প্রথমত: কারো ব্যক্তিত্ব, সম্মান ও উঁচু অবস্থানের দোহাই দিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা:

 যেসব কাজ, কথা ও বিশ্বাসে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি নেই এবং তিনি পছন্দও করেন না সেসব কিছু দ্বারা তাঁর নৈকট্য তালাশ করাই হচ্ছে নিষিদ্ধ উসীলা।

এসব নিষিদ্ধ উসীলায় আক্রান্ত হয়ে অনেকেই শরী‘আত অনুমোদিত উসীলা, যা করার প্রতি আল্লাহ তা‘আলা উৎসাহ দিয়েছেন, তা থেকে গাফেল হয়ে পড়েছে। ফলে তারা শরী‘আত অনুমোদিত উসীলা থেকে বিমুখ হয়ে পড়েছে এবং নিষিদ্ধ উসীলা অবলম্বনে ব্যস্ত থাকার কারণে শরী‘আতসম্মত উসীলা থেকে মাহরূম হয়েছে। ফলে তাদের সমস্ত চেষ্টাই নিষ্ফল ও যাবতীয় শ্রমই পণ্ড হচ্ছে।

মুসলিম ভাইদের কল্যাণকামিতা ও ইসলামের বাণীকে সর্বত্র প্রচার-প্রসার করার প্রত্যাশায় নিচে সে সব নিষিদ্ধ উসীলার কিছু প্রকারের বিবরণ পেশ করছি:

প্রথমত: কারো ব্যক্তিত্ব, সম্মান ও উঁচু অবস্থানের দোহাই দিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা:

আল্লাহর কোনো মাখলুকের সম্মানের দোহাই দিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করা বিদ‘আত। যেমন, কেউ বললো, ‘হে আল্লাহ! তোমার নবীর মর্যাদা বা অমুক বান্দার সম্মান-মর্যাদার দোহাই দিয়ে আমি তোমার নিকট প্রার্থনা করছি’। অনুরূপভাবে আল্লাহর নবীর অধিকার বা আল্লাহর কোনো বান্দার অধিকারের দোহাই দিয়ে প্রার্থনা করাও বিদ‘আতী উসীলা। এ ধরনের কোনো উসীলা ইসলামে নেই। না এটার বর্ণনা কুরআনে এসেছে, যে কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿مَّا فَرَّطۡنَا فِي ٱلۡكِتَٰبِ مِن شَيۡءٖ﴾ [الانعام: ٣٨]

“আমরা এ কিতাবে কোনো কিছুর বর্ণনা করতে ত্রুটি করি নি”, [সূরা আল-আন‘আম:৩৮] আর না এ জাতীয় উসীলা আল্লাহর নবীর কোনো হাদীসে এসেছে, অথচ আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু স্পষ্ট বলেছেন বলেছেন:

«علمنا رسول اللهﷺ كل شيء حتى الخراء»

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে জীবনের সকল বিষয়েই শিক্ষা দান করেছেন, এমনকি পায়খানা-প্রস্রাব কীভাবে করতে হবে, সে পদ্ধতিও।”[1] আর না সাহাবায়ে কেরামের কারো কর্মকাণ্ডে এর নজির রয়েছে।

ইসলাম তো আল্লাহর সুন্দর নাম ও তাঁর মহৎ গুণ দিয়েই আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছে।

উসীলা গ্রহণের এইসব বিদ‘আতী পদ্ধতি প্রার্থনাকারীকে ‘শির্কে আকবর’ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারে, যদি প্রার্থনাকারী মনে করে যে, দুনিয়ার রাজন্যবর্গ বা আমীর-হাকীমদের মতো আল্লাহ তা‘আলাও মাধ্যমের মুখাপেক্ষী। এতে করে ‘খালেক’-কে মাখলুকের সঙ্গে তুলনা করা হয়, যেটা কোনোক্রমেই সঙ্গত নয়; আল্লাহকে কখনও তার সৃষ্টির সাথে কিয়াস করা যাবে না। বান্দার প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি যেমন কোনো মাধ্যমের দরকার হয় না, তেমনি বান্দার প্রতি তাঁর অসন্তোষের সামনেও কেউ অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে সক্ষম নয়।

মনে রাখবেন, মানুষ মর্যাদায় যতই শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হোক, তিনি ফিরিশতা, নবী বা রাসূল যেই হোন না কেন, আল্লাহর সঙ্গে তার কোনো তুলনা চলতে পারে না। মাখলুক, যতই সে উঁচু স্তরের হোক, সর্বদা সে মাখলুকই থাকে, খালেকের কাছে সর্ববিষয়ে সে মুখাপেক্ষী। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তিনি একক স্রষ্টা-খালেক, তিনি সর্ববিষয়ে অমুখাপেক্ষী। কোনো বিষয়ে যার কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন পড়ে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَمۡلِكُ لَهُمۡ رِزۡقٗا مِّنَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ شَيۡ‍ٔٗا وَلَا يَسۡتَطِيعُونَ ٧٣ فَلَا تَضۡرِبُواْ لِلَّهِ ٱلۡأَمۡثَالَۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ وَأَنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ٧٤﴾ [النحل: ٧٣، ٧٤]

“তারা আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্তুর ইবাদত করে, যে তাদের জন্যে ভুমণ্ডল ও নভোমণ্ডল থেকে সামান্য রুযী দেওয়ারও অধিকার রাখে না এবং মুক্তিও রাখে না। অতএব, আল্লাহর কোনো সদৃশ সাব্যস্ত করো না, নিশ্চয় আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না”। [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৮৩-৮৪]

আর কারণেই সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পরে তাঁর দো‘আর উসীলা পরিত্যাগ করে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর দো‘আর উসীলা গ্রহণ করেছিলেন।

এখানে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার, তা হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর উসীলা দেওয়ার উদ্দেশ্য এটা নয় যে, তারা নবীর জীবদ্দশায় বলতেন, হে আল্লাহ! নবীর সম্মানে বৃষ্টি দিন বা নবীর মৃত্যুর পরে বলতেন না যে, হে আল্লাহ আব্বাসের সম্মানে আমাদের বৃষ্টি প্রদান করুন। কারণ, এ ধরনের বিদ‘আতী দো‘আ সাহাবায়ে কেরাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শিক্ষা লাভ করেন নি। আল্লাহর কিতাবেও এর কোনো ভিত্তি নেই। তাই তারা এ ধরনের উসীলা গ্রহণ থেকে বহু দূরেই ছিলেন। কারো মৃত্যুর পর যদি তার সম্মানের উসীলা দিয়ে প্রার্থনা করা জায়েয হতো, তাহলে তার সর্বাধিক হকদার ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এ ধরনের উসীলা গ্রহণ তো মূলত মক্কী যুগের মুশরিকদের শির্কেরই অনুরূপ। আল্লাহ তা‘আলা সে বিষয়ে পবিত্র কালামে বলেছেন:

﴿مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ﴾ [الزمر: ٣]

“আমরা তাদের উপাসনা করি না শুধু এ জন্য যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী অবস্থায় এনে দেবে। [সূরা আয-যুমার, আয়াত: ৩]বিষয়টি সত্যিই নাজুক। মানুষ যখন কোনো মানুষের ব্যক্তিত্ব বা তার সম্মান-ইজ্জতের দোহাই দিয়ে প্রার্থনা করে, তখন তার বিশ্বাস যদি এমন হয় যে, সে ব্যক্তি তার কোনো উপকার বা ক্ষতিতে ভূমিকা রাখতে পারে, তাহলে তা হবে পরিষ্কার বড় শির্ক এবং তা তাকে ইসলামের গণ্ডী থেকে তাকে বের করে দিবে। আল্লাহর কাছে আমরা আশ্রয় চাই।

[1] সহীহ মুসলিম
দ্বিতীয়ত: কোনো নেককার ওলী কিংবা পীর-বুযুর্গকে ডাকা, তাদের নামে ‘নজরনেওয়াজ’ মান্নত করা বা তাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা

কোন মৃত নেককার ওলী কিংবা পীর-বুযুর্গকে ডাকা, তাদের সম্মানের উসীলায় দো‘আ করা এবং তাদের জন্য নজরনেওয়াজ মান্নত করা -এটা স্পষ্টতঃই ইসলাম বহির্ভুত বিষয়; বরং তা বড় শির্ক ও তাওহীদ বিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত। যেমন, কেউ বললো, ‘হে খাজা বাবা, হে অমুক ওলী, এই অনুন্যোপায় ভক্তের হাতটি ধরুন, আমাকে সাহায্য করুন, আল্লাহর কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করুন, আমি আপনার আশ্রয়ে, আমি আপনার ও আল্লাহর ওপরে। এই যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিস্কার শির্কী কথাবার্তার অন্তর্ভুক্ত।

এইরূপে কোনো মৃত ব্যক্তির নামে নজর বা মান্নত করাও শরী‘আতসম্মত উসীলা নয়। অর্থাৎ এভাবে বলা যে, ‘খাজা বাবা’! যদি আল্লাহ আমাকে অমুক জিনিসটি মিলিয়ে দেন, তাহলে তোমার নামে এই জিনিস নজরনেওয়াজ দেবো। অথবা হে আমার ওলী, তোমার দরবারে এই হাদিয়া পেশ করবো। অথবা যদি আমি অমুক জিনিস হাসিল করতে পারি তাহলে তোমার জন্য এটা ওটা দিব। এই সবই ‘গাইরুল্লাহর’ জন্য মান্নত এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য ইবাদত করার শামিল। ফলে ইসলামের সঙ্গে এর সুদূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। আল্লাহ তা‘আলা এ সম্পর্কে বলেন:

﴿وَجَعَلُواْ لِلَّهِ مِمَّا ذَرَأَ مِنَ ٱلۡحَرۡثِ وَٱلۡأَنۡعَٰمِ نَصِيبٗا فَقَالُواْ هَٰذَا لِلَّهِ بِزَعۡمِهِمۡ وَهَٰذَا لِشُرَكَآئِنَاۖ فَمَا كَانَ لِشُرَكَآئِهِمۡ فَلَا يَصِلُ إِلَى ٱللَّهِۖ وَمَا كَانَ لِلَّهِ فَهُوَ يَصِلُ إِلَىٰ شُرَكَآئِهِمۡۗ سَآءَ مَا يَحۡكُمُونَ ١٣٦﴾ [الانعام: ١٣٦]

“আর তারা আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করে চাষাবাদ ও পশুপালন থেকে যা কিছু তারা উৎপাদন করেছে তার একাংশ এবং বলে-‘এই হচ্ছে আল্লাহর জন্য’ (তাদের ধারণা অনুযায়ী) ‘আর এটা হচ্ছে আমাদের অংশীদার দেবতাদের জন্য’। তারপর যা তাদের অংশী দেবতাদের জন্য, তা আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, আর যা আল্লাহর জন্য, তা পৌঁছে যায় তাদের অংশীদারদের কাছে। কী নিকৃষ্ট যা তারা সিদ্ধান্ত নেয়”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১৩৬]

কোনো মৃত বান্দার কাছে ধর্না দেওয়া, তার কাছে কিছু আশা করা, কিছু প্রার্থনা করা, তাদের কবরে গেলাফ চড়িয়ে মাজার বানানো, আগরবাতি, মোমবাতি জ্বালানো প্রভৃতি মুর্খতাসুলভ কর্মকাণ্ড না ছিল নবীর শিক্ষা, না সাহাবী ও তাবেঈগণের কর্মরীতি। বরং তারা বিশ্বাস করতো যে দো‘আ কেবল আল্লাহর দিকেই করতে হয়। যেমনটি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعۡوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ فَلۡيَسۡتَجِيبُواْ لِي وَلۡيُؤۡمِنُواْ بِي لَعَلَّهُمۡ يَرۡشُدُونَ ١٨٦﴾ [البقرة: ١٨٦]

“আর যখন বান্দারা আমার সম্পর্কে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, দেখ, আমি অতি নিকটে। আমি প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করি, যখন সে আমাকে আহ্বান করে। কাজেই তারা আমার প্রতি সাড়া দিক এবং আমার প্রতি ঈমান আনুক। যাতে তারা সুপথে চলতে পারে”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৬]

আর তাদেরকে তাদের নবী তাওহীদবাদীগণের সর্দার মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিখিয়েছিলেন যে, “দো‘আই হচ্ছে ইবাদত”।[1]

সুতরাং যে ইবাদতটি নিতান্তই আল্লাহ তা‘আলার জন্য খাস, সেটা অন্য কারো জন্য করা কী করে বৈধ হতে পারে?

জেনে রাখুন, উপরোক্ত যাবতীয় বিদ‘আতী কর্মকাণ্ডই তাওহীদ ও নবী-রাসূলগণের শিক্ষা-পরিপন্থী। নবী-রাসূলগণের শিক্ষা হলো, ইবাদত হবে শুধুমাত্র এক ও লা-শরীক আল্লাহর জন্য। এটা আল্লাহ ভিন্ন আর কারো জন্য হতে পারে না। তারা এটাও বলেছেন যে, আল্লাহ শুধুমাত্র খালেছ ও বিশুদ্ধ এবং শরী‘আত সমর্থিত ইবাদতই কবুল করেন। আল্লাহ তাঁর বান্দার সব গুনাহই ক্ষমা করেন, কিন্তু শির্ক তাঁর নিকট অমার্জনীয় অপরাধ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ وَيَغۡفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَآءُۚ وَمَن يُشۡرِكۡ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱفۡتَرَىٰٓ إِثۡمًا عَظِيمًا ٤٨﴾ [النساء: ٤٨]

“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। এছাড়া অন্য সব অপরাধ যাকে ইচ্ছা তিনি ক্ষমা করেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শরীক করে, সে এক বিরাট পাপ উদ্ভাবন করে। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৪৮]

>
[1] তিরমিযী
তৃতীয়ত: কোনো পীর-বুযুর্গের রূহের উদ্দেশ্যে প্রাণী জবাই করা এবং তাদের কবরের পাশে অবস্থান করা

বিভিন্ন পর্ব উপলক্ষে পীর-বুযুর্গদের মাযারে যবাই করা, ওরস আয়োজন করা, তাদের কবরের গম্বুজের কাছে অবস্থান করা এবং সে উপলক্ষে সেখানে অবস্থান করে শরী‘আত বিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া, অসুস্থ ব্যক্তিকে সেখানে সুস্থতা লাভের আশায় নিয়ে যাওয়া, সেখানে অবস্থান করা, কবরবাসী বুযুর্গের নিকট আরোগ্য চাওয়া, বিভিন্ন মনোবাঞ্ছা পূরণের আবেদন করা, তাদের কাছে দো‘আ চাওয়া, তাদের দ্বারা উদ্ধার কামনা করা প্রভৃতি ক্রিয়াকর্ম সম্পূর্ণ শরী‘আত বিরোধী ও কঠিন ভ্রষ্টতা। আল্লাহর দীন ইসলামে এসব কর্মকাণ্ডের কোনো অনুমোদন নেই। আল্লাহ এগুলো প্রবের্তন করেন নি। এগুলো তো আদতে ইসলামপূর্ব জাহেলী যুগের কর্মকাণ্ড এবং ইবাদতে আল্লাহর সঙ্গে স্পষ্ট শরীক নির্বাচন করা। অথচ আল্লাহ এ ধরণের শির্ক থেকে বান্দাদেরকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। আল্লাহ বলেন,

﴿وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗا﴾ [النساء: ٣٦]

“তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৬]

তিনি আরও বলেন,

﴿فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ﴾ [البقرة: ٢٢]

“অতএব, তোমরা আল্লাহর কোনো সমকক্ষ সাব্যস্ত করো না, অধিকন্তু তোমরা জান”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২] এ বাতিলে বারবার আমলকারী এবং তার স্বীকৃতি প্রদানকারী উভয়েই বিধানের দিক থেকে সমান। আর তা হচ্ছে আল্লাহর সাথে শির্ক করা।

শরী‘আতের এতো নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেখে অবাক হতে হয় যে, অনেক মুর্খ, যারা মুসলিম বলেই নিজেদের পরিচয় দেয়, উসীলা গ্রহণের কিতাব, সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মাহর প্রদর্শিত পথ পরিহার করে, নিজেদের মনগড়া পথ ও পন্থায় উসীলা গ্রহণ করছে। বরং তারা তাদের নিজেদের মনগড়া দো‘আ-অযীফার দিকে ধাবিত হচ্ছে, তারা এমনসব বিদ‘আতী উসীলা গ্রহণ করছে যা আল্লাহ তা‘আলা কখনো অনুমোদন করেন নি, তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কখনও ব্যবহার করেন নি আর উম্মতের সম্মানিত গ্রহণযোগ্য উত্তরসূরীদের থেকেও বর্ণিত হয় নি।

আমার প্রিয় ভায়েরা! এ বিদ‘আতী উসীলা অস্বীকার করার বিষয়টি শুধু আমাদের অভিমতই নয়, বরং এাই হচ্ছ দীনের মূল বিষয়, দীনের মধ্যে যে সব বিদ‘আত এসে পড়েছে সেসবই নিষিদ্ধ। বরং জেনে রাখুন, সাহাবী, তাবেঈন, চার ইমাম ও তাদের অনুসারীগণ এ অভিমতই পোষণ করতেন।

বর্ণিত ক্ষেত্রে মুসলিমদের পদস্খলনের কারণ:

প্রথম কারণ: উসীলা গ্রহণের ক্ষেত্রে মুসলিমদের একটি বিরাট অংশের এই দুঃখজনক পদস্খলনের অন্যতম কারণ হলো ‘তাকলীদ’। তাকলীদ অর্থ হলো, কারো এমন কোনো কথার অনুসরণ করা, যার পক্ষে বক্তার কাছে কোনো প্রমাণ নেই। এই ধরনের অনুসরণ শরী‘আতে নিষিদ্ধ। আর মুকাল্লিদ হলো, ঐ ব্যক্তি যে কোনো সুনির্দিষ্ট আলিম অনুসরণ করে ও তার মতামতের বাইরে যায় না। যদিও শরী‘আতের প্রমাণাদি তার মতামতের বিপরীত হয়।

আল্লাহ তা‘আলা এ ধরনের অনুসরণের নিন্দা করেছেন। আর আল-কুরআনের বহু আয়াতে তা থেকে নিষেধ করেছেন,

﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ ٱتَّبِعُواْ مَآ أَنزَلَ ٱللَّهُ قَالُواْ بَلۡ نَتَّبِعُ مَآ أَلۡفَيۡنَا عَلَيۡهِ ءَابَآءَنَآۚ أَوَلَوۡ كَانَ ءَابَآؤُهُمۡ لَا يَعۡقِلُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَلَايَهۡتَدُونَ ١٧٠﴾ [البقرة: ١٧٠]

“আর যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা অবতরণ করেছেন, তার অনুসরণ করো, তারা বলে, ‘না, আমরা বরং অনুসরণ করি তার, যার ওপর আমাদের পিতৃপুরুষদের দেখেছি। তারা কি তাদের পিতৃপুরুষদের (অন্ধ) অনুসরণ করবে, যদিও তারা ছিল অজ্ঞ এবং পথনির্দেশ কিছুই গ্রহণ করে নি?” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৭০]

পূর্ববর্তী বিজ্ঞ আলিম সমাজ ও মুজতাহিদগণও অন্ধ তাকলীদ করতে নিষেধ করে গেছেন। কারণ, অন্ধ তাকলীদ মুসলিমদের মাঝে পারস্পরিক দ্বন্ধ ও দুর্বলতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। যে কোনো বিরোধপূর্ণ বিষয়ে আল্লাহ ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রদর্শিত পথের অনুসরণের মধ্যেই রয়েছে মুসলিমদের ঐক্য ও শক্তি। এ কারণেই আমরা সাহাবীদের মধ্যে কাউকেই যাবতীয় বিষয়ে কোনো বিশেষ কারো অনুসরণ করতে দেখি না। তদ্রূপ চার ইমামের কাউকেও তাদের কাছে ভিন্ন কোনো মতের সত্যতা প্রকাশের পর নিজের মতের ওপরই অবিচল থাকতেও দেখি না। নিজেদের মতের বিপরীত যদি হাদীসের কোনো প্রমাণ তারা পেতেন, তো নির্বিবাদে তা গ্রহণ করে নিতেন। তাছাড়া অন্যদেরকেও তারা কোনো দলীল-প্রমাণ না বুঝে অন্ধের মতো তাদের অনুসরণ করতে নিষেধ করতেন। তারা পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত বাণীটি সম্পর্কে সম্মকরূপে অবগতই ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ٱتَّبِعُواْ مَآ أُنزِلَ إِلَيۡكُم مِّن رَّبِّكُمۡ وَلَا تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِۦٓ أَوۡلِيَآءَۗ قَلِيلٗا مَّا تَذَكَّرُونَ ٣﴾ [الاعراف: ٣]

“তোমাদের রবের কাছ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে তা অনুসরণ করো। আর তাঁকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। তোমরা খুব অল্পই মনে রাখো।” [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৩]

দ্বিতীয় কারণ: এই ভ্রষ্টতার দ্বিতীয় কারণ হলো, আয়াতে কুরআন বা হাদীসে রাসূলের কিছু গ্রহণ ও কিছু বর্জন। এর ফলে তারা নিজেদের মতামতের পক্ষে জোরালো কোনো প্রমাণ পেশ করতে তো সক্ষম হচ্ছেই না, বরং ক্ষেত্র বিশেষে কুরআনের সঠিক মর্ম ও তাফসীরও উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আয়াতের প্রকৃত মর্ম থেকে সরে গিয়ে সুদূরতম কোনো অপব্যাখ্যার মাধ্যমে নিজেদের মত প্রমাণের অপচেষ্টা করছে। সে রকমই একটি আয়াত হলো:

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱبۡتَغُوٓاْ إِلَيۡهِ ٱلۡوَسِيلَةَ﴾ [المائ‍دة: ٣٥]

“ওহে যারা ঈমান এনেছো, আল্লাহকে ভয় করো এবং তার দিকে উসীলা অন্বেষণ করো”। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৩৫]

এখানে উসীলা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ সন্তুষ্ট হন এমন আমল দ্বারা তার নৈকট্য অর্জন করা। এ তাফসীর বিষয়ে তাফসীরবিদদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। এখন এই আয়াত দিয়ে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার বৈধতা দানের চেষ্টা করা মূল বিষয় থেকে ‘তাহরীফ’ তথা কুরআনের মর্ম বিকৃতির চেষ্টা ছাড়া আর কী হতে পারে? তাহলে বুঝা গেল যে আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা যে উসীলার নির্দেশ দিয়েছেন তা হচ্ছে, সৎকাজ ও যা আল্লাহকে সন্তুষ্ট করে এমন কাজের দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য প্রার্থনা করা। এ তাফসীরের ব্যাপারে তাফসীরকারগণের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই।

অনুরূপভাবে আরও যে বিশুদ্ধ হাদীসটি বুঝার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে সমস্যা হয়েছে তা হচ্ছে, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর দো‘আর উসীলা গ্রহণের বিষয়টি, যার বর্ণনা পূর্বে চলে গেছে। প্রতিপক্ষ এ সম্পর্কে বলতে চায়, আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকটাত্মীয় হওয়ার কারণেই উমার তার উসীলা গ্রহণ করেছিলেন। তাদের উত্তরে আমরা বলবো, মু‘আবিয়া রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যে বৃষ্টির জন্য ইয়াযীদ ইবনুল আসওয়াদ আল-জুরাশীর মতো ব্যক্তির উসীলা গ্রহণ করেছিলেন, সেটা কোন শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে? অথচ জুরাশী দো‘আও করেছিলেন এবং সেই দো‘আ কবুলও হয়েছিল এবং আল্লাহ বৃষ্টিও বর্ষণ করেছিলেন।

আরো আছে, এক অন্ধের হাদীস। যেই অন্ধ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে তার জন্য দো‘আর আবেদন করে বলেছিলো, ‘আপনি আমার জন্য দো‘আ করুন, তিনি যেন আমাকে সুস্থতা দান করেন।’ জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, ‘তুমি চাইলে আমি দো‘আ করবো, আর চাইলে তুমি ধৈর্যও ধারণ করতে পারো। সেটাই হবে তোমার জন্য উত্তম।’ লোকটি বললো, আপনি আমার জন্য দো‘আই করুন। ফলে নবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উত্তমরূপে অযু করে আসতে বললেন। তারপর এইভাবে দো‘আ করতে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার রহমতের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বারা আপনার স্মরণাপন্ন হচ্ছি। হে মুহাম্মদ! আমি আপনার দ্বারা আমার প্রয়োজন পূরণের জন্য আমার রবের সামনে মুখ ফিরাচ্ছি। হে আল্লাহ! আমার ব্যাপারে তাঁর সুপারিশ গ্রহণ করুন।’ ফলে লোকটি এমনভাবে ফিরে আসলো যে, তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়েছে।

এই হাদীসের মর্ম খুবই স্পষ্ট। লোকটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তার জন্য দো‘আ করার আবেদন জানিয়েছে এবং পাশাপাশি আল্লাহর কাছে এই দো‘আও করেছে, যেন তিনি তাঁর রাসূলের দো‘আ কবুল করেন। কারণ লোকটি বলেছিল, “হে আল্লাহ! আমার ব্যাপারে তাঁর সুপারিশ গ্রহণ করুন”।

তৃতীয় কারণ: এই জাতীয় ভ্রষ্টতার তৃতীয় কারণ হলো, দুর্বল ও বানোয়াট হাদীসের ওপর আমল। যে হাদীসগুলোর কোনো ভিত্তি নেই এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা মূল দ্বীনের সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। উদাহরণস্বরূপ নিম্নে আমরা তার দু’একটি উল্লেখ করছি:

যেমন, একটি হাদীস এরকম বলা হয়, ‘তোমরা আমার উচ্চ মর্যাদার উসীলা গ্রহণ করো। কারণ, আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমার মর্যাদা অনেক সুউচ্চ।’

আরেকটি হাদীস এ রকম বর্ণনা করা হয়েছে, ‘আদম আ. যখন ভুল করে ফেললেন, তিনি আল্লাহর নিকট এই বলে ক্ষমা চাইলেন, ‘হে রব! আমি আপনার নিকট মুহাম্মাদের উসীলা দিয়ে ক্ষমা চাইছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। তখন তাকে বলা হলো, আমি তো মুহাম্মাদকে সৃষ্টিই করি নি, তুমি তার কথা জানলে কী করে? তখন আদম আ. বললেন, হে রব! যখন আপনি আমাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করলেন এবং আমার দেহে আপনার রূহ ফুঁকে দিলেন, আমি মাথা উঠিয়ে দেখতে পেলাম, আপনার ‘আরশের পায়ায় লিপিবদ্ধ রয়েছে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্’। তখন আমি বুঝতে পারলাম, আপনার নিকট অত্যাধিক প্রিয় না হলে এই নামটি আপনি আপনার নামের সঙ্গে জুড়ে দিতেন না। তখন আল্লাহ বললেন, ‘যদিও আমি এখনও মুহাম্মদকে সৃষ্টি করি নি, তবুও তোমাকে আমি ক্ষমা করে দিলাম।’

ইমাম যাহাবী রহ. উপরোক্ত বর্ণনাটি সম্পর্কে বলেছেন, এটা একটি বাতিল ও মাওদু‘ হাদীস।

আরো একটি বর্ণনা আছে, ‘যে ব্যক্তি সালাতের জন্য বাড়ি থেকে বের হলো এবং বললো:

اللهم إني أسألك بحق السائلين عليك، وأسألك بحق ممشاي هذا ...

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যা ও ইমাম যাহাবী এই হাদীসটিকে দুর্বল বলে মত ব্যক্ত করেছেন।

সর্বশেষ আমাদের বক্তব্য হলো, তওহীদপন্থী সকলের কর্তব্য হচ্ছে উসীলার এমন সব পদ্ধতি বর্জন করে চলা, যেগুলো অবলম্বন করলে কোনটি দ্বারা ‘শির্কে আকবর’ (বড় শির্ক), কোনটি দ্বারা ‘শির্কে আসগর’ (ছোট শির্ক) বা কোনটির কারণে হারাম বিদ‘আতের শিকার হতে হয়। তাছাড়া তা দো‘আতে সীমালঙ্ঘনের অন্তর্ভুক্ত। আর এ কারণেই আমাদের অনেক দো‘আ নিষ্ফল হয়ে থাকে। কেননা, আল্লাহ তা‘আলা তো কেবল শরী‘আত সম্মত দো‘আই কবুল করেন।

অনুরূপভাবে প্রত্যেক তাওহীদবাদী মুসলিমের উচিৎ কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত শব্দ ও বাক্য দিয়েই দো‘আ করা। কেননা, সেসব দো‘আই গ্রহণযোগ্য হবার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে এবং ঐসব বাক্য দ্বারা দো‘আ করার ফলে পূণ্য ও সাওয়াব পাওয়ারও আশা রয়েছে।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৪ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে