লগইন করুন
একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হলো তার যৌবনকাল। যৌবনকালকে একজন মানুষের জীবনের স্বর্ণ যুগ বলা যেতে পারে। কিন্তু এ যৌবনকাল মানুষের জন্য যেমনি গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ। যৌবনকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ কাজ নয়, কিন্তু সম্ভব। সে সফল ব্যক্তি যে তার যৌবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং কাজে লাগাতে পারে।
একজন যুবকের জন্য ভাল থাকাটা খুবই চ্যালেঞ্জিং হলেও তার খারাপ হওয়াটা অত্যন্ত সহজ। কারণ, এ সময়টাতে একজন যুবককে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে অসংখ্য অশুভশক্তি। আমি এটাকে এভাবে প্রকাশ করি যে, কচুর পাতার পানি যেমন টলমল করে যে কোনো মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে, ঠিক তেমনি একজন যুবক যে কোনো সময় নষ্ট হয়ে যেতে পারে। যে কোনো সময় হয়ে যেতে পারে তার জীবনের সব কিছু এলোমেলো। বর্তমান সময়ে গোটা বিশ্বের দিক তাকালে আমরা দেখতে পাই, বর্তমানে যুবক শ্রেণি বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও সংকটে নিপতিত। তারা তাদের জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। তাই যুব সমাজকে সচেতন করা এবং তাদেরকে অশুভশক্তির করাল ঘ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য চেষ্টা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
নিম্নে আমরা যৌবনের গুরুত্ব, ইসলামের প্রচার-প্রসারে যুবকদের ভূমিকা এবং যুবক শ্রেণী ধ্বংসের বিভিন্ন উপকরণগুলো উল্লেখ করব, যাতে যুবকরা তাদের মূল্য উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং যে সব কারণে যুব সমাজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিপতিত হয়, সে সব কারণ থেকে দূরে থেকে তারা তাদের নিজেদের রক্ষা করতে পারে এবং ভয়াবহ পরিণতি হতে নিজেদের বাঁচাতে পারে।
একজন মানুষের যৌবনকালই হল, তার জীবনের স্বর্ণ যুগ এবং কর্ম সম্পাদন, ক্যারিয়ার গঠন ও নেক আমল করার মুখ্য সময়। এ সময়টিকে যে কাজে লাগাবে সে উন্নতি করতে পারবে। আর যে এ সময়টিকে হেলা-খেলায় নষ্ট করবে সে জীবনে কোনো উন্নতি করতে পারবে না। কারণ, মানুষের যৌবনকাল, দুটি দুর্বলতা- বাল্যকাল ও বার্ধক্য কাল-এর মাঝে একটি সবলতা বা শক্তি। সুতরাং এ সময়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া ও কাজে লাগানোর জন্য চেষ্টা করাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ এবং তার জীবনের সুবর্ণ সুযোগ। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«اغتنم خمسا قبل خمس: شبابك قبل هرمك، وصحتك قبل سقمك، وغناك قبل فقرك، وفراغك قبل شغلك، وحياتك قبل موتك »
“তোমরা পাঁচটি জিনিসকে পাঁচটি জিনিসের পূর্বে গণিমত-সুবর্ণ সুযোগ- মনে কর। তোমার যৌবনকে কাজে লাগাও বার্ধক্য আসার পূর্বে, তোমার সুস্থতাকে কাজে লাগাও তোমার অসুস্থতার পূর্বে, তোমার সচ্ছলতাকে কাজে লাগাও অসচ্ছলতার পূর্বে, তোমার অবসরতাকে কাজে লাগাও তোমার ব্যস্ততার পূর্বে, আর তোমার হায়াতকে কাজে লাগাও তোমার মৃত্যু আসার পূর্বে”।[1]
ইমাম আহমদ আহমদ রহ. বলেন, “আমি যৌবনকে এমন বস্তুর সাথেই তুলনা করি, যে বস্তুটি ক্ষণিকের জন্য আমার বগলের নীচে থাকে, তারপর তা হারিয়ে যায়”।
যৌবনকাল হল, ইবাদত বন্দেগী ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করার একটি মুখ্য সময়। এটি বেশি দিন স্থায়ী হয় না। যৌবন মানুষের জীবনে একজন আগন্তুক মেহমানের মত। সেটি মানুষের জীবনে একবার আসে আবার খুব দ্রুত চলে যায়। বুদ্ধিমান সে- যে তার যৌবনকে কাজে লাগায় এবং ভবিষ্যৎ জীবন তথা বার্ধক্যের জন্য পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করে। যদি কোনো বুদ্ধিমান যৌবনকে কাজে না লাগায়, তখন তার আফসোসের আর অন্ত থাকে না। তার আফসোস তাকে শেষ করে দেয়। কোনো কবি যৌবন সম্পর্কে বলেন,
ضيف زارنا أقام عندنا قليلا .. .. سوّد الصحف بالذنوب وولى
“যৌবন হল, একজন মেহমান যে আমাদের আঙ্গিনায় এসে কিছু সময় অবস্থান করল, তারপর সে গুনাহ দ্বারা আমলনামাকে কালো করল, অতঃপর পালিয়ে গেল”।
যৌবন মানুষের জীবনের একবারই আসে বার বার আসে না। একবার চলে গেলে তা আর কখনো ফিরে আসবে না। যৌবন কাজে না লাগিয়ে অবহেলায় নষ্ট করলে, যেমনিভাবে দুনিয়াতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে অনুরূপভাবে আখিরাতে আল্লাহর নিকট তার জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা কিয়ামতের দিন মানুষকে তার যৌবন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে বলবেন, তুমি তোমার যৌবনকে কোথায় ব্যয় করলে এবং কিভাবে তার ক্ষয় করলে। হাদিসে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لا تزول قدما ابن آدم يوم القيامة من عند ربه، حتى يُسأل عن خمس: عن عمره فيم أفناه؟ وعن شبابه فيم أبلاه؟ وعن ماله من أين اكتسبه وفيم أنفقه؟ وماذا عمل فيما علم؟"
“কিয়ামতের দিন পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ব্যতীত, কোনো আদম সন্তান আল্লাহর সম্মুখ হতে পা সরাতে পারবে না। তার জীবনকে কোথায় ব্যয় করেছে। যৌবনকে কোথায় ক্ষয় করেছে, সম্পদ কোথায় থেকে অর্জন করেছে এবং কোথায় ব্যয় করছে। আর যা জেনেছে, সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করছে”।[2]
وعدّ صلى الله عليه وسلم في السبعة الذين يظلهم الله في ظله يوم لا ظل إلا ظله: « شابا نشأ في عبادة الله".
আর যে যুবক তার যৌবনকে আল্লাহর ইবাদতে কাটিয়ে দেয়, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পর্কে বলেছেন, আল্লাহ কিয়ামতের দিন-যেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না-তাকে আল্লাহ স্বীয় ছায়ার তলে আশ্রয় দেবেন।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তা‘আলা একমাত্র যুবক বান্দাকে জ্ঞান দান করেন। যাবতীয় কল্যাণ যৌবনেই লাভ করা সম্ভব হয়। তারপর তিনি তার দাবির পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ হিসেবে আল্লাহ তা‘আলার বাণী তিলাওয়াত করে শোনান। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿قَالُواْ سَمِعۡنَا فَتٗى يَذۡكُرُهُمۡ يُقَالُ لَهُۥٓ إِبۡرَٰهِيمُ ٦٠﴾ [الانبياء: ٦٠]
“তাদের কেউ কেউ বলল, আমরা শুনেছি এক যুবক এই মূর্তিগুলোর সমালোচনা করে। তাকে বলা হয় ইবরাহিম”।[3]
﴿نَّحۡنُ نَقُصُّ عَلَيۡكَ نَبَأَهُم بِٱلۡحَقِّۚ إِنَّهُمۡ فِتۡيَةٌ ءَامَنُواْ بِرَبِّهِمۡ وَزِدۡنَٰهُمۡ هُدٗى ١٣ ﴾ [الكهف: ١٣]
“আমরা তোমাকে তাদের সংবাদ সঠিকভাবে বর্ণনা করছি। নিশ্চয় তারা কয়েকজন যুবক, যারা তাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমরা তাদের হিদায়েত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।”[4]
﴿يَٰيَحۡيَىٰ خُذِ ٱلۡكِتَٰبَ بِقُوَّةٖۖ وَءَاتَيۡنَٰهُ ٱلۡحُكۡمَ صَبِيّٗا ١٢ وَحَنَانٗا مِّن لَّدُنَّا وَزَكَوٰةٗۖ وَكَانَ تَقِيّٗا ١٣﴾ [مريم: ١٢، ١٣]
“হে ইয়াহইয়া, তুমি কিতাবটিকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধর’ আমরা তাকে শৈশবেই প্রজ্ঞা দান করেছি। আর আমাদের পক্ষ থেকে তাকে স্নেহ-মমতা ও পবিত্রতা দান করেছি এবং সে মুত্তাকী ছিল।”[5] হাফসা বিনতে সীরিন রহ. বলেন, “হে যুবক সম্প্রদায়! তোমরা কর্ম কর, কারণ, যৌবনকালই হল, কাজ করার উপযুক্ত সময়”। আহনাফ ইবনে কাইস রহ. বলেন, السودد مع السواد ‘নেতৃত্ব কালো থাকা অবস্থায়’ অর্থাৎ, যদি কোনো ব্যক্তি যৌবন কালে নেতা না হতে পারে, সে বুড়ো কালেও নেতা হতে পারবে না।
>[2] বর্ণনায় তিরমিযি, হাদিস: ২৪১৬; আল্লামা আলবানী হাদিসটিকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেন।
[3] সূরা আম্বিয়া, আয়াত: ৬০
[4] সূরা কাহাফ, আয়াত: ১৩
[5] সূরা মারয়াম, আয়াত: ১২, ১৩