আহলে সুন্নাতের উলামায়ে কিরাম উসীলাকে দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন।
১। শরী‘আত অনুমোদিত উসীলা ও
২। শরী‘আত নিষিদ্ধ উসীলা।
শরী‘আত অনুমোদিত উসীলা ও তার প্রকার:
শরী‘আত অনুমোদিত উসীলা হলো, যেসব ওয়াজিব ও মুস্তাহাব ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট হন এবং যেসব ইবাদত তিনি পছন্দ করেন, সেসবের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা। ঐ ইবাদত চাই মৌখিক হোক বা কর্মের মাধ্যমে পালনীয় হোক বা বিশ্বাস সংক্রান্ত হোক। শরী‘আত অনুমোদিত উসীলাকে আমরা তিনটি ভাগে বিভক্ত করতে পারি:
১. উসীলাসমূহের অন্যতম ও শ্রেষ্ঠতম ও বান্দার জন্য সবচেয়ে উপকারী উসীলা হলো, আল্লাহ তা‘আলার সুন্দরতম নামসমূহ এবং তাঁর সমুচ্চ গুণাবলীর উসীলা গ্রহণ করা। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ ﴾ [الاعراف: ١٨٠]
“আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম, তোমরা তাঁকে সে নামে ডাকো”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৮০] অর্থাৎ আল্লাহকে তাঁর সুন্দর নামসমূহের উসীলায় আহ্বান কর।
উপরোক্ত আয়াতটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাঁর কোনো নাম বা গুণের উসীলায় প্রার্থনা করা বৈধ। আরও প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তা‘আলার কোনো নাম বা তাঁর গুণের উসীলায় তাঁর নিকট প্রার্থনা করা আল্লাহ তা‘আলা অনেক পছন্দ করেন। আর এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এভাবে প্রার্থনা করেছেন। কাজেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন ও তাবে-তাবেঈগণ যে পদ্ধতিতে ও যে উসীলায় রাব্বুল আলামীনের দরবারে প্রার্থনা করেছেন, তা যে আমাদের জন্যও প্রার্থনার একটি অনুমোদিত পন্থা, তাতে সন্দেহ নেই।
২. প্রার্থনাকারী তার কোনো নেক আমলের উসীলায় প্রার্থনা করা। যেমন, কেউ বলতে পারে, হে আল্লাহ! আপনার প্রতি আমার ঈমান ও বিশ্বাস, ভালোবাসা ও মহব্বত এবং আপনার রাসূলের প্রতি ঈমান ও আনুগত্যের উসীলায় আমার পেরেশানী দূর করে দিন। এইরূপে প্রার্থনাকারী তার অন্যান্য এমনসব নেক আমলের কথা উল্লেখ করে সেগুলো উসীলায় প্রার্থনা করতে পারে, যে নেক আমলগুলো সে একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সম্পন্ন করেছে। যেমন, আল্লাহর প্রতি ঈমান, সালাত, সাওম, জিহাদ, তিলাওয়াতে কুরআন, যিকির, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি দুরূদ, ইস্তেগফার, এইরূপে অন্য যে কোনো নেক আমল ও গুনাহ থেকে আত্মরক্ষার কথাই উসীলা হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
উসীলার উল্লিখিত পদ্ধতিটির বৈধতার প্রমাণ পবিত্র কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে পাওয়া যায়:
﴿ٱلَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَآ إِنَّنَآ ءَامَنَّا فَٱغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ ٱلنَّارِ ١٦﴾ [ال عمران: ١٦]
“যারা বলে, হে আমাদের রব! আমরা ঈমান এনেছি, সুতরাং আমাদের অন্যায়-অপরাধ ক্ষমা করে দিন এবং আমাদেরকে জাহান্নামের ‘আযাব থেকে রক্ষা করুন”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৬]
হাদীসে পূর্ব যুগের এ ধরনের একটি ঘটনাও বর্ণিত রয়েছে। সেখানে উল্লেখ আছে, তিন ব্যক্তি একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলো; কিন্তু ঘটনাক্রমে একখণ্ড পাথর গড়িয়ে এসে তাদের গুহামুখ বন্ধ করে দেয়। ফলে সেখান থেকে মুক্তির আর কোনো উপায় না দেখে, তারা তিনজনই নিজ নিজ ধারণা অনুযায়ী নিজেদের সর্বোৎকৃষ্ট আমলের কথা উল্লেখ করে সে উসীলায় আল্লাহ তা‘আলার নিকট এই বিপদ থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা জানায়। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের পেরেশানী দূর করেন ও বিপদ থেকে মুক্তি দেন।[1]
৩. কেউ খুব কঠিন বিপদে পতিত হলো, কিন্তু নিজের আমলের দুর্বলতার দরুন নিজের দো‘আর ওপর তার ভরসা নেই। তাই আল্লাহর জীবিত কোনো প্রিয় বান্দা, যার তাকওয়া-পরহেজগারী এবং কুরআন-সুন্নাহর জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে তার আস্থা রয়েছে, এমন কারো কাছে গিয়ে তার বিপদ-মুক্তি ও সমস্যা উত্তরণের জন্য দো‘আর আবেদন জানানো, এটিও উসীলার শরী‘আত অনুমোদিত একটি পন্থা; শরী‘আত তার ওপর প্রমাণ দিচ্ছে এবং তা করার দিক-নির্দেশনা দিচ্ছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ جَآءُو مِنۢ بَعۡدِهِمۡ يَقُولُونَ رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لَنَا وَلِإِخۡوَٰنِنَا ٱلَّذِينَ سَبَقُونَا بِٱلۡإِيمَٰنِ﴾ [الحشر: ١٠]
“হে আল্লাহ! আমাদেরকে এবং আমাদের যে সকল মুমিন ভাই ইতোপূর্বে গত হয়েছেন, তাদেরকে ক্ষমা করে দিন”। [সূরা আল-হাশর, আয়াত: ১০]
হাদীসে বর্ণিত আছে:
«دَعْوَةُ الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ لِأَخِيهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ مُسْتَجَابَةٌ»
“কোনো মুমিন ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য কোনো মুমিনের দো‘আ আল্লাহ কবুল করেন”।[2]
এ মর্মেরই একটি হাদীস রয়েছে যা আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, মদীনায় যখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিত, উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর কাছে গিয়ে বৃষ্টির জন্য দো‘আ করতে বলতেন। সুতরাং উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন, ‘হে আল্লাহ! ইতঃপূর্বে আমরা আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উসীলায় আপনার নিকট বৃষ্টি প্রার্থনা করতাম এবং আপনি বৃষ্টি বর্ষণ করতেন। এখন আমরা আপনার নিকট নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচার উসীলা দিয়ে প্রার্থনা করছি, আপনি আমাদের প্রতি বারি বর্ষণ করুন। ফলে বৃষ্টিপাত হতো।[3]
উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর বক্তব্যের উদ্দেশ্য হলো, ‘আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে আমাদের জন্য দো‘আ আবেদন করতাম এবং নবীর দো‘আর দ্বারা আমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতাম; কিন্তু নবী তো এখন আর আমাদের মাঝে বিদ্যমান নেই। তিনি তো উচ্চ বন্ধুদের কাছে চলে গিয়েছেন। আমাদের জন্য তিনি দো‘আ করবেন, এটা এখন আর সম্ভব নয়। কাজেই আমরা এখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা আব্বাসের নিকট এসেছি এবং তার নিকট আমাদের জন্য দো‘আ করার আবেদন করছি।’
উপরোক্ত পদ্ধতি তিনটিই হলো উসীলা গ্রহণের শরী‘আতসম্মত পদ্ধতি। এ ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতির পক্ষে শরী‘আতের কোনো অনুমোদন নেই। তবে বর্ণিত পদ্ধতিত্রয় হুকুমের দিক থেকে একই পর্যায়ভুক্ত নয়। তন্মধ্যে কিছু আছে ওয়াজিব উসীলা, যেমন: আল্লাহর নাম, তাঁর সিফাত এবং ঈমান ও তাওহীদ, এগুলোর উসীলা দেওয়া। অন্যদিকে কিছু আছে মুস্তাহাব উসীলা; যেমন, যে কোনো নেক আমল এবং নেক বান্দাদের দ্বারা কৃত দো‘আর উসীলা।কাজেই মুসলিমের ওপর কর্তব্য হচ্ছে, বিপদ-আপদ ও বালা-মুসিবতের সময় একমাত্র আল্লাহর নিকট বৈধ উসীলার মাধ্যমে নৈকট্য অর্জন করা। আর অন্তরে আল্লাহর ভয়, তাঁর প্রতি যথাযথ লজ্জা ও তাঁর প্রতি আনুগত্যের অনুভুতি নিয়ে গোনাহ ও বিদ‘আতের পথ পরিত্যাগ করা।
>[2] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৭৩৩
[3] সহীহ বুখারী