তিনটি বিষয় আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন:
- আল্লাহর দিকে আহবান করা
- আল্লাহর কাছে পৌঁছার রাস্তা সম্পর্কে অবহিত করা ও
- আল্লাহর নিকট পৌঁছার পর মানুষের যা ঘটবে, সে সম্পর্কে অবহিত করা।
প্রথমটিই হচ্ছে, আল্লাহর একত্ব (তাওহীদ) ও তার প্রতি বিশ্বাস (ঈমান) সম্পর্কে বর্ণনা করা।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে, শরী‘আতের বিধি-বিধান বর্ণনা করা।
তৃতীয়টি হচ্ছে, আখেরাত এবং আখেরাতে শান্তি-শাস্তি, জান্নাত-জাহান্নাম যা কিছু ঘটবে, তদ্বিষয়ের বর্ণনা দেওয়া।
বিস্তারিত বর্ণনা
১। প্রথমতঃ মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা, তার নামসমূহ, গুণাবলী ও কার্যাদি, তার মহানত্ব, ক্ষমতা ও সৃষ্টির প্রতি দয়া সম্পর্কে পরিচয় দানের মাধ্যমে তার দিকে দা‘ওয়াত দিতে হবে। অতএব, আমরা মানুষের উদ্দেশ্যে বর্ণনা করবো যে,আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র মহান-যাতে তারা আল্লাহ তা‘আলাকে সম্মান করে। তিনিই একমাত্র বড়, যাতে তারা তার বড়ত্ব ঘোষণা করে। তিনিই একমাত্র সর্বশক্তিমান, যাতে তারা তাকে ভয় করে। তিনিই একমাত্র মহামহিম, যাতে তারা তাকে ভালবাসে। তিনিই একমাত্র দাতা, যাতে তারা তার কাছেই চায়। তার ভাণ্ডার পরিপূর্ণ, যাতে তারা শুধুমাত্র তার দরজায় দাঁড়ায়।
তাদেরকে আমরা আরো বর্ণনা করবো যে, পবিত্র আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র স্রষ্টা আর তিনি ব্যতীত সবকিছুই সৃষ্ট। তিনিই একমাত্র মালিক আর তিনি ব্যতীত সবকিছুই তার মালিকানাধীন। তিনিই কেবল রিযিক্বদাতা আর তিনি ছাড়া সবাই রিযিক্বপ্রাপ্ত। একমাত্র তিনিই অমুখাপেক্ষী আর তিনি ব্যতীত সবকিছুই তার মুখাপেক্ষী।
আমরা আরো বর্ণনা করবো যে, সবকিছু শুধুমাত্র তার হাতে এবং তিনি ছাড়া কারো হাতে কিছুই নেই। সৃষ্টি ও কর্তৃত্ব তারই এবং তার জন্যই রাজত্ব ও প্রশংসা। তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
আমরা মানুষদেরকে আরো বলবো যে, আল্লাহ তা‘আলাই একমাত্র ইবাদতের উপযুক্ত। তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয়। যখন মানুষ আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহ ও গুণাবলীর পরিপূর্ণতা, তার মহানত্ব ও ক্ষমতার পরিপূর্ণতা, তার রহমত ও জ্ঞানের প্রশস্ততা, তার নিদর্শনাবলী ও সৃষ্টিজগতের বিশালতা এবং তার নেয়ামতসমূহের প্রতুলতা সম্পর্কে জানবে, তখনই তারা তার প্রতি ঈমান আনবে, তার মহানত্ব বর্ণনা করবে, তাকে ভালবাসবে এবং তার আনুগত্য ও ইবাদতে ঝাপিয়ে পড়বে।
এরপর আমরা ঈমানের অন্যান্য রুকন বর্ণনা করবো। যেমন-ফেরেশতামণ্ডলী, আসমানী কিতাবসমূহ ও রাসূলগণের প্রতি ঈমান আনা; এতে গায়েবের প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় হবে।
এগুলো হলো দা‘ওয়াতী কাজের সর্বপ্রথম, সুউচ্চ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
(১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِمَّنْ دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ ) [فصلت: 33]
‘আর তার চেয়ে কার কথা উত্তম,যিনি আল্লাহর দিকে দা‘ওয়াত দেন, সৎকর্ম করেন এবং বলেন যে, অবশ্যই ‘আমি মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত’ (সূরা হা-মীম সাজদা: ৩৩)।
(২) আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
(هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ هُوَ الرَّحْمَنُ الرَّحِيمُ(22) هُوَ اللَّهُ الَّذِي لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْمَلِكُ الْقُدُّوسُ السَّلَامُ الْمُؤْمِنُ الْمُهَيْمِنُ الْعَزِيزُ الْجَبَّارُ الْمُتَكَبِّرُ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ (23) هُوَ اللَّهُ الْخَالِقُ الْبَارِئُ الْمُصَوِّرُ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى يُسَبِّحُ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (24)) [الحشر: 2 - 24]
‘তিনিই আল্লাহ, যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই; দৃশ্য-অদৃশ্যের জ্ঞাতা; তিনিই পরম করণাময়, দয়ালু। (২২) তিনিই আল্লাহ; যিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, তিনিই বাদশাহ, মহাপবিত্র, ত্রুটিমুক্ত, নিরাপত্তাদানকারী, রক্ষক, মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রতাপশালী, অতীব মহিমান্বিত, তারা যা শরীক করে, তা হতে পবিত্র মহান। (২৩) তিনিই আল্লাহ, স্রষ্টা, উদ্ভাবনকর্তা, আকৃতিদানকারী; তাঁর রয়েছে সুন্দর নামসমূহ; আসমান ও যমীনে যা আছে, সবই তার মহিমা ঘোষণা করে। তিনি মহাপরাক্রমশারী, প্রজ্ঞাময়’(সূরা আল-হাশর: ২২-২৪)।
(৩)আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
(فَاعْلَمْ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ مُتَقَلَّبَكُمْ وَمَثْوَاكُمْ (19)) [محمد: 19]
‘অতএব, জেনে রাখ, নিঃসন্দেহে আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই। তুমি ক্ষমা প্রার্থনা কর তোমার এবং মুমিন নারী-পুরুষদের ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্য। আল্লাহ তোমাদের গতিবিধি এবং নিবাস সম্পর্কে অবগত রয়েছেন’ (সূরা মুহাম্মাদ: ১৯)।
২। অতঃপর আখেরাত ও তাতে যা কিছু ঘটবে তার মাধ্যমে দা‘ওয়াত দিতে হবে। যেমন-পুনরুত্থান, হাশর (ক্বিয়ামতের দিন একত্রিত হওয়া), পুলছিরাত, মীযান (দাঁড়িপাল্লা), জান্নাত ও জাহান্নাম; যাতে মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তার আনুগত্যে আগ্রহী হয় এবং কুফরী ও অবাধ্যতা ছেড়ে দেয়। আর যেন তারা সৎকাজে প্রতিযোগিতা করে।
(১) আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ يَوْمَئِذٍ يَتَفَرَّقُونَ (14) فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَهُمْ فِي رَوْضَةٍ يُحْبَرُونَ (15) وَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَلِقَاءِ الْآخِرَةِ فَأُولَئِكَ فِي الْعَذَابِ مُحْضَرُونَ (16)) [الروم: 14 - 16]
‘আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে. সেদিন তারা বিভক্ত হয়ে পড়বে। (১৪) অতএব, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে তাদেরকে জান্নাতে পরিতুষ্ট করা হবে। (১৫) আর যারা কুফরী করেছে এবং আমার আয়াতসমূহ ও পরকালের সাক্ষাতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, তাদেরকেই আযাবের মধ্যে উপস্থিত করা হবে’(সূরা আর-রূম: ১৪-১৬)।
(২) আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
(وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِأَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ ) [التوبة: 72]
‘আল্লাহ মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারীদেরকে জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন, যার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হবে নহরসমূহ, তাতে তারা চিরদিন থাকবে এবং (ওয়াদা দিচ্ছেন) স্থায়ী জান্নাতসমূহে পবিত্র বাসস্থানসমূহের। আর আল্লাহর পক্ষ হতে সন্তুষ্টি সবচেয়ে বড়। এটাই মহা সফলতা’ (সূরা আত-তাওবা: ৭২)।
(৩) আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
(وَعَدَ اللَّهُ الْمُنَافِقِينَ وَالْمُنَافِقَاتِ وَالْكُفَّارَ نَارَ جَهَنَّمَ خَالِدِينَ فِيهَا هِيَ حَسْبُهُمْ وَلَعَنَهُمُ اللَّهُ وَلَهُمْ عَذَابٌ مُقِيمٌ (68)) ... [التوبة: 68].
‘আল্লাহ মুনাফিক পুরুষ, মুনাফিক নারী ও কাফেরদেরকে জাহান্নামের আগুনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাতে তারা চিরদিন থাকবে, এটি তাদের জন্য যথেষ্ট। আর আল্লাহ তাদের লা‘নত করেছেন এবং তাদের জন্য রয়েছে স্থায়ী আযাব’ (সূরা আত-তাওবা: ৬৮)।
৩। অতঃপর দ্বীন ও শরী‘আতের বিধি-বিধান বর্ণনা করা, হালাল-হারাম, ফরয-সুন্নাত, ইবাদত ও লেন-দেন, অধিকার ও দণ্ডবিধি বর্ণনা করার মাধ্যমে দা‘ওয়াতী কাজ করা। দা‘ওয়াতী কাজে এটিই ছিল নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নির্দেশনা।
মক্কায় দা‘ওয়াতী কাজ ছিল আল্লাহ তা‘আলার দিকে আহবান করা এবং পরকাল ও উত্তম চরিত্র সম্পর্কে অবহিত করা। আর রাসূলগণ ও তাদের জাতির অবস্থা বর্ণনা করা।
অতঃপর মদীনায় আল্লাহ তা‘আলা শরী‘আতের বিধি-বিধানের মাধ্যমে দ্বীনের পূর্ণতা দান করেন। ফলে, যারা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছিলেন, তারা সেগুলি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। কাফের ও মুনাফিকরা দ্বীন ইসলামের মাধ্যমে পরাস্ত হয়েছে। অতঃপর মানুষেরা দলেদলে দ্বীন ইসলামে প্রবেশ করেছে এবং দ্বীন পরিপূর্ণ হয়েছে।
১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
(الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا) [المائدة: 3]
‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামত সম্পূর্ণ করলাম আরতোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে পছন্দ করলাম ইসলামকে’ (সূরা আল-মায়েদা: ৩)।
২। আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন:
(إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللَّهِ وَالْفَتْحُ (1) وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا (2) فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا (3)) [النصر:1 - 3].
‘যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় আসবে (১) এবং তুমি লোকদেরকে দলে দলে আল্লাহর দীনে দাখিল হতে দেখবে, (২) তখন তুমি তোমার রবের সপ্রশংস তাসবীহ পাঠ কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর।নিশ্চয় তিনি তওবা কবুলকারী’ (সূরা আন-নাছর: ১-৩)।