إن الحمد لله نحمده ونستعينه ونستغفره ونعود بالله من شرور أنفسنا وسيئات أعمالنا، من يهده الله فلا مضل له، ومن يضلل فلا هادی له، وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له، وأشهد أن محمد عبده ورسوله
يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالًا كَثِيرًا وَنِسَاءً ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ ۚ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَقُولُوا قَوْلًا سَدِيدًا * يُصْلِحْ لَكُمْ أَعْمَالَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ۗ وَمَن يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيمًا
শ্রদ্ধেয় মুহাম্মাদ বিন জামীল যাইনু (হাফেযাহুল্লা-হু তাআলা) সাহেব। সিরিয়া দেশের এক প্রতিভাধর কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর অনুসারী সালাফী আলেম। বর্তমানে তিনি মক্কা মুকারামার বাসিন্দা এবং দারুল হাদীস আলখাইরিয়্যাহ’র অন্যতম শিক্ষক। শিক্ষকতার সাথে সাথে তিনি দাওয়াত ও তবলীগের কাজে নিজেকে ওয়াকফ ও উৎসর্গ করে দিয়েছেন। হক ও সত্যের সন্ধান পেয়ে মানুষকে তার সন্ধান দিতে কুরআন ও সহীহ হাদীসের। আলোকে বহু বই-পুস্তক রচনা করেছেন। অত্র পুস্তকখানি সেই সিরিজের অন্যতম।
শির্কের প্রচলন ও ধরন প্রায় সকল দেশে একই প্রকার। তিনি তাঁর নিজ দেশ ও পরিবেশে ঘটমান যে সব শির্ক ও বিদআতকে চিহ্নিত করেছেন তা আমাদের দেশ ও পরিবেশেও দৃশ্যমান। তাই বইটির অনুবাদ ফলপ্রসু ও যথার্থ হবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। বাংলার মানুষ যদি এ ধরনের নির্দেশিকার অনুসরণ করেন তবে নিঃসন্দেহে তারা সেই দলের অন্তর্ভুক্ত হবেন, যে দল পার্থিব জীবনে বাতিলের বিরুদ্ধে জিহাদে আল্লাহর তরফ হতে সাহায্যপ্রাপ্ত, যে দলের একমাত্র নেতা ও প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মাদ রসূলুল্লাহ (সা.) এবং তাঁর সাহাবায়ে কেরাম। যে দলের দলীয় নীতি আল-কুরআন, সহীহ সুন্নাহ ও সালাফের ব্যাখ্যা। যে দল কিয়ামত আসা পর্যন্ত বাতিলের উপর হক নিয়ে বিজয়ী থাকবে ও তার বিরুদ্ধবাদীরা তার কোনও ক্ষতিসাধন করতে পারবে না। আর যে দল। পরকালে আল্লাহর আযাব ও জাহান্নাম হতে মুক্তি প্রাপ্ত হবে।
যে দলের মতাদর্শ অতি নির্মল। যাতে কোন পার্থিব স্বার্থান্বেষিতা নেই। নেই কোন ‘মারপ্যাচ’ ও প্রবঞ্চনা। কুরআন ও সুন্নাহর কোন অপব্যাখ্যা নেই। সহীহ সুন্নাহর কোন প্রকার রদ্দ বলতে নেই। সুন্নাহর নামে দুর্বল, জাল ও ভিত্তিহীন হাদীস এবং কোন অদ্ভুত গালগল্পের শরয়ী স্থান নেই। এ দলের। নেতা ও নীতি ব্যতীত আর কারো ব্যক্তিত্ব ও মতপূজা এবং অন্ধ-পক্ষপাতিত্ব নেই। এই দলই তো ফির্কাহনা-জিয়াহ ও তায়েফাহ মানসূরাহ।
আল্লাহর নিকট সকাতর প্রার্থনা যে, তিনি সকল মুসলিমকে এই দলেরই দলভুক্ত করুন এবং পৃথিবীর বুকে তার সংবিধান প্রতিষ্ঠা করে, ইসলামের বিজয়-নিশান উডডয়মান করে এবং মানুষকে শান্তির সুধা পান করিয়ে ‘খেলাফত’-এর দায়িত্ব পালনে প্রয়াস ও প্রেরণা দিন। আল্লাহুম্মা আমীন।
আব্দুল হামীদ ফায়যী
আল মাজমাআহ্
১৬/৫/৯৫ খ্রিঃ
إن الحمد لله نحمده و نستعينه ونستغفره ونعوذ بالله من شرور أنفسنا ومن سيئات أعمالنا من يهده الله فلا مضل له ومن يضلل فلا هادي له وأشهد أن لا إله إلا الله وحده لا شريك له و أشهد أن محمدا عبده ورسوله، أما بعد
অত্র পুস্তিকাটি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিভিন্নমুখী গবেষণা-প্রবন্ধের সমষ্টি, যা সকল মুসলিমকে নির্ভেজাল তওহীদের আকীদার (একত্ববাদের বিশ্বাসের) প্রতি আহ্বান করে এবং অধিকাংশ ইসলামী রাষ্ট্রসমূহে প্রচলিত শির্ক হতে সুদূরে থাকতে আবেদন করে। যে শির্ক পূর্ববর্তী জাতিসমূহের ধ্বংসের এবং বর্তমান পৃথিবীর দুর্গতি ও দুর্দশার মূল কারণ। বিশেষ করে মুসলিম জাহান যার কারণে শতমুখী বিপদ, দূরবস্থা, যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলার সম্মুখীন।
এই গবেষণামূলক প্রবন্ধ ও বিষয়াবলী ফির্কাহ নাজিয়াহ অ তায়েফাহ মনসূরাহ’ (মুক্তি প্রাপক দল এবং সাহায্যপ্রাপ্ত জামাআত)এর আকীদাহ ও বিশ্বাস স্পষ্টাকারে বিবৃত করবে- যেমন হাদীসে নববীতে বর্ণিত হয়েছে। যাতে জগদ্বাসীর জন্য সত্য পথ আলোকিত ও স্পষ্ট হয়ে উঠে এবং তারা মোক্ষ ও সাহায্যপ্রাপ্ত হতে পারে। ইনশা-আল্লাহ।
আল্লাহর নিকটেই প্রার্থনা করি, যেন তিনি এই পুস্তিকা দ্বারা সমগ্র মুসলিম জাতিকে উপকৃত করুন এবং তা একমাত্র তার সন্তুষ্টির জন্য বিশুদ্ধ করুন।
মুহাম্মদ বিন জামীল যইনু।
১। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا
অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর রশিকে (ধর্ম বা কুরআন)কে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং পরস্পর বিছিন্ন হয়ে পড়ো না। (সূরা আলে ইমরান ১০৩ আয়াত)
২। তিনি আরো বলেন,
وَلَا تَكُونُوا مِنَ الْمُشْرِكِينَ * مِنَ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا ۖ كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ
অর্থাৎ, আর অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা দ্বীন সম্বন্ধে নানামতের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে। প্রত্যেক দলই নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে সন্তুষ্ট। (সূরা রুম ৩২ আয়াত)।
৩। রসূল (সা.) বলেন, “আমি তোমাদেরকে আল্লাহ-ভীতি এবং (নেতার নেতৃত্ব) মান্য ও আনুগত্য করতে অসিয়ত করছি; যদিও তোমাদের নেতা একজন হাবশী ক্রীতদাস হয়। যেহেতু তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পরও জীবিত থাকবে সে বহু মতভেদ দেখতে পাবে। সুতরাং তোমরা আমার সুন্নত (আদর্শ) এবং সুপথ প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত (আদর্শ) অবলম্বন করো, তা শক্ত করে ধারণ করো এবং দন্ত দ্বারা দৃঢ়ভাবে ধরো। আর অভিনব কর্মাবলী হতে দূরে থেকো। যেহেতু প্রত্যেক অভিনব কর্ম বিদ্আত, প্রত্যেক বিদ্আত ভ্রষ্টতা এবং প্রত্যেক ভ্রষ্টতা জাহান্নামে নিয়ে যায়।” (হাদীসটিকে নাসাঈ এবং তিরমিযী বর্ণনা করেছেন তিরমিযী বলেন, হাদীসটি হাসান সহীহ)
৪। তিনি আরো বলেন, “সাবধান! তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব ইয়াহুদী ৭১ ও খ্রিষ্টানরা ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছে, আর এই মিল্লাত (উম্মত) ৭৩ দলে বিভক্ত হবে; ৭২ টি দল জাহান্নামে যাবে এবং একটি যাবে জান্নাতে আর সেটি হল জামাআত।” (হাদীসটিকে আহমদ প্রমুখ বর্ণনা করেছেন এবং হাফেয হাদীসটিকে হাসান বলেছেন)।
দ্বিতীয় এক বর্ণনায় তিনি বলেন, “কেবল একটি দল ব্যতীত সবগুলি জাহান্নামে যাবে; যে দলটি আমি ও আমার সাহাবার মতানুসারী হবে।” (হাদীসটিকে তিরমিযী বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী সহীহুল জামে' (৫২১৯)তে এটিকে হাসান বলেছেন।)।
৫৷ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসূল (সা.) আমাদের জন্য স্বহস্তে একটি রেখা টানলেন। অতঃপর তিনি বললেন, “এটি আল্লাহর সরল পথ।” অতঃপর ঐ রেখার ডাইনে ও বামে কতকগুলি রেখা টেনে বললেন, “এগুলি বিভিন্ন পথ। এই পথগুলির প্রত্যেটির উপর একটি করে শয়তান আছে; যে ঐ পথের প্রতি মানুষকে আহ্বান করে।” অতঃপর তিনি আল্লাহ তাআলার এই বাণী পাঠ করলেন,
وَأَنَّ هَٰذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ ۖ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ۚ ذَٰلِكُمْ وَصَّاكُم بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
অর্থাৎ, এবং নিশ্চয় এটি আমার সরল পথ। সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ কর এবং বিভিন্ন পথের অনুসরণ করো না। করলে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ হতে বিচ্ছিন্ন করবে। এ ভাবে আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা সাবধান হও। (সূরা আনআম ১৫৩ আয়াত) (হাদীসটি সহীহ এটিকে আহমদ ও নাসাঈ বর্ণনা করেছেন।)
৬। শায়খ (পীর) আব্দুল কাদের জীলানী তাঁর গ্রন্থ গুনয়্যাহ’তে বলেন, আহলে সুন্নাহ অল জামাআতই ফির্কাহ নাজিয়াহ (মুক্তিপ্রাপ্ত দল)। আর আহলে সুন্নাহর একটি নাম ছাড়া অন্য কোন নাম নেই। আর তা হল আসহাবুল হাদীস।
৭। আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা আমাদেরকে আদেশ করেন যে, আমরা যেন কুরআন করীমকে শক্তভাবে ধারণ করি এবং সেই মুশরেকিন (পৌত্তলিক)দের দলভুক্ত না হই যারা স্বধর্মে বিভিন্ন দল ও জামাআত সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রসূল করীম ঐ আমাদেরকে জানান যে, ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা বহু দলে বিভক্ত হয়েছে আর মুসলিমরা তাদের চেয়ে আরো অধিক দলে বিভক্ত হবে। সত্য পথ হতে বিচ্যুত হওয়ার কারণে এবং আল্লাহর কিতাব ও নবী (সা.)র সুন্নাহ হতে দূরে থাকার ফলে এই সকল ফির্কাহগুলি জাহান্নামের শিকার হবে। এদের। মধ্যে একটি ফির্কাহই জাহান্নাম হতে মুক্তি লাভ করে জান্নাত প্রবেশ করবে; আর এই ফির্কাহ হল সেই জামাআত, যে কিতাব ও সহীহ সুন্নাহ এবং রসূল (সা.)-এর চরিত্রকে (নিজেদের আদর্শরূপে) শক্তভাবে ধারণ করবে।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে ফির্কাহ নাজিয়াহর দলভুক্ত কর এবং সমগ্র মুসলমানকে ঐ দলভুক্ত হওয়ার তওফীক দান কর।
১। ফির্কাহ নাজিয়াহ (মুক্তি প্রাপ্ত দল), যে ফির্কাহ রসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ ও তাঁর পর তাঁর সাহাবাগণের মতাদর্শের অনুসারী। আর সে আদর্শ হল কুরআন করীম; যা আল্লাহ তার রসূলের উপর অবতীর্ণ করেছেন এবং রসূল তার সাহাবাগণের নিকট তা সহীহ হাদীসে ব্যাখ্যা করেছেন এবং (ঐ কিতাব ও তার ব্যাখ্যা বা সুন্নাহ) উভয়কে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করতে আদেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, যা অবলম্বন করলে তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। তা হল আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ। হওয’ (কাওসারে) আমার নিকট অবতরণ না করা পর্যন্ত তা বিচ্ছিন্ন হবে না।” (হাদীসটিকে আলবানী সহীহুল জামে’তে সহীহ বলেছেন।)
২। ফির্কাহ নাজিয়াহ বিতর্ক ও মতানৈক্যের সময় আল্লাহর বাণীর অনুসারী হয়ে তাঁর এবং তাঁর রসূলের উক্তির প্রতি রুজু করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا
(অর্থাৎ, আর যদি কোন বিষয়ে তোমাদের মতভেদ ঘটে তবে সে বিষয় তোমরা আল্লাহ ও রসূলের প্রতি ফিরিয়ে দাও এটিই তো উত্তম এবং পরিণামে প্রকৃষ্টতর। (সূরা নিসা ৫৯ আয়াত)
তিনি আরো বলেন,
فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِّمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
অর্থাৎ, কিন্তু না, তোমার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হতে পারবে না; যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচার-ভার তোমার উপর অর্পণ না করে, অতঃপর তোমার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে তাদের মনে কোন দ্বিধা থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে না নেয়। (সূরা নিসা ৬৫ আয়াত)
৩। ফির্কাহ নাজিয়াহ আল্লাহর বাণীর অনুসারী হয়ে আল্লাহ এবং তার রসূলের উক্তির উপর কারো উক্তিকে অগ্রাধিকার ও প্রাধান্য দেয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تُقَدِّمُوا بَيْنَ يَدَيِ اللَّهِ وَرَسُولِهِ ۖ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! আল্লাহ ও তার রসূলের সম্মুখে তোমরা কোন বিষয়ে অগ্রণী হয়ো না এবং আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ অবশ্যই সর্বশ্রোতা সর্বজ্ঞ। (সূরা হুজুরাত ১ আয়াত)
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, 'আমার মনে হয় ওরা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি বলছি, নবী (সা.) বলেছেন’ আর ওরা বলছে, আবু বকর ও উমর বলেছেন। (এটিকে আহমদ প্রভৃতিগণ বর্ণনা করেছেন ও আহমাদ শাকের এটিকে সহীহ বলেছেন)
৪। ফির্কাহ নাজিয়াহর বিবেচনায় তওহীদ হল, সকল প্রকার ইবাদত; যেমন, দুআ বা প্রার্থনা, সাহায্য ভিক্ষা, বিপদে ও স্বাচ্ছন্দ্যে আহ্বান, যবেহ, নযরনিয়ায, ভরসা, আল্লাহর বিধান অনুসারে বিচার ও শাসন করা ইত্যাদিতে আল্লাহকে একক মানা। এটাই হল সেই বুনিয়াদ যার উপর সঠিক ইসলামী রাষ্ট্র রচিত হয়। সুতরাং অধিকাংশ মুসলিম দেশগুলিতে বর্তমানে যে শির্ক এবং তার বহিঃপ্রকাশ রয়েছে তা দুরীভূত করা একান্ত জরুরী। যেহেতু তা তওহীদের এক দাবী। সে জামাআতের বিজয় অসম্ভব যে জামাআত তওহীদকে অবহেলার সাথে উপেক্ষা করে এবং সকল রসূল ও বিশেষ করে আমাদের সম্মানিত রসূল (সা.) সালাওয়াতুল্লাহি অসালামুহু আলাইহিম আজমাঈন -কে আদর্শ মেনে সর্বপ্রকার শির্কের বিরুদ্ধে অবিশ্রাম সংগ্রাম না করে।
৫। ফির্কাহ নাজিয়াহ তার ইবাদতে, ব্যবহারে ও আচরণে বরং সারা জীবনে। রসূল (সা.) ৪-এর সুন্নাহকে জীবিত করে। যার কারণে এত লোকের মাঝে তারা। (প্রবাসীর মত) মুষ্টিমেয় ও বিরল। যেমন রসূল (সা.) তাদের প্রসঙ্গে অবহিত করে বলেছেন, “নিশ্চয় ইসলাম (প্রবাসীর মত অসহায়) অল্পসংখ্যক মানুষ নিয়ে শুরুতে আগমন করেছে এবং অনুরূপ অল্প সংখ্যক মানুষ নিয়েই ভবিষ্যতে প্রত্যাগমন করবে যেমন শুরুতে আগমন করেছিল। সুতরাং সুসংবাদ ঐ মুষ্টিমেয় লোকেদের জন্য।” (হাদীসটিকে মুসলিম বর্ণনা করেছেন)।
অন্য এক বর্ণনায় আছে,“--- সুতরাং শুভ সংবাদ ঐ (প্রবাসীর মত অসহায়) অল্প সংখ্যক লোকদের জন্য যারা মানুষ অসৎ হয়ে গেলে তাদেরকে সংস্কার করে সঠিক পথে রাখতে সচেষ্ট হয়। (আলবানী বলেন এটিকে আবূ আমর আদ্দা-নী সহীহ সনদ দ্বারা বর্ণনা করেছেন)।
৬। ফির্কাহ নাজিয়াহ আল্লাহ এবং তাঁর রসূলের উক্তি ছাড়া আর কারো উক্তি ও কথার পক্ষপাতিত্ব করে না। যে রসূল ছিলেন নিষ্কলুষ এবং যিনি নিজের খেয়াল-খুশী মতে কোন কথা বলতেন না। কিন্তু তিনি ব্যতীত অন্য মানুষ, যতই তিনি বহুমুখী মর্যাদার অধিকারী হন না কেন, ভুল করতেই পারেন। নবী (সা.) বলেন, “প্রত্যেক আদম সন্তান ক্রটিশীল ও অপরাধী, আর অপরাধীদের মধ্যে উত্তম লোক তারা যারা তওবা করে।” (হাদীসটি হাসান এটিকে আহমদ বর্ণনা করেছেন)।
ইমাম মালেক বলেন, 'নবী (সা.) এর পর তিনি ব্যতীত প্রত্যেকেরই কথা গ্রহণ করা বা উপেক্ষাও করা যাবে। (অর্থাৎ তিনি ব্যতীত অন্য সকলের অভিমত ও উক্তি গ্রহণীয় এবং উপেক্ষণীয়ও।)
৭। ফির্কাহ নাজিয়াহ হল ‘আহলে হাদীস। যাদের সম্পর্কে আল্লাহর রসূল (সা.) বলেছেন, “আমার উম্মতের মধ্যে এক দল চিরকাল হক (সত্যের) উপর বিজয়ী থাকবে আল্লাহর আদেশ (কিয়ামতের পূর্বমুহূর্ত) আসা পর্যন্ত, যারা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে তারা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে ।” (এটিকে মুসলিম বর্ণনা করেছেন। কবি বলেন,
“আহলে হাদীসরা আহলে নবী, যদিও
তারা তাঁর ব্যক্তিত্বের সাহচর্যে ছিল না।
কিন্তু তারা তাঁর বাণীর সংসর্গে থাকে।”
৮। ফির্কাহ নাজিয়াহ আয়েম্মায়ে মুজতাহেদীন (মুজতাহিদ সকল ইমাম)কে শ্রদ্ধা করে। তাদের মধ্যে কোন একজনের একতরফা পক্ষপাতিত্ব করে না। বরং ফিকহ (দ্বীনের জ্ঞান) গ্রহণ করে কুরআন ও সহীহ হাদীসসমূহ হতে এবং তাঁদের উক্তি সমূহ হতেও -যদি তা সহীহ হাদীসের অনুসারী হয়। আর এই নীতিই তাদের নির্দেশের অনুকুল। যেহেতু তাঁরা সকলেই নিজ নিজ। অনুসারীগণকে সহীহ হাদীসের মত গ্রহণ করতে এবং এর প্রতিকুল প্রত্যেক মত ও উক্তিকে প্রত্যাখ্যান করতে অসিয়ত করে গেছেন।
৯। ফির্কাহ নাজিয়াহ সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে বাধা প্রদান করে। এই দল বিদআতী সকল নীতি এবং সর্বনাশী দলসমুহকে প্রতিহত করে। যে দলসমূহ উম্মতকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে ও দ্বীনে বিদআত রচনা করে রসূল (সা.) এবং তাঁর সাহাবার সুন্নাহ (ও নীতি) থেকে দূরে সরে আছে।
১০। ফির্কাহ নাজিয়াহ সমগ্র মুসলিম জাতিকে রসূল (সা.) ও তার সাহাবাগণের সুন্নাহ (তরীকা)কে দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে আহবান করে। যাতে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত হয় এবং আল্লাহর অনুগ্রহে ও তাঁর রসূল (সা.)-এর সুপারিশে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে।
১১। ফির্কাহ নাজিয়াহ মনগড়া সমস্ত মানব রচিত আইন-কানুনকে অস্বীকার করে। কারণ তা ইসলামী আইনের বিরোধী ও পরিপন্থী। আর আল্লাহর কিতাবকে জীবন ও রাষ্ট্র-সংবিধান রূপে মেনে নিতে সকলকে আহবান করে -যে কিতাবকে আল্লাহ মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সুখ-সমৃদ্ধির জন্য অবতীর্ণ করেছেন। আর তিনিই অধিক জানেন, কি তাদের জন্য কল্যাণকর। সেই কুরআন অপরিবর্তনীয়। যার বিধান কোন কালেও পরিবর্তিত হবে না এবং যুগের বিবর্তনে তার ক্রমবিকাশও ঘটবে না। নিশ্চিত ভাবে সারা বিশ্বের এবং বিশেষ করে মুসলিম-বিশ্বের দুর্গতি, বিভিন্ন কষ্ট, লাঞ্ছনা এবং অবজ্ঞার সম্মুখীন হওয়ার একমাত্র কারণ হল আল্লাহর কিতাব এবং তার রসূলের সুন্নাহ দ্বারা জীবন ও রাষ্ট্র পরিচালনা ত্যাগ করা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রগতভাবে ইসলামী শিক্ষা ও নির্দেশের প্রতি প্রত্যাবর্তন ছাড়া মুসলিমদের কোন ইজ্জত ও শক্তি ফিরে আসতে পারে না। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّىٰ يُغَيِّرُوا مَا بِأَنفُسِهِمْ
অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না -যে পর্যন্ত না তারা নিজের অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে। (সূরা রা'দ ১১ আয়াত)
১২। ফির্কাহ নাজিয়াহ সকল মুসলিমকে আল্লাহর পথে জিহাদের দিকে আহ্বান করে। আর জিহাদ প্রত্যেক মুসলিমের উপর তার শক্তি ও সামর্থ্যানুযায়ী ওয়াজেব। এই জিহাদ বিভিন্ন মাধ্যমে হয়ে থাকেঃ
(ক) রসনা ও কলম দ্বারা জিহাদঃ মুসলিম ও অমুসলিমকে সঠিক ও বিশুদ্ধ ইসলাম এবং সেই শিকমুক্ত তওহীদ বরণ এবং শক্তভাবে ধারণ করার প্রতি আহবান করা, যে শির্ক বহু মুসলিম দেশেই প্রসার লাভ করেছে। যে বিষয়ে রসূল (সা.) আমাদেরকে সতর্ক করেছেন যে, তা মুসলিমদের মাঝে আপতিত। হবে। তিনি বলেছেন, “কিয়ামত আসবে না যে পর্যন্ত না আমার উম্মতের। কিছু সম্প্রদায় মুশরিকদের সাথে মিলিত হবে এবং আমার উম্মতের কিছু সম্প্রদায় মূর্তিপূজা করবে।” (হাদীসটি সহীহ, এটিকে আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন এবং এর মর্মার্থ নিয়ে একটি হাদীস মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে।)
(খ) অর্থ দ্বারা জিহাদঃ ইসলাম প্রচার করা ও ইসলামের প্রতি সঠিকভাবে আহবানকারী বই-পুস্তক ছাপানোর উপর অর্থ ব্যয় করে, নও মুসলিম এবং দুর্বলশ্রেণীর মুসলিম -যাদের মনকে ইসলামের প্রতি অনুরাগী করা প্রয়োজন - তাদের মাঝে বন্টন করে এবং মুজাহেদীনদের জন্য অস্ত্র-শস্ত্র, যুদ্ধ-সামগ্রী ও প্রয়োজনীয় খাদ্য-বস্ত্র ইত্যাদি নির্মাণ ও ক্রয় করার উপর খরচ করে এই জিহাদ হয়।
(গ) প্রাণ দ্বারা জিহাদঃ ইসলামের বিজয়ের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে লড়াই লড়ে এই জিহাদ হয়, যাতে আল্লাহর বাণীই সমুন্নত আর কাফেরদের। বাণী ভুলুণ্ঠিত হয়। জিহাদের এই প্রকারগুলির প্রতি ইঙ্গিত করে রসূলে করীম (সা.) বলেছেন, “তোমরা তোমাদের অর্থ, প্রাণ এবং জিহ্বা দ্বারা মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর।” (হাদীসটি সহীহ, এটিকে আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন।)।
আল্লাহর পথে জিহাদের শরয়ী মান ও নির্দেশ কয়েক প্রকারঃ
১। ফরযে আইন (যা ব্যক্তিগত ভাবে প্রত্যেকের উপর ফরয)। এই মান তখন হয় যখন কোন মুসলিম দেশকে শত্রুপক্ষ আক্রমণ ও গ্রাস করে। যেমন- ফিলিস্তীন (প্যালেষ্টাইন); যাকে দুষ্কৃতী ইয়াহুদীরা জবরদখল করে নিজেদের করায়ত্ত করে ফেলেছে। সুতরাং যথাসাধ্য জান ও মাল ব্যয় করে ঐ দেশ হতে ইয়াহুদীকে বহিষ্কার না করা পর্যন্ত এবং মসজিদে আকসাকে মুসলিমদের প্রতি ফিরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত সকল সামর্থ্যবান মুসলমান গোনাহগার থাকবে।
২ ফরযে কিফায়াহ, যথেষ্ট পরিমাণে কিছু লোক ঐ কর্তব্য পালন করলে অবশিষ্ট মুসলিমদের উপর তা আর ফরয থাকে না। সারা বিশ্বে ইসলামী দাওয়াত পৌছে দেওয়ার পথে এই জিহাদ সম্পন্ন হয়, যাতে সকল রাষ্ট্র ইসলামকেই রাষ্ট্রীয় সংবিধান বলে মেনে নেয়। আর যে ব্যক্তি এই দাওয়াতকে প্রতিহত করার পথে খাড়া হবে তাকেও পরাভূত করার উদ্দেশ্যে তার বিরুদ্ধে জিহাদ করা হবে যাতে দাওয়াত তার প্রবাহ পথে গতিশীল থাকে।
১। ফির্কাহ নাজিয়াহ মানুষের মধ্যে (প্রবাসীর মত অসহায়) মুষ্টিমেয়। যাদের জন্য আল্লাহর রসূল (সা.) দুআ করে বলেছেন, “শুভ সংবাদ ঐ (প্রবাসীর মত অসহায়) মুষ্টিমেয় লোকেদের জন্য; যারা বহু অসৎ লোকের মাঝে অল্পসংখ্যক সৎলোক। তাদের অনুগত লোকের চেয়ে অবাধ্য লোকের সংখ্যা অধিক।” (সহীহ, এটিকে আহমদ বর্ণনা করেছেন।)
এই দলের অনুসারীদের সম্পর্কে কুরআন কারীম সংবাদ দিয়েছে, এদের প্রশংসা করে কুরআন বলে,
وَقَلِيلٌ مِّنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ
অর্থাৎ, আমার বান্দাগণের মধ্যে অল্পসংখ্যকই লোক কৃতজ্ঞ। (সূরা সাবা ১৩ আয়াত)
২। ফির্কাহ নাজিয়াহর শত্রু বহু মানুষ। লোকেরা তাদের প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়। তাদেরকে মন্দনাম ও খেতাবে অভিহিত করে থাকে। অবশ্য এ বিষয়ে তাদের আদর্শ ও নমুনা ছিলেন আম্বিয়াগণ; যাদের প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَىٰ بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا
(অর্থাৎ, এবং এরপর প্রত্যেক নবীর জন্য শয়তান মানব ও দানবকে শত্রু করেছি যারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অন্যকে চমকপ্রদ বাক্য দ্বারা প্ররোচিত করে থাকে ---। (সূরা আনআম ১১২ আয়াত)
আল্লাহর রসূল (সা.) যখন তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট তওহীদের দাওয়াত পেশ করলেন তখন তারা তাকে বলেছিল, 'মিথ্যুক যাদুকর। অথচ এর পূর্বে তারা তাঁকে ‘সত্যবাদী আমানতদার’ বলে আখ্যা করত।
৩। শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (সউদী আরবের প্রধান মুফতী) ফির্কাহ নাজিয়াহ প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেন, “সালাফীগণই ফির্কাহ নাজিয়াহ; এবং তারা যারা সলফে সালেহ (রসূল ও সাহাবা)র মতাদর্শে চলে।
এগুলি ফির্কাহ নাজিয়াহর অল্প কিছু নীতি ও নিদর্শন। এবারে এই পুস্তিকার আগামী অধ্যায়গুলিতে ফির্কাহ নাজিয়াহর আকীদা ও বিশ্বাস সম্পর্কে আলোচনা করব; যে ফির্কাহর আর এক নাম ‘তায়েফাহ মনসূরাহ’ (সাহায্য প্রাপ্ত দল)। যাতে আমরা সকলে তার আকীদায় বিশ্বাসী হতে পারি। ইন শাআল্লাহ।
১। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “সর্বকালে আমার উম্মতের একটি দল হকের সাথে বিজয়ী থাকবে, তাদেরকে যারা উপেক্ষা করবে তারা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না, যতক্ষণ না আল্লাহর আদেশ (কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত) এসে উপস্থিত হবে।”(মুসলিম)
২। তিনি আরো বলেন, “শামবাসী অসৎ হয়ে গেলে তোমাদের মধ্যে কোন মঙ্গল নেই। আর চিরকালের জন্য আমার উম্মতের একটি দল সাহায্য প্রাপ্ত থাকবে, কিয়ামত কায়েম হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে উপেক্ষাকারীরা তাদের কোন ক্ষতি সাধন করতে পারবে না।” (সহীহ, মুসনাদে আহমদ)
৩। ইবনুল মুবারক বলেন, 'আমার মতে তারা হলেন আসহাবুল হাদীস।”
৪। ইমাম বুখারী বলেন, আলী ইবনুল মাদানী বলেছেন, তাঁরা হলেন আসহাবুল হাদীস।”
৫। আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, 'এই সাহায্যপ্রাপ্ত দলটি যদি আসহাবুল হাদীস না হয় তবে জানি না তারা কারা ?”
৬। আহলে হাদীসরাই যেহেতু সুন্নাহ এবং তার আনুষঙ্গিক সকল বিষয়ের অধ্যয়নে বিশেষজ্ঞ তাই তারাই সকল মানুষের চেয়ে তাদের নবী (সা.)-এর সুন্নাহ, আদর্শ, পথনির্দেশ, চরিত্র, যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং এর সম্পৃক্ত যাবতীয় বিষয়ে অধিক জ্ঞান রাখে।
৭। ইমাম শাফেয়ী ইমাম আহমাদকে সম্বোধন করে বলেন, আপনারা আমার চেয়ে অধিক হাদীস জানেন। অতএব আপনাদের নিকট শুদ্ধভাবে কোন হাদীস এলে সে বিষয়ে আমাকে খবর দেবেন, আমি তা সংগ্রহের জন্য যাত্রা করব -চাহে তা হিজায, কুফা অথবা বসরায় হোক।
সুতরাং আহলে হাদীস আল্লাহ আমাদের হাশর তাদের সহিত করেন - কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষের পক্ষপাতিত্ব করে না -তাতে সে ব্যক্তি যতই শীর্ষস্থানীয় এবং সম্মানাই হন না কেন। পক্ষপাতিত্ব করে শুধু মুহাম্মাদ এর। পক্ষান্তরে অন্যান্য লোকেরা যারা আহলে হাদীস ও হাদীসের উপর আমলে সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত নয়, তারা তাদের ইমামগণের উক্তির পক্ষপাতিত্ব করে -অথচ এমনটি করতে তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা তাদের পক্ষপাতিত্ব করে থাকে; যেমন আহলে হাদীসগণ তাদের নবী (সা.) এর উক্তির পক্ষপাতিত্ব করে। সুতরাং বিস্ময়ের কিছু নয় যে, তারাই হল সাহায্য প্রাপ্ত এবং মুক্তি প্রাপ্ত দল বা জামাআত।
৮। খতীব বাগদাদী তার শারাফু আসহাবিল হাদীস (আহলে হাদীসের মর্যাদা) নামক গ্রন্থে বলেন, 'রায় ওয়ালা’ (মনগড়া মতকে প্রাধান্যদাতা) যদি ফলপ্রসু ইলম অন্বেষণে ব্যাপৃত হত এবং বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের রসূলের সুন্নাহসমূহ অনুসন্ধান করত, তবে সে সেই জিনিস অর্জন করতে পারত যা অন্যান্য থেকে তাকে অমুখাপেক্ষী করত। যেহেতু হাদীসে রয়েছে। তওহীদের মৌলনীতি সমূহের পরিজ্ঞান, আগত বিভিন্নমুখী অঙ্গীকার ও তিরস্কারের বিবৃতি, বিশ্বজগতের প্রতিপালকের গুণাবলী, জান্নাত ও জাহান্নামের আকৃতি বিষয়ক সংবাদ; তাতে সংযমী ও দুষ্কৃতীদের জন্য আল্লাহ কি প্রস্তুত রেখেছেন তার খবর এবং আল্লাহ পৃথিবীসমুহে ও আকাশমন্ডলীতে কি সৃষ্টি করেছেন তারও খবর।
আর হাদীসে রয়েছে আম্বিয়াগণের কাহিনী, যাহেদ (সংসার-বিরাগী) ও আওলিয়াগণের বৃত্তান্ত, বাশ্মীদের ওয়ায, ফকীহগণের উক্তি, রসূলের খুতবা এবং তার মু’জিযা (অলৌকিক ঘটনাবলী)। এতে রয়েছে কুরআন আযীম এবং তাতে উল্লেখিত মহাসংবাদ ও প্রজ্ঞাপূর্ণ উপদেশের ব্যাখ্যা ও সাহাবাদের নিকট হতে আহকামে (কর্মাকর্মে) সংরক্ষিত তাঁদের বাণী।
আল্লাহ আহলে হাদীসকে শরীয়তের রুকন (স্তম্ভ) করেছেন এবং তাদের দ্বারা প্রত্যেক নিকৃষ্ট বিদআতকে চিহ্নিত করেছেন। সুতরাং তারা সৃষ্টিজগতে আল্লাহর আমানতদার নবী (সা.) ও তার উম্মতের মাঝে মাধ্যম, তাঁর গ্রন্থের মূল পাঠ সংরক্ষণে প্রয়াসী। তাদের আলোক প্রদীপ্ত, তাদের মর্যাদা সমুন্নত, আসহাবে হাদীস ব্যতীত প্রত্যেক দলই ঐ সমস্ত খেয়াল খুশীর আশ্রয় নেয়, যার প্রতি তারা রুজু করে এবং যে রায়কে পছন্দ ও ভালো মনে করে, আর তার উপর তারা নির্বিচল থাকে।
কিতাব (কুরআন) তাদের সরঞ্জাম ও হাতিয়ার, সুন্নাহ তাদের হুজ্জত (অকাট্য দলীল), রসূল (সা.) তাদের স্বীয় দল; তার প্রতিই তাদের সম্বন্ধ। তারা রায়ের (মনগড়া মতের) প্রতি দৃকপাত করে না। যারা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করে আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করেন এবং যারা তাদের প্রতি শত্রুতা করে আল্লাহ তাদেরকে উপেক্ষা করেন।
হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে আহলে হাদীসের দলভুক্ত কর। হাদীসের উপর আমল, তার অনুসারীদের প্রতি ভালোবাসা এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী আমলকারীদের সহায়তা করার তওফীক দান কর। (আমীন)
যে ইবাদত করার জন্য আল্লাহ বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেই ইবাদতে আল্লাহকে একক ও অদ্বিতীয় জানা ও মানার নাম তওহীদ। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
অর্থাৎ, আমার ইবাদতের জন্যই আমি মানুষ এবং জিনকে সৃষ্টি করেছি।(১) (সূরা যারিয়াত ৫৬ আয়াত) (অর্থাৎ আমি ওদেরকে কেবল এই জন্যই সৃষ্টি করেছি। যে, ওরা ইবাদতের যোগ্য হিসাবে আমাকেই একক বলে মানবে এবং দুআ ও প্রার্থনার স্থল হিসাবে আমাকেই অদ্বিতীয় স্বীকার করবে।)
কুরআন কারীম হতে সংগৃহীত তওহীদের প্রকরণ নিম্নরূপঃ
১৷ তওহীদুর রব্ব (প্রতিপালক বিষয়ে একত্ববাদ); আর তা হল এই কথার স্বীকার যে, আল্লাহই বিশ্বজাহানের স্রষ্টা ও প্রতিপালক। অবশ্য একথা কাফেরদলও স্বীকার করেছে; কিন্তু এ স্বীকারোক্তি তাদেরকে ইসলামে প্রবিষ্ট করেনি। আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَهُمْ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ
অর্থাৎ, যদি তুমি ওদেরকে জিজ্ঞাসা কর যে, কে ওদেরকে সৃষ্টি করেছে? তাহলে অবশ্যই ওরা বলবে, 'আল্লাহ।' (সূরা যুখরুফ ৮৭ আয়াত)
বর্তমান যুগে কমিউনিষ্টরা প্রতিপালক (আল্লাহর) অস্তিত্বকে অস্বীকার ও অবিশ্বাস করে, তাই তারা জাহেলিয়াতের কাফেরদের চেয়েও বড় কাফের।
২। তওহীদুল ইলাহ (উপাস্য বিষয়ে একত্ববাদ); আর তা হল সকল। প্রকার বিধিবদ্ধ ইবাদত -যেমন, দুআ ও প্রার্থনা, সাহায্য প্রার্থনা, তওয়াফ, যবেহ, নযর ইত্যাদিতে আল্লাহকে একক মান্য করা। এই প্রকার তওহীদকেই কাফের দল অস্বীকার করেছিল, এবং এই তওহীদ নিয়েই নুহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত সমস্ত রসূল ও তাদের উম্মতের মাঝে দ্বন্দ্ব ও বিবাদ ছিল। কুরআন কারীমের অধিকাংশ সূরাসমূহে এই তওহীদ এবং একমাত্র আল্লাহকেই (বিপদে-আপদে) ডাকা ও তাঁরই নিকট প্রার্থনা করার উপর মানুষকে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। যেমন সূরা ফাতেহায় আমরা পড়ে থাকি,
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
অর্থাৎ, আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি, তাই তোমাকেই কেবল আহবান করি এবং তুমি ব্যতীত আর কারো নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি না।
একমাত্র আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা, কুরআন দ্বারা মীমাংসা ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা, শরীয়তের নিকটেই নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের বিচারপ্রার্থী হওয়া, এ সব কিছু তওহীদুল ইলাহের শামীল। আর এর প্রত্যেকটাই আল্লাহর এই বাণীর আওতাভুক্ত যাতে তিনি বলেন,
إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي
অর্থাৎ, নিশ্চয় আমি আল্লাহ, আমি ভিন্ন আর কোন (সত্য) উপাস্য নেই, সুতরাং তুমি আমারই উপাসনা কর। (সূরা ত্বহা ১৪ আয়াত)
৩৷ তওহীদুল আসমা-ই অসিফাত (আল্লাহর নাম ও গুণাবলী বিষয়ে একত্ববাদ); আর তা হল, কুরআন কারীম এবং সহীহ হাদীসে বর্ণিত সেই সমস্ত সিফাত বা গুণ, যার দ্বারা আল্লাহ নিজেকে গুণান্বিত করেছেন অথবা তার রসূল (সা.) তার জন্য বর্ণনা করেছেন তা বাস্তব ও প্রকৃত ভেবে, কোন প্রকারে তার অপব্যাখ্যা না করে, কোন উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত কল্পনা না করে এবং তার প্রকৃতার্থ ‘জানি না’ বলে সে বিষয়ে আল্লাহকে ভারার্পণ না করে ঈমান ও প্রত্যয় রাখা। যেমন আল্লাহর আরশে আরোহণ, রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশে পৃথিবীর আকাশে তাঁর অবতরণ, তার হস্ত, তার আগমন ইত্যাদি গুণ। আমরা এ সবের সেই রূপ ব্যাখ্যা করব যে রূপ সলফ কর্তৃক বর্ণিত হয়েছে। যেমন তাবেয়ীন কর্তৃক তাঁর সমারূঢ় হওয়ার ব্যাখ্যা সহীহ বুখারীতে বর্ণিত; আর তা এই যে, তিনি সারা সৃষ্টির উর্ধে আরশের উপরে সমারূঢ়। যেমনঃ তার মহিমা ও মহত্বের উপযুক্ত (এবং তা কারো সদৃশ নয়)। আল্লাহ তাআলা বলেন,
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ۖ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ
অর্থাৎ, তার সদৃশ কোন কিছুই নেই এবং তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শুরা ১১ আয়াত)
ক। তা'বীলঃ আয়াত ও সহীহ হাদীসের স্পষ্ট অর্থকে ভিন্ন কোন অসঙ্গত ও বাতিল অর্থে পরিবর্তন করাকে বলা হয়। যেমন, আল্লাহ আরশে সমারূঢ় আছেন। এর অর্থ এই করা যে, তিনি সার্বভৌম ক্ষমতা বা কর্তৃত্বের অধিকারী।”
খা। তা’ত্বীল (অর্থহীন, নিস্ক্রিয় বা বিরহিতকরণ): আল্লাহর গুণাবলীকে। অস্বীকার করা এবং তাঁকে (ঐ সমস্ত) গুণবিহীন ভাবাকে বলে। যেমন, আল্লাহর আকাশের উর্ধে অবস্থানকে কিছু ভ্রষ্ট ফির্কাহ অস্বীকার করে ও বলে, 'আল্লাহ সকল স্থানেই আছেন!’ (বা আল্লাহ মুমিনের হৃদয়ে আছেন।)
গ। তাকয়ীফ (কেমনত্ব বর্ণনা করা): আল্লাহর গুণাবলীর কেমনত্ব বর্ণনা করাকে বলে। যেমন বলা, তার রকমত্ব (হস্ত-পদ প্রভৃতি) এই রূপ।” সুতরাং আরশের উপর আল্লাহর আরোহণ করা তার কোন সৃষ্টির আরোহন করার মত নয় এবং তাঁর আরোহণ করার কেমনত্ব তিনি ব্যতীত আর কেউ জানে না।
ঘ। তামষীল (নমুনা বা দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা): সৃষ্টির গুণাবলীর দ্বারা আল্লাহর গুণাবলীর দৃষ্টান্ত দেওয়া অথবা তার গুণাবলীকে সৃষ্টির গুণাবলীর সহিত তুলনা করা। সুতরাং এ বলা বৈধ নয় যে, আমাদের অবতরণ করার মত আল্লাহ আকাশের প্রতি অবতরণ করেন। অবতরণের হাদীসটিকে মুসলিম বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহর গুণকে সৃষ্টির গুণের সদৃশ ভাবার কথা শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহর প্রতি আরোপ করা এক মিথ্যা অপবাদ। যেহেতু আমরা তার গ্রন্থাবলীতে একথার সত্যতার প্রমাণ পাইনি। বরং তিনি এই তাশবীহ ও তামষীলের (আল্লাহর গুণাবলী সৃষ্টির অনুরূপ হওয়ার কথা) খণ্ডন করেছেন এটাই আমরা পেয়েছি।
ঙ। তাফীয’ (ভারার্পণ করা): সলফগণ আল্লাহর গুণাবলীর কেমনত্ব বিষয়ের জ্ঞান তার প্রতি সমর্পণ করেন এবং ঐ গুণাবলীর অর্থ বিষয়ক জ্ঞান তাঁর প্রতি সমর্পণ করেন না (যেহেতু সে সবের অর্থ তাদের নিকট স্পষ্ট ও বিদিত এবং কেমনত্ব অবিদিত)। উদাহরণ স্বরূপ (استوى) ইসতিওয়া’ (আরোহণ করা) এর অর্থ কোন কিছুর ঊর্ধে অবস্থান বা আরোহণ করা যার কেমনত্ব আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে না।
(لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ) এর অর্থ আল্লাহ ব্যতীত কেউ সত্য মাবুদ (উপাস্য) নেই। এতে রয়েছে সমস্ত গাইরুল্লাহ (আল্লাহ ব্যতীত সকল সৃষ্টি) হতে উপাস্যতার খন্ডন এবং তা কেবল আল্লাহরই জন্য প্রতিপাদন।
১- আল্লাহ তাআলা বলেন, (فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ) অর্থাৎ, সুতরাং তুমি জান যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন (সত্য) উপাস্য নেই।” (সূরা মুহাম্মদ ১৯ আয়াত)
অতএব এই কলেমার অর্থ জানা ওয়াজেব এবং তা ইসলামের সমস্ত রুকন (স্তম্ভের) অগ্রে হওয়া বাঞ্ছনীয়।
২। মহানবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি বিশুদ্ধ-চিত্তে (ইখলাসের সহিত) “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ” বলবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (সহীহ মুসনাদে আহমদ)
আর মুখলিস (বিশুদ্ধ-চিত্ত) সেই হতে পারে যে তার অর্থ বুঝে, তার দাবী অনুযায়ী কর্ম (আমল) সম্পাদন করে এবং অন্যান্য আমলের পূর্বে তার প্রতি মানুষকে আহ্বান করে (দাওয়াত দেয়)। যেহেতু এতেই রয়েছে সেই তওহীদ যার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আল্লাহ বিশ্ব রচনা করেছেন।
৩। রসূল (সা.)-এর পিতৃব্য আবুতালেবের যখন মরণকাল উপস্থিত হয়, তখন তিনি তাকে বলেছিলেন, 'হে পিতৃব্য! আপনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলুন - এটা এমন এক কলেমা যাকে আল্লাহর নিকট আপনার (মুক্তির) জন্য দলীল স্বরুপ পেশ করব। কিন্তু তিনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলতে অস্বীকার করলেন। (বুখারী ও মুসলিম)
৪। রসূল (সা.) তের বছর মক্কায় অবস্থান করে আরববাসীদের এই বলে আহ্বান করেছেন যে, তোমরা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ সত্য উপাস্য নেই) বল। কিন্তু তারা বলেছিল, একটি মাত্র উপাস্য!? এরূপ তো আমরা কক্ষনো শুনিনি।
কারণ আরবরা এর অর্থ বুঝেছিল। আর এও বুঝেছিল যে, এই বাণী যে বলবে, সে আল্লাহ ব্যতীত ভিন্ন কাউকে আহবান করতে পারে না। তাই তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং বলেওনি। তাদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَٰهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ * وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُو آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ * بَلْ جَاءَ بِالْحَقِّ وَصَدَّقَ الْمُرْسَلِينَ
অর্থাৎ, ওদের নিকট আল্লাহ ব্যতীত কোন (সত্য) উপাস্য নেই’ বলা হলে ওরা অহংকারে অগ্রাহ্য করত এবং বলত, আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে বর্জন করব? বরং (মুহাম্মাদ) তো সত্য নিয়ে এসেছিল এবং সমস্ত রসূলের সত্যতা স্বীকার করেছিল। (সূরা সাফফাত ৩৫-৩৭ আয়াত)।
প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া কোন। সত্য উপাস্য নেই) বলবে এবং আল্লাহ ব্যতীত পূজ্যমান যাবতীয় ব্যক্তি ও বস্তুকে অস্বীকার ও অমান্য করবে তার জান ও মাল অবৈধ হয়ে যাবে।” (মুসলিম)
হাদীস শরীফটির মমার্থ এই যে, সাক্ষ্যবাণী উচ্চারণ করণের সাথে সাথে প্রত্যেক গায়রুল্লাহর ইবাদত -যেমন মৃত কবরবাসীদের নিকট কিছু প্রার্থনা ইত্যাদি- প্রত্যাখ্যান ও অস্বীকার করা একান্ত জরুরী। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, কিছু মুসলিম ঐ কলেমা তাদের মুখে আবৃত্তি করে। থাকে অথচ তাদের কর্মকান্ড ও আমল এবং গায়রুল্লাহকে ডাকা ও তার নিকট প্রার্থনা দ্বারা তারা ওর অর্থের বিরুদ্ধাচরণ করে!
৫। “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তওহীদ ও ইসলামের মূল ভিত্তি এবং জীবনের এক পুর্ণাঙ্গ নীতি; যা সকল প্রকার ইবাদত ও উপাসনাকে কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়। আর তা তখন সম্ভব হয় যখন মুসলিম আল্লাহরই বিনীত আজ্ঞানুবর্তী হয়, একমাত্র তাঁকেই আহবান করে, তারই নিকট সবকিছু প্রার্থনা করে এবং সকল সংবিধানকে উপেক্ষা করে কেবল শরীয়তের সংবিধান ও কানুনকে বিচার-ভার সমর্পণ করে ও তারই মীমাংসাকে সাদরে মেনে নেয়।।
৬। ইবনে রজব বলেন, 'ইলাহ (উপাস্য) তিনিই, যার সম্ভ্রম ও সম্মানে, ভক্তি ও ভয়ে, যার অনুগ্রহের আশায়, যার উপর ভরসা রেখে, যার নিকট যাচনা করে ও যাকে আহ্বান করে আনুগত্য করা হয় এবং বিরুদ্ধাচরণ না করা হয়। আর এ সমস্ত একমাত্র আল্লাহ ভিন্ন আর কারো জন্য উপযুক্ত নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি কোন সৃষ্টিকে উপাস্যের বৈশিষ্ট্য ঐ বিষয়গুলির মধ্যে যে কোন একটিতেও (আল্লাহর শরীক করবে তার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলার বিশুদ্ধচিত্ততায় (ইখলাসে) ত্রুটি থেকে যাবে এবং তার মধ্যে সৃষ্টির দাসত্ব স্থানলাভ করবে। যে পরিমাণে ঐ শির্ক বৃদ্ধি করবে সেই পরিমাণে ঐ ত্রুটি এবং দাসত্ব ও বৃদ্ধি পেতে থাকবে।”
৭ কলেমা “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তার পাঠকারীকে উপকৃত করবে; যদি সে শির্ক দ্বারা তা নষ্ট না করে। তা করলে কলেমা সেই ব্যক্তির জন্য ঐ ওযুর মতই হবে যা অপবিত্রতা (বাতকর্ম ইত্যাদির কারণে নষ্ট হয়ে যায়।
মহানবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তির (জীবনে) শেষ কথা 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ হবে সে জান্নাত লাভ করবে।” (হাসান, হাকেম বর্ণনা করেছেন।
১। (محمد رسول الله) মুহাম্মাদূর রসূলুল্লাহ’র অর্থ এই বিশ্বাস যে, তিনি আল্লাহর তরফ হতে প্রেরিত দূত ও রসূল। সুতরাং তিনি আমাদেরকে যে খবর দেন তা বিশ্বাস ও সত্যজ্ঞান করব, তিনি আমাদেরকে যা আদেশ করেন তাতে আমরা তার আনুগত্য করব। তিনি আমাদেরকে যা নিষেধ করেন ও বাধা দেন তা আমরা বর্জন করব এবং তিনি যা বিধেয় করেছেন কেবল সেই অনুসারেই আমরা আল্লাহর ইবাদত করব।
শায়খ আবুল হাসান নদবী ‘নবুওঅত’ গ্রন্থে বলেন, 'প্রত্যেক যুগ ও প্রত্যেক পরিবেশে আম্বিয়া (আলাইহিমুস সালামগ)ণের সর্বপ্রথম দাওয়াত এবং সর্ববৃহৎ লক্ষ্য ছিল আল্লাহ তাআলা সম্বন্ধে আকীদাহ ও বিশ্বাসের সংশুদ্ধি, আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মাঝে সম্পর্ক যথার্থকরণ, দ্বীন ও আনুগত্যকে আল্লাহরই জন্য বিশুদ্ধকরণের প্রতি আহ্বান, কেবলমাত্র আল্লাহরই জন্য ইবাদত ও উপাসনাকরণ, এবং (এই কথার জ্ঞানদান যে,) তিনিই একমাত্র উপকারী ও অপকারী, তিনিই ইবাদত, দুআ, শরণ প্রার্থনা, যবেহ ইত্যাদির একক অধিকারী। তাদের দাওয়াতী সংগ্রাম তাদের যুগে সেই পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীভূত ছিল যা মূর্তি, ছবি এবং জীবিত ও মৃত সাধু-সজ্জনদের উপাসনা রূপে প্রচলিত ছিল।”
২। এই আমাদের রসূল, যাকে সম্বোধন করে তার প্রভু বলেন,
قُل لَّا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ ۚ وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ ۚ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
অর্থাৎ, বল, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের ভালোমন্দের উপরও আমার কোন অধিকার নেই। আমি যদি অদৃশ্যের (গায়বের) খবর জানতাম, তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণ লাভ করে নিতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না। আমি তো শুধু মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদবাহী মাত্র।' (সূরা আরাফ ১৮৮ আয়াত)
রসূল (সা.) বলেন, “তোমরা আমার প্রশংসায় অতিরঞ্জন করো না; যেমন খ্রিষ্টানরা মারয়্যাম-তনয়ের প্রশংসায় অতিরঞ্জন করেছিল। আমি তো একজন। বান্দা মাত্র। সুতরাং তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রসূলই বলো।”
উক্ত হাদীসে (اطراء) শব্দের অর্থ হল, প্রশংসায় (না’তে) বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন করা। অতএব আমরা তার প্রশংসায় সীমালংঘন করব না এবং আল্লাহকে ছেড়ে তাকে উপাস্য বলে আহবান করব না; যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসা বিন মারয়্যামের ব্যাপারে মাত্রাধিক প্রশংসায় অতিরঞ্জন করে (এবং তাঁকে মাবুদের আসনে বসিয়েছিল) শির্কে আপতিত হয়েছিল। তাই আমাদেরকে আমাদের রসূল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমরা যেন কেবল বলি, মুহাম্মাদ আল্লাহর দাস এবং তার প্রেরিত দূত।
৩। একমাত্র আল্লাহকেই (বিপদে-আপদে) আহবান করা এবং তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে আহবান না করা; যদিও তিনি রসূল হন অথবা কোন নৈকট্যপ্রাপ্ত অলী। এই নির্দেশে রসূল (সা.) এ-এর আনুগত্য করলে তার মহব্বত ও প্রেম প্রকাশ হয়। তিনি বলেন, “যখন তুমি চাইবে তখন আল্লাহরই নিকট চাও এবং যখন সাহায্য ভিক্ষা করবে তখন আল্লাহর নিকটেই সাহায্য ভিক্ষা করো।” (তিরমিযী, তিনি এটিকে হাসান-সহীহ বলেছেন।)
রসূল (সা.) কোন উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তায় পড়লে বলতেন, “হে চিরঞ্জীব! হে অবিনশ্বর! আমি তোমার রহমতের অসীলায় (তোমার নিকট) সাহায্যের আবেদন করছি।” (তিরমিযী, হাদীসটি হাসান) আল্লাহ কবির প্রতি সদয় হন। তিনি বলেছেন,
‘দূর হয়ে যাক বিপদ মোদের আল্লাহর কাছেই চাই।
আল্লাহ ছাড়া বিপত্তারণ আর তো কেহ নাই।”
১। আরবী সাহিত্যের উলামাগণ উল্লেখ করেন যে, উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা (না’বুদু ও নাসতাঈন) ক্রিয়ার পূর্বে (ইয়্যা-কা) কর্মকারককে অগ্রে উল্লেখ করেছেন যাতে ইবাদত কেবল তারই জন্য ও সাহায্য প্রার্থনা কেবল তারই নিকট নিরূপিত হয় এবং তা কেবল তারই মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়।
২। অত্র আয়াত শরীফটি - যা মুসলিম নামাযে ও তার বাইরে প্রত্যহ বহুবার আবৃত্তি করে থাকে তা -সূরা ফাতিহার সারাংশ এবং সূরা ফাতিহা সমগ্র কুরআন মাজীদের সারাংশ ও নির্যাস।
৩। অত্র আয়াতে ইবাদত কথাটি ব্যাপক। যাতে সর্বপ্রকার ইবাদত ও উপাসনা যেমন নামায, ন্যর, যবেহ এবং বিশেষ করে দুআকে বুঝানো হয়েছে। যেহেতু নবী (সা.) বলেন, “দুআই হচ্ছে ইবাদত।” (তিরমিযী, আর তিনি এটিকে হাসান সহীহ বলেছেন)।
সুতরাং নামায যেমন এক প্রকার ইবাদত; যা কোন রসূল অথবা ওলীর জন্য নিবেদন করা বৈধ নয়, তেমনি দুআ (প্রার্থনা করা ও বিপদে ফরিয়াদ করা)ও এক প্রকার ইবাদত যা গায়রুল্লাহর জন্য নিবেদন করা অবৈধ। বরং তা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট। তিনি বলেন,
قُلْ إِنَّمَا أَدْعُو رَبِّي وَلَا أُشْرِكُ بِهِ أَحَدًا
অর্থাৎ, বল, 'আমি আমার প্রতিপালককেই কেবল ডাকি এবং তার সহিত অন্য কাউকেও শরীক করি না।' (সূরা জিন ২০ আয়াত)
৪। প্রিয় রসূল (সা.) বলেন, “মাছের উদরে অবস্থানকালে যুননুন (ইউনূস (আঃ) যে দুআ করেছিলেন সেই দুআ হল,
لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
(অর্থাৎ, তুমি ব্যতীত কেউ সত্য উপাস্য নেই, তুমি পবিত্র। আমি নিশ্চয় অত্যাচারীদের দলভুক্ত।) কোন মুসলিম যদি এই দুআ দ্বারা কখনো প্রার্থনা করে তবে আল্লাহ অবশ্যই তা মঞ্জুর করেন। (হাকেম হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন এবং যাহাবী এতে একমত হয়েছেন।