যেসব কাজ, কথা ও বিশ্বাসে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি নেই এবং তিনি পছন্দও করেন না সেসব কিছু দ্বারা তাঁর নৈকট্য তালাশ করাই হচ্ছে নিষিদ্ধ উসীলা।
এসব নিষিদ্ধ উসীলায় আক্রান্ত হয়ে অনেকেই শরী‘আত অনুমোদিত উসীলা, যা করার প্রতি আল্লাহ তা‘আলা উৎসাহ দিয়েছেন, তা থেকে গাফেল হয়ে পড়েছে। ফলে তারা শরী‘আত অনুমোদিত উসীলা থেকে বিমুখ হয়ে পড়েছে এবং নিষিদ্ধ উসীলা অবলম্বনে ব্যস্ত থাকার কারণে শরী‘আতসম্মত উসীলা থেকে মাহরূম হয়েছে। ফলে তাদের সমস্ত চেষ্টাই নিষ্ফল ও যাবতীয় শ্রমই পণ্ড হচ্ছে।
মুসলিম ভাইদের কল্যাণকামিতা ও ইসলামের বাণীকে সর্বত্র প্রচার-প্রসার করার প্রত্যাশায় নিচে সে সব নিষিদ্ধ উসীলার কিছু প্রকারের বিবরণ পেশ করছি:
প্রথমত: কারো ব্যক্তিত্ব, সম্মান ও উঁচু অবস্থানের দোহাই দিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা:
আল্লাহর কোনো মাখলুকের সম্মানের দোহাই দিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা বিদ‘আত। যেমন, কেউ বললো, ‘হে আল্লাহ! তোমার নবীর মর্যাদা বা অমুক বান্দার সম্মান-মর্যাদার দোহাই দিয়ে আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি’। অনুরূপভাবে আল্লাহর নবীর অধিকার বা আল্লাহর কোনো বান্দার অধিকারের দোহাই দিয়ে প্রার্থনা করাও বিদ‘আতী উসীলা। এ ধরনের কোনো উসীলা ইসলামে নেই। না এটার বর্ণনা কুরআনে এসেছে, যে কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿مَّا فَرَّطۡنَا فِي ٱلۡكِتَٰبِ مِن شَيۡءٖ﴾ [الانعام: ٣٨]
“আমরা এ কিতাবে কোনো কিছুর বর্ণনা করতে ত্রুটি করি নি”, [সূরা আল-আন‘আম:৩৮] আর না এ জাতীয় উসীলা আল্লাহর নবীর কোনো হাদীসে এসেছে, অথচ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু স্পষ্ট বলেছেন বলেছেন:
«علمنا رسول اللهﷺ كل شيء حتى الخراء»
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে জীবনের সকল বিষয়েই শিক্ষা দান করেছেন, এমনকি পায়খানা-প্রস্রাব কীভাবে করতে হবে, সে পদ্ধতিও।”[1] আর না সাহাবায়ে কেরামের কারো কর্মকাণ্ডে এর নজির রয়েছে।
ইসলাম তো আল্লাহর সুন্দর নাম ও তাঁর মহৎ গুণ দিয়েই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছে।
উসীলা গ্রহণের এইসব বিদ‘আতী পদ্ধতি প্রার্থনাকারীকে ‘শির্কে আকবর’ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে, যদি প্রার্থনাকারী মনে করে যে, দুনিয়ার রাজন্যবর্গ বা আমীর-হাকীমদের মতো আল্লাহ তা‘আলাও মাধ্যমের মুখাপেক্ষী। এতে করে ‘খালেক’-কে মাখলুকের সঙ্গে তুলনা করা হয়, যেটা কোনোক্রমেই সঙ্গত নয়; আল্লাহকে কখনও তার সৃষ্টির সাথে কিয়াস করা যাবে না। বান্দার প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি যেমন কোনো মাধ্যমের দরকার হয় না, তেমনি বান্দার প্রতি তাঁর অসন্তোষের সামনেও কেউ অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম নয়।
মনে রাখবেন, মানুষ মর্যাদায় যতই শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হোক, তিনি ফিরিশতা, নবী বা রাসূল যেই হোন না কেন, আল্লাহর সঙ্গে তার কোনো তুলনা চলতে পারে না। মাখলুক, যতই সে উঁচু স্তরের হোক, সর্বদা সে মাখলুকই থাকে, খালেকের কাছে সর্ববিষয়ে সে মুখাপেক্ষী। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তিনি একক স্রষ্টা-খালেক, তিনি সর্ববিষয়ে অমুখাপেক্ষী। কোনো বিষয়ে যার কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন পড়ে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَمۡلِكُ لَهُمۡ رِزۡقٗا مِّنَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ شَيۡٔٗا وَلَا يَسۡتَطِيعُونَ ٧٣ فَلَا تَضۡرِبُواْ لِلَّهِ ٱلۡأَمۡثَالَۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ٧٤﴾ [النحل: ٧٣، ٧٤]
“তারা আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্তুর ইবাদত করে, যে তাদের জন্যে ভুমণ্ডল ও নভোমণ্ডল থেকে সামান্য রুযী দেওয়ারও অধিকার রাখে না এবং মুক্তিও রাখে না। অতএব, আল্লাহর কোনো সদৃশ সাব্যস্ত করো না, নিশ্চয় আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না”। [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৮৩-৮৪]
আর কারণেই সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পরে তাঁর দো‘আর উসীলা পরিত্যাগ করে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর দো‘আর উসীলা গ্রহণ করেছিলেন।
এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার, তা হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর উসীলা দেওয়ার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, তারা নবীর জীবদ্দশায় বলতেন, হে আল্লাহ! নবীর সম্মানে বৃষ্টি দিন বা নবীর মৃত্যুর পরে বলতেন না যে, হে আল্লাহ আব্বাসের সম্মানে আমাদের বৃষ্টি প্রদান করুন। কারণ, এ ধরনের বিদ‘আতী দো‘আ সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শিক্ষা লাভ করেন নি। আল্লাহর কিতাবেও এর কোনো ভিত্তি নেই। তাই তারা এ ধরনের উসীলা গ্রহণ থেকে বহু দূরেই ছিলেন। কারো মৃত্যুর পর যদি তার সম্মানের উসীলা দিয়ে প্রার্থনা করা জায়েয হতো, তাহলে তার সর্বাধিক হকদার ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এ ধরনের উসীলা গ্রহণ তো মূলত মক্কী যুগের মুশরিকদের শির্কেরই অনুরূপ। আল্লাহ তা‘আলা সে বিষয়ে পবিত্র কালামে বলেছেন:
﴿مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ﴾ [الزمر: ٣]
“আমরা তাদের উপাসনা করি না শুধু এ জন্য যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী অবস্থায় এনে দেবে। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩]বিষয়টি সত্যিই নাজুক। মানুষ যখন কোনো মানুষের ব্যক্তিত্ব বা তার সম্মান-ইজ্জতের দোহাই দিয়ে প্রার্থনা করে, তখন তার বিশ্বাস যদি এমন হয় যে, সে ব্যক্তি তার কোনো উপকার বা ক্ষতিতে ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে তা হবে পরিষ্কার বড় শির্ক এবং তা তাকে ইসলামের গণ্ডী থেকে তাকে বের করে দিবে। আল্লাহর কাছে আমরা আশ্রয় চাই।