ইবন জারীর আত-ত্ববারী রহ. বলেন, “তাওয়াক্কুল’ -এর সঠিক মানে হলো: বান্দাকে তার দীন ও দুনিয়ার ব্যাপারে চেষ্টা-তদবির করার যে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ চেষ্টা-সাধনা করার পর তার কর্তৃক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি দৃঢ় আস্থা পোষণ করা, কাজ-কারবারে তাঁর ওপর ভরসা করা এবং এর সবকিছু তাঁর প্রতি ন্যস্ত করা।”[1]
আর ইবনুল কাইয়্যেম রহ. বলেন, “তাওয়াক্কুল’ হলো বান্দাকে তার দীন ও দুনিয়ার ব্যাপারে যা উপকৃত করে তা অর্জন করার ক্ষেত্রে এবং তার দীন ও দুনিয়ার ব্যাপারে যা ক্ষতি করে তা প্রতিরোধ করার ব্যাপারে আল্লাহর ওপর হৃদয়-মন দিয়ে নির্ভর করা, আর এ নির্ভরতার সাথে সরাসরি উপায়-উপকরণের অবলম্বনও জরুরি।”[2]
সুতরাং ‘তাওয়াক্কুল’ হলো আল্লাহর ওপর ভরসা, তাঁর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁর শরণাপন্ন হয়ে এবং তাঁর ওপর সবকিছু ন্যস্ত করার মধ্য দিয়ে অন্তরের কাজ ও ইবাদত করার নাম। আরও থাকবে বান্দা কর্তৃক ঐ বিষয়ের প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর দক্ষতাপূর্ণ জ্ঞানে ও সুন্দর পছন্দে তাঁর বান্দার জন্য যা ফয়সালা করেছেন; যখন সে তার বিষয়টি তাঁর ওপর ন্যস্ত করে, তবে সাথে সাথে তাকে নির্দেশিত উপায়-উপকরণ ব্যবহার করতে হবে এবং তা অর্জনের ব্যাপারে তার চেষ্টা-সাধনা থাকতে হবে।
‘তাওয়াক্কুল’ -এর স্বরূপ হচ্ছে: উপায়-উপকরণের ব্যবহার এবং অন্তর দ্বারা উপায়-উপকরণের মালিক আল্লাহর ওপর নির্ভর করা।[3]
‘তাওয়াক্কুল’ -এর গুরুত্বের পক্ষে দলীল হলো: আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁর নবীকে সুস্পষ্টভাবে তাঁর ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ করার নির্দেশ প্রদান করা, যেখানে তিনি বলেছেন:
فَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِۖ إِنَّكَ عَلَى ٱلۡحَقِّ ٱلۡمُبِينِ
“সুতরাং আল্লাহর ওপর নির্ভর করুন; আপনি তো স্পষ্ট সত্যে প্রতিষ্ঠিত।” [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৭৯] আর এ একই নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে আল-কুরআনুল কারীমের আরও নয়টি জায়গায়; আর এর মধ্যে তিনি তাঁর মুমিন বান্দাগণকে তা অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন; আর এটাই হলো শরী‘আতসম্মত ‘তাওয়াক্কুল’, আর এটা এমন ‘তাওয়াক্কুল’, যা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দ্বারা উপায়-উপকরণ গ্রহণ করার বিষয়টিকে দাবি করে এবং আরও দাবি করে উপায়-উপকরণের মালিক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার ওপর হৃদয়-মনের নির্ভরতা। এ মাসয়ালাতে এটাই হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মত। আর এটাই সঠিক ও বাস্তব, যার পক্ষে প্রমাণ পেশ করে শরী‘আতের বক্তব্যগুলো এবং যুক্তিভিত্তিক দলীলসমূহ। সুতরাং আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী ‘মুতাওয়াক্কিল’ (আল্লাহর ওপর ভারসাকারী) ব্যক্তি (শুধু) উপায়-উপকরণের প্রতি মনোযোগ দেয় না, অর্থাৎ সে শুধু উপায়-উপকরণে নিশ্চিন্ত থাকে না, তার আশায় বসে থাকে না এবং তার ভয়ও করে না; ঠিক যেমনিভাবে সে উপায়-উপকরণ থেকে বিরতও থাকে না, ফলে সে তাকে ফেলে দেয় না, অবহেলা করে না এবং তাকে বাদ দেয় না; বরং সে মনোযোগ দিয়ে তা অবলম্বন করে, দৃষ্টি রাখে তার (উপায়-উপকরণের) স্রষ্টা ও পরিচালক আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার প্রতি[4]।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَأَعِدُّواْ لَهُم مَّا ٱسۡتَطَعۡتُم
“আর তোমরা তাদের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য প্রস্তুতি রাখ।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৬০]
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«اعْقِلْهَا وَتَوَكَّلْ»
“তাকে (উটটিকে) বেঁধে নাও এবং (আল্লাহর ওপর) ভরসা করা।”[5] আর এটাই ছিল ‘তাওয়াক্কুল’-এর ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের হিদায়াত বা নির্দেশনা, তারা ছিলেন ‘তাওয়াক্কুল’ -এর দিক থেকে সবচেয়ে বেশি পরিপূর্ণ নৈতিক চরিত্রের অধিকারী, আর তাঁদের হিদায়াত ও নির্দেশনার ওপরই জীবন চালিয়েছেন তাঁদের পরে আগত প্রজন্মসমূহ।
শরী‘আতসম্মত এ ‘তাওয়াক্কুল’ -এর বিপরীতে রয়েছে আরেক প্রকার ‘তাওয়াক্কুল’, যা শরী‘আতসম্মত নয়, আর তা হলো আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ (ভরসা) করা। আর তা দুই প্রকার:
১. এমন বিষয় বা কাজে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ (ভরসা) করা, যা সমাধানের ব্যাপারে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ছাড়া অন্যের কোনো ক্ষমতা নেই। যেমন, ঐসব ব্যক্তিবর্গ, যারা তাদের সাহায্য, রিযিক ও শাফা‘আতের দাবি পূরণের ব্যাপারে মৃতব্যক্তি ও ‘তাগুত’ (শয়তান)-এর ওপর ভরসা করে। বস্তুত এটা হলো বড় মাপের শির্ক, শির্কে আকবার।[6] এ প্রকারের ‘তাওয়াক্কুল’-কে ‘তাওয়াক্কুল আস-সির’ বা ‘গোপন তাওয়াক্কুল’ নামে অভিহিত করা হয়। কারণ, এ জাতীয় ‘তাওয়াক্কুল’ শুধু এমন ব্যক্তির পক্ষ থেকেই হয়ে থাকে, যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, সৃষ্টিজগতের মধ্যে এ মৃতব্যক্তির কোনো গোপন ক্ষমতা রয়েছে।[7]
২. এমন বিষয় বা কাজে আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্যের ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ করা, যা সমাধানের ব্যাপারে তার ধারণা অনুযায়ী ভরসাকৃত ব্যক্তি ক্ষমতা রাখে। বস্তুত এটা ছোট শির্ক[8]। এর দৃষ্টান্ত হলো: “দৃশ্যমান স্বাভাবিক উপায়-উপকরণে ‘তাওয়াক্কুল’ করা। যেমন, কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কোনো নেতা বা শাসকের ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ করা, যার হাতে আল্লাহ ‘রিযিক’ সরবরাহ অথবা দুঃখ-কষ্ট বা অসুবিধা দূর করার অথবা এর মত কোনো ক্ষমতা দিয়েছেন। তখন এটা হালকা বা ছোট মানের শির্ক বলে গণ্য হবে।”[9]
হজের পাথেয় বর্জন করা তথা উপায়-উপকরণ পুরোপুরি বর্জন করাটা শরী‘আতসম্মত ‘তাওয়াক্কুল’-এর অন্তর্ভুক্ত নয়, আর আলিমগণের ঐক্যবদ্ধ রায় হলো; মুসলিম ব্যক্তির ওপর (শারীরিক ও আর্থিক) সামর্থ্য ছাড়া হজ আবশ্যক হয় না। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
وَلِلَّهِ عَلَى ٱلنَّاسِ حِجُّ ٱلۡبَيۡتِ مَنِ ٱسۡتَطَاعَ إِلَيۡهِ سَبِيلٗاۚ
“আর মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৯৭]
ইবনু কুদামা রহ. বলেন, (পাঁচটি শর্ত পূরণের মাধ্যমে হজ আবশ্যক হয়, তারপর তিনি তা উল্লেখ করেছেন তন্মধ্যে) অন্যতম একটি শর্ত হলো সামর্থ্য।[10] এ শর্তে বর্ণিত সামর্থ্য দ্বারা উদ্দেশ্য হলো: পাথেয় ও যাতায়াত ব্যবস্থা অবলম্বন করা।
ইবন কুদামা রহ. বলেন, ‘আর সামর্থ্য হলো: পাথেয় ও যানবাহনের মালিক হওয়া।’[11]
সামর্থ্য এর উক্ত ব্যাখ্যার দলীল হলো, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক প্রদত্ত জবাব, যখন তাঁর নিকট জনৈক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল:
«مَا يُوجِبُ الحَجَّ ؟ قال : الزادُ والراحلةُ»
“কিসে হজকে আবশ্যক করবে? জবাবে তিনি বলেন, ‘পাথেয় ও যাতায়াত ব্যবস্থা’।”[12]
এসব ভাষ্য থেকে আমাদের নিকট স্পষ্ট হয়ে গেল যে, হজ আবশ্যক হওয়ার জন্য অন্যতম একটি শর্ত হলো ‘রসদপত্র’; আর হাজী সাহেবের জন্য তার সফরের মধ্যে ও আবাসিক অবস্থানে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর আলিম সমাজ হাজীদেরকে সর্কতার জন্য বেশি বেশি পাথেয় ও রসদপত্র সাথে রাখার উপদেশ দিয়ে থাকেন, যাতে তাকে জনগণের দ্বারস্থ হতে না হয়, এমনকি সে নিজেকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে না দেয়।
আল্লামা ইবন উসাইমীন রহ. বলেন,
‘যিনি হজ অথবা উমরা করার ইচ্ছা করেন, তার জন্য উচিৎ হলো বেশি বেশি করে খরচপাতি ও সফরের সম্বল কাছে রাখা এবং সতর্কতার জন্য তার প্রয়োজনের চেয়েও অতিরিক্ত অর্থ সঙ্গে রাখা, যাতে তাৎক্ষণিক জরুরি প্রয়োজন পূরণ করতে পারে’।[13]
অদ্ভুত ব্যাপার হলো যে, একটি গোষ্ঠী বিশ্বাস পোষণ করে যে, পাথেয় ও সহায়-সম্বল নিয়ে হজের উদ্দেশ্যে সফর করাটা আল্লাহর ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ (ভরসা) করার পরিপন্থী। ফলে তারা সহায়-সম্বল ছাড়া সফরে বের হয়ে যায় এবং তারা তাদের নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়; তাদের ধারণা যে, এ সবকিছুই তারা করছে ‘তাওয়াক্কুল’-কে পরিশুদ্ধ করার নিমিত্তে।[14]
বস্তুত তাদের এ ধরনের কুধারণা ও মন্দ বিশ্বাস অনেক আগ থেকেই চালু ছিল। এর প্রমাণ হলো:
১. আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা’র উক্তি, তিনি বলেন,
«كَانَ أَهْلُ الْيَمَنِ يَحُجُّونَ، وَلَا يَتَزَوَّدُونَ، وَيَقُولُونَ : نَحْنُ الْمُتَوَكِّلُونَ، فَإِذَا قَدِمُوا مَكَّةَ سَأَلُوا النَّاسَ، فَأَنْزَلَ اللَّهُ تَعَالَى: ﴿ وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيۡرَ ٱلزَّادِ ٱلتَّقۡوَىٰۖ ﴾ [البقرة: ١٩٧] » .
“ইয়ামানের অধিবাসীগণ হজে গমনকালে পাথেয় সঙ্গে নিতো না এবং তারা বলত: আমরা আল্লাহর ওপর ভরসাকারী; কিন্তু যখন তারা মক্কায় আগমন করত, তখন তারা জনগণের কাছে সাহায্যের আবেদন করে বেড়াতো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা আয়াত অবতীর্ণ করেন:
وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيۡرَ ٱلزَّادِ ٱلتَّقۡوَىٰۖ
“আর তোমরা পাথেয় সংগ্রহ কর। নিশ্চয় সবচেয়ে উত্তম পাথেয় হচ্ছে তাকওয়া।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৭]”[15]
ইমাম ইবন জারীর ত্ববারী রহ. বলেন, “বর্ণিত আছে যে, এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছে এমন এক সম্প্রদায়ের ব্যাপারে, যারা পাথেয় ছাড়া হজ করত, আর তাদের কেউ কেউ যখন ইহরাম বাঁধতো, তখন তাদের সাথে থাকা পাথেয় ছুড়ে ফেলে দিত এবং অন্যের নিকট পাথেয় চেয়ে আবেদন করত। তারপর তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সঙ্গে পাথেয় না নিত, আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার সফরের জন্য পাথেয় নেয়ার নির্দেশ প্রদান করেন, আর তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি পাথেয়ের মালিক ছিল, তিনি তাকে তার পাথেয়কে সংরক্ষণ করতে এবং তা ছুড়ে ফেলে না দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন”।[16]
২. সা‘ঈদ ইবন নাসীর বলেন,
«سألت سفيان بن عيينة رحمه الله _ فقلت : يا أبا محمد ! عندنا قوم يلبسون الشعر، ويحجون ولا يتزودون، ويزعمون أن من حمل الزاد فليس بمؤمن . فقال: كذبوا ؛ هؤلاء أعداء السنة، لا تجالسوهم ولا تحدثوهم»
“আমি সুফিয়ান ইবন ‘উয়ায়ানা রহ. কে প্রশ্ন করে বললাম: হে আবূ মুহাম্মাদ! আমাদের সমাজে এক সম্প্রদায় রয়েছে, যারা পশমের পোশাক পরিধান করে, আর তারা হজ করে এবং সঙ্গে পাথেয় নিয়ে যায় না, আর তারা বিশ্বাস করে যে, যে ব্যক্তি পাথেয় নিয়ে (হজে) যায়, সে ব্যক্তি মুমিন নয়। এ কথা শুনে তিনি বললেন: ‘তারা মিথ্যা বলেছে; এসব লোক সুন্নাহ’র শত্রু, তোমরা তাদের সাথে উঠা-বসা করবে না এবং তাদের সাথে কোনো কথা বলবে না।”[17]
৩. জনৈক ব্যক্তি ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. এর কাছে এসে বলল:
«أُرِيد أَنْ أَخْرُجَ إلى مكَّةَ على التوكُّلِ بِغَير زادٍ، فقال له أَحْمَدُ : اخرج في غير القَافِلَةِ . فقال : لا ؛ إِلاَّ معهُم، فقال : على جراب النَّاسِ تَوكلتَ» .
“আমি আল্লাহর ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ (ভরসা) করে কোনো রকম পাথেয় ছাড়াই মক্কার উদ্দেশ্যে বের হতে চাই, তখন আহমাদ রহ. তাকে লক্ষ্য করে বললেন: তাহলে তুমি কাফেলার সাথে না গিয়ে একা একা বের হও। তখন সে বলল: না, বরং আমি তাদের সাথেই বের হব। তখন তিনি বললেন: তাহলো তো তুমি জনগণের ভাণ্ডারের ওপর ‘তাওয়াক্কুল’ করেছ।”[18]
আর কোনো সন্দেহ নেই যে, এর কারণ হলো ‘তাওয়াক্কুল’-এর প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য সম্পর্কে ঐসব লোকজনের অজ্ঞতা ও মূর্খতা; আরও একটি কারণ হলো, তাদের ওপর ইবলিস শয়তানের আছর বা প্রভাব।
ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. বলেন,
«وقد لَبَّسَ إِبْلِيسُ على أقوامٍ يَدعُون التوكُّل؛ فخرجوا بِلاَ زادٍ، وظنُّوا أن هذا هو التوكُّلُ وهُم على غاية الخطأَ» .
“আর ইবলিস কর্তৃক প্রতারণার শিকার হয়েছে এমন কতগুলো গোষ্ঠী, যারা তাওয়াক্কুল তথা আল্লাহর ওপর ভরসা করার দাবি করে। ফলে তারা পাথেয় ছাড়া (হজের উদ্দেশ্যে) বের হয়ে যায়, আর বিশ্বাস করে যে, এটাই হলো ‘তাওয়াক্কুল’ অথচ তারা চরম ভুল ও বিভ্রান্তির মধ্যে ডুবে আছে”।[19]
ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ. এর জবাব ও যুক্তি খণ্ডনের মধ্য দিয়ে আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে, যে ব্যক্তি পাথেয় ছাড়া হজ করবে, সে ব্যক্তি হবে জনগণের ওপর তাওয়াক্কুলকারী ও নির্ভরশীল, আর এ কথা বলা সঠিক হবে না যে, সে আল্লাহর ওপর ভরসাকারী।বস্তুত আল্লাহর তা‘আলার ওপর ভরসা করা হচ্ছে, মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, আর তা হলো উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা এবং সাথে আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীল হওয়া। ‘তাওয়াক্কুল’ মানে এমনটি নয় যেমনটি রূপরেখা পেশ করে ইবলিস তার অনুসারীদের জন্য।
>[2] ইবনুল কাইয়্যেম, যাদ আল-মা‘আদ: (৪/১৫)।
[3] ইবন রজব, ‘জামে‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম’: (২/৪৯৭); আল-কারাফী, ‘আয-যাখীরা’: (১৩/২৪৭); ইবনুল কায়্যিম, ‘মাদারেজ আস-সালেকীন’: (৩/৫২৩)।
[4] ‘মাদারেজ আস-সালেকীন’: (৩/৫০০)।
[5] ইমামা তিরমিযী রহ. কিয়ামতের বর্ণনা প্রসঙ্গে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, বাব নং ৬০, হাদীস নং ৫৩৭, (৪/৬৬৮); ইবন হিব্বান, আস-সহীহ, হাদীস নং ২৫৪৯।
[6] ‘তাইসীরুল ‘আযীয আল-হামীদ ফী শরহি কিতাব আত-তাওহীদ’: (৪৯৮)।
[7] ‘মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসায়েল আশ-শাইখ ইবন ‘উসাইমীন’: (৬/৫৪)।
[8] ‘তাইসীরুল ‘আযীয আল-হামীদ ফী শরহি কিতাব আত-তাওহীদ’: (৪০)।
[9] ‘তাইসীরুল ‘আযীয আল-হামীদ ফী শরহি কিতাব আত-তাওহীদ’: (৪৯৮)।
[10] ‘আল-মুগনী’: (৫/৬)।
[11] ‘আল-মুগনী’: (৫/৮)।
[12] হাদীসটি ‘মারফু’ সনদে আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণনা করেছেন। ইবন মাজাহ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৮৯৬; তিরমিযী, আস-সুনান, হাদীস নং ৮১৩।
[13] ‘আল-মানহাজ লে-মুরীদ আল-হাজ ওয়াল ‘উমরা’: (পৃ. ১০৫)।
[14] ‘দেখুন: ‘তালবীসু ইবলিস’: (২/৮৩২); ‘আস-সুনান ওয়াল মুবতাদা‘আত আল-মুতা‘আল্লাকা বিল আযকার ওয়াস সালাওয়াত’: (পৃ. ১৫২); ‘মানাসিক আল-হাজ ওয়াল ‘উমরা’: (পৃ. ৪৬)।
[15] সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৪৫১; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ১৭৩০; নাসাঈ, ‘আস-সুনান আল-কুবরা’ (৮৭৩৯)।
[16] ‘জামে‘উল বায়ান ‘আন তা’বীল আয়িল কুরআন’: (২/২৭৮)।
[17] দেখুন: ‘আস-ছিকাত: (৮/২৬৯)।
[18] এ কাহিনীটি ইমাম আহমাদ রহ. থেকে ইবনুল জাওযী রহ. বর্ণনা করেছেন ‘তালবীসু ইবলিস’: (২/৮৩২) গ্রন্থে।
আর তিনি তা সনদসহ এর চেয়ে আরও পরিপূর্ণভাবে বর্ণনা করেছেন, তাঁর নিকট বর্ণনাটি এসেছে: (তাহলে তুমি কি একা একা মরুভূমিতে প্রবেশ করবে, নাকি জনগণের সাথে? জবাবে সে বলল: না, জনগণের সাথে প্রবেশ করব; তখন ইমাম আহমাদ রহ. বললেন: তুমি মিথ্যা বলছ; তুমি আল্লাহর ওপর ভরসাকারী নও; সুতরাং তুমি একা একা প্রবেশ কর, আর তা না হলে তুমি জনগণের ভাণ্ডারের ওপর ভরসাকারী) ‘আল-হাছ্ছু ‘আলাত তিজারাত ওয়াস সানা‘আত...’: (পৃ. ৯৪)।
[19] ‘তালবীসু ইবলিস’: (২/৮৩২); আর এ অদ্ভুত ‘তাওয়াক্কুল’-এর উদাহরণ ও দৃষ্টান্ত দেখুন আল-কুশাইরীর ‘আর-রিসালা’ নামক গ্রন্থে: (পৃ. ১০৬-১০৮)।
‘রিয়া’ (الرياء) শব্দটি الرؤية (দেখা) শব্দ থেকে নির্গত, আর তার মানে হলো: মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে ইবাদতকে প্রকাশ করা, ফলে তারা ইবাদত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রশংসা করে।[1]
‘রিয়া’ ও ‘সুম‘আ’ -এর মধ্যে পার্থক্য:
‘রিয়া’ হলো জনগণকে দেখানোর জন্য আমল করা, আর ‘সুম‘আ’ হলো তাদেরকে শুনানোর জন্য আমল করা। সুতরাং ‘রিয়া’ -এর সম্পর্ক দৃষ্টিশক্তির অনুভূতির সাথে; আর সুম‘আ’ -এর সম্পর্ক হলো শ্রবণশক্তির অনুভূতির সাথে। আর তার মধ্যে শামিল হবে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক তার আমলকে গোপন করা, অতঃপর তা জনগণের নিকট বর্ণনা বা প্রচার করা। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘রিয়া’ বা লোক দেখানো আমল করা থেকে সতর্ক করেছেন; নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللَّهُ بِهِ وَمَنْ يُرَائِي يُرَائِي اللَّهُ بِهِ
“যে ব্যক্তি স্বীয় খ্যাতি অর্জনের চিন্তায় ইবাদত করবে, আল্লাহ তার বিনিময়ে জনমনে তার আসল চেহারা উন্মোচন করে দেবেন; আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করবে, আল্লাহ তার বিনিময়ে জনগণকে তার প্রকৃত অবস্থা দেখিয়ে দেবেন।”[2]
নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন,
«إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ، قَالُوا : وَمَا الشِّرْكُ الْأَصْغَرُ يَا رَسُولَ اللَّهِ ؟ قَالَ : الرِّيَاءُ، يَقُولُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ : إِذَا جَازَى النَّاسَ بِأَعْمَالِهِمْ : اذْهَبُوا إِلَى الَّذِينَ كُنْتُمْ تُرَاءُونَ فِي الدُّنْيَا، فَانْظُرُوا هَلْ تَجِدُونَ عِنْدَهُمْ مِنْ جَزَاءٍ ؟»
“আমি তোমাদের ব্যাপারে যেসব বিষয়ে ভয় করি, তন্মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়টি হলো ‘ছোট্ট শির্ক’। সহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! ‘ছোট্ট শির্ক’ কী? জবাবে তিনি বললেন: লোক দেখানো আমল। কিয়ামতের দিন যখন আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে তাদের কৃতকর্মের প্রতিদান দিবেন, তখন তিনি এ জাতীয় লোকজনকে উদ্দেশ্য করে বলবেন: তোমরা ঐসব লোকের কাছে যাও, যাদেরকে দেখানোর জন্য তোমরা দুনিয়াতে আমল করতে; তারপর দেখ- তাদের নিকট তোমরা কোনো প্রতিদান পাও কিনা?।”[3]
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তা‘আলার নিকট দো‘আ করেছেন, যাতে তিনি তাঁর হজকে একান্তভাবে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য নির্দিষ্ট করে নেন, লোক দেখানো ও সুখ্যাতি অর্জনের কারণ না বানান; আর সে দো‘আর একটি হলো:
«اللَّهُمَّ اجْعَلْهَا حَجَّةً غَيْرَ رِيَاءٍ وَلاَ مُهابَةٍ وَلاَ سُمْعَةٍ» .
“হে আল্লাহ! আপনি এটাকে এমন হজে পরিণত করুন, যাতে (আপনার উদ্দেশ্য ছাড়া) কোনো রকম ‘রিয়া’ (প্রদর্শনী), প্রতিপত্তি ও সুনামের উদ্দেশ্য না থাকে।”[4]
আর এর ওপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, হজের মূল উদ্দেশ্য যদি হয় লোক দেখানোর জন্য, তাহলে হজটি বাতিল বলে গণ্য হবে; আর হজের মূল উদ্দেশ্য যদি হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, তারপর হঠাৎ করে তার ওপর ‘রিয়া’ বা লোক দেখানোর নিয়ত এসে আপতিত হয়, অতঃপর তা যদি মনে মনে থাকে এবং তা মন থেকে দূর করে দেয়, তাহলে তা তার জন্য ক্ষতিকর হবে না; আর যদি সে লোক দেখানোর নিয়তটি তার সাথে স্থায়ী হয়ে পড়ে, তাহলে তা তার পুরো হজটাকে নষ্ট করে ফেলবে। কারণ, হজ এমন ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত, যার শেষটা প্রথম অংশের সাথে সংযুক্ত।[5]
বস্তুত হজ হলো একসাথে আর্থিক ও শারীরিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত একটি ইবাদত, আর মুসলিমগণকে তা পালন করার সময় অনেক কষ্ট ও ক্লান্তির শিকার হতে হয়; কিন্তু তারা এসব কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করেন আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি লাভের আশায় ও তাঁর জান্নাত পাওয়ার দাবিতে।
আর যে জিনিসটি তাদেরকে এসব কষ্ট ও ক্লান্তিকে ভুলিয়ে রাখে, তা হলো নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে বর্ণিত ঐসব হাদীস, যা হজের ফযীলত ও হাজী সাহেবের সাওয়াব প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে।
আর এসব হাদীসের মধ্য থেকে অন্যতম একটি হলো, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, যেখানে তিনি বলেছেন:
«الْعُمْرَةُ إِلَى الْعُمْرَةِ كَفَّارَةٌ لِمَا بَيْنَهُمَا, والْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ»
“এক উমরা থেকে আরেক উমরা- উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের জন্য কাফ্ফারা, আর মাকবূল (কবুল) হজের একমাত্র প্রতিদান হলো জান্নাত।”[6]
কিন্তু সেখানে কোনো কোনো হাজী সাহেবকে দেখা যায়- তারা হজের নিয়ত করেন এবং কতবার হজ করেছেন তাকে সংখ্যায় প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, আর তাদের কেউ কেউ চিন্তা করেন হজ থেকে ফিরে আসার সময় তাকে বলা হবে: ‘আল-হজ অমুক’। আবার কেউ চিন্তা করেন: সে যখন কোনো মাজলিসে কথা বলবে, তখন সে বলবে: ‘আমি সাতবার হজ করেছি’ অথবা সে বলবে: ‘আমি ‘আরাফাতে পনের বার অবস্থান করেছি’।
ইমাম ইবনুল জাওযী রহ. বলেন, ‘হাজীগণের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, যিনি চান- সাক্ষাতের সময় তাকে ‘আলহাজ্জ’ বলা হবে। আর হজের উদ্দেশ্যে মক্কায় গমনকারীগণের মধ্য থেকে এমন অনেক আছেন, যার চিন্তা হলো তার হজের সংখ্যাতথ্য প্রকাশ করা, ফলে তিনি বলেন, ‘আমি আরাফার ময়দানে বিশ বার অবস্থান করেছি’।[7] আর অনেক আশ্রয়দানকারী আছেন, যিনি দীর্ঘ সময় ধরে মক্কায় অবস্থান করছেন, অথচ তিনি এখনও তার ভিতরকে পবিত্র করার কাজটি শুরু করেন নি, আর কখনও কখনও তার চিন্তার সম্পর্ক থাকে এমন সব অবদানের সাথে, যে অবদান তিনি তার কাছে থাকা কারও জন্য রেখেছেন। আবার কখনও কখনও তিনি বলেন, আশ্রয়দানকারী ও সেবক হিসেবে আজকে আমার বিশ বছর পূর্ণ হলো। আর একটা গোষ্ঠীর ওপর শয়তান ভর করেছে, তাদের কেউ কেউ হজ আদায়ের পদ্ধতির মধ্যে এমন কিছু নতুন বিষয় চালু করেছে, যা তার অন্তর্ভুক্ত নয়। ফলে আমি একদল লোককে দেখি- তারা তাদের ইহরামের মধ্যে কৃত্রিম ভান করে, যার ফলে তারা একটি কাঁধকে খোলা রাখে এবং কয়েক দিন এভাবে সূর্যের তাপের মধ্যে অবস্থান করে, তারপর তাদের চামড়া খসে পড়ে এবং তাদের মাথা ফুলে যায়, আর এর দ্বারা মানুষের মাঝে নিজের ভাব বা সৌন্দর্য প্রকাশ করে’।[8] আর এ ধরণের আকীদা পরিপন্থী কাজ এ যুগের মানুষের মধ্যেও বিদ্যমান রয়েছে।
>[2] সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ৬৪৯৯; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ২৯৮৬)।
[3] আহমাদ, আল-মুসনাদ: (২৩১৯)
[4] বায়হাকী, আস-সুনান (৪/৩৩২, ৩৩৩), কিতাবুল হজ।
[5] ‘জামে‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম’: (১/৮১-৮৪); ‘তাইসীরুল ‘আযীয আল-হামীদ ফী শরহি কিতাব আত-তাওহীদ’: (পৃ. ৫৩০-৫৩৪)।
[6] হাদীসটি ‘মারফু’ সনদে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন; সহীহ বুখারী, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৬৮৩; সহীহ মুসলিম, আস-সহীহ, হাদীস নং ১৩৪৯; ইবন মাজাহ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৮৮৮; তিরমিযী, আস-সুনান, হাদীস নং ৯৩৩; নাসাঈ, আস-সুনান, হাদীস নং ২৬২৮।
আর হজের ফযীলত সম্পর্কে একগুচ্ছ হাদীস দেখুন: আত-তারগীব ওয়া আত-তারহীব: (২/১৬২-১৮৩); ‘মাজমা‘উ আয-যাওয়ায়েদ’: (৩/২০৬-২১০); ‘ইতহাফ আল-খায়রাত’: (৩/১৩৮-১৪১); ‘আল-মাতালেব আল-‘আলীয়া’: (৬/২৬২-২৯০)।
[7] অর্থাৎ আমি বিশবার হজ করেছি।
[8] ‘তালবীসু ইবলিস’: (২/৮৩০-৮৩১) সংক্ষেপ করে উদ্ধৃত; আরও দেখুন: ‘আস-সুনান ওয়াল মুবতাদা‘আত আল-মুতা‘আল্লাকা বিল আযকার ওয়াস সালাওয়াত’: (পৃ. ১৫১-১৫২)।
তাবিজ হলো: “এমন কতগুলো পুঁতি বা গুটিকা, যা লোকেরা তাদের সন্তানদের শরীরের ঝুলিয়ে রাখত, যাতে তার দ্বারা তারা নজর লাগা থেকে বাঁচতে পারে।”[1]
আর তাবিজ-কবচ ও অনুরূপ কিছু ঝুলিয়ে রাখার বিষয়টি এক প্রকারের মহামারী, যা ব্যাপকভাবে অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রে প্রচলিত, আর তা ঝুলিয়ে রাখার বিষয়টি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এ বিষয়টি চতুষ্পদ জন্তু ও যানবাহন পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে, আর এ বিষয়টি একেবারে দৃশ্যমান একটি বিষয়। আর এটাকে ‘তাওহীদ’ তথা আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা বলে গণ্য করা হয়, যে তাওহীদসহ আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। অনুরূপভাবে তাওহীদের বিপরীত শির্কের ব্যাপারে মানুষের অজ্ঞতাও এ ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছে।[2]
আর তাবিজ-কবচ এর বিষয় নিয়ে আলোচনাটি কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে হতে পারে:
তাবিজের মধ্যে যা কিছু লেখা হয়, সেসব দিক বিবেচনায় তা কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে:
প্রথম প্রকার: এমন সব তাবিজ, যাতে কুরআনের আয়াত ও হাদীসে নববী লিপিবদ্ধ করা হয়।
দ্বিতীয় প্রকার: এমন সব তাবিজ, যাতে সুনির্দিষ্ট কোনো বাক্য লিপিবদ্ধ করা হয়; আর তাতে সুস্পষ্ট শির্কী কথা লেখা থাকে।
তন্মধ্যে প্রথম প্রকারের তাবিজের বিষয়টি নিয়ে আলিম সমাজের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, তবে বিশুদ্ধ মতে তা হারাম; কারণ হারামের উপায় ও উপলক্ষ্য বন্ধ করা জরুরী। আর যেসব আলিম তাকে বৈধ বলেছেন, তারাও কারও ওপর বালা-মুসিবত নাযিলের পরে এ ধরনের তাবিজ ব্যবহার করার শর্ত করেছেন, তার পূর্বে নয়।[3]
আর দ্বিতীয় প্রকার তাবিজ-কবচ হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করার অন্তর্ভুক্ত।
আর তাবিজের সাথে মানুষের অন্তর সম্পৃক্ত হওয়ার বিবেচনায় তা দু’ভাগে বিভক্ত:
প্রথম প্রকার: যিনি তাকে উপকার লাভ বা ক্ষতি নিরোধের কারণ হিসেবে গ্রহণ করেন, আর তিনি জানেন যে, তা প্রকৃতপক্ষে কোনো উপকারও করতে পারে না এবং কোনো ক্ষতিও করতে পারে না; এ অবস্থায় তা ‘ছোট্ট শির্ক’ বলে বিবেচিত হবে।
দ্বিতীয় প্রকার: যিনি তাকে গ্রহণ করেন এমন আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে- যে, তাতে উপকার ও অপকার নিহিত রয়েছে; সে মনে করে যে এ তাবিজ তার থেকে অকল্যাণ দূর করতে পারে এবং তার জন্য কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে; এ অবস্থায় এটা (না‘উযু বিল্লাহ) এমন বড় শির্ক হিসেবে গণ্য হবে যা ব্যক্তিকে দীনের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়।
আর এ অধ্যায়ে আমার আলোচনাটি তাবিজ-কবচের প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় প্রকারের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
আর এ অধ্যায়ের মধ্যে আমি তাকে আকীদাগত বিরোধের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেছি, তা বহনকারীর অবস্থার দিকে লক্ষ্য না করেই, তারা কি সেটার জ্ঞান রাখে নাকি সেটা সম্পর্কে অজ্ঞ সেটার কথা বিবেচনায় না এনেই। কারণ, মুসলিমগণের কেউ কেউ বেড়ে উঠেছেন এমন সব স্থানে, যেখানে অজ্ঞতা ও মূর্খতা ছড়িয়ে গেছে এবং সঠিক জ্ঞান হারিয়ে গেছে, আর ‘অজ্ঞতার কারণে ক্ষমা’ ও এতদসংক্রান্ত মাসয়ালা নিয়ে ‘ইলম’ বিষয়ক গ্রন্থসমূহে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে।[4]
বস্তুত তাবিজ-কবচের বিষয়টি অনেক আগ থেকেই পরিচিত বিষয়; বরং তা জাহেলি যুগের কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। আর এ কারণে তা তাওহীদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে এবং তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্তরকে তা দোদুল্যমান রাখে, আর তাকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়তে বিরত রাখে। ইসলাম তাবিজের ব্যাপারে সতর্কবার্তা নিয়ে এসেছে; এ প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, আর এর মধ্যে কিছু হাদীস নিম্নরূপ:
১. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إن الرُّقَى والتَّمَائِمَ والتِّوَلَةَ شِرْك»
“নিশ্চয় ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবচ ও বশীকরণ বিদ্যা শির্ক।”[5]
২. ‘উকবা ইবন ‘আমের আল-জুহানী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَقْبَلَ إِلَيْهِ رَهْطٌ، فَبَايَعَ تِسْعَةً، وَأَمْسَكَ عَنْ وَاحِدٍ، فَقَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ ! بَايَعْتَ تِسْعَةً، وَتَرَكْتَ هَذَا ؟ قَالَ : «إِنَّ عَلَيْهِ تَمِيمَةً»، فَأَدْخَلَ يَدَهُ فَقَطَعَهَا، فَبَايَعَهُ، وَقَالَ : « مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একটি দল আগমন করল। অতঃপর তিনি নয় জনের বাই‘আত তথা (আনুগত্যের) শপথ গ্রহণ করলেন; কিন্তু একজনকে বাই‘আত করানো থেকে বিরত থাকলেন। উপস্থিত সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি নয় জনকে শপথ করালেন, আর একে বাদ দিলেন? জবাবে তিনি বললেন: ‘তার সাথে তাবিজ রয়েছে’। অতঃপর তিনি তাঁর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তা কেটে ফেললেন এবং তাকে বাই‘আত করালেন অতঃপর বললেন: ‘যে ব্যক্তি তাবিজ লটকালো, সে শির্ক করল।”[6] সুতরাং এসব হাদীসের মধ্যে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে যে, বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাসের অন্যতম একটি বিপরীত কাজ হলো হাজীগণ কর্তৃক তাবিজ-কবচ ও অনুরূপ কোনো কিছু ব্যবহার করে মক্কায় আগমন করা।
---------------------
[1] ‘আত-তা‘রিফাত আল-ই‘তিকাদিয়্যা’: (পৃ. ১২১)।
[2] দেখুন: ‘আহকামুর রুকা ওয়াত তামায়েম’: (পৃ. ২২৯)।
[3] দেখুন: আত-তামহীদ: (১৭/১৬০); আল-জামে‘ লি আহকামিল কুরআন: (১০/৩১৯); আর তাঁদের প্রত্যেকই ইবন আবদিল বার্র ও কুরতুবী রহ.-এর সূত্রে বক্তব্য দিয়েছেন যে, এ শর্তটি একদল আলেম সমাজের। আরও দেখুন: ‘শরহু মা‘আনিল আছার’: (৪/৩২৫); আল-বায়ান ওয়া আত-তাহসীল: (১/৪৩৯); যাদ আল-মা‘আদ: (৪/৩২৭); আহকামুর রুকা ওয়াত তামায়েম: (পৃ. ২৪৫) ।
[4] আর এ মাসয়ালাটি স্বতন্ত্রভাবে কয়েকটি গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম একটি গ্রন্থ হলো ড. আবদুর রাযযাক ইবন তাহেরের ‘আল-জাহলু বে-মাসায়েল আল-ই‘তিকাদ ওয়া হুকমুহু’ ।
[5] হাদীসটি যয়নব আছ-ছাকাফিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি তার স্বামী আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন; আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ৩৬১৫; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ৩৮৮৩; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৫৩০।
[6] আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ১৭৪২২ এবং হাদীসের শব্দগুলো তার; ত্ববারানী, আল-মু‘জাম আল-কাবীর (৮৮৫), (১৭/৩১৯-৩২০); হাকেম, আল-মুস্তাদরাক (৪/২১৯)।
সহীহ আকীদা-বিশ্বাসের ঘোর বিরোধী অন্যতম একটি কাজ হলো কিছু সংখ্যক হাজী সাহেব কর্তৃক আল্লাহ তা‘আলার একত্ববাদের ঘোষণা দেওয়ার জন্য ‘মক্কা’-য় আগমন করে এমতাবস্থায় যে, তারা তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করে, ফলে আমরা তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিকে দেখতে পাই, যিনি হজ করার জন্য আসেন বিশেষ কতগুলো (বানানো) দো‘আ নিয়ে, যা লেখা থাকে কতগুলো পাতার উপর, যা তারা অধিক হারে ব্যবহার করে, তার মধ্যে রয়েছে আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্য প্রার্থনা, আবেদন ও নিবেদন। যেমন, তাদের কেউ কেউ দো‘আ করে আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট, অথবা হাসান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট অথবা শি‘আদের বারো ইমামের নিকট।[1]
আর এসব গ্রন্থে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছে যেসব দো‘আ ও সাহায্য প্রার্থনা করা হয়, তার বর্ণনা খুব শীঘ্রই সামনের অধ্যায়ে আসছে এবং সেখানে তাদের যুক্তিও খণ্ডন করা হয়েছে।