ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
وَكُلُّ دَعْوَى النُّبُوَّةِ بَعْدَهُ فَغَيٌّ وَهَوًى
তার পরে যেসব লোক নবুওয়াতের দাবি করবে, তাদের প্রত্যেকের দাবি ভ্রষ্টতা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
.....................................................
ব্যাখ্যা: যখন সাব্যস্ত হলো যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নাবী, তখন জানা গেল, তার পরে যে কেউ নবুওয়াত দাবী করবে, সে মিথ্যুক হিসাবে গণ্য হবে। এ কথা বলা যাবে না যে, নবুওয়াতের দাবিদার যদি অলৌকিক মুজেযা এবং উজ্জ্বল দলীল-প্রমাণ দেখায়, তাহলে কিভাবে তাকে মিথ্যুক বলা হবে?
এর জবাবে আমরা বলবো যে, এমনটি অকল্পনীয় এবং অসম্ভব। কেননা আল্লাহ তা‘আলা যখন সংবাদ দিয়েছেন, তিনিই সর্বশেষ নাবী তখন এটি অসম্ভব যে, নবুওয়াতের কোনো দাবিদার আসবে; কিন্তু তার দাবিতে মিথ্যাবাদিতা প্রকাশিত হবে না। الغي শব্দটি الرشاد এর বিপরীত। নফ্সের প্রবৃত্তিকে الهوى বলা হয়। অর্থাৎ নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে যারা নবুওয়াতের দাবি করেছে, তারা প্রবৃত্তির অনুসরণ করেই তা করেছে। কোনো দলীলের উপর ভিত্তি করে তারা তা করেনি। সুতরাং তাদের নবুওয়াতের দাবি সম্পূর্ণ বাতিল।[1]
নিকটবর্তী অতিতে ভারতবর্ষের মীর্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী নবুওয়াতের দাবী করেছিল। তার অনুসারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ভারত বর্ষের অনেক আলেম তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন এবং মুসলমানদেরকে পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে সমস্ত ভন্ড এবং মিথ্যুক নাবী থেকে উম্মতকে সতর্ক করেছেন সে তাদেরই একজন। আল্লামা ছানাউল্লাহ অম্রিতসরী রহিমাহুল্লাহ অত্যন্ত কঠোর ভাষায় তার প্রতিবাদ করেন। এতে মিথ্যুক কাদিয়ানী শাইখ ছানাউল্লাহর সাথে চ্যালেঞ্জ করলে উভয় পক্ষের মাঝে ১৩২৬ হিজরী সালে এক বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে এ মর্মে পরস্পরে অভিশাপ করা হয় যে, দু’জনের মধ্যে যে মিথ্যুক সে যেন অল্প সময়ের মধ্যে এবং সত্যবাদীর জীবদ্দশাতেই কলেরা রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯০৮ সালের ২৬ মে ধ্বংস যায়। আল্লাহ তা‘আলা শায়খ ছানাউল্লাহর দু’আ কবুল করলেন। এ ঘটনার এক বছর এক মাস দশদিন পর মিথ্যুক কাদীয়ানী ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
মির্জা গোলাম আহমাদ কাদিয়ানীর দিকে সম্বন্ধ করে এ ফির্কাকে কাদিয়ানী ফির্কা বলা হয়। সে সঙ্গে তাদের আসল চেহারা লুকানোর জন্য তারা নিজেদেরকে আহমাদিয়া মুসলিম জামাআত বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে মির্জা গোলাম আহমাদ জন্মগ্রহণ করে। গবেষকগণ এ মর্মে একমত হয়েছেন যে, তার পিতা ইংরেজদের গুপ্তচর ছিল। ইংরেজরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য এ গোলাম আহমাদকে ব্যবহার করেছে। ইতিহাস প্রমাণ করে, যে সময় আরব উপদ্বীপে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের সংস্কার আন্দোলন আত্মপ্রকাশ করে এবং পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের মতই ভারতেও শাইখের তাওহীদী দাওয়াত ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক সে সময় গোলাম আহমাদকে লন্ডনের তরফ থেকে নাবী বানানো হয়। কারণ ভারতবর্ষের মুসলিমগণ শাইখের দাওয়াতে প্রভাবিত হয়ে এবং স্থানীয় আলেমদের আহবানে সাড়া দিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদে ঝাপিয়ে পড়ে। ইংরেজরা এটি বুঝতে পেরে মুসলিমদের মধ্যে ফিতনা ও বিভক্তি সৃষ্টি করার জন্য এবং সে জিহাদী আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য চিন্তা করতে থাকে। এ জন্য তারা বিচক্ষণ যুবক গোলাম আহমাদকে নির্বাচন করে তার মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
গোলাম আহমাদ প্রথমেই নবুওয়াত দাবি করেনি। কারণ প্রথমেই নবুওয়াত দাবি করলে লোকদের পক্ষ থেকে কঠোর প্রতিবাদ উঠার ও তাকে সরাসরি মিথ্যুক হিসাবে সাব্যস্ত করার আশঙ্কা ছিল। তাই মুসলিমদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনের জন্য এবং নিজেকে দ্বীনের একজন সৈনিক হিসাবে দেখানোর জন্য সর্বপ্রথম সে ইহুদী-খৃষ্ঠান মুসলিমদের প্রতিবাদে البراهين الأحمدية নামে একটি কিতাব রচনা করে। কিছুদিন পরে সে নিজেকে শতাব্দির মুজাদ্দেদ হিসাবে দাবি করে। এর কিছুদিন পর সে নিজেকে প্রতিশ্রম্নত ইমাম মাহদী বলে প্রচার করতে থাকে। অতঃপর সে নিজেকে ঈসা মাসীহ বলে দাবি করে। পরিশেষে সে সরাসরি ও প্রকাশ্যে নবুওয়াতের দাবি করে।
গোলাম আহমাদের মৃত্যুর পর যখন তার লিখিত কিতাবগুলো উদ্ধার হল, তখন সেখানে ইংরেজদের বরাবর লিখিত একটি চিঠি পাওয়া গিয়েছিল। তার হাতেই চিঠিতে লিখা ছিল, আমি ইংরেজ শাসকদের প্রশংসা, সমর্থন ও ভারত বর্ষের মুসলিমদেরকে ইংরেজদের অনুগত থাকার প্রতি উৎসাহিত করে পঞ্চাশাধিক কিতাব লিখেছি। এগুলোর প্রত্যেকটিতেই আমি মুসলিমদেরকে জিহাদের পথ পরিহার করা এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত থাকার আহবান জানিয়েছি। সুতরাং তার লেখনির মাধ্যমেই প্রমাণিত যে, আল্লাহর পক্ষ হতে নয়; বরং লন্ডন থেকে তার কাছে অহী প্রেরিত হতো। ইংরেজ পর্যটকদের থেকেও সে অহী গ্রহণ করতো। এ অহীর উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষ থেকে শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাবের দাওয়াতের প্রভাবকে মুছে ফেলা এবং মুসলিমদের জিহাদী চেতনাকে বিলীন করা।
কাদিয়ানীদের শরীয়াতের অন্যতম মূলনীতি হলো, জিহাদকে চিরতরে বাতিল করে দেয়া। ভারতবর্ষে যখন ইংরেজ হটাও আন্দোলন চলছিল এবং তাদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের ভয়াবহ যুদ্ধ চলছিল, তখন গোলাম আহমাদ কাদিয়ানী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়াতো এবং বলতো ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা শরীয়াত সম্মত নয়। অতঃপর সে শরীয়াতের অনেক হারাম জিনিসও হালাল করেছে এবং নিজের পক্ষ হতে নতুন নতুন হুকুম-আহকাম যাহির করা শুরু করেছে। ভারতবর্ষের বাইরে ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই কাদিয়ানী মতবাদের প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে ক্ষুধা ও দারিদ্রকে কাজে লাগিয়ে কাদিয়ানীরা আফ্রিকা মহাদেশেও তাদের বিভ্রান্তি প্রচার করে যাচ্ছে।
গোলাম আহমাদের মৃত্যুর পর কাদীয়ানীরা একাধিক লোককে তাদের খলীফা নির্বাচন করে। তাদের বর্তমান খলীফা হলো মির্জা মাসরুর আহমাদ। সে স্থায়ীভাবে লন্ডনে বসবাস করছে।
পরিশেষে জেনে রাখা আবশ্যক যে কুরআন-সুন্নাহর অনেক দলীল ও মুসলিমদের সকল মাযহাবের আলেমদের ঐক্যমতে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বশেষ নাবী হলেও কাদিয়ানীরা খতমে নবুওয়াতকে অস্বীকার করে। আমরা তাদের কুফুরী থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ তা‘আলার আশ্রয় প্রার্থনা করছি।