الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على سيد المرسلين، وعلى آله وصحبه أجمعين. وبعد
সহীহ সুন্নাহ বা হাদীস দ্বারা শুদ্ধ আমল ও ইবাদত করতে বাংলার মুসলিম সমাজকে অনুপ্রাণিত করার উদ্দেশ্যে এটি একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। যেহেতু সন্দিগ্ধ যয়ীফ হাদীসকে ভিত্তি করে কোন আমল করার চেয়ে সহীহ হাদীসকেই ভিত্তি করে নিঃসন্দেহে নিশ্চিতরূপে আমল করাটাই উত্তম। কারণ যয়ীফ হাদীস দ্বারা আমল ‘বিদআত’ বলে পরিগণিত।। বাংলাভাষায় লিখিত অধিকাংশ দুআ ও যিকরের বই-পুস্তকগুলিতে অনেক যয়ীফ হাদীস থেকে দুআ ও যিকর সংকলিত হয়েছে। যার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রেখে -আমার। জানা মতে -বিশুদ্ধ হাদীস থেকে বিশুদ্ধ দুআগুলি অত্র পুস্তিকায় সংকলন করেছি। এ প্রয়াস আল-মাজমাআর সমবায় ইসলামী দাওয়াত অফিসের কর্তৃপক্ষের নিকট ব্যক্ত হলে তাঁরা বইটিকে প্রকাশ করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর জন্য আমি নিজের এবং তাঁদের জন্য আল্লাহর নিকট উত্তম প্রতিদানের আশা রাখি।। অর্থ-হৃদয়ঙ্গম সহ নামায, দুআ ও যিকর আদি করাই উত্তম ও আবশ্যিক ভেবে এ পুস্তিকায় প্রত্যেক দুআর শেষে তার অর্থ সংযােজিত হয়েছে। আরবী জানেন না এমন বাঙালী-পাঠকের জন্য দুআর বাংলা উচ্চারণও তার সাথে যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু আরবী ভিন্ন কোন অন্য ভাষায় কুরআন কারীমের আয়াত লিখা ওলামাদের ফতোয়া মতে অবৈধ বলে কোন কুরআনী দুআর উচ্চারণ দেওয়া সম্ভব হয়নি। আশা করি।
আল্লাহ ও তাঁর যিকর-ভক্ত মুসলিম পাঠক কোন কারী আলেমের নিকট মৌখিক মুখস্ত করে নেবেন। অথবা নিজে আরবী শিখে সৃষ্টিকর্তা সুমহান প্রভুর বাণী নিজে পড়ার সৌভাগ্য লাভ করবেন। কারণ ভক্তি-ভাজনের বচনামৃতে পরিতৃপ্ত না হতে পারলে ভক্তের ভক্তি অপূর্ণই থেকে যায়।।
সংক্ষেপ করতে চেয়ে পুস্তিকার হাওয়ালায় কোথাও কোথাও সংকেত ব্যবহার করা হয়েছে যা প্রিয় পাঠক-পাঠিকা অনায়াসে বুঝে নেবেন বলে আশা রাখি। যেমন কুঃ= কুরআন মাজীদ এবং তার পর সুরা ও আয়াত নং, বুঃ= বুখারী, মুঃ= মুসলিম, আঃদাঃ= আবু দাউদ, তিঃ= তিরমিযী, নাঃ= নাসাঈ, ইঃমাঃ ইবনে মাজাহ, আঃ= আহমাদ, জাঃ জামে’, মাঃ= মাজমাউ, ইঃগঃ= ইরওয়াউল গালীল, সঃ= সহীহ ইত্যাদিকে বুঝিয়েছি।
বিশেষ কতকগুলো আরবী অক্ষর উচ্চারণের প্রয়াসে বিশেষ বানান প্রদত্ত হয়েছে। যেমন, ش = শ, ص = স্ব, ض =য্ব, ط = ত্ব, ق = ক্ব, و = অ, ওয়া, ব, ع ও ء তে জযম বুঝাতে ' ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন তাশদীদের নিচে জের ব্যবহার করা হয়েছে। হরফের উপরেই, যা খেয়াল করে পড়া একান্ত জরুরী। যারা প্রতিনিয়ত আল্লাহ তাআলার স্মরণ চান এবং তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্ভেজাল অনুসরণ চান তারা অত্র পুস্তিকা দ্বারা প্রভূত উপকৃত হবেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি অসাল্লামের বিশুদ্ধ অনুসরণের সাথে তাকে সর্বদা স্মরণকারীদের দলভুক্ত করুন। আমীন।
আব্দুল হামীদ মাদানী,
আল-মাজমাআহ,
সউদী আরব
৩০/১০/৯৪
‘যিকর’এর অর্থ স্মরণ। মু’মিন সর্বদা আল্লাহর রহমত ছায়ায় প্রতিপালিত, তার জীবন আল্লাহর দয়াবারিতে সদা সিক্ত। তার জীবনের সকল কিছুই আল্লাহর দান। প্রতি পদে তাকে আল্লাহরই আনুগত্য করতে হয়। আল্লাহই তার স্রষ্টা, মালিক, বিধানকর্তা এবং একমাত্র উপাস্য। তাই তার নিকটে আল্লাহ সদা স্মরণীয়। অন্তরে, মুখে ও কর্মে তাঁর যিকর করা মুসলিমের অপরিহার্য কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা বলেন, (وَلَذِكْرُ اللَّهِ أَكْبَرُ) অর্থাৎ, আল্লাহর যিকর (স্মরণ)ই সবচেয়ে বড়।” (সূরা আনকাবুত ৪৫ আয়াত) তিনি আরো বলেন, (فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ) অর্থাৎ, অতএব তোমরা আমাকে স্মরণ কর আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং কৃতঘ্ন হয়ো না।' (সূরা বাক্বারাহ ১৫২)।
তিনি অন্যত্র বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিকরূপে স্মরণ কর। (সূরা আহযাব ৪১)।
তিনি আরো বলেন, 'আল্লাহকে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহকে অধিক স্মরণকারিণী নারী এদের জন্য আল্লাহ ক্ষমা ও মহা প্রতিদান রেখেছেন।” (সূরা আহযাব ৩৫ আয়াত)
তিনি আরো বলেন, “হে মুমিনগণ তোমাদের ঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে উদাসীন না করে, যারা উদাসীন হবে তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।” (সূরা মুনাফিকূন ৯)
তিনি আরো বলেন, “সেই সমস্ত গৃহে -- যে সমস্ত গৃহকে আল্লাহ নির্মাণ ও সম্মান করতে এবং তাতে তার নাম স্মরণ করতে আদেশ দিয়েছেন সেখানে সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ঘােষণা করে সে সব লোক, যাদেরকে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ক্রয়বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে এবং নামায পড়া ও যাকাত প্রদান করা হতে বিরত রাখে। না। তারা ভয় করে সেদিনকে, যেদিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি ভীতি-বিহ্বল হয়ে পড়বে।” (সূরা নুর ৩৬-৩৭)
“তুমি তোমার প্রতিপালককে মনে মনে সবিনয় ও সশঙ্কচিত্তে অনুচ্চস্বরে প্রত্যুষে ও সন্ধ্যায় স্মরণ কর এবং উদাসীনদের দলভুক্ত হয়ো না।” (সুরা আরাফ ২০৫)
তিনি অন্যত্র বলেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন কোন দলের সম্মুখীন হবে, তখন অবিচলিত থাক এবং আল্লাহকে অধিক অধিক স্মরণ কর; যাতে তোমরা সফলকাম হও।” (সূরা আনফাল ৪৫ আয়াত)
তিনি আরো বলেন, “অতঃপর যখন তোমরা হজ্জ সম্পন্ন করে নেবে, তখন আল্লাহকে এমনভাবে স্মরণ করবে যেমন তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষকে স্মরণ করতে অথবা তদপেক্ষা গভীরভাবে।” (সূরা বাক্বারাহ ২০০ আয়াত)
তিনি বলেন, “অতঃপর নামায সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান কর ও আল্লাহকে অধিকরূপে স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা জুমুআহ ১০ আয়াত)
তিনি আরো বলেন, “সে (ইউনুস) যদি আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘােষণা না করত, তাহলে সে পুনরুত্থান-দিবস পর্যন্ত সেথায় (মৎসগর্ভে) অবস্থান করত।” (সুরা স্বা-ফাত ১৪৩-১৪৪)।
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “কোন সম্প্রদায় যখন আল্লাহর যিকর করতে বসে তখন ফিরিশতামন্ডলী তাদেরকে বেষ্টিত করেন, আল্লাহর রহমত তাদেরকে ছেয়ে নেয়, তাদের উপর শান্তি বর্ষণ হয় এবং আল্লাহ তার নিকটবর্তী ফিরিশতাবর্গের নিকট তাদের কথা আলোচনা করেন।” (মুসলিম ৪/২০৭৪)।
“আল্লাহর ভ্রমণরত অতিরিক্ত ফিরিশতাদল আছেন, যারা যিকরের মজলিস অনুসন্ধান করে থাকেন।” (বুখারী ৭/১৬৮ ও মুসলিম ৪/২০৬৯)।
“যে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং যে করে না, উভয়ের উপমা জীবিত ও মৃতের ন্যায়।” (বুখারী৭/ ১৬৮; মুসলিম ১/৫৩৯)
“আমি কি তোমাদেরকে তোমাদের উত্তম কাজের সন্ধান দেব না? যা তোমাদের প্রভুর নিকট সবচেয়ে পবিত্র, তোমাদের মর্যাদায় সব চেয়ে উচ্চ, সােনা-চাদি দান করার চেয়ে উত্তম এবং শত্রুর সম্মুখীন হয়ে গর্দান কাটা ও কাটানোর চেয়ে শ্রেয়।” সকলে বললেন, নিশ্চয় বলে দিন। তিনি বললেন, “আল্লাহ তাআলার যিকর।” (তিরমিযী ৫/৪৫৮, ইবনে মাযাহ ২/১২৪৫, সহীহুল জামে’ ২৬২৯নং)।
“আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আমার বান্দার ধারণার কাছে থাকি। যখন সে আমাকে স্মরণ করে তখন আমি তার সঙ্গে থাকি। যদি সে আমাকে অন্তরে স্মরণ করে তাহলে তাকেও আমি আমার অন্তরে স্মরণ করি, যদি সে আমাকে কোন সভায় স্মরণ করে তবে আমি তাকে তার চেয়ে উত্তম সভায় স্মরণ করে থাকি--” (বুখারী ৮/১৭১, মুসলিম ৪/২০৬১নং)
“মুফারিদগণ আগে বেড়ে গেছে।” সকলে জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রসূল! ‘মুফারিদ কারা? তিনি বললেন, “আল্লাহর অধিক অধিক যিকরকারী পুরুষ ও নারী।” (মুসলিম ৪/২০৬২নং)
এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রসূল! কল্যাণের দরজা তো অনেক। তার সবটা পালন করতে আমি সক্ষম নই। অতএব আমাকে এমন কাজের সন্ধান দিন, যাকে আমি দৃঢ়ভাবে ধরে থাকব, আর অধিক ভার দিবেন না যাতে আমি ভুলে না যাই (যেহেতু আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি)। তিনি বললেন, “তোমার জিহ্বা যেন সর্বদা আল্লাহর যিকরে আর্দ্র থাকে।” (তিরমিযী ৫/৪৫৮ ইবনে মাজাহ ২/১২৪৬)
“যে ব্যক্তি এমন মজলিসে বসে, যেখানে সে আল্লাহর যিকর করে না (এর জন্য) আল্লাহর তরফ থেকে তার উপর পরিতাপ আসবে।” (আবুউদ ৪/২৬৪ সহীহুল জামে' ৫৩৪২)
আল্লাহর যিকর ও স্মরণে শতাধিক উপকার ও লাভ রয়েছে। যেমন, যিকর শয়তান দূর করে, রহমানকে সন্তুষ্ট করে, অন্তর থেকে দুশ্চিন্তা দূর করে ও অশান্তি অপসারণ করে, হৃদয়ে প্রশান্তি ও উৎফুল্লতা আনে, দেহ-মনকে সবল করে, চিত্তকে জ্যোতির্ময় করে, মুখমণ্ডলকে দীপ্তিময় করে, রুজী আনয়ন করে, আল্লাহর ভালোবাসা দান করে, জীবনে আল্লাহর ভীতি আনে, মু’মিনকে আল্লাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন করায়, আল্লাহর সামীপ্য প্রদান করে, মারেফাতের দ্বার উন্মুক্ত করে, আল্লাহর স্মরণ দান করে, অন্তর জীবিত করে, আত্মা ও অন্তরকে আহার প্রদান করে, পাপমুক্ত করে, বহু উদ্বেগ দুরীভূত করে, আল্লাহর আযাব ও গযব থেকে নিস্তার দেয়, শান্তি ও রহমত আনে, পরচর্চা, গীবত, চুগলী, গালি, মিথ্যা, অশ্লীলতা, বাজে ও অসার কথা থেকে দুরে রাখে, কিয়ামতে পরিতাপ থেকে নিষ্কৃতি দেয়, নির্জনে ক্রন্দনের সাথে যিকরকারীকে ছায়াহীন কিয়ামতে আল্লার আরশ তলে ছায়া দান করে, হৃদয়ের শূন্যতা ও প্রয়োজন দূর করে, মু’মিনকে সতর্ক ও সংযমী করে, বন্ধুত্ব, প্রেম, সাহায্য ও প্রেরণার মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গতা দান করে, অত্যাধিক নেকী ও পুরস্কারের অধিকারী করে, হৃদয়ের কঠোরতা দূর করে, মনের রোগ নিরাময় করে।
যিকরকারীর জন্য ফিরিশতা দুআ করেন, যিকরের মজলিস ফিরিশ্তাবর্গের মজলিস, যিকরকারীদের নিয়ে আল্লাহ তাআলা ফিরিশ্তাবর্গের নিকট গর্ব করেন। যিকর শোকরের মস্তক, যিকর দুআকে কবুলের যােগ্য করে, মু'মিনকে আল্লাহর আনুগত্যে সহায়তা করে, মুশকিল আসান করে, বিপদ ও বালা দূর করে, অন্তর থেকে সৃষ্টির ভয় দূর করে, মেহনতের কাজে শক্তি প্রদান করে, যিকরে আছে মিষ্ট স্বাদ, আল্লাহর প্রেম ইত্যাদি। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য, আল-ওয়া-বিলুস স্বইয়িব, ইবনুল কাইয়্যেম)।
যিকর দুই প্রকার;
১। আল্লাহ তাআলার সুন্দরতম নামাবলী এবং মহত্তম গুণাবলীর যিকর করা, এসব দ্বারা তার প্রশংসা ও গুণগান করা এবং আল্লাহর জন্য যা উপযুক্ত নয় তা থেকে তাকে পাক ও পবিত্র মনে করা। এই যিকরও আবার দুই প্রকারের ;
ক - আল্লাহর নাম ও গুণাবলী দ্বারা তার প্রশংসা রচনা করা। যেমন “সুবহা-নাল্লা-হ’, ‘আলহামদু লিল্লা-হ’, ‘লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ’, ‘আল্লাহু আকবার’ প্রভৃতি।
খ- আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর অর্থ ও আহকাম উল্লেখ করা। যেমন বলা যে, আল্লাহ তাআলা বান্দার সমস্ত শব্দ শুনেন, সকল স্পন্দন দেখেন তাঁর নিকট কোন কর্মই গুপ্ত থাকে না, বান্দার মাতা-পিতা অপেক্ষা তিনিই বান্দার উপর অধিক দয়াশীল। তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান--ইত্যাদি।
কিন্তু এ ক্ষেত্রে সতর্কতার বিষয় এই যে, যিকরকারী যেন সেই নাম ও গুণের কথাই উল্লেখ করে, যার দ্বারা আল্লাহ পাক নিজের প্রশংসা করেছেন অথবা তার রসূল যার দ্বারা তাঁর গুণগান করেছেন। এতে যেন কোন প্রকারের হেরফের ও দৃষ্টান্ত বা উপমা বর্ণনা না করা হয় এবং গুণের দলীলকে নিরর্থক বা আল্লাহকে ঐ গুণহীন মনে না করা হয়। যেমন ঐ সকল নাম ও সিফাতের কোন দুর-ব্যাখ্যা করাও বৈধ নয়।
পক্ষান্তরে এই যিকর আবার তিন প্রকারের; হাদ, সানা এবং মাজদ। সন্তোষ ও ভক্তির সাথে আল্লাহর সিফাতে-কামাল উল্লেখ করে প্রশংসা করাকে হামদ’ বলা হয়। গুণের পর আরো গুণগ্রামের উল্লেখ করে প্রশংসা করাকে ‘সানা’ বলা হয়। এবং আল্লাহ তাআলার মাহাত্ম ও শান-শওকত এবং মহিমা ও সার্বভৌমত্বের গুণাবলী দ্বারা প্রশংসা করাকে ‘মাজদ’ বলা হয়। এই তিন প্রকার প্রশংসা সূরা ফাতিহার প্রারম্ভে একত্রিত হয়েছে। অতএব বান্দা যখন নামাযে বলে (الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ) অর্থাৎ, সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর নিমিত্তে তখন আল্লাহ বলেন, 'বান্দা আমার প্রশংসা করল। যখন বলে, (الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ) অর্থাৎ যিনি অনন্ত করুণাময়, পরম দয়ালু’ তখন আল্লাহ বলেন, 'বান্দা আমার স্তুতি বর্ণনা করল। আর বান্দা যখন বলে, (مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ) অর্থাৎ বিচার দিনের অধিপতি’ তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, বান্দা আমার গৌরব বর্ণনা করল।' (মুঃ ৩৯৫)।
২। আল্লাহর আদেশ, নিষেধ এবং বিভিন্ন অনুশাসনের যিকর (স্মরণ) করা। এটিও দুই রকম;
ক - আল্লাহর বিধান উল্লেখ ও জ্ঞাপন করে তাঁর স্মরণ করা। যেমন বলা যে, আল্লাহ এই করতে আদেশ করেছেন, অমুক করতে নিষেধ করেছেন, তিনি এই কাজে সন্তুষ্ট, ঐ কাজে রাগান্বিত ইত্যাদি।
খ – তার বিধান ও অনুশাসন পালন করে তার যিকর (স্মরণ করা, যেমন, যে কাজ তিনি আদেশ করেছেন সত্বর তা পালন করে তাঁর যিকর করা, যা নিষেধ করেছেন সত্বর তা বর্জন করে তার স্মরণ করা। এই সকল যিকর যদি যিকরকারীর নিকট একত্রিত হয়, তবে তার যিক শ্রেষ্ঠতম যিকর। যিকরের আরো এক প্রকার যিকর, আল্লাহ পাকের দেওয়া সম্পদ, দান অনুগ্রহ, সাহায্য ইত্যাদির স্থান ও কাল প্রভৃতি উল্লেখ করে যিকর (শুকর) করা। এটাও এক উত্তম যিকর।
সুতরাং উক্ত পাঁচ প্রকার যিকর, যা কখনো অন্তর ও রসনা দ্বারা হয় এবং এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ যিক। আবার কখনো কেবল অন্তর দ্বারা হয়, যা দ্বিতীয় পর্যায়ের এবং কখনো বা কেবল রসনা দ্বারা হয়, যা তৃতীয় পর্যায়ের। ২ নং যিকর হলে অন্যান্য অঙ্গ দ্বারা। কার্যে পরিণত করাও যিকর হয়। অতএব মুমিনের সারা জীবন ও জীবনের প্রতি মুহূর্তটাই যিকরের স্থল। যেমন রসূল (ﷺ)-এর যিকরে আমরা বুঝতে পারব।
উল্লেখ্য যে, দুআ অপেক্ষা যিকর উত্তম। যেহেতু যিকরে আল্লাহ তাআলার সুন্দরতম নাম, মহিমময় গুণ ইত্যাদির সাথে তার প্রশংসা করা হয়। কিন্তু দুআতে বান্দা নিজের প্রয়োজন আল্লাহর নিকট জানিয়ে তার পূরণভিক্ষা করে থাকে। যে দুইয়ের মাঝে রয়েছে। বিরাট পার্থক্য। আবার যিকর অপেক্ষা কুরআন তেলাঅত উত্তম। কিন্তু যথােপযুক্ত সময়কালে তেলাঅত, যিকর ও দুআ স্ব-স্ব স্থানে শ্রেষ্ঠ। (বিস্তারিত দ্রষ্টব্য আল ওয়াবিলুস সইয়্যেব)।
ফযীলত প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের একটি অক্ষর পাঠ করবে, সে এর বিনিময়ে একটি নেকী অর্জন করবে। আর একটি নেকী দশগুণ করা হবে। (অর্থাৎ, একটি অক্ষর তেলাঅতের প্রতিদানে ১০টি নেকীর অধিকারী হবে।) আমি বলছি না যে, ‘আলিফ-লাম-মীম” একটি অক্ষর। (বরং এতে রয়েছে তিনটি অক্ষর।)” (তিরমিযী ৫/১৭৫, সহীহুল জামে ৫/৩৪০)
“তোমরা কুরআন পাঠ কর। কারণ তা কিয়ামতের দিন পাঠকারীদের জন্য সুপারিশকারী রূপে আবির্ভূত হবে।” (মুসলিম)
“যে ব্যক্তি দশটি আয়াত পাঠ করবে, সে উদাসীনদের মধ্যে লিখিত হবে না, যে ব্যক্তি একশ’টি আয়াত পাঠ করবে, সে অনুগতদের মধ্যে লিখিত হবে। আর যে ব্যক্তি এক হাজারটি আয়াত পাঠ করবে, সে (অশেষ সওয়ারে) ধনপতিদের মধ্যে লিখিত হবে।” (সিলসিলাহ সহীহাহ ৬৪২)।
“তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম, যে কুরআন শিক্ষা করে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়।” (বুখারী ৬/১০৮)
“মসজিদে গিয়ে একটি আয়াত শিক্ষা করা বা মুখস্ত করা একটি বৃহদাকার উট লাভ করার চেয়েও উত্তম।” (মুসলিম)
“যে ব্যক্তি কষ্ট করেও কুরআন শুদ্ধ করে পড়ার চেষ্টা করে, তার ডবল সওয়াব।” (বুখারী ও মুসলিম)
“কুরআন-ওয়ালারাই আল্লাহওয়ালা এবং তার বিশিষ্ট বান্দা।” (সহীহুল জামে ২১৬৫)
“কুরআন তেলাঅতকারী পরকালে সম্মানের মুকুট ও চোগা পরিধান করবে। আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হবেন এবং আয়াতের সংখ্যা পরিমাণে সে উচ্চ দর্জায় উন্নীত হবে।” (সহীহুল জামে, ৮০৩০, ৮০২২, ৮০২১)
“মর্যাদায় সবচেয়ে বড় সূরা হল, সূরা ফাতেহা।” (বুখারী)
“যে গৃহে সূরা বাক্বারাহ তেলাঅত হয়, সে গৃহে শয়তান (জ্বিন) প্রবেশ করে না।” (মুসলিম)
“মর্যাদায় সর্বাপেক্ষা বড় আয়াত, আয়াতুল কুরসী।” (মুসলিম)।
“রাত্রে সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করলে, তা সব কিছু হতে যথেষ্ট হবে।” (বুখারী মুসলিম)
“সূরা বাক্বারাহ ও আলে-ইমরান উভয় সূরাই তেলাঅতকারীর জন্য কিয়ামতে আল্লাহর নিকট হুজুজত করবে।” (মুসলিম)
“সূরা কাহফের প্রথম দশ আয়াত মুখস্থ করলে দাজ্জালের ফিতনা থেকে মুক্তি লাভ করা সম্ভব হবে।” (মুসলিম)
“জুমআর দিন সূরা কাহফ পাঠ করলে দুই জুমআর মধ্যবর্তী জীবন আলোকময় হবে।” (সহীহুল জামে ৬৪৭০)।
“সূরা মুলক তার তেলাতকারীর জন্য সুপারিশ করে পাপক্ষালন করবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী)
“চার বার সূরা কাফিরুন’ পাঠ করলে এক খতমের সমান সওয়াব লাভ হয়।” (সহীহুল জামে ৬৪৬৬)
“সূরা ইখলাস’ তিনবার পাঠ করলে এক খতমের সমান নেকীলাভ হয়।” (বুখারী)
“যে সূরা ইখলাস ভালোবাসে, সে আল্লাহর ভালোবাসা এবং জান্নাত লাভ করবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
“উক্ত সূরা দশবার পাঠ করলে পাঠকারীর জন্য জান্নাতে এক গৃহ নির্মাণ করা হবে।” (সহীহুল জামে ৬৪৭২)
“কোন সম্প্রদায় আল্লাহর গৃহসমূহের কোন গৃহে সমবেত হয়ে যখনই কুরআন। তেলাঅত করে এবং আপােসে তার শিক্ষা গ্রহণ করে তখনই তাদের উপর শান্তি বর্ষিত হয়, রহমত তাদেরকে ছেয়ে নেয়, ফিরিশ্তামন্ডলী তাদেরকে বেষ্টিত করে রাখেন। এবং আল্লাহ তাঁর নিকটবর্তী ফিরিশ্তাবর্গের নিকট তাদের কথা আলোচনা করেন।” (মুসলিম)
আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ
অর্থাৎ, তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাক (আমার নিকট দুআ কর) আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব (আমি তোমাদের দুআ কবুল করব।) যারা অহংকারে আমার উপাসনায় (আমার কাছে দুআ করা হতে) বিমুখ, ওরা লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে।” (সূরা গাফের ৬০ আয়াত)।
তিনি আরো বলেন, “আর আমার বান্দাগণ যখন আমার সম্বন্ধে তোমাকে প্রশ্ন করে (তখন তুমি বল,) আমি তো কাছেই আছি। যখন কোন প্রার্থনাকারী আমার কাছে প্রার্থনা জানায়, তখন আমি তার প্রার্থনা মঞ্জুর করি।” (সূরা বাক্বারাহ ১৮৬)
রসুল (ﷺ) বলেন, “দুআই তো ইবাদত।” (আবু দাউদ ২/৭৮; তিরমিযী ৫/২১১)
“নিশ্চয় তোমাদের প্রভু লজ্জাশীল অনুগ্রহপরায়ণ, বান্দা যখন তার দিকে দুই হাত তোলে, তখন তা শূন্য ও নিরাশভাবে ফিরিয়ে দিতে বান্দা থেকে লজ্জা করেন।” (আবু দাউদ ২/৭৮; তিরমিযী ৫/৫৫৭)
“যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে না, আল্লাহ তার উপর ক্রোধান্বিত হন।” (তিরমিযী ৫/৪৫৬, ইবনে মাযাহ ২/১২৫৮)
দুআ অন্যান্য ইবাদতের মত এক ইবাদত। যা আল্লাহরই জন্য নির্দিষ্ট। সুতরাং গায়রুল্লাহর নিকট দুআ ও প্রার্থনা করলে বা কিছু চাইলে অথবা গায়রুল্লাহকে ডাকলে তা অবশ্যই শির্ক হয়। তাই যাবতীয় দুআ ও প্রার্থনা কেবল আল্লাহরই নিকট করতে হয় এবং যত কিছু চাওয়া কেবল তাঁরই নিকট চাইতে হয়। সর্বপ্রকার, সর্বভাষায় এবং একই সময় অসংখ্য ডাক কেবল তিনিই শুনতে ও বুঝতে পারেন এবং সর্বপ্রকার দান কেবল তিনিই করতে পারেন।
সাধারণভাবে দুআ করার কয়েকটি আদব ও নিয়ম রয়েছে, যা পালন করা বাঞ্ছনীয়, ১। ইখলাস বা একনিষ্ঠতা। এটি সর্বাপেক্ষা বড় আদব। আল্লাহ পাক বলেন,
“সুতরাং আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ-চিত্ত হয়ে তাকে ডাক, যদিও কাফেরগণ এ অপছন্দ করে।” (কুঃ ৪০/১৪)
“তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ-চিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে কেবল তারই উপাসনা করতে----।” (সূরা বাইয়্যিনাহ ৫ আয়াত)
২। দৃঢ়তার সাথে প্রার্থনা ও দুআ করা এবং আল্লাহ মঞ্জুর করবেন এই কথার উপর দৃঢ় প্রত্যয় রাখা। রসুল (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যেন না বলে, হে আল্লাহ! যদি তুমি চাও, তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দাও। হে আল্লাহ! যদি তুমি চাও, তাহলে আমাকে দয়া কর। বরং দৃঢ় নিশ্চিত হয়ে প্রার্থনা করা উচিত। যেহেতু আল্লাহকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ বাধ্য করতে পারে না।” (বুখারী ১১/১৩৯, মুসলিম ৪/২০৬৩)।
৩ আগ্রহাতিশয্যে নাছােড় বান্দা হয়ে বার-বার দুআ করা, দুআর ফল লাভে শীঘ্রতা না করা এবং অন্তরকে উপস্থিত রেখে প্রার্থনা করা।
রসুল (ﷺ) বলেন, “তোমাদের কারো দুআ কবুল করা হয়, যতক্ষণ না সে তাড়াতাড়ি করে। বলে, ‘দুআ করলাম কিন্তু কবুল হল না।” (বুখারী ১১/১৪০, মুসলিম ৪/২০৯৫)
“বান্দার দুআ কবুল হয়েই থাকে, যতক্ষণ সে কোন পাপের অথবা জ্ঞাতিবন্ধন টুটার জন্য দুআ না করে এবং (দুআর ফল লাভে) শীঘ্র না করে।” জিজ্ঞাসা করা হল, “হে আল্লাহর রসূল! শীঘ্রতা কেমন?’ বললেন, “এই বলা যে, দুআ করলাম, আরো দুআ করলাম। অথচ কবুল হতে দেখলাম না। ফলে সে তখন আক্ষেপ করে এবং দুআ করাই ত্যাগ করে বসে।” (মুসলিম ৪/২০৯৬)
“তোমরা আল্লাহর নিকট দুআ কর কবুল হবে এই দৃঢ় প্রত্যয় রেখে। আর জেনে রেখাে যে, আল্লাহ উদাসীন ও অন্যমনস্কের হৃদয় থেকে দুআ মঞ্জুর করেন না।” (তিরমিযী ৫/৫১৭)
মােট কথা দুআ করার সময় মনকে সজাগ রাখতে হবে, তার দুআ কবুল হবে --এই একীন রাখতে হবে এবং কি চাইছে তাও জানতে হবে।
সুতরাং যারা অভ্যাসগতভাবে দুআ করে থাকে অথবা দুআয় কি চায়, তা তারা নিজেই না জেনে তোতার বুলি আওড়ানোর মত আরবীতে দুআ আওড়ে থাকে, তাদের দুআ মঞ্জুর হবে কি?
৪। সুখে-দুঃখে ও নিরাপদে-বিপদে সর্বদা প্রার্থনা করা।
আল্লাহর রসুল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, দুঃখে ও বিপদে আল্লাহ তার দুআ কবুল করবেন, সেই ব্যক্তির উচিত, সুখে ও স্বাচ্ছন্দ্যে অধিক অধিক দুআ করা।” (তিরমিযী ৫/৪৬২)
৫। নিজের পরিবার ও সম্পদের উপর বদদুআ না করা। আনসারদের এক ব্যক্তি সেচক উট চলতে চলতে থেমে গেলে ধমক দিয়ে বলল, ‘চল, আল্লাহ তোকে অভিশাপ করুক। তা শুনে আল্লাহর রসূল (ﷺ) বললেন, “কে তার উটকে অভিশাপ দিচ্ছে?” লোকটি বলল, আমি, হে আল্লাহর রসূল! তিনি বললেন, “নেমে যাও ওর পিঠ থেকে, অভিশপ্ত উট নিয়ে আমাদের সঙ্গে এসাে না। তোমরা তোমাদের নিজেদের উপর বদদুআ করো না, তোমাদের সন্তানদের উপর বদ্দুআ করো না, আর তোমাদের সম্পদের উপরও বদুআ করো না। যাতে আল্লাহর তরফ থেকে এমন মুহূর্তের সমন্বয় না হয়ে যায়, যে মুহূর্তে দান চাওয়া হলে মঞ্জুর (প্রদান) করা হয়।” (মুসলিম ৪/২৩০৪)
৬। কেবল আল্লাহরই নিকট প্রার্থনা করা।
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “যখন কিছু চাইবে, তখন আল্লাহর নিকটই চাও। যখন সাহায্য চাইবে, তখন আল্লাহর নিকটেই চাও।” (তিরমিযী ৪/৬৬৭, মুসলিম ১/২৯৩)
যেহেতু প্রার্থনা এক ইবাদত। অন্যের কাছে প্রার্থনা করলে আল্লাহর ইবাদতে শির্ক করা হয়।
৭। উচ্চ ও নিঃশব্দের মধ্যবর্তী চাপা স্বরে সংগোপনে প্রার্থনা করা। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাক। তিনি সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” (সূরা আরাফ ৫৫ আয়াত)
আবু মূসা (রাঃ) বলেন, আমরা কোন সফরে নবী (ﷺ) এর সাথে ছিলাম। লোকেরা জোরে-শােরে তকবীর পড়তে শুরু করল। তখন নবী (ﷺ) বললেন, “হে লোক সকল! নিজেদের উপর কৃপা কর। নিশ্চয় তোমরা কোন বধির অথবা কোন দুরবর্তী) অনুপস্থিতকে আহ্বান করছে না। বরং তোমরা সর্বশ্রোতা নিকটবর্তীকে আহ্বান করছ। তিনি (তার ইলমসহ) তোমাদের সঙ্গে আছেন।” (বুখারী ৫/৭৫, মুসলিম ৪/২০৭৬)
৮। আল্লাহর সুন্দরতম নাম এবং মহত্তম গুণাবলীর অসীলায় অথবা কোন নেক আমলের অসীলায় দুআ করা। আর এ ছাড়া কোন সৃষ্টি (যেমন, নবী, ওলী, আরশ, কুর্সী প্রভৃতির) অসীলা ধরে দুআনা করা। যেমনঃ (رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ) অর্থঃ হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয় আমরা ঈমান এনেছি, অতএব আমাদের অপরাধসমূহ মার্জনা কর এবং জাহান্নামের শাস্তি হতে আমাদেরকে রক্ষা কর।” (সূরা আলে ইমরান ১৬ আয়াত)
৯। আল্লাহ তাআলার ইসমে আযম দিয়ে দুআ শুরু করলে তিনি তা কবুল করেন। এই ইসমে আযম দ্বারা দুআ করার বর্ণনা হাদীস শরীফে কয়েকরকম এসেছে;
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنِّي أَشْهَدُ أَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، الأَحَدُ الصَّمَدُ، الَّذِي لَمْ يَلِدْ، وَلَمْ يُولَدْ، وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা বিআন্নী আশহাদু আন্নাকা আন্তাল্লা-হ, লা ইলা-হা ইল্লা আন্তাল আহাদুস সামাদুল্লাযী লাম ইয়ালিদ অলাম ইউলাদ, অলাম য়্যাকুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ।
অর্থঃ- আমি সাক্ষি দিচ্ছি যে, তুমি আল্লাহ, তুমি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তুমি একক, ভরসাস্থল, যিনি জনক নন জাতকও নন এবং যার সমকক্ষ কেউ নেই এই অসীলায় আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি। (আবু দাউদ ১৪৯৩, তিরমিযী ৩৪৭৫, ইবনে মাজাহ ৩৮৫৭, আহমাদ, হাকেম, ইবনে হিব্বান)
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ يَا أَللَّهُ بِأَنَّكَ الْوَاحِدُ الْأَحَدُ، الصَّمَدُ، الَّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ، وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ، أَنْ تَغْفِرَ لِي ذُنُوبِي، إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
উচ্চারণঃ- আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা ইয়া-ল্লা-হু বিআন্নাকাল ওয়াহিদুল আহাদুস স্বামাদুল্লাহী লাম ইয়ালিদ অলাম ইউলাদ অলাম ইয়াকুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ, আন তাগফিরা লী যুনুবী, ইন্নাকা আন্তাল গাফুরুর রাহীম।
অর্থ- হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি, হে এক, একক, ভরসাস্থল আল্লাহ! যিনি জনক নন জাতকও নন এবং যার সমকক্ষ কেউ নেই, তুমি আমার গোনাহসমূহকে ক্ষমা করে দাও, নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল দয়াবান।” (সহীহ নাসাঈ ১২৩৪।
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنَّ لَكَ الْحَمْدَ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ الْمَنَّانُ يَا بَدِيعَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ
উচ্চারণঃ- আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা বিআন্না লাকাল হামদ, লা ইলা-হা ইল্লা আন্তাল মান্নানু বাদীউস সামাওয়াতি অল আরয্ব, ইয়া যাল জালালি অল ইকরাম, ইয়্যা হাইয়্যু ইয়া কায়্যুম।”
অর্থঃ- হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি এই অসীলায় যে, সমস্ত প্রশংসা তোমারই, তুমি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তুমি পরম অনুগ্ৰহদাতা, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর আবিষ্কর্তা, হে মহিমময় এবং মহানুভব, হে চিরঞ্জীব অবিনশ্বর।” (আবু দাউদ ১৪৯৫, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবন মাজাহ ৩৮ ৫৮, আহমাদ, হবে ইবন হিব্বান)।
لا إِلَهَ إِلا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
অর্থঃ- তুমি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই, তুমি পবিত্র মহান! অবশ্যই আমি সীমালংঘনকারী। (সূরা আম্বিয়া ৮৭ আয়াত)
১০। আল্লাহর প্রশংসা (হামদ ও সানা) দিয়ে অতঃপর নবী (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করে দুআশুরু করা এবং অনুরূপ শেষ করা।
রসূল (ﷺ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ দুআ করবে, তখন তার উচিত আল্লাহর হামদ ও সানা দিয়ে শুরু করা, অতঃপর নবীর উপর দরূদ পড়া, অতঃপর ইচ্ছামত দুআ করা।” (আবু দাউদ ২/৭৭, তিরমিযী ৫/৫১৬, নাসাঈ ৩/৪৪)।
১১৷ কাকুতি-মিনতি, বিনয়, আশা, আগ্রহ, মুখাপেক্ষিতা ও ভীতির সাথে দুআ করা। একান্ত ‘ফকীর’ হয়ে আল্লাহর দরবারে অক্ষমতা, সঙ্কীর্ণতা ও দুরবস্থার অভিযােগ করা। যেভাবে আয়্যুব নবী ব্যাধিগ্রস্ত হলে, যাকারিয়া নবী নিঃসন্তান হলে, ইউনুস নবী মাছের পেটে গেলে আল্লাহর কাছে দুআ করেছিলেন।
মহান আল্লাহ বলেন, “তোমার প্রতিপালককে মনে মনে সবিনয় ও সশঙ্কচিত্তে অনুচ্চ স্বরে প্রত্যুষে ও সন্ধ্যায় স্মরণ কর এবং উদাসীনদের দলভুক্ত হয়ো না।” (সূরা আ’কফ ২০৫
“তারা সৎ কাজে প্রতিযােগিতা করত, আশা ও ভীতির সাথে আমাকে ডাকত এবং তারা ছিল আমার নিকট বিনীত।” (সূরা আম্বিয়া ৯০ আয়াত)
বান্দার যতই সুখ থাক, স্বাচ্ছন্দ্যের সাগরে ডুবে থাকলেও সে সর্বদা আল্লাহর রহমতের ভিখারী ও মুখাপেক্ষী। মিসকিন বান্দার যা আছে তা কাল চলে যেতে পারে। সব আছে বা সব পেয়েছি বলে দুআ বন্ধ করা মূর্খতা। সব কিছু থাকলেও যা আছে তা যাতে চলে না যায়, তার জন্যও দুআ করতে হবে। তাছাড়া পরজীবনের কথা তার অজানা। পরকালে সুখ পাবে কি না সে বিষয়ে সে নিশ্চিত নয়। অতএব পরকালের সুখও তাকে চেয়ে নিতে হবে এবং সে প্রার্থনা হবে অনুনয়-বিনয় সহকারে; ঔদ্ধত্যের সাথে নয়।
১২। নিজের অপরাধ ও আল্লাহর অনুগ্রহকে স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন-পূর্বক দুআ করা। এ বিষয়ে 'সাইয়েদুল ইস্তিগফার' দুআ ইস্তিগফারের অনুচ্ছেদে আসবে।
১৩। কষ্ট-কল্পনার সাথে ছন্দ বানিয়ে দুআ না করা। এ বিষয়ে ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, প্রত্যেক জুমআহ (সপ্তাহে) লোকদেরকে মাত্র একবার ওয়ায কর। যদি না মানো তবে দুইবার। তাও যদি না মানে তবে তিনবার। লোকেদেরকে এই কুরআনের উপর বিরক্ত করো না। আর আমি যেন তোমাকে না (দেখতে) পাই যে, কোন সম্প্রদায় তাদের নিজেদের কোন কথায় ব্যাপৃত থাকলে তুমি তাদের নিকট গিয়ে নিজের বয়ান শুরু করে দাও এবং তাদের কথা কেটে তাদেরকে বিরক্ত কর। বরং তুমি সেখানে উপস্থিত হয়ে চুপ থাক; অতঃপর তারা সাগ্রহে আদেশ করলে তুমি বয়ান কর। খেয়াল করে ছন্দযুক্ত দুআ থেকে দুরে থাক। যেহেতু আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তার সাহাবাবর্গের নিকট উপলব্ধি করেছি যে, তারা এটাই করতেন। অর্থাৎ, ছন্দ বানিয়ে দুআ উপেক্ষা করতেন।” (বুখারী ৭/১৫৩)
১৪ তওবা করে (অর্থাৎ বিশুদ্ধ চিত্তে, পাপ বর্জন করে, লজ্জিত হয়ে, পুনঃ ঐ পাপে না ফিরার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে এবং অন্যায়ভাবে কারো মাল হরফ করে থাকলে তা ফেরৎ দিয়ে ও কারো প্রতি জুলুম করে থাকলে তার প্রতিশােধ দিয়ে অথবা ক্ষমা চেয়ে তারপর) দুআ করা। যেহেতু পাপে লিপ্ত থাকলে দুআ কবুল হয় না।
১৫৷ হালাল পানাহার করা এবং হালাল পরিধান করা। এ বিষয়ে আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “হে লোক সকল! আল্লাহ পবিত্র তিনি পবিত্র জিনিসই গ্রহণ করেন। নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদেরকে সেই আদেশই করেছেন যে আদেশ রসূলগণকে করেছেন, তিনি বলেন, “হে রসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু আহার কর ও সৎকাজ কর, তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।” (কুঃ ২৩/৫১)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, যার অর্থ, “হে মুমিনগণ! আমি তোমাদেরকে যা দান করেছি তা থেকে পবিত্র বস্তু আহার কর---।” (সূরা বাকারাহ ১৭২)
অতঃপর রসূল সেই ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, যে ব্যক্তি ধুলোধূসরিত আলুথালু বেশে (সৎকাজের উদ্দেশ্যে) সফর করে। তার হাত দুটিকে আকাশের দিকে তুলে, ‘হে প্রভু! হে আমার প্রতিপালক!’ বলে (দুআ করে), কিন্তু তার আহার্য হারাম, তার পরিধেয় হারাম এবং হারাম খাদ্যে সে প্রতিপালিত হয়েছে। সুতরাং কেমন করে তার প্রার্থনা মঞ্জুর হবে? (মুসলিম ৪৭০৩)
১৬। খুব গুরুত্বপূর্ণ দুআ হলে ফিরিয়ে ফিরিয়ে ৩ বার করে বলা। যেমন আল্লাহর রসুল (ﷺ) যখন কুরাইশের উপর বদুআ করেছিলেন, তখন ৩ বার করে বলেছিলেন। (বুখারী ৪/৬৫, মুসলিম ৩/১৪১৮)
১৭৷ দুআর পূর্বে ওযু করা। অবশ্য প্রত্যেক দুআ বা যিকরের জন্য ওযু বা গোসল করা জরুরী নয়। তবে সাধারণ প্রার্থনার জন্য মুস্তাহাব। (বুখারী ৫/১০১, মুসলিম ৪/১৯৪৩)
১৮৷ কেবলা-মুখ হয়ে দুআ করা। এ আদবটিও সকল দুআর ক্ষেত্রে জরুরী নয়।
১৯। মুখ বরাবর দুই হাত তুলে দুআ করা। এ আদবটিও সেখানে ব্যবহৃত, যেখানে আল্লাহর রসুলের নির্দেশ আছে। অথবা যেখানে কোন নির্দেশ নেই সেখানে সাধারণ প্রার্থনার ক্ষেত্রে এ আদবের খেয়াল রাখা উচিত। কিন্তু হাত তুলে দুআর শেষে মুখে হাত বুলানো প্রসঙ্গে কোন সহীহ হাদীস নেই। তাই মুখে হাত বুলানো বিদআত। প্রকাশ থাকে যে, ইস্তিগফার করার সময় একটি আঙ্গুল তুলে ইশারা করে এবং সকাতর প্রার্থনার সময় দুই হাত মাথা বরাবর লম্বা করে তুলে দুআ করতে হয়। (আবু দাউদ, সহীহুল জামে’ ৬৬৯৪নং)
২০। অশ্রু বিসর্জনের সাথে দুআ করা। (মুসলিম ১/১৯১) ২১।
২১। অপরের জন্য দুআ করলে নিজের জন্য প্রথমে দুআ শুরু করা। যেমন নবী (ﷺ) কারোর জন্য দুআ করলে নিজের জন্য প্রথম শুরু করতেন। (তিরমিযী ৫/৪৬৩)
২২। দুআয় সীমালংঘন ও অতিরঞ্জন না করা। যেমন, হে আল্লাহ! আমি জান্নাতের সম্পদ, সৌন্দর্য, হুর-গেলমান, দুধের নহর---চাই। হে আল্লাহ! আমি জাহান্নামের আগুন থেকে, তার শিকল ও বেড়ি থেকে, ফুটন্ত পানি ও পুঁজ থেকে পানাহ চাই---' হে আল্লাহ! আমি জান্নাতের ডান দিকে সাদা মহল চাই-- ইত্যাদি বলে দুআ করা বৈধ নয়। এখানে সংক্ষিপ্তভাবে জাহান্নাম থেকে রেহাই পেতে এবং জান্নাতে প্রবেশ করতে চাওয়াই যথেষ্ট। তাই তো সেই দুআ করা উচিত, যার শব্দ কম অথচ অর্থ অনেক ব্যাপক। (আবু দাউদ ১/২৪, ২/৭৭)
আল্লাহ তাআলা বলেন, (ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ)
অর্থাৎ, তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাক, তিনি সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা আরাফ ৫৫ আয়াত)
সহীহ দুআ ও যিকর দুআতে প্রায় ২০ প্রকার সীমালংঘন হতে পারে;
ক- শির্কমূলক দুআ করা।
খ- শরীয়ত যা হবে বলে, তা না হতে দুআ করা; যেমন বলা যে, আল্লাহ! তুমি কিয়ামত কায়েম করো না, কাফেরকে আযাব দিয়ো না।
গ- শরীয়ত যা হবে না বলে, তা হতে দুআ করা; যেমন বলা যে, আল্লাহ! তুমি কাফেরকে বেহেস্ত দান কর, আমাকে দুনিয়ায় চিরস্থায়ী কর, আমাকে গায়েবী ইলম দাও বা আমাকে নিস্পাপ কর’ ইত্যাদি।
ঘ- জ্ঞান ও বিবেকে যা হওয়া সম্ভব, তা না হতে দুআ করা।
ঙ- জ্ঞান ও বিবেকে যা হওয়া অসম্ভব তা হওয়ার জন্য প্রার্থনা করা; যেমন, আল্লাহ! আমি যেন একই সময় দুই স্থানে উপস্থিত ও প্রকাশ হতে পারি ইত্যাদি।
চ- সাধারণতঃ যা ঘটা অসম্ভব তা ঘটতে প্রার্থনা করা। যেমন, আল্লাহ! আমাকে এমন মুরগী দাও, যে সােনার ডিম পাড়ে, আমাকে যেন পানাহার করতে না হয়’ ইত্যাদি।
ছ- শরীয়তে হবে না বলে শ্রুত, পুনরায় তা না হতে প্রার্থনা করা; যেমন, আল্লাহ! তুমি কাফেরদেরকে জান্নাত দিও না ইত্যাদি।
জ – শরীয়তে হবে বলে শ্রুত, পুনরায় তা হতে দুআ করা।
ঝ - প্রার্থিত বিষয়কে আল্লাহর ইচ্ছায় লটকে দেওয়া; যেমন, হে আল্লাহ! তুমি যদি চাও তাহলে আমাকে ক্ষমা কর ইত্যাদি।
ঞ- অন্যায়ভাবে কারো উপর বদদুআ করা।
ট- কোন হারাম বিষয় প্রার্থনা করা; যেমন, আমি যেন ব্যভিচার করতে বা চুরি করতে পারি বা তাতে ধরা না পড়ি।
ঠ- প্রয়োজনের অধিক উচ্চ স্বরে দুআ করা।
ড- অবিনীতভাবে আল্লাহর অনুগ্রহের মুক্ষাপেক্ষী না হয়ে দুআ করা।
ঢ- আল্লাহর সঠিক নাম ও গুণ ব্যতিরেকে অন্য নাম ধরে ও গুণ বর্ণনা করে প্রার্থনা।
ণ- যা বান্দার জন্য উপযুক্ত নয় তা চাওয়া; যেমন, নবী বা ফিরিশতা হতে চাওয়া।
ত- অপ্রয়োজনীয় লম্বা দুআ করা। (একই দুআ দু-তিন ভাষায় বলা।)
থ- কষ্ট-কল্পনার সাথে ছন্দ বানিয়ে দুআ করা।
দ- অকান্নায় ইচ্ছাকৃত হাে হাে করে উচ্চ শব্দে দুআ করা।
ধ- নিয়মিত এমন প্রকার, এমন রূপে এবং এমন স্থান ও কালে দুআ করা যা কিতাব ও সুন্নাহতে প্রমাণিত নয়।
ন- গানের মত লম্বা সূর-ললিত কণ্ঠে দুআ করা। (মাজাল্লাতুল বায়ান ৭৩ সংখ্যা ১৯৯৪ খ্রিঃ ১২০- ১২৮ পঃদ্রষ্টব্য)
২৩। কোন পাপ কাজ করার উদ্দেশ্যে অথবা জ্ঞাতিবন্ধন ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে দুআ না করা।
২৪। সর্বপ্রকার গোনাহ থেকে দূরে থেকে দুআ করা।
২৫। সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দেওয়া।
২৬৷ যে সময় স্থান ও অবস্থাকালে দুআ কবুল হয়, সে সময়াদিতে দুআ করার সুযােগ গ্রহণ করা।
২৭। ছােট না চেয়ে বড় কিছু চাওয়া। মুসলিম ২৬৭৯)
২৮। এমন কিছু না চাওয়া, যা সহ্য করার ক্ষমতা নেই। যেমন, আখেরাতের আযাব দুনিয়াতেই না চাওয়া। (ঐ ২৬৮৮)
দুঃখ-কষ্ট চেয়ে ধৈর্য প্রার্থনা না করে সরাসরি দুঃখ-কষ্ট থেকে পানাহ চাওয়া উচিত। তাই এমন প্রার্থনা করা বৈধ নয় -
দুঃখ যদি দিও প্রভু, শক্তি দিও সহিবারে।
বিপদে মােরে রক্ষা করো এ নহে মাের প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়,
দুঃখ তাপে ব্যথিত চিতে নাইবা দিলে সান্ত্বনা
দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।
সহায় মাের না যদি জুটে, নিজের বল না যেন টুটে
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি লভিলে শুধু বঞ্চনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।
নিম্নলিখিত সময়, স্থান ও অবস্থায় দুআ কবুল করা হয় বলে হাদীস-সূত্রে জানতে পারা যায়ঃ
শবেকদরে, রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশে, ফরয নামাযের পশ্চাতে (সালাম ফিরার পূর্বে), আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তীকালে, ইকামত হলে, রাত্রের কোন এক মুহূর্তে, জুমআর রাত্রি-দিনের কোন এক মুহুর্তে, ফরয নামাযের জন্য আযান দেওয়ার সময়, বৃষ্টি বর্ষণের সময়, জিহাদে হানাহানি চলা কালে, সত্য নিয়তে ও দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে যমযম পানি পান করার সময়, সিজদারত অবস্থায়, রাত্রি কালে ঘুম থেকে জেগে লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু অহদাহু লা শারীকা লাহু লাহুল মুলকু অলাহুল হামদু অহুয়া আলা কুল্লি শাইইন কাদীর। আল হামদু লিল্লা-হ, সুবহা-নাল্লাহ, অলা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হ, অল্লা-হু আকবার, অলা হাওলা অলা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লা-হ’ বলে দুআ করার সময়, ওযু করে ঘুমিয়ে রাত্রে জেগে দুআ করার সময়, ইসমে আযম দ্বারা দুআ করার সময়, কারো মৃত্যুর পর, শেষ তাশাহহুদে আল্লাহর প্রশংসা করে ও নবী (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করে দুআ করার সময়, কারো অনুপস্থিতিতে তার জন্য কেউ দুআ করার সময়, রমযান মাসে, যিকরের মজলিসে, বিপদের সময়, ‘ইন্না লিল্লাহ------ আল্লাহুম্মা’জুরনী-----’ পড়ার সময়, নির্মল ইখলাস ও আল্লাহর প্রতি হৃদয়ের পরম ভক্তি ও চরম আগ্রহের সময়, অত্যাচারিত অত্যাচারীর উপর বদুআ করলে, পিতামাতা পুত্রের জন্য দুআ অথবা বন্দুআ করলে, মুসাফির দুআ করলে, রোযাদার। দুআ করলে, আর্তব্যক্তি দুআ করলে, ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ দুআ করলে, কাবাঘরের ভিতরে, সাফার উপর, মারওয়ার উপর, আরাফার দিনে আরাফার ময়দানে, মাশআরুল হারামের নিকট, মিনায় ছােট ও মধ্যম জামরায় পাথর মারার পর, ইস্তিফতাহে নির্দিষ্ট দুআ পাঠ করলে, সূরা ফাতেহা পাঠ করার সময় ও শেষে আমীন বলার সময়, রুকু থেকে মাথা তুলে ইত্যাদি। (আদ দুআ মিনাল কিতাবি অস্ সুন্নাহ ১০-১৫)
১। অনেকে দুআ করে, কিন্তু তাদের দুআ কবুল হয় না, চায় অথচ পায় না। এর কতকগুলি কারণ আছে, যেমন; শীঘ্রতা করা। দুআ করার পরই যে মঞ্জুর হবে তা জরুরী নয়। যেমন আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “তোমাদের কারো দুআ কবুল করা হয়, যতক্ষণ না সে তাড়াতাড়ি করে। বলে, ‘দুআ করলাম অথচ কবুল হল না।” (বুখারী ১১/১৪০, মুসলিম ৪/ ২০৯৫)।
২। সৃষ্টিকর্তা সর্বজ্ঞ আল্লাহ তাআলার হিকমত।
বান্দা দুআতে যা চায়, তা তার জন্য মঙ্গলদায়ক কি না, তা সে সঠিক জানে না। কিন্তু আল্লাহ পাক সব কিছু জানেন, বান্দা যা চাচ্ছে, তা তার জন্য কল্যাণকর বটে কি না, তা বর্তমানেই তার জন্য ফলপ্রসু, নাকি কিছুদিন বা দীর্ঘদিন পর? অথবা যা চাচ্ছে, তা তার জন্য যথােপযুক্ত নয়। বরং অন্য কিছু তার জন্য অধিক লাভদায়ক। অথবা কল্যাণ আসার চেয়ে আসন্ন বিপদ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া তার জন্য ভালো। তাই আল্লাহ বান্দার জন্য যা করেন, তা তার মঙ্গলের জন্যই করেন। বান্দার আসল মঙ্গলের প্রতি খেয়াল রেখে কখনো দুআ কবুল হয়, কখনো কবুল হয় না। তা বলে তার দুআ করাটা বৃথানষ্ট হয়ে যায় না। প্রিয় নবী সু বলেন, “কোন মুসলিম যখন আল্লাহর নিকট এমন দুআ করে, যাতে পাপ ও তিবন্ধন ছিন্নতা নেই, তখন আল্লাহ তাকে তিনটের একটা দান করে। থাকেন; সত্বর তার দুআ মঞ্জুর করা হয় অথবা পরকালের জন্য তা জমা রাখা হয়। অথবা অনুরূপ কোন অকল্যাণকে তার জীবন হতে দুর করা হয়।” লোকেরা বলল, তাহলে আমরা অধিক অধিক দুআ করব।' তিনি বললেন, “আল্লাহও অধিক দানশীল।” (আহমদ ৩/১৮, হাকেম ১৪৯৩ যদুল মাসীর ১/১৯০)
৩। কোন পাপ বা জ্ঞাতিবন্ধন ছিন্ন করার দুআ করলে তা কবুল হয় না। পাপের দুআ যেমন, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ে উন্নতির জন্য দুআ, চোরের চুরি করতে ধরা না পড়ার দুআ ইত্যাদি।
৪। হারাম পানাহার ও পরিধান করা।
৫৷ দুআয় দৃঢ়চিত্ত না হওয়া এবং আল্লাহর ইচ্ছায় ‘যদি যােগ করা। যেহেতু আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু নেই। যেমন দুআর আদবে আলোচিত হয়েছে।
৬। সৎকাজের আদেশ এবং অসৎকাজে বাধা দান ত্যাগ করা। মানুষ নিজে ভালো হলেই যথেষ্ট নয়। অপরকে ভালো করার চেষ্টা করাও তার সর্বাঙ্গীন ভালো হওয়ার পরিপূরক। তাই সর্বাঙ্গসুন্দর ভালো লোক হতে চাইলে সামর্থ্যানুযায়ী সৎকাজের আদেশ দিতে হবে এবং সম্মুখে বা জানতে কোন পাপকাজ ঘটলে, তাতে সাধ্যানুক্রমে (হাত দ্বারা, না পারলে মুখ দ্বারা) বাধা দিতে হবে। তাও না পারলে, অন্তর দ্বারা ঘৃণা করতে হবে। নচেৎ শাস্তিতে সেও তাদের দলভুক্ত হবে, আর তার দুআও মঞ্জুর হবে না। (বুখারী ১১/১৩৯, ৪/২০৬৩)
৭। কিছু পাপ বা নির্দিষ্ট অবাধ্যাচরণে লিপ্ত থাকা। যার অবাধ্যাচরণ করা হয় ও যার কথার অন্যথাচরণ করা হয় তার নিকট প্রার্থনা করে কিছু পাওয়ার আশা সব সময় করা যায় না। এ ব্যাপারে রসূল (ﷺ) এর একটি ইঙ্গিত, তিনি বলেন, “তিন ব্যক্তি দুআ করে অথচ তাদের দুআ মঞ্জুর করা হয় না; (১) যে ব্যক্তির বিবাহ-বন্ধনে কোন দুশ্চরিত্রা স্ত্রী থাকে অথচ তাকে তালাক দেয় না, (২) এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির নিকট মালের অধিকারী থাকে অথচ তার উপর সাক্ষী রাখে না, (৩) যে ব্যক্তি নির্বোধকে তার সম্পদ দান করে অথচ আল্লাহ পাক বলেন, “আর তোমাদের সম্পদ নির্বোধদের হাতে অর্পণ করো না---” (কুঃ ৪/৫; হাকেম ২/৩০২)
৮৷ ঔদাস্য, কুপ্রবৃত্তি ও খেয়াল-খুশীর বশবর্তী থাকা এবং মিনতি, ভক্তি, আশা ও ভীতির অভাব থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন, “আল্লাহ অবশ্যই কোন সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরাই পরিবর্তন না করে।” (কুঃ ১৩/১১)
আর রসুল (ﷺ) বলেন, যা পুর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, জেনে রাখ যে, আল্লাহ উদাসীন ও অমনোযােগী হৃদয় থেকে দুআ মঞ্জুর করেন না।
দুআ কবুল হওয়ার কারণসমূহ
পূর্বের আলোচনা হতে কি কি কারণে দুআ মঞ্জুর হয়, তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। যেমন হালাল খাওয়া-পরা, দুআর ফললাভের জন্য তাড়াতাড়ি না করা, পাপ ও জ্ঞাতিবন্ধন ছিন্নের দুআ না করা এবং গোনাহ থেকে দূরে থেকে বিশুদ্ধচিত্তে আল্লাহরই নিকট দুআ করা ইত্যাদি। (আয যিকরু আদ্দুয়া দ্রষ্টব্য)।
দুআ কবুলের এক শর্ত হল বিশুদ্ধ ঈমান। তাই কাফের বা মুশরিকের দুআ বা বদুআ কবুল নয়। অবশ্য কাফের যদি মুসলিমের হক্কে দুআ করে তবে তাতে ‘আমীন’ বলা বৈধ। কারণ মুসলিমের হক্কে কাফেরের দুআও কবুল হয়ে থাকে। (সিঃ সহীহাহ ৬/৪৯৩)।
দুআ ও যিকরকারী মুসলিমদের জন্য একটি সতর্কতার বিষয় এই যে, কেউ যেন দুআ ও যিকর করতে গিয়ে বিদআত করে না বসে। দুআ বা যিকর কেবল তাই করা উচিত, যা আল্লাহ ও তার রসূল (ﷺ) শিক্ষা দিয়েছেন। অথবা কোন সাহাবী তার জীবনে তা আমল করে গেছেন। যা কিতাব ও সহীহ (ও হাসান) সুন্নাহতে অথবা কোন সাহাবার আমলে প্রমাণিত। যেহেতু সহীহ হাদীসের উপর আমলই মুসলিমদের জন্য যথেষ্ট। অন্যথা জাল ও দুর্বল হাদীস অথবা কোন আলেমের মনগড়া কল্পিত আরবী বাক্য দ্বারা যিকর বা দুআ বিদআত হবে। যেমন যদি কোন অনির্দিষ্ট দুআ বা যিকর কোন স্থান, সময়, নিয়ম, গুণ, সংখ্যা বা কারণ ইত্যাদি দ্বারা নির্দিষ্ট করে নেওয়া হয়, তাহলে তাও বিদআতরূপে পরিগণিত হবে। তাই সাধারণ ক্ষেত্রে ও নিজের প্রয়োজনের সময় দুআ করতেও কুরআনী দুআ, শুদ্ধ হাদীসে বর্ণিত দুআয়ে-রসূল অথবা শুদ্ধ প্রমাণিত কোন সাহাবার দুআ বেছে নেওয়া উচিত। কোন দুআ না পেলে হাম্দ ও দরূদ পড়ে নিজের ভাষার নিজের প্রয়োজন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা চলে।
পক্ষান্তরে রসূল (ﷺ) যে স্থানে বা সময়ে দুআ করতে নির্দেশ দিয়েছেন বা নিজে দুআ করেছেন সেই দুআর সেই নিয়ম ও পদ্ধতি সকলের ক্ষেত্রে মান্য হবে। যেমন ইস্তিসকায়, আরাফায়, সাফা মারওয়ার উপর, ছােট ও মধ্যম জামরায় পাথর মারার পর, কুনুতে, কেউ দুআ করতে আবেদন করলে তার জন্য (কখনো কখনো) হাত তুলে দুআ করছেন। এসব ক্ষেত্রে হাত তুলে দুআ করা হবে। নামাযের পর দুআ বা যিকর। করেছেন বা করতে নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু হাত তুলেননি বা তুলতে নির্দেশ দেননি, দাফনের পর দুআ করতে নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু হাত তুলতে বলেননি বা নিজেও হাত তুলে ওখানে দুআ করেননি, বর-কনের জন্য দুআ করেছেন, কিন্তু হাত তুলেননি। তাই এ সব ক্ষেত্রে এবং যেখানে তার আদর্শ বর্তমান রয়েছে, সেখানে হাত তোলা দুআর আদব বলে আমরা হাত তুলতে পারি না। তাই তো জুমআর খুতবায় দুআ বিধেয় হলেও, হাত তুলে বিদআত। মাসরুক বলেন, ‘(জুমআর দিন ইমামমুক্তাদী মিলে যারা হাত তুলে দুআ করে) আল্লাহ তাদের হাত কেটে নিক।” (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ ৫৪৯১ ও ৫৪৯৩ নং)
অনুরূপ কারণে জামাআত থাকতেও আল্লাহর রসূল (ﷺ) যেখানে জামাআতী দুআ করেননি বা কোন সাহাবাও করেননি, সেখানে আমরাও জামাআত করে দুআ করতে পারি না। তিনি যেমন করেছেন বা নির্দেশ দিয়েছেন, সাহাবায়ে কেরাম ঐ সব ক্ষেত্রে যেমন করেছেন, তেমনটাই করা আমাদের কর্তব্য। অনুসরণে আমাদের কল্যাণ এবং নতুনভাবে কিছু করাতেই বিপদ আছে। | আসুন, আমরা আগামীতে দেখি, আমাদের আদর্শ রসূল সু কোথায়, কোন সময়ে, কিভাবে, কতবার, কি দুআ বা যিক পড়েছেন বা পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং সেই মতই আমল করি। যেগুলি প্রার্থনার সাধারণ দুআ সেগুলি আমাদের প্রয়োজন মত সময়ে অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে বেছে নিয়ে প্রার্থনা করি।