নাবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুজেযা সম্পর্কে কিছু কথা - ১

যে ব্যক্তি রাসূলের সত্যবাদিতা, ওয়াদা-অঙ্গিকার রক্ষা করা এবং তার কথা ও কাজের মিল থাকার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করবে, সে নিশ্চিতভাবেই জানতে পারবে যে, তিনি কবি কিংবা গণক নন। লোকেরা মিথ্যুক থেকে সত্যবাদীকে বিভিন্ন দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে থাকে। যেমন তারা বিভিন্ন প্রকার পেশা যেমন লেখালেখি, কাপড় বুনানো, কৃষিকাজ, নাহুশাস্ত্র, ডাক্তারী, ফিকাহশাস্ত্র ইত্যাদির দাবিদারকে যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা করে থাকে। নবুওয়াতের দাবিদারের মধ্যে ইলম ও আমল থাকতে হবে। রাসূলের মধ্যে অবশ্যই ইলম ও আমল থাকবে। তার মধ্যে থাকবে সর্বোত্তম ইলম ও সর্বোত্তম আমল।

সুতরাং সত্য নাবী ও মিথ্যাবাদী কিভাবে এক হতে পারে? গবেষক আলেমদের মতে একজন বা দুইজন বা তিনজনের খবরের সাথে কখনো এমন কিছু আলামত বিদ্যমান থাকে যার কারণে তা দ্বারাও অকাট্য ইলম অর্জিত হয়। যেমন কেউ অন্য কারো সন্তুষ্টি, ভালোবাসা, ক্রোধ, আনন্দ দুঃশ্চিন্তা ইত্যাদি অভ্যন্তরীন অবস্থা এমন আলামতের মাধ্যমে জানতে পারে, যা তার চেহারার মধ্যেই পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় এ আলামতগুলো ব্যাখ্যা করে বুঝানো সম্ভব হয় না।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلَوْ نَشَاءُ لَأَرَيْنَاكَهُمْ فَلَعَرَفْتَهُم بِسِيمَاهُمْ وَلَتَعْرِفَنَّهُمْ فِي لَحْنِ الْقَوْلِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ أَعْمَالَكُمْ

‘‘আমি চাইলে তাদেরকে চাক্ষুষ দেখিয়ে দিতাম। আর তুমি তাদের চেহারা দেখেই চিনতে পারতে। তবে বাচনভঙ্গি থেকে তুমি তাদেরকে অবশ্যই চিনে ফেলবে। আল্লাহ তোমাদের সব আমল ভালো করেই জানেন’’। (সূরা মুহাম্মাদ: ৩০)

কোনো কোনো আলেম বলেছেন, কেউ অন্তরে কিছু গোপন করলে, আল্লাহ তা‘আলা তা তার চেহারা এবং জবানের মাধ্যমে প্রকাশ করে দেন। সুতরাং সংবাদ দাতার সত্যবাদিতা ও মিথ্যাবাদিতা যেহেতু আনুসাঙ্গিক বিভিনণ আলামত দ্বারা প্রকাশিত হয়ে যায়, সেহেতু নবুওয়াত ও রেসালাতের দাবিদারের দাবির সত্যতা প্রকাশিত হবে না কেন? সত্য নাবীর সত্যতার বিষয়টি কিভাবে গোপন থাকতে পারে? অসংখ্য দলীলের মাধ্যমে সত্য নাবীর সত্যতা এবং মিথ্যাবাদির মিথ্যাচারিতার মাঝে পার্থক্য হবে না কেন?

এ জন্যই খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা যেহেতু নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সত্যতা ও ন্যায় পরায়ণতা সম্পর্কে অবগত ছিলেন, তাই অহী অবতীর্ণ সূচনা হওয়ার পর তিনি যখন খাদীজাকে বললেন,

إِنِّي قَدْ خَشِيتُ عَلَى نَفْسِي" ، فقالت: كلا والله لا يخزيك الله، إِنَّكَ لَتَصِلُ الرَّحِمَ، وَتَصْدُقُ الْحَدِيثَ، وَتَحْمِلُ الْكَلَّ، وَتُقِرِّي الضَّيْفَ، وَتُكْسِبُ الْمَعْدُومَ، وَتُعِينُ عَلَى نَوَائِبِ الْحَقِّ

‘‘আমি আমার নিজের জীবন নাশের আশঙ্কা করছি, খাদীজা তখন বললেন, কখনোই নয়; আল্লাহ তা‘আলা আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। কেননা আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেন, সদা সত্য কথা বলেন, দুর্বল ও দুঃখীদের খেদমত করেন। বঞ্চিত ও অভাবীগণের উপার্জনের ব্যবস্থা করেন। মেহমানদারী করেন এবং বিপদগ্রস্তদেরকে সাহায্য করেন।[1]

নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও নিজ থেকে মিথ্যাবাদি হওয়ার আশঙ্কা করেননি। কারণ তিনি নিজের সম্পর্কে ভালো করেই জানতেন যে, তিনি মিথ্যা বলেন না। তিনি কেবল ভয় করেছেন যে, শত্রুরা তার বিরোধীতা শুরু করবে কি না এবং তারা তাকে মিথ্যাবাদী হিসাবে সাব্যস্ত করেন কি না। তাই খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তার উপরোক্ত গুণাবলী উল্লেখ করে আশ্বস্ত করলেন যে, এমনটি হওয়া অসম্ভব। কারণ তাকে সর্বোত্তম চরিত্র ও সুমহান গুণাবলীসহ সৃষ্টি করা হয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি সম্পর্কিত নীতি হলো, তিনি যাকে প্রশংসনীয় চরিত্র ও গুণাবলীসহ সৃষ্টি করেন, তাকে তিনি কখনো লাঞ্ছিত করেন না।

এমনি নাজ্জাশী ছাহাবীদের থেকে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সংবাদ জানার পর এবং তাদের নিকট থেকে কুরআন শ্রবণ করার পর বললেন,

إِنَّ هَذَا وَالَّذِي جَاءَ بِهِ مُوسَى عَلَيْهِ السَّلَامُ لَيَخْرُجُ مِنْ مِشْكَاةٍ وَاحِدَةٍ

নিশ্চয় এ বাণী এবং মূসা আলাইহিস সালাম যা নিয়ে এসেছেন, তা একই উৎস থেকে বের হয়েছে।[2]

وَكَذَلِكَ وَرَقَةُ ابْنُ نَوْفَلٍ، لَمَّا أَخْبَرَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَا رَآهُ، وَكَانَ وَرَقَةُ [قَدْ] تَنَصَّرَ، وَكَانَ يَكْتُبُ الْإِنْجِيلَ بِالْعَرَبِيَّةِ، فَقَالَتْ لَهُ خَدِيجَةُ: "أَيْ عَمِّ! اسْمَعْ مِنِ ابْنِ أَخِيكَ مَا يَقُولُ، فَأَخْبَرَهُ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمَا رَأَى فَقَالَ: هَذَا [هُوَ] النَّامُوسُ الَّذِي كَانَ يَأْتِي مُوسَى

এমনি যখন খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তাকে সঙ্গে করে নিয়ে তার চাচাত ভাই ওরাকা ইবনে নওফল ইবনে আসাদ ইবনে আবদুল উয্যার নিকট গেলেন, তখন ওরাকাও অনুরূপ কথা বলেছেন। ওরাকা জাহেলী যুগে ঈসায়ী ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ইবরানী ভাষায় কিতাব লিখতেন। তাই আল্লাহর ইচ্ছা ও তাওফীক অনুযায়ী তিনি ইঞ্জিলের অনেকাংশ ইবরানী ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি বৃদ্ধ ও অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাদীজা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা তাকে তার ভাতিজা অর্থাৎ রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট থেকে সব কথা শুনতে বললেন। ওরাকা তার ভাতিজার ঘটনা শুনতে চাইলেন। রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে তার সব ঘটনা শুনালেন। ওরাকা তাকে বললেন, এ সে ফেরেশতা যাকে মূসা (আ.)এর নিকট আল্লাহ নাযিল করেছিলেন।[3]

وَكَذَلِكَ هِرَقْلُ مَلِكُ الرُّومِ، فَإِنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمَّا كَتَبَ إِلَيْهِ كِتَابًا يَدْعُوهُ فِيهِ إِلَى الْإِسْلَامِ، طَلَبَ مَنْ كَانَ هُنَاكَ مِنَ الْعَرَبِ، وَكَانَ أَبُو سُفْيَانَ قَدْ قَدِمَ فِي طَائِفَةٍ مِنْ قُرَيْشٍ فِي تِجَارَةٍ إِلَى الشَّامِ، وَسَأَلَهُمْ عَنْ أَحْوَالِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَسَأَلَ أَبَا سُفْيَانَ، وَأَمَرَ الْبَاقِينَ إِنْ كَذَبَ أَنْ يُكَذِّبُوهُ، فَصَارُوا بِسُكُوتِهِمْ مُوَافِقِينَ لَهُ فِي الْأَخْبَارِ، سَأَلَهُمْ: هَلْ كَانَ فِي آبَائِهِ مِنْ مَلِكٍ؟ فَقَالُوا: لَا، قَالَ: هَلْ قَالَ هَذَا الْقَوْلَ أَحَدٌ قَبْلَهُ؟ فَقَالُوا: لَا، وَسَأَلَهُمْ: أَهْوَ ذُو نَسَبٍ فِيكُمْ؟ فَقَالُوا: نَعَمْ، وَسَأَلَهُمْ: هَلْ كُنْتُمْ تَتَّهِمُونَهُ بِالْكَذِبِ قَبْلَ أَنْ يَقُولَ مَا قَالَ؟ فَقَالُوا: لَا، مَا جَرَّبْنَا عَلَيْهِ كَذِبًا، وَسَأَلَهُمْ: هَلِ اتَّبَعَهُ ضُعَفَاءُ النَّاسِ أَمْ أَشْرَافُهُمْ؟ فَذَكَرُوا أَنَّ الضُّعَفَاءَ اتَّبَعُوهُ؟ وَسَأَلَهُمْ: هَلْ يَزِيدُونَ أَمْ يَنْقُصُونَ؟ فَذَكَرُوا أَنَّهُمْ يَزِيدُونَ، وَسَأَلَهُمْ: هل يرجع أَحَدٌ مِنْهُمْ عَنْ دِينِهِ سُخْطَةً لَهُ بَعْدَ أَنْ يَدْخُلَ فِيهِ؟ فَقَالُوا: لَا، وَسَأَلَهُمْ: هَلْ قَاتَلْتُمُوهُ؟ قَالُوا: نَعَمْ، وَسَأَلَهُمْ عَنِ الْحَرْبِ بَيْنَهُمْ وَبَيْنَهُ؟ فَقَالُوا: يُدَالُ عَلَيْنَا مَرَّةً وَنُدَالُ عَلَيْهِ أُخْرَى، وَسَأَلَهُمْ: هَلْ يَغْدِرُ؟ فَذَكَرُوا أَنَّهُ لَا يَغْدِرُ، وَسَأَلَهُمْ: بِمَاذَا يَأْمُرُكُمْ؟ فَقَالُوا: يَأْمُرُنَا أَنْ نَعْبُدَ اللَّهَ وَحْدَهُ لَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا، وَيَنْهَانَا عَمَّا كَانَ يَعْبُدُ آبَاؤُنَا، وَيَأْمُرُنَا بِالصَّلَاةِ وَالصِّدْقِ وَالْعَفَافِ وَالصِّلَةِ. وَهَذِهِ أَكْثَرُ مِنْ عَشْرِ مَسَائِلَ، ثُمَّ بَيَّنَ لَهُمْ مَا فِي هَذِهِ الْمَسَائِلِ مِنَ الْأَدِلَّةِ، فَقَالَ: سَأَلْتُكُمْ هَلْ كَانَ فِي آبَائِهِ مِنْ مَلِكٍ؟ فَقُلْتُمْ: لَا، قُلْتُ: لَوْ كَانَ فِي آبَائِهِ [مِنْ] مَلِكٍ لَقُلْتُ: رَجُلٌ يَطْلُبُ مُلْكَ أَبِيهِ، وَسَأَلْتُكُمْ هَلْ قَالَ هَذَا الْقَوْلَ [فِيكُمْ] أَحَدٌ قَبْلَهُ؟ فَقُلْتُمْ: لَا، فَقُلْتُ: لَوْ قَالَ هَذَا الْقَوْلَ أَحَدٌ [قَبْلَهُ] لَقُلْتُ: رَجُلٌ ائْتَمَّ بِقَوْلٍ قِيلَ قَبْلَهُ، وَسَأَلْتُكُمْ هَلْ كُنْتُمْ تَتَّهِمُونَهُ بِالْكَذِبِ قَبْلَ أَنْ يَقُولَ مَا قَالَ؟ فَقُلْتُمْ: لَا، فَقُلْتُ: قَدْ عَلِمْتُ أَنَّهُ لَمْ يَكُنْ لِيَدَعَ الْكَذِبَ عَلَى النَّاسِ ثم يذهب فيكذب على الله تعالى، وَسَأَلْتُكُمْ أَضُعَفَاءُ النَّاسِ يَتْبَعُونَهُ أَمْ أَشْرَافُهُمْ؟ فَقُلْتُمْ: ضُعَفَاؤُهُمْ وَهُمْ أَتْبَاعُ الرُّسُلِ، يَعْنِي فِي أَوَّلِ أَمْرِهِمْ، ثُمَّ قَالَ: وَسَأَلْتُكُمْ هَلْ يَزِيدُونَ أَمْ يَنْقُصُونَ؟ فَقُلْتُمْ، بَلْ يَزِيدُونَ، وَكَذَلِكَ الْإِيمَانُ حَتَّى يَتِمَّ، وَسَأَلْتُكُمْ هَلْ يَرْتَدُّ أَحَدٌ مِنْهُمْ عَنْ دِينِهِ سُخْطَةً لَهُ بَعْدَ أَنْ يَدْخُلَ فِيهِ؟ فَقُلْتُمْ: لَا، وَكَذَلِكَ الْإِيمَانُ، إِذَا خَالَطَتْ بَشَاشَتُةُ الْقُلُوبَ لَا يَسْخَطُهُ أَحَدٌ

এমনি রোমের সম্রাট হিরাক্লিয়াসও অনুরূপ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে রোমের সম্রাটের কাছে চিঠি লিখলেন, তখন সে সময় সেখানে যে সমস্ত আরব লোক উপস্থিত ছিল, তাদেরকে ডাকলেন। তখন আবু সুফিয়ান এক বাণিজ্যিক কাফেলায় শরীক হয়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। রোমের সম্রাট তখন নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থা সম্পর্কে উপস্থিত আরবদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন। হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে জিজ্ঞাসা করলেন এবং বাকীদেরকে বললেন, তারা যেন আবু সুফিয়ান মিথ্যা বললে সাথে সাথে তা ধরিয়ে দেয়। সুতরাং হিরাক্লিয়াস প্রশ্ন করতে লাগলেন এবং আবু সুফিয়ান সেসব প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিল। বাকীরা চুপ থেকে তার সংবাদকে সমর্থন করে যাচ্ছিল।

হিরাক্লিয়াস যেসব প্রশ্ন সেদিন করেছিলেন, তার মধ্যে নিমেণর প্রশ্নগুলো অন্যতম। তিনি আবু সুফিয়ানকে প্রশ্ন করলেন, তার পূর্ব পুরুষদের মধ্যে কেউ রাজা-বাদশাহ ছিলেন কি? আবু সুফিয়ান বললো না। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, তার পূর্বে অন্য কেউ অনুরূপ কথা বলেছে কি? আবু সুফিয়ান বললো, না। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি তোমাদের মধ্যে উচ্চ মর্যাদাপূর্ণ বংশের লোক? আবু সুফিয়ান বললো, হ্যাঁ। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, লোকটি বর্তমানে যা বলছে, তোমরা কি এর পূর্বে কখনো তার প্রতি মিথ্যাবাদীতার অভিযোগ করেছো? আবু সুফিয়ান বলল, আমরা তার উপর কখনো মিথ্যা বলার অভিযোগ পেশ করতে পারিনি। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, নেতৃস্থানীয় ও প্রভাবশালী লোকেরা তার অনুসরণ করেছে? না দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা? আবু সুফিয়ান বলল, দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা।

হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, তার অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না কমছে? আবু সুফিয়ান বললো তার অনুসারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, কেউ তার দ্বীন গ্রহণ করার পর দোষ-ত্রুটি দেখে পুনরায় দ্বীন পরিত্যাগ করে কি? আবু সুফিয়ান বলল, না। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কি তার সাথে কখনো যুদ্ধ করেছো? আবু সুফিয়ান বললো, হ্যাঁ। হিরাক্লিয়াস এবার তাদের মাঝে এবং তার মধ্যকার যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। আবু সুফিয়ান বললো, যুদ্ধের ফলাফল আমাদের ও তার মধ্যে ঘূর্ণায়মান। কখনও তিনি বিজয়ী হয়েছেন আবার কখনও আমরা বিজয়ী হয়েছি। হিরাক্লিয়াস জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি কি ওয়াদা ভঙ্গ করেন? আবু সুফিয়ান বললো, না। তবে বর্তমানে আমরা তার সাথে একটি সন্ধি চুক্তিতে আবদ্ধ আছি। জানি না তিনি এতে কি করবেন।

আবু সুফিয়ান বলেন, এ কথাটি ব্যতীত আমি তার বিরুদ্ধে অন্য কিছু বলার সাহস পেলাম না। হিরাক্লিয়াস বললেন, তিনি তোমাদেরকে কিসের আদেশ দেন? আবু সুফিয়ান বললো, তিনি আমাদেরকে বলেন, এক আল্লাহর ইবাদত করো। তার সাথে অন্য কিছুকে শরীক করো না। তোমাদের পূর্ব পুরুষরা যেসব বস্তুর উপাসনা করত তা ছেড়ে দাও। তিনি আমাদেরকে ছলাতের আদেশ দেন। তিনি আরো আদেশ দেন, তোমরা সত্য বলো, অন্যায় থেকে বিরত থাকো এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো। এভাবে হিরাক্লিয়াস দশাধিক প্রশ্ন করলেন। অতঃপর এগুলোর মধ্যে তার নবুওয়াতের সত্যতার পক্ষে যেসব দলীল-প্রমাণ রয়েছে, তাও উল্লেখ করলেন। সম্রাট আবু সুফিয়ানকে বললেন, আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তার পূর্ব পুরুষদের মধ্যে কেউ রাজা-বাদশাহ ছিলেন কি? তুমি বলেছো, না। তার পূর্ব পুরুষদের মধ্যে যদি কেউ রাজা-বাদশাহ থাকতো, তাহলে আমি বলতাম, তিনি এমন ব্যক্তি যিনি তার পূর্বপুরুষদের রাজত্ব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছেন। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তোমাদের মধ্যে ইতিপূর্বে অন্য কেউ এরূপ কথা বলেছে কি? তুমি বলেছো না। সুতরাং আমি বলছি, ইতিপূর্বে যদি কেউ এ ধরণের কথা বলত, তাহলে আমি বলতাম, তিনি তার পূর্বসূরি ব্যক্তির কথাই বলছেন।

আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, বর্তমানে তিনি যা বলছেন, ইতিপূর্বে তোমরা কি কখনও তার উপর মিথ্যাবাদীতার অভিযোগ করেছো? তুমি বলেছো, না। তাই আমি বিশ্বাস করি যে, মানুষের সাথে মিথ্যা বলা ছেড়ে দিয়ে তিনি আল্লাহ সম্পর্কে কখনও মিথ্যা বলতে পারেন না। তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, সম্মানিত ও ধনাঢ্য ব্যক্তিগণ তার অনুসরণ করেছে, না দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা? তুমি বলেছা, দরিদ্র ও দুর্বল শ্রেণীর লোকেরা তার অনুসরণ করছে। মূলতঃ দুর্বল ও অসহায়গণই নাবী-রসূলদের অনুসারী হয়ে থাকে। অর্থাৎ শুরুর দিকে দুর্বলরাই নাবী-রসূলদের দ্বীন কবুল করে। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তার অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে না কমছে? তুমি বলেছো, তাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। নিশ্চয়ই ঈমানের বিষয়টি এরূপই হয়ে থাকে, যতক্ষণ না তা পূর্ণতায় রূপ নেয়। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তার দ্বীনে দিক্ষীত হওয়ার পর নাখোশ হয়ে কেউ ধর্মান্তরিত হয়েছে কি? তুমি বলেছা, না। ঈমানের আলো যখন অন্তরে প্রবেশ করে তখন এরূপই হয়ে থাকে।[4]

এগুলোই সত্যের সবচেয়ে বড় দলীল। বাতিল ও মিথ্যার মুখোশ পরিশেষে অবশ্যই উন্মুক্ত হয়। সত্যের সন্ধানীরা তখন মিথ্যা পরিহার করে। আর যারা সত্যের সন্ধানী নয়, তারা তা থেকে সবসময় দূরে থাকে। মূলতঃ মিথ্যা সামান্য পরেই পরাভূত হয়। হিরাক্লিয়াস বলেন, আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তার সাথে তোমাদের যুদ্ধের ফলাফল কী হয়েছে? তুমি বলেছো, যুদ্ধের ফলাফল আমাদের ও তার মধ্যে ঘূর্ণায়মান। কখনও তিনি বিজয়ী হয়েছেন আবার কখনও আমরা বিজয়ী হয়েছি। রসূলগণের অবস্থা ঠিক এ রকম। তাদেরকে কখনো বিপদাপদ ও কষ্টের মধ্যে ফেলে পরীক্ষা করা হয়। অতঃপর তাদের পরিণাম ভালো হয়। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি কি অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন? তুমি বলেছো, না।

প্রকৃতপক্ষে রসূলগণ এরূপই হয়ে থাকেন। তারা কখনো অঙ্গীকার ভঙ্গ করেন না। হিরাক্লিয়াসের এ কথা বলার কারণ হলো, তিনি রসূলদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার নীতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা কখনো তাদেরকে বিজয়ী করেন আবার কখনো তাদেরকে বিপদাপদ দিয়ে পরীক্ষা করেন। আর তারা কখনোই গাদ্দারী করেন না। সুতরাং হিরাক্লিয়াস অবগত ছিলেন যে, এগুলো সত্য নাবীর আলামত। আর সত্য নাবী-রসূল ও মুমিনদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম সুন্নাত হলো, তিনি তাদেরকে সুখ-শান্তি ও বিপদাপদের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন। যেন তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও ধৈর্যধারণ করার মর্যাদা লাভ করেন।

ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَا يَقْضِي اللَّهُ لِلْمُؤْمِنِ قَضَاءً إِلَّا كَانَ خَيْرًا لَهُ، وَلَيْسَ ذَلِكَ لِأَحَدٍ إِلَّا لِلْمُؤْمِنِ، إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ

‘‘ঐ সত্তার শপথ! যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, মুমিন বান্দার জন্য আল্লাহ তা‘আলা যে ফায়ছালাই করেন না কেন, তাই তার জন্য ভালো। মুমিন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারো জন্য এমনটি হয় না। মুমিন বান্দার কল্যাণ হলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এতে তার জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর মুমিন ব্যক্তির অকল্যাণ হলে ধৈর্যধারণ করে। এতেও তার জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছে’’।[5]

[1]. ছহীহ মুসলিম ১৬০, ছহীহ বুখারী ৪৯৫৩।

[2]. হাসান: সীরাতে ইবনে ইসহাক, (১/৩৫৭-৩৬৩), ইবনে হিশাম, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে কাসীর।

[3]. ছহীহ বুখারী হা/৩, ছহীহ মুসলিম হা/১৬০।

[4]. ছহীহ বুখারী ৭।

[5]. ছহীহ মুসলিম, (৮/২২৭)