[৫] এমন ‘আমল যা ব্যক্তির গুনাহগুলো সাধারণভাবে মাফ করিয়ে দেয় - ৪

৫৯. হাজ্জ ও ‘উমরাহ্ পরপর করা :

পরপর হাজ্জ ও ‘উমরাহ্ করলে জীবনের গুনাহসমূহ মাফ করে দেয়া হয়। নাবী (সা.) বলেছেন :

تَابِعُوا بَيْنَ الْحَجِّ وَالْعُمْرَةِ فَإِنَّهُمَا يَنْفِيَانِ الْفَقْرَ وَالذُّنُوبَ كَمَا يَنْفِي الْكِيرُ خَبَثَ الْحَدِيدِ

‘তোমরা হজ্জকে ‘উমরাহ্ ও ‘উমরাহকে হজ্জের অনুগামী কর। (অর্থাৎ হাজ্জ করলে ‘উমরাহ্ ও ‘উমরাহ্ করলে হাজ্জ কর।) কারণ হাজ্জ ও ‘উমরাহ্ উভয়েই দারিদ্র্য ও পাপরাশিকে সেরূপ দূরীভূত করে যেরূপ (কামারের) হাপর লোহার ময়লাকে দূরীভূত করে ফেলে।’[1]


৬০. হাজরে আসওয়াদ ও রুক্নে ইয়ামানী স্পর্শ করা :

হাজারে আসওয়াদ চুম্বন ও রুক্নে ইয়ামানী স্পর্শ করলে পাপ মাফ হয়। নাবী (সা.) বলেছেন :

إنَّ مَسْحَ الحَجَرِ الْأسْوَدِ والرُّكْنِ اليَمانِي يَحُطَّانِ الخَطايا حَطًّا

‘‘হাজারে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী উভয়কে স্পর্শ পাপ মোচন করে।’’[2]

‘আবদুল্লাহ ইবন ‘উমার বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,

إِنَّ مَسْحَهُمَا يَحُطَّانِ الْخَطِيئَةَ

‘‘উভয়কে স্পর্শ পাপ মোচন করে।’’[3]

ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন :

فالسنة في الحجر الاسود استلامه وتقبيله والسنة في الركن اليماني استلامه ولا يقبل

‘‘হাজরে আসওয়াদের ক্ষেত্রে সুন্নাহ্ হলো সেটি স্পর্শ করা ও চুমু দেয়া আর রুকনুল ইয়ামানীর ক্ষেত্রে সুন্নাহ্ হলো সেটি শুধু স্পর্শ করা, চুমু দেয়া (সুন্নাহ) নয়।’’[4]

অতএব যেহেতু রুকনে ইয়ামানী চুমু দেয়ার কোন দলীল নেই। সুতরাং তা বৈধ নয়।


৬১. কা‘বাহ্ ঘর ত্বওয়াফ করা :

মুসলিমদের কিবলা কা‘বাহ্ ঘর ত্বওয়াফ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ইবাদাত। হাজ্জ ও ‘উমরাহ্ পালনের সময় ত্বওয়াফ করা জরুরি। কিন্তু সাধারণভাবে নফল হিসেবেও কা‘বাহ্ ঘর ত্বওয়াফ করা অনেক ফযীলতের ‘আমল। ত্বওয়াফের মাধ্যমে ত্বওয়াফকারীর গুনাহও মাফ হয়। নাবী (সা.) বলেছেন :

مَنْ طَافَ بِهٰذَا الْبَيْتِ أُسْبُوعًا يُحْصِيهِ كُتِبَ لَه بِكُلِّ خُطْوَةٍ حَسَنَةٌ وَكُفِّرَ عَنْهُ سَيِّئَةٌ وَرُفِعَتْ لَه دَرَجَةٌ وَكَانَ عَدْلَ عِتْقِ رَقَبَةٍ

‘‘যে ব্যক্তি এই (কাবা) ঘর সাতবার চক্কর দেয় (অর্থাৎ একবার ত্বওয়াফ করে) তার প্রতি পদক্ষেপের (হাঁটার সময় পা রাখা-উঠানো) বিনিময়ে একটি করে সাওয়াব তার ‘আমলনামায় লেখা হয় ও তার থেকে একটি করে গুনাহ মাফ করা হয় এবং তার মর্যাদা বাড়ানো হয় আর পুরো ত্বওয়াফ একটি দাসমুক্তির সমতুল্য।’’[5]

‘উমায়র (রহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন,

أَنَّ ابْنَ عُمَرَ كَانَ يُزَاحِمُ عَلَى الرُّكْنَيْنِ زِحَامًا مَا رَأَيْتُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ ﷺ يَفْعَلُه فَقُلْتُ يَا أَبَا عَبْدِ الرَّحْمٰنِ إِنَّكَ تُزَاحِمُ عَلَى الرُّكْنَيْنِ زِحَامًا مَا رَأَيْتُ أَحَدًا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ ﷺ يُزَاحِمُ عَلَيْهِ فَقَالَ إِنْ أَفْعَلْ فَإِنِّىْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ ﷺ يَقُولُ إِنَّ مَسْحَهُمَا كَفَّارَةٌ لِلْخَطَايَا وَسَمِعْتُه” يَقُولُ مَنْ طَافَ بِهٰذَا الْبَيْتِ أُسْبُوعًا فَأَحْصَاهُ كَانَ كَعِتْقِ رَقَبَةٍ وَسَمِعْتُه” يَقُولُ لَا يَضَعُ قَدَمًا وَلَا يَرْفَعُ أُخْرٰى إِلَّا حَطَّ اللهُ عَنْهُ خَطِيئَةً وَكَتَبَ لَه” بِهَا حَسَنَةً

ইবনু ‘উমার চাপাচাপি করে হলেও হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়ামানী বায়তুল্লাহর এই দুই রুকনে যেতেন। আমি একদিন তাঁকে বলাম, আপনি এ দু’টি রুকনে ভীড়ে চাপাচাপি করে হলেও গিয়ে উপস্থিত হন কিন্তু অন্য কোন সাহাবী তো এমন চাপাচাপি করে সেখানে যেতে দেখি না। তিনি বললেন, যদি আমি এরূপ চাপাচাপি করি তাতে দোষ কী? কেননা আমি তো রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, এ দু’টো রুকন স্পর্শ করা স্পর্শকারীর গুনাহসমূহের কাফফারাহ্ হয়ে যায় তাঁকে আরো বলতে শুনেছি, কেউ যদি যথাযথ ভাবে বায়তুল্লাহর সাতবার ত্বওয়াফ করে (অর্থাৎ সাত চক্কর দিয়ে এক ত্বওয়াফ সম্পন্ন করে) তাহলে তাতে একটি ক্রীতদাস মুক্ত করার মত সাওয়াব হয়। আমি তাঁকে আরো বলতে শুনেছি, ত্বওয়াফ করতে গিয়ে এমন কোন কদম সে রাখেনা বা তা উঠায় না যা দ্বারা তার একটি গুনাহ মাফ না হয় এবং একটি নেকী লেখা না হয়।[6]


৬২. ‘আরাফাত দিবসের সিয়াম রাখা :

হাজ্জের মৌলিক কাজ হচ্ছে যিলহাজ্জ মাসের ৯ তারিখে মক্কার অনতিদূরে ‘আরাফাত ময়দানে সারাদিন অবস্থান করা। কিন্তু এই দিনে যারা ‘আরাফাতের ময়দানের বাইরে থাকেন, অর্থাৎ হাজ্জ করেন না তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ্সম্মত ‘আমল হচ্ছে এই দিন সিয়াম পালন করা। আর এই একটি সিয়ামের মাধ্যমে ব্যক্তির পূর্বের একবছর ও পরের একবছরের গুনাহ মাফ করা হয়। ক্বাতাদাহ্ বলেন, নাবী (সা.) ‘আরাফার দিবসের সাওম পালন করার ফযীলত সম্পর্কে বলেছেন,

صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِى قَبْلَه وَالسَّنَةَ الَّتِى بَعْدَه

‘‘আর ‘আরাফাত দিবসের সাওম (রোযা) সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, এর মাধ্যমে তিনি পূর্ববর্তী বছর ও পরবর্তী বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন।’’[7]

ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) বলেন :

والمراد بها الصغائر … أنه ان لم تكن صغائر يرجى التخفيف من الكبائر فان لم يكن رفعت درجات

‘‘এর দ্বারা সগীরা গুনাহ উদ্দেশ্য।... যদি সগীরা গুনাহ ব্যক্তির ‘আমলনামায় না থাকে তাহলে তার কাবীরা গুনাহ (থাকলে) হালকা করা হবে বলে আশা করা যায়। আর যদি কাবীরা গুনাহও না থাকে তাহলে তার মর্যাদা উন্নীত করা হয়।’’[8]

সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, নাবী (সা.) বলেন :

مَنْ صَامَ يَوْمَ عَرَفَةَ غُفِرَ لَه ذَنْبٌ سَنَتَيْنِ مُتَتَابِعَتَيْنِ

‘‘যে ব্যক্তি ‘আরাফার দিন সিয়াম রাখে তার উপর্যুপরি দুই বছরের পাপরাশি মাফ হয়ে যায়।’’[9]


৬৩. মুহার্রমের ১০ তারিখে (‘আশূরার) সিয়াম রাখা :

রমাযানের ফরয সিয়ামের পরে সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ সিয়াম হচ্ছে ‘আশূরা দিনের (অর্থাৎ মুহাররম মাসের ১০ তারিখের) সিয়াম। এই সিয়াম পূর্বের এক বছরের গুনাহ মাফ করায়। কাতাদাহ্ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নাবী (সা.) ‘আশূরার সাওম (মুহাররম মাসের দশ তারিখে সিয়াম) পালন করার ফযীলত সম্পর্কে বলেন,

صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِى قَبْلَه

‘‘আর ‘আশূরার সাওম (রোযা) সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তিনি এর মাধ্যমে বান্দার পূর্ববর্তী বছরের গুনাহসমূহ মাফ করে দিবেন।’’[10]

উল্লেখ্য যে, এই দিনের সাথে সাথে আগের দিন (৯ তারিখ) বা পরের দিন (১১ তারিখ) মোট দুই দিন সিয়াম পালন করা মুস্তাহাব ও অধিক ফযীলতের।


৬৪. রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সলাত ও সালাম পাঠ করা :

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সলাত ও সালাম পেশ করা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি ‘আমল। তাঁর প্রতি সলাত পেশ করলে শুধু সাওয়াবই হয় না বরং গুনাহও মাফ হয়। আনাস ইবন মালিক নাবী (সা.)-এর বরাত দিয়ে বলেন যে, তিনি বলেছেন :

مَنْ صَلّٰى عَلَيَّ وَاحِدَةً صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ عَشْرًا وَحَطَّ عَنْهُ عَشْرَ خَطِيئَاتٍ

‘‘যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার সলাত আদায় করবে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রতি দশবার রহমত বর্ষণ করেন এবং তার দশটি গুনাহ মোচন করেন।’’[11]

আবূ ত্বলহাহ্ আল আনসারী হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

أَصْبَحَ رَسُولُ اللهِ ﷺ يَوْمًا طَيِّبَ النَّفْسِ يُرٰى فِي وَجْهِهِ الْبِشْرُ قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ أَصْبَحْتَ الْيَوْمَ طَيِّبَ النَّفْسِ يُرٰى فِي وَجْهِكَ الْبِشْرُ قَالَ أَجَلْأَتَانِي آتٍ مِنْ رَبِّىْ عَزَّ وَجَلَّ فَقَالَ مَنْ صَلّٰى عَلَيْكَ مِنْ أُمَّتِكَ صَلَاةً كَتَبَ اللهُ لَه عَشْرَ حَسَنَاتٍ وَمَحَا عَنْهُ عَشْرَ سَيِّئَاتٍ وَرَفَعَ لَه عَشْرَ دَرَجَاتٍ

একদিন সকালে রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রফুল্ল মনে সকাল করলেন। তখন তার চেহারায় আনন্দের ছাপ দেখা যাচ্ছিল। তখন সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সা.) আজ আপনি প্রফুল্লচিত্তে সকাল করেছেন, এতে আপনার চেহারায় খুশির ছাপ দেখা যাচ্ছে। (এর কারণ কী?) তখন তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমার কাছে আমার সম্মানিত রবের পক্ষ থেকে একজন আগমণকারী এসে বললো, ‘‘আপনার উম্মাতের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি তোমার প্রতি একবার সলাত পাঠ করবে আল্লাহ তার জন্য দশটি সাওয়াব লিখে দেন, তার দশটি গুনাহ মোচন করেন এবং তার মর্যাদার দশটি স্তর বৃদ্ধি করে দেন।’’[12]

[1]. সুনান আন্ নাসায়ী : ২৬৩০, ২৬৩১; জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৮১০, হাদীসটি হাসান সহীহ।

[2]. আল মু‘জামুল কাবীর : ১৩৪৩৮, সহীহ আল জামি‘ : ২১৯৪।

[3]. মুসনাদ আহমাদ : ৫৭০১; সুনান আন্ নাসায়ী : ২৯১৯, হাদীসটি সহীহ।

[4]. আল মাজমূ’, খ. ৮, পৃ. ৩৭।

[5]. মুসনাদে আহমাদ : ৫৭০১।

[6]. জামি‘ আত্ তিরমিযী : ৯৫৯, হাদীসটি সহীহ।

[7]. সহীহ মুসলিম : ২৮০৩।

[8]. শারহু সহীহ মুসলিম, খ. ৮, পৃ. ২৯২।

[9]. আল মু‘জামুল কাবীর : ৫৯২৩; সহীহুত তারগীব : ১০১২।

[10]. সহীহ মুসলিম : ২৮০৩।

[11]. মুসনাদ আহমাদ : ১১৯৯৮; আলবানী আস্ সহীহাহ্ গ্রন্থে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, হাদীস নং ৮২৯।

[12]. মুসনাদ আহমাদ : ১৬৩৫২; সনদ হাসান।