ইজমা এর আভিধানিক অর্থ: দৃঢ় সংকল্প করা, একমত হওয়া।
পারিভাষিক অর্থ:
اتفاق مجتهدي هذه الأمة بعد النبي صلى الله عليه وسلم على حكم شرعي
‘‘ইজমা হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশার পর শারঈ কোন হুকুমের বিষয়ে এ উম্মতের মুজতাহিদগণের ঐক্যমত পোষণ করা।’’
আমাদের বক্তব্য: اتفاق (ঐক্যমত) এ শব্দ দ্বারা ‘মতানৈক্যের অস্তিত্ব বের হয়ে গেছে। যদিও মতানৈক্য একজন বিদ্বানের পক্ষ থেকে হয়। কাজেই কোন বিষয়ে মতানৈক্য বিদ্যমান থাকলে সে বিষয়ে ইজমা সংঘঠিত হবে না।
مجتهدي (মুজতাহিদগণ) এ শব্দ দ্বারা সাধারণ মানুষ ও মুকাল্লিদগণ বের হয়ে গেছে। কাজেই এদের একমত হওয়া বা ভিন্ন মত পোষণ করা ধর্তব্য হবে না।
هذه الامة (এ উম্মতের) এ অংশ দ্বারা অন্য জাতির ঐক্যমত বের হয়ে গেছে। সুতরাং ভিন্ন জাতির ঐক্যমত শরীয়তে ধর্তব্য হবে না।
بعد النبي صلى الله عليه وسلم (রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশার পর) এ অংশ দ্বারা তার জীবদ্দশায় তার (ছাহাবীদের) ঐক্যমত বের হয়ে গেছে। সেগুলো স্বয়ং সম্পন্ন ভাবে দলীল হওয়ার কারণে তা ইজমা হিসাবে অভিহিত হবে না। কেননা, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা, কাজ ও অনুমোদনের সুন্নাহ দ্বারাই দলীল অর্জিত হয়। এজন্য ছাহাবীরা যখন বলেন, আমরা রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে এরূপ করতাম অথবা তারা এরূপ করতো। এগুলো বিধানগতভাবে মারফু হাদীছ; ‘ইজমার বিবরণ’ নয়।
على حكم شرعي (শারঈ কোন হুকুমের বিষয়ে) এ অংশ দ্বারা জ্ঞানগত কিংবা প্রকৃতিগত বিষয়ে ঐক্যমত বের হয়ে গেছে। এখানে এসবের কোন অনুপ্রবেশ নেই। কেননা, ‘ইজমা’ শরীয়তের একটি দলীল এখানে আলোচ্য বিষয় এটিই।
বেশ কিছু দলীলের ভিত্তিতে ইজমা প্রামাণ্য বিষয় বলে গণ্য। তন্মেধ্যে অন্যতম দলীল হলো:
১. আল্লাহর বাণী:
وَكَذَالِكَ جَعَلْنٰكُمْ أُمَّةً وَّسَطًا لِّتَكُوْنُوْا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ
‘‘এমনিভাবেই আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী সম্প্রদায় করেছি যাতে করে তোমরা মানবমন্ডলীর জন্যে সাক্ষ্যদাতা হও (সূরা আল-বাক্বারা ২:১৪৩)।’’
‘মানুষের জন্য সাক্ষী হতে পারো’ এটি মানুষের কর্মের বিধানের সাক্ষ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে। ফলে সাক্ষীর কথা গ্রহণযোগ্য।
২. আল্লাহর বাণী:
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ
‘‘অত:পর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হও, তবে আল্লাহ ও তাঁর রসূলের দিকে প্রত্যাবর্তন করো (সূরা আন-নিসা ৪:৫৯)।’’
আয়াতটি প্রমাণ করে যেসব ব্যাপারে তাঁরা ঐক্যমত পোষণ করেন, তা হক্ব বা সত্য।
৩. রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী:
لا تجتمع امتي علي الضلالة
‘‘আমার উম্মত গোমরাহীর উপর ঐক্যমত পোষণ করবে না।’’[1]৪. আমরা বলতে পারি যে, কোন বিষয়ে এ উম্মতের ঐক্যমত পোষণ করা হয়তো হক হবে, না হয় বাতিল হবে। যদি হক হয় তাহলে সেটি দলীল যোগ্য। আর যদি বাতিল হয়, তাহলে এটি কিভাবে হতে পারে যে, আল্লাহর নিকট সর্বাধিক মর্যাদাবান এ উম্মত আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর হতে ক্বিয়ামত পর্যন্ত একটি বাতিল বিষয়ের উপর ঐক্যমত পোষণ করবেন, যে বিষয়ের ব্যাপারে আল্লাহ সন্তুষ্ট নন? এটা তো বড়ই অসম্ভব বিষয়!
ইজমা দু’প্রকার। যথা:
১. القطعي (অকাট্ট ইজমা)
২. الظني (প্রবল ধারণা মূলক ইজমা)
১. القطعي (অকাট্ট ইজমা): যে ইজমা উম্মতের পক্ষ হতে অবধারিতভাবে সংঘঠিত হওয়া জানা যায়, তাকে القطعي ইজমা বলে। যেমন: পাঁচ ওয়াক্ত ছ্বলাত ফরজ হওয়ার উপর ইজমা, ব্যভিচার হারাম হওয়ার উপর ইজমা প্রভৃতি। এ ধরণের ইজমা সাব্যস্ত হওয়া এবং প্রমাণ্যতাকে কেউ অস্বীকার করে না। এ ইজমা বিরোধী ব্যক্তি অজ্ঞ না হলে কাফের গণ্য হবে।
২. الظني (প্রবল ধারণা মূলক ইজমা): যে ইজমা অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, তাকে الظني ইজমা বলে। এ ধরনের ইজমা সাব্যস্ত হওয়া সম্ভবের ব্যাপারে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। তবে এ ব্যাপারে অধিকতর অগ্রগণ্য মত হলো শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়া (রহঃ) এর অভিমত। العقيدة الواسطية নামক গ্রন্থে তিনি বলেছেন,
الاجماع الذي ينضبط ما كان عليه السلف الصالح اذ بعدهم كثر الإختلاف وانتشرت الأمة.
‘‘বিধিবদ্ধ ইজমা সেটাই যার উপর সালাফে সালেহীন ছিলেন। কারণ তাঁদের পরে প্রচুর পরিমাণে মতানৈক্য বৃদ্ধি পায় এবং উম্মাহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে।’’[1]
তুমি জেনো রেখো, রহিত নয় এমন সুস্পষ্ট ছহীহ দলীলের বিপক্ষে এ উম্মতের ইজমা বা ঐক্যমত পোষণ করা সম্ভব নয়। কেননা, এ উম্মতের কেবল হক্বের উপরই ঐক্যমত পোষন করতে পারে।কাজেই যখন কোন ইজমাকে দলীলের বিরোধী মনে হবে, সেক্ষেত্রে তুমি দেখতে পাবে যে, হয়ত দলীলটি ছহীহ নয়, অথবা তা দ্ব্যর্থহীন বা সুস্পষ্ট নয় অথবা সেটি মানসুখ বা রহিত অথবা মাস’আলাটিতে মতানৈক্য রয়েছে, যা তুমি জানো না।
ইজমা সংঘটিত হওয়ার কিছু শর্ত রয়েছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো :
১. বিশুদ্ধ পন্থায় ইজমা সাব্যস্ত হওয়া। এটি হতে পারে এভাবে যে, ইজমার বিষয়টি আলেমদের মাঝে সুপ্রসিদ্ধ থাকবে অথবা গভির জ্ঞানের অধিকারী কোন নির্ভরযোগ্য বিদ্বান ইজমার বিষয়টি বর্ণনা করবেন।
২. তার পূর্বে স্থায়ী কোন মতভেদ থাকবে না। যদি তার পূর্বে এরূপ মতভেদ থাকে, তাহলে সে বিষয়ে ইজমা সংঘটিত হবে না। কেননা, বিদ্বানদের মৃত্যুর কারণে তাঁদের অভিমত গুলো বাতিল হয়ে যায় না। সুতরাং ইজমা পূর্বের মতভেদকে উঠিয়ে দেয় না। তবে এটি নতুন করে মতভেদ সৃষ্টি করতে বাধা দেয়। উৎস শক্তিশালী হওয়ার কারণে এ মতটিই অগ্রগণ্য অভিমত।
এ ব্যাপারে এটিও বলা হয় যে, ইজমার ক্ষেত্রে এটি শর্ত নয়। (ইজমা সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে পূর্বের মতভেদ না থাকা শর্ত নয়) কাজেই একাধিক অভিমত সমূহের মাঝে দ্বিতীয় যুগে এসে যে কোন একটি মতের উপর ইজমা সংঘটিত হতে পারে। ফলে ইজমা পরবর্তীদের উপর দলীল হিসেবে গণ্য হবে।
অধিকাংশ বিদ্বানদের মতানুসারে ইজমা সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে ইজমাকারীদের যুগের পরিসমাপ্তি ঘটা শর্ত নয়। কাজেই কোন যুগের অধিবাসীদের পক্ষ থেকে শুধুমাত্র তাদের ঐক্যমত পোষণের মাধ্যমে ইজমা সংঘটিত হবে। পরবর্তিতে তাদের জন্য অথবা অন্যদের জন্য তার বিরুদ্ধাচারণ করা জায়েয নেই। কেননা, যেসব দীলল সমূহ ইজমার হুজ্জিয়্যাত বা প্রামাণ্যতার উপর প্রমাণ করে, তাতে যুগের পরিসমাপ্তির শর্তের উল্লেখ নেই। উপরন্তু এটি এ কারণে যে, ইজমা তাদের একমত হওয়ার সময়ই সংঘটিত হয়ে যায়। কাজেই পরবর্তীতে কোন জিনিস তাকে উঠিয়ে দিবে? যখন কোন মুজতাহিদ কোন কথা বলেন অথবা কোন কর্ম করেন এবং তা অন্যান্য মুজতাহিদগনের মাঝে প্রসিদ্ধ লাভ করে। তাঁরা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা প্রত্যাখ্যান বা প্রতিবাদ করেন না। এ ব্যাপারে বলা হয় যে, এটি ইজমা হিসাবে গণ্য হবে। আবার এটাও বলা হয় যে, এটি ‘হুজ্জত বা প্রামাণ্য’ হিসাবে গণ্য হবে; ইজমা হিসাবে নয়। এটাও বলা হয় যে, এটি প্রত্যাখ্যান করার আগেই তাদের জীবন কালের পরিসমাপ্তি ঘটলে তা ইজমা হিসেবে গণ্য হবে। কেননা, প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাদের যুগের পরিসমাপ্তি পর্যন্ত প্রত্যাখ্যান না করে অব্যাহত ভাবে চুপ থাকা বিষয়টিতে তাদের সহমত পোষণ করার উপর প্রমাণ বহন করে। সুতরাং এ মতটি সত্যের অধিকতর নিকটবর্তী অভিমত।