লগইন করুন
সাধারণভাবে দুআ করার কয়েকটি আদব ও নিয়ম রয়েছে, যা পালন করা বাঞ্ছনীয়, ১। ইখলাস বা একনিষ্ঠতা। এটি সর্বাপেক্ষা বড় আদব। আল্লাহ পাক বলেন,
“সুতরাং আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ-চিত্ত হয়ে তাকে ডাক, যদিও কাফেরগণ এ অপছন্দ করে।” (কুঃ ৪০/১৪)
“তারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধ-চিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে কেবল তারই উপাসনা করতে----।” (সূরা বাইয়্যিনাহ ৫ আয়াত)
২। দৃঢ়তার সাথে প্রার্থনা ও দুআ করা এবং আল্লাহ মঞ্জুর করবেন এই কথার উপর দৃঢ় প্রত্যয় রাখা। রসুল (ﷺ) বলেন, “তোমাদের মধ্যে কেউ যেন না বলে, হে আল্লাহ! যদি তুমি চাও, তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দাও। হে আল্লাহ! যদি তুমি চাও, তাহলে আমাকে দয়া কর। বরং দৃঢ় নিশ্চিত হয়ে প্রার্থনা করা উচিত। যেহেতু আল্লাহকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ বাধ্য করতে পারে না।” (বুখারী ১১/১৩৯, মুসলিম ৪/২০৬৩)।
৩ আগ্রহাতিশয্যে নাছােড় বান্দা হয়ে বার-বার দুআ করা, দুআর ফল লাভে শীঘ্রতা না করা এবং অন্তরকে উপস্থিত রেখে প্রার্থনা করা।
রসুল (ﷺ) বলেন, “তোমাদের কারো দুআ কবুল করা হয়, যতক্ষণ না সে তাড়াতাড়ি করে। বলে, ‘দুআ করলাম কিন্তু কবুল হল না।” (বুখারী ১১/১৪০, মুসলিম ৪/২০৯৫)
“বান্দার দুআ কবুল হয়েই থাকে, যতক্ষণ সে কোন পাপের অথবা জ্ঞাতিবন্ধন টুটার জন্য দুআ না করে এবং (দুআর ফল লাভে) শীঘ্র না করে।” জিজ্ঞাসা করা হল, “হে আল্লাহর রসূল! শীঘ্রতা কেমন?’ বললেন, “এই বলা যে, দুআ করলাম, আরো দুআ করলাম। অথচ কবুল হতে দেখলাম না। ফলে সে তখন আক্ষেপ করে এবং দুআ করাই ত্যাগ করে বসে।” (মুসলিম ৪/২০৯৬)
“তোমরা আল্লাহর নিকট দুআ কর কবুল হবে এই দৃঢ় প্রত্যয় রেখে। আর জেনে রেখাে যে, আল্লাহ উদাসীন ও অন্যমনস্কের হৃদয় থেকে দুআ মঞ্জুর করেন না।” (তিরমিযী ৫/৫১৭)
মােট কথা দুআ করার সময় মনকে সজাগ রাখতে হবে, তার দুআ কবুল হবে --এই একীন রাখতে হবে এবং কি চাইছে তাও জানতে হবে।
সুতরাং যারা অভ্যাসগতভাবে দুআ করে থাকে অথবা দুআয় কি চায়, তা তারা নিজেই না জেনে তোতার বুলি আওড়ানোর মত আরবীতে দুআ আওড়ে থাকে, তাদের দুআ মঞ্জুর হবে কি?
৪। সুখে-দুঃখে ও নিরাপদে-বিপদে সর্বদা প্রার্থনা করা।
আল্লাহর রসুল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, দুঃখে ও বিপদে আল্লাহ তার দুআ কবুল করবেন, সেই ব্যক্তির উচিত, সুখে ও স্বাচ্ছন্দ্যে অধিক অধিক দুআ করা।” (তিরমিযী ৫/৪৬২)
৫। নিজের পরিবার ও সম্পদের উপর বদদুআ না করা। আনসারদের এক ব্যক্তি সেচক উট চলতে চলতে থেমে গেলে ধমক দিয়ে বলল, ‘চল, আল্লাহ তোকে অভিশাপ করুক। তা শুনে আল্লাহর রসূল (ﷺ) বললেন, “কে তার উটকে অভিশাপ দিচ্ছে?” লোকটি বলল, আমি, হে আল্লাহর রসূল! তিনি বললেন, “নেমে যাও ওর পিঠ থেকে, অভিশপ্ত উট নিয়ে আমাদের সঙ্গে এসাে না। তোমরা তোমাদের নিজেদের উপর বদদুআ করো না, তোমাদের সন্তানদের উপর বদ্দুআ করো না, আর তোমাদের সম্পদের উপরও বদুআ করো না। যাতে আল্লাহর তরফ থেকে এমন মুহূর্তের সমন্বয় না হয়ে যায়, যে মুহূর্তে দান চাওয়া হলে মঞ্জুর (প্রদান) করা হয়।” (মুসলিম ৪/২৩০৪)
৬। কেবল আল্লাহরই নিকট প্রার্থনা করা।
আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “যখন কিছু চাইবে, তখন আল্লাহর নিকটই চাও। যখন সাহায্য চাইবে, তখন আল্লাহর নিকটেই চাও।” (তিরমিযী ৪/৬৬৭, মুসলিম ১/২৯৩)
যেহেতু প্রার্থনা এক ইবাদত। অন্যের কাছে প্রার্থনা করলে আল্লাহর ইবাদতে শির্ক করা হয়।
৭। উচ্চ ও নিঃশব্দের মধ্যবর্তী চাপা স্বরে সংগোপনে প্রার্থনা করা। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাক। তিনি সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” (সূরা আরাফ ৫৫ আয়াত)
আবু মূসা (রাঃ) বলেন, আমরা কোন সফরে নবী (ﷺ) এর সাথে ছিলাম। লোকেরা জোরে-শােরে তকবীর পড়তে শুরু করল। তখন নবী (ﷺ) বললেন, “হে লোক সকল! নিজেদের উপর কৃপা কর। নিশ্চয় তোমরা কোন বধির অথবা কোন দুরবর্তী) অনুপস্থিতকে আহ্বান করছে না। বরং তোমরা সর্বশ্রোতা নিকটবর্তীকে আহ্বান করছ। তিনি (তার ইলমসহ) তোমাদের সঙ্গে আছেন।” (বুখারী ৫/৭৫, মুসলিম ৪/২০৭৬)
৮। আল্লাহর সুন্দরতম নাম এবং মহত্তম গুণাবলীর অসীলায় অথবা কোন নেক আমলের অসীলায় দুআ করা। আর এ ছাড়া কোন সৃষ্টি (যেমন, নবী, ওলী, আরশ, কুর্সী প্রভৃতির) অসীলা ধরে দুআনা করা। যেমনঃ (رَبَّنَا إِنَّنَا آمَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ) অর্থঃ হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয় আমরা ঈমান এনেছি, অতএব আমাদের অপরাধসমূহ মার্জনা কর এবং জাহান্নামের শাস্তি হতে আমাদেরকে রক্ষা কর।” (সূরা আলে ইমরান ১৬ আয়াত)
৯। আল্লাহ তাআলার ইসমে আযম দিয়ে দুআ শুরু করলে তিনি তা কবুল করেন। এই ইসমে আযম দ্বারা দুআ করার বর্ণনা হাদীস শরীফে কয়েকরকম এসেছে;
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنِّي أَشْهَدُ أَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ، الأَحَدُ الصَّمَدُ، الَّذِي لَمْ يَلِدْ، وَلَمْ يُولَدْ، وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
উচ্চারণ : আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা বিআন্নী আশহাদু আন্নাকা আন্তাল্লা-হ, লা ইলা-হা ইল্লা আন্তাল আহাদুস সামাদুল্লাযী লাম ইয়ালিদ অলাম ইউলাদ, অলাম য়্যাকুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ।
অর্থঃ- আমি সাক্ষি দিচ্ছি যে, তুমি আল্লাহ, তুমি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তুমি একক, ভরসাস্থল, যিনি জনক নন জাতকও নন এবং যার সমকক্ষ কেউ নেই এই অসীলায় আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি। (আবু দাউদ ১৪৯৩, তিরমিযী ৩৪৭৫, ইবনে মাজাহ ৩৮৫৭, আহমাদ, হাকেম, ইবনে হিব্বান)
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ يَا أَللَّهُ بِأَنَّكَ الْوَاحِدُ الْأَحَدُ، الصَّمَدُ، الَّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ، وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ، أَنْ تَغْفِرَ لِي ذُنُوبِي، إِنَّكَ أَنْتَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
উচ্চারণঃ- আল্লাহুম্মা ইন্নী আসআলুকা ইয়া-ল্লা-হু বিআন্নাকাল ওয়াহিদুল আহাদুস স্বামাদুল্লাহী লাম ইয়ালিদ অলাম ইউলাদ অলাম ইয়াকুল্লাহু কুফুওয়ান আহাদ, আন তাগফিরা লী যুনুবী, ইন্নাকা আন্তাল গাফুরুর রাহীম।
অর্থ- হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি, হে এক, একক, ভরসাস্থল আল্লাহ! যিনি জনক নন জাতকও নন এবং যার সমকক্ষ কেউ নেই, তুমি আমার গোনাহসমূহকে ক্ষমা করে দাও, নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল দয়াবান।” (সহীহ নাসাঈ ১২৩৪।
اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنَّ لَكَ الْحَمْدَ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ الْمَنَّانُ يَا بَدِيعَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَا ذَا الْجَلَالِ وَالْإِكْرَامِ يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ
উচ্চারণঃ- আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকা বিআন্না লাকাল হামদ, লা ইলা-হা ইল্লা আন্তাল মান্নানু বাদীউস সামাওয়াতি অল আরয্ব, ইয়া যাল জালালি অল ইকরাম, ইয়্যা হাইয়্যু ইয়া কায়্যুম।”
অর্থঃ- হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি এই অসীলায় যে, সমস্ত প্রশংসা তোমারই, তুমি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তুমি পরম অনুগ্ৰহদাতা, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর আবিষ্কর্তা, হে মহিমময় এবং মহানুভব, হে চিরঞ্জীব অবিনশ্বর।” (আবু দাউদ ১৪৯৫, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবন মাজাহ ৩৮ ৫৮, আহমাদ, হবে ইবন হিব্বান)।
لا إِلَهَ إِلا أَنتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ الظَّالِمِينَ
অর্থঃ- তুমি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই, তুমি পবিত্র মহান! অবশ্যই আমি সীমালংঘনকারী। (সূরা আম্বিয়া ৮৭ আয়াত)
১০। আল্লাহর প্রশংসা (হামদ ও সানা) দিয়ে অতঃপর নবী (ﷺ)-এর উপর দরূদ পাঠ করে দুআশুরু করা এবং অনুরূপ শেষ করা।
রসূল (ﷺ) বলেন, “যখন তোমাদের কেউ দুআ করবে, তখন তার উচিত আল্লাহর হামদ ও সানা দিয়ে শুরু করা, অতঃপর নবীর উপর দরূদ পড়া, অতঃপর ইচ্ছামত দুআ করা।” (আবু দাউদ ২/৭৭, তিরমিযী ৫/৫১৬, নাসাঈ ৩/৪৪)।
১১৷ কাকুতি-মিনতি, বিনয়, আশা, আগ্রহ, মুখাপেক্ষিতা ও ভীতির সাথে দুআ করা। একান্ত ‘ফকীর’ হয়ে আল্লাহর দরবারে অক্ষমতা, সঙ্কীর্ণতা ও দুরবস্থার অভিযােগ করা। যেভাবে আয়্যুব নবী ব্যাধিগ্রস্ত হলে, যাকারিয়া নবী নিঃসন্তান হলে, ইউনুস নবী মাছের পেটে গেলে আল্লাহর কাছে দুআ করেছিলেন।
মহান আল্লাহ বলেন, “তোমার প্রতিপালককে মনে মনে সবিনয় ও সশঙ্কচিত্তে অনুচ্চ স্বরে প্রত্যুষে ও সন্ধ্যায় স্মরণ কর এবং উদাসীনদের দলভুক্ত হয়ো না।” (সূরা আ’কফ ২০৫
“তারা সৎ কাজে প্রতিযােগিতা করত, আশা ও ভীতির সাথে আমাকে ডাকত এবং তারা ছিল আমার নিকট বিনীত।” (সূরা আম্বিয়া ৯০ আয়াত)
বান্দার যতই সুখ থাক, স্বাচ্ছন্দ্যের সাগরে ডুবে থাকলেও সে সর্বদা আল্লাহর রহমতের ভিখারী ও মুখাপেক্ষী। মিসকিন বান্দার যা আছে তা কাল চলে যেতে পারে। সব আছে বা সব পেয়েছি বলে দুআ বন্ধ করা মূর্খতা। সব কিছু থাকলেও যা আছে তা যাতে চলে না যায়, তার জন্যও দুআ করতে হবে। তাছাড়া পরজীবনের কথা তার অজানা। পরকালে সুখ পাবে কি না সে বিষয়ে সে নিশ্চিত নয়। অতএব পরকালের সুখও তাকে চেয়ে নিতে হবে এবং সে প্রার্থনা হবে অনুনয়-বিনয় সহকারে; ঔদ্ধত্যের সাথে নয়।
১২। নিজের অপরাধ ও আল্লাহর অনুগ্রহকে স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন-পূর্বক দুআ করা। এ বিষয়ে 'সাইয়েদুল ইস্তিগফার' দুআ ইস্তিগফারের অনুচ্ছেদে আসবে।
১৩। কষ্ট-কল্পনার সাথে ছন্দ বানিয়ে দুআ না করা। এ বিষয়ে ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, প্রত্যেক জুমআহ (সপ্তাহে) লোকদেরকে মাত্র একবার ওয়ায কর। যদি না মানো তবে দুইবার। তাও যদি না মানে তবে তিনবার। লোকেদেরকে এই কুরআনের উপর বিরক্ত করো না। আর আমি যেন তোমাকে না (দেখতে) পাই যে, কোন সম্প্রদায় তাদের নিজেদের কোন কথায় ব্যাপৃত থাকলে তুমি তাদের নিকট গিয়ে নিজের বয়ান শুরু করে দাও এবং তাদের কথা কেটে তাদেরকে বিরক্ত কর। বরং তুমি সেখানে উপস্থিত হয়ে চুপ থাক; অতঃপর তারা সাগ্রহে আদেশ করলে তুমি বয়ান কর। খেয়াল করে ছন্দযুক্ত দুআ থেকে দুরে থাক। যেহেতু আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তার সাহাবাবর্গের নিকট উপলব্ধি করেছি যে, তারা এটাই করতেন। অর্থাৎ, ছন্দ বানিয়ে দুআ উপেক্ষা করতেন।” (বুখারী ৭/১৫৩)
১৪ তওবা করে (অর্থাৎ বিশুদ্ধ চিত্তে, পাপ বর্জন করে, লজ্জিত হয়ে, পুনঃ ঐ পাপে না ফিরার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে এবং অন্যায়ভাবে কারো মাল হরফ করে থাকলে তা ফেরৎ দিয়ে ও কারো প্রতি জুলুম করে থাকলে তার প্রতিশােধ দিয়ে অথবা ক্ষমা চেয়ে তারপর) দুআ করা। যেহেতু পাপে লিপ্ত থাকলে দুআ কবুল হয় না।
১৫৷ হালাল পানাহার করা এবং হালাল পরিধান করা। এ বিষয়ে আল্লাহর রসূল (ﷺ) বলেন, “হে লোক সকল! আল্লাহ পবিত্র তিনি পবিত্র জিনিসই গ্রহণ করেন। নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদেরকে সেই আদেশই করেছেন যে আদেশ রসূলগণকে করেছেন, তিনি বলেন, “হে রসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু আহার কর ও সৎকাজ কর, তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবহিত।” (কুঃ ২৩/৫১)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন, যার অর্থ, “হে মুমিনগণ! আমি তোমাদেরকে যা দান করেছি তা থেকে পবিত্র বস্তু আহার কর---।” (সূরা বাকারাহ ১৭২)
অতঃপর রসূল সেই ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, যে ব্যক্তি ধুলোধূসরিত আলুথালু বেশে (সৎকাজের উদ্দেশ্যে) সফর করে। তার হাত দুটিকে আকাশের দিকে তুলে, ‘হে প্রভু! হে আমার প্রতিপালক!’ বলে (দুআ করে), কিন্তু তার আহার্য হারাম, তার পরিধেয় হারাম এবং হারাম খাদ্যে সে প্রতিপালিত হয়েছে। সুতরাং কেমন করে তার প্রার্থনা মঞ্জুর হবে? (মুসলিম ৪৭০৩)
১৬। খুব গুরুত্বপূর্ণ দুআ হলে ফিরিয়ে ফিরিয়ে ৩ বার করে বলা। যেমন আল্লাহর রসুল (ﷺ) যখন কুরাইশের উপর বদুআ করেছিলেন, তখন ৩ বার করে বলেছিলেন। (বুখারী ৪/৬৫, মুসলিম ৩/১৪১৮)
১৭৷ দুআর পূর্বে ওযু করা। অবশ্য প্রত্যেক দুআ বা যিকরের জন্য ওযু বা গোসল করা জরুরী নয়। তবে সাধারণ প্রার্থনার জন্য মুস্তাহাব। (বুখারী ৫/১০১, মুসলিম ৪/১৯৪৩)
১৮৷ কেবলা-মুখ হয়ে দুআ করা। এ আদবটিও সকল দুআর ক্ষেত্রে জরুরী নয়।
১৯। মুখ বরাবর দুই হাত তুলে দুআ করা। এ আদবটিও সেখানে ব্যবহৃত, যেখানে আল্লাহর রসুলের নির্দেশ আছে। অথবা যেখানে কোন নির্দেশ নেই সেখানে সাধারণ প্রার্থনার ক্ষেত্রে এ আদবের খেয়াল রাখা উচিত। কিন্তু হাত তুলে দুআর শেষে মুখে হাত বুলানো প্রসঙ্গে কোন সহীহ হাদীস নেই। তাই মুখে হাত বুলানো বিদআত। প্রকাশ থাকে যে, ইস্তিগফার করার সময় একটি আঙ্গুল তুলে ইশারা করে এবং সকাতর প্রার্থনার সময় দুই হাত মাথা বরাবর লম্বা করে তুলে দুআ করতে হয়। (আবু দাউদ, সহীহুল জামে’ ৬৬৯৪নং)
২০। অশ্রু বিসর্জনের সাথে দুআ করা। (মুসলিম ১/১৯১) ২১।
২১। অপরের জন্য দুআ করলে নিজের জন্য প্রথমে দুআ শুরু করা। যেমন নবী (ﷺ) কারোর জন্য দুআ করলে নিজের জন্য প্রথম শুরু করতেন। (তিরমিযী ৫/৪৬৩)
২২। দুআয় সীমালংঘন ও অতিরঞ্জন না করা। যেমন, হে আল্লাহ! আমি জান্নাতের সম্পদ, সৌন্দর্য, হুর-গেলমান, দুধের নহর---চাই। হে আল্লাহ! আমি জাহান্নামের আগুন থেকে, তার শিকল ও বেড়ি থেকে, ফুটন্ত পানি ও পুঁজ থেকে পানাহ চাই---' হে আল্লাহ! আমি জান্নাতের ডান দিকে সাদা মহল চাই-- ইত্যাদি বলে দুআ করা বৈধ নয়। এখানে সংক্ষিপ্তভাবে জাহান্নাম থেকে রেহাই পেতে এবং জান্নাতে প্রবেশ করতে চাওয়াই যথেষ্ট। তাই তো সেই দুআ করা উচিত, যার শব্দ কম অথচ অর্থ অনেক ব্যাপক। (আবু দাউদ ১/২৪, ২/৭৭)
আল্লাহ তাআলা বলেন, (ادْعُوا رَبَّكُمْ تَضَرُّعًا وَخُفْيَةً إِنَّهُ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ)
অর্থাৎ, তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালককে ডাক, তিনি সীমালংঘনকারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা আরাফ ৫৫ আয়াত)
সহীহ দুআ ও যিকর দুআতে প্রায় ২০ প্রকার সীমালংঘন হতে পারে;
ক- শির্কমূলক দুআ করা।
খ- শরীয়ত যা হবে বলে, তা না হতে দুআ করা; যেমন বলা যে, আল্লাহ! তুমি কিয়ামত কায়েম করো না, কাফেরকে আযাব দিয়ো না।
গ- শরীয়ত যা হবে না বলে, তা হতে দুআ করা; যেমন বলা যে, আল্লাহ! তুমি কাফেরকে বেহেস্ত দান কর, আমাকে দুনিয়ায় চিরস্থায়ী কর, আমাকে গায়েবী ইলম দাও বা আমাকে নিস্পাপ কর’ ইত্যাদি।
ঘ- জ্ঞান ও বিবেকে যা হওয়া সম্ভব, তা না হতে দুআ করা।
ঙ- জ্ঞান ও বিবেকে যা হওয়া অসম্ভব তা হওয়ার জন্য প্রার্থনা করা; যেমন, আল্লাহ! আমি যেন একই সময় দুই স্থানে উপস্থিত ও প্রকাশ হতে পারি ইত্যাদি।
চ- সাধারণতঃ যা ঘটা অসম্ভব তা ঘটতে প্রার্থনা করা। যেমন, আল্লাহ! আমাকে এমন মুরগী দাও, যে সােনার ডিম পাড়ে, আমাকে যেন পানাহার করতে না হয়’ ইত্যাদি।
ছ- শরীয়তে হবে না বলে শ্রুত, পুনরায় তা না হতে প্রার্থনা করা; যেমন, আল্লাহ! তুমি কাফেরদেরকে জান্নাত দিও না ইত্যাদি।
জ – শরীয়তে হবে বলে শ্রুত, পুনরায় তা হতে দুআ করা।
ঝ - প্রার্থিত বিষয়কে আল্লাহর ইচ্ছায় লটকে দেওয়া; যেমন, হে আল্লাহ! তুমি যদি চাও তাহলে আমাকে ক্ষমা কর ইত্যাদি।
ঞ- অন্যায়ভাবে কারো উপর বদদুআ করা।
ট- কোন হারাম বিষয় প্রার্থনা করা; যেমন, আমি যেন ব্যভিচার করতে বা চুরি করতে পারি বা তাতে ধরা না পড়ি।
ঠ- প্রয়োজনের অধিক উচ্চ স্বরে দুআ করা।
ড- অবিনীতভাবে আল্লাহর অনুগ্রহের মুক্ষাপেক্ষী না হয়ে দুআ করা।
ঢ- আল্লাহর সঠিক নাম ও গুণ ব্যতিরেকে অন্য নাম ধরে ও গুণ বর্ণনা করে প্রার্থনা।
ণ- যা বান্দার জন্য উপযুক্ত নয় তা চাওয়া; যেমন, নবী বা ফিরিশতা হতে চাওয়া।
ত- অপ্রয়োজনীয় লম্বা দুআ করা। (একই দুআ দু-তিন ভাষায় বলা।)
থ- কষ্ট-কল্পনার সাথে ছন্দ বানিয়ে দুআ করা।
দ- অকান্নায় ইচ্ছাকৃত হাে হাে করে উচ্চ শব্দে দুআ করা।
ধ- নিয়মিত এমন প্রকার, এমন রূপে এবং এমন স্থান ও কালে দুআ করা যা কিতাব ও সুন্নাহতে প্রমাণিত নয়।
ন- গানের মত লম্বা সূর-ললিত কণ্ঠে দুআ করা। (মাজাল্লাতুল বায়ান ৭৩ সংখ্যা ১৯৯৪ খ্রিঃ ১২০- ১২৮ পঃদ্রষ্টব্য)
২৩। কোন পাপ কাজ করার উদ্দেশ্যে অথবা জ্ঞাতিবন্ধন ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে দুআ না করা।
২৪। সর্বপ্রকার গোনাহ থেকে দূরে থেকে দুআ করা।
২৫। সৎকাজের আদেশ ও মন্দ কাজে বাধা দেওয়া।
২৬৷ যে সময় স্থান ও অবস্থাকালে দুআ কবুল হয়, সে সময়াদিতে দুআ করার সুযােগ গ্রহণ করা।
২৭। ছােট না চেয়ে বড় কিছু চাওয়া। মুসলিম ২৬৭৯)
২৮। এমন কিছু না চাওয়া, যা সহ্য করার ক্ষমতা নেই। যেমন, আখেরাতের আযাব দুনিয়াতেই না চাওয়া। (ঐ ২৬৮৮)
দুঃখ-কষ্ট চেয়ে ধৈর্য প্রার্থনা না করে সরাসরি দুঃখ-কষ্ট থেকে পানাহ চাওয়া উচিত। তাই এমন প্রার্থনা করা বৈধ নয় -
দুঃখ যদি দিও প্রভু, শক্তি দিও সহিবারে।
বিপদে মােরে রক্ষা করো এ নহে মাের প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়,
দুঃখ তাপে ব্যথিত চিতে নাইবা দিলে সান্ত্বনা
দুঃখ যেন করিতে পারি জয়।
সহায় মাের না যদি জুটে, নিজের বল না যেন টুটে
সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি লভিলে শুধু বঞ্চনা
নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।