কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী ফিকাহ প্রথম পর্ব - তাওহীদ ও ঈমান মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম আত্তুওয়াইজিরী
৮. ঈমান

ঈমান: ঈমান শব্দটির আভিধানিক অর্থ বিশ্বাস করা। আর ইসলামি পরিভাষায় ঈমান হলো: আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, আসমানী কিতাবসমূহ, রসূলগণ, শেষ দিবস এবং ভাগ্যের ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনা এবং এর দাবি মোতাবেক আমল করা।

ঈমান কথা ও কাজের নাম। ঈমান অন্তর ও জবানের কথা এবং অন্তর, জবান ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ। ঈমান সৎকাজের দ্বারা বাড়ে এবং অসৎকাজের দ্বারা কমে।


ঈমানের শাখা-প্রশাখা:


عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ:্র الْإِيمَانُ بِضْعٌ وَسَبْعُونَ أَوْ بِضْعٌ وَسِتُّونَ شُعْبَةً، فَأَفْضَلُهَا قَوْلُ: لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ ،وَأَدْنَاهَا إِمَاطَةُ الْأَذَى عَنْ الطَّرِيقِ ، وَالْحَيَاءُ شُعْبَةٌ مِنْ الْإِيمَانِ أخرجه مسلم.

আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘‘ঈমানের তেহাত্তর বা তেষট্টির অধিক শাখা-প্রশাখা রয়েছে। এর মধ্যে সর্বোত্তম হলো ‘‘লা ইলাাহা ইল্লাল্লাাহ’’ আর সর্বনিম্ন হচ্ছে রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক জিনিস দূর করা। আর লজ্জাও ঈমানের একটি শাখা।’’[1]


ঈমানের পূর্ণতা:


আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পূর্ণ ভালোবাসা, আল্লাহ ও রসূল যা ভালোবাসেন তাকে ভালোবাসা জরুরি করে দেয়। তাই যখন মু‘মিন আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসে ও ঘৃণা করে যা অন্তরের কাজ এবং আল্লাহর ওয়াস্তে দেয় ও বারণ করে যা শরীরের কাজ তখন তার পূর্ণ ঈমান ও আল্লাহর পূর্ণ ভালোবাসা প্রমাণ হয়।

عَنْ أَبِي أُمَامَةَ  عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ:্র مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ، وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ، فَقَدْ اسْتَكْمَلَ الْإِيمَانَ أخرجه أبو داود.


আবু উমামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি  রসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি (সা.) বলেছেন: ‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ওয়াস্তে ভালোবাসে ও আল্লাহর ওয়াস্তে ঘৃণা করে এবং আল্লাহর ওয়াস্তে দেয় ও নিষেধ করে সে তার ঈমানকে পূর্ণ করল।’’ [2]


ঈমানের স্তরসমূহ:

ঈমানের স্বাদ ও মজা এবং হকিকত রয়েছে।

ঈমানের স্বাদ নবী (সা.) তাঁর ভাষায় বর্ণনা করেছেন:


 ذَاقَ طَعْمَ الْإِيمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللَّهِ رَبًّا وَبِالْإِسْلَامِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولًا أخرجه مسلم.

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে প্রতিপালক ও ইসলামকে দ্বীন এবং মুহাম্মদ (সা.) কে রসূল হিসাবে সন্তুষ্টি চিত্তে মেনে নিল সে প্রকৃত ঈমানের স্বাদ গ্রহণ করল।’’[3]

ঈমানের মজা নবী (সা.) তাঁর বাণী দ্বারা এভাবে বর্ণনা করেছেন:


 ثَلَاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنَّ حَلَاوَةَ الْإِيمَانِ: أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لَا يُحِبُّهُ إِلَّا لِلَّهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِمتفق عليه.

‘‘যার মধ্যে তিনটি জিনিস পাওয়া যাবে সে তা দ্বারা ঈমানের মজা-স্বাদ গ্রহণ করতে পারবে। (১) আল্লাহ ও তাঁর রসূলকে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসা। (২) আল্লাহর ওয়াস্তে মানুষকে ভালোবাসা। (৩) আগুনে নিক্ষেপ করা যেমন ঘৃণা করে তেমনি কুফরিতে ফিরে যাওয়াকে ঘৃণা করা।’’ [4]

ঈমানের হকিকত তারই জন্যে হাসিল হবে যার মধ্যে দ্বীনের হকিকত রয়েছে। আর দ্বীনের জন্য চেষ্টা-তদবির ক’রে এবং ইবাদত, দা’ওয়াত, হিজরত, সাহায্য ও সম্পদ খরচের মাধ্যমে পরিশ্রম করে।

আল্লাহর বাণী:

اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اِذَا ذُکِرَ اللّٰهُ وَجِلَتۡ قُلُوۡبُهُمۡ وَ اِذَا تُلِیَتۡ عَلَیۡهِمۡ اٰیٰتُهٗ زَادَتۡهُمۡ اِیۡمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّهِمۡ یَتَوَکَّلُوۡنَ ۚ﴿ۖ۲﴾ الَّذِیۡنَ یُقِیۡمُوۡنَ الصَّلٰوۃَ وَ مِمَّا رَزَقۡنٰهُمۡ یُنۡفِقُوۡنَ ؕ﴿۳﴾ اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ حَقًّا ؕ لَهُمۡ دَرَجٰتٌ عِنۡدَ رَبِّهِمۡ وَ مَغۡفِرَۃٌ وَّ رِزۡقٌ کَرِیۡمٌ ۚ﴿۴﴾

‘‘যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন তাদের অন্তর ভীত হয়ে পড়ে। আর যখন পাঠ করা হয় তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং স্বীয় রবের প্রতি ভরসা পোষণ করে। সে সমস্ত লোক যারা সালাত কায়েম করে এবং আমি যা তাদেরকে রুজি দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে। তারাই হল সত্যিকার ঈমানদার। তাদের জন্য রয়েছে স্বীয় রবের নিকট মর্যাদা, ক্ষমা এবং সম্মানজনক রুজি।’’ [সূরা আনফাল:২-৪]

আরো আল্লাহ -এর বাণী:

وَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا وَ هَاجَرُوۡا وَ جٰهَدُوۡا فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ الَّذِیۡنَ اٰوَوۡا وَّ نَصَرُوۡۤا اُولٰٓئِکَ هُمُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ حَقًّا ؕ لَهُمۡ مَّغۡفِرَۃٌ وَّ رِزۡقٌ کَرِیۡمٌ ﴿۷۴﴾

‘‘আর যারা ঈমান এনেছে, হিজরত করেছে, আল্লাহর রাহে জিহাদ করেছে এবং যারা তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে, সাহায্য-সহায়তা করেছে, তারাই হলো সত্যিকারে ঈমানদার। তাদের জন্যে রয়েছে, ক্ষমা ও সম্মানজনক রুজি।’’  [ সূরা আনফাল:৭৪ ]

আরো আল্লাহর বাণী:

اِنَّمَا الۡمُؤۡمِنُوۡنَ الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا بِاللّٰهِ وَ رَسُوۡلِهٖ ثُمَّ لَمۡ یَرۡتَابُوۡا وَ جٰهَدُوۡا بِاَمۡوَالِهِمۡ وَ اَنۡفُسِهِمۡ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ ؕ اُولٰٓئِکَ هُمُ الصّٰدِقُوۡنَ ﴿۱۵﴾


‘‘তারাই মু‘মিন, যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর পথে জানমাল দ্বারা জিহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।’’ [সূরা হুজুরাত: ১৫]

কোন বান্দা ঈমানের হকিকতে ততক্ষণ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না যতক্ষণ না সে বিশ্বাস করবে যে, তার ভাগ্যে যা কিছু ঘটে তা ভুল ক’রে না। আর যা সে ভুল করে তা ইচ্ছা ক’রে না।


ঈমানের সর্বোচ্চ স্তর:

ঈমানের যেমন আছে শব্দ তেমনি আছে আকৃতি ও হকিকত। আর ঈমানের সর্বোচ্চ স্তর হলো একিন। কারণ একিনের সাথে ঈমানে কোন প্রকার সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে না। দেখা ও না দেখা উভয় ব্যাপারে সমানভাবে একিন হয়। অতএব, আল্লাহ তা‘য়ালা যে সকল গায়বের খবর দিয়েছেন। যেমন: আল্লাহর নাম ও গুণসমূহ, ফেরেশতা মন্ডলী, কিতাবসমূহ, রসূলগণ ও শেষ দিবসের এগুলো তার নিকট চোখে দেখার মত হয়ে দাঁড়ায়। আর ইহাই হচ্ছে পূর্ণ একিন ও হাক্কুল একিন। এ ছাড়া ধৈর্য ও একিন দ্বারাই দ্বীনের মাঝে নেতৃত্ব লাভ করা যায়। আল্লাহর বাণী:

وَ جَعَلۡنَا مِنۡهُمۡ اَئِمَّۃً یَّهۡدُوۡنَ بِاَمۡرِنَا لَمَّا صَبَرُوۡا ۟ؕ وَ کَانُوۡا بِاٰیٰتِنَا یُوۡقِنُوۡنَ ﴿۲۴﴾


‘‘তারা সবর করত বিধায় আমি তাদের মধ্য থেকে নেতা মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার আদেশে পথ প্রদর্শন করত। তারা আমার আয়াতসমূহে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিল।’’ [সূরা সেজদাহ:২৪]

[1]. মুসলিম হাঃ নং ৩৫
[2]. হাদীসটি হাসান, আবু দাঊদ হাঃ নং ৪৬৮১ ও সিলসিলা সহীহা হাঃ নং ৩৮০ দ্রঃ
[3]. মুসলিম হাঃ নং ৩৪
[4]. বুখারী হাঃ নং ১৬ ও মুসলিম হাঃ নং ৪৩