যে ব্যক্তি এমন বিষয়ের জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছা করবে যা তার জ্ঞানের নাগালের বাইরে এবং যার বুঝ বশ্যতা স্বীকারে সন্তুষ্ট হবে না, তার ইচ্ছা তাকে নির্ভেজাল তাওহীদ, স্বচ্ছ মারেফত-পরিচয় ও ছহীহ ঈমান হতে দূরে সরিয়ে রাখবে।

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

فَمَنْ رَامَ عِلْمَ مَا حُظِرَ عَنْهُ عِلْمُهُ وَلَمْ يَقْنَعْ بِالتَّسْلِيمِ فَهْمُهُ حَجَبَهُ مَرَامُهُ عَنْ خَالِصِ التَّوْحِيدِ وَصَافِي الْمَعْرِفَةِ وَصَحِيحِ الْإِيمَانِ

যে ব্যক্তি এমন বিষয়ের জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছা করবে যা তার জ্ঞানের নাগালের বাইরে এবং যার বুঝ বশ্যতা স্বীকারে সন্তুষ্ট হবে না, তার ইচ্ছা তাকে নির্ভেজাল তাওহীদ, স্বচ্ছ মারেফত-পরিচয় ও ছহীহ ঈমান হতে দূরে সরিয়ে রাখবে।

.......................................................................

ব্যাখ্যা: এখানে পুর্বোক্ত কথার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। দ্বীনের মূলনীতির ব্যাপারে কথা বলতে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়; বরং অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিনা ইলমে কথা বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করার হুকুম করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَٰئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُولًا

‘‘এমন কোনো জিনিসের পেছনে লেগে যেয়ো না যে সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই। নিশ্চিয়ই চোখ, কান ও দিল সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে’’। (সূরা বানী ইসরাঈল: ৩৬) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَمِنَ النَّاسِ مَن يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَيَتَّبِعُ كُلَّ شَيْطَانٍ مَّرِيدٍ كُتِبَ عَلَيْهِ أَنَّهُ مَن تَوَلَّاهُ فَأَنَّهُ يُضِلُّهُ وَيَهْدِيهِ إِلَىٰ عَذَابِ السَّعِيرِ

‘‘কতক লোক এমন আছে যারা জ্ঞান ছাড়াই আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করে এবং প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তানের অনুসরণ করতে থাকে। অথচ তার ব্যাপারে তো এটা নির্ধারিত রয়েছে যে, যে ব্যক্তি তাকে বন্ধু বানাবে তাকে সে পথভ্রষ্ট করে ছাড়বে এবং জাহান্নামের আযাবের পথ দেখিয়ে দেবে’’। (সূরা আল হজ্জ: ৩-৪) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

وَمِنَ النَّاسِ مَن يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُّنِيرٍثَانِيَ عِطْفِهِ لِيُضِلَّ عَن سَبِيلِ اللَّهِ لَهُ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَنُذِيقُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَذَابَ الْحَرِيقِ

‘‘আরো কিছু লোক এমন আছে যারা কোনো জ্ঞান পথ নির্দেশনা ও দীপ্তিমান কিতাব ছাড়াই আল্লাহর ব্যাপারে বিতর্ক করে। সে বিতর্ক করে ঘাড় বাঁকিয়ে যাতে লোকদেরকে আল্লাহর পথ থেকে ভ্রষ্ট করা যায়। এমন ব্যক্তির জন্য রয়েছে দুনিয়ায় লাঞ্ছনা এবং কিয়ামতের দিন আমি তাকে আগুনের আযাবের জ্বালা আস্বাদন করাবো’’। (সূরা আল হজ্জ: ৮-৯)

আল্লাহ তা‘আলা সূরা কাসাসের ৫০ নং আয়াতে আরো বলেন,

وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

‘‘আল্লাহর হেদায়াতের পরিবর্তে যে ব্যক্তি নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, তার চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট আর কে হতে পারে? নিশ্চয়ই আল্লাহ্ জালেম সম্প্রদায়কে পথ দেখান না’’। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلَّا الظَّنَّ وَمَا تَهْوَى الْأَنْفُسُ وَلَقَدْ جَاءَهُمْ مِنْ رَبِّهِمُ الْهُدَى

‘‘তারা শুধু ধারণা এবং তাদের এ যা চায় তারই অনুসরণ করে। অথচ তাদের নিকট তাদের প্রভুর পক্ষ হতে হেদায়াত আগমন করেছে। (সূরা আন নাযম: ২৩) এ অর্থে এমন আরো অনেক আয়াত রয়েছে।

আবু উমামা বাহেলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

مَا ضَلَّ قَوْم بَعْد هُدًى كَانُوا عَلَيْهِ إِلَّا أُوتُوا الْجَدَل ثُمَّ تَلَا تِلْكَ الْآيَة مَا ضَرَبُوهُ لَك إِلَّا جَدَلًا بَلْ هُمْ قَوْم خَصِمُونَ

‘‘হেদায়াত পাওয়ার পর কোনো জাতি কেবল তখনই পথ ভ্রষ্ট হয়েছে, যখন তারা অযথা বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে। অতঃপর তিনি কুরআনের এ আয়াতটি পাঠ করলেন,

مَا ضَرَبُوهُ لَك إِلَّا جَدَلًا بَلْ هُمْ قَوْم خَصِمُونَ

‘‘এরা শুধু তর্কের উদ্দেশ্যেই তোমাকে এ কথা বলে। বস্তুত এরা তো এক বিতর্ককারী সম্প্রদায়’’। (সূরা যুখরুফ: ৫৮) ইমাম তিরমিযী হাদীছটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন, হাসান ছহীহ।[1] আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

«إِنَّ أَبْغَضَ الرِّجَالِ إِلَى اللَّهِ الأَلَدُّ الْخَصِمُ»

‘‘ঝগড়াটে লোকই আল্লাহর নিকট সর্বাধিক ঘৃণিত’’। ইমাম বুখারী ও মুসলিম হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।[2]

যে ব্যক্তি নিজেকে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের কাছে সোপর্দ না করবে, তার তাওহীদ নষ্ট হবে। কেননা যে ব্যক্তি হাদীছ দিয়ে কথা না বলবে, সে কেবল নিজস্ব মত ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করেই কথা বলবে। সে সঙ্গে সে এমন লোকের তাকলীদ (দলিলবিহীন অনুসরণ)ও করবে, যে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সুস্পষ্ট হেদায়াতের উপর নেই। এতে করে রাসূলের সুন্নাত থেকে সরে যাওয়া অনুপাতে তার তাওহীদ কমে যাবে। কেননা সে অনুসরণের ক্ষেত্রে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ইলাহ হিসাবে গ্রহণ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ

‘‘তুমি কি তাকে দেখো নি, যে নিজের প্রবৃত্তিকে নিজের ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? (সূরা ফুরকান: ৪৩)’’ অর্থাৎ তার এ যার ইবাদত করতে চায়, তারই ইবাদত করে। মূলত তিনটি বাতিল ফির্কার কারণেই মানুষের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রহিমাহুল্লাহ বলেন,

رَأَيْتُ الذُّنُوبَ تُمِيتُ الْقُلُوبَ... وَقَدْ يُورِثُ الذُّلَّ إِدْمَانُهَا

وَتَرْكُ الذُّنُوبِ حَيَاةُ الْقُلُوبِ... وَخَيْرٌ لِنَفْسِكَ عِصْيَانُهَا

وَهَلْ أَفْسَدَ الدِّينَ إِلَّا الْمُلُوكُ... وَأَحْبَارُ سُوءٍ وَرُهْبَانُهَا

(১) আমি অবশ্যই অবগত আছি যে, পাপাচার মানুষের অন্তর মেরে ফেলে। আর গুনাহর কাজে আসক্তি অপমান ও লাঞ্জনা ডেকে আনে।

(২) পাপাচার ছেড়ে দেয়ার মধ্যেই রয়েছে অন্তরের জীবন। নফসের অবাধ্য হওয়ার মধ্যেই রয়েছে তোমার কল্যাণ।

(৩) রাজা-বাদশারাই দ্বীনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে চরিত্রহীন পাদ্রী ও সন্ন্যাসীর দল।

যালেম শাসকরা তাদের নিকৃষ্ট রাজনীতির মাধ্যমে শরীয়তের উপর আপত্তি করে ও শরীয়তের বিরোধীতা করে এবং তাদের রাজনীতিকে আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর প্রাধান্য দেয়। নিকৃষ্ট সন্ন্যাসীর স্থলাভিষিক্ত ঐসমস্ত আলেম-উলামা, যারা তাদের রায় ও বাতিল কিয়াসসমূহের আশ্রয় নিয়ে শরীয়তের দলীল-প্রমাণ প্রত্যাখ্যান করে। তাদের রায় ও কিয়াসগুলো আল্লাহ তা‘আলার হারামকে হালাল করেছে এবং তার হালালকে করেছে হারাম, আল্লাহ যা বাতিল করেছেন, তারা তাকে মূল্যায়ন করেছে, আল্লাহ ও তার রসূল যা সকলের জন্য উন্মুক্ত রেখেছেন, তারা তাকে খাস করে নিয়েছে এবং এমনি আরো অনেক অন্যায় করেছে।

এ উম্মতের মুর্খ সুফীরাই খৃষ্টানদের ধর্মযাজক ও পাদ্রীদের আসন দখল করে নিয়েছে। এরাই প্রকৃত ঈমান ও শরীয়তের বিধি-বিধান বাস্তবায়নের পথে অন্তরায় হয়ে রয়েছে। এরা যাওক-রুচি, প্রেম-প্রীতি, আবেগ-অনুভূতি, মনের কল্পনা, আল্লাহর প্রেমের পাগল এবং শয়তানের ভ্রান্ত কাশফের আশ্রয় নিয়ে এমন নতুন দ্বীন তৈরী করে নিয়েছে, যার অনুমতি আল্লাহ তাদেরকে দেননি। আল্লাহ তা‘আলা তার নাবীর মাধ্যমে যে দ্বীন প্রেরণ করেছেন এগুলোর মাধ্যমে তারা তাকে বাতিল করে দিয়েছে। ঈমানের হাকীকতগুলো বাস্তবায়ন করা হতে কেবল শয়তান ও নফসের কুমন্ত্রণাই মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে।

পূর্বেকার কিছু লোক বলেছে, যখন শাসকের আদেশ আল্লাহর শরীয়তের পরিপন্থী হবে, তখন শাসকের আদেশকে শরীয়তের আদেশের উপর প্রাধান্য দিতে হবে। আরেক শ্রেণীর লোক বলেছে, আমাদের বিবেক-বুদ্ধির যুক্তি যখন কুরআন-হাদীছের দলীলের বিপরীত হবে, তখন বিবেক-বুদ্ধির যুক্তিকেই প্রাধান্য দিবো। আর সুফী সম্প্রদায়ের লোকেরা বলেছে, যখন আমাদের ‘যাওক বা রুচি’ এবং কাশফ শরীয়তের বাহ্যিক কোনো বিষয়ের পরিপন্থী হবে, তখন আমরা কাশফ[3] ও যাওককেই প্রাধান্য দিবো।

ইমাম গাজ্জালী রহিমাহুল্লাহ তার অন্যতম মূল্যবান কিতাব إحياء علوم الدين -এ বলেন, প্রশ্ন হলো মানতেক ও তর্কশাস্ত্র কি জ্যোতিষ শাস্ত্রের মত নিন্দনীয়? না কি এটি মুবাহ?

এর জবাবে আমি বলবো, মানুষেরা এ বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে চরম বাড়াবাড়ি ও সীমা লংঘন করেছে। কেউ কেউ বলেছেন, ইলমুল কালাম ও তর্কশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা বিদআত ও হারাম। শির্ক ছাড়া অন্যান্য সকল প্রকার পাপাচার নিয়ে আল্লাহর কাছে হাযির হওয়া ইলমে কালাম নিয়ে তার নিকট হাযির হওয়ার চেয়ে উত্তম। আবার কেউ কেউ বলেছেন, মানতেক, ইলমে কালাম ও তর্ক শাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা ফরয। কেউ বলেছেন, ফরযে কেফায়া আবার কেউ বলেছেন, ফরযে আইন। শুধু তাই নয়; তারা আরো বলেছেন, এটি সর্বোত্তম আমল এবং সর্বোচ্চ আনুগত্য। এর মাধ্যএে তাওহীদের জ্ঞান পুর্ণরূপে অর্জিত হয় এবং এটিই আল্লাহর দ্বীনের পথে সংগ্রামের অন্তর্ভূক্ত। ইমাম গাজ্জালী রহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, কেউ কেউ বলেছেন, ইলমে মানতেক ও তর্কশাস্ত্র সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্পূর্ণ নিষেধ। এটিই ইমাম শাফেঈ, আহমাদ বিন হান্বাল, সুফিয়ান সাওরী এবং সালাফদের মুহাদ্দিছদের মত। তাদের মতামতকে ইমাম গাজ্জালী স্বীয় কিতাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, সালাফদের সকল মুহাদ্দিছের ঐকমত্যে এটি হারাম। তাদের থেকে এ বিষয়ে যত উক্তি এসেছে তা উপরোক্ত কথার মধ্যেই সীমিত নয়।

আলেমগণ বলেছেন, ছাহাবীগণ ইলমে কালাম, মানতেক ও তর্কশাস্ত্র সম্পর্কে চুপ থাকার কারণ হলো, তারা তাওহীদের হাকীকত সম্পর্কে ভালো করেই জানতেন এবং অন্যদের তুলনায় ইলমে কালামের পরিভাষা ও শব্দ চয়ন সম্পর্কে অধিকতর জ্ঞানী ছিলেন। এ জন্যই তাদের থেকে দ্বীনের ক্ষেত্রে কোনো বিদআত ও ক্ষতিকর জিনিস বের হয়নি। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

هَلَكَ الْمُتَنَطِّعُونَ قَالَهَا ثَلَاثًا

যারা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে, তারা ধ্বংস হোক। কথাটি তিনি তিনবার বলেছেন।[4] অর্থাৎ দ্বীনের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানার সময় বেশী বেশী ঘাটাঘাটি করা ও গভীরে প্রবেশ করা ঠিক নয়। ইলমে কালাম ও তর্কশাস্ত্র যদি দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত হতো, তাহলে রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ব্যাপারে সর্বাগ্রে আদেশ দিতেন এবং কালাম শাস্ত্রবিদদের প্রশংসা করতেন। অতঃপর ইমাম গাজ্জালী রহিমাহুল্লাহ আরো অনেক দলীল-প্রমাণ উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তিনি অন্য পক্ষের দলীল উল্লেখ করেছেন। পরিশেষে তিনি বলেছেন, আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আপনার নিকট গ্রহণযোগ্য মত কোন্টি? এ প্রশ্নের জবাব ইমাম গাজ্জালী বিস্তারিতভাবে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তাতে লাভ ও ক্ষতি উভয়ই রয়েছে। এর যে অংশের মধ্যে উপকার রয়েছে, তা আমাদের জন্য অবস্থাভেদে হালাল অথবা মুস্তাহাব কিংবা ওয়াজিব হতে পারে।

আর ইলমে কালাম ও তর্কশাস্ত্রের যে অংশ ক্ষতিকর হবে, সে সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা আমাদের জন্য হারাম। ইলমে কালাম ও তর্কশাস্ত্রে ক্ষতিকর দিকগুলোর মধ্যে রয়েছে যে, তা সন্দেহ ছড়ায়, মানুষের আক্বীদাহ পরিবর্তন হয়ে যায় এবং এতে দ্বীনের উপর মানুষের দৃঢ়তা কমে যায়।

ইলমুল কালাম ও মানতেক-যুক্তিবিদ্যা শাস্ত্রে প্রবেশ করার মাধ্যমে মানুষের আক্বীদাহ এত দুর্বল হয়ে যায় যে সে ধীরে ধীরে সন্দেহপূর্ণ দলীলের দিকে ফিরে যায় এবং এতে লোকেরা মতভেদ করে থাকে। সুতরাং সত্য সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস অর্জন করার ক্ষেত্রে এর ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। এটি বিদ‘আতী আক্বীদাহকে শক্তিশালী করে এবং মানুষের অন্তরে একে ছাবেত করে দেয়। আর ইলমে কালাম, মানতেক ও তর্কশাস্ত্রের পিছনে লেগে থাকার প্রতি তাদের মনের টান ও আগ্রহ প্রবল হয়ে থাকে। তর্ক-বিতর্ক করার কারণে যে গোড়ামি শুরু হয়, তা থেকেই এ ক্ষতির সূত্রপাত হয়।

[1]. হাসান: তিরমিযী ৩২৫৩, মিশকাতুল মাসাবিহ ১৮০, ছহীহ তারগিব ১৩৭।

[2]. ছহীহ আল বুখারী ২৪৫৭, ছহীহ মুসলিম ২৬৬৮।

[3]. বিভিন্ন দিক নির্দেশনা ও আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য সুফীদের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য মূলনীতি হচ্ছে কাশফ। সুফীদের বিশ্বাস হচ্ছে আধ্যাত্মিক সাধনার মাধ্যমে একজন সুফী সাধকের হৃদয়ের পর্দা উঠে যায় এবং তাদের সামনে সৃষ্টি জগতের সকল রহস্য উন্মুক্ত হয়ে যায়। তাদের পরিভাষায় একেই বলা হয় কাশফ। সুফীরা কাশফের সংজ্ঞায় বলেছে,

بأنه: الإطلاع على ما وراء الحجاب من المعاني الغيبية والأمور الحقيقية وجوداً وشهوداً

পর্দার অন্তরালে যে সমস্ত গায়েবী তথ্য ও প্রকৃত রহস্য লুকায়িত আছে তা পাওয়া ও দেখার নামই হলো কাশফ। কাশফ হাসিল হয়ে গেলে আল্লাহ এবং সুফী সাধকের মাঝে কোন অন্তরায় থাকেনা। তখন তারা জান্নাত, জাহান্নাম, সাত আসমান, যমীন, আল্লাহর আরশ, লাওহে মাহফুয পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারে। তারা গায়েবের সকল খবর, মানুষের অন্তরের অবস্থা এবং সাত আসমানে ও যমীনে যা আছে তার সবই জানতে পারে। এমনকি তাদের অবগতি ব্যতীত গাছের একটি পাতাও ঝড়ে না, এক বিন্দু বৃষ্টিও বর্ষিত হয় না, আসমান-যমীনের কোন কিছুই তাকে অক্ষম করতে পারে না। এমনকি লাওহে মাহফুযে যা আছে, তাও তারা অবগত হতে পারে, তাতে কিছু বাড়াতে পারে, কমাতেও পারে। এমনি আরো অসংখ্য ক্ষমতা অর্জনের দাবী করে থাকে, যা একমাত্র মহান আল্লাহর গুণ।

কাশফের একটি উদাহরণ:

তাবলীগি নেসাব ফাযায়েলে আমাল নামক বইয়ের মধ্যে কাশফের একাধিক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। পাঠকদের জন্য আমরা এখানে মাত্র একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।

শায়খ আবু ইয়াজিদ কুরতুবী (রহি.) বলেন: আমি শুনেছি, যে ব্যক্তি সত্তর হাজার বার ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়ে সে দোযখের আগুন হতে নাজাত পায়। আমি এ খবর শুনিয়া এক নেছাব অর্থাৎ সত্তর হাজার বার আমার স্ত্রীর জন্য পড়লাম এবং কয়েক নেছাব আমার নিজের জন্য পড়িয়া আখেরাতের সম্বল করে রাখলাম। আমাদের নিকট এক যুবক থাকতো। তাহার সম্বন্ধে প্রসিদ্ধ ছিল যে, তাহার কাশ্ফ হয় এবং জান্নাত-জাহান্নামও সে দেখতে পায়। তার সত্যতার ব্যাপারে আমার কিছুটা সন্দেহ ছিল। একবার সে যুবক আমাদের সহিত খাওয়া-দাওয়ায় শরীক ছিল। এমতাবস্থায় হঠাৎ সে চিৎকার দিয়া উঠল এবং তাহার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল এবং সে বলল, আমার মা দোযখে জ্বলছে, আমি তার অবস্থা দেখতে পেয়েছি। কুরতুবী (রহি.) বলেন: আমি তার অস্থির অবস্থা লক্ষ্য করছিলাম। আমার খেয়াল হল যে, একটি নেছাব তাহার মার জন্য বখশাইয়া দেই। যা দ্বারা তার সত্যতার ব্যাপারেও আমার পরীক্ষা হয়ে যাবে। অর্থাৎ তাহার কাশ্ফ হওয়ার ব্যাপারটা পরীক্ষা হয়ে যাবে। সুতরাং আমার জন্য পড়া সত্তর হাজারের নেছাবসমূহ হতে একটি নেছাব তাহার মার জন্য বখশাইয়া দিলাম। আমি আমার অন্তরে তা গোপন রাখছিলাম। কিন্তু ঐ যুবক তৎক্ষনাৎ বলতে লাগল চাচা! আমার মা দোযখের আগুন হতে রক্ষা পেয়েছে।

কুরতুবী (রহি.) বলেন: এ ঘটনা হতে আমার দু’টি ফায়দা হল। এক. সত্তর হাজার বার কালেমা তাইয়্যেবা পড়ার বরকত সম্পর্কে যাহা আমি শুনেছি তার অভিজ্ঞতা। দুই. যুবকটির সত্যতার (তার কাশ্ফ হওয়ার) একীন হইয়া গেল। দেখুন: ফাযায়েলে আমাল, ১ম খন্ড, ১৩৫ পৃষ্ঠা, প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর-২০০১ ইং। দারুল কিতাব, ৫০ বাংলা বাজার ঢাকা-১১০০ থেকে প্রকাশিত)

[4]. ছহীহ মুসলিম ২৬৭০, মুসনাদে ইবনে আবী শাইবা।
কালামশাস্ত্রের অসারতা সম্পর্কে ইমাম গাজ্জালীর স্বীকারোক্তি

অতঃপর ইমাম গাজ্জালী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইলমে কালাম ও তর্কশাস্ত্রের উপকারীতা সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে, এর মাধ্যমে সকল বিষয়ের হাকীকত ও আসল অবস্থা জানা যায়। আসলে ইলমে কালামের মধ্যে এ পবিত্র উদ্দেশ্যটি আশানুরূপ বাস্তবায়ন হয় না। বিভিন্ন বিষয়ের যে পরিমাণ রহস্য পরিচয় এর মাধ্যমে উদঘাটিত হয়, তার চেয়ে এতে বিভ্রান্তি ও গোমরাহী হয় বেশি। ইমাম গাজ্জালী আরো বলেন, আপনি যখন কোনো মুহাদ্দিছ অথবা যাহেরী মাজহাবের লোকের নিকট এ কথা শুনবেন, তখন আপনার মনের মধ্যে এ কথা উদিত হবে যে, মূর্খতাই মানুষের বিরাট শত্রু। অর্থাৎ এরা যেহেতু ইলমে কালাম সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না, তাই তারা কখনো ইলমে কালামের প্রশংসা করবে না; বরং তারা এর নিন্দা করবেই।

সুতরাং হে ভাই! আপনি এ কথা এমন এক লোকের নিকট থেকে শুনতে পাচ্ছেন, যিনি ইলমে কালাম বা তর্কশাস্ত্রের গভীরে প্রবেশ করেছে। অতঃপর কালামশাস্ত্রের হাকীকত জানার পর এবং মুতাকাল্লিমীনদের-কালাম শাস্ত্রবিদদের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছার পরই তিনি উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন। তিনি যে শুধু কালাম শাস্ত্র সম্পর্কেই পান্ডিত্য অর্জন করেছেন, তা নয়; বরং জ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও ছিল তার অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বহু বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের পর তিনি নিশ্চিতভাবে জানতে সক্ষম হয়েছেন যে, ইলমে কালামের মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান ও সত্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিশ্বাস অর্জন করা অসম্ভব। ইলমে কালাম বা মানতেক ও তর্কশাস্ত্রের সর্বোচ্চ ফায়দা হলো এর মাধ্যমে কিছু কিছু বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা, পরিচয় এবং প্রকৃত অবস্থা জানা যায়। তবে তা খুবই বিরল।[1] ইমাম গাজ্জালীর কথা এখানেই শেষ।

সুতরাং ইলমে কালামের মধ্যে তেএ কোনো উপকার নাই বলে তিনি যে কথা বলেছেন, এটি উপস্থাপিত বিষয়ে চূড়ান্ত একটি দলীল। সালাফগণ এটিকে এ জন্য পছন্দ করেননি যে, তা এমন একটি নতুন পরিভাষা মাত্র, যা সঠিক অর্থে গঠন করা হয়েছে। যেমন অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিভাষার জন্য সঠিক শব্দ রয়েছে। বাতিলপন্থীদের সাথে তর্ক করার সময় এ নতুন পরিভাষাগুলো যে সঠিক অর্থে ব্যবহার করা হয়, সালাফগণ সেই সঠিক অর্থকে অপছন্দ করেননি; বরং তারা কালামশাস্ত্রের শব্দগুলোকে শুধু এ জন্য অপছন্দ করেছেন যে, তার মধ্যে রয়েছে অনেক মিথ্যা কথা এবং সত্যের পরিপন্থী বিষয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের বিরোধিতা এবং তাতে যেসব উপকারী ও সত্য-সঠিক জ্ঞান রয়েছে তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইলমে কালাম ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও লোকেরা এটি অর্জনের জন্য অনেক কষ্টকর পথ অতিক্রম করেছে এবং এর উপকার খুবই সামান্য হওয়া সত্ত্বেও এটিকে সাব্যস্ত করার জন্য অনেক লম্বা কথা বলেছে। আসলে ইলমে কালাম হলো ঐ শুকনো উটের মাংসের ন্যায়, যা পাহাড়ের চূড়ায় রাখা হয়েছে। সেখানে উঠতে খুব কষ্ট হয়। সেখানে উঠার রাস্তা সহজ নয় যে, অতি সহজেই তাতে উঠা যাবে। কষ্ট করে তাতে উঠেও তেএ কোনো লাভ নেই। কারণ সেখানে প্রচুর মাংস পাওয়া যাবে না যে, তা থেকে বাছাই করে কিছু সংগ্রহ করা যাবে।

তাদের নিকট সবচেয়ে সুন্দর যা পাওয়া যাবে, তার ব্যাখ্যা কুরআনেই বিশুদ্বভাবে করা হয়েছে। তাদের কাছে যা আছে তা অর্জন করাতে অযথা কষ্ট করা, দীর্ঘ সময় নষ্ট করা এবং সহজ বিষয়কে আরো জটিল করা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। কবি বলেন,

لَوْلَا التَّنَافُسُ فِي الدُّنْيَا لَمَا وُضِعَتْ... كُتْبُ التَّنَاظُرِ لَا الْمُغْنِي وَلَا الْعَمَدُ

يُحَلِّلُونَ بِزَعْــمٍ مِنْهُمُ عُقَدًا... وَبِالَّذِي وَضَعُوهُ زَادَتِ الْعـــُقَدُ

‘‘যদি দুনিয়ার সুনাম অর্জনের উদ্দেশ্য না থাকতো, তাহলে ইলমে কালাম ও তর্কশাস্ত্রের কিতাবগুলো রচিত হতো না। ‘আল-মুগনী’ এবং ‘আমাদ’ নামক কিতাবও রচিত হতো না। তারা মনে করে এর মাধ্যমে দ্বীনের দুর্বোধ্য বিষয়গুলো সহজ হবে। অথচ তাদের রচিত কিতাবগুলো দ্বীনের বিষয়গুলোকে আরো দুর্বোধ্য করেছে’’।

তারা মনে করেছে, ইলমে কালাম ও তর্কশাস্ত্রের উপর বড় বড় কিতাব লিখে দ্বীনের মধ্যকার বিভিন্ন সন্দেহ দূর করবে।

তবে প্রকৃত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে, এর মাধ্যমে সন্দেহ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

আর আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের মাধ্যমে অন্তরের আরোগ্য, হেদায়াত, ইলম ও ইয়াকীন অর্জিত না হলে ইলমে কালামের মাধ্যমে তা অর্জন করা অসম্ভব। বরং আল্লাহ তা‘আলা যা বলেছেন এবং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন, তাকেই মূল হিসাবে নির্ধারণ করা আবশ্যক। সেই সঙ্গে তার অর্থ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা, তা বোধগম্য করা এবং তার আকলী ও শরঈ দলীল-প্রমাণগুলো জানা আবশ্যক। শরঈ দলীলগুলোর উভয় প্রকার দলীলগুলোর দালালত সম্পর্কেও জানবে। সেই সঙ্গে মানুষের যেসব কথা কুরআন-সুন্নাহর সাথে সংগতিপূর্ণ হয় এবং যেসব কথা তার বিরোধী হয়, সেগুলোকে মুতাশাবেহা ও সংক্ষিপ্ত মনে করবে এবং কথাগুলোর প্রবর্তকদেরকে বলা হবে, এ শব্দগুলোর এ অর্থ হতে পারে। এর মাধ্যমে যদি রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংবাদের সমর্থন করা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তা গ্রহণ করা হবে। আর যদি তারা তার খবরের বিরোধীতা করতে চায়, তাহলে তাদের শব্দগুলো প্রত্যাখ্যাত হবে।

উদাহরণ স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলার সত্তা ও সিফাতের ক্ষেত্রে কালামশাস্ত্র বিদদের التركيب (যুক্ত করণ), الجسم (দেহ), التحيز (স্থান দখল করা), الجوهر (মূলবস্তু), الجهة (দিক), الحيز (পরিমন্ডল), العرض (অবস্থা) ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। কালাম শাস্ত্রবিদগণ যে অর্থে এ শব্দগুলো ব্যবহার করেছে, সে অর্থে কুরআন-হাদীছে এ শব্দগুলো উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি আরবী ভাষাতেও উক্ত অর্থে শব্দগুলো আসেনি। বরং তারা এমন অর্থকে ব্যাখ্যা করার জন্য শব্দগুলো ব্যবহার করে, যে অর্থে অন্যরা শব্দগুলো ব্যবহার করেনি। তাই উক্ত অর্থগুলো অন্যান্য শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করা হবে। দেখতে হবে কুরআন-সুন্নাহর কোন্ আকলী ও নকলী দলীলগুলো উক্ত অর্থ প্রকাশ করে। আল্লাহর সত্তা ও সিফাত সম্পর্কে যেসব সংক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহার করে, সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চাইলে বাতিল থেকে হক সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।

উদাহরণ স্বরূপ التركيب শব্দটির কথা বলা যেতে পারে। এর অনেক অর্থ রয়েছে।

(১) দুই বা ততোধিক বিষয়ের মাধ্যমে কোনো কিছু গঠন করাকে তারকীব বলা হয়। পরস্পর বিপরীতমুখী একাধিক জিনিসের সংমিশ্রণের মাধ্যমে কোনো বস্তু গঠিত হওয়াকে তারকীবে মাযজী বলা হয়। যেমন চারটি স্বভাব ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমন্বয়ে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর গঠন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এসব অংশ দ্বারা বিশেষিত হওয়ার সম্পূর্ণ উর্ধ্বে। উপরে সমুন্নত হওয়া এবং পূর্ণতার অন্যান্য গুণাবলী দ্বারা আল্লাহ তা‘আলাকে বিশেষিত করার অর্থ এ নয় যে, তিনি উপরোক্ত স্বভাবগুলো দ্বারা গঠিত।

(২) تركيب الجوار বা পাশাপাশি দু’টি জিনিসের দ্বারা কোনো জিনিস গঠিত হওয়াকে তারকীবুল জিওয়ার বলা হয়। যেমন দরজার দুই কপাট এবং অনুরূপ অন্যান্য জিনিস। আল্লাহ তা‘আলার জন্য একাধিক সিফাত সাব্যস্ত করা দ্বারা আবশ্যক হয় না যে, দরজার দুই কপাটের ন্যায় আল্লাহর সিফাতগুলো তার সাথে যুক্ত রয়েছে।

(৩) সমপর্যায়ের বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ে কোনো জিনিস গঠিত হওয়াকে الجواهر المفردة বা একক পদার্থ বলা হয়।

(৪) আদি ও মৌলিক বস্তু এবং আকৃতি দ্বারাও কোনো কোনো জিনিস গঠিত হয়। যেমন একটি আংটির উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এর মৌলিক উপাদান হলো রোপা এবং এর আকৃতি সকলেরই জানা। কালামশাস্ত্র বিদরা বলেছে, দেহ সাধারণত একক পদার্থ দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে। এ বিষয়ে তাদের আরো অনেক কথা রয়েছে। এতে কোনো লাভ নেই। তারা বলেছে, দু’টি মৌলিক জিনিস দ্বারা দেহ গঠিত হতে পারে, চারটি দিয়েও হতে পারে, ছয়টি দিয়ে, আটটি এবং ষোলটি দিয়েও গঠিত হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্বের সিফাত এবং সৃষ্টির উপরে তার সমুন্নত হওয়া সাব্যস্ত করার জন্য এ ধরণের তারকীব জরুরী নয়। প্রকৃত কথা হলো এ সকল জিনিস দ্বারা দেহ গঠিত নয়। তাদের কথা শুধু দলীল বিহীন দাবি ছাড়া অন্য কিছু নয়। যথাস্থানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

(৫) সত্তা এবং সিফাত দ্বারাও তারকীব হয়ে থাকে। কালাম শাস্ত্রবিদরা এটিকে তারকীব নাম দিয়েছে। কারণ তারা এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে অস্বীকার করতে চায়। এটি তাদের নিজস্ব পরিভাষা। আরবী ভাষায় এর কোনো অস্তিত্ব নেই। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এটি ব্যবহার করেননি। আমরা এদের পরিভাষার সাথে সম্মতি প্রদান করি না। তারা যদি আল্লাহর জন্য সিফাত সাব্যস্ত করাকে তারকীব বলে, তাহলে আমরা তাদেরকে বলবো যে, সিফাতের অর্থগুলোই মূল উদ্দেশ্য। শব্দগুলো ধর্তব্য নয়। তোমরা আল্লাহর জন্য সিফাত সাব্যস্ত করাকে যে কোনো নামে নামকরণ করতে পারো। অর্থ ছাড়া নামের উপর কোনো হুকুম প্রয়োগ হয় না। কেউ যদি দুধকে অন্য নামে নামকরণ করে, তাহলে এ নাম দেয়া হারাম নয়।

(৬) মাহিয়াত এবং এর অস্তিত্বের তারকীব। অর্থাৎ প্রকৃত বস্তু এবং তার অস্তিত্ব একসাথে যুক্ত কি না? মস্তিস্ক কল্পনা করতে পারে যে এ দু’টি বস্তু পরস্পর আলাদা। কিন্তু এ ও মস্তিস্কের কল্পনার বাইরে অস্তিত্বহীন কোনো সত্তা থাকতে পারে কি? এমনি সত্তা ছাড়া কোনো অস্তিত্ব আছে কি? এটি অসম্ভব। আপনি দেখবেন যে, কালামবিদগণ বলে থাকে যে, রবের সত্তাই কি তার অস্তিত্ব? না কি তার সত্তা অস্তিত্বের বাইরে অন্য একটি জিনিস? এ জাতিয় কথায় তারা মারাত্মক বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে এবং কোনো একটি কথাকে প্রাধান্য দেয়া থেকে বিরত রয়েছে, তাদের মতটিই সর্বোত্তম। আসলে এ সব বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া এবং বিস্তারিত ব্বিরণের মাধ্যমে বহু বিভ্রান্তি ও বাতিল কথার অবসান হয়ে থাকে।

[1]. ইমাম গাজ্জালীর এ কথা থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে, ইলমে কালাম, তর্কশাস্ত্র, দর্শন ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকৃত সত্য ও মারেফতে ইলাহী অর্জন করা মোটেই সম্ভব নয়।
আক্বীদার ক্ষেত্রে মুসলিমদের বিভ্রান্তির কারণ

আসলে আল্লাহর কালাম ও রাসূলের সুন্নাত থেকে বিমুখ হয়ে গ্রীক দর্শন এবং বিভিন্ন মানুষের মতাদর্শ নিয়ে ব্যস্ত থাকাই আক্বীদার ক্ষেত্রে মুসলিমদের গোমরাহীর মূল কারণ। এ শ্রেণীর গোমরাহ লোকদেরকে আহলে কালাম এ জন্য বলা হয় যে, তারা নতুন কোনো ইলম নিয়ে আসেনি। বরং তারা এমন কিছু বাড়তি কথা-বার্তা বলেছে, যাতে কোনো উপকার নেই। তারা শুধু ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয় সমূহকে অধিকতর সুস্পষ্ট করার জন্য কিছু উপমা-উদাহরণ পেশ করেছে। যদিও কিয়াস ও উপমা পেশ করে আক্বীদার বিষয়গুলো বাদ দিয়ে দ্বীনের অন্যান্য মাস‘আলায় উপকৃত হওয়া যায়। সেই সঙ্গে যারা বিবেক-বুদ্ধি ও অনুভূতির দলীলকে অস্বীকার করে তাদের সামনে কিয়াস ও উপমার মাধ্যমে দলীলও পেশ করা যায়।

আসল কথা হলো কোনো বিষয়ে কুরআন-হাদীছের দলীল থাকার পরও যে ব্যক্তি স্বীয় রায়, রুচি এবং মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে কথা বলল অথবা নিজের বিবেক-বুদ্ধির উপর নির্ভর করল সে কেবল ইবলীসেরই সাদৃশ্য অবলম্বন করলো। ইবলীস আল্লাহর আদেশের সামনে বশীভূত না হয়ে সে বলেছিল,

أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِين

‘‘আমি আদমের চেয়ে ভালো। তুমি তাকে সৃষ্টি করেছ মাটি থেকে। আর আমাকে সৃষ্টি করেছ আগুন থেকে’’। (সূরা আল ‘আরাফ: ১২) আল্লাহ আরো বলেন,

مَنْ يُطِعْ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللَّهَ وَمَنْ تَوَلَّى فَمَا أَرْسَلْنَاكَ عَلَيْهِمْ حَفِيظًا

‘‘যে ব্যক্তি রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করল সে আল্লাহর অনুসরণ করল। আর যারা মুখ ফিরিয়ে নিবে, আমি তাদের জন্য আপনাকে সংরক্ষণকারী হিসাবে প্রেরণ করিনি’’। (সূরা আন নিসা: ৮০)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمْ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ وَاللَّهُ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ

‘‘বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে ভালবাসবেন।’’ (সূরা আলে-ইমরান: ৩১)

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا

‘‘অতএব তোমার পালকর্তার কসম, তারা ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মেনে নেয়। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজের মনে কোন রকম সংকীর্ণতা বোধ না থাকে এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নেবে’’। (সূরা আন নিসা: ৬৫)

এখানে আল্লাহ তা‘আলা তার নিজের সত্তার শপথ করে বলেছেন যে, তারা তার নাবীকে ফায়ছালাকারী না বানালে, তার ফায়ছালাতে সন্তুষ্ট না থাকলে এবং তার ফায়ছালাকে মাথা পেতে মেনে না নিলে মুমিন হতে পারবে না।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৩ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে