সেখানে দলিল ও কারণ বর্ণনা করা হয়নি; কেননা এর ফলে কিতবের কলেবর ও মাসায়েলের শাখা-প্রশাখা বেড়ে যাবে। এ ছাড়া যে উদ্দেশ্যে কিতাবটি লিখা হয়েছে তার পরিপন্থী হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি শরিয়তের দলিলসমূহ বিস্তারিত জানতে ইচ্ছুক তিনি যেন, বড় বড় ফিকাহর মূল কিতাবসমূহে তালাশ করেন। যেমন: মুগনী, মাজমু‘য়া ফতোয়া, উম, মাবসূত, মুদাওয়ানাহ ইত্যাদি ফিকাহ ও হাদীস গ্রন্থসমূহ।

আর যে ব্যক্তি অন্তরের আমলসমূহের কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বিস্তারিতভাবে জানতে ইচ্ছুক সে যেন আমাদের লেখা সুপরিসর গ্রন্থ ‘‘মাওসূ‘য়া ফিকহিল কুলূব’’ (৫ খন্ডে) অধ্যায়ন করেন। এ ছাড়া যে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তাওহীদ, ঈমান এবং শরিয়তের বিধানসমূহের বিস্তারিত জ্ঞানার্জন করতে চান তিনি যেন আমাদের লেখা কিতাব ‘‘মাওসূ‘য়াতুল ফিকহিল ইসলামী’’ ৫ খন্ডে পড়েন।

কখনো আবার শাখা-প্রশাখার মাসায়েলের দলিল উল্লেখ করেছি; মাসয়ালাটির বিশেষ গুরুত্বের জন্য অথবা তা বেশি বেশি সংঘটিত হয় বলে কিংবা উৎসাহ প্রদানের উদ্দেশ্যে বা তা থেকে ভয়-ভীতি প্রদর্শনের  জন্যে।

কিতাবটির ইলমী তথা জ্ঞানতাত্ত্বিক বিষয়বস্ত্ত দু’টি মহান মূলের উপর নির্ভরশীল। তা হলো উম্মতের সালাফে সালেহীনগণের বুঝে কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীসসমূহ। প্রতিটি আয়াতের নম্বরসহ সূরার নাম গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করতে সচেষ্ট হয়েছি। আর নবী (সা.)-এর হাদীসসমূহ হতে শুধুমাত্র সহীহ হাদীস[3] অথবা হাসান হাদীস[4] উল্লেখ করেছি। সাথে সাথে প্রতিটি হাদীসের মূল হাদীস গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছি। এ ছাড়া প্রতিটি হাদীস সহীহ কিংবা হাসান তার হুকুম সহকারে নিম্নে বর্ণিত পন্থা অবলম্বন করেছি:

এ কিতাবে উল্লেখিত সমস্ত হাদীসগুলো হারাকাতসহ (স্বরবর্ণ ও স্বরধ্বনি যুক্তসহ) মূল হাদীসের কিতাবসমূহ থেকে নেয়া হয়েছে।

হাদীস যদি সহীহাইন (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)-এর কিংবা কোন একটির হয়, তাহলে প্রতিটির হাদীস নম্বরসহ উল্লেখ করেছি। আবার কখনো বিশেষ উপকার বা শব্দ বেশি হওয়ার কারণে একটির সাথে হাদীসের অন্য কোন কিতাবের নামও উল্লেখ করেছি।

যদি হাদীস সহীহাইনের বাইরের হয় যেমন: মুসনাদে আহমাদ, চারটি সুনান গ্রন্থ, (সুনানে নাসাঈ, সুনানে আবু দাঊদ, সুনানে তিরমিযী ও সুনানে ইবনে মাজাহ) ও সুনানে দারেমী ইত্যাদি হাদীসের কিতাবসমূহ, তাহলে দু’টি কিতাবের নাম উল্লেখ করেছি। আবার কখনো এর কম-বেশিও হয়েছে। এর সাথে হাদীসের আসল কিতাবের হাদীস নম্বর উল্লেখ করেছি।

হাদীসের তাখরীজে তথা রেফারেন্স বর্ণনায় মূল কিতাবের হাদীস নম্বরের উপর নির্ভর করেছি। আর আসল কিতাবে কোন নম্বর না থাকলে খন্ড ও পৃষ্ঠা নং উল্লেখ করেছি।

যদি হাদীস সহীহাইনের বাইরের হয়, তাহলে হাদীস তাখরীজ তথা রেফারেন্স উল্লেখের সময় প্রতিটি হাদীসের সহীহ বা হাসান হুকুমসহ তার সামনে (হাদীসটি সহীহ কিংবা হাসান) লিখেছি। আর এ ব্যাপারে পূর্বের ও পরের অভিজ্ঞ ইমামগণের মতামতের উপর নির্ভর করেছি।

যদি কোন হাদীস অন্যত্র দ্বিতীয়বার উল্লেখ হয় তাহলে অনেক ক্ষেত্রে আবারও তার তাখরীজ (রেফারেন্স উল্লেখ) করা হয়েছে। আর কখনো কোন হুকুম বর্ণনা বা তারগীব তথা উৎসাহ প্রদান অথবা তারহীব তথা ভয়প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তার সাথে কোন সহীহ হাদীস বা হাদীসের কোন অংশা সংযুক্ত ক’রে দিয়েছি।

আমাদের সামনে এ কিতাবটি ইসলামের আকীদা-বিশ্বাস, হুকুম-আহকাম, আদব-আখলাক সম্পর্কে সাধারণ পরিচিতি মাত্র। এতে বিক্ষিপ্ত বিষয়গুলো একত্রিত করেছি এবং তার অধ্যায়, মাসায়েল ও দলিলসমূহ একটি অপটির সাথে সুন্দর করে সঙ্কলন করেছি।

এ কিতাবটির নাম রেখেছি ‘‘মুখতাসার আল-ফিকহ্ আল-ইসলামী ফী যাওয়িল কুরআনি ওয়াস্সুন্নাহ’’ (কুরআন ও সুন্নাহ-এর আলোকে সংক্ষিপ্ত ইসলামী ফিকাহ্)। এর প্রথমভাগে উল্লেখ হয়েছে তাওহীদ ও ঈমান ও মধ্যম ভাগে বিভিন্ন সুন্নত ও হুকুম-আহকাম আর শেষভাগে দা‘ওয়াত ইলাল্লাহ তথা আল্লাহর দিকে মানুষকে দা‘ওয়াত।

কিতাবটি ১০টি পর্বে নিম্নে বর্ণিত পদ্ধতিতে সুবিন্যাস্ত করেছি:

  • প্রথম পর্ব: তাওহীদ ও ঈমান।
  • দ্বিতীয় পর্ব: ফাজায়েল, আদব-আখলাক, জিকির-আজকার ও  দোয়াসমূহে কুরআন-সুন্নাহর ফিকাহ্।
  • তৃতীয় পর্ব: ইবাদত সংক্রান্ত।
  • চতুর্থ পর্ব: লেনদেন ও আদান-প্রদান সম্পর্কে।
  • পঞ্চম পর্ব: বিবাহ ও তৎ সংশ্লীষ্ট বিষয়াদি।
  • ষষ্ঠ পর্ব: কিতাবুল ফারায়েজ তথা সম্পত্তির উত্তরাধিকার বণ্টন নীতিমালা।
  • সপ্তম পর্ব: শাস্তি ও দন্ডবিধি।
  • অষ্টম পর্ব: ফয়সালা তথা বিচার-আচারের নীতিমালা।
  • নবম পর্ব: জিহাদের আহকাম।
  • দশম পর্ব: আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াতের আহকাম।

এ কিতাবটির উদ্দেশ্য হলো প্রতিপালক মহান উপাস্য আল্লাহ তা‘য়ালাকে জানা এবং দ্বীনের আহকামের বর্ণনা করা। আর সারা বিশ্বের জনগণের জীবনের প্রতিটি বিভাগে আল্লাহর নির্দেশাবলির জীবিতকরণ। এ ছাড়া মানুষকে সীরাতে মুস্তাতীম আঁকড়িয়ে ধরার প্রতি উৎসাহিত করা।

আর আল্লাহর অনুগ্রহে এ প্রশস্ত ফিকাহর পাত্রটি প্রস্ত্তত হয়েছে যা থেকে নেওয়া খুবই সহজ; কারণ এর ফলের থোকাগুলো অতি নিকটে এবং শব্দসমূহ সুন্দর, পর্যাপ্ত অর্থবহ ও বাক্যসমূহ সংক্ষিপ্ত।

ইহা কোন প্রকার কষ্ট, বিরক্তি ও ক্লান্তি ছাড়াই তার তালাশকারীর প্রয়োজন পূর্ণ এবং উদ্দেশ্যে পৌঁছতে সাহায্য করবে।

ইহা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যের দিকে অন্তরসমূকে নড়াদানকারী, বিস্ময়কর উপকারিতার সমাহার, পাঠক ও শ্রোতার জন্য আরামদায়ক এবং নীরব সঙ্কল্পকে জান্নাতের উদ্যানসমূহেরপানে উদ্দীপক।

ইহা ঈমানদার অন্তরসমূহের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে, ফেটে যাওয়া ঘা'গুলোর চিকিৎসা করে, ব্যথার জ্বালা-যন্ত্রণাকে আরাম দেয়, সকল প্রকার বিদ‘আত ও অজ্ঞতাকে বিতাড়িত করে এবং প্রত্যেক প্রতাপশালী, মুনাফেক ও অবাধ্যদেরকে দমন করে।

আমি একত্রিত ও প্রস্ত্তত করেছি যাতে করে ইহা আল্লাহর মখলুকাত সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের উপায়, বাড়িতে অবস্থানকারীর জন্য সঙ্গী এবং মুসাফিরের জন্য পাথেয়, নিঃসঙ্গতার পরম বন্ধু, পরিবারের জন্য উদ্যান এবং উম্মতের জন্য ভোজসভা স্বরূপ হয়। আর আল্লাহর ফজল ও করমে কুরআন ও সুন্না্হ, বর্ণিত ও যুক্তিসঙ্গত এবং উৎসাহ ও ভয় প্রদর্শনের মাঝে জমাকারী এ মেঘ মালার সমারোহ ঘটেছে।

এর পাঠকারী দাওহীদ ও শরিয়তের গগনে সাঁতার কাটবে, সত্য, সুন্নাহ ও মর্যদাকে নির্ধারন করবে এবং শিরক, বিদ‘আত ও নিকৃষ্টকে ধ্বংস করবে।

আল্লাহর নিকট আকুল আবেদন এই যে, একে তাওহীদপন্থীদের জন্য চক্ষু শীতলকারী, ইবাদতকারীদের জন্য প্রদীপ, দ্বীনের আহবানকারী ও শিক্ষক মন্ডলীদের জন্য পাথেয়, তওবাকারীদের জন্য আলোকস্তম্ভ এবং পথচারীদের জন্য জ্যোতি বানিয়ে দেন।


প্রিয় মুসলিম ভাই!

আপনার জন্য এই পুস্পে পল্লবীত উদ্যান, যার ফল পেকে গেছে ও গাছসমূহ তার শীতল ছায়া দেয়া শুরু করেছে। এ কিতাবটি আমার প্রতি আল্লাহর শুধুমাত্র অনুকম্পা ও কৃপা ও দয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এর মধ্যে যে সমস্ত সঠিক উল্লেখ হয়েছে তা একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর যেসব ভুল-ভ্রান্তি ঘটেছে তা আমার ও শয়তানের পক্ষ থেকে। জিভের যেখানে স্খলন ঘটেছে অথবা ভুল ও ভ্রম হয়েছে তা থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।

স্মরণ রাখতে হবে যে, প্রত্যেক সঙ্কলক ও প্রনেতা-লেখক কঠিন সাবধানতা ও যাচাই-বাছাই, গভীর দৃষ্টি এবং গবেষণা করার পরেও পদস্খলন ও ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত নয়। এর সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মাসায়েল ও অধ্যায় এবং সংক্ষেপণ ও বিশ্লেষণ করতে গিয়েও অনীচ্ছাকৃতভাবে ভুল হয়ে যায়। বিশেষ করে এ ফেতনার যুগে খুব কম লেখকই আছেন যার মন-মস্তিস্ক সুস্থ থাকতে পারে; কেননা ব্যস্ততা অধিক, সমস্যা নানাবিধ, অস্থির ও বিঘ্নীতকর বিষয়ের হামলা এবং একাধারে বালা-মসিবত ও পেরেশানি। প্রত্যেক বনি আদম ভুল করে আর উত্তম ভুলকারী যারা তওবা করে। আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা ও তাঁর সন্তুষ্টি কামনা করছি।

কলম শরিয়তের আজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তির ন্যায় ভুল করে ও সঠিকও করে এবং আরম্ভ করে ও ফিরেও আসে। আর এমন কোন অঙ্গুলি নেই যার স্খলন ঘটে না এবং এমন কোন স্মরণশক্তি নেই যার ভ্রান্তি হয় না।

অতএব, ঐ মুসলিম ব্যক্তির প্রতি আল্লাহর দয়া যিনি এ কিতাবের মাঝে সঠিক দেখে আল্লাহর শোকর করবেন এবং কোন প্রকার ভুল-ত্রুটি দেখলে পরামর্শ দিবেন। তিনি একজন আমানতদার কল্যাণকামী এবং সত্যবাদী হেকিম যিনি ঐ সমস্ত জখমের চিকিৎসা করেন যা হতে কম সংখ্যক মানুষই নিরাপদে থাকেন। তিনি হাড়গোড় ভাঙ্গেন না এবং বিশেষ ও সাধারণের মাঝে ফেতনার বীজও বপন করেন না।

আর এ মহান দ্বীন যে তার দ্বারা আমল করবে, তার প্রতি দাওয়াত করবে, তার পক্ষ থেকে প্রতিহত করবে এবং এর জন্য ধৈর্যধারণ করবে তার কোন সন্দেহ থাকবে না।

পরিশেষে আল্লাহর নিকট দোয়া করি তিনি যেন এ কিতাবটি দ্বারা আমাকে ও সকল মুসলিম ভাইদেরকে উপকৃত করেন। আর ইহা আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর সস্ত্তষ্টচিত্তে কবুল করে নেন। আমাকে ও আমার পিতা-মাতা, পরিবার-পরিজন, প্রত্যেক সুধি পাঠক-পাঠিকা, শ্রোতামন্ডলী, প্রত্যেক উপকৃত ব্যক্তি, যাঁরা এর শিক্ষা দানকারী অথবা প্রচার-প্রসারে সাহায্যকারী এবং সকল মুসলিমকে ক্ষমা করেন ও ভুল-ত্রুটি মাফ করে দেন।


আল্লাহই একমাত্র আমাদের জন্য যথেষ্ট ও তিনিই উত্তম প্রতিনিধি। তিনিই উত্তম মাওলা তথা বন্ধু ও উত্তম সাহায্যকারী।


লিখেছেন

মহান রবের ক্ষমাভিখারী
মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম ইবনে আব্দুল্লাহ আত্তুওয়াইজিরী
আল-বুরাইদাহ, আল-কাসীম, সৌদি আরব।

মোবাইল:০৫০৮০১৩২২২-০৫০৪৯৫৩৩৩২
Mb_twj@hotmail.com


ত্রয়োদশ সংস্করণ

১৪৩২হি: ২০১১ইং

[1] বুখারী হাঃ নং ৭১ মুসলিম হাঃ নং ১০৩৭

[2] মুজতাহেদ হলেন: দ্বীনের মাসলা-মাসায়েল কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে নির্ধারণ করার বিশেষ শর্তাবলীসহ যোগ্যতাসম্পন্ন বিদ্বান। অনুবাদক

[3] সহীহ হাদীস বলে: যে হাদীসের বর্ণনাসূত্র অবিচ্ছিন্ন, বর্ণনাকারীগণ আদেল তথা বিশেষ চারিত্রিক গুণে গুনান্বিত, হাদীস গ্রহণ, স্মরণ ও সংরক্ষণে পূর্ণ দক্ষতা সম্পন্ন, সহীহ হওয়ার পরিপন্থী সর্বপ্রকার সূক্ষ্ণ দোষ-ত্রুটি মুক্ত ও অন্য কোন সহীহ হাদীসের বিপরীত না। মোট কথা যে হাদীস নবী (সা.) থেকে সুসাব্যস্ত ও আমলের যোগ। অনুবাদক

[4] হাসান হাদীস বলে: যে হাদীসের কোন বর্ণনাকারী উপরোক্ত সহীহ হাদীসের গুণাবলির মধ্যে শুধুমাত্র হাদীস গ্রহণ, স্মরণ ও সংরক্ষণে একটু দুর্বল। এ হাদীসও আমলোর যোগ্য। অনুবাদক

আল্লাহর বাণী:

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اعۡبُدُوۡا رَبَّکُمُ الَّذِیۡ خَلَقَکُمۡ وَ الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ ﴿ۙ۲۱﴾  الَّذِیۡ جَعَلَ لَکُمُ الۡاَرۡضَ فِرَاشًا وَّ السَّمَآءَ بِنَآءً ۪ وَّ اَنۡزَلَ مِنَ السَّمَآءِ مَآءً فَاَخۡرَجَ بِهٖ مِنَ الثَّمَرٰتِ رِزۡقًا لَّکُمۡ ۚ فَلَا تَجۡعَلُوۡا لِلّٰهِ اَنۡدَادًا وَّ اَنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ ﴿۲۲﴾

‘‘হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর, যিনি তোমাদিগকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদিগকে সৃষ্টি করেছেন। তাতে আশা করা যায়, তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে। যে পবিত্রসত্তা তোমাদের জন্য ভূমিকে বিছানা এবং আকাশকে ছাদ স্বরূপ স্থাপন করে দিয়েছেন, আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তোমাদের জন্য ফল-ফসল উৎপাদন করেছেন তোমাদের খাদ্য হিসাবে। অতএব, আল্লাহর সাথে তোমরা অন্য কাউকে সমকক্ষ করো না। বস্ত্তত: এসব তোমরা জান।’’ [সূরা বাকারা: ২১-২২]


তাওহীদ:

তাওহীদ হলো: আল্লাহ তা‘য়ালাকে তাঁর জন্য যা নির্দিষ্ট এবং ওয়াজিব সেসব বিষয়ে একক সাব্যস্ত করা।

বান্দা এ একিন-দৃঢ় বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ তাঁর রবূবিয়াতে তথা কার্যাদিতে, আসমা-সিফাতে মানে নাম ও গুণাবলীতে একক এবং উলূহিয়াতে অর্থাৎ বান্দার সকল ইবাদত কোন শরিক ছাড়াই একমাত্র তাঁরই জন্য নির্দিষ্ট করা সবচেয়ে বড় ফরজ।


তাওহীদের অর্থ:

বান্দা দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে এবং স্বীকার করবে যে, আল্লাহ একক, সবকিছুর প্রতিপালক ও মালিক। তিনিই একমাত্র সৃষ্টিকর্তা এবং পৃথিবীর মহাব্যবস্থাপক। আর তিনিই একমাত্র ইবাদতের হকদার, তাঁর কোন শরিক নেই। তিনি ছাড়া সকল মা‘বূদ বাতিল। তিনি পূর্ণ গুণে গুণান্বিত, সর্বপ্রকার ত্রুটি ও অপূর্ণতা থেকে পবিত্র। তাঁর সুন্দরতম নাম ও উচ্চমানের গুণ রয়েছে।

আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন:

اَللّٰهُ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ؕ لَهُ الۡاَسۡمَآءُ الۡحُسۡنٰی ﴿۸﴾

‘‘আল্লাহ তিনি ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ্-উপাস্য নেই। সব সৌন্দর্যমন্ডিত নাম তাঁরই।’’ [সূরা ত্বহা:৮]


তাওহীদের সূক্ষ্ম বূঝ:

আল্লাহ তা‘য়ালা একক, তাঁর কোন শরিক নেই। তিনি এক তাঁর সত্ত্বায়, নাম ও গুণাবলীতে এবং কাজে কেউ তাঁর সদৃশ নেই। তাঁরই সমস্ত রাজত্ব, সৃষ্টি ও নির্দেশ। তিনি একক, তাঁর কোন শরিক নেই।

তিনি মালিক আর বাকি সবই তাঁর দাস। তিনিই প্রতিপালক আর সকলেই তাঁর বান্দা। তিনিই সৃষ্টিকর্তা আর বাকি সবকিছুই তাঁর সৃষ্টিরাজি।

قُلۡ هُوَ اللّٰهُ اَحَدٌ ۚ﴿۱﴾ اَللّٰهُ الصَّمَدُ ۚ﴿۲﴾ لَمۡ یَلِدۡ ۬ۙ وَ لَمۡ یُوۡلَدۡ ۙ﴿۳﴾ وَ لَمۡ یَکُنۡ لَّهٗ کُفُوًا اَحَدٌ ﴿۴﴾


‘‘বলুন, তিনি আল্লাহ, একক, আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং কেউ তাঁকে জন্ম দেয়নি এবং তাঁর সমতূল্য কেউ নেই।’’ [সূরা এখলাস:১-৪]

আল্লাহ ক্ষমতাবান এবং তিনি ব্যতীত সকলে দুর্বল--। তিনি শক্তিমান আর বাকি সব অক্ষম। তিনি মহান আর সবই ক্ষুদ্র। তিনি অমুখাপেক্ষী আর সকলে তাঁরই মুখাপেক্ষী। তিনি শক্তিশালী ও সবই দুর্বল। তিনি মহাসত্য এবং তিনি ছাড়া সকল উপাস্য বাতিল। আল্লাহর বাণী:

ذٰلِکَ بِاَنَّ اللّٰهَ هُوَ الۡحَقُّ وَ اَنَّ مَا یَدۡعُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِهِ الۡبَاطِلُ ۙ وَ اَنَّ اللّٰهَ هُوَ الۡعَلِیُّ الۡکَبِیۡرُ ﴿۳۰﴾


‘‘এটাই প্রমাণ যে, আল্লাহ্-ই সত্য এবং আল্লাহ ব্যতীত তারা যাদের পূজা করে সব মিথ্যা। আল্লাহ্ সর্বোচ্চ, মহান।’’ [সূরা লোকমান:৩০]

তিনি মহান তাঁর চাইতে আর কেউ সুমহান নেই। তিনি সর্বোচ্চ তাঁর চাইতে কেউ উচ্চ নেই। তিনি বড় যার চাইতে আর কেউ বড় নেই। তিনি মেহেরবান তাঁর চাইতে কেউ বেশি দয়াবান নেই।

তিনি শক্তিধর, যিনি প্রত্যেক শক্তিশালীর মাঝে শক্তি সৃষ্টি করেন। তিনি শক্তিমান, যিনি সকল শক্তিমানের মধ্যে শক্তি সৃষ্টি করেছেন। তিনি পরম করুণাময়, যিনি প্রত্যেক করুণাকারীর ভিতরে করুণা সৃষ্টি করেছেন। তিনি মহাজ্ঞানী, যিনি সকল সৃষ্টিকে জানেন। তিনি রিজিকদাতা, যিনি প্রত্যেকটি রিজিক ও রিজিকপ্রাপ্তদেরকে সৃষ্টি করেছেন।


আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

ذٰلِکُمُ اللّٰهُ رَبُّکُمۡ ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ۚ خَالِقُ کُلِّ شَیۡءٍ فَاعۡبُدُوۡهُ ۚ وَ هُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ وَّکِیۡلٌ ﴿۱۰۲﴾  لَا تُدۡرِکُهُ الۡاَبۡصَارُ ۫ وَ هُوَ یُدۡرِکُ الۡاَبۡصَارَ ۚ وَ هُوَ اللَّطِیۡفُ الۡخَبِیۡرُ ﴿۱۰۳﴾


‘‘তিনিই আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনিই সবকিছুর স্রষ্টা। অতএব, তোমরা তাঁরই ইবাদত কর। তিনি প্রত্যেক বস্ত্তর কার্যনির্বাহী। দৃষ্টিসমূহ তাঁকে পেতে পারে না, অবশ্য তিনি দৃষ্টিসমূহকে পেতে পারেন। তিনি অত্যান্ত সূক্ষ্মদর্শী, সুবিজ্ঞ।’’ [সূরা আন‘আম:১০২-১০৩]

তিনিই সত্য ইলাহ্ যিনি তাঁর সত্ত্বা, মহত্ত্ব, সৌন্দর্য ও উত্তম এহসানের জন্য একমাত্র সমস্ত ইবাদতের হকদার। একমাত্র তাঁরই জন্য সুন্দরতম নাম ও তিনিই সুউচ্চ গুণাবলীর অধিকারী। আল্লাহর বাণী:

لَیۡسَ کَمِثۡلِهٖ شَیۡءٌ ۚ وَ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ ﴿۱۱﴾

‘‘কোন কিছুই তাঁর অনুরূপ নয়। তিনি সব শুনেন, সব দেখেন।’’ [সূরা শূরা:১১]

 

তিনি অভিজ্ঞ, মহাজ্ঞানী যিনি যা ইচ্ছা তাই করেন এবং যা ইচ্ছা তাই নির্দেশ করেন। আল্লাহর বাণী:

اَلَا لَهُ الۡخَلۡقُ وَ الۡاَمۡرُ ؕ تَبٰرَکَ اللّٰهُ رَبُّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۵۴﴾


‘‘জেনে রাখ, তাঁরই কাজ সৃষ্টি করা এবং আদেশ করা। আল্লাহ্, বরকতময় যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালক।’’ [সূরা আ‘রাফ: ৫৪]

তিনিই প্রথম সবকিছুর পূর্বে ও শেষ সবকিছুর পরে এবং তিনিই প্রকাশমান সবকিছুর উপরে ও অপ্রকাশমান সবকিছুর নিচে। তিনি সবকিছু অবগত এবং একক তাঁর কোন শরিক নেই। আল্লাহর বাণী:

هُوَ الۡاَوَّلُ وَ الۡاٰخِرُ وَ الظَّاهِرُ وَ الۡبَاطِنُ ۚ وَ هُوَ بِکُلِّ شَیۡءٍ عَلِیۡمٌ ﴿۳﴾

 

‘‘তিনিই সর্বপ্রথম, তিনিই সর্বশেষ, তিনিই প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান এবং তিনি সববিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত।’’ [সূরা হাদীদ:৩]

তিনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘য়ালা সত্য মালিক যাঁর হাতে সবকিছু। আর তিনি ছাড়া আর কারো হাতে কিছু নেই। অতএব, কোন শরিক ছাড়া একমাত্র তাঁরই অভিমুখে রওয়ানা হও।

আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

قُلِ اللّٰهُمَّ مٰلِکَ الۡمُلۡکِ تُؤۡتِی الۡمُلۡکَ مَنۡ تَشَآءُ وَ تَنۡزِعُ الۡمُلۡکَ مِمَّنۡ تَشَآءُ ۫ وَ تُعِزُّ مَنۡ تَشَآءُ وَ تُذِلُّ مَنۡ تَشَآءُ ؕ بِیَدِکَ الۡخَیۡرُ ؕ اِنَّکَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ ﴿۲۶﴾


‘‘বলুন হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।’’ [সূরা আল-ইমরান:২৬]

তিনিই আল্লাহ একমাত্র প্রতিটি জিনিসের মালিক, তিনিই প্রতিটি জিনিসের প্রতি ক্ষমতাশালী, তিনিই প্রতিটি জিনিস সম্পর্কে মহাজ্ঞানী, তিনিই প্রতিটি বস্ত্তর দানকারী। তিনিই প্রতিটি বিষয়ের একমাত্র নিয়ন্ত্রণকারী, তিনিই প্রত্যেক ক্ষমতাবানের প্রতি ক্ষমতাশীল, তিনিই প্রত্যেক পরাক্রমশালীর মহাপরাক্রমশালী। তিনিই একক প্রত্যেকের মালিক।

আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

تَبٰرَکَ الَّذِیۡ بِیَدِهِ الۡمُلۡکُ ۫ وَ هُوَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرُۨ ۙ﴿۱﴾

‘‘মহাপূণ্যময় তিনি, যার হাতে রাজত্ব। আর তিনি প্রতিটি জিনিসের উপর ক্ষমতাবান’’ [সূরা মুলক:১]

 

রসূলগণ যে তাওহীদের প্রতি দা'ওয়াত করেছেন এবং যার জন্য আসমানী কিতাবসমূহ নাজিল হয়েছে তা দু’প্রকার।

প্রথম: জ্ঞান ও সুসাব্যস্ত করার তাওহীদ। এটাকে ‘‘তাওহীদুর রবূবিয়্যাহ ও তাওহীদুল আসমা ওয়াস্সিফাত’’ বলা হয়। এ হচ্ছে আল্লাহর একত্ববাদ তাঁর সমস্ত নামে ও গুণাবলিতে এবং কার্যাদিতে।

এর অর্থ: বান্দা দৃঢ় বিশ্বাস রাখবে এবং স্বীকার করবে যে, আল্লাহ একক। তিনিই একমাত্র রব তথা প্রতিপালক, সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও এ পৃথিবীর মহাব্যবস্থাপক। তিনি তাঁর যাতে তথা সত্তায়, নামসমূহে ও গুণাবলীতে, কার্যাদিতে পরিপূর্ণ। সবকিছুই তিনি জানেন এবং সবকিছুকে ব্যাপৃত করে রেখেছেন। তাঁর হাতে রাজত্ব। তিনি প্রতিটি জিনিসের উপর ক্ষমতাবান। তাঁর সুন্দরতম নাম, উচ্চ গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে।

لَیۡسَ کَمِثۡلِهٖ شَیۡءٌ ۚ وَ هُوَ السَّمِیۡعُ الۡبَصِیۡرُ ﴿۱۱﴾

‘‘তাঁর সদৃশ কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’’ [সূরা শূরা: ১১]

দ্বিতীয়: ইচ্ছা ও চাওয়ায় তাওহীদ তথা একত্ববাদ। ইহাকে ‘‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ ওয়াল-‘ইবাদাহ্’’ বলে। আর তা হলো সকল প্রকার ইবাদতে আল্লাহকে একক সাব্যস্ত করা। যেমন: দোয়া, সালাত, ভয়-ভীতি ও আশা-আকাঙ্খা ইত্যাদি।

এর অর্থ: বান্দা একিন রাখবে এবং স্বীকার করবে যে, আল্লাহ একমাত্র সকল সৃষ্টির ইবাদতের হকদার। অতএব, কোন ইবাদত আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করা যাবে না। যেমন: দোয়া, সালাত, সাহায্য চাওয়া, ভরসা করা, ভয়-ভীতি, আশা-আকাংখা করা, জবাই করা ও নজর-মান্নত মানা ইত্যাদি সবই একমাত্র আল্লাহর জন্য আর অন্য কারো জন্য নয়। আর যে ব্যক্তি এগুলোর মধ্যে কোন কিছু অন্যের জন্য করবে সে মুশরিক হয়ে যাবে। যেমন: আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন:

 

وَ مَنۡ یَّدۡعُ مَعَ اللّٰهِ اِلٰـهًا اٰخَرَ ۙ لَا بُرۡهَانَ لَهٗ بِهٖ ۙ فَاِنَّمَا حِسَابُهٗ عِنۡدَ رَبِّهٖ ؕ اِنَّهٗ لَا یُفۡلِحُ الۡکٰفِرُوۡنَ ﴿۱۱۷﴾

‘‘যে কেউ আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যকে ডাকে, তার কাছে যার কোন সনদ নেই, তার হিসাব তার পালনকর্তার কাছে আছে। নিশ্চয়ই কাফেররা সফলকাম হবে না।’’ [সূরা মু‘মিনূন: ১১৭ ]


তাওহীদকে স্বীকার করার বিধান:

(ক) তাওহীদুর রবুয়িয়া মানুষ তার স্বভাব ও নিখিল বিশ্ব দেখেই স্বীকার করে থাকে। আর শুধুমাত্র এই তাওহীদ স্বীকার করলে আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং আজাব হতে বাঁচার জন্য যথেষ্ট নয়; কারণ ইহা ইবলীস শয়তান ও মুশরেকরাও স্বীকার করেছিল যা তাদের কোন উপকারে আসেনি; কেননা তারা তাওহীদুল উলুহিয়া তথা একমাত্র আল্লাহর ইবাদতকে মেনে নেইনি।

অতএব, যে শুধুমাত্র তাওহীদুর রবুবিয়াকে স্বীকার করবে সে তাওহীদপন্থী ও মুসলিম বলে বিবেচিত হবে না। আর যতক্ষণ সে তাওহীদুল উলুহিয়াকে না স্বীকার করবে ততক্ষণ তার জানমালের নিরাপত্তাও পাবে না। সে সাক্ষ্য দেবে যে আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মাবুদ নেই এবং তিনি একক তাঁর কোন শরিক নেই। আরো স্বীকার করবে যে, ইবাদতের হকদার একমাত্র আল্লাহই এবং কোন শরিক ছাড়াই সর্বদা এক আল্লাহরই ইবাদত করবে।

আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوا اللّٰهَ مُخۡلِصِیۡنَ لَهُ الدِّیۡنَ ۬ۙ حُنَفَآءَ وَ یُقِیۡمُوا الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوا الزَّکٰوۃَ وَ ذٰلِکَ دِیۡنُ الۡقَیِّمَۃِ ؕ﴿۵﴾


‘‘তাদেরকে এ ছাড়া কোন নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, সালাত কায়েম করবে এবং জাকাত দেবে। এটাই সঠিক দ্বীন।’’ [সূরা বাইয়িনাহ:৫]

(খ) তাওহীদুল উলূহিয়াহ ওয়াল ‘ইবাদাহ’’-এর বেশিরভাগ মানুষ কুফরি ও অস্বীকার করেছে। আর এ জন্যই আল্লাহ মানুষের নিকট সমস্ত রসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। তাঁদের উপর আসমানি কিতাব নাজিল করেছেন, যাতে করে মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্দেশ করেন এবং অন্য সকলের ইবাদত ত্যাগ করতে বলেন।

আল্লাহর বাণী:

وَ مَاۤ اَرۡسَلۡنَا مِنۡ قَبۡلِکَ مِنۡ رَّسُوۡلٍ اِلَّا نُوۡحِیۡۤ اِلَیۡهِ اَنَّهٗ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّاۤ اَنَا فَاعۡبُدُوۡنِ ﴿۲۵﴾


‘‘আপনার পূর্বে আমি যে রসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রেরণ করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। সুতরাং, আমারই এবাদত কর।’’ [ সূরা আম্বিয়া:২৫]

আরো আল্লাহর বাণী:

وَ لَقَدۡ بَعَثۡنَا فِیۡ کُلِّ اُمَّۃٍ رَّسُوۡلًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰهَ وَ اجۡتَنِبُوا الطَّاغُوۡتَ


‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত (আল্লাহ ব্যতীত সকল উপাস্য) থেকে বেঁচে থাক।’’ [সূরা নাহাল: ৩৬]


তাওহীদুর রবূবিয়া ও উলুহিয়ার অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক:

তাওহীদুর রবুবিয়াহ তাওহীদুল উলুহিয়াহকে আবশ্যক করে দেয়। তাই যে ব্যক্তি স্বীকার করে যে, আল্লাহই একমাত্র প্রতিপালক, সৃষ্টিকর্তা, মালিক ও রিজিকদাতা, তার জন্য এ কথা স্বীকার করা আবশ্যক হয়ে পড়ে যে, ইবাদতের হকদার একমাত্র আল্লাহই আর কেউ নয়। অতএব, সে আল্লাহ তা‘য়ালা ব্যতীত আর কাউকে ডাকবে না, একমাত্র তাঁরই নিকট বিপদ মুক্তি চাইবে, একমাত্র তাঁরই উপর ভরসা করবে, আল্লাহ ছাড়া আর কারো জন্য কোন ইবাদত করবে না। তাওহীদুল উলুহিয়া তাওহীদুর রবুবিয়াকে আবশ্যক করে। সুতরাং, যে কেউ একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করবে সে তাঁর সঙ্গে কোন কিছুকে শরিক করবে না। আর জরুরি ভিত্তিতে এ বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহই একমাত্র তাঁর প্রতিপালক, সৃষ্টিকর্তা ও মালিক।

তাওহীদুর রবুবিয়া ও তাওহীদুল উলুহিয়া কখনো এক সঙ্গে উল্লেখ হয় তখন তার অর্থ ভিন্ন হয়। এ সময় রবের অর্থ হবে মালিক-ব্যবস্থাপক আর ইলাহ্ অর্থ হবে সত্য মা‘বূদ যিনি একমাত্র ইবাদতের হকদার। যেমন : আল্লাহর বাণী:

قُلۡ اَعُوۡذُ بِرَبِّ النَّاسِ ۙ﴿۱﴾ مَلِکِ النَّاسِ ۙ﴿۲﴾ اِلٰهِ النَّاسِ ۙ﴿۳﴾

‘‘বলুন! আমি মানুষের প্রতিপালকের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি। মানুষের অধিপতি। মানুষের মা’বূদ।’’ [ সূরা নাস:১-৩]

আবার কখনো আলাদা আলাদা উল্লেখ হয় তখন উভয়ের অর্থ একই হয়।  যেমন  আল্লাহর বাণী:

قُلۡ اَغَیۡرَ اللّٰهِ اَبۡغِیۡ رَبًّا وَّ هُوَ رَبُّ کُلِّ

‘‘বলুন! আল্লাহ ব্যতীত আর কোন মা’বূদ তালাশ করব! অথচ তিনিই সবকিছুর প্রতিপালক।’’ [সূরা আন‘আম:১৬৪]


তাওহীদের হকিকত ও নির্যাস:

মানুষ দেখে প্রতিটি জিনিস একমাত্র আল্লাহ তা‘য়ালার পক্ষ থেকে হয়। আর কোন কারণাদি ও মাধ্যমের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে না। সে ভাল-মন্দ এবং লাভ-ক্ষতি ইত্যাদি শুধু আল্লাহ তা‘য়ালার কাছ থেকেই হয় মনে করে। তাই একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত করে এবং তার সাথে আর কারো ইবাদত করে না।


তাওহীদের  হকিকতের ফলাফল:  

একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করা এবং কোন সৃষ্টির নিকট অভিযোগ না করা। তাদের তিরস্কার ও নিন্দা না করা। আল্লাহর উপর পূর্ণ সন্তুষ্টি থাকা এবং তাঁকে মহব্বত করা ও তাঁর ফয়সালার প্রতি পূর্ণ আত্মসর্মপণ করা। এ ছাড়া সুন্দরভাবে তাঁর ইবাদত করা, সর্বদা তাঁর আনুগত্য করা, তাঁর প্রতি ভাল ধারনা রাখা এবং তাঁর জিকির দ্বারা প্রশান্তি ভাল করা।

মানুষ তার স্বভাবগতভাবে ও পৃথিবীর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপের মাধ্যমে তাওহীদে রবূবিয়াকে স্বীকার করে থাকে। এ তাওহীদকে স্বীকার করা আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর শাস্তি থেকে নাজাতের জন্য যথেষ্ট নয়; কারণ ইহা ইবলিস শয়তান স্বীকার করেছিল এবং মুশরিকরাও স্বীকার করেছিল। কিন্তু তাদের এ স্বীকারোক্তি কোন উপকারে আসেনি; কারণ তারা ‘‘তাওহীদুল ‘ইবাদাহ্’’ তথা ইবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য স্বীকার করে নাই। সুতরাং, যে ব্যক্তি শুধুমাত্র তাওহীদুর রবূবিয়াহকে স্বীকার করে সে মুওয়াহ্হিদ তথা তাওহীদপন্থী ও মুসলিম হতে পারে না। তার জীবন ও সম্পদ হারাম ততক্ষণ হয় না যতক্ষণ সে তাওহীদে উলূহিয়াকে স্বীকার করে না নেয়। সে সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য মা’বূদ (উপাস্য) নেই। তিনি একক ও তাঁর কোন শরিক নেই। আরো স্বীকার করবে যে, আল্লাহই একমাত্র ইবাদতের হকদার আর কেউ নয়। আর কোন প্রকার শিরক ছাড়াই একমাত্র আল্লাহর ইবাদতকে নিজের উপর আবশ্যকীয় করে নেবে।


তাওহীদের ফজিলত:

১. আল্লাহর বাণী:

وَ بَشِّرِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ ؕ کُلَّمَا رُزِقُوۡا مِنۡهَا مِنۡ ثَمَرَۃٍ رِّزۡقًا ۙ قَالُوۡا هٰذَا الَّذِیۡ رُزِقۡنَا مِنۡ قَبۡلُ ۙ وَ اُتُوۡا بِهٖ مُتَشَابِهًا ؕ وَ لَهُمۡ فِیۡهَاۤ اَزۡوَاجٌ مُّطَهَّرَۃٌ ٭ۙ وَّ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۲۵﴾

‘‘আর (হে নবী) যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্মসমূহ করেছে, আপনি তাদেরকে এমন বেহেশতের সুসংবাদ দিন, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহমান থাকবে। যখনই তারা খাবার হিসেবে কোন ফল প্রাপ্ত হবে, তখনই তারা বলবে, এতো অবিকল সে ফলই যা আমরা ইতিপূর্বেও লাভ করেছিলাম। বস্ত্তত: তাদেরকে একই প্রকৃতির ফল প্রদান করা হবে এবং সেখানে তাদের জন্য শুদ্ধচারিণী রমণীকূল থাকবে। আর সেখানে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে।’’ [সূরা বাকারা:২৫]   

২. আল্লাহর বাণী:

اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ لَمۡ یَلۡبِسُوۡۤا اِیۡمَانَهُمۡ بِظُلۡمٍ اُولٰٓئِکَ لَهُمُ الۡاَمۡنُ وَ هُمۡ مُّهۡتَدُوۡنَ ﴿۸۲﴾

‘‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানে কোন প্রকার শিরকের সংমিশ্রণ ঘটায়নি তাদের জন্য রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই হেদায়েতপ্রাপ্ত।’’ [সূরা আন‘আম: ৮২]

৩.  আল্লাহর বাণী:

اَلَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ تَطۡمَئِنُّ قُلُوۡبُهُمۡ بِذِکۡرِ اللّٰهِ ؕ اَلَا بِذِکۡرِ اللّٰهِ تَطۡمَئِنُّ الۡقُلُوۡبُ ﴿ؕ۲۸﴾


‘‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়।’’ [সূরা রা‘দ:২৮]

 

عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: « مَنْ شَهِدَ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ، وَأَنَّ عِيسَى عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ، وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ، وَالْجَنَّةُ حَقٌّ وَالنَّارُ حَقٌّ، أَدْخَلَهُ اللَّهُ الْجَنَّةَ عَلَى مَا كَانَ مِنْ الْعَمَلِ ».متفق عليه.


৪.  উবাদা ইবনে সামেত (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন:‘‘যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য প্রদান করবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য মা’বূদ নেই এবং নেই কোন প্রকার তাঁর শরিক।  আর মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বান্দা ও রসূল এবং ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও রসূল ও তাঁর বাণী যা রুহ হিসাবে মরয়মের মধ্যে নিক্ষেপ করে ছিলেন। আর জান্নাত সত্য ও জাহান্নামও সত্য। সে ব্যক্তিকে আল্লাহ জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, চাই সে যেই কোন আমল করুক না কেন।’’[1]


عَنْ جَابِرٍ قَال أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا الْمُوجِبَتَانِ فَقَالَ:« مَنْ مَاتَ لَا يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ مَاتَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ». أخرجه مسلم.

৫. জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী (সা.)-এর নিকট একজন মানুষ এসে বলল: হে আল্লাহর রসূল! ওয়াজিবকারী দু’টি জিনিস কি? তিনি (সা.) বললেন:‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরিক করা ছাড়া মারা যাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরিক করা অবস্থায় মারা যাবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’’[2]


তাওহীদপন্থীদের প্রতিদান:

আল্লাহর বাণী:

وَ بَشِّرِ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ عَمِلُوا الصّٰلِحٰتِ اَنَّ لَهُمۡ جَنّٰتٍ تَجۡرِیۡ مِنۡ تَحۡتِهَا الۡاَنۡهٰرُ ؕ کُلَّمَا رُزِقُوۡا مِنۡهَا مِنۡ ثَمَرَۃٍ رِّزۡقًا ۙ قَالُوۡا هٰذَا الَّذِیۡ رُزِقۡنَا مِنۡ قَبۡلُ ۙ وَ اُتُوۡا بِهٖ مُتَشَابِهًا ؕ وَ لَهُمۡ فِیۡهَاۤ اَزۡوَاجٌ مُّطَهَّرَۃٌ ٭ۙ وَّ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۲۵﴾


‘‘আর (হে নবী-সা.) যারা ঈমান এনেছে এবং সৎআমলসমূহ করেছে, তাদেরকে এমন জান্নাতের সুসংবাদ দিন, যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহমান থাকবে। যখনই তারা খাবার হিসাবে কোন ফলপ্রাপ্ত হবে, তখনই তারা বলবে, এতো অবিকল সে ফলই যা আমরা ইতিপূর্বেও লাভ করেছিলাম। বস্ত্তত: তাদেরকে একই প্রকৃতির ফল প্রদান করা হবে এবং সেখানে তাদের জন্য শুদ্ধচারিণী রমণীকূল থাকবে। আর সেখানে তারা অনন্তকাল অবস্থান করবে।’’ [সূরা বাকারা: ২৫]


عَنْ جَابِرٍ  قَالَ: أَتَى النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجُلٌ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا الْمُوجِبَتَانِ ؟ فَقَالَ:্র مَنْ مَاتَ لَا يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ ،وَمَنْ مَاتَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ . أخرجه مسلم.


২. জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.)-এর নিকটে একজন মানুষ এসে বলল, হে আল্লাহর রসূল! ওয়াজিবকারী দু’টি জিনিস কি? তিনি (সা.) উত্তরে বললেন:‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে শরিক না করে মারা যাবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরিক করা অবস্থায় মারা যাবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’’[3]


তাওহিদী কলেমার মহত্ব:

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو  أنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ:্র إِنَّ نَبِيَّ اللَّهِ نُوحًا صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا حَضَرَتْهُ الْوَفَاةُ قَالَ لِابْنِهِ:্র إِنِّي قَاصٌّ عَلَيْكَ الْوَصِيَّةَ، آمُرُكَ بِاثْنَتَيْنِ، وَأَنْهَاكَ عَنْ اثْنَتَيْنِ ، آمُرُكَ بِـ "لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ " فَإِنَّ السَّمَوَاتِ السَّبْعَ وَالْأَرْضِينَ السَّبْعَ لَوْ وُضِعَتْ فِي كِفَّةٍ ، وَوُضِعَتْ "لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ " فِي كِفَّةٍ رَجَحَتْ بِهِنَّ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ ، وَلَوْ أَنَّ السَّمَوَاتِ السَّبْعَ وَالْأَرْضِينَ السَّبْعَ ،كُنَّ حَلْقَةً مُبْهَمَةً قَصَمَتْهُنَّ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَسُبْحَانَ اللَّهِ وَبِحَمْدِهِ فَإِنَّهَا صَلَاةُ كُلِّ شَيْءٍ وَبِهَا يُرْزَقُ الْخَلْقُ، وَأَنْهَاكَ عَنْ الشِّرْكِ وَالْكِبْرِগ্ধ. أخرجه أحمد والبخاري في الأدب المفرد.


আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনে আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আল্লাহর নবী নূহ (আঃ)-এর মৃত্যুকালে তাঁর ছেলেকে বলেন: ‘‘আমি তোমাকে অসিয়ত করছি: দু’টি জিনিসের নির্দেশ করছি এবং অপর দু’টি জিনিস থেকে নিষেধ করছি। আদেশ করছি ‘‘লা ইলাাহা ইল্লাল্লাাহ’’ এর। স্মরণ রাখ! যদি সাত আসমান ও সাত জমিন এক পাল্লায় রাখা হয় আর অপর পাল্লায় রাখা হয় ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ তবে ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাাহ’’ এর পাল্লা ভারী হয়ে যাবে। যদি সাত আসমান ও সাত জমিন একটি অবিচ্ছদ্য গোলাকার বৃত্ত হত তাহলে ‘‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’’ ও ‘‘সুবহাানাল্লাহি ওয়াবি হামদিহি’’ সবকিছুকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলতো। ইহা প্রতিটি জিনিসের দোয়া এবং এর মাধ্যমেই সৃষ্টিরাজি রুজি পেয়ে থাকে। আর তোমাকে নিষেধ করি শিরক ও অহঙ্কার করা থেকে-----। ’’[4]


তাওহীদের পূর্ণতা:

তাওহীদের পূর্ণতা ততক্ষণ সম্ভব নয় যতক্ষণ পর্যন্ত একমাত্র আল্লাহর ইবাদত ও সর্বপ্রকার তাগুত তথা শিরক মুক্ত না হয়। যেমন আল্লাহর বাণী:

وَ لَقَدۡ بَعَثۡنَا فِیۡ کُلِّ اُمَّۃٍ رَّسُوۡلًا اَنِ اعۡبُدُوا اللّٰهَ وَ اجۡتَنِبُوا الطَّاغُوۡتَ

‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা এক আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত তথা শিরক থেকে দূরে থাক।’’ [সূরা নাহ্ল: ৩৬ ]


তাগুতের বর্ণনা:

তাগুত হলো: এমন প্রত্যেক জিনিস যা দ্বারা মানুষ সীমালঙ্খন করে। চাই তা মা‘বূদ (উপাস্য) হোক যেমন: মূর্তি অথবা অনুসরণীয় ব্যক্তি হোক যেমন: জ্যোতিষ-গণক ও ধর্ম ব্যবসায়ী পীর-বুজর্গ এবং বদ আমল আলেম সমাজ অথবা মান্যবর ব্যক্তিরা হোক যেমন: শাসক ও নেতাজি ও প্রধানরা যারা আল্লাহর অবাধ্য।


তাগুতের নেতারা:

তাগুত অনেক আছে তাদের মধ্যে বড় পাঁচটি:

  • ইবলিস: হে আল্লাহ! আমারা তার থেকে তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
  • যার ইবাদত করা হয় আর সে তাতে সন্তুষ্ট থাকে।
  • যে মানুষকে নিজের ইবাদতের জন্য ডাকে।
  • যে ব্যক্তি ‘‘গায়বী ইলম’’ তথা কোন মাধ্যম ছাড়াই অদৃশ্যের খবরাদির জ্ঞান দাবি করে।
  • যে আল্লাহর বিধান ছাড়া অন্যের বিধান (মানব রচিত বিধান) দ্বারা বিচার ফয়সালা করে।

 

اَللّٰهُ وَلِیُّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا ۙ یُخۡرِجُهُمۡ مِّنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوۡرِ۬ؕ وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡۤا اَوۡلِیٰٓـُٔهُمُ الطَّاغُوۡتُ ۙ یُخۡرِجُوۡنَهُمۡ مِّنَ النُّوۡرِ اِلَی الظُّلُمٰتِ ؕ اُولٰٓئِکَ اَصۡحٰبُ النَّارِ ۚ هُمۡ فِیۡهَا خٰلِدُوۡنَ ﴿۲۵۷﴾

‘‘যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তাদেরকে তিনি বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। আর যারা কুফরি করে তাদের অভিভাবক হচ্ছে তাগুত। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। এরাই হলো জাহান্নামের অধিবাসী, চিরকাল তারা সেখানেই থাকবে।’’ [সূরা বাকারা:২৫৭]

[1]. বুখারী হাঃ নং ৩৪৩৫ ও মুসলিম হাঃ নং ২৮
[2]. মুসলিম হা: নং ৯৩
[3]. মুসলিম হাঃ নং ৯৩
[4]. হাদীসটি সহীহ, আহমাদ হাঃ নং ৬৫৮৩ বুখারীর আদাবুল মুফরাদ হাঃ নং ৫৫৮ সহীহ আদাবুল মুফরাদ হাঃ নং ৪২৬ আলবানীর সিলসিলা সহীহা হাঃ নং ১৩৪ দ্রষ্টব্য।

ইবাদতের অর্থ:

ইবাদতের হকদার একমাত্র আল্লাহ তা‘য়ালা। ইবাদত শব্দটি দু’টি জিনিসের উপর প্রয়োগ হয়:

প্রথম: ইবাদত করা: মহব্বত ও সম্মানের সথে আল্লাহর আদেশসমূহের বাস্তবায়ন ও নিষেধসমূহ বর্জন করে তাঁর জন্য নিজেকে বিলিন ও অবনত করা।

দ্বিতীয়: যার দ্বারা ইবাদত করা হয়: আর তা কথা হোক বা কাজ হোক, প্রকাশ্য হোক বা গোপনীয় হোক যা আল্লাহ পছন্দ করেন এবং করলে খুশি হন। যেমন: দোয়া, জিকির, সালাত, ভালোবাসা ইত্যাদি। সুতরাং, সালাত একটি ইবাদত যার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা হয়। আমরা অবনত হয়ে এবং মহব্বত করে ও সম্মানের সঙ্গে একমাত্র আল্লাহর জন্য ইবাদত করব। আর শুধুমাত্র তাঁর শরিয়ত সম্মতই ইবাদত করব।


জ্বিন ও ইনসান সৃষ্টির হিকমত:

আল্লাহ জ্বিন-ইনসানকে অযথা সৃষ্টি করেন নাই। পানাহার, খেলাধুলা ও হাসি-তামাশা করার জন্য সৃষ্টি করেন নাই। বরং তাদের সৃষ্টি করেছেন একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার জন্য। তারা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে, তাঁরই মহত্ব গাইবে এবং তাঁরই আনুগত্য করবে। তাঁর নির্দেশসমূহ মানবে এবং নিষেধসমূহ ত্যাগ করবে। তাঁর দেয়া সীমারেখা লঙ্ঘন করবে না। আর অন্য সবার ইবাদত ত্যাগ করবে। যেমন: আল্লাহ তা‘য়ালা এরশাদ করেন:

وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ ﴿۵۶﴾

‘‘আমি জ্বিন ও ইনসানকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছি।’’ [সূরা যারিয়াত: ৫৬]

 

ইবাদতের হিকমত:

আল্লাহর প্রতি ঈমানের ভিত্তিতে তাঁর সমস্ত নির্দেশ পালন ও নিষেধ ত্যাগ করা। আর সর্বদা সৃষ্টিকর্তা ও অন্তরের মালিকের ধিয়ান করা। ইহা আল্লাহর বেশি বেশি জিকির ও সব সময় অন্তরে তাঁর ধিয়ান এবং ইবাদতের মাধ্যমে হওয়া সম্ভব। আর যখন ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং শক্তিশালী হয় তখন তার আমলও বৃদ্ধি পায় ও মজবুত হয়। এরপর দুই জগতের সাফলতার দ্বারা সকল অবস্থা সঠিক হয়ে যায়। আর বিপরীত হলে বিপরীত দাঁড়ায়।

আল্লাহর তা‘য়ালার বাণী:

یٰۤاَیُّهَاالَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اذۡکُرُوا اللّٰهَ ذِکۡرًا کَثِیۡرًا﴿ۙ۴۱﴾  وَّ سَبِّحُوۡهُ بُکۡرَۃً وَّ اَصِیۡلًا ﴿۴۲﴾


‘‘মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর। আর সকাল-বিকাল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা কর।’’ [সূরা আহজাব:৪১-৪২]

আল্লাহর তা‘য়ালার বাণী:

وَ لَوۡ اَنَّ اَهۡلَ الۡقُرٰۤی اٰمَنُوۡا وَ اتَّقَوۡا لَفَتَحۡنَا عَلَیۡهِمۡ بَرَکٰتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ وَ لٰکِنۡ کَذَّبُوۡا فَاَخَذۡنٰهُمۡ بِمَا کَانُوۡا یَکۡسِبُوۡنَ ﴿۹۶﴾

‘‘আর যদি সে জনপদের অধিবাসীরা ঈমান আনত এবং আল্লাহভীরু হত, তবে আমি তাদের প্রতি আসমানী ও পার্থিব নেয়ামতসমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং আমি তাদেরকে পাকড়াও করেছি তাদের কৃতকর্মের বদলাতে।’’ [সূরা আ‘রাফ: ৯৬]


ইবাদতের পদ্ধতি:

আল্লাহর ইবাদত দু’টি বিশাল মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত:

(১) আল্লাহ তা‘য়ালার পরিপূর্ণ ভালোবাসা।  

(২) আল্লাহর জন্য নিজেকে পূর্ণ অবনত মস্তকে বিলিন করা।

এ দু’টি মূলনীতি আবার অন্য দু’টি বড় মূল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, আর তা হলো:

(এক) আল্লাহর অনুকম্পা, এহসান, দয়া ও দানসমূহের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যা ভালোবাসাকে অপরিহার্য করে দেয়।

(দুই) আত্মা ও আমলের ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি লক্ষ্য করা, যা দ্বারা জন্ম নেয় আল্লাহর জন্য অবনতি হওয়া ও নিজেকে বিলিন করা।

আর সব চাইতে নিকটের দরজা যার দ্বারা বান্দা তার রবের নিকট পৌঁছতে পারে তা হলো মুখাপেক্ষীর দরজা। নিজেকে গরিব-মিসকিন ভাবা এবং নেই কোন উপায়-উপান্ত ও নেই কোন পন্থা ও অসিলা এমন ভেবে নিজেকে বিলিন করে দেয়া। এ ছাড়া পূর্ণভাবে একমাত্র আল্লাহর প্রয়োজন বোধ করা এবং তিনি ব্যতীত সে ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস হয়ে যাবে মনে করা।

১. আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

وَ مَا بِکُمۡ مِّنۡ نِّعۡمَۃٍ فَمِنَ اللّٰهِ ثُمَّ اِذَا مَسَّکُمُ الضُّرُّ فَاِلَیۡهِ تَجۡـَٔرُوۡنَ ﴿ۚ۵۳﴾


‘‘তোমাদের কাছে যেসব নেয়ামত আছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে। অত:পর তোমরা যখন দু:খ-কষ্টে পতিত হও তখন তাঁরই নিকট কান্নাকাটি কর। ’’ [সূরা নাহা্ল: ৫৩]

২. আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اَنۡتُمُ الۡفُقَرَآءُ اِلَی اللّٰهِ ۚ وَ اللّٰهُ هُوَ الۡغَنِیُّ الۡحَمِیۡدُ ﴿۱۵﴾

‘‘হে মানুষ সমাজ! তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ; তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।’’ [সূরা ফাতির:১৫]


ইবাদতের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ মানুষ:

নিঃসন্দেহে নবী-রসূলগণ (আঃ) আল্লাহর পরিপূর্ণ বান্দা; কারণ তাঁরা আল্লাহ সম্পর্কে সবার চেয়ে বেশি জানেন। তাঁরা অন্যদের চেয়ে তাঁকে বেশি তা‘যীম তথা সম্মান করেন। এর অতিরিক্ত আল্লাহ তাঁদেরকে মানুষের নিকটে রসূল হিসেবে প্রেরণ করে আরো তাঁদের সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁদের রেসালাতের ফজিলত তার সঙ্গে বিশেষ উবূদিয়্যাত তথা বন্দেগীর ফজিলতও সমন্বয় ঘটেছে।

এঁদের পরে স্থান হলো সিদ্দিকীনদের, যাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের জন্য পূর্ণ সত্যতা লাভ করেছে। যার ফলে তাঁরা আল্লাহর আদেশসমূহে অটল ও অনড়। এরপর স্থান হলো শহীদগণের। এরপর সলেহীন তথা সৎ ও নেক লোকদের।

আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

وَ مَنۡ یُّطِعِ اللّٰهَ وَ الرَّسُوۡلَ فَاُولٰٓئِکَ مَعَ الَّذِیۡنَ اَنۡعَمَ اللّٰهُ عَلَیۡهِمۡ مِّنَ النَّبِیّٖنَ وَ الصِّدِّیۡقِیۡنَ وَ الشُّهَدَآءِ وَ الصّٰلِحِیۡنَ ۚ وَ حَسُنَ اُولٰٓئِکَ رَفِیۡقًا ﴿ؕ۶۹﴾


‘‘আর যারা আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য করবে, তারা ওদের সঙ্গী হবে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন। তাঁরা হলেন নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাঁদের কতই না উত্তম সঙ্গী।’’ [ সূরা নিসা: ৬৯]


বান্দার প্রতি আল্লাহর হক (অধিকার):

আসমান ও জমিনবাসীদের উপর আল্লাহর হক হলো: তারা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। তাঁর আনুগত্য করবে, নাফরমানি ও অবাধ্যতা করবে না। তাঁকে সর্বদা স্মরণ করবে কখনো ভুলে যাবে না। তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে কখনো অকৃতজ্ঞতা করবে না। আর যার জন্য সৃষ্ট (ইবাদত) তার বিপরীত কিছু সংঘটিত হওয়াটা হয়তো অপারগতা কিংবা অজ্ঞতা আর না হয় বাড়াবাড়ি ও অবহেলার কারণে হয়ে থাকে।

তাই তো আল্লাহ আসমান ও জমিনবাসীকে আজাব দিলে তাতে তিনি কোন প্রকার জুলুমকারী হবেন না। আর যদি তাদের প্রতি দয়া করেন তাহলে তা হবে তাঁর পক্ষ থেকে তাদের উপর বিশেষ রহমত যা কাজের চেয়ে অনেক বেশি।


عَنْ مُعَاذٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: كُنْتُ رِدْفَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى حِمَارٍ يُقَالُ لَهُ عُفَيْرٌ فَقَالَ:্র يَا مُعَاذُ هَلْ تَدْرِي حَقَّ اللَّهِ عَلَى عِبَادِهِ وَمَا حَقُّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ ؟ قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ، قَالَ: فَإِنَّ حَقَّ اللَّهِ عَلَى الْعِبَادِ أَنْ يَعْبُدُوهُ وَلَا يُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا، وَحَقَّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ أَنْ لَا يُعَذِّبَ مَنْ لَا يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا، فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ: أَفَلَا أُبَشِّرُ بِهِ النَّاسَ ؟ قَالَ: لَا تُبَشِّرْهُمْ فَيَتَّكِلُوا .متفق عليه.

মু‘য়ায ইববে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি নবী (সা.)-এর পিছনে ‘উফায়ের নামের গাধার উপর বসে ছিলাম। তখন তিনি (সা.) বলেন: ‘‘হে মু‘য়ায! তুমি কি জানো আল্লাহর হক তাঁর বান্দার উপর এবং বান্দার হক আল্লাহর উপর কি? মু‘য়ায (রাঃ) বলেন আমি বললাম: এ ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রসূলই বেশি জানেন। রসূল (সা.) বলেন: বান্দার উপর আল্লাহর হক হলো: একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরিক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হলো: যে তাঁর সঙ্গে কোন কিছুকে শরিক করে না তাকে শাস্তি না দেয়া। মু‘য়ায (রাঃ) বলেন: আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! এ ব্যাপারে মানুষকে সুসংবাদ প্রদান করি? তিনি (রসূল সা.) বলেন: তাদের সুসংবাদ দিও না; কারণ তারা হাত-পা গুটিয়ে পরনির্ভরশীল হয়ে কাজ-কর্ম ও ইবাদত করা ছেড়ে দেবে।’’[1]


পূর্ণ দাসত্ব ও বন্দেগি:

প্রতিটি বান্দা তিনটি অবস্থার মধ্যে আবর্তন বিবর্তন করতে থাকে: (এক) আল্লাহর প্রচুর নেয়ামতের মধ্যে, যার ফলে আল্লাহর শুকরিয়া ও প্রশংসা করা বান্দার জন্য ওয়াজিব। (দুই) পাপকাজে লিপ্ত যার জন্য তওবা ও ক্ষমা চাওয়া ওয়াজিব। (তিন) আপদ-বিপদে যার দ্বারা আল্লাহ তাকে পরীক্ষা করেন। সে মুহূর্তে ধৈর্যধারণ করা ওয়াজিব। যে ব্যক্তি এ তিনটি ওয়াজিব আদায় করবে সে দুনিয়া ও আখেরাতে নিশ্চই সফলকামী হবে।  

আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে পরীক্ষা করেন তাদের ধৈর্যশক্তি ও দাসত্বের পূর্ণতা পর্যবেক্ষণ করার জন্যে। তাদের ধ্বংস ও শাস্তি দেয়ার জন্য নয়। তাই বান্দার বিপদকালে যেমন আল্লাহর পূর্ণ বন্দেগি করা জরুরি তেমনি ভালো অবস্থাতেও পূর্ণ বন্দেগি করা একান্ত প্রয়োজন। পছন্দ-অপছন্দ সবকিছুতে আল্লাহর বন্দেগি করা জরুরি। আর বেশির ভাগ মানুষ পছন্দে পূর্ণ গোলামি করে কিন্তু আসলে কঠিন সময়েও পূর্ণ বন্দেগি করাই হলো জরুরী। বন্দেগিতে বান্দারা সবাই সমান নয় বরং তাদের মাঝে কম-বেশি রয়েছে। ধরা যাক ওযু যা প্রচন্ড গরমে ঠান্ডা পানি দ্বারা করা এক প্রকার ইবাদত। পরম সুন্দরী নারীকে বিবাহ করাও একটি ইবাদত। অনুরূপ প্রচন্ড শীতে ঠান্ডা পানি দ্বারা ওযু করা ইবাদত। যে পাপ কাজ করতে আত্মা উৎসাহি তা মানুষের ভয়েও নয় বরং ইচ্ছা করেই ত্যাগ করাও বন্দেগি। ক্ষুধা ও কষ্টে ধৈর্যধারণ করাও দাসত্ব। কিন্তু এ দু’প্রকার বন্দেগির মাঝে রয়েছে ব্যাপক ব্যবধান।

অতএব, যে ব্যক্তি সুখে-দুঃখে ও পছন্দে-অপছন্দে সর্বাবস্থায় আল্লাহর বন্দেগি করতে পারে, তিনিই আল্লাহর সেই বান্দাদের অর্ন্তভুক্ত হন যাদের নেই কোন ভয়-ভীতি ও চিন্তা। আর তার উপর শত্রুদের নেই কোন শক্তি; কারণ আল্লাহই তার হেফাজতকারী। কিন্তু কখনো শয়তান তাকে ধ্বংস করে ফেলে। বান্দা কখনো গাফলতি-অমনোযোগী, মনপূজারী তথা কামনা-বাসনায় ও রাসে নিপতিত হয়, যার ফলে শয়তান তার মাঝে এ তিনটি দরজা দ্বারা প্রবেশ করে বসে। আল্লাহ পরীক্ষা করার নিমিত্তে প্রতিটি বান্দার উপর তার প্রবৃত্তি ও শয়তানকে শক্তি প্রদান করে দিয়েছেন। এ কথা জানা ও দেখার জন্যে যে, সে তার প্রতিপালকের আনুগত্য করছে না নাফরমানি করছে।

کُلُّ نَفۡسٍ ذَآئِقَۃُ الۡمَوۡتِ ؕ وَ نَبۡلُوۡکُمۡ بِالشَّرِّ وَ الۡخَیۡرِ فِتۡنَۃً ؕ وَ اِلَیۡنَا تُرۡجَعُوۡنَ ﴿۳۵﴾

‘‘আমি তোমাদেরকে মন্দ ও ভাল দ্বারা পরীক্ষা করে থাকি এবং আমারই কাছে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে।’’ [সূরা আম্বিয়া:৩৫]

মানুষের উপর আল্লাহর যেমন নির্দেশ রয়েছে তেমনি তার প্রবৃত্তিরও নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহ তা‘য়ালা চান মানুষ তার ঈমান ও সৎকর্ম পূর্ণ করুক। আর প্রবৃত্তি চায় সম্পদ ও কামনা-বাসনা পূর্ণ করুক। আল্লাহ তা‘য়ালা আমাদের থেকে চান আখেরাতের কাজ আর প্রবৃত্তি চায় দুনিয়াবী কাজ।

স্মরণ রাখতে হবে যে, কেবলমাত্র শক্তিশালী ঈমানই নাজাতের রাস্তা ও আলোর বাতি যার মাধ্যমে সত্য-মিথ্যার মাধ্যে পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। আর ইহাই হলো পরীক্ষাগার।

১. আল্লাহর বাণী:

اَحَسِبَ النَّاسُ اَنۡ یُّتۡرَکُوۡۤا اَنۡ یَّقُوۡلُوۡۤا اٰمَنَّا وَ هُمۡ لَا یُفۡتَنُوۡنَ ﴿۲﴾ وَ لَقَدۡ فَتَنَّا الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِهِمۡ فَلَیَعۡلَمَنَّ اللّٰهُ الَّذِیۡنَ صَدَقُوۡا وَ لَیَعۡلَمَنَّ الۡکٰذِبِیۡنَ ﴿۳﴾


‘‘মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যহতি পেয়ে যাবে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি, তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছি, যারা তাদের পূর্বের ছিল। আল্লাহ অবশ্যই জেনে নেবেন যারা সত্যবাদী এবং নিশ্চয় জেনে নিবেন মিথ্যুকদের।’’ [ সূরা আনকাবূত: ২-৩]

 

২. আরো আল্লাহর বাণী:

وَ مَاۤ اُبَرِّیٴُ نَفۡسِیۡ ۚ اِنَّ النَّفۡسَ لَاَمَّارَۃٌۢ بِالسُّوۡٓءِ اِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّیۡ ؕ اِنَّ رَبِّیۡ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۵۳﴾

‘‘আমি নিজেকে নির্দোষ বলি না। নিশ্চয় মন মন্দ কর্মপ্রবণ কিন্তু সে নয় যার প্রতি আমার পালনকর্তা অনুগ্রহ করেন। নিশ্চয় আমার রব ক্ষমাশীল, দয়ালু। [সূরা ইউসুফ: ৫৩]


বন্দেগির সঠিক বুঝ:

জমিন মিষ্টি ও তিতা সবধরণের ফলের গাছ রোপণের জন্য উপযুক্ত। আর ফিতরৎ তথা দ্বীনের মূল স্বভাব সেখানে যে কোন গাছ লাগানোর জন্য এক মুক্তাঙ্গন। অতএব, যে তাতে ঈমান ও তাকওয়ার গাছ লাগাবে সে চিরস্থায়ী স্বাদের ফল পাড়বে। আর যে কুফরি, অজ্ঞতা ও পাপের গাছ লাগাবে সে চিরস্থায়ী দুঃখের ও অনীষ্টের ফল পাড়বে।


মনে রাখতে হবে যে, সবচেয়ে যার জ্ঞান রাখা বেশি প্রয়োজন তা হলো: আপনার প্রতিপালকের পরিচয় এবং তাঁর ব্যাপারে যা ওয়াজিব তা জানা। যার ফলে মহান আল্লাহর ব্যাপারে আপনি জ্ঞানে অজ্ঞতা--, কাজে অবহেলা--, প্রবৃত্তির ত্রুটি, আল্লাহর হকে শিথিলতা--- ও লেনদেনে জুলুম করেন তা স্বীকার করতে পারবেন।

বান্দা যদি কোন নেকির কাজ করে তাহলে ভাবে ইহা আল্লাহর পক্ষ থেকে অনুগ্রহ। আল্লাহ যদি তা কবুল করে নেন তাহলে দ্বিতীয় অনুগ্রহ। আর যদি দ্বিগুণ বর্ধিত করেন তাহলে তৃতীয় অনুগ্রহ। কিন্তু যদি প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে এরূপ আমল গ্রহণযোগ্য নয় বলে বিবেচিত হবে।

আর যদি বান্দা কোন পাপ করে তাহলে মনে রাখতে হবে যে, তার প্রতিপালক তাকে ছেড়ে দিয়েছেন এবং তার হেফাজতের রশির বন্ধন কেটে ফেলেছেন। আর যদি তার পাপের জন্য তাকে পাকড়াও করেন তাহলে ইহা তাঁর ইনসাফ। কিন্তু যদি পাকড়াও না করেন তাহলে ইহা তাঁর অনুগ্রহ। আর যদি মাফ করে দেন তাহলে ইহা বান্দার প্রতি তাঁর বিশেষ এহসান ও অনুকম্পা।

আসমান-জমিনে যতকিছু সবই আল্লাহর বান্দা। প্রতিটি মানুষের স্বীকার করা ওয়াজিব যে, সে সৃষ্টিগত ও শরিয়তগতভাবে আল্লাহর বান্দা। আপনি তাঁরই বান্দা; কারণ তিনিই আপনার সৃষ্টিকর্তা, আপনার মালিক, আপনার সকল বিষয়ের মহাব্যবস্থাপক। আর আপনি তাঁর বান্দা চাইলে দিবেন আর না চাইলে দিবেন না। তিনি চাইলে আপনাকে ধনী বানাবেন আর চাইলে গরিব বানাবেন। তিনি চাইলে আপনাকে হেদায়েত দান করবেন আর চাইলে পথভ্রষ্ট করবেন। তিনি তাঁর হিকমত ও দয়ার দাবি মোতাবেক যা চাইবেন অপনার জন্যে তাই করবেন। শরিয়তগতভাবে আপনি তাঁর বান্দা; তাই তিনি যা বিধিবিধান করেছেন সে অনুযায়ী তাঁর ইবাদত করা আপনার প্রতি ওয়াজিব। তাঁর নির্দেশসমূহ আদায় করবেন ও নিষেধসমূহ ত্যাগ করবেন এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবেন যার ফলে দুনিয়া ও আখেরাতে সুখী হবে।


সমস্ত সৃষ্টিজীব আল্লাহর মুখাপেক্ষী:

তাদের মুখাপেক্ষীতা দুই প্রকার:

বাধ্যগত মুখাপেক্ষীতা - ইহা সমস্ত সৃষ্টিকুলের প্রতিপালকের মুখাপেক্ষীতা, তাদের অস্তিত্ব, চলাফেরা এবং যা তাদের প্রয়োজন তার জন্য।
নির্বাচিত মুখাপেক্ষীতা - আর ইহা দু’টি জিনিস জানার ফলাফল: বান্দার তার প্রতিপালকের পরিচয় জানা ও বান্দার তার নিজের পরিচয় জানা। অতএব, যে তার প্রতিপালককে সর্বতভাবে অমুখাপেক্ষী জানবে সে নিজেকে সর্বতভাবে মুখাপেক্ষী জানতে পারবে এবং বন্দেগির দরজাকে তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ করা পর্যন্ত নিজের প্রতি জরুরি করে নেবে।

আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اَنۡتُمُ الۡفُقَرَآءُ اِلَی اللّٰهِ ۚ وَ اللّٰهُ هُوَ الۡغَنِیُّ الۡحَمِیۡدُ ﴿۱۵﴾

‘‘হে মানুষ, তোমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আল্লাহ; তিনি অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।’’ [সূরা ফাতির:১৫] 

[1]. বুখারী হাঃ নং ২৮৫৬ ও মুসলিম হাঃ নং ৩০

শিরকের সংজ্ঞা: শির্ক হচ্ছে আল্লাহর রবূবিয়াতে (কাজে), আসমা ওয়াস্সিফাতে (নাম ও গুণাবলীতে) এবং উলূহিয়াতে (বান্দার সকল ইবাদতে) অথবা এর কোন একটিতে কোন কিছুকে শরিক স্থাপনের করার নাম। সুতরাং, মানুষ যখন এ বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহর সঙ্গে আর কেউ সৃষ্টিকর্তা বা সাহায্যকারী আছে তখন সে মুশরিক। আর যে এ বিশ্বাস করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কেউ ইবাদতের হকদার সেও মুশরিক। আর যে এ মনে করবে যে, আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে অন্য কেউ সদৃশ আছে সেও মুশরিক।

শির্কের ভয়াবহতা:

১. শিরক সবচেয়ে বড় জুলুম; কারণ ইহা আল্লাহর একান্ত বিশেষ হক তাওহীদের ব্যাপারে সীমালঙ্খন। তাওহীদ হলো সবচেয়ে বড় ইনসাফ। পক্ষান্তরে শিরক হলো সবচেয়ে বড় জুলুম ও ঘৃণ্যতা; কারণ এতে বিশ্ব জাহানের প্রতিপালককে ছোট করা হয় এবং তাঁর আনুগত্য থেকে অহংকার করা হয়। এ ছাড়া আল্লাহর বিশেষ হক অন্যের জন্য সাব্যস্ত করা হয়। শিরকের ভয়াবহতা কঠিন, যার ফলে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে মুশরিক হয়ে সাক্ষাৎ করবে তিনি তাকে কস্মিনকালেও ক্ষমা করবেন না।

যেমন আল্লাহর বাণী:

اِنَّ اللّٰهَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِهٖ وَ یَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰهِ فَقَدِ افۡتَرٰۤی اِثۡمًا عَظِیۡمًا ﴿۴۸﴾


‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে অংশীস্থাপন করলে তাকে ক্ষমা করবেন না এবং এর চেয়ে ছোট পাপ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন।’’ [সূরা নিসা: ৪৮]

শির্ক সবচেয়ে বড় জুলুম তথা অন্যায়। যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করল সে ইবাদতকে যথাস্থানে রাখল না এবং যে হকদার না তার জন্য নির্দিষ্ট করল, যা সবচেয়ে বড় জুলুম। যেমন আল্লাহর বাণী:

اِنَّ الشِّرۡکَ لَظُلۡمٌ عَظِیۡمٌ ﴿۱۳﴾

‘‘নিশ্চয় শিরক সবচেয়ে বড় জুলুম।’’ [সূরা লোকমান:১৩]

শির্ক সমস্ত সৎ আমলকে পন্ড করে দেয় এবং ধ্বংস ও ক্ষতিগ্রস্তের দিকে ঠেলে দেয়। আর ইহা সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ।

১. আল্লাহর বাণী:

وَ لَقَدۡ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ وَ اِلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ لَئِنۡ اَشۡرَکۡتَ لَیَحۡبَطَنَّ عَمَلُکَ وَ لَتَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ ﴿۶۵﴾

‘‘তোমার প্রতি ও তোমার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই অহি হয়েছে, তুমি আল্লাহর শরিক স্থির করলে তোমার কর্ম পন্ড হবে এবং তুমি হবে ক্ষতিগ্রস্ত। ’’ [সূরা জুমার: ৬৫]


عَنْ أَبِي بَكْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:্র أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ؟ ثَلَاثًا قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ:্র الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ وَجَلَسَ وَكَانَ مُتَّكِئًا فَقَالَ أَلاَ وَقَوْلُ الزُّورِ قَالَ فَمَا زَالَ يُكَرِّرُهَا حَتَّى قُلْنَا لَيْتَهُ سَكَتَ  متفق عليه.


২. আবু বাকরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) বলেছেন: আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় কবিরা গুনাহ সম্পর্কে জানিয়ে দেব না? রসূল (সা.) এভাবে তিনবার বললেন। তাঁরা (সাহাবাগণ) বললেন: হ্যাঁ, ইয়া রসূলাল্লাহ! তিনি বললেন: ‘‘আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, মা-বাবার অবাধ্য হওয়া। রসূল (সা.) এবার হেলান দেয়া অবস্থা থেকে উঠে বসে বললেন: সাবধান! মিথ্যা কথা থেকে সাবধান! বর্ণনাকারী বলেন: এ কথাটি রসূল (সা.) বারবার বলতেছিলেন এমনকি আমরা বলতে ছিলাম: হায়! যদি তিনি চুপ করতেন।’’[1]


শিরকের ঘৃণ্যতা ও কুপ্রভাব:

আল্লাহ তা‘য়ালা শিরকের চারটি ঘৃণ্যতা ও কু-পরিণতি সম্পর্কে চারটি আয়াতে উল্লেখ করেছেন তা হলো:

১. আল্লাহর বাণী:

اِنَّ اللّٰهَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِهٖ وَ یَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ یَّشَآءُ ۚ وَ مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰهِ فَقَدِ افۡتَرٰۤی اِثۡمًا عَظِیۡمًا ﴿۴۸﴾


‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে অংশীস্থাপন করলে তাকে ক্ষমা করবেন না এবং এর চেয়ে ছোট পাপ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন। আর যে শিরক করল সে বড় ধরনের অপবাদ ধারণ করল।’’ [সূরা নিসা: ৪৮]

আল্লাহর বাণী:

وَ مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰهِ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیۡدًا ﴿۱۱۶﴾

‘‘আর যে আল্লাহর সঙ্গে শিরক করল সে বহু দূরের ভ্রষ্টতায় পতিত হলো।’’ [ সূরা নিসা: ১১৬ ]

আল্লাহর বাণী:

اِنَّهٗ مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰهِ فَقَدۡ حَرَّمَ اللّٰهُ عَلَیۡهِ الۡجَنَّۃَ وَ مَاۡوٰىهُ النَّارُ ؕ وَ مَا لِلظّٰلِمِیۡنَ مِنۡ اَنۡصَارٍ ﴿۷۲﴾

‘‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর অংশীস্থাপন করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নামে। আর এরূপ অত্যাচারীদের জন্যে কোন সাহায্যকারী হবে না।’’  [সূরা মায়েদা:৭২]


আল্লাহর বাণী:

وَ مَنۡ یُّشۡرِکۡ بِاللّٰهِ فَکَاَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَآءِ فَتَخۡطَفُهُ الطَّیۡرُ اَوۡ تَهۡوِیۡ بِهِ الرِّیۡحُ فِیۡ مَکَانٍ سَحِیۡقٍ ﴿۳۱﴾


‘‘আর যে আল্লাহর সাথে শিরক করল; সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল। অত:পর মৃতভোজী পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোন দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।’’ [সূরা হাজ্ব: ৩১]

 

মুশরিকদের শাস্তি:

আল্লাহর বাণী:

اِنَّ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا مِنۡ اَهۡلِ الۡکِتٰبِ وَ الۡمُشۡرِکِیۡنَ فِیۡ نَارِ جَهَنَّمَ خٰلِدِیۡنَ فِیۡهَا ؕ اُولٰٓئِکَ هُمۡ شَرُّ الۡبَرِیَّۃِ ؕ﴿۶﴾

‘‘নিশ্চয় মুশরিক ও আহলে কিতাবের যারা কুফরি করেছে তাদের স্থান জাহান্নামে। সেখানে তারা চিরস্থায়ী অবস্থান করবে। তারাই হলো সর্বনিকৃষ্ট সৃষ্টিজীব।’’ [সূরা বাইয়িনা: ৬]

 

আরো আল্লাহর বাণী:

اِنَّ الَّذِیۡنَ یَکۡفُرُوۡنَ بِاللّٰهِ وَ رُسُلِهٖ وَ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یُّفَرِّقُوۡا بَیۡنَ اللّٰهِ وَ رُسُلِهٖ وَ یَقُوۡلُوۡنَ نُؤۡمِنُ بِبَعۡضٍ وَّ نَکۡفُرُ بِبَعۡضٍ ۙ وَّ یُرِیۡدُوۡنَ اَنۡ یَّتَّخِذُوۡا بَیۡنَ ذٰلِکَ سَبِیۡلًا ﴿۱۵۰﴾ۙ  اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡکٰفِرُوۡنَ حَقًّا ۚ وَ اَعۡتَدۡنَا لِلۡکٰفِرِیۡنَ عَذَابًا مُّهِیۡنًا ﴿۱۵۱﴾

‘‘যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী তদুপরি আল্লাহ ও রসূলের প্রতি বিশ্বাসে তারতম্য করতে চায় আর বলে যে, আমরা কতককে বিশ্বাস করি আর কতককে প্রত্যাখ্যান করি এবং এরই মধ্যবর্তী কোন পথ অবলম্বন করতে চায়। প্রকৃতপক্ষে এরাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী। আর যারা সত্য প্রত্যাখ্যানকারী তাদের জন্য তৈরী করে রেখেছি অপমানজনক আজাব।’’ [সূরা নিসা:১৫০-১৫১]

 

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ  قَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ :্রمَنْ مَاتَ وَهْوَ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ نِدًّا دَخَلَ النَّارَ  متفق عليه.

    আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী [সা.] বলেছেন:‘‘যে ব্যক্তি শিরক করা অবস্থায় মারা যাবে সে জান্নামে প্রবেশ করবে।’’[2]


শিরকের ভিত্তি:

শিরকের ভিত্তি ও ঘাঁটি যার উপর শিরকের বুনিয়াদ তা হলো গাইরুল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কেউ)-এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন। আর যে গাইরুল্লাহ এর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করবে, আল্লাহ তাকে যার সঙ্গে সে সম্পর্ক করেছে তার দিকে সোপর্দ করে দিবেন। তার দ্বারা তাকে শাস্তি দিবেন এবং যার সঙ্গে সম্পর্ক জুড়েছে সেদিক থেকে অপদস্ত করবেন। যার ফলে সে সবার নিকট ঘৃণিত হবে কেউ তার প্রশংসাকারী থাকবে না। অপদস্ত হবে কেউ তার সাহায্যকারী হবে না। যেমন আল্লাহ বলেন:

لَا تَجۡعَلۡ مَعَ اللّٰهِ اِلٰـهًا اٰخَرَ فَتَقۡعُدَ مَذۡمُوۡمًا مَّخۡذُوۡلًا ﴿۲۲﴾

‘‘আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করো না। তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে।’’ [সূরা বনি ইসরাঈল: ২২]


শিরকের সূক্ষ বুঝ:

আল্লাহর সাথে তাঁর নামসমূহ ও গুণাবলীতে, তাঁর বিধানে, তাঁর ইবাদতে শিরক করা। এ হলো শিরকের প্রকারসমূহ। প্রথমটি হলো রবুবিয়াতে শিরক। দ্বিতীয়টি হলো আনুগত্যে শিরক। তৃতীয়টি হলো ইবাদতে শিরক। আল্লাহ তা‘য়ালা হলেন সুমাহন একমাত্র প্রতিপালক এবং সমস্ত সৃষ্টিরাজির একমাত্র সৃষ্টিকর্তা।

আর আল্লাহর সাথে তাঁর বিধানে শিরক করা তাঁর ইবাদতে শিরক করার মতই। দু’টিই বড় শিরক যা মিল্লাতে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়; কারণ ইবাদত একমাত্র আল্লাহর হক যাঁর কোন শরিক নেই। যেমন আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

فَمَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلۡیَعۡمَلۡ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا ﴿۱۱۰﴾

‘‘অতএব, যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার পালনকর্তার ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।’’ [সূরা কাহাফ:১১০]

বিধান ফয়সালা করা একমাত্র আল্লাহর অধিকার। যেমন আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন:

لَهٗ غَیۡبُ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اَبۡصِرۡ بِهٖ وَ اَسۡمِعۡ ؕ مَا لَهُمۡ مِّنۡ دُوۡنِهٖ مِنۡ وَّلِیٍّ ۫ وَّ لَا یُشۡرِکُ فِیۡ حُکۡمِهٖۤ اَحَدًا ﴿۲۶﴾


‘‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান তাঁরই কাছে রয়েছে। তিনি কত চমৎকার দেখেন ও শোনেন। তিনি ব্যতীত তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। তিনি কাউকে নিজ কর্তেৃত্বে শরিক করেন না।’’ [সূরা কাহাফ:২৬]

যে কেউ আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান ছেড়ে অন্য কারো বিধান দ্বারা ফয়সালা করবে সে কাফের ও মুশরিক। আর তার প্রতিপালক হবে সেই যার দ্বারা ইবলীস শয়তান মানব রচিত বিধান প্রণয়ন করেছে। যেমন আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

اِتَّخَذُوۡۤا اَحۡبَارَهُمۡ وَ رُهۡبَانَهُمۡ اَرۡبَابًا مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَ الۡمَسِیۡحَ ابۡنَ مَرۡیَمَ ۚ وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡۤا اِلٰـهًا وَّاحِدًا ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ؕ سُبۡحٰنَهٗ عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ﴿۳۱﴾


‘‘তারা তাদের পন্ডিত ও দরবেশদেরকে তাদের পালনকর্তারূপে গ্রহণ করেছে আল্লাহ ব্যতীত এবং মরিয়মের পুত্রকেও। অথচ তারা আদিষ্ট ছিল একমাত্র মাবুদের ইবাদতের জন্য। তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তারা তাঁর শরিক সাব্যস্ত করে, তার থেকে তিনি পবিত্র।’’ [তাওবা:৩১]

আর শয়তানের ইবাদত হলো তার নিয়ম-কানুনে অনুগত হওয়া যার দ্বারা মানুষকে সে শিরকের দিকে টেনে নিয়ে যায়। আল্লাহ তা‘য়ালা এই শত্রু থেকে আমাদেরকে সাবধান করেছেন। যেমন আল্লাহর বাণী:

اَلَمۡ اَعۡهَدۡ اِلَیۡکُمۡ یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ اَنۡ لَّا تَعۡبُدُوا الشَّیۡطٰنَ ۚ اِنَّهٗ لَکُمۡ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ ﴿ۙ۶۰﴾  وَّ اَنِ اعۡبُدُوۡنِیۡ ؕؔ هٰذَا صِرَاطٌ مُّسۡتَقِیۡمٌ ﴿۶۱﴾


‘‘হে বনি আদম! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখেনি যে, শয়তানের ইবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। আর আমার ইবাদত কর। এটাই সরল পথ।’’ [সূরা ইয়াসীন:৬০-৬১]

আর যেসব কাফেররা মূর্তিকে সেজদা করে তারা কাফের ও ফাজের। যখন তারা আল্লাহর বিধান পরিবর্তন করে শয়তানের বিধানের অনুগত হয়েছে তখন তারা এর দ্বারা তাদের পুরাতন কুফরির সাথে নতুন আর এক কুফরি সংযুক্ত করেছে। যেমন আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন:

اِنَّمَا النَّسِیۡٓءُ زِیَادَۃٌ فِی الۡکُفۡرِ یُضَلُّ بِهِ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا یُحِلُّوۡنَهٗ عَامًا وَّ یُحَرِّمُوۡنَهٗ عَامًا لِّیُوَاطِـُٔوۡا عِدَّۃَ مَا حَرَّمَ اللّٰهُ فَیُحِلُّوۡا مَا حَرَّمَ اللّٰهُ ؕ زُیِّنَ لَهُمۡ سُوۡٓءُ اَعۡمَالِهِمۡ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الۡکٰفِرِیۡنَ ﴿۳۷﴾

‘‘এই মাস পিছিয়ে দেয়ার কাজ কেবল কুফরির মাত্রা বৃদ্ধি করে, যার ফলে কাফেররা গোমরাহীতে পতিত হয়। এরা হালাল করে নেয় একে এক বছর এবং হারাম করে নেয় অন্য বছর, যাতে তারা গণনা পূর্ণ করে নেয় আল্লাহর নিষিদ্ধ মাসগুলোকে। অত:পর হালাল করে নেয় আল্লাহর হারামকৃত মাসগুলোকে। তাদের মন্দ কাজগুলো তাদের জন্যে শোভনীয় করে দেয়া হল। আর আল্লাহ কাফের সম্প্রদায়কে হেদায়েত করেন না।’’ [সূরা তাওবা:৩৭]

[1]. বুখারী হাঃ নং ২৬৫৪ ও মুসলিম হাঃ নং ৮৭
[2]. বুখারী হাঃ নং ৪৪৯৭ ও মুসলিম হাঃ নং ৯২

শির্ক দু’প্রকার (১) বড় শির্ক। (২) ছোট শির্ক।

 

বড় শির্ক দ্বীন থেকে খারেজ করে দেয়, সমস্ত আমল পন্ড করে দেয় এবং তওবা ছাড়া মারা গেলে চিরস্থায়ী জাহান্নামী বানায়। আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য ইবাদত করা বড় শিরক। যেমন: গাইরুল্লাহকে আহবান করা। কবরবাসী, জ্বিন ও শয়তান ইত্যাদির নামে নজর-মান্নত মানা ও জবাই করা। অনুরূপ গাইরুল্লাহ এর নিকট এমন জিনিস চাওয়া যা তার শক্তির বাইরে। যেমন: অভাবমুক্ত, রোগ আরোগ্য, প্রয়োজন কামনা করা ও বৃষ্টি চাওয়া। এসব অজ্ঞ-মূর্খরা অলি ও নেককারদের কবরের পার্শ্বে বা গাছ ও পাথর ইত্যাদি মূর্তির নিকটে বলে ও করে থাকে।

বড় শির্কের কিছু প্রকার:

ভয়-ভীতিতে শির্ক: আল্লাহ ব্যতীত যেমন: মূর্তি বা তাগুত কিংবা মৃত বা অনুপস্থিত অলিদের কিংবা জ্বিন বা মানুষ  ক্ষতি বা অনিষ্ট করতে পারে বলে ভয় করা। এ ধরনের ভয়-ভীতির স্থান দ্বীন ইসলামে অনেক বড়। সুতরাং যে ইহা আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য করবে সে আল্লাহর সাথে বড় শিরক করল। আল্লাহ  এরশাদ করেন:

فَلَا تَخَافُوۡهُمۡ وَ خَافُوۡنِ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۱۷۵﴾

‘‘সুতরাং, তাদেরকে ভয় করা না বরং যদি তোমরা মু‘মিন হয়ে থাক তাহলে আমাকে ভয় কর।’’ [সূরা আল-ইমরান:১৭৫]

ভরসার মধ্যে শিরক: প্রতিটি বিষয়ে ও প্রতিটি অবস্থায় একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করা একটি বিরাট ইবাদত। ভরসা একমাত্র আল্লাহর উপর করা ওয়াজিব। সুতরাং যে ব্যক্তি গাইরুল্লাহ এর উপর এমন ব্যাপারে ভরসা করে যা তার ক্ষমতার বাইরে। যেমন: ক্ষতিকর জিনিস দূর করার জন্যে বা কল্যাণ ও রিজিক লাভের জন্য মৃত্যু ও অনুপস্থিত ইত্যাদির উপর ভরসা করা। এ ধরনের কাজ যে করবে সে বড় শিরক করল।

আল্লাহর বাণী:

وَ عَلَی اللّٰهِ فَتَوَکَّلُوۡۤا اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۲۳﴾

‘‘আর তোমরা একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা কর যদি তোমরা মু‘মিন হয়ে থাক।’’ [ সূরা মায়েদা: ২৩ ]

মহব্বত তথা ভালোবাসায় শির্ক: আল্লাহর ভালোবাসা যা পূর্ণ বিনয়তা ও পূর্ণ আনুগত্যকে বাধ্য করে। এ ভালোবাসা একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট। এর মধ্যে অন্য কাউকে শরিক করা হারাম। অতএব, যে ব্যক্তি আল্লাহর অনুরূপ আর কাউকে ভালোবাসল ও ভক্তি করল সে আল্লাহর সঙ্গে ভালোবাসা ও সম্মানে শিরক করল।

আল্লাহর বাণী :

وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّتَّخِذُ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ اَنۡدَادًا یُّحِبُّوۡنَهُمۡ کَحُبِّ اللّٰهِ

‘‘আর মানুষের মধ্যে এরূপ আছে- যারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে সদৃশ স্থির করে, আল্লাহকে ভালোবাসার ন্যায় তারা তাদেরকে ভালোবেসে থাকে।’’ [ সূরা বাকার: ১৬৫]

আনুগত্যে শির্ক: আনুগত্যে শিরকের মধ্যে যেমন: শারিয়তের নাফরমানি ও অবাধ্যতার বিষয়ে আলেম সমাজ, ইমাম, শাসনকর্তা, রাষ্ট্রপতি ও পীর-বুজুর্গদের আনুগত্য করা। আল্লাহর হারামকৃত বস্ত্তকে হালাল বা আল্লাহর হালালকৃত বিষয়কে হারাম করার ব্যাপারে তাদের আনুগত্য করা। অতএব, এ ব্যাপারে তাদের যে আনুগত্য করবে সে তাদেরকে বিধান রচনায় ও হালাল-হারাম করার ব্যাপারে আল্লাহর সঙ্গে শরিক বানালো। আর ইহা বড় শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

 

আল্লাহর বাণী:

اِتَّخَذُوۡۤا اَحۡبَارَهُمۡ وَ رُهۡبَانَهُمۡ اَرۡبَابًا مِّنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ وَ الۡمَسِیۡحَ ابۡنَ مَرۡیَمَ ۚ وَ مَاۤ اُمِرُوۡۤا اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡۤا اِلٰـهًا وَّاحِدًا ۚ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ ؕ سُبۡحٰنَهٗ عَمَّا یُشۡرِکُوۡنَ ﴿۳۱﴾


‘‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের আলেম, ধর্ম-যাজক ও মরয়মের ছেলে মাসীহকে রব তথা প্রতিপালক বানিয়ে নিয়েছে। অথচ তাদেরকে এক ইলাহ্ ছাড়া অন্য কোন ইলাহর ইবাদত করতে বলা হয়নি। তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ্ নেই। তারা যে সকল তাঁর শরিক সাব্যস্ত করে, তা থেকে তিনি পবিত্র।’’ [সূরা তাওবা: ৩১]


মুনাফেকি দু’প্রকার:

বড় মুনাফেকি: ইহা বিশ্বাসে মুনাফেকি, বাইরে ইসলাম প্রকাশ করে আর ভিতরে কুফরি গোপন করে রাখাকে বলে। এমন ব্যক্তি কাফের যার স্থান হবে জাহান্নামের সর্বনিম্নে ।

আল্লাহর বাণী:

اِنَّ الۡمُنٰفِقِیۡنَ فِی الدَّرۡکِ الۡاَسۡفَلِ مِنَ النَّارِ ۚ وَ لَنۡ تَجِدَ لَهُمۡ نَصِیۡرًا ﴿۱۴۵﴾ۙ

‘‘নিশ্চয় মুনাফেকরা জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্থানে থাকবে। আর আপনি তাদের জন্য কোন সাহায্যকারী পাবেন না।’’ [সূরা নিসা: ১৪৫]

ছোট মুনাফেকি: ইহা কাজ-কর্ম ইত্যাদির মধ্যে হয়ে থাকে। এমন ব্যক্তি মিল্লাতে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায় না কিন্তু পাপিষ্ঠ হয়।


عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ:     ্র أَرْبَعٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ كَانَ مُنَافِقًا خَالِصًا، ومَنْ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْهُنَّ كَانَتْ فِيهِ خَصْلَةٌ مِنْ النِّفَاقِ حَتَّى يَدَعَهَا، إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا أُئْـتُمِنَ خَانَ ،وَإِذَا عَاهَدَ غَدَرَ ، وَإِذَا خَاصَمَ فَجَرَ متفق عليه.

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী (সা.) বলেছেন: ‘‘যার মধ্যে চারটি অভ্যাস থাকবে সে সুস্পষ্ট মুনাফেক। আর যার মধ্যে এর কোন একটি পাওয়া যাবে সে সেটির মুনাফিক যতক্ষণ সেটি ত্যাগ না করে। যখন তার নিকট কোন আমানত রাখা হয় সে তার খেয়ানত করে। যখন কথা বলে তখন সে মিথ্যা বলে। যখন অঙ্গীকার করে তখন তা ভঙ্গ করে। আর যখন ঝগড়া করে তখন বাজে কথা বলে।’’ [1]

ছোট শিরক: ইহা তাওহীদকে হ্রাস করে দেয়। কিন্তু মিল্লাতে ইসলাম থেকে খারিজ তথা বের করে দেয় না। ইহা বড় শিরক পর্যন্ত পৌঁছানোর একটি শক্তিশালী মাধ্যম। ছোট শিরককারীকে শাস্তি ভোগ করতে হবে, তবে কাফেরদের মত চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে না। বড় শিরক সমস্ত আমলকে পন্ড করে দেয় কিন্তু ছোট শিরক শুধুমাত্র সে কাজটি পন্ড করে। কোন কাজ আল্লাহর জন্য ক’রে কিন্তু মানুষের প্রশংসা অর্জন করাও উদ্দেশ্য থাকে। যেমন: মানুষ দেখানো বা শুনানো কিংবা তাদের প্রশংসার জন্য সালাত সুন্দর করে আদায় করা কিংবা দান-খয়রাত করা, রোজা পালন করা আথবা জিকির-আজকার করা। একে বলা হয় ‘‘রিয়া’’ তথা লোক দেখানো আমল যার সংমিশ্রণে আমল বাতিল হয়ে যায়।

আল্লাহর বাণী:

قُلۡ اِنَّمَاۤ اَنَا بَشَرٌ مِّثۡلُکُمۡ یُوۡحٰۤی اِلَیَّ اَنَّمَاۤ اِلٰـهُکُمۡ اِلٰهٌ وَّاحِدٌ ۚ فَمَنۡ کَانَ یَرۡجُوۡا لِقَآءَ رَبِّهٖ فَلۡیَعۡمَلۡ عَمَلًا صَالِحًا وَّ لَا یُشۡرِکۡ بِعِبَادَۃِ رَبِّهٖۤ اَحَدًا ﴿۱۱۰﴾


‘‘বলুন! আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের ইলাহ এক ইলাহ্। অতএব, যে ব্যক্তি তার রবের সাক্ষাত কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে।’’ [ সূরা কাহাফ: ১১০]


عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ  قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: ্র قَالَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنْ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيهِ مَعِي غَيْرِي تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ أخرجه مسلم.

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: আল্লাহ তাবারক ওয়া তা‘য়ালা বলেন:‘‘আমি সর্বপ্রকার শরিক থেকে অমুখাপেক্ষী। যে ব্যক্তি কোন আমলে আমার সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করে আমি তাকে ও তার শিরককে ত্যাগ করি।’’ [2]

ছোট শিরকের মধ্যে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করা। অনুরূপভাবে কারো কথা ‘‘আল্লাহ এবং অমুকের ইচ্ছায়’’ বা ‘‘যদি আল্লাহ ও ঐ ব্যক্তি না হতো’’ অথবা ‘‘ইহা আল্লাহ ও উমুক ব্যক্তির পক্ষ থেকে’’ কিংবা ‘‘আমার আল্লাহ ও উমুক ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ নেই’’ ইত্যাদি বলা। ওয়াজিব হলো: ‘‘আল্লাহ যা চেয়েছেন অত:পর অমুক যা চেয়েছে’’ এমন বলা।


عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ:্র مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ كَفَرَ أَوْ أَشْرَكَ  أخرجه أبو داود والترمذي.

১. ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ [সা.]কে বলতে শুনেছি: ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করল সে কুফরি অথবা শির্ক করল।’’ [3]


عَنْ حُذَيْفَةَ  عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ:্র لَا تَقُولُوا: مَا شَاءَ اللَّهُ وَشَاءَ فُلَانٌ ، وَلَكِنْ قُولُوا: مَا شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ شَاءَ فُلَانٌ أخرجه أحمد وأبوداود.

২. হুযাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (সা.) বলেছেন:‘‘তোমরা ‘‘আল্লাহ যা চেয়েছেন এবং অমুক যা চেয়েছে’’ বলো না। বরং ‘‘আল্লাহ যা চেয়েছেন অতঃপর অমুক যা চেয়েছে’’ বল।’’[4]

ছোট শিরক কখনো বড় শিরকে পরিণত হতে পারে। আর ইহা শিরককারীর অন্তরের ব্যাপার। অতএব, ছোট-বড় সর্বপ্রকার শিরক থেকে প্রতিটি মুসলিমের সতর্ক থাকা ফরজ; কারণ শিরক বড় জুলুম যা আল্লাহ কখনো ক্ষমা করবেন না। যেমন আল্লাহর বাণী:

اِنَّ اللّٰهَ لَا یَغۡفِرُ اَنۡ یُّشۡرَکَ بِهٖ وَ یَغۡفِرُ مَا دُوۡنَ ذٰلِکَ لِمَنۡ یَّشَآءُ

‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে অংশীস্থাপন করলে তাকে ক্ষমা করবেন না এবং এর চেয়ে ছোট পাপ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করবেন।’’ [সূরা নিসা আয়াত: ৪৮]


কিছু শিরকি কথা বা মাধ্যম:

কিছু কথা বা কাজ আছে যা বড় ও ছোট শিরকের মধ্যে আবর্তন-বিবর্তন করে। এটা যার দ্বারা ঘটবে তার অন্তরের উপর নির্ভর করবে। ইহা সঠিক আকীদার পরিপন্থী কাজ অথবা আকীদার মধ্যে কলুষ যা থেকে শরীয়ত সাবধান করে দিয়েছে। এগুলোর মধ্যে যেমন:

১. বালা ও সুতা প্রভৃতি আপদ-বিপদ দূর করা অথবা স্পর্শ না করার জন্য ব্যবহার করা।

২. সন্তানদের শরীরে তাবিজ-কবজ ঝুলানো। চাই তা পুঁতি হোক বা হাড় কিংবা কোন কিছুতে লিখা হোক যা বদ নজর ইত্যাদি থেকে বাঁচার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ইহা নিঃসন্দেহে শিরক।

৩. পাখী বা ব্যক্তি কিংবা কোন স্থান ইত্যাদির মাধ্যমে অশুভ বা কুলক্ষণ মনে করা যা শিরক; কারণ এর সম্পর্ক গাইরুল্লাহ এর সাথে জড়ানো হয়। এ বিশ্বাস করে যে তার দ্বারা ক্ষতি হয়। কিন্তু তা একটি সৃষ্টি যার ভাল-মন্দ করার কোন ক্ষমতা নেই। ইহা শয়তানের পক্ষ থেকে মানুষের অন্তরে এক প্রকার ওয়াসওয়াসা তথা কুমন্ত্রনা যা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ভরসার বিপরীত আকীদা।

৪. গাছ, পাথর, নির্দশন ও কবর ইত্যাদি দ্বারা বরকত হাছিল করা। এ ধরনের জিনিস থেকে বরকত চাওয়া ও আশা করা শিরকি আকীদা; কারণ এর দ্বারা গাইরুল্লাহ তথা আল্লাহ ছাড়া অন্যের সাথে সম্পর্ক জোড়া ও বরকত হাছিল করাই প্রমাণ করে।

৫. জাদু: ইহা হচ্ছে যার কারণ গোপনীয় ও সূক্ষ্ণ। ইহা বিপদ দূর করার বাক্য, মন্ত্র, বাণী ও ঔষধ যা অন্তর ও শরীরে প্রভাব ফেলে। যার ফলে অসুস্থ হয় কিংবা হত্যা করা হয় অথবা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে। ইহা শয়তানী কাজ। জাদু বেশির ভাগ শিরকের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। জাদু এক প্রকার শিরক; কারণ এর মধ্যে গাইরুল্লাহ তথা শয়তানের সাথে সম্পর্ক রয়েছে এবং ইলমে গায়বের (অদৃশ্যের জ্ঞান) দাবী করা হয়। আল্লাহ এরশাদ করেন:

وَ مَا کَفَرَ سُلَیۡمٰنُ وَ لٰکِنَّ الشَّیٰطِیۡنَ کَفَرُوۡا یُعَلِّمُوۡنَ النَّاسَ السِّحۡرَ

‘‘সুলাইমান কুফরি করে নাই বরং শয়তানরা কুফরি করেছে। যারা মানুষদেরকে জাদু শিক্ষা দিয়েছে।’’ [ সূরা বাকারা: ১০২]

আর জাদু কখনো কবিরা গুনাহ হয় যদি তা শুধু ঔষধ ও প্রতিষেধক হয়।

৬. গণকী ব্যবসা: শয়তানের সাহায্যে ভবিষ্যতে ঘটবে এমন ইলমে গায়ব তথা অদৃশ্যের জ্ঞান দাবী করে খবর দেয়া। ইহা শিরক; কারণ এতে গাইরুল্লাহ (আল্লাহ ব্যতীত অন্যের) নৈকট্য লাভ করা হয় এবং ইলমে গায়বের ব্যাপারে আল্লাহর সাথে শরিক দাবি করা হয়।


عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ وَالْحَسَنِ  عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ:্র مَنْ أَتَى كَاهِنًا أَوْ عَرَّافًا فَصَدَّقَهُ بِمَا يَقُولُ، فَقَدْ كَفَرَ بِمَا أُنْزِلَ عَلَى مُحَمَّدٍ  أخرجه أحمد والحاكم.

আবু হুরাইরা ও হাসান (রাঃ) থেকে বর্ণিত তাঁরা নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (সা.) বলেছেন:‘‘যে ব্যক্তি কোন গণক বা জ্যোতিষীর নিকটে যায় অতঃপর সে যা বলে তা বিশ্বাস করে, সে মুহাম্মদ (সা.) -এর উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তার সাথে কুফরি করল।’’[5]

৭. জ্যোতিষিক: সৌর জগতের অবস্থার আলোকে পৃথিবীতে বিভিন্ন পরিবর্তনের ভবিষ্যদ্বাণী করা। যেমন: ঝড়-বাতাস, বৃষ্টি বর্ষণ, রোগ, মৃত্যুর সময় ও ঠান্ডা-গরমের প্রকাশ এবং বিশ্ব-বাজারের মূল্য ইত্যাদি পরিবর্তন সম্পর্কে বাণী দেওয়া। ইহা শিরক; কারণ এর দ্বারা বিশ্ব-ব্যবস্থাপনা ও ইলমে গায়বে তথা অদৃশ্যের জ্ঞানে আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করা হয়।

৮. নক্ষত্র দ্বারা বৃষ্টি কামনা করা: তারকারাজির উঠা-ডুবার সাথে বৃষ্টি বর্ষণের সম্পর্ক করা। যেমন বলা: আমরা অমুক তারকার মাধ্যমে বৃষ্টি পেয়েছি। এখানে বৃষ্টি বর্ষণের সম্পর্ক আল্লাহর সাথে না করে তারকার সঙ্গে জুড়েছে যা বড় শিরক; কারণ বৃষ্টি বর্ষণ আল্লাহর হাতে কোন তারকার সাথে সম্পর্ক বা অন্যের হাতে নয়।

৯. নেয়ামতের সম্পর্ক গাইরুল্লাহর দিকে করা: দুনিয়া-আখেরাতে সকল প্রকার নেয়ামত একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে। অতএব, যে ব্যক্তি কোন নেয়ামতের সম্পর্ক গাইরুল্লাহর সাথে করবে সে শিরক ও কুফরি করল। যেমন: সম্পদ অর্জন অথবা আরোগ্য লাভের সম্পর্ক আল্লাহ ছাড়া অন্যের সঙ্গে করা। জলে-স্থলে ও নৌপথে নিরাপদে চলাফেরার নেয়ামতকে চালক, মাঝি ও পাইলটের সাথে করা। বিভিন্ন ধরনের নেয়ামত হাছিল এবং শত্রুতা ও শাস্তির প্রতিরক্ষাকে সরকারী বা ব্যক্তি কিংবা পতাকা ইত্যাদির সাথে সম্পর্ক জুড়া।  

ফরজ হলো প্রতিটি নেয়ামতের সম্পর্ক একমাত্র আল্লাহর সাথে করা এবং একমাত্র তাঁরই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। আর যা কিছু কোন সৃষ্টির হাতে সম্পাদন হয় তা শুধু কারণ মাত্র যা কখনো ফলদায়ক হয় আর কখনো হয় না। আবার কখনো উপকারে আসে আবার কখনো অপকারে আসে।

আল্লাহ তা‘য়ালা এরশাদ করেন:

وَ مَا بِکُمۡ مِّنۡ نِّعۡمَۃٍ فَمِنَ اللّٰهِ ثُمَّ اِذَا مَسَّکُمُ الضُّرُّ فَاِلَیۡهِ تَجۡـَٔرُوۡنَ ﴿ۚ۵۳﴾

‘‘তোমাদের কাছে যে সমস্ত নেয়ামত আছে, তা আল্লাহরই পক্ষ থেকে। অতঃপর তোমাদেরকে যখন দুঃখ-কষ্ট স্পর্শ করে তখন তাঁরই নিকট কান্নাকাটি কর।’’ [ সূরা নাহল: ৫৩]


ছবি তুলার বিধান:

আত্মা আছে এমন প্রতিটি জীবের ছবি উঠানো হারাম। বরং কবিরা গুনাহ। দ্বীন ও চরিত্র বিনষ্টের জন্য সব সময় সকল প্রকার ছবির বিরাট প্রভাব রয়েছে।

প্রথমত: ছবিই জমিনে সর্বপ্রথম শিরকের কারণ। আর এ ছিল নূহ (আঃ)-এর জাতির নেক-বুজুর্গদের ছবি-মূর্তি অঙ্কন করা। নেক লোকদের নাম হলো: ওয়াদ্দ, সুওয়া‘, ইয়াগুস, ইয়াউক ও নাসর। এ ছিল এক নেক উদ্দেশ্য আর তা হলো: যাতে করে তারা তাদেরকে দেখে জিকির ও ইবাদতে উৎসাহ ও উদ্দীপনা পায়। এরপর লম্বা সময় অতিবাহিত হয় এবং তারা গাইরুল্লাহর ইবাদত আরম্ভ করে। তাই দুনিয়াতে তাওহীদের প্রতি সর্বপ্রথম শিরকী অন্যায় ছিল ছবি তুলা।

দ্বিতীয়ত: ছবি তুলা দ্বীনের বিপর্যয়, চরিত্র ধ্বংস, নোংরা বিস্তার এবং মহৎ গুণ বিনষ্টের এক বিরাট কারণ। নারীদের উলঙ্গ ও বেপর্দা ছবি তুলে যুবকদের যৌন চহিদার সামনে সমপ্রচার করে তাদের দ্বীন ও চরিত্র ধ্বংস করা হচ্ছে যা চরিত্রের প্রতি এক বিরাট অবিচার। আর বিপর্যয় দূর করা কোন কল্যাণকর বয়ে নিয়ে আসার পূর্বের কাজ। আর যে জিনিস হারামের দিকে নিয়ে যায় তাও হারাম। তাই যদি সেটা হরাম জিনিস হয় এবং অন্য আর এক হারামের দিকে নিয়ে যায় তাহলে তার বিধান কি হওয়া উচিত?!

১. আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

وَ مَنۡ یَّعۡصِ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ یَتَعَدَّ حُدُوۡدَهٗ یُدۡخِلۡهُ نَارًا خَالِدًا فِیۡهَا ۪ وَ لَهٗ عَذَابٌ مُّهِیۡنٌ ﴿۱۴﴾

‘‘যে কেউ আল্লাহ ও রসূলের অবাধ্যতা করে এবং তার সীমা অতিক্রম করে তিনি তাকে আগুনে প্রবেশ করাবেন। সে সেখানে চিরকাল থাকবে। তার জন্যে রয়েছে অপমানজনক শাস্তি।’’ [সূরা নিসা:১৪]


عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:« أَشَدُّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمُصَوِّرُونَ».متفق عليه.

২. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (রাঃ) বলেছেন:‘‘কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন আজাব হবে ছবি অঙ্কনকারীদের।’’[6]


عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ:    «قَالَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ ذَهَبَ يَخْلُقُ كَخَلْقِي فَلْيَخْلُقُوا ذَرَّةً أَوْ لِيَخْلُقُوا حَبَّةً أَوْ شَعِيرَةً».متفق عليه.

৩. আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন আমি নবী (রাঃ) কে বলতে শুনেছি:‘‘আল্লাহ তা‘য়ালা বলেন: ওর চাইতে বড় জালেম কে হতে পারে, যে আমার সৃষ্টির মত সৃষ্টি করে। সে তার একটি অণু সৃষ্টি করুক তো বা একটি দানা বা জব সৃষ্টি করুক তো।’’[7]

[1]. বুখারী হাঃ নং ৩৪ ও মুসলিম হাঃ নং ৫৮
[2]. মুসলিম হাঃ নং ২৯৮৫
[3]. হাদীসটি সহীহ, আবু দাঊদ হাঃ নং ৩২৫১, তিরমিযী হাঃ নং ১৫৩৫ শব্দ তারই
[4]. হাদীসটি সহীহ, আহমাদ হাঃ নং ২৩৫৪, সিলসিলা সহীহা হাঃ নং ১৩৭ দ্রঃ, আবু দাঊদ হাঃ নং ৪৯৮০ শব্দ তারই
[5].হাদীসটি সহীহ, আহমাদ হাঃ নং ৯৫৩৬ শব্দ তারই, হাকেম হাঃ নং ১৫ ও ইরওয়াউল গালীল হাঃ নং ২০০৬ দ্রঃ
[6]. বুখারী হা: নং ৫৯৫০ মুসলিম হা: নং ২১০৯
[7]. বুখারী হা: নং ৭৫৫৯ মুসলিম হা: নং ২১১১

বন্ধুত্ব ও দোস্তী হলো: মুমিনদেরকে ভালবাসা, সাহায্য করা, সম্মান ও ইজ্জত করা।

দুশমনি ও শত্রুতা হলো: কাফেরদের থেকে দূরে ও সম্পর্ক ছিন্ন করা। এ ছাড়া তাদেরকে ভয় প্রদর্শন ও ওজরের পরে তাদের সাথে দুশমনি ও শত্রুতা রাখা।

মিত্রতা হলো আল্লাহ ও তাঁর দ্বীন, রসূল ও অলিদের ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ। আর শত্রুতা হলো বাতিল ও তার পরিবারকে ঘৃণার চিত্র ও দৃশ্য।

মিত্রতা ও শত্রুতা তাওহীদের বিশাল একটি বিষয়; কারণ ইহাই হচ্ছে তাওহীদ, ঈমান, আনুগত্য, তাকওয়া এবং বন্ধুত্ব ও দুশমনি। আর দুনিয়া ও আখেরাতে নিরাপত্তা বাস্তবায়ন হবে ঈমান ও শিরক ও মুশরেকদের সাথে দুশমনি দ্বারাই। আর জমিনে তাওহিদী কালেমা ততক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হবে না যতক্ষণ মিত্রদের সাথে মিত্রতা এবং শত্রুদের সাথে শত্রুতা করা না হবে।

১. আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

اِنَّمَا وَلِیُّکُمُ اللّٰهُ وَ رَسُوۡلُهٗ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا الَّذِیۡنَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ هُمۡ رٰکِعُوۡنَ ﴿۵۵﴾  وَ مَنۡ یَّتَوَلَّ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا فَاِنَّ حِزۡبَ اللّٰهِ هُمُ الۡغٰلِبُوۡنَ ﴿۵۶﴾

‘‘তোমাদের বন্ধু আল্লাহ, তাঁর রসূল এবং মুমিনরা-যারা সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং বিনম্র। আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূল এবং মুমিনদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে, তারাই আল্লাহর দল এবং তারাই বিজয়ী।’’ [সূরা মায়েদা:৫৫-৫৬]

২. আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوا الَّذِیۡنَ اتَّخَذُوۡا دِیۡنَکُمۡ هُزُوًا وَّ لَعِبًا مِّنَ الَّذِیۡنَ اُوۡتُوا الۡکِتٰبَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ وَ الۡکُفَّارَ اَوۡلِیَآءَ ۚ وَ اتَّقُوا اللّٰهَ اِنۡ کُنۡتُمۡ مُّؤۡمِنِیۡنَ ﴿۵۷﴾

‘‘হে মুমিনগণ, আহলে কিতাবদের মধ্য থেকে যারা তোমাদের ধর্মকে উপহাস ও খেলা করে, তাদেরকে এবং অন্যান্য কাফেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। আল্লাহকে ভয় কর, যদি তোমরা ঈমানদার হও।’’ [সূরা মায়েদা:৫৭]

৩. আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

قَدۡ کَانَتۡ لَکُمۡ اُسۡوَۃٌ حَسَنَۃٌ فِیۡۤ اِبۡرٰهِیۡمَ وَ الَّذِیۡنَ مَعَهٗ ۚ اِذۡ قَالُوۡا لِقَوۡمِهِمۡ اِنَّا بُرَءٰٓؤُا مِنۡکُمۡ وَ مِمَّا تَعۡبُدُوۡنَ مِنۡ دُوۡنِ اللّٰهِ ۫ کَفَرۡنَا بِکُمۡ وَ بَدَا بَیۡنَنَا وَ بَیۡنَکُمُ الۡعَدَاوَۃُ وَ الۡبَغۡضَآءُ اَبَدًا حَتّٰی تُؤۡمِنُوۡا بِاللّٰهِ

‘‘তোমাদের জন্যে ইবরাহীম ও তাঁর সংঙ্গীগণের মধ্যে চমৎকার আদর্শ রয়েছে। তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল: তোমাদের সাথে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইবাদত কর, তার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে মানিনা। তোমরা এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন না করলে তোমাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে চিরশত্রুতা থাকবে।’’ [সূরা মুমতাহিনাহ:৪]


কার্যকর মূলনীতিসমূহ যার দ্বারা বাস্তবায়িত হবে মিত্রতা ও শত্রুতা:

তাওহিদী কলেমা নিম্নের বিষয়াদিতে দোস্তী ও দুশমনি দাবী রাখে:

প্রথমত: মুমিনদের সাথে বন্ধুত্ব এবং কাফেরদের সাথে শত্রুতা রাখা। এ ছাড়া আল্লাহর শরিয়তের আনুগত্য এবং আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান দ্বারা ফয়সালা করা আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা এবং তাগূতকে অস্বীকার করা।

আল্লাহ তা‘য়ার বাণী:

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوا الۡیَهُوۡدَ وَ النَّصٰرٰۤی اَوۡلِیَآءَ ۘؔ بَعۡضُهُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّهُمۡ مِّنۡکُمۡ فَاِنَّهٗ مِنۡهُمۡ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا یَهۡدِی الۡقَوۡمَ الظّٰلِمِیۡنَ ﴿۵۱﴾


‘‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহুদি ও খ্রীষ্টানদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ জালেমদেরকে পথ প্রদর্শন করেন না।’’ [সূরা মায়েদা:৫১]

দ্বিতীয়ত: তাওহীদের সাক্ষ্য (লা ইলাহা ইল্লাল্লাাহ, মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ) একজন মুসলিমকে তাঁর মুসলিম ভাইয়ের সাথে বাস্তবে বন্ধুত্ব রাখা ওয়াজিব করে দেয়। আর জাহেলিয়াতের সমস্ত গোত্রীয়তাবাদ, জাতীয়তাবাদ ও বর্ণবাদের বন্ধুত্বকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। একজন মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই চাই সে যেখানেই হোক না কেন। আর ইসলামী রাষ্ট্র মুসলিমের রাষ্ট্র তা পৃথিবীর যে কোন স্থানে হোক না কেন।

আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

وَ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ الۡمُؤۡمِنٰتُ بَعۡضُهُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ۘ یَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ یَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ یُؤۡتُوۡنَ الزَّکٰوۃَ وَ یُطِیۡعُوۡنَ اللّٰهَ وَ رَسُوۡلَهٗ ؕ اُولٰٓئِکَ سَیَرۡحَمُهُمُ اللّٰهُ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَزِیۡزٌ حَکِیۡمٌ ﴿۷۱﴾


‘‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকর্মের আদেশ ও অসৎকর্মের নিষেধ করে। আর সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য করে। এদেরই উপর আল্লাহ দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্ররাক্রমশালী, সুকৌশলী।’’ [সূরা তাওবাহ:৭১]

আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَتَّخِذُوۡۤا اٰبَآءَکُمۡ وَ اِخۡوَانَکُمۡ اَوۡلِیَآءَ اِنِ اسۡتَحَبُّوا الۡکُفۡرَ عَلَی الۡاِیۡمَانِ ؕ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّهُمۡ مِّنۡکُمۡ فَاُولٰٓئِکَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ ﴿۲۳﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা স্বীয় পিতা, ও ভাইদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরকে ভালবাসে। আর তোমাদের যারা তাদের অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা সীমালঙ্ঘনকারী।’’ [সূরা তাওবাহ:২৩]

তৃতীয়ত: দ্বীনের নিদর্শনাবলি, বিধানসমূহ ও সমস্ত আদব প্রকাশ করা। আর আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নত দ্বারা মুসলিমের পার্থক্যকরণ ও সম্মানবোধ করা। এ ছাড়া কুরআন-সুন্নার বিপরীত সকল চিন্তা, কথা ও কাজ পরিহার করা। আর নব জাহেলিয়াতকে শূন্য করা ও তার জালিয়াতির মুখোশ খুলে দেয়া; যাতে করে মানুষ তার ধোকায় না পড়ে।

আল্লাহ তা‘য়ালা বাণী:

قُلۡ اِنَّ صَلَاتِیۡ وَ نُسُکِیۡ وَ مَحۡیَایَ وَ مَمَاتِیۡ لِلّٰهِ رَبِّ الۡعٰلَمِیۡنَ ﴿۱۶۲﴾ۙ  لَا شَرِیۡکَ لَهٗ ۚ وَ بِذٰلِکَ اُمِرۡتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الۡمُسۡلِمِیۡنَ ﴿۱۶۳﴾


‘‘বলুন! আমার সালাত, আমার কুরবানি, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছুই একমাত্র বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন শরিক নেই, আর এরই আদেষ্টিত হয়েছি এবং আমিই সর্বপ্রথম মুসলিম।’’ [সূরা আন‘আম:১৬২-১৬৩]

চতুর্থত: পৃথিবীর যে কোন স্থানের মাজলুম মুসলিমদের সাহায্য করা। এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই তার প্রতি ওয়াজিব হলো তার পাশে দাঁড়ানো। এ ছাড়া প্রতিটি স্থানে ও ব্যাপারে তাকে অর্থ, হাত ও জবান দ্বারা সাহায্য করা জরুরি।

আর তাওহীদের পরে সবচেয়ে বড় ওয়াজিব হলো আল্লাহর অলিদেরকে সাহায্য করা তাতে সে যেই হোক ও যেখানেই হোক না কেন। আর শয়তানের অলিদের সাথে শত্রুতা রাখা তাতে সে যেই হোক ও যেখানেই হোক না কেন। যদি উম্মতে মুসলিমা এ দায়িত্ব পালন না করে তবে নিজেদেরকে ফেতনা ও বিশাল বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেবে।

আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

اِنَّ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ هَاجَرُوۡا وَ جٰهَدُوۡا بِاَمۡوَالِهِمۡ وَ اَنۡفُسِهِمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ الَّذِیۡنَ اٰوَوۡا وَّ نَصَرُوۡۤا اُولٰٓئِکَ بَعۡضُهُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ؕ وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ لَمۡ یُهَاجِرُوۡا مَا لَکُمۡ مِّنۡ وَّلَایَتِهِمۡ مِّنۡ شَیۡءٍ حَتّٰی یُهَاجِرُوۡا ۚ وَ اِنِ اسۡتَنۡصَرُوۡکُمۡ فِی الدِّیۡنِ فَعَلَیۡکُمُ النَّصۡرُ اِلَّا عَلٰی قَوۡمٍۭ بَیۡنَکُمۡ وَ بَیۡنَهُمۡ مِّیۡثَاقٌ ؕ وَ اللّٰهُ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ بَصِیۡرٌ ﴿۷۲﴾  وَ الَّذِیۡنَ کَفَرُوۡا بَعۡضُهُمۡ اَوۡلِیَآءُ بَعۡضٍ ؕ اِلَّا تَفۡعَلُوۡهُ تَکُنۡ فِتۡنَۃٌ فِی الۡاَرۡضِ وَ فَسَادٌ کَبِیۡرٌ ﴿ؕ۷۳﴾

‘‘এতে কোন সন্দেহ নেই যে, যারা ঈমান এনেছে, দেশ ত্যাগ করেছে, স্বীয় জানমাল দ্বারা আল্লাহর রাহে জিহাদ করেছে এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় ও সাহায্য সহায়তা দিয়েছে, তারা একে অপরের বন্ধু। আর যারা ঈমান এনেছে কিন্তু দেশত্যাগ করেনি তাদের বন্ধুত্বে তোমাদের প্রয়োজন নেই যতক্ষণ না তারা দেশত্যাগ করে। অবশ্য যদি তারা ধর্মীয় ব্যাপারে তোমাদের সহায়তা কামনা করে, তবে তাদের সাহায্য করা তোমাদের কর্তব্য। কিন্তু তোমাদের সাথে যাদের সহযোগী চুক্তি বিদ্যমান রয়েছে, তাদের মোকাবেলায় নয়। বস্ত্তত: তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সে সবই দেখেন। আর যারা কাফের তারা পারস্পরিক বন্ধু। তোমরা যদি এমন ব্যবস্থা না কর, তবে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বিস্তার লাভ করবে এবং  দেশময় বড়ই অকল্যাণ হবে।’’ [সূরা আনফাল:৭২-৭৩]

পঞ্চমত: মুমিনদেরকে আশান্বিত করা এবং আল্লাহর সাহায্য তাঁর অলিদের জন্য অতি নিকটে তার সুসংবাদ দেয়া। এ ছাড়া আল্লাহর দুশমন কাফেরদের জন্য লাঞ্ছনা অতি নিকটে তারও খবর দেয়া।

আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

وَ لَیَنۡصُرَنَّ اللّٰهُ مَنۡ یَّنۡصُرُهٗ ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَقَوِیٌّ عَزِیۡزٌ ﴿۴۰﴾  اَلَّذِیۡنَ اِنۡ مَّکَّنّٰهُمۡ فِی الۡاَرۡضِ اَقَامُوا الصَّلٰوۃَ وَ اٰتَوُا الزَّکٰوۃَ وَ اَمَرُوۡا بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ نَهَوۡا عَنِ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ لِلّٰهِ عَاقِبَۃُ الۡاُمُوۡرِ ﴿۴۱﴾

‘‘আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন, যারা আল্লাহর সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ প্ররাক্রমশালী, শক্তিধর। তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ্য দান করলে তারা সালাত কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করে। প্রত্যেক কর্মের পরিণাম আল্লাহর এখতিয়ারভুক্ত।’’ [সূরা হাজ্ব:৪০-৪১]

নিঃসন্দেহে পরিণাম মুত্তাকীন এবং সাহায্য ধৈর্যশীল ও ঈমানদার আল্লাহর অলিগণের জন্য অবধারতি।


আল্লাহ তা‘য়ালার বাণী:

فِیۡ بِضۡعِ سِنِیۡنَ ۬ؕ لِلّٰهِ الۡاَمۡرُ مِنۡ قَبۡلُ وَ مِنۡۢ بَعۡدُ ؕ وَ یَوۡمَئِذٍ یَّفۡرَحُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ ۙ﴿۴﴾ بِنَصۡرِ اللّٰهِ ؕ یَنۡصُرُ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ هُوَ الۡعَزِیۡزُ الرَّحِیۡمُ ۙ﴿۵﴾ وَعۡدَ اللّٰهِ ؕ لَا یُخۡلِفُ اللّٰهُ وَعۡدَهٗ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ ﴿۶﴾

‘‘অগ্র-পশ্চাতের কাজ আল্লাহর হাতেই। সেদিন মুমিনগণ আনন্দিত হবে। আল্লাহর সাহায্যে, তিনি যাকে ইচ্ছা সাহায্য করেন এবং তিনি পরাক্রমশীল, পরাম দয়ালু। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি হয়ে গেছে, আল্লাহ তাঁর প্রতিশ্রুতি খেলাফ করবেন না। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না।’’ [সূরা রূম: ৪-৬]

ইসলাম হলো: একত্ববাদের সাথে একমাত্র আল্লাহর জন্য আত্মসমর্পণ করা, ইবাদতের দ্বারা তাঁর আনুগত্য করা এবং শিরক ও মুশরেকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা।

মানবজাতির ইসলামের প্রয়োজনীয়তা:

মানব জাতির দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ ইসলাম ছাড়া সম্ভব নয়। ইসলাম মানব জাতির জীবনে পানাহার ও আবহাওয়ার চেয়েও বেশি প্রয়োজন। প্রতিটি মানুষ শরীয়তের মুখাপেক্ষী। মানুষের গতি দু’টি অবস্থার মধ্যে আবর্তন-বিবর্তন করে। প্রথমটি হলো: এমন গতি যার মাধ্যমে তার জন্যে লাভজনক জিনিস বয়ে আনে। দ্বিতীয়টি হলো: এমন গতি যার দ্বারা তার জন্যে যা ক্ষতিকর তা প্রতিহত করে। ইসলাম এমন এক আলো যা তার জন্য উপকার ও অপকার সবই বর্ণনা করে দেয়।

দ্বীন ইসলামের তিনটি স্তর রয়েছে তা হলো: ইসলাম, ঈমান ও এহ্সান। প্রতিটি স্তরের আবার কিছু রোকন রয়েছে।


ইসলাম, ঈমান ও এহসানের মধ্যে পার্থক্য:

১. যদি ইসলাম ও ঈমান দু’টি শব্দ একত্রে উল্লেখ হয় তবে ইসলাম শব্দের উদ্দেশ্য হলো: বাহ্যিক কার্যাদি তা হলো পাঁচটি রোকন। আর ঈমান শব্দের উদ্দেশ্য গোপনীয় কার্যাদি তা হলো ছয়টি রোকন। আর যখন ভিন্ন জায়গায় ব্যবহার হবে তখন একটি অপরটির অর্থে ও বিধানে শামিল হবে।

২. এহসানের সীমা-রেখা ঈমানের সীমা-রেখার চাইতে ব্যাপক। আর ঈমানের বেষ্টণী ইসলামের বেষ্টণীর চাইতে ব্যাপক। অতএব, এহসান শব্দটি অর্থের দিক থেকে ব্যাপক; কারণ সে ঈমানকেও শামিল করে। তাইতো কোন বান্দা ততক্ষণ এহসানের স্তরে পৌঁছতে পারবে না যতক্ষণ না তার মধ্যে ঈমান মজবুত হবে। আর এহসান শব্দটির বিশেষ অর্থে মুহসিন তথা এহসানকারী; কেননা এহসানকারীগণ ঈমানদারগণের মধ্যে একটি ছোট দল। অতএব, প্রত্যেক মুহসিন মু‘মিন কিন্তু প্রত্যেক মু‘মিন মুহসিন নয়।

৩. ঈমান ইসলামের চাইতে অর্থের দিক থেকে ব্যাপক; কারণ ঈমান ইসলামকে শামিল করে। যার ফলে কোন বান্দা ঈমানের স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না যতক্ষণ তার মধ্যে ইসলাম দৃঢ়মূল না হয়। আর ঈমান শব্দটি বিশেষ অর্থে মু‘মিন তথা ঈমানদারগণ। কেননা ঈমানদারগণ মুসলিমদের মধ্য হতে একটি ছোট দল, সবাই মু‘মিন নয়। সুতরাং, প্রত্যেক মু‘মিন মুসলিম কিন্তু প্রত্যেক মুসলিম মু‘মিন নয়।

ইসলাম, কুফর ও শিরকের মাঝে পার্থক্য:

ইসলাম: ইসলাম শব্দটির আভিধানিক অর্থ আত্মসমর্পণ করা। আর ইসলামি পরিভাষায় ইসলাম হলো: তাওহীদের  সাথে একমাত্র আল্লাহর জন্য আত্মসমর্পণ করা, ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর আনুগত্য করা এবং শিরক ও মুশরিকদের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা। অতএব, যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর জন্য আত্মসমর্পণ করবে সে মুসলিম। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও অন্যের জন্য আত্মসমর্পণ করবে সে মুশরিক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য আত্মসর্মপণ করবে না সে অহংকারী কাফের।

কুফরি: প্রতিপালক মহান আল্লাহকে সম্পূর্ণভাকে অস্বীকার করাকে বলে।

শিরক: বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর সঙ্গে তাঁর কাজে, নাম ও গুণাবীতে ও বান্দার ইবাদতে অন্য কাউকে শরিক করে তাঁর মর্যাদাকে ছোট করে দেওয়ার নাম।
কুফরি শিরকের চাইতে বেশি মারাত্মক; কারণ শিরকের দ্বারা আল্লাহর শরিক সাব্যস্ত করা হয়। আর কুফরি দ্বারা প্রতিপালককে অস্বীকার করা হয়। তবে একটি অপরটির স্থানে ব্যবহার হয়। আর যখন একই সঙ্গে ব্যবহার হয় তখন ভিন্ন অর্থ দাঁড়ায়। কিন্তু যখন ভিন্ন স্থানে ব্যবহার হয় তখন একটি অপরটির অর্থ ও হুকুম শামিল করে।

সবচেয়ে বড় নেয়ামত:

মানব জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ইসলাম একটি বিরাট নেয়ামত। আর কুরআনুল কারীম সবচেয়ে মহান কিতাব যা আল্লাহ তা‘য়ালা তাঁর মখলুকাতের মধ্যে মনোনীত ব্যক্তিকে ওয়ারিস বানান। আল্লাহর বাণী:

ثُمَّ اَوۡرَثۡنَا الۡکِتٰبَ الَّذِیۡنَ اصۡطَفَیۡنَا مِنۡ عِبَادِنَا ۚ فَمِنۡهُمۡ ظَالِمٌ لِّنَفۡسِهٖ ۚ وَ مِنۡهُمۡ مُّقۡتَصِدٌ ۚ وَ مِنۡهُمۡ سَابِقٌۢ بِالۡخَیۡرٰتِ بِاِذۡنِ اللّٰهِ ؕ ذٰلِکَ هُوَ الۡفَضۡلُ الۡکَبِیۡرُ ﴿ؕ۳۲﴾

‘‘অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করেছি তাদেরকে যাদেরকে আমি আমার বান্দাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেছি। তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী এবং কেউ আল্লাহর নির্দেশক্রমে কল্যাণের পথে এগিয়ে গেছে। এটাই মহা অনুগ্রহ।’’ [সূরা ফাতির:৩২]

আল্লাহ তা‘য়ালা এ উম্মতকে যাদের মহান কিতাবের ওয়ারিস বানিয়েছেন তিনভাবে ভাগ করেছেন: (১) নিজের প্রতি অত্যাচারী। (২) মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী। (৩) কল্যাণের পথে অগ্রগামী।

অতএব, নিজেদের প্রতি জুলুমকারী যে একবার তাঁর রবের আনুগত্য করে আর একবার নাফরমানি করে। সে সৎ আমলের সাথে খারাপ আমল মিলিয়ে ফেলে। আয়াতে এ প্রকারের দ্বারা আল্লাহ আরম্ভ করেছেন যাতে করে সে নিরাশ না হয়ে পড়ে এবং তার প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া এরাই হলো বেশির ভাগ জান্নাতের অধিবাসী।

আর মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী হলো: যে তার প্রতি যে সকল ওয়াজিব তা আদায় করে এবং হারামগুলো ত্যাগ করে।

আর কল্যাণের পথে অগ্রগামী হলো: যে তার প্রতি যে সকল ওয়াজিব তা আদায় করে এবং হারামগুলো ত্যাগ করে। এ ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায়  বেশি বেশি নফল ইবাদতও করে। এ প্রকারের উল্লেখ আয়াতে সর্বশেষ করার কারণ হলো: যাতে করে সে তার আমল নিয়ে আশ্চর্য না হয়, ফলে আমল বরবাদ না হয়ে পড়ে। তা ছাড়া এরাই জান্নাতে প্রবেশের বেশি অধিকারী। আর নিজেদের প্রতি জুলমকারীরা বেশির ভাগ জান্নাতী হলেও সর্বাস্রে প্রবেশকারী হিসাবে সংখ্যা কম। এরা বেশি হওয়ার জন্য তাদের দ্বারা আয়াতে শুরু করা হয়েছে।

আর আল্লাহ তা‘য়ালা প্রত্যেক প্রকারের জন্য জান্নাতে প্রবেশের ওয়াদা করেছেন। যেমন আল্লাহর বাণী:


جَنّٰتُ عَدۡنٍ یَّدۡخُلُوۡنَهَا یُحَلَّوۡنَ فِیۡهَا مِنۡ اَسَاوِرَ مِنۡ ذَهَبٍ وَّ لُؤۡلُؤًا ۚ وَ لِبَاسُهُمۡ فِیۡهَا حَرِیۡرٌ ﴿۳۳﴾

‘‘তারা প্রবেশ করবে বসবাসের জান্নাতে। তথায় তারা স্বর্ণনির্মিত, মোতি খচিত কংকন দ্বারা অলংকৃত হবে। সেখানে তাদের পোশাক হবে রেশমের।’’ [সূরা ফাতির: ৩৩]

ইসলামের রোকন পাঁচটি:

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ  قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ بُنِيَ الإسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ: شَهَادَةِ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَّسُولُ اللهِ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَحَجِّ الْبَيْتِ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ متفق عليه.

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘‘ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত। (১) সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ্ নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসূল। (২) সালাত প্রতিষ্ঠা করা। (৩) জাকাত প্রদান করা। (৪) হজ্ব সম্পাদন করা। (৫) রমজান মাসের রোজা রাখা।’’[1]

‘‘লা ইলাাহা ইল্লাল্লাাহ্’’ এ সাক্ষ্য প্রদানের অর্থ:

মানুষ তার জবান ও অন্তর দ্বারা স্বীকার করবে যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন সত্য ইলাহ্-উপাস্য নেই। আর তিনি ছাড়া যত মা’বূদ রয়েছে তাদের উলূহিয়াত বাতিল এবং তাদের ইবাদত করাও বাতিল। ইহা নেতিবাচক ‘‘লা ইলাহা’’ অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত যার ইবাদত করা হয় সকলকে অস্বীকার করা। আর ইতিবাচক ‘‘ইল্লাল্লাাহ’’ অর্থাৎ সকল প্রকার ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই করা, যার ইবাদতে কোন শরিক নেই।  যেমন তাঁর রাজত্বে তিনি একক তাঁর কোন শরিক নেই।


‘‘মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাাহ্’’ এ সাক্ষ্য প্রদানের অর্থ:

নবী (সা.) যার নির্দেশ করেছেন তার আনুগত্য করা এবং যা খবর দিয়েছেন তা বিশ্বাস করা। আর যে সকল জিনিস থেকে নিষেধ-বারণ করেছেন ও যে সকল ব্যাপারে ধমক দিয়েছেন সেগুলো থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকা এবং তাঁর দেয়া শরীয়ত ছাড়া অন্য কোন শরীয়ত মোতাবেক আল্লাহর ইবাদত না করা।

[1]. বুখারী হাঃ নং ৮ ও মুসলিম হাঃ নং ১৬ শব্দ তারই

ঈমান: ঈমান শব্দটির আভিধানিক অর্থ বিশ্বাস করা। আর ইসলামি পরিভাষায় ঈমান হলো: আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, আসমানী কিতাবসমূহ, রসূলগণ, শেষ দিবস এবং ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনা এবং এর দাবি মোতাবেক আমল করা।

ঈমান কথা ও কাজের নাম। ঈমান অন্তর ও জবানের কথা এবং অন্তর, জবান ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ। ঈমান সৎকাজের দ্বারা বাড়ে এবং অসৎকাজের দ্বারা কমে।


ঈমানের শাখা-প্রশাখা:


عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:্র الْإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً، فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ ،وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الْأَذَى عَنْ الطَّرِيقِ ، وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنْ الْإِيمَانِ أخرجه مسلم.

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘‘ঈমানের তেহাত্তর বা তেষট্টির অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোত্তম হলো ‘‘লা ইলাাহা ইল্লাল্লাাহ’’ আর সর্বনিম্ন হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস দূর করা। আর লজ্জাও ঈমানের একটি শাখা।’’[1]


ঈমানের পূর্ণতা:


আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পূর্ণ ভালোবাসা, আল্লাহ ও রসূল যা ভালোবাসেন তাকে ভালোবাসা জরুরি করে দেয়। তাই যখন মু‘মিন আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসে ও ঘৃণা করে যা অন্তরের কাজ এবং আল্লাহর ওয়াস্তে দেয় ও বারণ করে যা শরীরের কাজ তখন তার পূর্ণ ঈমান ও আল্লাহর পূর্ণ ভালোবাসা প্রমাণ হয়।

عَنْ أَبِي أُمَامَةَ  عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ:্র مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ، وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ، فَقَدْ اسْتَكْمَلَ الْإِيمَانَ أخرجه أبو داود.


আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি  রসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (সা.) বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসে ও আল্লাহর ওয়াস্তে ঘৃণা করে এবং আল্লাহর ওয়াস্তে দেয় ও নিষেধ করে সে তার ঈমানকে পূর্ণ করল।’’ [2]


ঈমানের স্তরসমূহ:

ঈমানের স্বাদ ও মজা এবং হকিকত রয়েছে।

ঈমানের স্বাদ নবী (সা.) তাঁর ভাষায় বর্ণনা করেছেন:


 ذَاقَ طَعْمَ الْإِيمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللَّهِ رَبًّا وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا أخرجه مسلم.

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে প্রতিপালক ও ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মদ (সা.) কে রসূল হিসাবে সন্তুষ্টি চিত্তে মেনে নিল সে প্রকৃত ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করল।’’[3]

ঈমানের মজা নবী (সা.) তাঁর বাণী দ্বারা এভাবে বর্ণনা করেছেন:


 ثَلَاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنَّ حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ: أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لَا يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِمتفق عليه.

‘‘যার মধ্যে তিনটি জিনিস পাওয়া যাবে সে তা দ্বারা ঈমানের মজা-স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে। (১) আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসা। (২) আল্লাহর ওয়াস্তে মানুষকে ভালোবাসা। (৩) আগুনে নিক্ষেপ করা যেমন ঘৃণা করে তেমনি কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে ঘৃণা করা।’’ [4]

ঈমানের হকিকত তারই জন্যে হাসিল হবে যার মধ্যে দ্বীনের হকিকত রয়েছে। আর দ্বীনের জন্য চেষ্টা-তদবির ক’রে এবং ইবাদত, দা’ওয়াত, হিজরত, সাহায্য ও সম্পদ খরচের মাধ্যমে পরিশ্রম করে।

আল্লাহর বাণী:

اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِرَ اللّٰهُ وَجِلَتۡ قُلُوۡبُهُمۡ وَ اِذَا تُلِیَتۡ عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتُهٗ زَادَتۡهُمۡ اِیۡمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّهِمۡ یَتَوَکَّلُوۡنَ ۚ﴿ۖ۲﴾ الَّذِیۡنَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰهُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ ؕ﴿۳﴾ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ حَقًّا ؕ لَهُمۡ دَرَجٰتٌ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ وَ مَغۡفِرَۃٌ وَّ رِزۡقٌ کَرِیۡمٌ ۚ﴿۴﴾

‘‘যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন তাদের অন্তর ভীত হয়ে পড়ে। আর যখন পাঠ করা হয় তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং স্বীয় রবের প্রতি ভরসা পোষণ করে। সে সমস্ত লোক যারা সালাত কায়েম করে এবং আমি যা তাদেরকে রুজি দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। তারাই হল সত্যিকার ঈমানদার। তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় রবের নিকট মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক রুজি।’’ [সূরা আনফাল:২-৪]

আরো আল্লাহ -এর বাণী:

وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ هَاجَرُوۡا وَ جٰهَدُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ الَّذِیۡنَ اٰوَوۡا وَّ نَصَرُوۡۤا اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ حَقًّا ؕ لَهُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ رِزۡقٌ کَرِیۡمٌ ﴿۷۴﴾

‘‘আর যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে, আল্লাহর রাহে জিহাদ করেছে এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, সাহায্য-সহায়তা করেছে, তারাই হলো সত্যিকারে ঈমানদার। তাদের জন্যে রয়েছে, ক্ষমা ও সম্মানজনক রুজি।’’  [ সূরা আনফাল:৭৪ ]

আরো আল্লাহর বাণী:

اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ ثُمَّ لَمۡ یَرۡتَابُوۡا وَ جٰهَدُوۡا بِاَمۡوَالِهِمۡ وَ اَنۡفُسِهِمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ اُولٰٓئِکَ هُمُ الصّٰدِقُوۡنَ ﴿۱۵﴾


‘‘তারাই মু‘মিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে জানমাল দ্বারা জিহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।’’ [সূরা হুজুরাত: ১৫]

কোন বান্দা ঈমানের হকিকতে ততক্ষণ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না যতক্ষণ না সে বিশ্বাস করবে যে, তার ভাগ্যে যা কিছু ঘটে তা ভুল ক’রে না। আর যা সে ভুল করে তা ইচ্ছা ক’রে না।


ঈমানের সর্বোচ্চ স্তর:

ঈমানের যেমন আছে শব্দ তেমনি আছে আকৃতি ও হকিকত। আর ঈমানের সর্বোচ্চ স্তর হলো একিন। কারণ একিনের সাথে ঈমানে কোন প্রকার সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে না। দেখা ও না দেখা উভয় ব্যাপারে সমানভাবে একিন হয়। অতএব, আল্লাহ তা‘য়ালা যে সকল গায়বের খবর দিয়েছেন। যেমন: আল্লাহর নাম ও গুণসমূহ, ফেরেশতা মন্ডলী, কিতাবসমূহ, রসূলগণ ও শেষ দিবসের এগুলো তার নিকট চোখে দেখার মত হয়ে দাঁড়ায়। আর ইহাই হচ্ছে পূর্ণ একিন ও হাক্কুল একিন। এ ছাড়া ধৈর্য ও একিন দ্বারাই দ্বীনের মাঝে নেতৃত্ব লাভ করা যায়। আল্লাহর বাণী:

وَ جَعَلۡنَا مِنۡهُمۡ اَئِمَّۃً یَّهۡدُوۡنَ بِاَمۡرِنَا لَمَّا صَبَرُوۡا ۟ؕ وَ کَانُوۡا بِاٰیٰتِنَا یُوۡقِنُوۡنَ ﴿۲۴﴾


‘‘তারা সবর করত বিধায় আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার আদেশে পথ প্রদর্শন করত। তারা আমার আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল।’’ [সূরা সেজদাহ:২৪]

[1]. মুসলিম হাঃ নং ৩৫
[2]. হাদীসটি হাসান, আবু দাঊদ হাঃ নং ৪৬৮১ ও সিলসিলা সহীহা হাঃ নং ৩৮০ দ্রঃ
[3]. মুসলিম হাঃ নং ৩৪
[4]. বুখারী হাঃ নং ১৬ ও মুসলিম হাঃ নং ৪৩
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »