ইসলাম মানুষকে কোনো ক্ষেত্রেই বল্গাহীন স্বাধীনতা দেয় নি। সব ক্ষেত্রেই রয়েছে নির্দিষ্ট নীতিমালা। আয়-উপার্জন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটে নি। এ ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে ইসলামের দু’টি মূলনীতি রয়েছে।
এক- ব্যবসায়িক পণ্য, উপাদান ও কায়কারবারগুলো বৈধ হতে হবে। অবৈধ পণ্যের ব্যবসা ও অবৈধ কায়কারবারকে ইসলাম বৈধতা দেয় না। যেমন, মদ, জুয়া, সুদ, ঘুষ ইত্যাদির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়া ইসলামে অনুমোদন নেই। কারণ, এসব বিষয়কে ইসলামে মৌলিকভাবেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং আপনার ব্যবসার সাথে এসবের সংমিশ্রণ আপনার ব্যবসাকে কলুষিত করে।
দুই- ব্যবসা-বাণিজ্য সকল অবস্থায় বৈধ পন্থায় হতে হবে। অর্থাৎ সেখানে কোনো ধরনের ধোঁকাবাজি, ভেজাল ও ফাঁক-ফোকর থাকতে পারবে না। কোনো ধরনের মিথ্যার আশ্রয় থাকতে পারবে না। এ বিষয়ে ইসলামের কয়েকটি দৃষ্টিভঙ্গি আমরা নিম্নে আলোচনা করছি-
ব্যবসা দ্বারা মানুষের উপকার করার মানসিকতা থাকতে হবে। কারো ক্ষতি যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্ধান্ত দেন যে,
«أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَضَى أَنْ لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ».
“নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যের ক্ষতি করা কোনোটিই উচিত নয়”।[1]
ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে আমরা শুধু লাভ করছি তা নয়; বরং আমরা তাদের জিনিস ও সেবা প্রদান করছি। যদি আমরা যৌক্তিক লাভ করে থাকি এবং মনোপলি না করি তবে সমাজের জন্য এটি একটি বড় সহায়তা। ভালো জিনিস যৌক্তিক দামে প্রদান করায় সমাজের মানুষ সন্তুষ্ট হবে, তাতে আল্লাহ তা‘আলাও আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন। যখন ব্যবসায়ী ও গ্রাহক উভয় পক্ষ অনুভব করবে আমরা উপকৃত হয়েছি তখন সেখানে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হবে। ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাবে। যা একটি সুগঠিত সমাজের জন্য প্রয়োজন। এতে উভয় পক্ষই পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সাওয়াব পাবেন।
এ ধরনের অপকর্ম ইসলামে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত। মন্দ জিনিস ভালো বলে চালিয়ে দেওয়া, ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে ধোঁকা দেওয়া ইত্যাদি সম্পূর্ণ হারাম। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ عَلَى صُبْرَةِ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيهَا، فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلًا فَقَالَ: «مَا هَذَا يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ؟» قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: «أَفَلَا جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ كَيْ يَرَاهُ النَّاسُ، مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّي».
“একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাজারে গিয়ে একজন খাদ্য বিক্রেতার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তিনি খাদ্যের ভিতরে হাত প্রবেশ করে দেখলেন ভিতরের খাদ্যগুলো ভিজা বা নিম্নমান। এ অবস্থা দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে খাবারের পন্যের মালিক এটা কী? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল, এতে বৃষ্টি পড়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি সেটাকে খাবারের উপরে রাখলে না কেন; যাতে লোকেরা দেখতে পেত? “যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়”।[1]
>মিথ্যা অবশ্যই একটি নিন্দনীয় ও বড় ধরনের অপরাধ। ব্যবসার সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ আরও বেশি মারাত্মক ও ক্ষতিকর। কোনো মুসলিম সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ করতে পারে না। সত্যকে গোপন করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تَلۡبِسُواْ ٱلۡحَقَّ بِٱلۡبَٰطِلِ وَتَكۡتُمُواْ ٱلۡحَقَّ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٤٢﴾ [البقرة: ٤٢]
“তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না। জেনেশুনে সত্য গোপন করো না”।[1]
একজন মুমিনের দোষ-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক, যা মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু একজন মুমিনের মধ্যে মিথ্যা ও খিয়ানতের দোষ থাকাকে কোনোক্রমেই মেনে নেওয়া যায় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো,
«أيكون المؤمن جبانًا؟ قال: نعم. قيل: أيكون بخيلاً؟ قال: نعم. قيل: أيكون كذابًا؟ قال: لا».
“একজন মুমিন দুর্বল হওয়া কি স্বাভাবিক? তিনি বললেন, হ্যাঁ- হতে পারে। আবারও জিজ্ঞাসা করা হলো, মুমিন কি কৃপণ হতে পারে? বললেন, হ্যাঁ। তারপর জিজ্ঞাসা করা হলো, একজন মুমিন মিথ্যুক হতে পারে? বললেন, “না”।[2]
হাদীসে একজন মুমিনের অন্যান্য দুর্বলতা বা দোষের কথা স্বাভাবিক বলা হলেও মিথ্যাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়া হয় নি।
এ কারণেই তুমি দেখতে পাবে, যে ব্যবসায়ী সত্যবাদী, আমানতদার-মিথ্যা কথা বলে না, খিয়ানত করে না- তার দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়ে। তার ব্যবসা দৈনন্দিন উন্নত হতে থাকে। তার দোকানে গ্রাহকের ভিড় বাড়তে থাকে। তার কাছে মানুষ আমানত রাখে, তার সাথে মানুষ লেন-দেন বাড়াতে থাকে। ফলে দেখা যায় সে এক সময় বড় একজন ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়। পক্ষান্তরে যে মিথ্যা কথা বলে, মানুষ তার কাছে ভিড়তে চায় না, তার থেকে পলায়ন করে। একে অপরকে বলতে থাকে, তার সাথে তোমরা কোনো ধরনের লেন-দেন করবে না। তার মো‘আমালা সঠিক নয়। ফলে দেখা যায়, ধীরে ধীরে তার ব্যবসা লাভের পরিবর্তে লসের দিকে যায়। মানুষের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা বিলুপ্ত হতে থাকে। মান-সম্মান সব ধুলায় মিশে যায়। তার রিযিকের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এ জন্যেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أربع إذا كن فيك فلا عليك مما فات من الدنيا: حفظ أمانة، وصدق حديث، وحسن خليقة، وعفة في طعمة»[3].
“চারটি গুণ যখন তোমার মধ্যে থাকবে, তখন দুনিয়াদারী সব খুঁয়ে গেলেও তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমানত সংরক্ষণ, কথায় সততা, উত্তম চরিত্র, হালাল খাদ্য”। এ চারটি গুণ এমন, যেগুলো কোনো ব্যবসায়ীর মধ্যে বিদ্যমান থাকলে, অবশ্যই তার ব্যবসার উন্নতি হবে, আল্লাহ তা‘আলা তার ব্যবসা বাণিজ্যে বরকত দেবেন এবং এ ধরনের ব্যবসায়ী মানুষের নিকট প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হবে। দুনিয়াতেও তার সম্মান বৃদ্ধি পাবে, আখেরাতে তো বটেই; কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য, আমরা আমাদের পণ্যগুলো বিক্রির জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকি। এটি অত্যন্ত গর্হিত কাজ, যা কখনোই কল্যাণ বয়ে আনে না। সাময়িক লাভবান হলেও পরিণতি খুবই করুণ।
[2] বাইহাকী শু‘আবুল ঈমান, হাদীস নং ৪৮১২। হাদীসটি সহীহ।
[3] মুসনাদে আহমাদ (৬৬৫২) ও ত্বাবরানী, হাসান সনদে।
অন্যকে দেওয়ার সময় ওজনে কম দেওয়া আর নেওয়ার সময় বেশি করে নেওয়া জঘন্য অপরাধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَيۡلٞ لِّلۡمُطَفِّفِينَ ١ ٱلَّذِينَ إِذَا ٱكۡتَالُواْ عَلَى ٱلنَّاسِ يَسۡتَوۡفُونَ ٢ وَإِذَا كَالُوهُمۡ أَو وَّزَنُوهُمۡ يُخۡسِرُونَ ٣﴾ [المطففين: ١، ٣]
“ধ্বংস যারা পরিমাপে কম দেয় তাদের জন্য। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে। আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়”। [সূরা আল-মুতাফফিফীন, আয়াত: ১-৩]
সুতরাং তুমি যখন কাউকে দেবে তখন কম দেবে না। তুমি যে কাজটি তোমার নিজের জন্য পছন্দ করো না, তা অন্যের জন্য কীভাবে পছন্দ কর। তুমি যখন নিজের জন্য নাও তখনতো তোমাকে মাপে কম দিলে তুমি রাজি হবে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لاَ يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ، حَتَّى يُحِبَّ لِأَخِيهِ مَا يُحِبُّ لِنَفْسِهِ».
“তুমি তোমার নিজের জন্য যা ভালোবাসো তা অন্যের জন্যও ভালোবাসার আগ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না”।[1]
শু‘আইব আলাইহিস সালাম যে নীতি বর্ণনা করেন, কুরআন তা তুলে ধরছেন এভাবে:
﴿وَإِلَىٰ مَدۡيَنَ أَخَاهُمۡ شُعَيۡبٗاۚ قَالَ يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥۖ وَلَا تَنقُصُواْ ٱلۡمِكۡيَالَ وَٱلۡمِيزَانَۖ ٨٤﴾ [هود: ٨٤]
“হে আমার কাওম! আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো মা‘বুদ নাই। আর পরিমাপে ও ওজনে কম দিও না”। [সূরা সূরা হূদ, আয়াত: ৮৪]
﴿وَيَٰقَوۡمِ أَوۡفُواْ ٱلۡمِكۡيَالَ وَٱلۡمِيزَانَ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَلَا تَبۡخَسُواْ ٱلنَّاسَ أَشۡيَآءَهُمۡ وَلَا تَعۡثَوۡاْ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُفۡسِدِينَ ٨٥﴾ [هود: ٨٥]
“আর হে আমার জাতি! ন্যায় নিষ্ঠার সাথে ঠিকভাবে পরিমাপ কর ও ওজন দাও এবং লোকদের জিনিসপত্রে কোনোরূপ ক্ষতি করো না”। [সূরা হূদ, আয়াত: ৮৫]
অন্য জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَوۡفُواْ ٱلۡكَيۡلَ إِذَا كِلۡتُمۡ وَزِنُواْ بِٱلۡقِسۡطَاسِ ٱلۡمُسۡتَقِيمِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلٗا ٣٥﴾ [الاسراء: ٣٥]
“মেপে দেওয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং সঠিক পাল্লায় ওজন করবে। এটি উত্তম, এর পরিণাম শুভ”। [সূরা বনী ঈসরাইল, আয়াত: ৩৫]
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “...যখন কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা ওজনে বা মাপে কম দেয়, তখন শাস্তিস্বরূপ তাদের খাদ্য-শস্য উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে”।[2]
অপর একটি বর্ণনায় এসেছে, “...যে জাতি মাপে ও ওজনে কম দেয়, তাদের রিযিক উঠিয়ে নেওয়া হয়...”।[3] মনে রাখতে হবে, সালাত, সাওম ইত্যাদি নেক আমলে ত্রুটি হলে আল্লাহ তা‘আলা হয়তো তা তার নিজের অনুগ্রহে ক্ষমা করে দেবেন; কিন্তু মানুষকে সামান্য অণু পরিমাণ ঠকানো হলে বা অণু পরিমাণ মানুষের হক নষ্ট করলে, এ দায়ভার কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা নিবেন না। কিয়ামতের দিন প্রতারিত ক্রেতাকে ডেকে আল্লাহ তা‘আলা ওই প্রতারকের আমলনামা থেকে সমপরিমাণ সাওয়াব তাকে দিয়ে দেবেন। প্রতারকের সাওয়াব যদি শেষ হয়ে যায় বা কোন সাওয়াব না থাকে, তবে প্রতারিতদের গোনাহ তাঁর কাঁধের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। সেদিন কাঁদতে কাঁদতে যদি শরীরের প্রতিটি লোমকূপ থেকে রক্তও প্রবাহিত হতে থাকে, তাতেও কোন কাজ হবে না। সেদিন এমন ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা কোনক্রমেই ক্ষমা করবে না, যদি প্রতারিত ব্যক্তি তাকে ক্ষমা না করেন।
[2] আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হাদীস নং ৭৮৫
[3] মুয়াত্তা মালেক, হাদীস নং ৫৩৭০
মিথ্যা মানবতাবোধকে লোপ করে, নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ঘটায়। মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহর অভিশাপ। মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ: الْمَنَّانُ الَّذِي لَا يُعْطِي شَيْئًا إِلَّا مَنَّهُ، وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْفَاجِرِ، وَالْمُسْبِلُ إِزَارَهُ».
“কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তিন ব্যক্তির সাথে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন- যে তার ব্যবসায়িক পণ্যকে মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে”।[1]
অপর একটি হাদীসে এ দৃষ্টান্ত এভাবে তুলে ধরা হয়েছে-
«رجل حلف على سلعة بعد العصر، لقد أعطي بها كذا، وكذا، فصدقه المشتري وهو كاذب».
“এক ব্যক্তি আসরের পর তার পণ্য সম্পর্কে কসম খেয়ে বলে, তাকে পণ্যটি এত এত মূল্যে দেওয়া হয়েছে। তার কথা ক্রেতা বিশ্বাস করল, অথচ সে মিথ্যুক”।[2] এ ধরনের ব্যবসায়ীর জন্য উল্লিখিত হাদীসে অত্যন্ত কঠিন ও বেদনাদায়ক শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
>[2] আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৪৭৪; নাসায়ী, হাদীস নং ৪৪৬২
এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে অভিযোগ করল, যে সে বেচা-কেনাতে প্রতারিত হয় বা ঠকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«إِذَا أَنْتَ بَايَعْتَ، فَقُلْ: لَا خِلَابَةَ، ثُمَّ أَنْتَ فِي كُلِّ سِلْعَةٍ ابْتَعْتَهَا بِالْخِيَارِ ثَلَاثَ لَيَالٍ».
“যখন তুমি ক্রয়-বিক্রয় করবে, তখন তুমি বলে দিবে যে কোনো প্রতারণা বা ঠকানোর দায়িত্ব আমি নেব না। তোমার জন্য তিনদিন পর্যন্ত পণ্য ফেরত দেওয়ার অধিকার রয়েছে”।[1]
সুদ একটি মারাত্মক অপরাধ। সুদ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। ব্যবসার নামে কোন প্রকার সুদ চালু করা যাবে না। সুদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ٱلَّذِينَ يَأۡكُلُونَ ٱلرِّبَوٰاْ لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ ٱلَّذِي يَتَخَبَّطُهُ ٱلشَّيۡطَٰنُ مِنَ ٱلۡمَسِّۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ قَالُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡبَيۡعُ مِثۡلُ ٱلرِّبَوٰاْۗ وَأَحَلَّ ٱللَّهُ ٱلۡبَيۡعَ وَحَرَّمَ ٱلرِّبَوٰاْۚ ٢٧٥﴾ [البقرة: ٢٧٥]
“যারা সুদ খায় তারা কিয়ামতের দিন দণ্ডায়মান হবে শয়তানের আসরে মোহাবিষ্টদের মতো। কারণ, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় (ব্যবসা) ওতো সুদের মতো, অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৫]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
﴿يَمۡحَقُ ٱللَّهُ ٱلرِّبَوٰاْ وَيُرۡبِي ٱلصَّدَقَٰتِۗ ٢٧٦﴾ [البقرة: ٢٧٦]
“আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খায়রাতকে বর্ধিত করেন”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৬]
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا أَحَدٌ أَكْثَرَ مِنَ الرِّبَا، إِلَّا كَانَ عَاقِبَةُ أَمْرِهِ إِلَى قِلَّةٍ».
“সুদ যদিও বৃদ্ধি পায় কিন্তু এর শেষ পরিণতি হচ্ছে স্বল্পতা”।[1]
লেনদেন যদি সুদ সংক্রান্ত হয় তবে হাদীসে এসেছে, জাবের ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন যে,
«لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آكِلَ الرِّبَا، وَمُؤْكِلَهُ، وَكَاتِبَهُ، وَشَاهِدَيْهِ» ، وَقَالَ: «هُمْ سَوَاءٌ».
“আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ গ্রহণকারী, প্রদানকারী, হিসাবকারী এবং সাক্ষী সকলের প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন এবং তিনি বলেন তারা সকলেই সমান”।[2]
>[2] সহীহ মুসলিম নং ১৫৯৮
বৃক্ষস্থিত ফলকে বৃক্ষ হতে আহরিত ফলের বিনিময়ে অনুমান করে বিক্রি করাকে মুযাবানা বলে। বিভিন্ন ধরণের মুযাবানা বর্তমানেও প্রচলিত আছে। ক্ষেতে অকীর্তিত খাদ্য শস্য যথা গম, বুট ইত্যাদিকে শুকনা পরিষ্কার করা খাদ্য যথা, গম, বুট ইত্যাদির বিনিময়ে অনুমান করে বিক্রি করাকে মুহাকালা বলে। সুদের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলোকেও সুদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন।[1]
>ব্যবসার জটিল মারপ্যাঁচে অন্যের মাল হরণ করা হারাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَٰرَةً عَن تَرَاضٖ مِّنكُمۡۚ ٢٩﴾ [النساء : ٢٩]
“হে ঈমানদারগন তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯]
হাদীসে এসেছে একটি ব্যবসায়িক লেনদেনে উভয় পক্ষই খুঁতসহ পণ্যেও সঠিক বর্ণনা দিতে হবে। ইসলামের বিজনেস কন্ডাক্ট সম্পর্কে জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু এভাবে বর্ণনা করেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«رَحِمَ اللَّهُ رَجُلًا سَمْحًا إِذَا بَاعَ، وَإِذَا اشْتَرَى، وَإِذَا اقْتَضَى».
“আল্লাহ তার প্রতি দয়া বর্ষণ করুক যে বিক্রির সময়, ক্রয়ের সময় এবং অভিযোগের সময় সদয় থাকে”।[1]