অতঃপর ইমাম গাজ্জালী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইলমে কালাম ও তর্কশাস্ত্রের উপকারীতা সম্পর্কে ধারণা করা হয় যে, এর মাধ্যমে সকল বিষয়ের হাকীকত ও আসল অবস্থা জানা যায়। আসলে ইলমে কালামের মধ্যে এ পবিত্র উদ্দেশ্যটি আশানুরূপ বাস্তবায়ন হয় না। বিভিন্ন বিষয়ের যে পরিমাণ রহস্য পরিচয় এর মাধ্যমে উদঘাটিত হয়, তার চেয়ে এতে বিভ্রান্তি ও গোমরাহী হয় বেশি। ইমাম গাজ্জালী আরো বলেন, আপনি যখন কোনো মুহাদ্দিছ অথবা যাহেরী মাজহাবের লোকের নিকট এ কথা শুনবেন, তখন আপনার মনের মধ্যে এ কথা উদিত হবে যে, মূর্খতাই মানুষের বিরাট শত্রু। অর্থাৎ এরা যেহেতু ইলমে কালাম সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না, তাই তারা কখনো ইলমে কালামের প্রশংসা করবে না; বরং তারা এর নিন্দা করবেই।
সুতরাং হে ভাই! আপনি এ কথা এমন এক লোকের নিকট থেকে শুনতে পাচ্ছেন, যিনি ইলমে কালাম বা তর্কশাস্ত্রের গভীরে প্রবেশ করেছে। অতঃপর কালামশাস্ত্রের হাকীকত জানার পর এবং মুতাকাল্লিমীনদের-কালাম শাস্ত্রবিদদের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছার পরই তিনি উপরোক্ত মন্তব্য করেছেন। তিনি যে শুধু কালাম শাস্ত্র সম্পর্কেই পান্ডিত্য অর্জন করেছেন, তা নয়; বরং জ্ঞানের অন্যান্য শাখাতেও ছিল তার অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বহু বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের পর তিনি নিশ্চিতভাবে জানতে সক্ষম হয়েছেন যে, ইলমে কালামের মাধ্যমে প্রকৃত জ্ঞান ও সত্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট বিশ্বাস অর্জন করা অসম্ভব। ইলমে কালাম বা মানতেক ও তর্কশাস্ত্রের সর্বোচ্চ ফায়দা হলো এর মাধ্যমে কিছু কিছু বিষয়ের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা, পরিচয় এবং প্রকৃত অবস্থা জানা যায়। তবে তা খুবই বিরল।[1] ইমাম গাজ্জালীর কথা এখানেই শেষ।
সুতরাং ইলমে কালামের মধ্যে তেএ কোনো উপকার নাই বলে তিনি যে কথা বলেছেন, এটি উপস্থাপিত বিষয়ে চূড়ান্ত একটি দলীল। সালাফগণ এটিকে এ জন্য পছন্দ করেননি যে, তা এমন একটি নতুন পরিভাষা মাত্র, যা সঠিক অর্থে গঠন করা হয়েছে। যেমন অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিভাষার জন্য সঠিক শব্দ রয়েছে। বাতিলপন্থীদের সাথে তর্ক করার সময় এ নতুন পরিভাষাগুলো যে সঠিক অর্থে ব্যবহার করা হয়, সালাফগণ সেই সঠিক অর্থকে অপছন্দ করেননি; বরং তারা কালামশাস্ত্রের শব্দগুলোকে শুধু এ জন্য অপছন্দ করেছেন যে, তার মধ্যে রয়েছে অনেক মিথ্যা কথা এবং সত্যের পরিপন্থী বিষয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের বিরোধিতা এবং তাতে যেসব উপকারী ও সত্য-সঠিক জ্ঞান রয়েছে তার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ইলমে কালাম ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও লোকেরা এটি অর্জনের জন্য অনেক কষ্টকর পথ অতিক্রম করেছে এবং এর উপকার খুবই সামান্য হওয়া সত্ত্বেও এটিকে সাব্যস্ত করার জন্য অনেক লম্বা কথা বলেছে। আসলে ইলমে কালাম হলো ঐ শুকনো উটের মাংসের ন্যায়, যা পাহাড়ের চূড়ায় রাখা হয়েছে। সেখানে উঠতে খুব কষ্ট হয়। সেখানে উঠার রাস্তা সহজ নয় যে, অতি সহজেই তাতে উঠা যাবে। কষ্ট করে তাতে উঠেও তেএ কোনো লাভ নেই। কারণ সেখানে প্রচুর মাংস পাওয়া যাবে না যে, তা থেকে বাছাই করে কিছু সংগ্রহ করা যাবে।
তাদের নিকট সবচেয়ে সুন্দর যা পাওয়া যাবে, তার ব্যাখ্যা কুরআনেই বিশুদ্বভাবে করা হয়েছে। তাদের কাছে যা আছে তা অর্জন করাতে অযথা কষ্ট করা, দীর্ঘ সময় নষ্ট করা এবং সহজ বিষয়কে আরো জটিল করা ব্যতীত অন্য কিছু নয়। কবি বলেন,
لَوْلَا التَّنَافُسُ فِي الدُّنْيَا لَمَا وُضِعَتْ... كُتْبُ التَّنَاظُرِ لَا الْمُغْنِي وَلَا الْعَمَدُ
يُحَلِّلُونَ بِزَعْــمٍ مِنْهُمُ عُقَدًا... وَبِالَّذِي وَضَعُوهُ زَادَتِ الْعـــُقَدُ
‘‘যদি দুনিয়ার সুনাম অর্জনের উদ্দেশ্য না থাকতো, তাহলে ইলমে কালাম ও তর্কশাস্ত্রের কিতাবগুলো রচিত হতো না। ‘আল-মুগনী’ এবং ‘আমাদ’ নামক কিতাবও রচিত হতো না। তারা মনে করে এর মাধ্যমে দ্বীনের দুর্বোধ্য বিষয়গুলো সহজ হবে। অথচ তাদের রচিত কিতাবগুলো দ্বীনের বিষয়গুলোকে আরো দুর্বোধ্য করেছে’’।
তারা মনে করেছে, ইলমে কালাম ও তর্কশাস্ত্রের উপর বড় বড় কিতাব লিখে দ্বীনের মধ্যকার বিভিন্ন সন্দেহ দূর করবে।
তবে প্রকৃত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান ব্যক্তি উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে যে, এর মাধ্যমে সন্দেহ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
আর আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের মাধ্যমে অন্তরের আরোগ্য, হেদায়াত, ইলম ও ইয়াকীন অর্জিত না হলে ইলমে কালামের মাধ্যমে তা অর্জন করা অসম্ভব। বরং আল্লাহ তা‘আলা যা বলেছেন এবং রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন, তাকেই মূল হিসাবে নির্ধারণ করা আবশ্যক। সেই সঙ্গে তার অর্থ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা, তা বোধগম্য করা এবং তার আকলী ও শরঈ দলীল-প্রমাণগুলো জানা আবশ্যক। শরঈ দলীলগুলোর উভয় প্রকার দলীলগুলোর দালালত সম্পর্কেও জানবে। সেই সঙ্গে মানুষের যেসব কথা কুরআন-সুন্নাহর সাথে সংগতিপূর্ণ হয় এবং যেসব কথা তার বিরোধী হয়, সেগুলোকে মুতাশাবেহা ও সংক্ষিপ্ত মনে করবে এবং কথাগুলোর প্রবর্তকদেরকে বলা হবে, এ শব্দগুলোর এ অর্থ হতে পারে। এর মাধ্যমে যদি রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংবাদের সমর্থন করা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তা গ্রহণ করা হবে। আর যদি তারা তার খবরের বিরোধীতা করতে চায়, তাহলে তাদের শব্দগুলো প্রত্যাখ্যাত হবে।
উদাহরণ স্বরূপ আল্লাহ তা‘আলার সত্তা ও সিফাতের ক্ষেত্রে কালামশাস্ত্র বিদদের التركيب (যুক্ত করণ), الجسم (দেহ), التحيز (স্থান দখল করা), الجوهر (মূলবস্তু), الجهة (দিক), الحيز (পরিমন্ডল), العرض (অবস্থা) ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। কালাম শাস্ত্রবিদগণ যে অর্থে এ শব্দগুলো ব্যবহার করেছে, সে অর্থে কুরআন-হাদীছে এ শব্দগুলো উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি আরবী ভাষাতেও উক্ত অর্থে শব্দগুলো আসেনি। বরং তারা এমন অর্থকে ব্যাখ্যা করার জন্য শব্দগুলো ব্যবহার করে, যে অর্থে অন্যরা শব্দগুলো ব্যবহার করেনি। তাই উক্ত অর্থগুলো অন্যান্য শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করা হবে। দেখতে হবে কুরআন-সুন্নাহর কোন্ আকলী ও নকলী দলীলগুলো উক্ত অর্থ প্রকাশ করে। আল্লাহর সত্তা ও সিফাত সম্পর্কে যেসব সংক্ষিপ্ত শব্দ ব্যবহার করে, সে সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চাইলে বাতিল থেকে হক সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।
উদাহরণ স্বরূপ التركيب শব্দটির কথা বলা যেতে পারে। এর অনেক অর্থ রয়েছে।
(১) দুই বা ততোধিক বিষয়ের মাধ্যমে কোনো কিছু গঠন করাকে তারকীব বলা হয়। পরস্পর বিপরীতমুখী একাধিক জিনিসের সংমিশ্রণের মাধ্যমে কোনো বস্তু গঠিত হওয়াকে তারকীবে মাযজী বলা হয়। যেমন চারটি স্বভাব ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমন্বয়ে মানুষ বা অন্যান্য প্রাণীর গঠন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এসব অংশ দ্বারা বিশেষিত হওয়ার সম্পূর্ণ উর্ধ্বে। উপরে সমুন্নত হওয়া এবং পূর্ণতার অন্যান্য গুণাবলী দ্বারা আল্লাহ তা‘আলাকে বিশেষিত করার অর্থ এ নয় যে, তিনি উপরোক্ত স্বভাবগুলো দ্বারা গঠিত।
(২) تركيب الجوار বা পাশাপাশি দু’টি জিনিসের দ্বারা কোনো জিনিস গঠিত হওয়াকে তারকীবুল জিওয়ার বলা হয়। যেমন দরজার দুই কপাট এবং অনুরূপ অন্যান্য জিনিস। আল্লাহ তা‘আলার জন্য একাধিক সিফাত সাব্যস্ত করা দ্বারা আবশ্যক হয় না যে, দরজার দুই কপাটের ন্যায় আল্লাহর সিফাতগুলো তার সাথে যুক্ত রয়েছে।
(৩) সমপর্যায়ের বিভিন্ন অংশের সমন্বয়ে কোনো জিনিস গঠিত হওয়াকে الجواهر المفردة বা একক পদার্থ বলা হয়।
(৪) আদি ও মৌলিক বস্তু এবং আকৃতি দ্বারাও কোনো কোনো জিনিস গঠিত হয়। যেমন একটি আংটির উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এর মৌলিক উপাদান হলো রোপা এবং এর আকৃতি সকলেরই জানা। কালামশাস্ত্র বিদরা বলেছে, দেহ সাধারণত একক পদার্থ দ্বারা গঠিত হয়ে থাকে। এ বিষয়ে তাদের আরো অনেক কথা রয়েছে। এতে কোনো লাভ নেই। তারা বলেছে, দু’টি মৌলিক জিনিস দ্বারা দেহ গঠিত হতে পারে, চারটি দিয়েও হতে পারে, ছয়টি দিয়ে, আটটি এবং ষোলটি দিয়েও গঠিত হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলার বড়ত্বের সিফাত এবং সৃষ্টির উপরে তার সমুন্নত হওয়া সাব্যস্ত করার জন্য এ ধরণের তারকীব জরুরী নয়। প্রকৃত কথা হলো এ সকল জিনিস দ্বারা দেহ গঠিত নয়। তাদের কথা শুধু দলীল বিহীন দাবি ছাড়া অন্য কিছু নয়। যথাস্থানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
(৫) সত্তা এবং সিফাত দ্বারাও তারকীব হয়ে থাকে। কালাম শাস্ত্রবিদরা এটিকে তারকীব নাম দিয়েছে। কারণ তারা এর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার সিফাতকে অস্বীকার করতে চায়। এটি তাদের নিজস্ব পরিভাষা। আরবী ভাষায় এর কোনো অস্তিত্ব নেই। রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও এটি ব্যবহার করেননি। আমরা এদের পরিভাষার সাথে সম্মতি প্রদান করি না। তারা যদি আল্লাহর জন্য সিফাত সাব্যস্ত করাকে তারকীব বলে, তাহলে আমরা তাদেরকে বলবো যে, সিফাতের অর্থগুলোই মূল উদ্দেশ্য। শব্দগুলো ধর্তব্য নয়। তোমরা আল্লাহর জন্য সিফাত সাব্যস্ত করাকে যে কোনো নামে নামকরণ করতে পারো। অর্থ ছাড়া নামের উপর কোনো হুকুম প্রয়োগ হয় না। কেউ যদি দুধকে অন্য নামে নামকরণ করে, তাহলে এ নাম দেয়া হারাম নয়।
(৬) মাহিয়াত এবং এর অস্তিত্বের তারকীব। অর্থাৎ প্রকৃত বস্তু এবং তার অস্তিত্ব একসাথে যুক্ত কি না? মস্তিস্ক কল্পনা করতে পারে যে এ দু’টি বস্তু পরস্পর আলাদা। কিন্তু এ ও মস্তিস্কের কল্পনার বাইরে অস্তিত্বহীন কোনো সত্তা থাকতে পারে কি? এমনি সত্তা ছাড়া কোনো অস্তিত্ব আছে কি? এটি অসম্ভব। আপনি দেখবেন যে, কালামবিদগণ বলে থাকে যে, রবের সত্তাই কি তার অস্তিত্ব? না কি তার সত্তা অস্তিত্বের বাইরে অন্য একটি জিনিস? এ জাতিয় কথায় তারা মারাত্মক বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেছে এবং কোনো একটি কথাকে প্রাধান্য দেয়া থেকে বিরত রয়েছে, তাদের মতটিই সর্বোত্তম। আসলে এ সব বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া এবং বিস্তারিত ব্বিরণের মাধ্যমে বহু বিভ্রান্তি ও বাতিল কথার অবসান হয়ে থাকে।