মূল: সাঈদ বিন আলী ইবনে ওহাফ আল-কাহতানী
অনুবাদ: সিরাজুল ইসলাম
ভূমিকা
সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করি, তাঁর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। তাঁর কাছে স্বীয় কু-রিপু ও অসৎ কর্মের অনিষ্ট হতে আশ্রয় চাই। তিনি যাকে হেদায়াত দেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না এবং তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে কেউ হেদায়াত দিতে পারে না।
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ছাড়া সত্যিকারের কোন মা‘বুদ নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরিক নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর বান্দা ও রাসূল। সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক তাঁর, তাঁর পরিবারবর্গ, সাহাবায়ে কেরাম এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগত তাঁর সকল অনুসারীর উপর।
‘‘নূরুস সুন্নাহ্ ওয়া জুলুমাতুল বিদআহ ’’ নামক এ সংক্ষিপ্ত গ্রন্থে আমি সুন্নাতের অর্থ ও আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাতের পরিচয় বর্ণনা করেছি। সুন্নাত একটি বিশেষ নিয়ামত, তাই সুন্নাত ও সুন্নাতের অনুসারীদের পরিচয়, মর্যাদা ও আমল কবুলের শর্ত সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি। পাশাপাশি বিদআত ও বিদআতপন্থীদের পরিচয়, বিদআতের প্রকারভেদ, কারণ, বিধান এবং এর ক্ষতিকর দিকসমূহ তুলে ধরেছি। প্রচলিত বিদআত, কবর কেন্দ্রিক বিদআত ও এর ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে আলোচনা করেছি। সাথে সাথে তা থেকে তাওবা করার প্রতি উৎসাহিত করেছি।
নিঃসন্দেহে সুন্নাত এমন আলোকবর্তিকা ও জীবনাদর্শ, যা বান্দাকে হেদায়াতের পথে পরিচালিত করে এবং সফলতার পথ প্রদর্শন করে।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ يَوْمَ تبْيَضُّ وُجُوْهٌ وَ تَسْوَدُّ وَجُوْهٌ. (آل عمران: 106)
অর্থঃ যে দিন অনেক চেহারা উজ্জ্বল হবে ও অনেক চেহারা মলিন হবে।
ইবনে আববাস (রা) বলেনঃ
تَبْيَضّ وُجُوْهُ أَهْلِ السُّنَّةِ وَ الاِئْتِلافِ، وَتَسْوَدُّ وُجُوْهُ أَهْلِ الْبِدْعَةِ وَ التَّفَرُّقِ.
অর্থঃ ‘‘আহলুস্ সুন্নাহ তথা সুন্নাতের অনুসারীদের চেহারা উজ্জ্বল হবে ও বিদআতপন্থীদের চেহারা অন্ধকারের ন্যায় কালো হবে’’।
অর্থাৎ সুন্নাতের অনুসারীদের অন্তর জিন্দা এবং তাদের আত্না আলোকিত। তারা প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। পক্ষান্তরে বিদআতপন্থীদের অন্তর মৃত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। আল্লাহ্ যাকে চান তাকে এ অন্ধকার হতে মুক্তি দিয়ে সুন্নাতের আলোকিত পথে নিয়ে আসেন।
আমি আলোচ্য বিষয় দু’টি অধ্যায়ে ভাগ করেছি।
১ম অধ্যায় : সুন্নাতের আলো
২য় অধ্যায় : বিদআতের অন্ধকার
প্রথম অধ্যায়ে ৫টি পরিচ্ছেদ আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে ১০টি পরিচ্ছেদ রয়েছে।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন এ কাজে বরকত দান করেন। এ আমলকে আমার জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর কল্যাণময় আমল হিসেবে গ্রহণ করেন এবং পাঠকদের উপকৃত করেন। তিনিই সর্বোত্তম প্রার্থনা কবুলকারী ও আশার স্থল, তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং সর্বোত্তম তত্ত্বাবধায়ক। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ ব্যতীত গুনাহ থেকে বাঁচার ও সৎকাজ করার শক্তি নেই। আল্লাহ্ তা‘আলা স্বীয় বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর রহমত, বরকত ও শান্তি বর্ষণ করুন। আরো রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন তাঁর পরিবার বর্গ, সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁর সকল একনিষ্ঠ অনুসারীগণের উপর।
লিখক ডঃ সাঈদ ইবনে আলী ইবনে ওহাফ আল-কাহত্বানী।
সুন্নাতের কিছু অনুসারী আছে যারা জামাতবদ্ধ সুদৃঢ় আকীদা-বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। যাদেরকে ‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ বলা হয়।
এখানে তিনটি বিষয় রয়েছেঃ ১. আকীদা, ২. আহলুস সুন্নাহ ও ৩. আল-জামাআহ। নিম্নে প্রত্যেকটির পরিচয় দেয়া হলোঃ
প্রথম : ‘আকীদা’ এর শাব্দিক অর্থ
বন্ধন, বাঁধন, দৃঢ়ভাবে বাঁধা।
পারিভাষিক অর্থ
আকীদা এমন সুদৃঢ় ও সঠিক ঈমানকে বলে, যার মধ্যে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
সুতরাং যদি তার সে সুদৃঢ় বিশ্বাস বিশুদ্ধ ও সঠিক হয়, তাহলে আকীদাও বিশুদ্ধ এবং সঠিক হবে। যেমন, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা। আর যদি তা ভ্রান্ত হয়, তাহলে আকীদাও ভ্রান্ত এবং বাতিল বলে গণ্য হবে। যেমন, বিভিন্ন ভ্রান্ত আকীদাপন্থী পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের আকীদা ও বিশ্বাস।[1]
দ্বিতীয় : ‘আহলুস সুন্নাহ’ এর অর্থ
‘সুন্নাহ’ এর শাব্দিক অর্থ
পথ বা জীবনাদর্শ, তা উৎকৃষ্ট হোক বা নিকৃষ্ট।
ইসলামী আকীদাপন্থীদের পরিভাষায় সুন্নাহ অর্থ
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবীগণ যে জীবনাদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করেছেন সে জীবনাদর্শকে সুন্নাহ বলা হয়।
এটা এমন এক আদর্শ, যা অনুসরণ করা ওয়াজিব। এ সুন্নাতের অনুসারীদের প্রশংসা করা হয়েছে। পক্ষান্তরে এর বিরোধীদের নিন্দা করা হয়েছে। এজন্যই বলা হয় অমুক ব্যক্তি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অনুসারী। অর্থাৎ সে সুদৃঢ় ও প্রশংসিত আদর্শের অনুসারী।[2]
হাফেয ইবনে রজব রহ. বলেন, সুন্নাত হলো প্রচলিত পদ্ধতি, যা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও খোলাফায়ে রাশেদীনের বিশ্বাস, আমল ও বক্তব্যসমূহ অন্তর্ভুক্ত করে। এটাই হলো প্রকৃত সুন্নাত।[3]
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, সুন্নাত হল ঐ সকল আমল, যা পালনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনুগত হওয়ার ব্যাপারে শরীয়তের দলিল রয়েছে। চাই তা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে পালন করেছেন বা তাঁর অনুমোদনে সে যুগে পালন করা হয়েছে অথবা চাহিদা না থাকায় কিংবা অসুবিধার কারণে সে যুগে পালিত হয়নি। এ সবই সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত।[4]
এখানে সুন্নাতের অর্থ হল
বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সকল ক্ষেত্রে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদীস, মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের আদর্শের অনুসরণ করা।
তৃতীয় : ‘জামাআহ’ এর শাব্দিক অর্থ
দল, গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ইত্যাদি।
ইবনে ফারেস রহ. বলেন, জীম, মীম ও আইন হরফ দ্বারা গঠিত শব্দ কোন বস্তু একত্রিত করা বুঝায়।
ইসলামী আকীদার পরিভাষায়
জামাআত হল, উম্মতে মুহাম্মাদীর নেককার ব্যক্তিবর্গ। যেমন, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী এবং কিয়ামত পর্যন্ত আগত নিষ্ঠার সাথে তাদের অনুসারীগণ, যারা কিতাবুল্লাহ্ ও সুন্নাতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর ঐকমত্য পোষণকারী।[5]
আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, জামাআত ঐ বিষয়কে বলে, যা সত্যের অনুকূল হয়, যদিও তাতে তুমি একা হও।
নুয়াইম ইবনে হাম্মাদ রহ. বলেন, যখন জামাআত ভেঙ্গে যাবে তখন তোমার জন্য আবশ্যক হল, ভেঙ্গে যাওয়ার পূর্বে জামাআত যে উদ্দেশ্য ও আর্দশের উপর ছিল সে আর্দশের উপর অটল থাকা, যদিও তুমি একা হও। কেননা সে সময় তুমি একাই জামাআত হিসেবে গণ্য হবে।[6]
[2] মাবাহিসু আকীদাতি আহলিস্সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ - ড: নাসের আল-আকল : ১৩পৃ:
[3] জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ১/১২০
[4] মাজমুয়ায়ে ফতোয়ায়ে ইবনে তাইমিয়া : ২১/৩১৭
[5] শরহু আকীদাতি আত-তহাবী : ৬৮পৃ:
[6] ইগাসাতিল লাফহান, ইবনে তাইমিয়া : ১/৭০
১. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ
যারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবায়ে কেরামের আদর্শের অনুসারী এবং সুন্নাতকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণকারী। যথা- তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী ও হেদায়াতপ্রাপ্ত ইমামগণ। তারা সুন্নাতের অনুসরণে সুদৃঢ় ও সর্বদা সকল প্রকার বিদআত থেকে দূরে থাকে। এরাই কিয়ামত পর্যন্ত সাহায্যপ্রাপ্ত জামাআত।[1] রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাতের সাথে সম্পর্ক থাকার কারণে এবং বাহ্যিক, আন্তরিক, ও মৌখিক কার্যাবলীতে সুন্নাতকে সম্মিলিতভাবে আঁকড়ে ধরার কারণে এ নামে তাদের নামকরণ করা হয়েছে।[2]
এ প্রসঙ্গে আওফ বিন মালেক (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
افْتَرَقَتْ الْيَهُودُ عَلَى إِحْدَى وَسَبْعِينَ فِرْقَةً فَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَسَبْعُونَ فِي النَّارِ وَافْتَرَقَتْ النَّصَارَى عَلَى ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً فَإِحْدَى وَسَبْعُونَ فِي النَّارِ وَوَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لَتَفْتَرِقَنَّ أُمَّتِي عَلَى ثَلَاثٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً وَاحِدَةٌ فِي الْجَنَّةِ وَثِنْتَانِ وَسَبْعُونَ فِي النَّارِ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَنْ هُمْ قَالَ الْجَمَاعَةُ. (ترمذي)
অর্থঃ ইহুদীরা একাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে, তন্মধ্যে একদল জান্নাতী এবং সত্তর দল জাহান্নামী। খ্রীষ্টানরা বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে, তন্মধ্যে একাত্তর দল জাহান্নামী ও একদল জান্নাতী। ঐ সত্ত্বার শপথ! যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, নিশ্চয়ই আমার উম্মত তেহাত্তর দলে বিভক্ত হবে, তাদের একদল জান্নাতী এবং বাহাত্তর দল জাহান্নামী। জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা? তিনি বললেন, তারা হল (সুন্নাতের অনুসারী) দল।[3]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত, সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তারা কারা ? উত্তরে তিনি বললেন, مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِي অর্থঃ যারা আমি এবং আমার সাহাবায়ে কেরামের অনুসারী।[4]
২. মুক্তিপ্রাপ্ত দল
জাহান্নাম থেকে মুক্তি প্রাপ্ত দল হল, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ। কেননা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতের বিভক্ত দলসমূহের আলোচনার প্রাক্কালে তাদেরকে পৃথকভাবে উল্লেখ করেছেন।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
كُلُّهَا فِيْ النَّارِ إِلَّا وَاحِدَةٌ.
অর্থঃ তারা সকলেই জাহান্নামী হবে একটি দল ব্যতীত।[5]
৩. সাহায্য প্রাপ্ত দল
‘আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’ আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে সর্বদা সাহায্য প্রাপ্ত একটি দল।
মুআবিয়া (রা) সূত্রে বর্ণিত হাদীসে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي قَائِمَةٌ بِأَمْرِ اللهِ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ أَوْ خَالَفَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ ظَاهِرُوْنَ عَلى النَّاسِ. (متفق عليه)
অর্থঃ আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা আল্লাহর নির্দেশের উপর অটল থাকবে। বিরোধীদের বিরোধিতা ও অপমানকারীদের অপমান তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আল্লাহর ফয়সালা (কিয়ামত) আসার পূর্ব পর্যন্ত তারা সর্বদা মানুষের উপর বিজয়ী থাকবে।[6]
মুগীরা ইবনে শুবা (রা) থেকে অন্য রেওয়ায়াতে এ ধরণের হাদীস বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
لَا تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِي ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ لَا يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِيَ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ كَذَلِكَ. (مسلم)
‘সর্বদা আমার উম্মতের একটি জামাআত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর ফয়সালা (কিয়ামত) আসার পূর্ব পর্যন্ত অপমানকারীদের অপমান তাদের কোন ক্ষতি করবে না।’[7]
জাবের (রা) থেকেও মুসলিমের অন্য রেওয়ায়াতে এ ধরণের হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
৪. কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতের অনুসারী
তারা কিতাবুল্লাহ ও সুন্নাতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে সুদৃঢ়ভাবে ধারণকারী হবে। যে আর্দশের উপর আনসার ও মুহাজির সাহাবায়ে কেরামগণ ছিলেন, তারাও সে আদর্শের অনুসারী হবে। এ জন্যই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, তারা আমি এবং আমার সাহাবায়ে কেরামের আর্দশের অনুসারী হবে।
৫. সৎ নেতৃবর্গ
যারা সত্যের পথপ্রদর্শক এবং সে অনুযায়ী আমলকারী। আইয়ূব সখতিয়ানী রহ. বলেন, ‘ঐ যুবক সৌভাগ্যবান, যাকে আল্লাহ্ তা‘আলা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের কোন একজন দ্বীনদার আলিমের সাহচর্য লাভের তাওফিক দিয়েছেন।’[8]
ফুযাইল ইবনে আয়ায রহ. বলেন, আল্লাহ তা‘আলার এমন কিছু বান্দা আছে, যাদের মাধ্যমে আল্লাহ অনেক দেশকে জীবন্ত করেছেন তথা হেদায়াত দান করেছেন, তারাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ।[9]
৬. বিদআত থেকে বাধাদানকারী
যারা বিদআতপন্থীদের সকল প্রকার বিদআত ও কুসংস্কার থেকে নিরুৎসাহিত করে এবং সুন্নাতের অনুসরণ করতে উৎসাহিত করে, তারাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ ও সর্বোত্তম মানুষ।
আবু বকর ইবনে আইয়াশকে জিজ্ঞেস করা হল, সুন্নী কারা? উত্তরে তিনি বললেন, যাদের সামনে প্রবৃত্তি নিয়ে আলোচনা করা হলে তারা সেদিকে মনোযোগ দেয় না।[10]
ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ হচ্ছে সর্বোত্তম উম্মত, তারা সহজ, সরল ও সঠিক পথের অনুসারী।[11]
৭. সৌভাগ্যবান দল
যারা এ উম্মতের মধ্যে শত প্রতিকূলতার পরও সত্যের ধারক-বাহক হিসেবে পরিচিত।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
بَدَأَ الْإِسْلَامُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ. (مسلم)
অর্থঃ ইসলাম অচেনা ক্ষুদ্র পরিসরে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং অতিসত্তর তা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে। সুতরাং সুসংবাদ অচেনাদলের জন্য।[12]
আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) থেকে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. বর্ণনা করেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করা হল, গুরাবা তথা অচেনা দূর্বল দল কারা? তিনি বললেন, ঐ সকল লোক, যারা আল্লাহর জন্য পরিবার পরিজন ও স্বজাতি থেকে দূরে রয়েছে।[13]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আ‘স (রা) থেকে ইমাম আহমদ রহ. অন্যত্র বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে জিজ্ঞেস করা হল, হে আল্লাহর রাসূল! অচেনা ক্ষুদ্র দল কারা? তিনি বললেন, অধিকাংশ পাপীদের মধ্যে কিছু সৎকর্ম পরায়ণ লোক।[14]
অন্য সূত্রে বর্ণিত এক হাদীসে রয়েছে, যখন মানুষ বিশৃংখল হয়ে পড়ে, তখন তারা সংশোধন করে দেয় এবং নিজেরা সঠিক পথে চলে।[15]
সুতরাং আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ হল, বিদআতপন্থী ও প্রবৃত্তির অনুসারী দলসমূহের বিপরীত একটি সঠিক দল।
৮. জ্ঞানের ধারক -বাহক
আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ অহীলব্ধ জ্ঞানের অনুসারী এবং তারা উক্ত জ্ঞানের ধারক-বাহক। তারা সীমালংঘনকারীদের সীমালংঘন, ভ্রান্তপন্থীদের ভ্রান্তমত এবং মূর্খদের অপব্যাখ্যা থেকে দূরে থাকে।
এ জন্যই ইবনে সিরীন রহ. বলেন, তারা হাদীসের সনদ সম্পর্কে প্রশ্ন করে না। যখন সনদে কোন সমস্যা সৃষ্টি হয় তখন তারা বলে, আমাদের কাছে হাদীস বর্ণনাকারীদের পরিচয় দাও। অতঃপর আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের অনুসারীগণ বর্ণনাকারীদের জ্ঞানের গভীরতার প্রতি লক্ষ্য করে তাদের হাদীস গ্রহণ করেন। পক্ষান্তরে বিদআতপন্থীদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করে তাদের হাদীস গ্রহণ করেন না।[16]
৯. আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের কোন একজনের ইন্তেকাল সকলকে ব্যথিত করে
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ এমন সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যা কুরআন ও হাদীসের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূল। তারা খাঁটি মুমিনদের নিকট প্রিয় মানুষ ও দ্বীনের সঠিক রাহবার।
আইউব সাখতিয়ানী রহ. বলেন, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের কোন এক ব্যক্তির মৃত্যুর খবর শুনলে মনে হয় যেন আমি আমার একটি অঙ্গ হারিয়ে ফেলেছি। [17]
তিনি আরো বলেন, যারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মৃত্যু কামনা করে, তারা নিজেদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূর তথা দ্বীনের আলো নিভিয়ে ফেলতে চায়। অথচ আল্লাহ স্বীয় নূর তথা দ্বীনের আলো পূর্ণাঙ্গ করবেন, যদিও তা কাফিরদের অপছন্দ হয়।[18]
[2] ফাতহু রবিবল বারিয়্যাতি বি তাখলীসিল হামুবিয়াতি - ইবনে উসাইমিন : ১০পৃ:
[3] ইবনে মাজা : ২/৩২১
[4] তিরমিযী : ২৬৪১
[5] উসূলু আহলিস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ - সালেহ ইবনে ফাওযান : ১১ পৃ
[6] বুখারী : ৩৬৪১ ও মুসলিম : ১০৩৭
[7] মুসলিম : ১৯২০
[8] শরহে উসূলে ইতিকাদে আহলুস্ সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআহ : ১/৬৬
[9] শরহে উসূলে ইতিকাদে আহলুস্ সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআহ : ১/৭২
[10] শরহে উসূলে ইতিকাদে আহলুস্ সুন্নাহ্ ওয়াল জামাআহ : ১/৭২
[11] ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া : ৩/৩৬৮
[12] মুসলিম : ১৪৫
[13] নেহায়া লেখক ইবনে আসীর : ৫/৪১
[14] মুসনাদে ইমাম আহমদ : ২/১৭৭
[15] আহমদ : ৪/১৭৩
[16] মুকাদ্দামায়ে মুসলিম : ১/১৫
[17] শরহু উসূলে ইতিকাদে আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ : ১/৬৬
[18] শরহে উসূলে ইতিকাদে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ : ১/৬৮
নিয়ামত দু‘ প্রকারঃ
১. সাধারণ নিয়ামত ও ২. শর্তযুক্ত নিয়ামত
সাধারণ নিয়ামত
যা স্থায়ী সৌভাগ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট। সে নিয়ামত হল ইসলাম ও সুন্নাতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। কেননা ইসলাম ও সুন্নাহ আল্লাহ প্রদত্ত সবচেয়ে বড় নিয়ামত।
ইহকালীন ও পরকালীন সৌভাগ্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর নির্ভরশীল- (ক) ইসলাম (খ) সুন্নাহ ও (গ) দুনিয়া ও আখেরাতে সুস্থতা। ইসলাম ও সুন্নাত এমন এক নিয়ামত যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে পারি। আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমরা তাঁর নিকট সালাতের মাধ্যমে প্রার্থনা করি এবং এ পথের অনুসারীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করি, যাদের তিনি সর্বোত্তম বন্ধুর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ مَنْ يُطِعِ اللهَ والرَّسُولَ فَأُوْلَئٍٍِكَ مَعَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِّنَ النًبِيَيْنَ وَالصِّدِّيْقِينَ وَالشُّهدَآءِِ وَالصَالٍِحِيْنَ وَحَسُنَ أُوْلَئِكَ رَفِيْقًا. (النساء: 69)
অর্থঃ যারা আল্লাহ ও রাসূলের অনুগত তারা ঐ ব্যক্তিদের সঙ্গী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেনঅ। তারা হলেন, নবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীলগণ এবং এরাই সর্বোত্তম সঙ্গী।[1]
কুরআনে বর্ণিত এ চার প্রকারের লোকই সাধারণ নিয়ামতের অধিকারী। যাদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
اَلْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكَمْ نَعْمَتِيْ وَ رَضِيْتُ لَكُمْ الإِسْلامَ دِيْنًا (المائدة:3)
আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।[2]
এ আয়াতে দ্বীন ইসলাম নামক নিয়ামতকে পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ করে দেয়ার ঘোষণা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ওমর ইবনে আব্দুল আযীয রহ. এর বক্তব্য উল্লেখ্য। তিনি বলেন, নিশ্চয়ই ঈমানের নির্ধারিত সীমা (ফরজ, সুন্নাত ও আইন কানুন) রয়েছে। যে তা পরিপূর্ণ করল সে ঈমান পরিপূর্ণ করল।[3]
দ্বীন হল আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়ত, যা তাঁর আদেশ-নিষেধ ও ভালবাসার সমন্বয়কে বুঝায়। যে নিয়ামত দ্বারা মুমিনদের বিশেষিত করা হয়েছে, তা হল ইসলাম ও সুন্নাতের নিয়ামত। এটা এমন নিয়ামত যা অর্জিত হলে প্রকৃত সন্তুষ্ট ও খুশি হওয়া উচিত। আর আল্লাহর নিয়ামতের উপর খুশি হলে আল্লাহ খুশি হন।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
قُلْ بِفَضْلِ اللهِ وَبِرَحْمَتِِهِ فَبِذلِكَ فَلْيَفْرَحُوْا هُوَ خَيْرٌ مِّمَّا يَجْمَعُوْنَ. (يونس:58)
আপনি বলে দিন, আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমতের উপর সকলেরই আনন্দিত হওয়া উচিত। এটা ঐ সম্পদ হতে বহুগুণ উত্তম যা তারা সঞ্চয় করছে।[4]
সালফে সালেহীনের মতে, আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ হল, ইসলাম ও সুন্নাহ। ঊভয়ের মাধ্যমে প্রশান্তি লাভ করার নামই হল অন্তরের সজীবতা। যখনই মানুষের মাঝে উভয়টা সুদৃঢ় হবে, তখনই হৃদয় অত্যধিক আনন্দিত হবে এবং সুন্নাতের সংস্পর্শে ধন্য হবে।[5]
শর্তযুক্ত নিয়ামত
যেমন, শারীরিক সুস্থতা, সম্মান বৃদ্ধি পাওয়া, অধিক সন্তান হওয়া ও পূণ্যবতী স্ত্রী লাভ করা ইত্যাদি।
আর এ জাতীয় নিয়ামত পাপী, পূণ্যবান, মুমিন, কাফির সকলেই পেয়ে থাকে। যখন এ কথা বলা হয় যে, কাফিরকে আল্লাহ তাআলা এ নিয়ামত দান করেছেন, তখন তা সত্য বলে গণ্য হবে। আর শর্তযুক্ত নিয়ামত কাফির ও পাপীকে আস্তে আস্তে দেয়া হয়।[6]
[2]মায়েদা : ৩
[3] বুখারী - কিতাবুল ঈমান :১/৯
[4] ইউনুসঃ ৫৮
[5]ইজতিমাউল জুয়ুশিল ইসলামিয়াহ আলা গাজওয়াল মুআত্তালা ওয়াল জাহমিয়া- ইবনে কাইয়্যিম (র): ২/৩৩-৩৬
[6] ইজতিমাউল জুয়ুশিল ইসলামিয়াহ আলা গাজওয়াল মুআত্তালা ওয়াল জাহমিয়া - ইবনে কাইয়্যিম (র): ২/৩৬
সুন্নত আল্লাহ তা‘আলার সুরক্ষিত বেষ্টনী এবং তা প্রবেশকারীর জন্য নিরাপদ স্থান। এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এতে প্রবেশকারী গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। সুন্নাত প্রাত্যহিক জীবনে আমলের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পায়। সুন্নাত অনুযায়ী আমলের ক্ষেত্রে দুর্বলতার কারণে সুন্নাতের নূর হ্রাস পায়। মুনাফিক ও বিদআতপন্থীদের সুন্নাতের নূরও দূর হয়ে যায়। তাইতো কিয়ামতের দিন সুন্নাতের অনুসারীদের চেহারা উজ্জ্বল হবে। পক্ষান্তরে কাফির ও বিদআতপন্থীদর চেহারা কৃষ্ণবর্ণ ও মলিন হবে।
আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেনঃ
يَوْمَ تَبْيَضُّ وُجُوْهٌ وَ تَسْوَدُّ وَ (آل عمران: 106)
অর্থঃ সেদিন কিছু চেহারা শ্বেতবর্ণ উজ্জ্বল আর কিছু চেহারা কৃষ্ণবর্ণ মলিন হবে।[1]
ইবনে আববাস (রা) বলেন, সুন্নাতের অনুসারীদের চেহারা শ্বেতবর্ণ ও উজ্জ্বল হবে। পক্ষান্তরে বিদআতপন্থী ও মুসলিমদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিকারীদের চেহারা কৃষ্ণবর্ণ বা মলিন হবে।[2]
সুন্নাত হলো জীবন ও নূর যা বান্দার সৌভাগ্য, হেদায়াত ও বিজয় নিয়ে আসে।
আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন :
أومَنْ كَانَ مَيْتًا فَأَحْيَيْنَاهُ وَجَعَلْنَا لَهُ نُورًا يَمْشِى بهِ فِى النَّاسِ كَمَن مَّثَلُهُ
(الأنعام :122)
অর্থঃ এমন ব্যক্তি যে ছিল প্রাণহীন। অতঃপর তাকে আমি জীবন দান করি এবং তার জন্য এমন আলোর (ব্যবস্থা) করে দেই যার সাহায্যে সে মানুষের মাঝে চলা-ফেরা করতে থাকে। সে কি এমন লোকের মতো হতে পারে যে (ডুবে) আছে অন্ধকার পুঞ্জের মধ্যে? তা হতে বের হওয়ার পথ পাচ্ছে না। এরূপেই কাফিরদের জন্য তাদের কার্যকলাপ মনোরম বানিয়ে দেয়া হয়েছে।[3]
[2]ইজতিমাউল জুয়ুশিল ইসলামিয়াহ আলা গাজওয়াল মুআত্তালা ওয়াল জাহমিয়া- ইবনে কাইয়্যিম (র): ২/৩৯
[3] আনআম : ১২২
সুন্নাতের অনুসারীর মর্যাদা
প্রকৃত সুন্নাতের অনুসারী ব্যক্তি সজিব, সতেজ ও আলোকিত হৃদয়ের অধিকারী হয়। যা আল্লাহ্ তা‘আলা কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন। এটা ঈমানদারদের একটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য। কেননা সজিব ও আলোকিত হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান, বুদ্ধি ও হেদায়াত প্রাপ্ত। তারা তাওহীদে বিশ্বাসী ও রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর প্রকৃত অনুসারী হওয়ার তাওফিক লাভ করে থাকে।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্ তা’আলার নিকট প্রার্থনা করে বলতেন, আল্লাহ্ যেন তাঁর অন্তরে, কানে, চোখে, জিহবায়, উপরে-নিচে, ডানে-বামে, সামনে-পিছনে নূর বা আলো দান করেন। তাঁর ব্যক্তি সত্ত্বাকেও যেন নূরের দ্বারা আলোকিত করেন। তাঁর গোস্ত, হাঁড় ও রক্তের মধ্যেও যেন নূর দান করেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এভাবে তাঁর নিজ সত্ত্বা, সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ অনুভূতি এবং ষষ্ঠ দিকের জন্য আল্লাহর নিকট নূর প্রার্থনা করেছেন।
প্রত্যেক মুমিনের ভিতর-বাহির, কথা-কাজ ইত্যাদি সবই সমুজ্জ্বল। আর এ আলো মুমিন ব্যক্তির জন্য কিয়ামতের দিন তার ঈমানী শক্তির দৃঢ়তা ও দুর্বলতার উপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হবে। এ আলো তার সামনে পিছনে চলতে থাকবে। সেদিন কারো কারো নূরের জ্যোতি হবে সূর্যের জ্যোতির ন্যায়, আবার কারো চন্দ্রের জ্যোতির ন্যায়, আবার কারো কারো জ্যোতি হবে লম্বা খেজুর গাছের ন্যায়, কারো জ্যোতি হবে দন্ডায়মান মানুষের ন্যায়, এমনকি মুমিনদের কাউকে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলের মাথায় নূর দেয়া হবে। তা একবার জ্বলবে আবার নিভে যাবে। মোট কথা দুনিয়াতে যে যতটুকু ঈমানের শক্তিতে বলিয়ান ছিল কিয়ামতের দিন তাকে ততটুকু ঈমানের জ্যোতি দেয়া হবে।[1]
সুন্নাতের অনুসারীদের বৈশিষ্ট্য
সুন্নাতের অনুসারীদের কতিপয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে
১. কুরআন ও হাদীস এমন ভাবে আঁকড়ে ধরা যেমন ভাবে মাড়ির দাঁত দিয়ে কোন কিছু আঁকড়ে ধরা হয়, যা সহজে ছুটে না।
২. দ্বীনের মৌলিক বিধানাবলী ও তার শাখা-প্রশাখার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীস অনুসরণ করা।
৩. সুন্নাতের অনুসারীদের ভালবাসা ও বিদআতের অনুসারীদের ঘৃণা করা।
৪. সুন্নাতের অনুসারীরা সংখ্যায় কম হলেও নিজেকে একাকী না ভাবা। কেননা সততা মুমিনের হারানো সম্পদ। সে সত্যকে গ্রহণ করে যদিও মানুষ তার বিরোধিতা করে।
৫. কুরআন ও হাদীসের আদর্শ বাস্তবায়নের নিমিত্তে কথা ও কাজে সত্যাশ্রয়ী হওয়া।
৬. রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেই একমাত্র আদর্শের মাপকাঠি হিসেবে মেনে নেয়া। কারণ তার চরিত্রই হচ্ছে আল-কুরআনের প্রতিচ্ছবি।[2]
বিদআতের অনুসারীদের অবস্থান
বিদআতের অনুসারীরা মৃত ও অন্ধকারাচ্ছন্ন হৃদয়ের অধিকারী। আল্লাহ্ তা‘আলা অবিশ্বাসীকে মৃত ও অন্ধকারে নিমজ্জিত ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মৃত ও অন্ধকার হৃদয় সম্পন্ন ব্যক্তি আল্লাহ ও দ্বীনের পরিচয় সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অজ্ঞ। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের অবস্থা বর্ণনায় বলেন : এরা জীবিত নয়, বরং মৃত এবং এরা অন্ধকারে এমনভাবে নিমজ্জিত যা থেকে বের হতে পারবে না।
বিদআতের অন্ধকার তাদের গোটা জীবনকে আচ্ছন্ন করে রাখার কারণে তাদের অন্তর হক বা সত্যকে বাতিল হিসেবে আর বাতিলকে হক হিসেবে গণ্য করে। তাদের যাবতীয় কথা, কাজ এমনকি তাদের গোটা জীবনটাই অন্ধকারাচ্ছন্ন। পরিশেষে তাদের কবরও হবে অন্ধকারময়।
যখন কিয়ামতের দিন পুলসিরাত পার হওয়ার জন্য মানুষের মাঝে নূর বন্টন করা হবে, তখনও তাদের অন্ধকারের মধ্যেই রাখা হবে। এ নূর তারা পাবে না। তাদের আবাসস্থল হবে জাহান্নাম।
আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দাদের মধ্য থেকে যার কল্যাণ কামনা করেন, তাকে অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখান। আর যার কল্যাণ কামনা করেন না। তাকে অন্ধকারের মধ্যেই রেখে দেন।[3]
[2] আকীদাতুস সালফ ও আসহাবুল হাদীস- ইমাম আবু উসমান ইসমাঈল ইবনে আব্দুর রহমান : ২৬৪পৃ:
[3] ইজতিমাউল জুয়ুশিল ইসলামিয়াহ আলা গাজওয়াল মুআত্তালা ওয়াল জাহমিয়া - ইবনে কাইয়্যিম (র): ২/৩৮-৪১
বিদআতের শাব্দিক অর্থ
দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়ার পর তাতে নতুন কিছু প্রবর্তিত হওয়া, অথবা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইনতিকালের পর দ্বীনের মধ্যে ইবাদতের নামে মনগড়া কিছু রসম-রেওয়াজ চালু করা। বিদআত শব্দের মূল ধাতু হল بدع এর অর্থ কোন উপমা ছাড়াই নতুন কিছু সৃষ্টি করা।[1]
যেমন- কুরআনে এসেছে, بَدِيْعُ السََّمَوتِ وَ اْلأَرْضِ
অর্থ : আসমান ও জমিন সৃষ্টিকারী।[2]
পারিভাষিক অর্থ
ওলামায়ে কেরাম বিদআতের বিভিন্ন সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন, যা একটি অপরটির পরিপূরক।
১. শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেনঃ দ্বীনের মধ্যে বিদআত হচ্ছে এমন আমল, যা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামে প্রবর্তন করেননি এবং মুস্তাহাব বা ওয়াজিব হিসেবেও এর কোন অনুমোদন দেননি।[3]
বিদআত সাধারণত দু’ প্রকার
ক. কথা ও বিশ্বাসের মধ্যে বিদআত ও খ. ইবাদাত ও কাজের মধ্যে বিদআত।
এখানে প্রথম প্রকার দ্বিতীয় প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম আহমদ রহ. ও অন্যান্য আলিমগণ স্বীয় মাযহাবে ঘোষণা দিয়েছেন যে, স্বভাব ও ইবাদতের সমষ্টির নাম আমল।
ইবাদত হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু এসেছে সে অনুযায়ী বিনীত হয়ে আমল করা।
স্বভাবের মূল হচ্ছে আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন একমাত্র তাই ক্ষতিকর মনে করা।[4]
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেনঃ বিদআত হচ্ছে, ইবাদত এবং বিশ্বাসে কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মতের পরিপন্থী কাজ করা। যথা-খারেজী, রাফেজী, কাদরিয়া ও জাহমিয়াদের কার্যক্রম অথবা যারা মসজিদে জিকির আজকারের নামে নাচ-গানের অনুষ্ঠান করে তাদের অনুকরণ করা অথবা কুরআন ও হাদীস বিরোধী জীবন-যাপন করা।[5]
২. আল্লামা শাতবী রহ. বলেনঃ বিদআত হচ্ছে, দ্বীনের মধ্যে নব আবিস্কৃত বিষয়াবলী যা ইবাদতের সাদৃশ কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা ইবাদত নয়। এর দ্বারা আল্লাহর ইবাদত বেশি পরিমাণে করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।[6]
যারা স্বভাবগত কাজকে বিদআতের অন্তর্ভুক্ত মনে করে না এ সংজ্ঞা তাদের মতামত অনুযায়ী । তারা শুধুমাত্র শরীয়ত বহির্ভূত কাজকেই ইবাদত হিসেবে পালন করাকে বিদআত বলে। যারা স্বভাবগত কাজকে বিদআতের অন্তর্ভুক্ত করে; তারা বলেনঃ বিদআত হল, দ্বীনের মাঝে নব আবিস্কৃত বিষয় যা শরীয়তের কার্যক্রমের সাদৃশ এবং বিদআতি কার্যকলাপকে সাওয়াবের কাজ মনে করা।[7]
অতঃপর তিনি আরও একটি সংজ্ঞা বর্ণনা করেনঃ স্বভাবগত কাজকে অভ্যাস হিসেবে আমল করলে তা বিদআত হবে না কিন্তু তা যদি ইবাদত হিসেবে করা হয় কিংবা ইবাদত হিসেবে নামকরণ করা হয় তাহলে বিদআত হবে। এখানে তিনি দু’টি সংজ্ঞাকে একত্রে এনেছেন। স্বভাবগত বিষয় যা করা ইবাদত। যেমন, ক্রয়-বিক্রয়, বিবাহ-তালাক ও ভাড়া দেয়া ইত্যাদি। কেননা এগুলোতে কিছু শর্ত ও নিয়মাবলী রয়েছে যে সম্পর্কে মানুষকে কোন স্বাধীনতা দেয়া হয়নি।[8]
৩. হাফেয ইবনে রজব রহ. বলেন : বিদআত হচ্ছে, দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু বিষয় প্রচলন করা শরীয়তে যার কোন ভিত্তি নেই। শরীয়তে যার ভিত্তি আছে তা বিদআত হবে না।[9]
এমন প্রত্যেক বস্তু যা দ্বীনের অংশ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয় অথচ ইসলামে এর কোন ভিত্তি নেই, তা স্পষ্ট ভ্রষ্টতা। দ্বীন ইসলাম এ সকল ভ্রষ্টতা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। চাই সেটা বিশ্বাসগত হোক বা বক্তব্যধর্মী অথবা কর্মমূলক। মোট কথা দ্বীন নব আবিস্কৃত বিদআত থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
সালফে সালেহীনের উক্তি মতে কতিপয় নব আবিস্কৃত বিষয়কে উত্তম বলা হয়েছে। এর দ্বারা আভিধানিক বিদআত বুঝানো হয়েছে, শরীয়তে নিষিদ্ধ বিদআত বুঝানো হয়নি।
যেমন- ক. উমর (রা) এর যুগে যখন রমযান মাসে লোকজন মসজিদে একজন ইমামের পিছনে তারাবীহর সালাত পড়ার জন্য একত্রিত হল, তখন তিনি বের হলেন এবং লোকজনকে এ অবস্থায় দেখে বললেন, এটা কতই না উৎকৃষ্ট বিদআত![10]
উমর (রা) এর এ কথার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইতিপূর্বে এ ধরণের কাজ আর কখনো সংঘটিত হয়নি, অথচ এটা শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত।
খ. রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমযান মাসে কিয়ামুল-লাইলের জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় লোকজন মসজিদে এসে কেউ জামাতে, কেউ একা কিয়ামুল লাইল তথা নফল সালাত আদায় করতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীদের নিয়ে মাঝে মাঝে জামাতে সালাত আদায় করতেন। তিনি ভবিষ্যত উম্মতের অক্ষমতার বিষয় ও পরে তা ফরজ করে দেয়ার আশংকায় তা আদায় করতে নিষেধ করেছিলেন।[11]
গ. অনুরূপ রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতকে খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতের অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর কিয়ামুল লাইল খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত।[12]
বিদআত সাধারণত দু‘ধরণের :
১। কুফরী : যার মাধ্যমে উক্ত বিদআতপন্থী ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে।
২। ফাসেকী : যার মাধ্যমে উক্ত বিদআতপন্থী ইসলাম থেকে বের হবে না কিন্তু গুনাহগার হবে।[13]
[2] আনআমঃ ১০১
[3] ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া : ৪/১০৭
[4] ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া :৪/১৯৬
[5] ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া : ১৮/৩৪৬
[6] আল-ইতিসাম - শাতেবী (র) : ১/৫৩
[7] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ১/৫০-৫৬
[8] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) :২/৫৬৮
[9] জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ২/১২৭
[10] বুখারী : ২০১০
[11] বুখারী : ২০১২
[12] জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম : ২/১২৯
[13] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ২/৫১৬
কোন আমলই আল্লাহ তাআলার নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তাতে দু‘টি শর্ত পাওয়া না যাবে।
এক. ইখলাছের সাথে ইবাদত করা, অর্থাৎ আমল বা ইবাদত একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য করা।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى. (متفق عليه)
অর্থঃ প্রত্যেক কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল। মানুষ যে নিয়ত করবে তাই পাবে।[1]
দুই. সুন্নাতের অনুসরণ অর্থাৎ ইবাদতে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাতের পূর্ণ অনুসরণ।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ. (مسلم)
অর্থঃ যে ব্যক্তি আমাদের পক্ষ থেকে স্বীকৃত নয় এমন কোন আমল করল, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।[2]
সুতরাং যার ঈমান ও আমল একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাত মোতাবেক হবে, তার সে আমল আল্লাহ্ তা’আলার নিকট গ্রহণযোগ্য হবে। আর যদি এ দু‘টি শর্ত বা কোন একটি পাওয়া না যায়, তাহলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
(الفرقان :২৩) وَ قَدِمْنآَ إِلى مَاعَمِلُوا مِنْ عَمَلٍ فَجَعَلْنَاهُ هَبَآءً مُّنْثُوْرًا
অর্থঃ আমি তাদের কর্মগুলোর প্রতি মনোনিবেশ করব, অতঃপর তা বিক্ষিপ্ত ধুলিকণায় পরিণত করে দেব।[3]
এ দু‘টো বিষয়ই আল্লাহ্ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
وَمَنْ أَحْسَنُ دِيْنًا مِّمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلّهِ و هُوَ مَحْسِنٌ. (النساء : 125)
অর্থঃ যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণ করে ও সৎ কর্ম করে, তার অপেক্ষা কার ধর্ম উৎকৃষ্ট?[4]
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র ইরশাদ করেনঃ
بَلَى مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَلَهُ أَجْرُهُ عِنْدَ رَبِّهِ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ. (البقرة : 112)
অর্থ : অবশ্য যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য নিজেকে সম্পূর্ণরূপে সমর্পণ করেছে এবং সৎ কর্মশীল হয়েছে, তার জন্য স্বীয় রবের নিকট প্রতিদান রয়েছে এবং তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না।[5]
উমর (রা) বর্ণিত إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ অর্থঃ ‘‘প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’’ হাদীসটি আন্তরিক আমল বা কার্যাবলীর মানদন্ড। আর উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা) বর্ণিত, مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ অর্থঃ ‘‘যে ব্যক্তি আমাদের পক্ষ থেকে স্বীকৃত নয় এমন কোন আমলের প্রচলন করল, তা প্রত্যাখ্যাত হবে’’। হাদীসটি বাহ্যিক আমল বা কার্যাবলীর মানদন্ড।
এ দু’টি হাদীসের মধ্যে দ্বীনের সকল বিষয় তথা মৌলিক ও শাখা-প্রশাখা বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সকল কথা বা কাজ সম্পর্কে দিক নির্দেশনা রয়েছে।
ইমাম নববী রহ. আয়েশা (রা) এর হাদীসের উপর একটি মূল্যবান কথা বলেছেন। তিনি বলেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বাণী :
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ অর্থঃ ‘‘যে ব্যক্তি আমাদের পক্ষ থেকে স্বীকৃত নয় এমন কোন আমলের প্রচলন করল, তা প্রত্যাখ্যাত হবে’’। দ্বিতীয় বর্ণনায় এসেছে, مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ অর্থঃ ‘‘যে ব্যক্তি আমাদের পক্ষ থেকে স্বীকৃত নয় এমন কোন আমল করল, তা প্রত্যাখ্যাত হবে’’। হাদীসদ্বয়ে উল্লেখিত শব্দ সম্পর্কে আরবগণ বলেনঃ الرد শব্দটা এখানেمردود তথা প্রত্যাখ্যাত অর্থে। যার প্রকৃত অর্থ হচ্ছেঃ যে আমল রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পক্ষ থেকে অনুমোদিত নয় তা বাতিল, প্রত্যাখ্যাত ও অগ্রহণযোগ্য। এ হাদীসটি ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ একটি উসূল বা মূলনীতি। এর মাধ্যমে সকল প্রকারের বিদআত, নব আবিস্কৃত ও বানোয়াট বিষয়াবলীর মূলোৎপাটন করা হয়েছে।
তবে আয়েশার (রা) বর্ণনা দু’টির প্রথমটিতে من أحدث ও দ্বিতীয়টিতে من عمل শব্দ এসেছে। এ হাদীসদ্বয়ের মাধ্যমে সকল প্রকার বিদআতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন, কেউ পূর্ব প্রবর্তিত বিদআত অনুযায়ী আমল করল কিন্তু সে নিজে এর প্রবর্তক নয়, তাহলে তাকে দ্বিতীয় হাদীসের আওতাভুক্ত বলা হবে। মোট কথা সকল প্রকার বিদআত চাই সেটা আমল করা হোক বা প্রবর্তন করা হোক, সবই পথভ্রষ্টতার শামিল ও প্রত্যাখ্যাত।[6]
[2] মুসলিম : ১৭১৮
[3] ফুরকানঃ ২৩
[4] নিসা : ১২৫
[5] বাকারা : ১১২
[6] ইমাম নববীর শরহে মুসলিম : ১৪/২৫৭
বিদআতের নিন্দা বা তিরস্কার সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে অনেক বর্ণনা এসেছে। সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীগণ বিদআত থেকে বিরত থাকার জন্য বিভিন্নভাবে সতর্কতা প্রদর্শন করেছেন। সংক্ষেপে তা আলোচনা করা হলঃ
দ্বীনের মধ্যে বিদআতের নিন্দা
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
هُوَ الَّذِيْ أَنزَلَ عَلَيْكَ الكِتَابَ مِنْهُ أياتٌ مُّحْكَمَاتُ هُنَّ أُمُّ الْكِتَابِ وَأُخَرُ مُتَشَابَهَاتُ فَأَمَّا الّذِّيْنَ فِى قُلُوبِهِمْ زَيْغُ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَاءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَآءَ تَأْوِيْلِهِ وَمَا يَعْلُمُ تَأْوِيْلَهُ إِلاَّ اللهُ. (آل عمران:7)
অর্থঃ তিনিই আপনার প্রতি কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, যাতে অকাট্য আয়াতসমূহ রয়েছে ওগুলো কিতাবের মূল। এ ছাড়া কতিপয় আয়াত অস্পষ্ট। অতএব যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে, মূলতঃ তারাই অশান্তি সৃষ্টি ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে অস্পষ্টের অনুসরণ করে। আর আল্লাহ্ ব্যতীত এর প্রকৃত অর্থ অন্য কেউ অবগত নয়।[1]
ইমাম শাতেবী রহ. এর সমর্থনে কিছু আসর (সাহাবীদের উক্তি) পেশ করেছেন। যদ্বারা বুঝা যায়, উক্ত আয়াতটি কুরআনের বক্তব্য নিয়ে যারা বিতর্ক করে তথা খারেজী বা তাদের সমগোত্রীয়দের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :
وَأَنَّ هَذاَ صِِرَاطي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلاَ تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيْلِهِ ذَلكُمْ وَصّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ. (الأنعام: 153)
অর্থঃ এ পথই আমার সরল পথ, সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ কর। এ পথ ছাড়া অন্য কোন পথের অনুসরণ করবে না। কারণ তা তোমাদেরকে হেদায়াতের পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে। আল্লাহ তোমাদের এ নিদের্শ দিলেন যেন তোমরা সতর্ক হও।[2]
সুতরাং সিরাতে মুস্তাকীম হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত সহজ সরল ও সঠিক পথ। যে পথের দিকে উক্ত আয়াতে আহবান করা হয়েছে। এটাই রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাত তথা জীবনাদর্শ। আর সুবুল বা বিভিন্ন রাস্তা হচ্ছে (দ্বীনের মধ্যে) মতানৈক্য ও বিদআত সৃষ্টিকারীদের পথ। উপরোক্ত আয়াতে সকল প্রকারের বিদআত সৃষ্টিকারীদের পথ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেনঃ
وَعَلَى اللهِ قَصْدُ السَّبِيلِ وَ مِنْهاَ جَآئِرٌ وَلَوْ شَآءَ لَهَداكُمْ َأجْمَعِيْنَ. (النحل:9)
অর্থঃ সরল পথ আল্লাহর নিকট পৌছার মাধ্যম, কিন্তু কিছু বক্র পথও রয়েছে; তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সকলকে সৎপথে পরিচালিত করতেন।[3]
কাস্দুস সাবিল হচ্ছে সত্যের পথ, এর বাইরের সকল পথ সত্য হতে বিচ্যুত এবং তা বিদআতে পরিপূর্ণ ও ভ্রান্ত।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
إِنَّ الذِّيْنَ فَرَّقُواْ دِينَهُمْ وَكَانُواْ شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِى شَييء إِنَّمَآ أَمْرُهُمْ إِلَى اللهِ ثُمَّ يُنَبِّئُِِهُمْ بِمَا كَانوُاْ يَفْعَلُونَ.(الأنعام:159)
অর্থঃ নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দ্বীনে মতভেদ সৃষ্টি করে এবং বিভিন্ন দলে- উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে, তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের বিষয়টি আল্লাহর দায়িত্বে রয়েছে। পরিশেষে তিনিই তাদেরকে নিজ কর্মকান্ড সম্পর্কে অবহিত করবেন।[4]
এরাই হচ্ছে প্রবৃত্তির অনুসারী, পথভ্রষ্ট এবং বিদআত সৃষ্টিকারী।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَلاَ تَكُونُواْ مِنَ الْمُشْرِكِيْنَ مِنَ الَّذِيْنَ فَرَّقُواْ دِينَهُمْ وَكَانُواْ شِيَعًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيهِمْ فَرِحُونَ . (الروم :31-32)
অর্থঃ তোমরা মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না। যারা নিজেদের দ্বীনের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে উৎফুল্ল।[5]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِه أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ ألِيْمٌ . ( النور: 63)
অর্থঃ সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের এ ভয় করা উচিত যে, তাদের উপর বিপর্যয় আপতিত হবে অথবা কঠিন শাস্তি তাদের গ্রাস করবে।[6]
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
قُلْ هُوَ الْقاَدِرُ عَلَى أن يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عَذَابًا مِّن فَوْقِكُمْ أَوْ مِن تَحتِ أَرْجُلِكُمْ أَوْ يَلْبِسَكُمْ شِيَعًا.(الأنعام: 65)
অর্থঃ হে রাসূল! বলুন, আল্লাহ তোমাদের উর্ধ্বদেশ অথবা তলদেশ হতে শাস্তি প্রেরণ করতে এবং তোমাদের বিভিন্ন দলে উপদলে বিভিক্ত করতে যথেষ্ট ক্ষমতাবান।[7]
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَلاَ يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ، إِلاَّ مَن رَّحِمَ رَبُّكَ . (الهود: 118-119)
অর্থঃ আর তারা সদা-সর্বদা মতভেদ সৃষ্টি করতে থাকবে কিন্তু যার প্রতি আপনার রবের অনুগ্রহণ হয় (সে মতভেদ করবে না)।[8]
দ্বিতীয় : হাদীস
বিদআতের নিন্দা, তিরস্কার ও তা থেকে সতর্কতা প্রদর্শন করে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) অনেক হাদীস বর্ণনা করেছেন। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হলঃ
আয়েশা (রা) বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলছেনঃ
مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ مِنْهُ فَهُوَ رَدٌّ. وفي رواية مسلم مَنْ عَمِلَ عَمَلًا لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهُوَ رَدٌّ. (بخاري ومسلم)
অর্থঃ যে আমাদের দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু প্রবর্তন করল, যা এর অন্তর্ভুনয় তা প্রত্যাখ্যাত। মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় রয়েছেঃ যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করল যা আমাদের পক্ষ থেকে অনুমোদিত নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।[9]
জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) স্বীয় জুমআর খুতবায় বলেছেনঃ
فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الْأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ. (مسلم)
অর্থঃ উত্তম বাণী হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার বাণী। আর উত্তম পথনির্দেশনা হচ্ছে মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর পথনির্দেশনা। নিকৃষ্টতম বিষয় হচ্ছে (দ্বীনের মধ্যে) নতুন নতুন বিধান ইবাদতের নামে প্রবর্তন করা, প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা।[10]
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুতবায় আল্লাহর প্রশংসা করার পর বলেনঃ
مَنْ يَهْدِهِ اللَّهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ وَمَنْ يُضْلِلْهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللَّهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْيِ هَدْيُ مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الْأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌ وَكُلُّ ضَلَالَةٍ فِي النَّارِ. (مسلم ونسائي)
অর্থঃ আল্লাহ্ যাকে হেদায়াত দান করেন তাকে কেউ পথভ্রষ্ট করতে পারে না। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোন পথ প্রদর্শনকারী নেই। নিশ্চয়ই সর্বাধিক সত্যবাণী হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার কিতাবের বাণী। আর সর্বোত্তম পথ হলো মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কর্তৃক প্রদর্শিত পথ। আর মন্দ বিষয়গুলো হলো (দ্বীনের মধ্যে) নবসৃষ্ট আমল বা কাজ। প্রত্যেক নবসৃষ্ট আমলই বিদআত। প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতাই জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।[11]
আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
مَنْ دَعَا إِلَى هُدًى كَانَ لَهُ مِنْ الْأَجْرِ مِثْلُ أُجُورِ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْئًا وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلَالَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنْ الْإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لَا يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا. (مسلم)
অর্থঃ যে ব্যক্তি (মানুষকে) হেদায়াতের দিকে আহবান করবে, সে হেদায়াতের পথ অনুসরণকারীর সমপরিমাণ সাওয়াব পাবে। এতে কারো সাওয়াব কম হবে না। আর যে ব্যক্তি (মানুষকে) পথভ্রষ্টতার দিকে আহবান করবে সে ঐ ভ্রষ্টপথ অনুসরণকারীর সমপরিমাণ গুনাহগার হবে। এতে কারো গুনাহ কম হবে না।[12]
জারির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা) বলেন :
مَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا بَعْدَهُ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَيْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِي الْإِسْلَامِ سُنَّةً سَيِّئَةً كَانَ عَلَيْهِ وِزْرُهَا وَوِزْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ بَعْدِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَيْءٌ. (مسلم)
অর্থঃ যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন ভাল কাজের প্রচলন করল তার জন্য সে কাজের প্রতিদান রয়েছে এবং পরবর্তীতে যারা ঐ ভাল কাজের উপর আমল করল তা থেকেও সে প্রতিদান পাবে, এতে কারো প্রতিদান কম করা হবে না। এমনিভাবে যে ব্যক্তি কোন মন্দ কাজের প্রচলন করল তার আমলনামায় সে মন্দ কাজের গুনাহ রয়েছে এবং পরবর্তীতে উক্ত গুনাহে লিপ্তদের গুনাহও লিখা হবে। এতে কারো গুনাহ কম হবে না।[13]
ইরবাজ বিন সারিয়া (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন :
وَعَظَناَرَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَوْعِظَة وَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوْبُ وَذَرَفَتْ مِنْهاَ الْعُيُوْنُ فَقُلْنَا: يَارَسُوْلَ اللهِ! كَأَنَّـهَا مَوْعِظَةُ مُوْدِعُ فَأَوْصِناَ قَالَ: أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ تُأَمَّرُ عَلَيْكُمْ عَبْدُ، فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالٌ. (أبوداود)
অর্থঃ একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের মাঝে এমন ভাষণ দিলেন যাতে আমাদের অন্তর বিগলিত হল এবং চক্ষু হতে অশ্রু প্রবাহিত হল, তখন আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! মনে হচ্ছে এ আলোচনা যেন বিদায়ী উপদেশ। সুতরাং আমাদের আরো কিছু ওসিয়ত করুন। তখন তিনি বললেনঃ আল্লাহকে ভয় কর, আমীরের কথা শোন এবং তার আনুগত্য কর; যদিও সে কৃতদাস হয়। আর যে ব্যক্তি আমার পর বেঁচে থাকবে সে অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে, সে সময় তোমাদের উচিত হবে আমার এবং আমার খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরা যেমনি তোমরা কোন বস্ত্ত মাড়ির দাঁত দিয়ে মজবুত ভাবে আঁকড়ে ধর। বিদআত পরিহার কর। কেননা সকল প্রকার বিদআতই পথভ্রষ্টতা।[14]
হুজাইফা (রা) হতে বর্ণিত :
كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُونَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ الْخَيْرِ وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنْ الشَّرِّ مَخَافَةَ أَنْ يُدْرِكَنِي فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّا كُنَّا فِي جَاهِلِيَّةٍ وَشَرٍّ فَجَاءَنَا اللَّهُ بِهَذَا الْخَيْرِ فَهَلْ بَعْدَ هَذَا الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ قَالَ نَعَمْ قُلْتُ وَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الشَّرِّ مِنْ خَيْرٍ قَالَ نَعَمْ وَفِيهِ دَخَنٌ قُلْتُ وَمَا دَخَنُهُ قَالَ قَوْمٌ يَهْدُونَ بِغَيْرِ هَدْيِي تَعْرِفُ مِنْهُمْ وَتُنْكِرُ قُلْتُ فَهَلْ بَعْدَ ذَلِكَ الْخَيْرِ مِنْ شَرٍّ قَالَ نَعَمْ دُعَاةٌ عَلَى أَبْوَابِ جَهَنَّمَ مَنْ أَجَابَهُمْ إِلَيْهَا قَذَفُوهُ فِيهَا قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ صِفْهُمْ لَنَا قَالَ هُمْ مِنْ جِلْدَتِنَا وَيَتَكَلَّمُونَ بِأَلْسِنَتِنَا قُلْتُ فَمَا تَأْمُرُنِي إِنْ أَدْرَكَنِي ذَلِكَ قَالَ تَلْزَمُ جَمَاعَةَ الْمُسْلِمِينَ وَإِمَامَهُمْ قُلْتُ فَإِنْ لَمْ يَكُنْ لَهُمْ جَمَاعَةٌ وَلَا إِمَامٌ قَالَ فَاعْتَزِلْ تِلْكَ الْفِرَقَ كُلَّهَا وَلَوْ أَنْ تَعَضَّ بِأَصْلِ شَجَرَةٍ حَتَّى يُدْرِكَكَ الْمَوْتُ وَأَنْتَ عَلَى ذَلِكَ. (متفق عليه)
অর্থঃ লোকজন রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে কল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করত, আর আমি অকল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম যাতে তা থেকে বেঁচে থাকতে পারি। কোন এক সময় আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা জাহেলিয়াত ও কুসংস্কারের মাঝে নিমজ্জিত ছিলাম, অতঃপর আল্লাহ আমাদের কল্যাণের পথ দেখালেন, এ কল্যাণের পরে কি আবার অকল্যাণ আসবে? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ; অতঃপর আবার জিজ্ঞেস করলাম, এ অকল্যাণের পর কি আবার কল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ; কিন্তু তার মধ্যে ফ্যাসাদ থাকবে। আমি বললাম, তার মধ্যে ফ্যাসাদ কি? তিনি বললেন, এক দল লোক সুন্নাতের অনুসারী হবে বটে, তবে তা আমার সুন্নাত নয়। তারা আমার সুন্নাত ছেড়ে অন্য মতাদর্শ গ্রহণ করবে, তাদের মাঝে সৎকর্ম এবং অসৎকর্ম উভয়টিই পাওয়া যাবে। আমি বললাম, এ কল্যাণের পরও কি আবার অকল্যাণ আসবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ; একদল লোক মানুষকে জাহান্নামের দিকে আহবান করবে, যারা তাদের ডাকে সাড়া দেবে তারা জাহান্নামের স্বাদ গ্রহণ করবে। অতঃপর আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাদের পরিচয় দিন। তিনি বললেন, তারা আমাদের স্ব-জাতি ও আমাদের ভাষাতেই কথা বলবে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! ঐ সময় যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে আমার জন্য আপনার পরামর্শ কি? তিনি বললেন, তুমি মুসলিম জামাআত ও তাদের ইমামের অনুসরণ করবে। আমি বললাম, যদি তাদের জামাআত ও ইমাম না থাকে? তিনি বললেন, তাহলে সকল জামাআতই পরিত্যাগ করবে। যদি প্রয়োজন হয় কোন গাছের শিকড় ধরে আমরণ এভাবে পড়ে থাকবে।[15]
এ হাদীসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইমাম নববী রহ. বলেন, هدي(হাদী) শব্দের অর্থ হল ত্বরীকা ও আদর্শ। আর জাহান্নামের দিকে আহবানকারী দল প্রসঙ্গে উলামায়ে কেরাম বলেন, তারা হল সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ যারা মানুষকে বিদআতের দিকে আহবান করে। যেমন-খারেজী, কারামতী ও বস্ত্তবাদী দল।[16]
যায়েদ বিন আরকাম (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন :
أَلَا أَيُّهَا النَّاسُ فَإِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ يُوشِكُ أَنْ يَأْتِيَ رَسُولُ رَبِّي فَأُجِيبَ وَأَنَا تَارِكٌ فِيكُمْ ثَقَلَيْنِ أَوَّلُهُمَا كِتَابُ اللَّهِ فِيهِ الْهُدَى وَالنُّورُ [هوحبل الله المتين من أتبعه كان على الـهدى ومن تركه كان على الضلالة] فَخُذُوا بِكِتَابِ اللَّهِ وَاسْتَمْسِكُوا بِهِ.(مسلم)
অর্থঃ হে লোকসকল! নিশ্চয়ই আমি একজন মানুষ, যখনই আমার রবের পক্ষ থেকে মৃত্যুদূত আসবে তখনই আমি তার আহবানে সাড়া দেব। আর আমি তোমাদের জন্য দু‘টি বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি। তার একটি হল আল্লাহর কিতাব (অপরটি আমার সুন্নাত), যাতে রয়েছে হেদায়াত ও নূর। এটা আল্লাহর সুদৃঢ় রশি। যারাই এ কিতাব মেনে চলবে তারাই হেদায়াত পাবে। আর যারা তা ছেড়ে দেবে তারা পথভ্রষ্ট হবে। তোমরা আল্লাহর কিতাব সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর।[17]
এ হাদীসে আল্লাহর কিতাব মেনে চলার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।
আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
يَكُونُ فِي آخِرِ الزَّمَانِ دَجَّالُونَ كَذَّابُونَ يَأْتُونَكُمْ مِنْ الْأَحَادِيثِ بِمَا لَمْ تَسْمَعُوا أَنْتُمْ وَلَا آبَاؤُكُمْ فَإِيَّاكُمْ وَإِيَّاهُمْ لَا يُضِلُّونَكُمْ وَلَا يَفْتِنُونَكُمْ.(مسلم)
অর্থঃ শেষ জমানায় এমন কিছু মিথ্যাবাদী প্রতারকের আবির্ভাব ঘটবে, যারা তোমাদের কাছে এমনসব হাদীস বর্ণনা করবে; যা তোমরা ও তোমাদের পূর্ব পুরুষ কোন দিন শোননি। অতএব তোমরা তাদের হতে দূরে থাক যাতে তারা তোমাদের গোমরাহী ও ফিতনায় ফেলতে না পারে।[18]
তৃতীয় : বিদআত সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামদের মতামত
১. ইবনে সা’দ রহ. আবু বকর সিদ্দিক (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেনঃ উপস্থিত জনতা! নিশ্চয়ই আমি সুন্নাতের অনুসারী বিদআতপন্থী নই। যদি আমি ভাল কাজ করি তাহলে আমাকে সাহায্য করবে, আর যদি ভুল করি তাহলে সংশোধন করে দিবে।[19]
২. ওমর ইবনে খাত্তাব (রা) বলেন, তোমরা তর্কবীদদের থেকে দূরে থাক। কেননা তারা সুন্নাতের দুশমন এবং হাদীস অনুযায়ী আমলে অক্ষম। তারা মনগড়া মতামত বা রায় দিয়ে নিজেরাও গোমরাহ হয় অন্যকেও গোমারাহ করে।[20]
৩. আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, তোমরা সুন্নাতের অনুসরণ কর, বিদআতের অনুসরণ করবে না। এটাই তোমাদের জন্য যথেষ্ট। কেননা সকল প্রকার বিদআতই ভ্রষ্টতা।[21]
চতুর্থ : বিদআত সম্পর্কে তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীগণের অভিমত
১. ওমর ইবনে আব্দুল আজিজ রহ. এক ব্যক্তির নিকট চিঠি লিখেছিলেন, তিনি তাতে বলেছিলেন, আমি তোমাকে আল্লাহর ভয়, তাঁর হুকুমের ব্যাপারে মধ্যপন্থা অবলম্বন, তাঁর নবীর সুন্নাতের অনুসরণ করা এবং কোন ব্যাপারে সুন্নাত প্রমাণিত হওয়ার পর তা ছেড়ে বিদআত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিচ্ছি।[22]
২. হাসান বসরী রহ. বলেন, আমল ব্যতীত কোন কথা ছহীহ হবে না, নিয়ত ব্যতীত কোন কথা ও আমল ছহীহ হবে না এবং সুন্নাতের অনুসরণ ব্যতীত কোন নিয়ত, আমল ও কথা ছহীহ হবে না।[23]
৩. ইমাম শাফেয়ী রহ. বলেন, তর্কবীদদের ব্যাপারে আমার ফায়সালা হল খেজুরের ডাল দ্বারা তাদের প্রহার কর, উটের উপর আরোহন করাও, প্রতিটি গোত্রের মধ্যে প্রদক্ষিণ করার কালে একথা বলতে থাক যে, এরা কুরআন ও সুন্নাত ছেড়ে তর্কশাস্ত্র গ্রহণ করেছে। তাই এটাই এর উপযুক্ত বদলা।[24]
৪. ইমাম মালেক রহ. বলেন, যে ইসলামে উত্তম মনে করে কোন বিদআত প্রচলন করল, সে যেন এ ধারণা পোষণ করল যে, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর রেসালতের দায়িত্বে খিয়ানত করেছেন। পক্ষান্তরে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃالْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ. অর্থঃ আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম।[25]
অতএব এ যুগান্তকারী ঘোষণা কালে যে আমল দ্বীন হিসাবে স্বীকৃত ছিল না, তা আজও দ্বীন হতে পারে না।[26]
৫. ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. বলেন, সুন্নাতের উসূল হল, রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীগণ যা করেছেন তা গ্রহণ করা, তাদের অনুকরণ করা ও বিদআত পরিত্যাগ করা। কেননা সকল বিদআতই ভ্রষ্টতা। তাই ঝগড়া-বিবাদ পরিহার করা, প্রবৃত্তির অনুসারীদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকা, লৌকিকতা পরিহার করা এবং দ্বীনের ব্যাপারে বিতর্কে না জড়ানো উচিত।[27]
পঞ্চম : বিদআত অগ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণ
১. একথা সত্য যে, মানুষের জ্ঞান অহীর জ্ঞান ব্যতীত অসম্পূর্ণ। নিশ্চয়ই বিদআত অহীর পরিপন্থী।
২. শরীয়ত পূর্ণাঙ্গ রূপে এসেছে, তাতে কম-বেশি করার কোন অবকাশ নেই।
৩. বিদআতপন্থী শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণকারী।
৪. বিদআতপন্থী প্রবৃত্তির অনুসারী। কেননা জ্ঞান-বুদ্ধি যদি শরীয়ত সম্মত না হয়, তাহলে তা প্রবৃত্তির অনুসরণেই হয়।
৫. বিদআতপন্থী নিজেকে শরীয়ত প্রবর্তকের (আল্লাহ তা‘আলার) স্থলাভিষিক্ত বানিয়ে নেয়। কেননা শরীয়ত প্রবর্তক তা প্রবর্তন করে সে অনুযায়ী আমল করা অত্যাবশ্যক করেছেন আর বিদআত প্রবর্তক শরীয়তে নতুন কিছু প্রবর্তন করে তাই করতে চাচ্ছে।[28]
[2] আনআম : ১৫৩
[3] নাহলঃ ৯
[4] আনআম : ১৫৯
[5] রূমঃ ৩১-৩২
[6] আন-নূরঃ ৬৩
[7] আনআমঃ ৬৫
[8] হুদঃ ১১৮-১১৯
[9] বুখারী : ২৬৯৭ ও মুসলিম : ১৭১৮
[10] মুসলিম : ৮৬৭
[11] মুসলিম : ৮৬৭ ও নাসাঈ : ১৫৭৮
[12] মুসলিম : ২৬৭৪
[13] মুসলিম : ১০১৭
[14] আবু দাউদ : ৪৭০৭ ও তিরমিযী : ২৬৭৬
[15] বুখারী : ৭০৮৪ ও মুসলিম :১৮৪৭
[16] শরহে মুসলিম : ১২/৪৭৯
[17] মুসলিম : ২৪০৮
[18] মুকাদ্দামায়ে মুসলিম : ৬ ও ৭
[19] আত-তাবাকাতুল কুবরা : ৩/১৩৬
[20] সুনানে দারেমী : ১২১
[21] আল মুজামুল কাবীর : ৮৭৭
[22] আবু দাউদ : ৪৬১২
[23] শরহে উসূলে ই‘তিকাদে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ : ১/৬৩ নং ১৮
[24] আল হিলইয়াহ লেখক আবু নাইম : ৯/১১৬
[25] মায়িদাঃ ৩
[26] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ১/৬৫
[27] শরহে উসূলে ই‘তিকাদে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ : ১/১৭৬
[28] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ১/৬১-৭০
বিদআত সৃষ্টির অনেকগুলো কারণ রয়েছে। যেমন-
(১) অজ্ঞতা
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَلاَ تَقفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفؤَاد كُلُّ أُؤُلَئِكَ كَانَ عَنهُ مَسْئُولاً.(الإسراء : 36)
অর্থঃ যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই কর্ণ, চক্ষু, হৃদয় এর প্রত্যেকটির ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে।[1]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنهاَ وَ مَا بَطَنَ وَاْلإِثْمَ وَ الْبَغْيَ بَغَيْرِالْحَقِّ وَأَن تُشْرِكُواْ بِاللّهِ مَالَمْ يُنَزِّلُ بِهِ سٌلْطَانًا وَ اَنْ تَقٌولُواْ عَلَى اللهِ مَا لاَ تَعْلَمُونَ. (الأعراف: 33)
অর্থঃ আপনি বলে দিন, প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, পাপ, অসংগত বিরোধিতা এবং কোন কিছুকে আল্লাহর সাথে শরিক করা, যার স্বপক্ষে আল্লাহ কোন দলিল অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলা যে ব্যাপারে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই, এ সবই আমার রব নিষিদ্ধ করেছেন।[2]
আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে বলতে শুনেছিঃ
إِنَّ اللهَ لَا يَنْتَزِعُ الْعِلْمَ مِنَ النَّاسِ اِنْتِزَاعًا، وَلكِنْ يَقْبَضُ الْعُلَماَءَ فَيُرْفَعُ الْعِلْمُ مَعَهُمْ، وَيُبْقي فِيْ النَّاسِ رُؤُوْسًا جُهّالاً يَفْتُوْنَ بِغَيْرِ عِلْمٍ فَيَضَِلُّوْنَ وَ يُضِِلُّوْنَ .(متفق عليه)
অর্থঃ আল্লাহ মানুষ থেকে (দ্বীনি) জ্ঞান ছিনিয়ে নেবেন না বরং আলেমগণকে দুনিয়া থেকে উঠিয়ে নিবেন, তাদের সাথে ইল্মও উঠে যাবে। দুনিয়াতে মুর্খ নেতারা বেঁচে থাকবে তারা (কুরআন-হাদীসের) ইল্ম ব্যতীত ফতোয়া দিবে। ফলে নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে, অন্যদেরও পথভ্রষ্ট করবে।[3]
(২) প্রবৃত্তির অনুকরণ
প্রবৃত্তির অনুকরণ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর যা মানুষকে বিদআত সৃষ্টিকারী ও আত্মপুজারী বানিয়ে দেয়।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
يَادَاودُ إِنّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِى الاَرْضِ فَاحْكٍََُِِِمِِِْْْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَ لاَ تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِِِلَّكَ عَن سَبِيلِ اللهِ إِنَّ الَّذِينَ يَِضلُّوْنَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدُ بِماَ نَسُواْ يَوْمَ الْحِساَبِ. (ص: 26)
অর্থঃ হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি। অতএব তুমি মানুষের মাঝে সুবিচার কর এবং প্রবৃত্তির (খেয়াল খুশির) অনুসরণ কর না। কেননা এটা তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করবে। যারা আল্লাহর পথ পরিত্যাগ করে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কেননা তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে।[4]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا. (الكهف: 28)
অর্থঃ আপনি তার অনুসরণ করবেন না যার অন্তরকে আমি আমার স্মরণ থেকে অমনোযোগী করে দিয়েছি। সে আপন প্রবৃত্তির অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে।[5]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
أَفَرَءَيتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَ قَلْبَهِ و جَعَلَ عَلَى بَصَرَهِ غِشوَةً فَمَن يَهْدِيهِ مِنْ بَعْدِ اللهِ أَفَلاَ تَذَكَّرُونَ .(الجاثية: 23)
অর্থঃ আপনি কি ঐ ব্যক্তির দিকে লক্ষ্য করেছেন, যে প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে। আল্লাহ যথার্থই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন, তার কর্ণ ও হৃদয়ে মোহর লাগিয়ে দিয়েছেন এবং তার চোখের উপরে রেখেছেন আবরণ। অতঃপর আল্লাহর পর কে তাকে পথ নির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?[6]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَمَنْ أَضَلُّّّ مِمَّنِ اتَّبَع هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّّنَ اللهِ.( القصص: 50)
অর্থঃ আল্লাহর পক্ষ হতে হেদায়াত ব্যতীত যে আত্মপুজারী হয়, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে?[7]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
إِن يَتَّبعُونَ إِلاَّ الظَنَّ وَمَا تَهْوَى اْلأَنْفُسُ وَلَقَدْ جَآءَهُمْ مِّن رَّبِّهُمْ الْـهُدى.(النجم: 23)
অর্থঃ তারা তো অনুমান এবং নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে, অথচ তাদের নিকট আপন রবের পথ নির্দেশ এসেছে।[8]
(৩) সন্দিহান হওয়া
বিদআতপন্থী সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বিদআতে জড়িয়ে পড়ে।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَيْكَ الْكِتاَبَ مِنْهُ أياتٌ مُّحْكَماتٌ هُنَّ أُمُّ الْكِتَاب وَأَخَرُ مُتَشَابِهاتٌ فَأَمّا الَّذِينَ فِى قُلُوبِهِمْ زَيَغٌ فَيَتَّبِعُونَ مَا تَشَابَهَ مِنْهُ ابْتِغَآءَ الْفِتْنَةِ وَابْتِغَآءَ تَأْوِيْلِهِ، وَ مَايَعْلَمُ تَأْوِيلَهُ إِلاَّ اللهُ وَالرَّاسِخُونَ فِى الْعِلْمِ يَقٌولٌوْنَ أمَنَّا بِهِ كُلٌّ مِّنْ عِند رَبّنَا وَمَا يَذَّكَّرُ إِلآَّ أُولُواْ الأَلْبَابِ. (آل عمران: 7)
অর্থঃ তিনিই আপনার প্রতি কিতাব নাযিল করেছেন যাতে সুস্পষ্ট ও অ^কাট্য আয়াতসমূহ রয়েছে। ওগুলো কিতাবের মূল আর কিছু আয়াত অস্পষ্ট। অতএব যাদের অন্তরে বক্রতা রয়েছে তারাই অশান্তি সৃষ্টি ও (ইচ্ছামত) ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে অস্পষ্টের অনুসরণ করে। অথচ আল্লাহ ব্যতীত এর অর্থ কেউই জানে না। যারা জ্ঞানী তারা বলে, আমরা এতে বিশ্বাস করি। সবই আমাদের রবের নিকট হতে আগত। জ্ঞানীরা ব্যতীত কেউই উপদেশ গ্রহণ করে না।[9]
(৪) যুক্তির উপর নির্ভর করা
যে ব্যক্তি আকল বা যুক্তির উপর নির্ভর করে এবং কুরআন ও সুন্নাহ ছেড়ে দেয় অথবা কোন একটি ছেড়ে দেয়, সে পথভ্রষ্ট হয়ে যায়।
আল্লাহ্ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَ مَآ أتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوهُ وَمَا نَـهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُواْ وَاتَّقُواْ اللهَ إنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ.(الحشر: 7)
অর্থঃ রাসূল তোমাদের জন্য যা কিছু নিয়ে এসেছেন তা গ্রহণ কর এবং যা হতে নিষেধ করেছেন তা হতে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ শাস্তি দানে কঠোর।[10]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَمَا كَانَ لِمُؤْمِن وَ لاَ مُؤمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَ رَسوُلُه أَمْرًا أَن يَكُونَ لَهُمْ الْخيَرَةُ مِنْ أَمْرِِهِمْ وَمَن يَعْصِ اللهَ ورَسَولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلاَلاً مُّبِينًا.(الأحزاب : 36)
অর্থঃ আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যদি কোন ব্যাপারে ফায়সালা করেন তখন কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর জন্য নিজেদের ব্যাপারে (অন্য কোন) সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার থাকবে না। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং তাঁর হুকুমের অবাধ্য হল সে সুস্পষ্ট পথভ্রষ্ট হয়ে গেল।[11]
(৫) অন্ধ অনুকরণ ও গোঁড়ামী
অধিকাংশ বিদআতপন্থী তাদের পূর্ব পুরুষ ও পীর-মাশায়েখদের তাকলীদ তথা অন্ধ অনুকরণ এবং নিজ মাজহাবের ব্যাপারে গোঁড়ামী করে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ اتَّبِعُواْ مَآ أَنزَلَ اللهُ قاَلُواْ بَلْ نَتَّبِعُ مَآ أَلْفَيْنَا عَلَيهِ آبَاءَنَا.(البقرة : 170)
অর্থঃ যখন তাদের বলা হয়, তোমরা আল্লাহর কিতাবের অনুসরণ কর; তখন তারা বলে, বরং আমরা তারই অনুসরণ করব যার উপর আমাদের পিতৃপুরুষদের পেয়েছি।[12]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
بَلْ قاَلُوآْإِنّاوَجَدْنَآ آبَاءَنَا عَلَى أُمّـةٍ وَ اِنَّا عَلَى آثَارهِمْ مُّهْتَدُونَ.(الزخرف : 22)
অর্থঃ বরং আমরা পূর্বপুরুষদের একটি মতাদর্শের উপর পেয়েছি এবং তাদের পথ ধরেই আমরা হেদায়াত প্রাপ্ত হব।[13]
বিদআতপন্থীদের নিকট তাদের বিদআতী কর্মকান্ড আকর্ষণীয় করে দেয়া হয়।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
أَفَمَن زُيِّنَ لَهُ سُوءُ عَمَلِهِ فَرَءَاهُ حَسَنًا فَإِنَّ اللهَ يُضِلُّ مَن يَشَآء وَ يَهْديْ مَنْ يَّشَاءُ فَلاَ تَذْهَبْ نَفْسُكَ عَلَيْهِمْ حَسَرَاتٍ إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ بِمَا يَصْنَعُونَ. (الفاطر: 8)
অর্থঃ কাউকে যদি তার মন্দ কর্ম সুন্দর করে দেখানো হয় তখন সে ওটাকে উত্তম মনে করে। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা গোমরাহ করেন এবং যাকে ইচ্ছা হেদায়াত দান করেন। অতএব আপনি তাদের জন্য আক্ষেপ করে নিজ প্রাণকে ধ্বংস করবেন না। তারা যা করে আল্লাহ্ সে সম্পর্কে সম্মক জ্ঞাত।[14]
বিদআতপন্থীর পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
يَوْمَ تُقَلَّبُ وَجُوهُهُمْ فِىالنَّارِ يَقُولُونَ يَالَيْتَنَآ أَطَعْنَا اللهَ وأَطَعْنَا الرَّسُولا. وَقَالُواْ رَبَّنَا إنَّآ أَطَعْنَا سَادَتنَا وَكَبُرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السّبِيلا. رَبَّنَآ ءَاتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذاَبِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيْرًا.(الأحزاب:66-68)
অর্থঃ যে দিন তাদের মুখমণ্ডল অগ্নিতে উলট পালট করা হবে সে দিন তারা বলবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করতাম! তারা আরো বলবে, হে আমাদের রব! আমরা নিজ নেতা ও বড়দের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের রব! তাদের দ্বিগুণ শাস্তি প্রদান করুন ও তাদের উপর লানত বর্ষণ করুন।[15]
(৬) বিদআতপন্থীদের সংশ্রব ও তাদের সাথে উঠা বসা করা
বিদআতপন্থীদের সঙ্গ দেয়া ও তাদের সাথে উঠা বসা করার দ্বারাও সমাজে বিদআত প্রচার-প্রসার লাভ করে। আল্লাহ তা‘আলা বিদআতের অনুসারীদের সংশ্রবকে নিন্দনীয় বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَيَوْمَ يَعضُّ الظَّالِم عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَالَيْتَنِيْ اتّّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِِ سَبِيلاً. يَاوَيْلَتَي لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيلاً. لَّقَدْ أَضَلّنِى عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَآءَنِى وَكَان الشَّيْطَانُ لِلإِنْساَنِ خَذُولاً.(الفرقان: 27-29)
অর্থঃ যালিমরা সে দিন নিজ হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম। হায়! দুর্ভোগ আমার, আমি যদি অমুককে বন্ধু রূপে গ্রহণ না করতাম। আমার নিকট উপদেশ পৌঁছার পর সে আমাকে বিভ্রান্ত করেছিল । শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক।[16]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَإِذَا رَأْيَتَ الذِّيْنَ يَخُوضُونَ فِي ءَايَاتِنَا فَأَعْرَضَ عَنْهُمْ حَتَّى يَخُوَضُواْ فِى حَدِيثٍ غَيْرِهِ وَإِمَّا يُنسِيَنَّكَ الشِّيْطَانُ فَلاَ تَقْعُدْ بَعْدَ الذِّكْرى مَعَ الْقَوْمِ الظَّالِمِيْنَ. (الأنعام : 68)
অর্থঃ যখন আপনি দেখবেন লোকজন আমার আয়াতসমূহে দোষ-ক্রটি অনুসন্ধান করছে। তখন আপনি তাদের হতে দূরে সরে যাবেন, যতক্ষণ না তারা অন্য কোন প্রসঙ্গে নিমগ্ন হয়। শয়তান যদি এটা আপনাকে ভুলিয়ে দেয় তবে স্মরণ হওয়ার পর আর এ যালিমদের সাথে বসবেন না।[17]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَقَدْ نَزَّل عَلَيْكُمْ فِى الْكِتَاب أَنْ إِذَا سَمِعْتُمْ ءَاياتِ اللهِِ يُكْفَرُبِهَا وَ يُسْتَهْزَأُ بِهَا فَلاَ تَقْعُدُواْ مَعَهُمْ حتَّى يَخُوضُوْا فِى حَديْث غَيْرِهِ إِنَّكُمْ إِذًا مِثْلَهُمْ إنَّّّ اللهَ جَامِعُ الْمُناَفِقِيْنَ وَالْكَافِرِيْنَ فِيْ جَهَنَّمَ جَمِيْعًا.(النساء: 140)
অর্থঃ নিশ্চয়ই তিনি তোমাদের নির্দেশ করছেন যে, যখন তোমরা আল্লাহর নিদর্শনসমূহের প্রতি কারো অবিশবাস ও উপহাস করার কথা শুনবে, তখন তাদের সাথে বসবে না যে পর্যন্ত না তারা অন্য কথায় লিপ্ত হয়। অন্যথায় তোমরাও তাদের সাদৃশ হয়ে যাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুনাফিক ও কাফিরদের জাহান্নামে একত্রিত করবেন।[18]
রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
إِنَّمَا مَثَلُ الْجَلِيسِ الصَّالِحِ وَالْجَلِيسِ السَّوْءِ كَحَامِلِ الْمِسْكِ وَنَافِخِ الْكِيرِ فَحَامِلُ الْمِسْكِ إِمَّا أَنْ يُحْذِيَكَ وَإِمَّا أَنْ تَبْتَاعَ مِنْهُ وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ مِنْهُ رِيحًا طَيِّبَةً وَنَافِخُ الْكِيرِ إِمَّا أَنْ يُحْرِقَ ثِيَابَكَ وَإِمَّا أَنْ تَجِدَ رِيحًا خَبِيثَةً.(بخاري ومسلم)
অর্থঃ নিশ্চয়ই সৎসঙ্গ ও অসৎসঙ্গের দৃষ্টান্ত হল মিশ্ক আম্বর বহনকারী ও কামারের ন্যায়। অতঃপর মিশ্ক বহনকারী হয়ত তোমাকে কিছু দেবে অথবা তুমি তার থেকে কিছু কিনবে। আর তা না হলে কমপক্ষে তার থেকে সুঘ্রাণযুক্ত বাতাস পাবে। আর কামার হাপরে ফুৎকারের মাধ্যমে হয়ত তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দেবে অথবা তার থেকে তুমি দূর্গন্ধময় বাতাস পাবে।[19]
(৭) আলেমদের নিশ্চুপ থাকা ও সঠিক ইল্ম গোপন করা
এটা লোক সমাজে বিদআত ও ফিতনা-ফ্যাসাদ সৃষ্টির অন্যতম কারণ।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُون مَآ أَنزَلْنَا منَ الْبَيّنَاتِ وَالْهُدى مِن بَعْدِ مَابَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِىالْكِتَابِ أُولئِكَ يَلْعَنُهُمُ الله ويلعنهم اللاَّعِنُونَ إِلاَّ الَّذِينَ تَابُواْ وَأَصْلَحُواْ و بَيَّنُواْ فَأُوْلئِكَ أَتُوبُ عَلَيْهِمْ وَأنَا التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ. (البقرة: 159-160)
অর্থঃ আমি যে সকল ষ্পষ্ট নিদর্শন ও পথ-নির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, তা মানুষের নিকট প্রকাশ করার পরও যারা ঐ সকল বিষয় গোপন করে, আল্লাহ তাদের উপর লানত করেন এবং অভিসম্পাতকারীগণও লানত করে থাকেন। কিন্তু তারাই লানত থেকে মুক্ত যারা তাওবা করেছে, নিজেদের সংশোধন করেছে ও সঠিক বিষয় প্রকাশ করেছে। আমি তাদের তাওবা কবুল করি। আমিই তওবা গ্রহণকারী ও দয়ালু।[20]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَآ أَنزَلَ اللهُ مِنَ الْكِتَابِ وَ يَشْتَرُونَ بَهِ ثَمَنًا قَلِيلاً أولئك مَا يَأْكُلُونَ فِى بُطُونِهِمْ إِلاَّ النَّارَ وَلاَ يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يُزَكِيهِمْ وَلَهُمْ عَذاَبٌ أَلِيْمُ.(البقرة-174)
অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ যা কিতাবে অবতীর্ণ করেছেন তা যারা গোপন করে ও সামান্য মূল্যে বিক্রি করে, তারা স্ব-স্ব উদরে অগ্নি ছাড়া আর কিছুই ভক্ষণ করে না। কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাদের সাথে কথা বলবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং এদের জন্যই রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।[21]
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَاِذْ أَخَذَ اللهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُواْ الْكِتَابَ لَتُبَيِنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلاَ تَكْتُمُونَهُ فَنَبَذُوْهُ وَرَآءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ.(آل عمران- 187)
অর্থঃ স্মরণ করুন, যখন আহলে কিতাবদের থেকে আল্লাহ্ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন যে, তোমরা নিশ্চয়ই এটা মানুষের কাছে প্রকাশ করবে, গোপন করবে না। এরপরও তারা তা অগ্রাহ্য করে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করলো। অতএব তারা যা ক্রয় করে তা কতই না নিকৃষ্ট।[22]
আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতের একটি দলের উপর দাওয়াত ইলাল্লাহ, সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা ওয়াজিব করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেনঃ
وَلْتَكُنْ مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَ يَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُوْلئِكَ هُمُ المُفْلِحُـونَ. (آل عمران: 104)
অর্থঃ তোমাদের মধ্যে এরূপ একটি দল থাকা উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। এরাই সফলকাম।[23]
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ. (مسلم)
অর্থঃ তোমাদের যে কেউ গর্হিত কাজ হতে দেখে, সে যেন তা হাত দ্বারা বাধা করে। যদি এ শক্তি না থাকে তাহলে যেন মুখ দ্বারা বাধা প্রদান করে, তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে যেন অন্তরে ঘৃণা করে। এটা ঈমানের নিম্নতম স্তর।[24]
এ হাদীস দ্বারা একথাই প্রমাণিত হয় যে, প্রত্যেক মুসলিমের উপর নিজের ক্ষমতা ও শক্তি অনুযায়ী সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা ওয়াজিব।
এছাড়াও আব্দুল্লাহ ইব্নে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
مَا مِنْ نَبِيٍّ بَعَثَهُ اللَّهُ فِي أُمَّةٍ قَبْلِي إِلَّا كَانَ لَهُ مِنْ أُمَّتِهِ حَوَارِيُّونَ وَأَصْحَابٌ يَأْخُذُونَ بِسُنَّتِهِ وَيَقْتَدُونَ بِأَمْرِهِ ثُمَّ إِنَّهَا تَخْلُفُ مِنْ بَعْدِهِمْ خُلُوفٌ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ وَيَفْعَلُونَ مَا لَا يُؤْمَرُونَ فَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِيَدِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِلِسَانِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَمَنْ جَاهَدَهُمْ بِقَلْبِهِ فَهُوَ مُؤْمِنٌ وَلَيْسَ وَرَاءَ ذَلِكَ مِنْ الْإِيمَانِ حَبَّةُ خَرْدَلٍ.
অর্থঃ আমার পূর্বে যত নবী এসেছেন তাদের প্রত্যেকেরই স্বীয় উম্মতের মধ্য থেকে কিছু সাথী এবং ঘনিষ্ঠ লোক ছিল। যারা তাঁর সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরত এবং তাঁর হুকুম মেনে চলত। পরবর্তীতে এমন এক প্রজন্ম এল, যারা যা বলত তা করত না এবং তারা এমন কাজ করত যার নির্দেশ ছিল না। যে ব্যক্তি সর্বশক্তি দিয়ে তাদের প্রতিরোধ করবে সে মুমিন, যে মৌখিকভাবে প্রতিবাদ করবে সে মুমিন এবং যে অন্তরে ঘৃণা করবে সেও মুমিন। এর বাইরে কারো অন্তরে সরিষার দানা পরিমাণও ঈমান নেই।[25]
আবু হুরাইরা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ مَنْ سُئِلَ عَنْ عِلْمٍ عَلِمَهُ ثُمَّ كَتَمَهُ أُلْجِمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ (ترمذي, أبو داود و ابن ماجة)
অর্থঃ যদি কাউকে এমন বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হয় যা সে জানে অতঃপর সে তা গোপন করে, তাহলে তাকে কিয়ামতের দিন আগুনের লাগাম পরানো হবে।[26]
(৮) কাফেরদের সাদৃশ অবলম্বন ও তাদের অনুসরণ করা
এটা মুসলিমদের মাঝে বিদআত ছড়ানোর বড় কারণ। এ বিষয়টি আবু ওয়াকেদ লাইছি রহ. বর্ণিত হাদীস দ্বারা বুঝা যায়। তিনি বলেন, আমরা রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাথে হুনাইনের দিকে রওয়ানা হলাম। আমরা বিগত দিনের কর্মকান্ড (কুফুরী) নিয়ে আলোচনা করছিলাম। কেননা তারা মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হয়েছিলেন। তিনি বললেন, একটি গাছের সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে গিয়ে আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য একটি ‘‘জাতে আনওয়াত’’ (এক প্রকার গাছ মুশরিকরা যার পূজা করত) এর ব্যবস্থা করে দিন যেমনটি তাদের অর্থাৎ কাফেরদের জন্য রয়েছে। তাদের একটি বরই গাছ ছিল যার পার্শ্বে তারা নীরবে বসে উপাসনা করত এবং তাতে তাদের যুদ্ধের অস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত। তারা এটাকে ‘‘জাতু আনওয়াত’’ বলত। যখন আমরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে একথা বললাম, তখন তিনি বললেন, আল্লাহু আকবার! তোমরা এমন কথা বলছ, যেমন বণী ইসরাইলের লোকেরা মূসা (আঃ) কে বলেছিল।
اجْعَل لَّنا إِلـهًاكَمَا لَهُمْ ءَالِهَةٌ قَالَ إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُونَ. (الأعراف: 138)
‘‘আপনি আমাদের জন্য মাবুদ নির্বাচন করুন, যেমন তাদের জন্য অনেক মা‘বুদ রয়েছে। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই তোমরা তো মূর্খ জাতি।[27]
তোমরা অবশ্যই পূর্ববর্তী লোকদের পথ অবলম্বন করবে।[28]
এ হাদীস থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়, যেমনি কাফিরদের সাদৃশ বনী ইসরাইলদের উপরোক্ত অসংগত প্রার্থনা করতে উৎসাহিত করেছিল তেমনি সাহাবীদেরকেও রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কাছে আল্লাহ ছাড়া অন্যের দ্বারা বরকত হাসিলের উদ্দেশ্যে এমন একটি গাছের প্রার্থনা করতে উৎসাহিত করেছিল। এভাবেই অধিকাংশ মানুষ কাফিরদের অনুসরণ বা সাদৃশ অবলম্বন করতে গিয়ে বিদআত ও শিরকে লিপ্ত হয়। যথা- মিলাদ মাহফিল, জানাযা সংক্রান্ত বিদআত, কবরের উপর বিল্ডিং নির্মাণ ইত্যাদি। নিঃসন্দেহে এ সকল বিষয় বা পূর্ববর্তীদের অনুসরণ প্রবৃত্তি পূজা ও বিদআতেরই অন্তর্ভুক্ত।
এ বিষয়টি আবু সাঈদ খুদরী (রা) বর্ণিত হাদীস দ্বারা আরো স্পষ্ট হয়। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
لَتَتْبَعُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ شِبْرًا شِبْرًا وَذِرَاعًا بِذِرَاعٍ حَتَّى لَوْ دَخَلُوا جُحْرَ ضَبٍّ تَبِعْتُمُوهُمْ قُلْنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى قَالَ فَمَنْ؟(متفق عليه)
অর্থঃ নিশ্চয়ই তোমরা পূর্ববর্তী লোকদের রীতিনীতির পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুকরণ করবে। এমনকি তারা যদি গুইসাপের গর্তে প্রবেশ করে থাকে, তাহলে তোমরাও তা করবে। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! ইহুদী-খৃষ্টানদের? তিনি বলেন, তাদের ব্যতীত আর কাদের?[29]
ইমাম নববী রহ. বলেন, ‘‘السَنَنُ ’’ অর্থ রাস্তা। হাদীসের শব্দ شبر، ذراع و جحر الضب তথা বিঘত, হাত ও গুইসাপের গর্তে প্রবেশ দ্বারা এ উম্মতের পুর্বেকার লোকদের সাথে শরীয়ত বিরোধী কার্যকলাপ ও অন্যায়ের মাঝে হুবহু মিল থাকার উপমা দেয়া হয়েছে, কুফরীতে মিল থাকার উপমা নয়। এ হাদীসের মাধ্যমে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মু‘জিযা বাস্তবায়িত হল। কেননা তিনি যে সংবাদ দিয়ে গেছেন, তা আজ সংঘটিত হচ্ছে।
প্রকাশ থাকে যে, বিঘত, হাত, রাস্তা ও গর্তে প্রবেশ এ সবই শরীয়ত কর্তৃক নিষিদ্ধ ও নিন্দিত বিষয়ে তাদের (কাফেরদের) অনুসরণ-অনুকরণ করার কারণে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উপমা হিসেবে তুলে ধরেছেন, অথচ তিনি অমুসলিমদের সাদৃশ অবলম্বন করতে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন।
রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
بُعٍثْتُ بَيْنَ يَدَيِ السَّاعَةِ بِالسَّيْفِ حَتّى يَعْبُدَ اللهَ وَحْدَه لَا شَرِيْكَ لَه، وَجَعَلَ رِزْقِيْ تَحْتَ ظِلِّ رَمْحِيْ وَجَعَلَ الذِلُّ وَالصِّغَارَ عَلى مَنْ خَالَفَ أَمْرِيْ، وَمَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ.
(أحمد)
অর্থঃআমি কিয়ামতের পূর্বে তরবারীসহ প্রেরিত হয়েছি যাতে (মানুষ) এক আল্লাহর ইবাদত করে যার কোন অংশিদার নেই। আর তিনি আমার জীবিকাকে বর্শার ছাঁয়ার নিচে রেখেছেন। যারা আমার দ্বীনের পরিপন্থী কাজ করবে তাদের জন্য রেখেছেন অপমান ও লাঞ্ছনা। আর যারা কোন জাতির সাদৃশ অবলম্বন করবে তারা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।[30]
(৯) দুর্বল ও বানোয়াট হাদীসের উপর নির্ভর করা
এ ধরণের হাদীসের উপর নির্ভর করার ফলে অধিকাংশ বিদআত সৃষ্টি হয় ও তার প্রচার-প্রসার ঘটে। অধিকাংশ বিদআতপন্থীই অনির্ভরযোগ্য, দুর্বল ও মিথ্যা হাদীসের উপর নির্ভর করে। তারা এমন হাদীসের উপর নির্ভরশীল যা হাদীস বিশারদগণের নিকট অগ্রহণযোগ্য। তারা সহীহ হাদীস পরিত্যাগ করে। যার ফলে অনিবার্য ক্ষতি, ধ্বংস ও বিপদে পতিত হয়। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া সৎকর্ম সম্পাদন ও অসৎকর্ম পরিত্যাগ সম্ভব নয়।[31]
(১০) বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন
এটাও বিদআত প্রসারের অন্যতম কারণ এবং শিরকে লিপ্ত হওয়ারও কারণ। কেননা আদম (আঃ) এর পরবর্তী ১০ যুগ পর্যন্ত লোকজন তাওহীদ ও আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল। তারপর থেকে লোকজন তৎকালীন নেক্কার ব্যক্তিবর্গের দিকে ঝুঁকে গিয়ে তাদের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি ও সীমালংঘন করতে করতে এক পর্যায়ে আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের ইবাদত শুরু করে দেয়। এরপর আল্লাহ তা‘আলা তাওহীদের দিকে আহবান কল্পে নূহ (আঃ) কে প্রেরণ করেন, এরই সূত্র ধরে তাওহীদের বানী নিয়ে নবী-রাসূল (আঃ) প্রেরণের ধারাবাহিকতা শুরু হয়।
সীমালংঘন ব্যক্তি পর্যায়েও হতে পারে। যথা-ইমাম ও অলীদের নিষ্পাপ মনে করা এবং তাদেরকে প্রাপ্য মর্যাদার চেয়ে উঁচু মর্যাদায় আসীন করা। এ ধরণের বাড়াবাড়ির এক পর্যায়ে তাদের ইবাদতও করা হয়।
সীমালংঘন দ্বীনের মাঝেও হতে পারে। যথা-আল্লাহর দেয়া বিধানে অতিরঞ্জন অথবা কোন বিষয়ে কঠোরতা কিংবা অন্যায়ভাবে কাউকে কাফির বলে আখ্যায়িত করা।
সীমালংঘন বলতে বুঝায় : বিশ্বাস ও আমলের ক্ষেত্রে সীমা অতিক্রম করা। এটা কারো প্রশংসা বা দূর্নাম বর্ণনার ক্ষেত্রে অত্যধিক বাড়াবাড়ির ফলে হয়ে থাকে। অথচ আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে ভীতি প্রদর্শন করতে গিয়ে আহলে কিতাবদের উদ্দেশ্য করে বলেনঃ
يَااَهْلَ الكِتَابِ لاَ تَغْلُوأ فِى دِينِكُمْ. (النساء: 171)
অর্থঃ হে আহলে কিতাবরা! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করো না।[32]
তেমনি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)ও দ্বীনের ব্যাপারে সীমালংঘন করতে নিষেধ করেছেন।
ইবনে আববাস (রা) বর্ণনা করেন, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
وَإِيَّاكُمْ وَالْغُلُوَّ فِي الدِّينِ فَإِنَّمَا أَهْلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ الْغُلُوُّ فِِِي الدِّينِ.(نسائي)
অর্থঃ তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে সীমালংঘন থেকে বিরত থাক, কেননা তোমাদের পূর্ববতী লোকেরা দ্বীনের ব্যাপারে সীমালংঘন করার ফলে ধ্বংস হয়েছে।[33]
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, দ্বীনের মধ্যে সীমালংঘনই শিরক ও বিদআত সৃষ্টি এবং কুপ্রবৃত্তির অনুসরণের অন্যতম কারণ।
দ্বীনের মধ্যে সীমালংঘনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সতর্কবাণী উচ্চারণ করতঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ
لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ فَقُولُوا عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ.(بخاري)
অর্থঃ তোমরা আমাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না যেমনিভাবে খ্রীষ্টানরা ঈসা ইবনে মারিয়াম (আঃ) কে নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিল। আমি আল্লাহর বান্দা, তাই আমাকে আল্লাহর বান্দা ও রাসূল বলবে।[34]
[2] আ‘রাফঃ ৩৩
[3] বুখারী : ৭৩০৭ ও মুসলিম : ২৬৭৩
[4] ছোয়াদঃ ২৬
[5] কাহাফঃ ২৮
[6] জাছিয়াঃ ২৩
[7] কাছাছঃ ৫০
[8] নাজমঃ ২৩
[9] আলে-ইমরানঃ ৭
[10] আল-হাশর : ৭
[11] আহযাব : ৩৬
[12] আল-বাকারাঃ ১৭০
[13] যুখরুফঃ ২২
[14] ফাতির : ৮
[15] আহযাবঃ ৬৬-৬৮
[16] ফুরকানঃ ২৭-২৯
[17] আনআমঃ ৬৮
[18] নিসাঃ ১৪০
[19] বুখারী : ৫৫৩৪ ও মুসলিম : ২৬২৮
[20] বাকারাঃ ১৫৯-১৬০
[21] বাকারাঃ ১৭৪
[22] আলে-ইমরানঃ ১৮৭
[23] আলে-ইমরানঃ ১০৪
[24] মুসলিম : ৪৯
[25] মুসলিম : ৫০
[26] তিরমিযী :২৬৪৯ ও আবু দাউদ : ৩৬৫৮ ইবনে মাজাহ: ২৬৬
[27] আ‘রাফ : ১৩৮
[28] তিরমিযী : ২১৮০
[29] বুখারী : ৭৩২০ ও মুসলিম : ২৬৬৯
[30] আহমদ : ২/৫০
[31] ফতোয়া ইবনে তাইমিয়াঃ ২২নং খন্ড; ৩৬১-৩৬৩, ইতিসামঃ আল্লামা শাতেবী ১মঃ ২৮৭-২৯৪
[32] নিসাঃ ১৭১
[33] নাসাঈ : ৫/২৬৮
[34] বুখারী : ৩৪৪৫