ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, فَمَنْ سَمِعَهُ فَزَعَمَ أَنَّهُ كَلَامُ الْبَشَرِ فَقَدْ كَفَرَ অতএব যে ব্যক্তি কুরআন শুনে তাকে মানুষের কালাম বলে ধারণা করবে, সে কাফের হয়ে যাবে। কুরআন আল্লাহর কালাম। এ কথা যে ব্যক্তি অস্বীকার করবে, তার কাফের হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি যে বলল, কুরআন মুহাম্মাদের কালাম অথবা অন্য কোনো সৃষ্টির কালাম সেও কুফুরী করল। সে সৃষ্টি চাই মানুষ হোক কিংবা ফেরেশতা হোক।
আর কেউ যখন স্বীকার করলো যে, কুরআন আল্লাহর কালাম, অতঃপর সে তার তাবীল করলো এবং তার শব্দ ও অর্থের মধ্যে বিকৃত করলো, সে ঐ ব্যক্তির কিছু কুফুরী কথাকে সমর্থন করলো, যে বলেছিল إِنْ هَذَا إِلَّا قَوْلُ الْبَشَرِ ‘‘এটাতো মানুষের কথা বৈ আর কিছুই নয়’’। (সূরা মুদ্দাস্সির: ২৫) তারা ঐসব লোক যাদেরকে শয়তানই কেবল পদস্খলন ঘটিয়েছে।
শাইখের উক্তি: ولا نكفر أحدا من أهل القبلة بذنب ما لم يستحله আহলে কিবলার কেউ কোন গুনাহ করলেই আমরা তাকে কাফের বলি না, যতক্ষণ না সে হালাল মনে করে সেই গুনাহয় লিপ্ত হয়, এ কথার ব্যাখ্যা করার সময় এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসবে ইনশাআল্লাহ।
ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, আমরা জেনে নিলাম ও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করলাম যে, এ কুরআন মানুষের সৃষ্টিকর্তারই কালাম। তা কোনো মানুষের কথার সাথে সাদৃশ্য রাখে না। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার কথা সর্বোত্তম, সর্বাধিক সুস্পষ্ট এবং সর্বাধিক সত্য। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَمَنْ أَصْدَقُ مِنَ اللَّهِ حَدِيثًا
‘‘আর আল্লাহর কথার চেয়ে অধিক সত্য আর কার কথা হতে পারে?’’ (সূরা নিসা: ৮৭) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেছেন,
قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لاَ يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا
‘‘হে নাবী! বলো, সমস্ত মানব ও জিন যদি এ কুরআনের অনুরূপ রচনা করে আনয়নের জন্য জড়ো হয় এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারী হয়; তবুও তারা কখনো এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না’’। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৮৮) আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন,
قُلْ فَأْتُوا بِسُوَةٍ مِثْلِهِ
‘‘তুমি বলে দাও যে, তোমরা কুরআনের সূরার ন্যায় একটি সূরা তৈরী করে আনয়ন করো’’। (সূরা ইউনুস: ৩৮)
তৎকালীন মক্কার কাফেররা রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কঠোর শত্রুতা পোষণ করা সত্ত্বেও কুরআনের অনুরূপ একটি সূরা রচনা করতে পারল না। অথচ তারা ছিল আরবদের মধ্যে সর্বাধিক বিশুদ্ধভাষী। এতে বুঝা গেল রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন আল্লাহর পক্ষ হতে সত্য নাবী। কুরআনের শব্দমালা এবং তার গ্রন্থনা উভয়ের মধ্যেই মুজেযা রয়েছে। একটিকে বাদ দিয়ে শুধু অন্যটির মধ্যেই যে মুজেযা রয়েছে, তা নয়। আরবী ভাষায় এ কুরআন বক্রতা মুক্ত এবং সুস্পষ্ট আরবী ভাষায় এটি নাযিল হয়েছে। কুরআনের অনুরূপ কোনো কালাম থাকার যে নফী বা নাকোচ এসেছে, তা কেবল কথার ধরণ, তার মাধ্যমে কথা বলা এবং গ্রন্থনা ও অর্থের দিক থেকেই; শব্দ ও অক্ষরের দিক মূল্যায়ন করে তার সদৃশ হওয়ার নফী করা হয়নি। অর্থাৎ কুরআনের মধ্যে যে শব্দমালা ও অক্ষরসমূহ রয়েছে, আরবদের কাছেও উহা রয়েছে। তারা কেবল ২৯টি অক্ষর দ্বারাই কথা বলতো। কুরআনেও এ ২৯টি অক্ষরই রয়েছে।[1]
সূরার প্রথমে উল্লেখিত হরফে মুকাত্তাআ তথা বিচ্ছিন্ন বর্ণগুলোর মাধ্যমে এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ তারা তাদের কথা-বার্তায় যে পদ্ধতি ব্যবহার করতো এবং যে ভাষায় তারা পরস্পর সম্বোধন করতো তাতেও তারা হরফে মুকাত্তাআ ব্যবহার করতো। আপনি কি দেখেন না যে, সূরার শুরুত হরফে মুকাত্তাআ ব্যবহার করার পরই কুরআনের আলোচনা এসেছে? যেমন আল্লাহ তা‘আলা সূরা বাকারার শুরুতে বলেন,
الم ذَٰلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ ۛ فِيهِ هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ ‘‘আলিফ লাম মীম। এটি আল্লাহর কিতাব, এর মধ্যে কোন সন্দেহ নেই। এটি মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত’’ (সূরা বাকারা:১-২)। আল্লাহ তা‘আলা সূরা আল-ইমরানের শুরুতে আরো বলেন,
الم اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ نَزَّلَ عَلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ
‘‘আলিফ লাম মীম। তিনিই আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি চিরজীবন্ত ও সবকিছুর ধারক। তিনি তোমার উপর সত্য সহকারে এ কিতাব নাযিল করেছেন’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা আরাফের শুরুতে বলেন,
المص كِتَابٌ أُنْزِلَ إِلَيْكَ
‘‘আলিফ লাম মীম সোয়াদ। এ কিতাব তোমার উপর নাযিল করা হয়েছে’’। আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইউনুসের শুরুতে বলেন,
الر تِلْكَ آيَاتُ الْكِتَابِ الْحَكِيمِ
‘‘আলিফ -লাম -রা। এগুলো এমন একটি কিতাবের আয়াত যা হিকমত ও জ্ঞানের পরিপূর্ণ’’।
এমনি অন্যান্য সূরার প্রথমে কাটা কাটা বর্ণ উল্লেখ করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে সতর্ক করেছেন যে, হে মক্কাবাসীগণ! রাসূলে করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাদের জন্য এমন বিষয় নিয়ে আসেননি, যা তোমাদের কাছে অপরিচিত। বরং তিনি তোমাদের ভাষাতেই সম্বোধন করেছেন।
কিন্তু পঁচা মতবাদের প্রবক্তারা এরূপ বিষয়কে আল্লাহ তা‘আলার কথা বলা এবং জিবরীল কর্তৃক উহা শ্রবণ করার ঘটনাকে নাকোচ করার অযুহাত বানিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ মানুষ যেহেতু বাক্য, অক্ষর ও আওয়াজের মাধ্যমে কথা বলে, তাই মানুষের কালামের সাথে আল্লাহ তা‘আলার কালামের সাদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ভয়ে তারা বলেছে যে, আল্লাহ তা‘আলা অক্ষর ও আওয়াজের মাধ্যমে কথা বলেন না।
এমনি তারা আল্লাহ তা‘আলার বাণী: لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ ‘‘তার সদৃশ কোনো কিছুই নেই’’, এ কথাকে আল্লাহর সিফাতকে নাকোচ করার অযুহাত বানিয়েছে। অথচ এ আয়াতের পরের অংশই তাদের কথার প্রতিবাদ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَ هُوَ السَّميْعُ الْبَصِيْر ‘‘তিনি সর্বশ্রোতা এবং সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা শূরা: ১১) এমনি আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, قُلْ فَأْتُوا بِسُوَةٍ مِثْلِهِ বলো, তোমরা কুরআনের সূরার ন্যায় একটি সূরা তৈরী করে আনয়ন করো। (সূরা ইউনুস: ৩৮)
আল্লাহ তা‘আলা এটি বলেননি যে, তোমরা একটি হরফ তৈরী করে আনো কিংবা একটি শব্দ রচনা করে নিয়ে আসো। এর মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। কেননা কুরআনের হরফের মত হরফ বা শব্দ তাদের পক্ষে নিয়ে আসা সম্ভব ছিল। কারণ ২৯টি হরফ এবং এগুলো দ্বারা গঠিত শব্দগুলোই তারা তাদের কথা-বার্তায় ব্যাবহার করতো। তারা কুরআনের শব্দগুলো দ্বারা কুরআন নাযিল হওয়ার পূর্বে কথা বলতো এবং এগুলোর অর্থও জানতো।
তাই কুরআনের সূরার মত একটি সূরা কিংবা দশটি আয়াত রচনা করে আনার চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কুরআনের সর্বাধিক ছোট সূরার মধ্যেও তিন আয়াতের কম নেই। এ জন্যই ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ রহিমাহুমাল্লাহ বলেছেন, ছবলাতে কমপক্ষে তিনটি ছোট আয়াত অথবা একটি বড় আয়াত পাঠ করতে হবে। অন্যথায় ছ্বলাত বিশুদ্ধ হবে না। কেননা এর চেয়ে কম পরিমাণের মাধ্যমে তাদেরকে অক্ষম ও অপারগ করা হয়নি। অর্থাৎ এর চেয়ে কম রচনা করার জন্য তাদের সাথে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। আল্লাহ তা‘আলাই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন।