তাবিজ হলো: “এমন কতগুলো পুঁতি বা গুটিকা, যা লোকেরা তাদের সন্তানদের শরীরের ঝুলিয়ে রাখত, যাতে তার দ্বারা তারা নজর লাগা থেকে বাঁচতে পারে।”[1]
আর তাবিজ-কবচ ও অনুরূপ কিছু ঝুলিয়ে রাখার বিষয়টি এক প্রকারের মহামারী, যা ব্যাপকভাবে অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্রে প্রচলিত, আর তা ঝুলিয়ে রাখার বিষয়টি শুধু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এ বিষয়টি চতুষ্পদ জন্তু ও যানবাহন পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে, আর এ বিষয়টি একেবারে দৃশ্যমান একটি বিষয়। আর এটাকে ‘তাওহীদ’ তথা আল্লাহর একত্ববাদ সম্পর্কে মানুষের অজ্ঞতা বলে গণ্য করা হয়, যে তাওহীদসহ আল্লাহ তা‘আলা যুগে যুগে রাসূলগণকে পাঠিয়েছেন। অনুরূপভাবে তাওহীদের বিপরীত শির্কের ব্যাপারে মানুষের অজ্ঞতাও এ ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছে।[2]
আর তাবিজ-কবচ এর বিষয় নিয়ে আলোচনাটি কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে হতে পারে:
তাবিজের মধ্যে যা কিছু লেখা হয়, সেসব দিক বিবেচনায় তা কয়েক প্রকারের হয়ে থাকে:
প্রথম প্রকার: এমন সব তাবিজ, যাতে কুরআনের আয়াত ও হাদীসে নববী লিপিবদ্ধ করা হয়।
দ্বিতীয় প্রকার: এমন সব তাবিজ, যাতে সুনির্দিষ্ট কোনো বাক্য লিপিবদ্ধ করা হয়; আর তাতে সুস্পষ্ট শির্কী কথা লেখা থাকে।
তন্মধ্যে প্রথম প্রকারের তাবিজের বিষয়টি নিয়ে আলিম সমাজের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, তবে বিশুদ্ধ মতে তা হারাম; কারণ হারামের উপায় ও উপলক্ষ্য বন্ধ করা জরুরী। আর যেসব আলিম তাকে বৈধ বলেছেন, তারাও কারও ওপর বালা-মুসিবত নাযিলের পরে এ ধরনের তাবিজ ব্যবহার করার শর্ত করেছেন, তার পূর্বে নয়।[3]
আর দ্বিতীয় প্রকার তাবিজ-কবচ হলো আল্লাহ তা‘আলার সাথে শির্ক করার অন্তর্ভুক্ত।
আর তাবিজের সাথে মানুষের অন্তর সম্পৃক্ত হওয়ার বিবেচনায় তা দু’ভাগে বিভক্ত:
প্রথম প্রকার: যিনি তাকে উপকার লাভ বা ক্ষতি নিরোধের কারণ হিসেবে গ্রহণ করেন, আর তিনি জানেন যে, তা প্রকৃতপক্ষে কোনো উপকারও করতে পারে না এবং কোনো ক্ষতিও করতে পারে না; এ অবস্থায় তা ‘ছোট্ট শির্ক’ বলে বিবেচিত হবে।
দ্বিতীয় প্রকার: যিনি তাকে গ্রহণ করেন এমন আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে- যে, তাতে উপকার ও অপকার নিহিত রয়েছে; সে মনে করে যে এ তাবিজ তার থেকে অকল্যাণ দূর করতে পারে এবং তার জন্য কল্যাণ নিয়ে আসতে পারে; এ অবস্থায় এটা (না‘উযু বিল্লাহ) এমন বড় শির্ক হিসেবে গণ্য হবে যা ব্যক্তিকে দীনের গণ্ডি থেকে বের করে দেয়।
আর এ অধ্যায়ে আমার আলোচনাটি তাবিজ-কবচের প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় প্রকারের সাথে সম্পর্কযুক্ত।
আর এ অধ্যায়ের মধ্যে আমি তাকে আকীদাগত বিরোধের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করেছি, তা বহনকারীর অবস্থার দিকে লক্ষ্য না করেই, তারা কি সেটার জ্ঞান রাখে নাকি সেটা সম্পর্কে অজ্ঞ সেটার কথা বিবেচনায় না এনেই। কারণ, মুসলিমগণের কেউ কেউ বেড়ে উঠেছেন এমন সব স্থানে, যেখানে অজ্ঞতা ও মূর্খতা ছড়িয়ে গেছে এবং সঠিক জ্ঞান হারিয়ে গেছে, আর ‘অজ্ঞতার কারণে ক্ষমা’ ও এতদসংক্রান্ত মাসয়ালা নিয়ে ‘ইলম’ বিষয়ক গ্রন্থসমূহে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে।[4]
বস্তুত তাবিজ-কবচের বিষয়টি অনেক আগ থেকেই পরিচিত বিষয়; বরং তা জাহেলি যুগের কর্মকাণ্ডের অন্তর্ভুক্ত। আর এ কারণে তা তাওহীদের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে এবং তার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অন্তরকে তা দোদুল্যমান রাখে, আর তাকে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক গড়তে বিরত রাখে। ইসলাম তাবিজের ব্যাপারে সতর্কবার্তা নিয়ে এসেছে; এ প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, আর এর মধ্যে কিছু হাদীস নিম্নরূপ:
১. নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إن الرُّقَى والتَّمَائِمَ والتِّوَلَةَ شِرْك»
“নিশ্চয় ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবচ ও বশীকরণ বিদ্যা শির্ক।”[5]
২. ‘উকবা ইবন ‘আমের আল-জুহানী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَقْبَلَ إِلَيْهِ رَهْطٌ، فَبَايَعَ تِسْعَةً، وَأَمْسَكَ عَنْ وَاحِدٍ، فَقَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ ! بَايَعْتَ تِسْعَةً، وَتَرَكْتَ هَذَا ؟ قَالَ : «إِنَّ عَلَيْهِ تَمِيمَةً»، فَأَدْخَلَ يَدَهُ فَقَطَعَهَا، فَبَايَعَهُ، وَقَالَ : « مَنْ عَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ».
“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একটি দল আগমন করল। অতঃপর তিনি নয় জনের বাই‘আত তথা (আনুগত্যের) শপথ গ্রহণ করলেন; কিন্তু একজনকে বাই‘আত করানো থেকে বিরত থাকলেন। উপস্থিত সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি নয় জনকে শপথ করালেন, আর একে বাদ দিলেন? জবাবে তিনি বললেন: ‘তার সাথে তাবিজ রয়েছে’। অতঃপর তিনি তাঁর হাত ঢুকিয়ে দিয়ে তা কেটে ফেললেন এবং তাকে বাই‘আত করালেন অতঃপর বললেন: ‘যে ব্যক্তি তাবিজ লটকালো, সে শির্ক করল।”[6] সুতরাং এসব হাদীসের মধ্যে পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে যে, বিশুদ্ধ আকীদা-বিশ্বাসের অন্যতম একটি বিপরীত কাজ হলো হাজীগণ কর্তৃক তাবিজ-কবচ ও অনুরূপ কোনো কিছু ব্যবহার করে মক্কায় আগমন করা।
---------------------
[1] ‘আত-তা‘রিফাত আল-ই‘তিকাদিয়্যা’: (পৃ. ১২১)।
[2] দেখুন: ‘আহকামুর রুকা ওয়াত তামায়েম’: (পৃ. ২২৯)।
[3] দেখুন: আত-তামহীদ: (১৭/১৬০); আল-জামে‘ লি আহকামিল কুরআন: (১০/৩১৯); আর তাঁদের প্রত্যেকই ইবন আবদিল বার্র ও কুরতুবী রহ.-এর সূত্রে বক্তব্য দিয়েছেন যে, এ শর্তটি একদল আলেম সমাজের। আরও দেখুন: ‘শরহু মা‘আনিল আছার’: (৪/৩২৫); আল-বায়ান ওয়া আত-তাহসীল: (১/৪৩৯); যাদ আল-মা‘আদ: (৪/৩২৭); আহকামুর রুকা ওয়াত তামায়েম: (পৃ. ২৪৫) ।
[4] আর এ মাসয়ালাটি স্বতন্ত্রভাবে কয়েকটি গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম একটি গ্রন্থ হলো ড. আবদুর রাযযাক ইবন তাহেরের ‘আল-জাহলু বে-মাসায়েল আল-ই‘তিকাদ ওয়া হুকমুহু’ ।
[5] হাদীসটি যয়নব আছ-ছাকাফিয়্যাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি তার স্বামী আবদুল্লাহ ইবন মাস‘উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন; আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ৩৬১৫; আবূ দাউদ, আস-সুনান, হাদীস নং ৩৮৮৩; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৫৩০।
[6] আহমাদ, আল-মুসনাদ, হাদীস নং ১৭৪২২ এবং হাদীসের শব্দগুলো তার; ত্ববারানী, আল-মু‘জাম আল-কাবীর (৮৮৫), (১৭/৩১৯-৩২০); হাকেম, আল-মুস্তাদরাক (৪/২১৯)।