মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনয়ন করা আবশ্যক

নাবীদের মুজেযা নিঃসন্দেহে তাদের নবুওয়াতের পক্ষে একটি শক্তিশালী দলীল। তবে তাদের নবুওয়াতের দলীলসমূহ কেবল মুজেযার মধ্যেই সীমিত নয়। কেননা সর্বাধিক সত্যবাদী অথবা সর্বাধিক মিথ্যুকরাই নবুওয়াতের দাবি করে থাকে। সত্য নবুওয়াত এবং তার মিথ্যা দাবি কখনো এক হতে পারে না। অজ্ঞরাই কেবল সত্যিকার নবুওয়াত এবং নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। সত্যিকার নাবী ও ভন্ড নাবীর এমন অনেক আলামত রয়েছে, যা উভয়কে পরিষ্কার করে বর্ণনা করে দেয়। নবুওয়াতের দাবিদার ছাড়াও সাধারণ সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদীর মাঝে পার্থক্য করার অনেক পদ্ধতি রয়েছে। সুতরাং যারা নবুওয়াতের দাবি করবে, তারা সত্যবাদী কি না, তার মাঝে পার্থক্য করা যাবে না কেন?

রসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কবি হাস্সান বিন ছাবিত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু খুব সুন্দর বলেছেন,

لَوْ لَمْ يَكُنْ فِيهِ آيَاتٌ مُبَيِّنَةٌ... كَانَتْ بَدِيهَتُهُ تَأْتِيكَ بِالْخَبَرِ

‘‘তার মধ্যে যদি নবুওয়াতের সুস্পষ্ট বাহ্যিক নিদর্শনগুলো নাও থাকতো, তাহলে তার চাল-চলন, স্বভাব-চরিত্র, স্বাভাবিক অবস্থা এবং আচার-আচরণই তোমাকে বলে দিবে যে তিনি একজন সত্য নাবী’’।

এ পর্যন্ত যত মিথ্যুক নবুওয়াতের দাবি করেছে তাদের সকলের মূর্খতা, মিথ্যা ও পাপাচার সুস্পষ্ট হয়েছে। সে সঙ্গে তার মধ্যে শয়তানের গোলামি করার বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। যার মধ্যে সামান্য বিবেক-বুদ্ধিমান লোকও নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারের চালবাজি ও ধোঁকাবাজি ধরে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। কেননা যিনি নাবী বা রসূল হবেন, তিনি মানুষকে অবশ্যই অনেক সংবাদ প্রদান করবেন, অনেক বিষয়ের আদেশ করবেন এবং এমন অনেক কাজ করবেন, যার মাধ্যমে তার সত্যতা প্রকাশিত হবে। আর মিথ্যুক যে বিষয়ের আদেশ করবে, যে সংবাদ প্রদান করবে এবং সে যা করবে, তার মধ্যেই বিভিন্নভাবে মিথ্যা প্রকাশিত হয়ে যাবে। সত্যবাদীর বিষয়টি সম্পূর্ণ এর বিপরীত। শুধু তাই নয়; দুই জন লোক যদি এমন একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের দাবি করে, যাতে একজন সত্যবাদী এবং অন্যজন মিথ্যুক, তাতে সত্যবাদী থেকে মিথ্যুক অবশ্যই আলাদা হবে। যদিও তা প্রকাশ হতে কখনো দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। কেননা সত্যবাদিতা মানুষকে সৎকাজের দিকে পরিচালিত করে এবং মিথ্যাবাদিতা মানুষকে পাপাচারের দিকে নিয়ে যায়।

ছহীহ বুখারী ও ছহীহ মুসলিমে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,

عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ، فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ، وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ، حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللَّهِ صِدِّيقًا، وَإِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ، حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللَّهِ كَذَّابًا

‘‘তোমরা অবশ্যই সত্য বলবে। কারণ সত্য মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করে ও নেকীর পথ দেখায় এবং নেকী জান্নাতের দিকে চালিত করে। আর মানুষ সদা সত্য বলতে থাকলে এবং সত্যের অনুসন্ধান করতে থাকলে পরিশেষে আল্লাহর নিকট সে সিদ্দীক হিসাবে পরিগণিত হয়। আর তোমরা মিথ্যা বলা থেকে বিরত থাকবে। কেননা মিথ্যা মানুষকে পাপ কাজের পথ দেখায় এবং পাপ কাজ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। আর মানুষ সদা মিথ্যা বলতে থাকলে এবং মিথ্যার অনুসন্ধান করতে থাকলে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর নিকট মিথ্যুক হিসাবে তার নাম লিপিবদ্ধ হয়ে যায়’’।[1] এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ يُلْقُونَ السَّمْعَ وَأَكْثَرُهُمْ كَاذِبُونَ وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ

‘‘হে লোকেরা! আমি কি তোমাদের জানাবো শয়তানরা কার উপর অবতীর্ণ হয়? তারা তো প্রত্যেক মিথ্যুক বদকারের উপর অবতীর্ণ হয়। শোনা কথা কানে ঢুকিয়ে দেয় এবং এর বেশির ভাগই হয় মিথ্যা। আর ভ্রান্তরাই কেবল কবিদের পেছনে চলে। তুমি কি দেখনা তারা উপত্যকায় উদ্ভ্রামেত্মর মতো ঘুরে বেড়ায় এবং এমনসব কথা বলে যা তারা করে না’’? (সূরা শুআরা: ২১-২৬)

সুতরাং গণক এবং তাদের অনুরূপ লোকেরা যদিও কখনো কখনো অদৃশ্যের কিছু কিছু খবর বলতে পারে এবং তা সত্যও হয়, তথাপিও তারা এত মিথ্যা ও পাপাচারে লিপ্ত হয়, যা সুস্পষ্ট করে দেয় যে, তারা যেসব খবর প্রদান করে, তা ফেরেশতাদের থেকে গৃহীত নয় এবং তারা স্বয়ং নাবীদেরও অন্তর্ভুক্ত নয়। এ জন্যই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে সাইয়্যাদকে বলেছিলেন,

إِنِّي قَدْ خَبَأْتُ لَكَ خَبِيئًا فَقَالَ ابْنُ صَيَّادٍ هُوَ الدُّخُّ فَقَالَ اخْسَأْ فَلَنْ تَعْدُوَ قَدْرَكَ

‘‘আমি তোমার জন্য একটি বিষয় গোপন করে রেখেছি। পারলে বলে দাও তো আমি কী গোপন করেছি? ইবনে সাইয়্যাদ বললো, সেটি হল الدخ (ধূয়া)। এ কথা শুনে নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি লাঞ্ছিত হও। তুমি নিজের সীমার বাইরে যেতে পারবে না’’।[2]

ইবনে সাইয়্যাদ নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছিল, يَأْتِينِي صَادِقٌ وَكَاذِبٌ আমার কাছে সত্যবাদী ও মিথ্যাবাদী উভয়ই আগমন করে।[3] সে আরো বলেছিল, أَرَى عَرْشًا عَلَى الْمَاءِ আমি পানির উপর একটি আরশ দেখতে পাচ্ছি।[4] পানির উপর সে যে আরশ দেখতো, তা ছিল শয়তানের আরশ।

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে, وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ ‘‘গোমরাহ লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে চলে’’ (সূরা আশ শুয়ারা ২৬ : ২২৪)। الغاوي হলো ঐ ব্যক্তি যে, স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলে। যদিও পরিণামে তা তার জন্য ক্ষতিকর হয়।

[1]. ছহীহ মুসলিম হা/২৬০৭, তিরমিযী হা/১৯৭১।

[2]. ছহীহ বুখারী ১৩৫৪, ছহীহ মুসলিম ২৯৩০।

[3]. ছহীহ বুখারী ১৩৫৪, ছহীহ মুসলিম ২৯৩০।

[4]. ছহীহ মুসলিম ২৯২৫।