ছোট-বড় সমস্ত পাপ থেকে তাওবাহ্ করা ওয়াজিব। তাওবাহ্ কবূল হওয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে মর্যাদা ও সম্মানের ব্যপার। হকপন্থী আলেমগণের মতে আংশিক পাপ থেকে তাওবাহ্ করলে সেই তাওবাহ্ গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হবে এবং অবশিষ্ট পাপ রয়ে যাবে। তাওবাহ্ ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসে প্রচুর প্রমাণ রয়েছে এবং এ ব্যাপারে উম্মতের ঐকমত্যও বিদ্যমান।
তাওবাহ্ করলে মহান আল্লাহ তাঁর গুনাহগার বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
وَهُوَ الَّذِي يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِه وَيَعْفُو عَنِ السَّيِّئَاتِ وَيَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ
‘‘তিনিই তাঁর বান্দাদের তাওবাহ্ কবূল করেন এবং পাপসমূহ মোচন করেন। আর তোমরা যা কর, তিনি তা জানেন।’’[1]
আল্লাহ তা‘আলা তাওবাকারীর গুনাহ মাফ করে তাকে পরকালে জান্নাত দান করবেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
يٰۤاَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللهِ تَوْبَةً نَصُوحًا عَسٰى رَبُّكُمْ أَنْ يُكَفِّرَ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِىْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ
‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে তাওবাহ্ কর, খাঁটি তাওবা; আশা করা যায় তোমাদের রব তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন এবং তোমাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশে নহরসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে।’’[2]
তাওবাকারী তাওবাহ্ করার পর এমন অবস্থায় পৌঁছে যেন সে কোন গুনাহই করেনি অর্থাৎ সত্যিকার অর্থে তাওবাকারী নিষ্পাপ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
التَّائِبُ مِنْ الذَّنْبِ كَمَنْ لَا ذَنْبَ لَهُ
‘‘গুনাহ থেকে তাওবাকারী সেই ব্যক্তির মত, যার কোন গুনাহই নেই।’’[3]
নাবী (সা.) আরো বলেছেন :
وَيَتُوبُ اللهُ عَلٰى مَنْ تَابَ
‘‘আর যে তাওবাহ্ করে, আল্লাহ তার তাওবাহ্ গ্রহণ করেন।’’[4]
তিনি (সা.) আরো বলেছেন :
إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَبْسُطُ يَدَه بِاللَّيْلِ لِيَتُوبَ مُسِىءُ النَّهَارِ وَيَبْسُطُ يَدَه بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِىءُ اللَّيْلِ حَتّٰى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا
‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা নিজ হাত রাতে প্রসারিত করেন; যেন দিনে পাপকারী (রাতে) তাওবাহ্ করে। এবং দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করেন; যেন রাতে পাপকারী (দিনে) তাওবাহ্ করে। যে পর্যন্ত পশ্চিম দিকে থেকে সূর্যোদয় না হবে, সে পর্যন্ত এই রীতি চালু থাকবে।’’[5]
তাওবাকারী বান্দা সফল বান্দা। বান্দা তাওবাহ্ করলে আল্লাহ তা‘আলা খুশী হন। কোন বান্দা গুনাহ করার পর তাওবাহ্ করলে আল্লাহ কতটা আনন্দিত হন তার উদাহরণ দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :
اللهُ أَفْرَحُ بِتَوْبَةِ عَبْدِه مِنْ أَحَدِكُمْ سَقَطَ عَلٰى بَعِيرِه وَقَدْ أَضَلَّه فِي أَرْضِ فَلَاةٍ
‘‘আল্লাহ তা‘আলা নিজ বান্দার তাওবাহ্ করার জন্য ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বেশী আনন্দিত হন, যে তার উট মরুভূমিতে হারিয়ে ফেলার পর পুনরায় ফিরে পায়।’’[6]
সহীহ মুসলিম-এর অন্য বর্ণনায় এভাবে এসেছে যে,
لَلَّهُ أَشَدُّ فَرَحًا بِتَوْبَةِ عَبْدِه حِينَ يَتُوبُ إِلَيْهِ مِنْ أَحَدِكُمْ كَانَ عَلٰى رَاحِلَتِه بِأَرْضِ فَلَاةٍ فَانْفَلَتَتْ مِنْهُ وَعَلَيْهَا طَعَامُه وَشَرَابُه فَأَيِسَ مِنْهَا فَأَتٰى شَجَرَةً فَاضْطَجَعَ فِى ظِلِّهَا قَدْ أَيِسَ مِنْ رَاحِلَتِه فَبَيْنَا هُوَ كَذٰلِكَ إِذَا هُوَ بِهَا قَائِمَةً عِنْدَه فَأَخَذَ بِخِطَامِهَا ثُمَّ قَالَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ اللّٰهُمَّ أَنْتَ عَبْدِى وَأَنَا رَبُّكَ.أَخْطَأَ مِنْ شِدَّةِ الْفَرَحِ
‘‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তাওবায় যখন সে তাওবাহ্ করে তোমাদের সেই ব্যক্তির চেয়ে বেশী খুশি হন, যে তার বাহন (উট)-এর উপর চড়ে কোন মরুভূমি বা জনহীন প্রান্তর অতিক্রমকালে বাহনটি তার নিকট থেকে পালিয়ে যায়। আর খাদ্য ও পানিয় সব ওর পিঠের উপর থাকে। বহু খোঁজাখুঁজির পর নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে বাহনটি (উটটি) হঠাৎ তার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। সে তার লাগাম ধরে খুশির চোটে বলে ওঠে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আর আমি তোমার রব!’ সীমাহীন খুশির কারণে সে ভুল করে ফেলে।’’[7] উল্লেখ্য, এ জাতীয় অনিচ্ছাকৃত ভুল মার্জনীয়।
তাওবাহ্ আল্লাহর রহমতের অংশ। বান্দা গুনাহ করলে আল্লাহ তাঁর রহমতের কারণে বান্দাকে মাফ করে দেন। তবে তার জন্য বান্দাকে আল্লাহর কাছে তাওবাহ্ করতে হবে। শুধু তাওবা-ই নয়, তাওবার পর সৎ ‘আমলের উপরে অটল থাকতে হবে, তাহলেই আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফ করে দিবেন। আল্লাহ তার এই রহমতের কথা এভাবে বলেছেন,
وَإِذَا جَاءَكَ الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِآيَاتِنَا فَقُلْ سَلَامٌ عَلَيْكُمْ كَتَبَ رَبُّكُمْ عَلٰى نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ أَنَّه مَنْ عَمِلَ مِنْكُمْ سُوءًا بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابَ مِنْ بَعْدِه وَأَصْلَحَ فَأَنَّه غَفُورٌ رَّحِيمٌ
‘‘আর যারা আমাদের আয়াতসমূহের উপর ঈমান আনে, তারা যখন তোমার কাছে আসে, তখন তুমি বল, ‘তোমাদের উপর সালাম’। তোমাদের রব তাঁর নিজের উপর লিখে নিয়েছেন দয়া, নিশ্চয় যে তোমাদের মধ্য থেকে না জেনে খারাপ কাজ করে তারপর তাওবাহ্ করে এবং শুধরে নেয়, তবে তিনি অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’’[8]
আল্লাহ তা‘আলার এই রহমতের শতকরা মাত্র ১ ভাগ অর্থাৎ ১০০ রহমতের মধ্যে মাত্র ১টি রহমত দুনিয়ার সকল সৃষ্টির মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। এই রহমতের কারণেই মা-বাবা তাদের সন্তানকে লালনপালনে এতো কষ্ট সহ্য করেন এবং আদর করেন। গাভী তার বাছুরকে জিহবা দিয়ে আদর করে। আরও যত রহমত ও দয়ার দৃষ্টান্ত আমরা সৃষ্টিজগতে দেখতে পাই তার সবকিছুই আল্লাহ তা‘আলার ১০০টি রহমতের ১টির প্রভাব। বাকী ৯৯টি রহমত আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামাতের জন্য রেখে দিয়েছেন। আবূ হুরায়রাহ্ হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি (সা.) বলেছেন :
إِنَّ اللهَ خَلَقَ الرَّحْمَةَ يَوْمَ خَلَقَهَا مِائَةَ رَحْمَةٍ فَأَمْسَكَ عِنْدَه” تِسْعًا وَتِسْعِينَ رَحْمَةً وَأَرْسَلَ فِىْ خَلْقِهِ كُلِّهِمْ رَحْمَةً وَاحِدَةً فَلَوْ يَعْلَمُ الْكَافِرُ بِكُلِّ الَّذِىْ عِنْدَ اللهِ مِنْ الرَّحْمَةِ لَمْ يَيْئَسْ مِنْ الْجَنَّةِ وَلَوْ يَعْلَمُ الْمُؤْمِنُ بِكُلِّ الَّذِىْ عِنْدَ اللهِ مِنْ الْعَذَابِ لَمْ يَأْمَنْ مِنْ النَّارِ
‘‘আল্লাহ যেদিন রহমত সৃষ্টি করেন সেদিন ১০০টি রহমত সৃষ্টি করেছেন। ৯৯টি তাঁর কাছে রেখে দিয়েছেন এবং ১টি মাত্র রহমত সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যদি কাফির আল্লাহর কাছে সুরক্ষিত প্রতিটি রহমত সম্পর্কে জানে তাহলে সে জান্নাত লাভে নিরাশ হবে না। আর মু’মিন যদি আল্লাহর কাছে যে শাস্তি আছে সে সম্পর্কে জানে তা হলে সে জাহান্নাম থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করবে না।’’[9]
আর দুনিয়ার ঐ ১টি রহমতের কারণেই আল্লাহ বান্দার ছোট-বড় সকল গুনাহ মাফ করেন।
[2]. সূরা আত্ তাহরীম ৬৬ : ৮।
[3]. সুনান ইবনু মাজাহ : ৪২৫০; শু‘আবুল ঈমান : ৭১৯৬, সহীহুত তারগীব : ৩১৪৫, হাদীসটি হাসান।
[4]. সহীহুল বুখারী : ৬৪৩৪, ৬৪৩৯; সহীহ মুসলিম : ২৪৬২।
[5]. সহীহ মুসলিম : ৭১৬৫।
[6]. সহীহুল বুখারী : ৬৩০৯; সহীহ মুসলিম : ৭১২৮।
[7]. সহীহ মুসলিম : ৭১৩৬।
[8] সূরা আল আন্‘আম ০৬ : ৫৪।
[9]. সহীহুল বুখারী : ৬৪৬৯।