إِنَّ الْحَمْدُ للهِ ، نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ ، وَنَعُـوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا ، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا ، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلاَ مُضِلَّ لَهُ ، وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَلاَ هَادِيَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيْكَ لَهُ ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ
নিশ্চয়ই যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার জন্য। আমরা তারই প্রশংসা করি, তার কাছে সাহায্য চাই, তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। আল্লাহর নিকট আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনিষ্টতা ও আমাদের কর্মসমূহের খারাপ পরিণতি থেকে আশ্রয় কামনা করি। আল্লাহ যাকে হেদায়েত দেন, তাকে গোমরাহ করার কেউ নেই। আর যাকে গোমরাহ করেন তাকে হেদায়েত দেওয়ার কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্যিকার ইলাহ নেই, তিনি একক, তার কোনো শরিক নেই। আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সালাত ও সালাম নাযিল হোক তার উপর, তার পরিবার-পরিজন ও তার সাহাবীদের উপর এবং যারা কিয়ামত অবধি ইহসানের সাথে তাদের অনুসরণ করেন তাদের উপর।
বর্তমান সময়ে যুব সমাজের দুরবস্থা ও তাদের নৈতিক পতন এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যা বলার অপেক্ষা রাখে না। এভাবে চলতে থাকলে, মুসলিম সমাজের অবস্থা যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনাতীত। তাই যুব সমাজকে তাদের অপ-মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা এবং নিশ্চিত ধ্বংস থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। এ দায়িত্ববোধ থেকে এ বইটি সংকলনের প্রেরণা পাই। এ বইটি বর্তমান সময়ের যুব সমাজের বিভিন্ন সমস্যা এবং এগুলোর সমাধান তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করি পাঠক বন্ধুরা বইটি পড়ে উপকৃত হবেন এবং ধ্বংসের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট প্রার্থনা তিনি যেন আমাদেরকে ভালো কর্ম করার তাওফিক দেন এবং খারাপ ও মন্দ কর্ম হতে হেফাজত করেন। আমীন
জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের
একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হলো তার যৌবনকাল। যৌবনকালকে একজন মানুষের জীবনের স্বর্ণ যুগ বলা যেতে পারে। কিন্তু এ যৌবনকাল মানুষের জন্য যেমনি গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ। যৌবনকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়, কিন্তু সম্ভব। সে সফল ব্যক্তি যে তার যৌবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং কাজে লাগাতে পারে।
একজন যুবকের জন্য ভাল থাকাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং হলেও তার খারাপ হওয়াটা অত্যন্ত সহজ। কারণ, এ সময়টাতে একজন যুবককে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে অসংখ্য অশুভশক্তি। আমি এটাকে এভাবে প্রকাশ করি যে, কচুর পাতার পানি যেমন টলমল করে যে কোনো মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে, ঠিক তেমনি একজন যুবক যে কোনো সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যে কোনো সময় হয়ে যেতে পারে তার জীবনের সব কিছু এলোমেলো। বর্তমান সময়ে গোটা বিশ্বের দিক তাকালে আমরা দেখতে পাই, বর্তমানে যুবক শ্রেণি বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও সংকটে নিপতিত। তারা তাদের জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। তাই যুব সমাজকে সচেতন করা এবং তাদেরকে অশুভশক্তির করাল ঘ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
নিম্নে আমরা যৌবনের গুরুত্ব, ইসলামের প্রচার-প্রসারে যুবকদের ভূমিকা এবং যুবক শ্রেণী ধ্বংসের বিভিন্ন উপকরণগুলো উল্লেখ করব, যাতে যুবকরা তাদের মূল্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং যে সব কারণে যুব সমাজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিপতিত হয়, সে সব কারণ থেকে দূরে থেকে তারা তাদের নিজেদের রক্ষা করতে পারে এবং ভয়াবহ পরিণতি হতে নিজেদের বাঁচাতে পারে।
একজন মানুষের যৌবনকালই হল, তার জীবনের স্বর্ণ যুগ এবং কর্ম সম্পাদন, ক্যারিয়ার গঠন ও নেক আমল করার মুখ্য সময়। এ সময়টিকে যে কাজে লাগাবে সে উন্নতি করতে পারবে। আর যে এ সময়টিকে হেলা-খেলায় নষ্ট করবে সে জীবনে কোনো উন্নতি করতে পারবে না। কারণ, মানুষের যৌবনকাল, দুটি দুর্বলতা- বাল্যকাল ও বার্ধক্য কাল-এর মাঝে একটি সবলতা বা শক্তি। সুতরাং এ সময়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া ও কাজে লাগানোর জন্য চেষ্টা করাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ এবং তার জীবনের সুবর্ণ সুযোগ। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«اغتنم خمسا قبل خمس: شبابك قبل هرمك، وصحتك قبل سقمك، وغناك قبل فقرك، وفراغك قبل شغلك، وحياتك قبل موتك »
“তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের পূর্বে গণিমত-সুবর্ণ সুযোগ- মনে কর। তোমার যৌবনকে কাজে লাগাও বার্ধক্য আসার পূর্বে, তোমার সুস্থতাকে কাজে লাগাও তোমার অসুস্থতার পূর্বে, তোমার সচ্ছলতাকে কাজে লাগাও অসচ্ছলতার পূর্বে, তোমার অবসরতাকে কাজে লাগাও তোমার ব্যস্ততার পূর্বে, আর তোমার হায়াতকে কাজে লাগাও তোমার মৃত্যু আসার পূর্বে”।[1]
ইমাম আহমদ আহমদ রহ. বলেন, “আমি যৌবনকে এমন বস্তুর সাথেই তুলনা করি, যে বস্তুটি ক্ষণিকের জন্য আমার বগলের নীচে থাকে, তারপর তা হারিয়ে যায়”।
যৌবনকাল হল, ইবাদত বন্দেগী ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার একটি মুখ্য সময়। এটি বেশি দিন স্থায়ী হয় না। যৌবন মানুষের জীবনে একজন আগন্তুক মেহমানের মত। সেটি মানুষের জীবনে একবার আসে আবার খুব দ্রুত চলে যায়। বুদ্ধিমান সে- যে তার যৌবনকে কাজে লাগায় এবং ভবিষ্যৎ জীবন তথা বার্ধক্যের জন্য পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করে। যদি কোনো বুদ্ধিমান যৌবনকে কাজে না লাগায়, তখন তার আফসোসের আর অন্ত থাকে না। তার আফসোস তাকে শেষ করে দেয়। কোনো কবি যৌবন সম্পর্কে বলেন,
ضيف زارنا أقام عندنا قليلا .. .. سوّد الصحف بالذنوب وولى
“যৌবন হল, একজন মেহমান যে আমাদের আঙ্গিনায় এসে কিছু সময় অবস্থান করল, তারপর সে গুনাহ দ্বারা আমলনামাকে কালো করল, অতঃপর পালিয়ে গেল”।
যৌবন মানুষের জীবনের একবারই আসে বার বার আসে না। একবার চলে গেলে তা আর কখনো ফিরে আসবে না। যৌবন কাজে না লাগিয়ে অবহেলায় নষ্ট করলে, যেমনিভাবে দুনিয়াতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অনুরূপভাবে আখিরাতে আল্লাহর নিকট তার জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন মানুষকে তার যৌবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে বলবেন, তুমি তোমার যৌবনকে কোথায় ব্যয় করলে এবং কিভাবে তার ক্ষয় করলে। হাদিসে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لا تزول قدما ابن آدم يوم القيامة من عند ربه، حتى يُسأل عن خمس: عن عمره فيم أفناه؟ وعن شبابه فيم أبلاه؟ وعن ماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه؟ وماذا عمل فيما علم؟"
“কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ব্যতীত, কোনো আদম সন্তান আল্লাহর সম্মুখ হতে পা সরাতে পারবে না। তার জীবনকে কোথায় ব্যয় করেছে। যৌবনকে কোথায় ক্ষয় করেছে, সম্পদ কোথায় থেকে অর্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করছে। আর যা জেনেছে, সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করছে”।[2]
وعدّ صلى الله عليه وسلم في السبعة الذين يظلهم الله في ظله يوم لا ظل إلا ظله: « شابا نشأ في عبادة الله".
আর যে যুবক তার যৌবনকে আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে দেয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে বলেছেন, আল্লাহ কিয়ামতের দিন-যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না-তাকে আল্লাহ স্বীয় ছায়ার তলে আশ্রয় দেবেন।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র যুবক বান্দাকে জ্ঞান দান করেন। যাবতীয় কল্যাণ যৌবনেই লাভ করা সম্ভব হয়। তারপর তিনি তার দাবির পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ হিসেবে আল্লাহ তা‘আলার বাণী তিলাওয়াত করে শোনান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قَالُواْ سَمِعۡنَا فَتٗى يَذۡكُرُهُمۡ يُقَالُ لَهُۥٓ إِبۡرَٰهِيمُ ٦٠﴾ [الانبياء: ٦٠]
“তাদের কেউ কেউ বলল, আমরা শুনেছি এক যুবক এই মূর্তিগুলোর সমালোচনা করে। তাকে বলা হয় ইবরাহিম”।[3]
﴿نَّحۡنُ نَقُصُّ عَلَيۡكَ نَبَأَهُم بِٱلۡحَقِّۚ إِنَّهُمۡ فِتۡيَةٌ ءَامَنُواْ بِرَبِّهِمۡ وَزِدۡنَٰهُمۡ هُدٗى ١٣ ﴾ [الكهف: ١٣]
“আমরা তোমাকে তাদের সংবাদ সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। নিশ্চয় তারা কয়েকজন যুবক, যারা তাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমরা তাদের হিদায়েত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।”[4]
﴿يَٰيَحۡيَىٰ خُذِ ٱلۡكِتَٰبَ بِقُوَّةٖۖ وَءَاتَيۡنَٰهُ ٱلۡحُكۡمَ صَبِيّٗا ١٢ وَحَنَانٗا مِّن لَّدُنَّا وَزَكَوٰةٗۖ وَكَانَ تَقِيّٗا ١٣﴾ [مريم: ١٢، ١٣]
“হে ইয়াহইয়া, তুমি কিতাবটিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর’ আমরা তাকে শৈশবেই প্রজ্ঞা দান করেছি। আর আমাদের পক্ষ থেকে তাকে স্নেহ-মমতা ও পবিত্রতা দান করেছি এবং সে মুত্তাকী ছিল।”[5] হাফসা বিনতে সীরিন রহ. বলেন, “হে যুবক সম্প্রদায়! তোমরা কর্ম কর, কারণ, যৌবনকালই হল, কাজ করার উপযুক্ত সময়”। আহনাফ ইবনে কাইস রহ. বলেন, السودد مع السواد ‘নেতৃত্ব কালো থাকা অবস্থায়’ অর্থাৎ, যদি কোনো ব্যক্তি যৌবন কালে নেতা না হতে পারে, সে বুড়ো কালেও নেতা হতে পারবে না।
>[2] বর্ণনায় তিরমিযি, হাদিস: ২৪১৬; আল্লামা আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
[3] সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৬০
[4] সূরা কাহাফ, আয়াত: ১৩
[5] সূরা মারয়াম, আয়াত: ১২, ১৩
ইসলামের প্রথম যুগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যে সব সাহাবী তার প্রতি ঈমান আনে, তাকে সাহায্য করে, সহযোগিতা করে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেদায়াতের যে আলোকবর্তিকা নিয়ে আসেন, তার অনুসরণ করে, তারা সবাই ছিল যুবক! ইসলামী দুনিয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অনেক সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবকদের হাতেই ন্যস্ত করেন এবং তাদের হাতে দায়িত্ব সমর্পণ করেন। যেমন, উসামা ইবনু যায়েদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এর মত বড় সাহাবীদের উপস্থিতিতে মাত্র আঠারো বছর বয়সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের সেনাপতি নিয়োগ করেন। হুনাইনের যুদ্ধে যাওয়ার সময় উত্তাব ইবন উসাইদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে মাত্র বিশ বছর বয়সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কার গভর্নর নিয়োগ করেন। এ ছাড়াও ইসলামের ইতিহাসে ইসলামের ঝাণ্ডা বহন করা, ইসলামের পতাকাকে সমুন্নত রাখা এবং ইসলামের আলোকে দুনিয়ার আনাচে কানাচে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যুবকদের ভূমিকা বিষয়ে আরও অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।
ইয়াহয়া ইবনে মঈন রহ. আহমদ ইবন হাম্বলকে হাদিস শেখার জন্য ইমাম শাফেয়ী রহ. এর বাহনের পিছনে হাটতে দেখে বলেন, হে আবু আব্দুল্লাহ! তুমি সুফিয়ান সাওরীর রহ. এর মত এত বড় মর্যাদাশীল হওয়া স্বত্বেও তার থেকে হাদিস শোনা ছেড়ে দিয়ে, এ যুবকের বাহনের পিছনে হাঁটছ এবং তার থেকে হাদিস শুনছ? আহমদ রহ. তাকে উত্তর দিয়ে বলেন, ‘যদি আপনি এ যুবককে চিনতে পারতেন, তবে আপনিও অপর পাশ দিয়ে হাঁটতেন’। সুফিয়ানে সাওরীর ইলম যদি উপরে হওয়ার কারণে ছুটে যায়, তবে নিচে হওয়ার কারণে তা আমি লাভ করতে পারব। আর এ যুবকের জ্ঞান যদি ছুটে যায়, তবে তা উপরে বা নীচে কোথাও পাওয়া যাবে না।
ইরাক থেকে একটি জামাত ওমর ইবন আব্দুল আযীয রহ. এর নিকট আসলে, তাদের মধ্যে একজন যুবককে দেখতে পেল, সে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে সামনের দিক অগ্রসর হচ্ছে। তার অবস্থা দেখে ওমর ইবন আব্দুল আযীয রহ. তাকে বলল, হে যুবক! তুমি থাম, বড়দের কথা বলতে দাও। তখন সে বলল, হে আমীরুল মুমিনীন! কোনো কোনো বিষয়ের সম্পর্ক বয়সের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। যদি বয়সের সাথে সম্পর্কিত হত, তাহলে মুসলিমদের মধ্যে খলিফা হওয়ার মত এমন অনেক ব্যক্তি আছে, যার বয়স আপনার থেকে অনেক বেশি। তার কথা শোনে ওমর ইবন আব্দুল আযীয বলল, ঠিক আছে তুমি বল।
মাকামাতের ব্যাখ্যায় আল্লামা মাসউদী রহ. একটি ঘটনা বর্ণনা করেন, মাহদী বসরায় প্রবেশ করে দেখলেন, ইয়াস ইবন মুয়াবিয়া নামে একজন বাচ্চার পিছনে চারশত আলেম এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ। তারা সবাই ইয়াসের পিছনে হাঁটছে আর ইয়াস তাদের সামনে হাঁটছে। এ দৃশ্য দেখে মাহদী বলল, এদের মধ্যে কি সামনে বাড়িয়ে দেওয়ার মত এ বাচ্চা ছাড়া কোনো মুরব্বী নাই? তারপর মাহদী তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, হে বাবু তোমার বয়স কত? তখন সে বলল, -আল্লাহ তা‘আলা আমীরের হায়াতকে বৃদ্ধি করুক- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামা ইবন যায়েদ ইবন হারেসাকে যখন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর উপস্থিতিতে ইসলামী সৈন্য দলের সেনাপতি নিযুক্ত করেন, তখন তার বয়স যত ছিল, বর্তমানে আমার বয়সও তাই। তার কথা শোনে মাহদী বলল, “আল্লাহ তোমার মধ্যে বরকত দান করুক” তুমি সামনেই থাক।
খতীব রহ. তারিখে বাগদাদে উল্লেখ করেন, ইয়াহয়া ইবন আকসাম বিশ বছর বয়সে বসরার গভর্নর নিযুক্ত হন। বয়স কম হওয়াতে লোকেরা তাকে খাট করে দেখল এবং তাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে জিজ্ঞাসা করল, তোমার বয়স কত? সে উত্তরে বলল, আমি উত্তাব ইবন উসাইদ হতে বড় যাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের বছর মক্কার কাযী নিয়োগ করে পাঠিয়েছিলেন। আমি মুয়ায ইবন জাবাল রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বড়, যাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়ামনের কাযী বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। আমি কা‘আব ইবন সুয়াইদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বড় যাকে ওমর ইবন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বসরার গবর্নর বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। তিনি তাদের এমনভাবে উত্তর দিলেন, যার মধ্যে তাদের অভিযোগের সব উত্তর প্রমাণসহ বিদ্যমান।
আবুল ইয়াকযান রহ. বলেন, হাজ্জাজ ইবন ইউছুফ মুহাম্মদ ইবন কাশেমকে সতের বছর বয়সে যুদ্ধের সেনাপতি বানান। তিনি পারসিকদের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হন। তারপর তাকে সিন্ধু প্রদেশের সেনাপতি বানালে তিনি সিন্ধু ও ভারত উপ মহাদেশ জয় করেন।
হাতীত আয-যাইয়াতকে হাজ্জাজ ইবন ইউসুফের নিকট ধরে নিয়ে আসা হলে, হাজ্জাজ তাকে জিজ্ঞাসা করে বলল, তুমি কি হাতীত? সে বলল, হ্যাঁ আমি হাতীত, তুমি আমাকে তোমার যা ইচ্ছা তা জিজ্ঞাসা কর। আমি আল্লাহর নিকট তিনটি ওয়াদা করছি। তুমি যদি কোনো কথা জিজ্ঞাসা কর, সত্য বলব, যদি কষ্ট দাও ধৈর্য ধরব, আর যদি ক্ষমা কর, কৃতজ্ঞ হব। তার কথা শোনে হাজ্জাজ বলল, আমার সম্পর্কে তুমি কি ধারণ পোষণ কর? তখন হাতীত আয-যাইয়াত বলল, যমীনে তুমি আল্লাহর দুশমনদের মধ্য হতে একজন দুশমন। তুমি মা বোনদের ইজ্জত নষ্ট কর, সামান্য অপরাধে মানুষ হত্যা কর। হাজ্জাজ বলল, আমীরুল মুমিনীন আব্দুল মালেক ইবনে মারওয়ান সম্পর্কে তোমার মন্তব্য কি? সে বলল, সে তোমার চেয়েও বড় অপরাধী। তুমি তার অপরাধসমূহের একটি অপরাধ মাত্র।
দেখুন, একজন যুবকের সাহস, সততা ও প্রতিশ্রুতি কত দৃঢ় ও মজবুত। মৃত্যু নিশ্চিত জানা স্বত্বেও সে কোনো লুকোচুরির আশ্রয় নেয়নি।
আব্দুল্লাহ ইবন যিয়াদ তেইশ বছর বয়সে খুরাসানের গভর্নর নিযুক্ত হন। মু‘আয রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে ত্রিশ বছরের কম বয়সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়ামনের গবর্নর বানান। নাহু ও আরবি ভাষার ইমাম ছিবওয়াই রহ. মাত্র বত্রিশ বছরে মারা যান। ইব্রাহীম নাখয়ী থেকে মানুষ হাদিস গ্রহণ করেন, তার বয়স মাত্র আঠারো বছর।
বুহতরী বলেন,
لا تنظرن إلى العباس من صغر في السن وانظر إلى الجد الذي شادا
إن النجوم نجومَ الأفق أصغرُها في العين أذهبُها في الجو إصعــادا
“আব্বাস বয়সে ছোট বলে তুমি তাকে তুচ্ছ মনে করো না। তুমি তার দৃঢ়তা ও জ্ঞানের গভীরতা দেখ। মরু ভূমিতে চলার জন্য পথনির্দেশক নক্ষত্রটি মহা মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ তবে দেখতে খুবই ছোট”।
যুবকরাই হলো, উম্মতের কাণ্ডারি, মজবুত খুঁটি, চালিকা শক্তি ও প্রাণ, যুবকদের ছোয়া ছাড়া কোনো দাওয়াত ও আন্দোলন কখনোই সফল হতে পারে না। যুবকদের শক্তি ও তাদের আন্দোলনের উপর ভিত্তি করেই যে কোনো আন্দোলন প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং মিশন সফল হয়।
মোটকথা, যে সমাজ বা দেশে যুব সমাজের চরিত্র ভালো থাকবে, সে সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক জীবন যাপন ঠিক থাকবে। আর যে সমাজে যুবকদের চারিত্রিক ও নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেবে, সে সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা ও স্বাভাবিক জীবন যাপন ঠিক থাকবে না এবং সে সমাজের পতন ও ধ্বংস অনিবার্য।
মনে রাখতে হবে, বর্তমানে আমাদের যুব সমাজ অসংখ্য সংকট ও সমস্যায় জর্জরিত। এ সব সংকট ও সমস্যার মধ্য হতে অন্যতম সংকট ও সমস্যা হলো মাদক সেবন ও নেশা করা। ইসলামে সব ধরনের মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ হলেও ধর্মীয় মূল্যবোধ হারিয়ে যুব সমাজ মাদকের মরণ নেশায় মেতে উঠেছে। বাংলা ‘নেশা’ শব্দটি মূলত ফার্সি শব্দ ‘নাশাতুন’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হচ্ছে ‘মত্ততা’। বর্তমান সময়ে অধিকাংশ যুব সমাজ মাদক-আক্রান্ত হয়ে ধ্বংসের অবলীলায় নিপতিত হতে দেখা যায়। বিভিন্ন ধরনের মাদকের সয়লাব যুবকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়াতে তারা কোনো না কোনো উপায়ে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। মাদক বর্তমানে এত বেশি ব্যাপক আকার ধারণ করছে, যার ভয়ানক প্রভাব ও বিস্তার লক্ষ্য করা যায় আমাদের মানুষ গড়ার আঙ্গিনা-শিক্ষাঙ্গনগুলোতেও। এটি বর্তমান সময়ে যুব সমাজের জন্য একটি ভয়ানক পরিণতি ও অশনি সংকেত। তাই, বর্তমানে যদি একজন যুবক নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে তাকে সঠিক পথে রাখার জন্য কিংবা মাদক থেকে দূরে রাখার জন্য সময়মত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা হয়, তাহলে যুব সমাজের কাছে জাতির যে প্রত্যাশা তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হতে বাধ্য।
যুব সমাজ ধ্বংস ও তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের প্রধান অন্তরায় মাদক। মাদক শুধু একজন যুবকের মেধা ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের প্রতিবন্ধক নয় বরং মাদক একজন যুবককে ধ্বংসের অবলীলা ও মারাত্মক পরিণতির দিক ঠেলে দিয়ে তাকে চিরতরে ধ্বংস ও অকেজো করে দেয়। তার মূল্যবান জীবনটা নষ্ট হয়ে যায়।
ইসলামি মূল্যবোধ বান্ধব সমাজ ব্যবস্থা ছাড়া সব সমাজেই মাদকের ছুটাছুটি পরিলক্ষিত। মুসলিম পারিবারিক বন্ধন ও ইসলামি মূল্যবোধ কম-এমন পরিবারের সদস্যরা অতি সামান্য কারণে মাদকদ্রব্যে অধিকতর আসক্ত হচ্ছে। যারা নেশা করে তাদের অধিকাংশই জানে, নেশা কোনও রকম উপকারী বা ভালো কাজ নয় এবং তা মানুষের জীবনীশক্তি বিনষ্ট করে। এসব জেনেশুনেও মাদকাসক্ত মানুষ নেশার অন্ধকার জগতের মধ্যে থাকতে চায়। মাদকাসক্ত তরুণ প্রজন্ম ধর্ম-কর্ম সবকিছু বিসর্জন দিয়ে হতাশাকে সঙ্গী করে জীবনের চলার পথ থেকে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে এবং বিবেক-বুদ্ধি হারিয়ে সামাজিকতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ইসলাম মানুষকে নেশা গ্রহণ ও মাদক সেবন হতে সম্পূর্ণ নিষেধ করে। মানুষকে ধ্বংস ও করুণ পরিণতি হতে রক্ষা করার জন্য ইসলামী অনুশাসন মেনে চলার কোনো বিকল্প নাই। তাই আমাদের জানতে হবে ইসলাম মাদক সম্পর্কে কি দিক-নির্দেশনা দেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেছেন,
«كل شراب أسكر فهو حرام»
“যে কোনো ধরনের নেশাজাত পানীয় হারাম”।[1] তিনি আরও বলেন,
«كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ، وَكُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ، وَمَنْ شَرِبَ الْخَمْرَ فِي الدُّنْيَا فَمَاتَ وَهُوَ يُدْمِنُهَا لَمْ يَتُبْ، لَمْ يَشْرَبْهَا فِي الْآخِرَةِ» رواه مسلم.
‘নেশাজাতীয় যেকোনো দ্রব্যই মাদক, আর যাবতীয় মাদকই হারাম, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মাদক সেবন করে, অতপর নেশাগ্রস্ত অবস্থায় মারা যায় এবং সে তাওবা না করে, আখিরাতে সে মদ পান করা হতে বঞ্চিত হবে’।[2]
মানবসভ্যতার প্রতি মারাত্মক হুমকি সৃষ্টিকারী দেশের অন্যতম অভিশাপ মাদকাসক্তি। মাদকদ্রব্যের নেশার ছোবল এমনই ভয়ানক যে তা ব্যক্তিকে পরিবার, সমাজ, দেশ থেকেই বিচ্ছিন্ন করে না; তা সমগ্র জীবন ধ্বংস করে দেয়। মাদক কেবল সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্রেরই ক্ষতি করে না; সভ্যতা ও সংস্কৃতিকেও বিপন্ন করে। পরিমাণে অল্প হোক আর বেশি হোক-পান বা অন্য কোনোভাবে গ্রহণ করা হোক, নেশা ও চিত্ত-বিভ্রমক হলেই তা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। মানবতার মুক্তির কাণ্ডারি ইসলামই সর্বনাশা মাদক সম্পর্কে মানব জাতিকে সর্বোচ্চ সতর্ক করছে। মানুষ যাতে মাদক থেকে দূরে থাকে তার জন্য মাদক সেবনে এ নেশাগ্রস্থ ব্যক্তির জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করেছেন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡخَمۡرُ وَٱلۡمَيۡسِرُ وَٱلۡأَنصَابُ وَٱلۡأَزۡلَٰمُ رِجۡسٞ مِّنۡ عَمَلِ ٱلشَّيۡطَٰنِ فَٱجۡتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ ٩٠ ﴾ [المائدة: ٩٠]
‘ওহে মুমিনগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা ও ভাগ্য নির্ণায়ক তীর হচ্ছে ঘৃণ্য বস্তু, শয়তানের কারসাজি। সুতরাং, তোমরা এসব বর্জন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার”।[3]
মাদক হলো এমন এক ধরনের অবৈধ ও বর্জনীয় বস্তু, যা গ্রহণ বা সেবন করলে আসক্ত ব্যক্তির এক বা একাধিক কার্যকলাপের অস্বাভাবিক পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটতে পারে। মাদকাসক্তিতে মানুষের কোনও না কোনও ক্ষয়ক্ষতি তো হয়ই এবং ধীরে ধীরে তা নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। মাদক কেবল একক অপরাধ নয়, মাদকাসক্তির সঙ্গে সন্ত্রাস ও অন্যান্য অপরাধ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে মানুষের অন্তরে মাদকের ক্ষতির অনুভূতি জাগ্রত করে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لا تشربوا الخمر؛ فإنها مفتاح كل شر»
‘তোমরা মাদক ও নেশা পান করো না; কেননা এটা সব অপকর্ম ও অশ্লীলতার মূল’।[4]
মাদকের করাল গ্রাসে তরুণ সমাজ আজ সৃষ্টিশীল ও সৃজনশীল কাজে মেধা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞার আশানুরূপ অবদান রাখতে পারছে না। যে তরুণ তার অমিত সম্ভাবনাকে পরিবার, দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজে লাগাতে পারত, মাদকের নীল দংশন তার সুকুমার বৃত্তি নষ্ট করে, এমনকি ক্রমান্বয়ে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। উপরন্তু তথা কালেমা, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাতসহ আল্লাহ তায়ালার বিধিবদ্ধ দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত থেকে দূরে রাখে এবং পাপাচারে লিপ্ত করে। এতে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা‘আলা অসন্তুষ্ট হন। এ মর্মে কুরআনে মাজীদে আল্লাহ বলেন,
﴿إِنَّمَا يُرِيدُ ٱلشَّيۡطَٰنُ أَن يُوقِعَ بَيۡنَكُمُ ٱلۡعَدَٰوَةَ وَٱلۡبَغۡضَآءَ فِي ٱلۡخَمۡرِ وَٱلۡمَيۡسِرِ وَيَصُدَّكُمۡ عَن ذِكۡرِ ٱللَّهِ وَعَنِ ٱلصَّلَوٰةِۖ فَهَلۡ أَنتُم مُّنتَهُونَ ٩١﴾ [المائدة: ٩١]
‘নিশ্চয় শয়তান মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদের আল্লাহর স্মরণ ও সালাত থেকে বিরত রাখতে চায়, তবু কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না[5]?’ যেহেতু মাদকাসক্তি একটি জঘন্য সামাজিক ব্যাধি, জনগণের সামাজিক আন্দোলন, গণসচেতনতা ও সক্রিয় প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর প্রতিকার করা সম্ভব। ঘর থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাড়া-মহল্লা ও এলাকায় মাদকদ্রব্য ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ঘৃণা প্রকাশের আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মাদকদ্রব্যের মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে নিয়মিত সভা-সমিতি, সেমিনার, কর্মশালার আয়োজন করতে হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ধর্মীয় বিধিবিধান সম্পর্কিত শিক্ষামূলক ক্লাস নিতে হবে। মাদকদ্রব্য উৎপাদন, চোরাচালান, ব্যবহার, বিক্রয় প্রভৃতি বিষয়ে প্রচলিত আইনগুলোর বাস্তব প্রয়োগ ও কঠোর বিধান কার্যকর নিশ্চিত করা দরকার। সমাজজীবনে এহেন ঘৃণ্য মাদকদ্রব্যের ব্যবহার ও প্রসার রোধ করা অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে যারা মাদকদ্রব্য প্রস্তুত, এর প্রচলন ও সরবরাহের কাজে জড়িত তাদের দেশ ও জাতির স্বার্থে এহেন অনৈতিক কাজ অবশ্যই বর্জন করা উচিত। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের আগে মসজিদের ইমাম-খতিবের ভাষণে মাদকের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে সোচ্চার থাকতে হবে এবং মাদকের কুফল সম্পর্কে গণসচেতনতা সৃষ্টি করে মাদকের অবৈধ উৎপাদন, বিপণন, ব্যবহার ও চোরাচালান রোধসহ সকল স্তরের মুসল্লিদের কঠোর অবস্থান নিতে হবে। শুধু মদ্যপায়ী ও বিক্রেতা নয়, বরং মদ ও মাদকদ্রব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত ১০ জনের প্রতি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত দিয়েছেন। তারা হচ্ছে,
«لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الخَمْرِ عَشَرَةً: عَاصِرَهَا، وَمُعْتَصِرَهَا، وَشَارِبَهَا، وَحَامِلَهَا، وَالمَحْمُولَةُ إِلَيْهِ، وَسَاقِيَهَا، وَبَائِعَهَا، وَآكِلَ ثَمَنِهَا، وَالمُشْتَرِي لَهَا، وَالمُشْتَرَاةُ لَهُ»
“১. মদ্যপানকারী, ২. মাদক প্রস্ততকারক ৩. মাদক প্রস্তুতের উপদেষ্টা, ৪. মাদক বহনকারী, ৫. যার কাছে মাদক বহন করা হয় ৬. যে মাদক পান করায়, ৭. মাদক বিক্রেতা, ৮. মাদকের মূল্য গ্রহণকারী ৯. মাদক ক্রয়-বিক্রয়কারী, ১০. যার জন্য মাদক ক্রয় করা হয়”[6]।
সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গসহ সকল শ্রেণীর ধর্মপ্রাণ লোক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে মাদকদ্রব্যের প্রসার রোধে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালালে দেশ থেকে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে ইসলামে কঠোর শাস্তির বিধান আছে। ইহকাল ও পরকালে মাদকাসক্তির ভয়াবহতা জনগণের সামনে তুলে ধরার পরও যারা এ ভয়ঙ্কর নেশা ছাড়ে না তাদের জন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দণ্ডবিধি প্রবর্তন করেছেন, যাতে তারা সংশোধিত হয় এবং অন্যরা শিক্ষা নিতে পারে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইসলামী মূল্যবোধে উজ্জীবিত হওয়ার শিক্ষাই মাদকের সর্বনাশা অভিশাপ থেকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তরুণদের রক্ষা করতে পারে।
অতএব, ধর্মভীরু মা-বাবা ও অভিভাবকদের উচিত সর্বনাশা মাদকের কুফল ও ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সন্তানদের সচেতন করা। তাহলেই মাদকাসক্ত সন্তানদের নিয়ে মা-বাবার সমস্যা অনেক কমে যাবে। মা-বাবা ও অভিভাবকেরা, নিজেদের সন্তানদের সামনে ধর্মীয় রীতিনীতি, ইসলামি মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার সুন্দর আদর্শ তুলে ধরুন। কারণ তারাই একদিন সমাজ-সংসার তথা দেশের কর্ণধার হবে। প্রত্যেক অভিভাবকের উচিত, তাদের সন্তান যাতে কোনও অসৎ সংস্রবে পড়ে মাদকাসক্ত না হয় সেদিক সজাগ দৃষ্টি রাখা। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক শৃঙ্খলা, সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক, সর্বোপরি মানসিক বিকাশের উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।
মাদক ত্যাগের ব্যাপারে আসক্ত ব্যক্তিদেরও আত্মপ্রত্যয়ী হওয়া দরকার। মাদক থেকে বিরত থাকার জন্য নিজস্ব উদ্যোগই সবচেয়ে ভালো। নিজ থেকে নেশা ছাড়া সম্ভব না হলে তাদের ইসলামি মূল্যবোধে উদ্বুদ্ধ করতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র প্রদত্ত সহযোগিতা গ্রহণ করতে হবে। তরুণ প্রজন্ম ও যুব সমাজে মাদকাসক্তির নেশায় যে নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে তা কেবল ইসলামি মূল্যবোধই প্রতিরোধ করতে পারে। আসক্তদেরকে মাদক ত্যাগে উৎসাহিত করতে সর্বস্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে।হাদিসে মাদকের সেবনের বিভিন্ন পরিণতির কথা উল্লেখ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের অন্তরে মাদকের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করেছেন এবং বিভিন্ন প্রকার শাস্তি ও আযাবের কথা উল্লেখ করে মানুষকে সর্তক করেছেন। যেমন-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাদকের বিস্তারকে কিয়ামতের আলামত বলে আখ্যায়িত করেন।
[2] মুসলিম, হাদিস: ২০০৩
[3] সূরা আল-মায়িদা, আয়াত-৯০
[4] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৩৭১। হাকিম, হাদিস: ৭২৩১; হাদিসটি সহীহ বুখারি মুসলিম এর শর্ত অনুযায়ী।
[5] সূরা আল-মায়িদা, আয়াত-৯১
[6] তিরমিযী, ১২৯৫।
মাদক ও নেশাজাত দ্রব্যের বিস্তার কিয়ামতের আলামত। আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إن من أشراط الساعة: أن يرفع العلم ويثبت الجهل، ويُشرب الخمر، ويظهر الزنا رواه البخاري ومسلم،
“কিয়ামতের আলামতসমূহের কতক আলামত হল, দুনিয়া থেকে ইলম তুলে নেয়া হবে, অজ্ঞতা-নিরক্ষরতা-প্রতিস্থাপিত হবে, মদ্য পান ব্যাপক হবে এবং ব্যভিচার বৃদ্ধি পাবে।[1] অর্থাৎ কিয়ামতের পূর্বে মানুষের মধ্যে মদ্যপান ও নেশা গ্রহণ অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাবে। যেমনটি অপর একটি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ويكثر شرب الخمر “এবং মদ্যপান বৃদ্ধি পাবে”।[2]
কিয়ামতের পূর্বে দেশ ও সমাজে মাদকের সয়লাব এত ব্যাপক হবে, কেউ কেউ মাদক সেবন করাকে অপরাধও মনে করবে না। তারা মনে করবে মাদক সেবন করা কোনো অপরাধ নয় বরং তা হালাল। অনেক সময় দেখা যাবে, মাদক ও নেশা জাতীয় বস্তুর নাম পরিবর্তন করে বিভিন্ন প্রকার কোমল পানীয় ও শরবতের নামে নামকরণ করে তা পান করা হবে। তারা মনে করবে নাম পরিবর্তন করা দ্বারা তা হালাল হয়ে যাবে। ফলে মাদক সেবন যে হারাম ও নিষিদ্ধ তা তাদের অন্তর থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে। মাদকের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়বে, এটা যে নিষিদ্ধ তার প্রতি কোনো ভ্রূক্ষেপ করা হবে না। ‘উবাদাহ ইবন সামেত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ليستحلنّ طائفة من أمتي الخمر، باسم يسمّونها إياه»
“আমার উম্মতের মধ্যে একটি গোষ্ঠী এমন হবে, যারা মদকে ভিন্ন নামে নামকরণ করে সেটাকে হালাল মনে করবে”।[3]
এর চেয়েও অধিক শক্তিশালী হাদিস -যাতে এ ধরনের অপরাধীদের বিষয়ে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে- যেটি ইমাম বুখারী রহ. সহীহ বুখারিতে আবু মালেক আল আশ‘আরী হতে বর্ণনা করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ليكوننّ من أمتي أقوام، يستحلّون الحِرَ والحرير، والخمر والمعازف، ولينزلن أقوام إلى جنب عَلَم، يروح عليهم بسارحةٍ لهم، يأتيهم -يعني الفقير- لحاجةٍ فيقولون: ارجع إلينا غداً. فيبيّتهم الله، ويضع العَلَم، ويمسخ آخرين قردة وخنازير إلى يوم القيامة»
“আমার উম্মতের কতক সম্প্রদায় এমন হবে, যারা যিনা-ব্যভিচার, রেশমী কাপড় পরিধান করা, মাদক সেবন করা ও গান-বাজনাকে বৈধ মনে করবে। আর উম্মতের একটি সম্প্রদায় একটি পাহাড়ের পাদদেশে অবতরণ করলে তাদের নিকট তাদের রাখাল তাদের ছাগলগুলো নিয়ে উপস্থিত হবে। তখন তাদের নিকট একজন ভিক্ষুক এসে ভিক্ষা চাইলে তারা তাকে বলবে, তুমি আমাদের নিকট আগামীকাল এস। রাতে তাদের উপর আযাব এসে তাদের ধ্বংস করে দেবে। আর আল্লাহ তাদের উপর পাহাড় ধ্বসে দিবেন। আর তাদের কতেককে তিনি কিয়ামত পর্যন্ত বানর ও শুকরের আকৃতিতে পরিণত করে দিবেন।[4]
>[2] বুখারি, হাদিস: ৫২৩১
[3] আহমদ, হাদিস:২২৭০৯
[4] বুখারি, হাদিস: ৫৫৯০
এক: কোনো বস্তুকে অন্য নামে নামকরণ দ্বারা বস্তুর আসল রূপ পরিবর্তন হয় না। আর শরীয়তের সব বিধানই হল, স্পষ্ট, মজবুত ও শক্তিশালী। শরিয়তের বিধান দ্বারা কোনো প্রকার খেল-তামাশা করা বৈধ নয়। সুতরাং, যে নামেই নাম করণ করা হোক না কেন, তার মধ্যে যখন কারণ- নেশা-পাওয়া যাবে, তখন তা সেবন বা পান হারাম হবে। এমনকি যদি আমরা মদকে পানিও নাম রাখি, তা হলেও তা হারাম হবে। কারণ, হাদিসে স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যে পানীয় দ্বারা মানুষের মস্তিষ্ক নষ্ট হয়, তা হারাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«كل شراب أسكر فهو حرام»
“যে কোনো ধরনের নেশাজাত পানীয় হারাম”[1]।
অনুরূপভাবে রাসূল সা. বলেন,
«كل مسكر خمر، وكل مسكر حرام»
“নেশাজাতীয় যেকোনো দ্রব্যই মাদক, আর যাবতীয় মাদকই হারাম[2]।”
আর যারা মদ পান করাকে বৈধ দাবী এবং হালাল মনে করে তাদের বলা হবে, আল্লাহ তা‘আলা যে সব বস্তুকে হারাম করেছে, তাকে হালাল মনে করা দ্বারা একজন মানুষ ইসলামের বন্ধন থেকে বের হয়ে যায়। শেখ সুলাইমান আত-তামিমী রহ. বলেন, যে সব বস্তু নিষিদ্ধ হওয়া বা হালাল হওয় বিষয়ে উম্মতের ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সে ধরনের হালাল বা হারাম মনে করা কুফর। কারণ, আল্লাহ ও তার রাসূল যে বস্তুকে হালাল করেছেন, তার হালাল হওয়াকে অস্বীকার করা যাবে না এবং যে বস্তুকে হারাম করেছে তাকে হালাল বলে আখ্যায়িত করা যাবে না। এ ধরনের ধৃষ্টতা কেবল সেই দেখাতে পারে যে ইসলামের দুশমন, ইসলামের বিধি-বিধান অস্বীকারকারী এবং কুরআনও সুন্নাহ এবং উম্মতের ইজমাকে অমান্যকারী।
দুই: পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের হেফাযত করা একজন মানুষের জন্য খুবই জরুরী। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের হেফাযত ছাড়া ইসলামের মাকাসেদ তথা মূল উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। আর ইসলামের মাকাসেদকে সংরক্ষণ করার জন্য পরিপূর্ণ চেষ্টা করা একজন মুমিনের দায়িত্ব ও কর্তব্য। কিন্তু মদ মানুষের জ্ঞানকে নষ্ট করে দেয় যা একজন মানুষের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয়। মদ মানুষের জ্ঞানকে বিলুপ্ত করে, চিন্তা-ফিকিরকে নষ্ট করে দেয়। একজন মানুষ যাতে তার জ্ঞানহারা না হয়, এ কারণে আল্লাহ মানুষকে মদ পান হতে কঠিন হুশিয়ারি উচ্চারণ করে। আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে মদ থেকে দূরে থাকার জন্য সুস্পষ্ট ও পরিষ্কার নিষেধ করেন, যার মধ্যে কোনো প্রকার ব্যাখ্যা বা বিকৃতির সুযোগ নাই। এ কারণেই ইমাম কুরতবী রহ. আল্লাহ তা‘আলার বাণী فاجتنبوه এর তাফসীরে বলেন, আল্লাহর এ কথাটি দ্বারা মদ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকাকে বুঝায়। ফলে মদ থেকে কোনো উপায়ে কোনো প্রকার উপকার গ্রহণ করা যাবে না। মদ পান করা যাবে না, বিক্রি করা যাবে না, শরবত বানানো যাবে না, ঔষধ বানানো যাবে না ইত্যাদি। ইমাম ইবন মাজাহ আবুদ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে একটি হাদিস বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,
«لا تشربوا الخمر؛ فإنها مفتاح كل شر»
“তোমরা মদ সেবন করো না, কারণ, মদ সমস্ত অনিষ্টতার চাবি-কাঠি”।[3]
মদের ক্ষতি শুধু দু একটির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর ক্ষতি এত ব্যাপক- যার কারণে আল্লাহ তা‘আলা মদ সেবন করাকে শুধু হারাম বা নিষিদ্ধ করেননি বরং মদ বিক্রি করা, তৈরি করা, আমদানি-রফতানি বিপণনসহ যাবতীয় সব কিছুকেই নিষিদ্ধ করেন। যারা মদের বাণিজ্য করে, তাদের ব্যাপারেও কঠিন হুশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে। যারা মদ পান করে তারা আখেরাতে এ জাতীয় পানীয় থেকে বঞ্চিত হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন, আব্দুল্লাহ ইবন ওমরের হাদিস বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«من شرب الخمر في الدنيا فمات وهو يدمنها لم يتب، لم يشربها في الآخرة»
“যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মদ পান করে এবং নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তাওবা না করে মারা যায়, সে আখিরাতে ঐ জাতীয় কোনো পানীয় পান করতে পারবে না।[4] আর জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে একটি হাদিস বর্ণিত, তাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وإن على الله لعهدا لمن شرب المسكر أن يسقيه من طينة الخبال: عرق أهل النار»
“যারা দুনিয়াতে মাদক সেবন করে, তাদেরকে আখিরাতে জাহান্নামীদের দেহের পচা-গলা, পুঁজ ও ঘাম পান করানো বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”[5] অনুরূপভাবে আবু দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে একটি মারফু হাদিস বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لا يدخل الجنة مدمن خمر»
“নেশাকরায় অভ্যস্ত ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না”।[6]
আবদুল্লাহ ইবন ওমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে আরও একটি হাদিস বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«من شرب الخمر لم تقبل له صلاةٌ أربعين صباحاً، فإن تاب: تاب الله عليه، فإن عاد لم يقبل الله له صلاة أربعين صباحاً، فإن تاب: تاب الله عليه، فإن عاد لم يقبل الله له صلاة أربعين صباحاً، فإن تاب: تاب الله عليه، فإن عاد الرابعة لم يقبل الله له صلاة أربعين صباحاً، فإن تاب لم يتب الله عليه، وسقاه من نهر الخبال».
“যে ব্যক্তি মদ পান করে, চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল করা হবে না। যদি সে তাওবা করে আল্লাহ তা‘আলা তার তাওবা কবুল করবেন। তারপর যদি সে পুনরায় মদ পান করে, আল্লাহ আবারো চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল করবেন না। তারপর যদি সে তাওবা করে আল্লাহ তা‘আলা তার তাওবা কবুল করবেন। তারপর যদি সে পুনরায় মদ পান করে, আল্লাহ আবারো চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল করবেন না। যদি সে তাওবা করে আল্লাহ তা‘আলা তার তাওবা কবুল করবেন। তারপর যদি সে চতুর্থবার পুনরায় মদ পান করে, আল্লাহ আবারো চল্লিশ দিন পর্যন্ত তার সালাত কবুল করবে না। তারপর যদি তাওবা করে তার তাওবা কবুল করা হবে না। আল্লাহ তাকে জাহান্নামীদের পচা-গলা ও পুঁজের নহর থেকে পান করাবেন”।[7] যারা প্রবৃত্তির পূজারি তাদের নিকট এ ধরনের উপদেশ অনেক সময় অমূলক। যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না, তাদের আখিরাতের ওয়াজ ও নছিহত দ্বারা মদ পান করা থেকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। এ ধরনের লোকদের নিকট মদ পান বা নেশাজাত দ্রব্য পান করা দুনিয়াবি ক্ষতিগুলো তুলে ধরতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে, মদ পান করা বা নেশা গ্রহণ করা কেবল শরীয়তের পরিপন্থীই নয় বরং নেশাজাত বস্তু সেবন করা দ্বারা একজন মানুষ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয় ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংসের দিক ঠেলে দেওয়া হয়। মদ পানের কারণে ঘরে বাইরে অশান্তি তৈরি হয়, বৈবাহিক সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয়, মারা-মারি হানা-হানি বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়াও রয়েছে একজন মানুষের দৈহিক ক্ষতি। মাদক সেবন দ্বারা বড় বড় রোগ-ক্যানসার, যক্ষ্মা ইত্যাদি মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি দেখা দেয়। এত কিছুর পরও কি বলা যাবে, মাদক সেবন করা বৈধ এবং তা নিষিদ্ধ এবং হারাম নয়?
>[2] মুসলিম, হাদিস: ৫০০৫।
[3] ইবন মাজাহ, হাদীস নং, ৩৩৭১; হাকিম, হাদিস: ৭২৩১; হাদিসটি সহীহ বুখারি মুসলিম এর শর্ত অনুযায়ী।
[4] বর্ণনায় মুসলিম, হাদিস: ২০০৩, নাসায়ী, হাদিস: ৫৬৭৩।
[5] বর্ণনায় মুসলিম, হাদিস: ২০০২।
[6] ইব্নু মাযা, হাদিস: ৩৩৭৬ ইবনু হাব্বান, হাদিস: ৬১৩৭।
[7] বর্ণনায় তিরমিযি, হাদিস: ১৮৬২।
বিজাতীয় সংস্কৃতির অগ্রাসন আমাদের যুব সমাজ ধ্বংসের অন্যতম কারণ। কারণ, আজ আমরা আমাদের নিজেদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও তমদ্দুন থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে বিজাতিদের সংস্কৃতির দ্বারস্থ হয়েছি এবং আমরা আমাদের নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে অমুসলিম কাফের ও বিজাতিদের সংস্কৃতির অন্ধানুকরণে ব্যাকুল হয়ে পড়েছি। বর্তমান সময়ে মুসলিম দেশসমূহে ইসলামী সংস্কৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত চর্চা হচ্ছে। এমনকি আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিজাতীয় সংস্কৃতিকে পাঠ্যসূচী করা হয়েছে। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মুসলিমরা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য কি তা ভুলেই গেছে। তাদের নিকট পশ্চিমা সংস্কৃতি ছাড়া কোনো কিছুই মনে হয় যেন গ্রহণযোগ্য নয়। একজন মুসলিম কেন যেন মনে করে, পশ্চিমা সংস্কৃতি ছাড়া নিজেকে আধুনিক বা অভিজাত হিসেবে প্রকাশ করা যায় না। ফলে মুসলিমরা তাদের নিজেদের হাজার বছরের আত্মপরিচয়কে ভুলে গিয়ে চোখ ধাঁধানো মরীচিকার পেছনে ছুটছে। তাদের প্রাত্যহিক ব্যাবহারিক জীবনের পশ্চিমাদের অনুকরণ করা একটি মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইসলামী সভ্যতাই সারা দুনিয়ার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বশ্রেষ্ঠ। ইসলামই মানুষকে মানবতা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি শিখিয়েছে। ইসলামের মহান আদর্শ ও মুসলিম সভ্যতা সংস্কৃতিকে অনুকরণ করে বিজাতিরা সারা দুনিয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর আমরা মুসলিমরা তাদের অন্ধ অনুকরণ করে বেড়াচ্ছি এবং সারা দুনিয়ার মধ্যে সব ধরনের অপমান সহ্য করে যাচ্ছি। আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের সতর্ক করে বলেন,
﴿وَلَا تَرۡكَنُوٓاْ إِلَى ٱلَّذِينَ ظَلَمُواْ فَتَمَسَّكُمُ ٱلنَّارُ وَمَا لَكُم مِّن دُونِ ٱللَّهِ مِنۡ أَوۡلِيَآءَ ثُمَّ لَا تُنصَرُونَ ١١٣ ﴾ [هود: ١١٣]
“তোমরা সীমালঙ্ঘনকারীদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ো না, অন্যথায় অগ্নি তোমাদেরকে স্পর্শ করবে। আর এই অবস্থায় আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোনো বন্ধু থাকবে না এবং তোমরা সাহায্যও পাবে না”।[1]
তাছাড়া সমাজ-বিজ্ঞানী প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«من تشبه بقوم فهو منهم»
“যে ব্যক্তি কোনো জাতির সাথে সামঞ্জস্য বিধান করবে, সে ব্যক্তি সেই জাতিরই দলভুক্ত হবে”।[2]
ভালো-মন্দ বাচ-বিচার না করে অন্ধভাবে অপরের ভঙ্গিমা নকল করে চলা, সব কাজে অপরের হুবহু অনুকরণ করা মানুষের জন্য নিন্দনীয়। কারণ, এমন স্বভাব কেবল বানরেরই হয়ে থাক। যে জাতি কোনো প্রকার বিচার-বিশ্লেষণ না করে চোখ বুজে অপরের অনুকরণ করে তৃপ্তি পায়, সে বানরের স্বভাবের অধকিারী বললে ভুল হবে না। কিন্তু মানুষ, বিশেষ করে কোনো মুসলিম পারে না বিজাতির কোনো অসভ্য ভঙ্গিমা নকল করে চলতে। কারণ, মুসলিমের আছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য। আর তা বিনাশ করে অপরের বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করার মানেই হল, নিজেকে ধ্বংস ও বিলীন করা।
বিজাতিদের সভ্যতা সংস্কৃতিতে মানবতার জন্য অনিবার্য ধ্বংস ও নিশ্চিত অশান্তি। তার প্রমাণ আমরা পশ্চিমা দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাই- আজ তাদের দেশে মানবতা কত অসহায়, নারীরা কতনা নির্যাতিত, নিষ্পেষিত। তাদের দেশের মানুষ তাদের বাবা-মায়ের পরিচয় কি তা জানে না। বৃদ্ধ মাতা পিতাদের খোজ খবর নেওয়ার মত কেউ নেই। আবার মা বাবার নিকট তাদের সন্তানেরও কোনো হিসেব নেই। ভাই বোনের কোনো পরিচয় নাই। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কোনো বন্ধন নেই। মানসিক অশান্তি তাদের নিত্য দিনের সাথী। তাদের জীবন যে কত দূর্বিসহ তা দেখলেই বুঝা যাবে। আত্মহত্যা পারিবারিক কলহ তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। এ কারণেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ উম্মতকে বিজাতিদের অনুকরণ করা থেকে সতর্ক করেন। তিনি বলেন,
«لتتعن سنن من كان قبلكم حذو القذة بالقذة وشبرا بشبر وذراعا بذراع حتى لو دخلوا جحر ضب لدخلتموه .قالوا اليهود والنصارى؟ قال: فمن !
“অবশ্যই তোমরা তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির পথ অনুসরণ করবে বিঘত-বিঘত এবং হাত-হাত (সম) পরিমাণ। এমনকি তারা যদি ষাণ্ডার গর্তে প্রবেশ করে, তাহলে তোমরাও তাদের পিছনে পিছনে যাবে।” সাহাবিগণ বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আপনি কি ইয়াহুদ ও নাসারার অনুকরণ করার কথা বলছেন?’ তিনি বললেন, “তবে আবার কার?”[3]
সাহাবী হুযাইফা ইবন ইয়ামান বলেন, ‘তোমরা অবশ্যই তোমাদের পূর্ববর্তী জাতির পথ অবলম্বন করবে জুতার মাপের মত (সম্পূর্ণভাবে)। তোমরা তাদের পথে চলতে ভুল করবে না এবং তারাও তোমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে চলতে ভুল করবে না। এমন কি তাদের কেউ যদি শুকনো অথবা নরম পায়খানা খায়, তাহলে তোমরাও (তাদের অনুকরণে) তা খেতে লাগবে[4]!’
তিনি মুসলিম জাতিকে সতর্ক করে বলেন, “সে ব্যক্তি আমার দলভুক্ত নয়, যে ব্যক্তি আমাদেরকে ছেড়ে অন্য কারো সাদৃশ্য অবলম্বন করে। তোমরা ইয়াহুদীদের সাদৃশ্য অবলম্বন করো না, আর খ্রিষ্টানদেরও সাদৃশ্য অবলম্বন করো না।”[5]
তাছাড়া রাসূল বলেন, ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানরা রোযা রাখে, কিন্তু সেহেরী খায় না। তাই ইসলাম তাদের অন্ধ অনুকরণ করে সেহেরী খাওয়া ত্যাগ করতে নিষেধ করল।[6]
রোযা রাখার পর ওরা ইফতার করে, কিন্তু বড্ড দেরী করে। ইসলাম তাদের অনুকরণ বর্জন করতে নির্দেশ দিয়ে সূর্য ডোবার সাথে সাথে সত্বর ইফতার করতে মুসলিম জাতিকে উদ্বুদ্ধ করল।[7]
সূর্য পূজকরা সূর্যের উদয় ও অস্তের সময় তার পূজা করে থাকে। তাই ঐ সময়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যেও নামায পড়াকে ইসলাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করল[8]।
যাতে মুশরিকদের সাথে তওহীদ বাদী মুসলিমদের কোনো প্রকার সাদৃশ্য ভাব না ফুটে ওঠে।
বৈরাগ্যবাদ বিজাতীয় আচার। ইসলামে তা নিষিদ্ধ হল।[9] পাশ্চাত্য-সভ্যতার ছোঁয়া লাগা মানুষ হীনমন্যতার শিকার হয়ে পশ্চিমা-বিশ্বের অনুকরণ করে। কাফেরদের বিভিন্নমুখী বিভব ও প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং পার্থিব উন্নয়ন দেখে মুসলিম নিজেদেরকে হেয় ও তুচ্ছজ্ঞান করে বসেছে। ভেবেছে, দুনিয়ায় ওরা যখন এত উন্নত, তখন ওদের সভ্যতাই হলো প্রকৃত সভ্যতা। সংকীর্ণ দৃষ্টিকোণে এটাই ধরে নিয়েছে যে, ওরা যেটা করে, সেটাই উত্তম ও অনুকরণীয়। ওদের মত করতে পারলে তারাও ঐরূপ উন্নতির পরশমণি হাতে পেয়ে যাবে। মনে করেছে যে, ওদের ঐ ছন্নছাড়া, লাগামছাড়া, বাঁধনহারা যৌন-স্বাধীনতাপূর্ণ জীবনই হলো ওদের উন্নতির মূল কারণ এবং প্রগতির মূল রহস্য।
>[2] আহমাদ ২/৫০, আবূ দাঊদ ৪০৩১, সহীহুল জামে’ ৬০২৫ নং
[3] বুখারী, মুসলিম ২৬৬৯, হাকেম, আহমাদ, সহীহুল জামে’ ৫০৬৭ নং
[4] ইবনে ওয়াদ্দাহ, আল-বিদাউ অন্নাহইয়ু ‘আনহা, নং ১৯৩; পৃ. ২/১৩৭।
[5] তিরমিযী, সহীহুল জামে, হাদিস; ২৬৯৫।
[6] মুসলিম, হাদিস: ১০৯৬।
[7] আবূ দাঊদ, হাদিস: ২৩৫৩, ইবনে মাজাহ, হাদিস: ১৬৯৮, হাকেম, হাদিস: ১/৪৩১
[8] মুসলিম, হাদিস: ৮৩২
[9] আবূ দাঊদ, হাদিস: ৪৯০৪
আকাশ সংস্কৃতির অগ্রাসন যুব সমাজ ধ্বংসের অন্যতম কারণ। আকাশ সংস্কৃতির কারণে, আজ মানুষ ঘরে বসেই সারা দুনিয়ার সব কিছুই অবলোকন করছে। ঘরে বসে নগ্ন, অর্ধ-নগ্ন, বেহায়াপনা, অশ্লীল গান-বাজনা, নাটক সিনেমা দেখে তারা তাদের নিজেদের মূল্যবান সময় নষ্ট করছে। যে সময়কে কাজে লাগিয়ে তারা তাদের ভবিষ্যৎ গঠন করতে পারত, তা না করে তারা তাদের নিজেদের ধ্বংস নিশ্চিত করছে। আকাশ সংস্কৃতির বিষাক্ত ছোবল আমাদের তরুণ সমাজকে প্রতিদিন নৈতিক অক্ষয়ের দিক নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের তথাকথিত সংস্কৃতি মনা নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, সাহিত্যিকদের কারণে আমাদের তরুণ সমাজ দিনের পর দিন নৈতিক অবক্ষয় ও ধ্বংসের অবলীলায় নিপতিত হচ্ছে। তাদের চরিত্র ধ্বংস করার পেছনে মূলত এসব নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার, সাহিত্যিকদের ভূমিকা বা অবদান অনেক বেশী। তারা তরুণ প্রজন্মকে চুরি, ডাকাতি, মাতা-পিতার অবাধ্যতা, ছেলে-মেয়ের অবাধ মেলা-মেশা ইত্যাদি শেখাচ্ছে। ভালো কিছু তারা জাতিকে দিতে পারেনি।
আকাশ সংস্কৃতির কারণে আজকাল আমরা দেশীয় সংস্কৃতি ভুলে বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়ছি, যার প্রভাব পড়ছে আজকাল তরুণদের মনে।
বিজাতীয় সংস্কৃতিতে মদ্যপানের ঘটনা অহরহ থাকে বিধায় আমাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এইসব বাজে জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। মসজিদে গিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করার থেকে DJ Party তে গিয়ে উদ্দাম নৃত্য, মাতলামি এবং বেহায়াপনায় তারা বেশী মনোযোগী হয়ে পড়ছে। নাট্যকার অথবা চলচ্চিত্রকাররাও সমাজের অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয়গুলো পর্দার মাধ্যমে তুলে ধরে মানুষের মাঝে জনসচেতনতা তৈরির করার চেয়ে কিভাবে তা মানুষের মাঝে অভ্যাসে পরিণত করা যায় সেই চেষ্টায় বেশী করে থাকে। ফলে নাটক সিনেমাগুলোর প্রধান বিষয়ই থাকে নারী পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা, অবাস্তব প্রেম ভালোবাসা, অশালীন গালিগালাজ, অবৈধ যৌনাচার। মনে হয় যেন এই ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনো ভালো বিষয় নেই। প্রেমের কারণে বাবা মাকে কিভাবে অপমান করতে সন্তান দ্বিধা-বোধ করেনা, তাই দেখানো হয়। ফলে তরুণ প্রজন্ম দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে আর সিনেমার দৃশ্য অনুসরণ করতে গিয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। বাবা মাকে খুশী করার চেয়ে আজকাল তরুণ তরুণীরা তাদের প্রিয়তম/প্রিয়তমার মন জোগাতে বেশী ব্যস্ত। ভালবাসার মানুষটির মন জোগানোর জন্য বাবার পকেট চুরি করা হচ্ছে নয়তো মায়ের টাকার পার্সে হানা দেওয়া হচ্ছে।
নগ্ন ও অশ্লীল গান-বাজনা যুব সমাজের চরিত্রকে কলুষিত করে তুলছে। যুব সমাজের চারিত্রকে হনন করার জন্যেই বর্তমানে গান-বাজনা, অশ্লীল, উলঙ্গ, অর্ধাউলঙ্গ ছবি ও নগ্ন নাটক-সিনেমার মহামারিকে সুপরিকল্পিতভাবে জাতির উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। হলিউড, বলিউড কিংবা ডালিউড ইত্যাদির প্রতি ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণে যুব সমাজ এক মহা বিপদের মুখোমুখি। তারা এ সব গান বাজনা শোনে এবং অশ্লীল দৃশ্য দেখে দেখে বাস্তব জীবনে নিজেদের তাদের মত করে সাজাতে ব্যস্ত। কিন্তু এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ তা তারা কোনোভাবেই অনুধাবন করতে পারছে না। যৌবনের সময়টা হল, একজন মানুষের ভবিষ্যৎ রচনা, ক্যারিয়ার গঠন ও যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার মুখ্য সময়। আর গান-বাজনা হল, মানুষকে তার ভবিয্যত লক্ষ্যে পৌছতে প্রতিবন্ধক এবং তাকে ফিরিয়ে রাখার মুখ্য উপকরণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَشۡتَرِي لَهۡوَ ٱلۡحَدِيثِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ ٱللَّهِ بِغَيۡرِ عِلۡمٖ وَيَتَّخِذَهَا هُزُوًاۚ أُوْلَٰٓئِكَ لَهُمۡ عَذَابٞ مُّهِينٞ ٦﴾ [لقمان: ٦]
“আর মানুষের মধ্য থেকে কেউ কেউ না জেনে আল্লাহর পথ থেকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য বেহুদা কথা খরিদ করে, আর তারা ঐগুলোকে হাসি-ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে, তারা ঐ সব লোক যাদের জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি”।[1]
বেশীর ভাগ তাফসীরকারক ‘লাহওয়াল হাদিস’ বলতে গানকে বুঝিয়েছেন। ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: এটা হচ্ছে গান। ইমাম হাসান বসরী র. বলেন: এটা গান ও বাদ্যের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে।
ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “গান অন্তরে মুনাফেকী সৃষ্টি করে, যেমনভাবে পানি ঘাস সৃষ্টি করে। যিকর অন্তরে ঈমান সৃষ্টি করে, যেমন পানি ফসল উৎপন্ন করে”।
আব্দুল্লাহ ইবন মসঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তিন তিনবার কসম খেয়ে বলেছেন, ‘উক্ত আয়াতে ‘অসার বাক্য’ বলতে ‘গান’কে বুঝানো হয়েছে। অনুরূপ বর্ণিত হয়েছে আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু এবং জাবের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু ও ইকরামা হতে।
গান হলো অসার, অবান্তর, অশ্লীল ও যৌন-উত্তেজনামূলক অথবা শির্কী ও বিদআতি কথামালাকে কবিতা-ছন্দে সুললিত ও সুরেলি কণ্ঠে গাওয়া শব্দ-ধ্বনির নাম। যা ইসলামে হারাম। হারাম তা গাওয়া এবং হারাম তা শোনাও। গানে হƒদয় উদাস হয়, রোগাক্রান্ত ও কঠোর হয়। গান হলো ‘ব্যভিচারের মন্ত্র’, অবৈধ ভালোবাসার আজব আকর্ষণ সৃষ্টিকারী যন্ত্র। তাই তো “মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নগ্নতা ও পর্দা-হীনতা এবং গানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন”।[2]
মিউজিক বা বাজনা শোনাও মুসলিমের জন্য বৈধ নয়। কারণ, বাজনা-ঝংকারও মানুষের মন মাতিয়ে তোলে, বিভোরে উদাস করে ফেলে এবং উন্মত্ততায় আন্দোলিত করে। ফলে তা সামাজিক অবক্ষয়, নীতি নৈতিকতার চন্দপতন ঘটায়। সবচেয়ে শুদ্ধ হাদিসের কিতাব বুখারী শরীফে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “অবশ্যই আমার উম্মতের মধ্যে এমন এক সম্প্রদায় হবে; যারা ব্যভিচার, (পুরুষের জন্য) রেশমবস্ত্র, মদ এবং বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার (হারাম হওয়া সত্ত্বেও) হালাল মনে করবে”।[3]
তিনি আরও বলেন, “অবশ্যই আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে, তাদের মাথার উপরে বাদ্যযন্ত্র বাজানো হবে এবং নর্তকী নাচবে। আল্লাহ তাদেরকে মাটিতে ধসিয়ে দেবেন এবং বানর ও শূকরে পরিণত করবেন[4]!”
তিনি আরও বলেন, “অবশ্যই আমার উম্মতের মাঝে (কিছু লোককে) মাটি ধসিয়ে, পাথর বর্ষণ করে এবং আকার বিকৃত করে (ধ্বংস করা) হবে। আর এ শাস্তি তখন আসবে, যখন তারা মদ পান করবে, নর্তকী রাখবে এবং বাদ্যযন্ত্র বাজাবে[5]।”
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, “অবশ্যই আল্লাহ আমার উম্মতের জন্য মদ, জুয়া, ঢোল তবলা এবং বীণা-জাতীয় বাদ্যযন্ত্রকে হারাম করেছেন[6]।” অন্য এক হাদিসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “ফিরিশতা সেই কাফেলার সঙ্গী হন না; যে কাফেলায় ঘণ্টার শব্দ থাকে[7]।” আর এক বর্ণনায় তিনি বলেন, “ঘণ্টা বা ঘুঙুর হলো শয়তানের বাঁশি[8]।”
>[2] আহমাদ, সহীহুল জামে, হাদিস: ৬৯১৪
[3] বুখারী, হাদিস: ৫৫৯০, আবূ দাঊদ, তিরমিযী, দারেমী, সহীহুল জামে হাদিস; ৫৪৬৬
[4] ইবনে মাজাহ, ইবনে হিব্বান, ত্বাবারানী, বাইহাকীর শুআবুল ঈমান, সহীহুল জামে হাদিস: ৫৪৫৪
[5] সহীহুল জামে’ ৩৬৬৫, ৫৪৬৭ নং
[6] আহমাদ, সিলসিলাহ সহীহাহ, হাদিস: ১৭০৮
[7] আহমাদ, সহীহুল জামে, হাদিস: ৭৩৪২
[8] মুসলিম, হাদিস: ২১১৪, আবূ দাঊদ, হাদিস: ২৫৫৬
জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য থাকতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ। পার্থিব উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন করা দ্বারা অর্জিত জ্ঞান মানবতার কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে না। আর যে জ্ঞান মানুষের মাঝে ও তার প্রভুর মাঝে সুসম্পর্ক তৈরি করে সে জ্ঞানই হল মানবতার কল্যাণ, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা এবং ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতের শান্তির গ্যারান্টি। কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য বর্তমানে যুব সমাজ যে জ্ঞান অর্জন বা শিক্ষা গ্রহণ করছে, তাও পার্থিব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই করছে। মানবতার কল্যাণ সাধন করার মত কোনো শিক্ষা তাদের পাঠ্য তালিকাতেই নেই। পশ্চিমা তথা বিজাতিদের অনুকরণে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও সেভাবেই সাজানো হয়েছে। ফলে মানুষের সাথে তাদের রবের সাথে সম্পর্ক না হয়ে আল্লাহর সাথে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, যা মানবতার জন্য বড় ধরনের শূন্যতা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ।
আবার অনেক সময় দেখা যাচ্ছে যে শরয়ী জ্ঞান বা দ্বীনী জ্ঞান দ্বারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করাই লক্ষ্য হওয়ার কথা, সে জ্ঞানকেও পার্থিব উদ্দেশ্যে অর্জন করা হচ্ছে অথবা দুনিয়াতে সু-খ্যাতি লাভ করার উদ্দেশ্যে অর্জন করা হচ্ছে। ফলে লোকটি দুনিয়াও আখিরাত উভয় জাহানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
«من تعلم علما مما يبتغى به وجه الله عز وجل لا يتعلمه إلا ليصيب به عرضا من الدنيا لم يجد عرف الجنة يوم القيامة»
যে ব্যক্তি এমন ইলম যা দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা হয় তা পার্থিব কোনো সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে শিখে, সে কিয়ামতের দিন জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না[1]।
>