ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, (قَدِيمٌ بِلَا ابْتِدَاءٍ دَائِمٌ بِلَا انْتِهَاءٍ) তিনি কাদীম (অনাদি, অবিনশ্বর, প্রাক্তন), তার কোনো শুরু নেই। তিনি অনন্ত-চিরন্তন, তার কোনো অন্ত নেই।[1]
.................
ব্যাখ্যা: আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
তিনিই الأَوَّلُ (প্রথম), তিনিই الآخِرُ (সর্বশেষ), তিনিই الظَّاهِرُ (সবকিছুর উপরে), তিনিই الْبَاطِنُ (মাখলুকের অতি নিকটে), আর তিনি সর্ব বিষয়ে عَلِيم (মহাজ্ঞানী)। (সূরা হাদীদ: ৩)।
নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দু‘আয় বলেছেন,
اللَّهُمَّ أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ
‘‘হে আল্লাহ! তুমিই সর্বপ্রথম, তোমার পূর্বে কেউ ছিল না। তুমিই সর্বশেষ, তোমার পর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না’’।[2]
আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামসমূহের অন্যতম আল-আওয়াল এবং আল-আখের নামের অর্থেই ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ قَدِيمٌ بِلَا ابْتِدَاءٍ، دَائِمٌ بِلَا انْتِهَاءٍ ‘‘অনাদি, অবিনশ্বর, প্রাক্তন, যার কোনো শুরু নেই এবং তিনি অনন্ত-চিরন্তন, যার কোনো অন্ত নেই’’ এ অংশটি ব্যবহার করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলার সিফাতসমূহ থেকে এ দু’টি বিশেষণ মানুষের ফিতরাত তথা সৃষ্টিগত স্বভাবের মধ্যেই বদ্ধমূল রয়েছে। কেননা এ বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, সমস্ত সৃষ্টিই এমন এক সত্তা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়, যিনি নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল। এ বিশ্বাস অতীতে সূচনাহীন সৃষ্টির অস্তিত্ব এবং ভবিষ্যতে সৃষ্টির পরিসমাপ্তি বিহীন সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকার ধারণাকে বাতিল সাব্যস্ত করে।[3]
আমরা প্রাণী, জীবজন্তু, গাছপালা, উদ্ভিদ, খনিজদ্রব্য, মহাশূন্যের বিভিন্ন ঘটনা যেমন মেঘ, বৃষ্টি, বজ্রপাত ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় প্রত্যক্ষ করি। এসব জিনিস এবং এ রকম অন্যান্য বস্তু সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়। কেননা অসম্ভব জিনিসের কোনো অস্তিত্ব নেই। আর যা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব, তা নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল হয় না। কেননা যে নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল হয়, সে কখনো অস্তিত্বহীন হয় না। সৃষ্টিজগতের এ জিনিসগুলো ছিল না। অতঃপর অস্তিত্ব ধারণ করেছে। এগুলোর অস্তিত্ব না থাকা অস্তিত্ব থাকার পরিপন্থী। আর অস্তিত্ব থাকা অস্তিত্ব ধারণ করা অসম্ভব হওয়ার ধারণার পরিপন্থী। আর যে বস্তু অস্তিত্ব গ্রহণ করা কিংবা না করার সম্ভাবনা রাখে সে নিজে নিজেই অস্তিত্ব গ্রহণ করতে পারে না।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمْ الْخَالِقُونَ أَمْ خَلَقُوا السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بَل لاَ يُوقِنُونَ
‘‘তারা কি কোন কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? না কি তারা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করে না’’। (সূরা তূর: ৩৫-৩৬)
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এখানে বলছেন, তারা কোন জিনিস ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে না কি তারা নিজেরাই নিজেদেরকে সৃষ্টি করেছে?
এটি জানা কথা যে, কোনো সৃষ্টিই নিজে নিজেকে সৃষ্টি করেনি। সুতরাং যে সৃষ্টি নিজেকে সৃষ্টি করতে পারে না এবং নিজেকে নিজেই অস্তিত্বহীন করতে পারে না, নিজে নিজেই অস্তিত্বে আসা তার পক্ষে অসম্ভব। বরং কেউ তাকে সৃষ্টি করেছে বলেই সে অস্তিত্বে এসেছে। অথচ তার আগে তা ছিল অস্তিত্বহীন। যে বস্তুর অস্তিত্বশীলতা তার অস্তিত্বহীনতার স্থলাভিষিক্ত হয় এবং অস্তিত্বহীনতা এর অস্তিত্বশীলতার স্থলাভিষিক্ত হয়, তার পক্ষে নিজে নিজেই অস্তিত্বে আসা সম্ভব নয় এবং তার অস্তিত্বহীন হওয়া আবশ্যক নয়।
কালাম শাস্ত্রবিদ এবং দার্শনিকরা যেসব বিবেক ও বোধশক্তির দলীল পেশ করে থাকে, তাতে যদি কোনো জ্ঞানী লোক গভীরভাবে চিন্তা করে, তাহলে দেখতে পাবে যে, তাদের যুক্তি ও উপস্থাপনার মধ্যে যেসব সত্য-সঠিক জিনিস রয়েছে, কুরআনে বর্ণিত আকলী দলীলসমূহেই তার কিয়দাংশ অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও অতি সংক্ষিপ্ত ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে তা এমন খোলাসা করে সাব্যস্ত করা হয়েছে, যার অনুরূপ বর্ণনা তাদের নিকট অনুপস্থিত। আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফুরকানের ৩৩ নং আয়াতে বলেন,
وَلَا يَأْتُونَكَ بِمَثَلٍ إِلَّا جِئْنَاكَ بِالْحَقِّ وَأَحْسَنَ تَفْسِيرًا
‘‘আর যখনই তারা তোমার সামনে কোন অভিনব কথা নিয়ে এসেছে তার সঠিক জবাব যথাসময়ে আমি তোমাকে দিয়েছি এবং সর্বোত্তম পদ্ধতিতে এর ব্যাখ্যা প্রদান করেছি’’।
আমরা বলবো না যে, স্রষ্টার অস্তিত্ব এবং অন্যান্য বিষয় সাব্যস্ত করার জন্য বিবেক-বুদ্ধি ও বোধশক্তির অস্পষ্ট দলীল পেশ করা উপকারী নয়। কেননা সুস্পষ্ট হওয়া কিংবা অস্পষ্ট হওয়া আপেক্ষিক বিষয়। কখনো কখনো কতিপয় লোকের কাছে সুস্পষ্ট বিষয় অন্যের কাছে অস্পষ্ট থাকে। ঠিক একই বিষয় একই ব্যক্তির কাছে এক সময় সুস্পষ্ট হয়, কিন্তু অন্য অবস্থায় অস্পষ্ট থাকে। আরো বলা যেতে পারে যে, বিবেক-বুদ্ধি ও বোধশক্তির দলীল-প্রমাণ অস্পষ্ট হলেও কতিপয় মানুষ তা মেনে নেয়, কিন্তু তারা এর চেয়ে অধিক সুস্পষ্ট বিষয়ে ঝগড়া করে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে গবেষণা করে এবং অনুসন্ধান করে অস্পষ্ট বিষয় অবগত হয়ে এত খুশী হয়, যতটা খুশী হয় না প্রকাশ্য দলীল-প্রমাণ দ্বারা উপলদ্ধ বিষয়াদি জানতে পেরে। কোনো সন্দেহ নেই যে, স্রষ্টার অস্তিত্ব সাব্যস্ত করার জ্ঞান এবং তার অস্তিত্ব আবশ্যক হওয়ার বিষয়টি এমন বাস্তব যে, মানুষের সৃষ্টিগত প্রকৃতি ও স্বভাবের মধ্যেই বদ্ধমূল হয়ে আছে। তারপরও কতিপয় মানুষের মাঝে এ সম্পর্কে কিছু সন্দেহ থাকার কারণে তা দূর করার জন্য বুদ্ধিভিত্তিক দলীল-প্রমাণ পেশ করার প্রয়োজন পড়ে।
কালাম শাস্ত্রবিদরা আল্লাহ তা‘আলার নামের মধ্যে قديم (কাদীম) শব্দটি ঢুকিয়ে দিয়েছে।[4] অথচ কাদীম আসমায়ে হুসনার (সুন্দর নামসমূহের) অন্তর্ভুক্ত নয়।[5] আরবদের যে ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে, তাতে قديم বলা হয় এমন জিনিসকে, যা অন্যের পূর্বে বিদ্যমান থাকে। তাই পুরাতন জিনিসের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে, هذا قديم (এটা পুরাতন)। নতুন জিনিসের ক্ষেত্রে বলা হয়, هذا جديد (এটা নতুন)। অন্যের চেয়ে অধিক অগ্রগামী বস্তুর জন্যই আরবরা কেবল এ নামটি ব্যবহার করে থাকে। যে জিনিসের আগে অন্য কিছুর অস্তিত্বই ছিল না, তার জন্য আরবরা এ নামটি ব্যবহার করেনি।
আল্লাহ তা‘আলা চন্দ্রের বিভিন্ন অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে সূরা ইয়াসীনের ৩৯ নং আয়াতে বলেন,
وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّىٰ عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ
‘‘আর আমি চাঁদের জন্য মনযিল নির্দিষ্ট করে দিয়েছি, সেগুলো অতিক্রম করে সে শেষ পর্যন্ত আবার খেজুরের পুরাতন শাখার মতো হয়ে যায়’’।
খেজুর গাছের নতুন শাখা গজানো পর্যন্ত পুরাতন শাখা বিদ্যমান থাকা। যখন নতুন শাখা বের হয়, তখন প্রথম শাখাকে قديم পুরাতন বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা সূরা আহকাফের ১১ নং আয়াতে বলেন,
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا لِلَّذِينَ آمَنُوا لَوْ كَانَ خَيْرًا مَّا سَبَقُونَا إِلَيْهِ وَإِذْ لَمْ يَهْتَدُوا بِهِ فَسَيَقُولُونَ هَٰذَا إِفْكٌ قَدِيمٌ
‘‘যারা মানতে অস্বীকার করেছে তারা মুমিনদের সম্পর্কে বলে, এ কিতাব মেনে নেয়া যদি কোন ভাল কাজ হতো তাহলে এ ব্যাপারে এসব লোক আমাদের চেয়ে অগ্রগামী হতে পারতো না। যেহেতু এরা তা থেকে হেদায়াত লাভ করেনি তাই তারা অবশ্যই বলবে, এটা পুরাতন মিথ্যা’’। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
قَالَ أَفَرَأَيْتُم مَّاكُنتُمْ تَعْبُدُونَ أَنتُمْ وَآبَاؤُكُمُ الْأَقْدَمُونَ
‘‘এ কথায় ইবরাহীম বললো, কখনো কি তোমরা সেই জিনিসগুলো দেখেছো যাদের ইবাদত তোমরা এবং তোমাদের পূর্ব পুরুষেরা করে অভ্যস্ত?’’ (সূরা শুআরা: ৭৫-৭৬)
এখানে পুরাতনের ক্ষেত্রে আধিক্য বুঝানোর জন্য أقدم শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এ অর্থেই ইমাম শাফেঈ রহিমাহুল্লাহর قديم ও جديد অর্থাৎ আগের ও পরের পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা সূরা হুদের ৯৮ নং আয়াতে বলেন,
يَقْدُمُ قَوْمَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَأَوْرَدَهُمُ النَّارَ
‘‘কিয়ামতের দিন সে নিজের কওমের অগ্রবর্তী হবে এবং নিজের নেতৃত্বে তাদেরকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাবে’’।
অর্থাৎ ফেরাউন তাদের আগে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। القدم মাসদার থেকে ফেলটি লাযেম ও মুতাআদ্দী উভয় অবস্থায়ই ব্যবহৃত হয়। যেমন লাযেম হিসাবে বলা হয়, أخذت ما قدم وما حدث ‘‘আমি পুরাতন ও নতুন উভয়টি গ্রহণ করেছি’’।
আর মুতাআদ্দী হিসাবে এভাবে বলা হয়, هَذَا قَدَمَ هَذَا وَهُوَ يَقْدُمُهُ ‘‘এটি ঐটির অগ্রণী হয়েছে এবং সে তার চেয়ে অগ্রগামী হচ্ছে’’।
এখান থেকেই মানুষের পা-কে قدم বলা হয়। কেননা চলার সময় মানুষের শরীরের অন্যান্য অংশের পূর্বে পা-ই সর্বপ্রথম সামনের দিকে অগ্রসর হয়।
কালাম শাস্ত্রবিদের অধিকাংশের নিকটই আল্লাহর নাম হিসাবে কাদীম শব্দটির ব্যবহার খুবই প্রসিদ্ধ।
সালাফ (পূর্ববর্তী) ও খালাফ (পরবর্তী) দের অনেকেই আল্লাহর নামসমূহের মধ্যে এটিকে শামিল করার প্রতিবাদ করেছেন। প্রতিবাদকারীদের মধ্যে ইমাম ইবনে হাযম রহিমাহুল্লাহ অন্যতম। কোন সন্দেহ নেই যে, কাদীম শব্দটি যেখানে মূলতঃ অগ্রণী-অগ্রগামী হওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়, সেখানে যার অস্তিত্ব সমস্ত সৃষ্টির পূর্বে, তিনি অন্যের তুলনায় পূর্বে হওয়ার আরো বেশী হকদার।
কিন্তু আল্লাহ তা‘আলার নামসমূহ এত সুন্দর যে, তা তার বিশেষ প্রশংসার প্রমাণ করে। التقدم (পূর্বে হওয়া) আভিধানিক অর্থে সাধারণভাবে অগ্রে হওয়ার অর্থ প্রদান করে। সকল সৃষ্টির পূর্বে হওয়ার সাথে নির্দিষ্ট নয়। সুতরাং এটি আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামসমূহের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার উপযুক্ত নয়।[6]
এ অর্থে কুরআন ও হাদীছে তার الأول (প্রথম) নাম এসেছে। এ নামটি কাদীম এর চেয়ে উত্তম। কেননা الأول (প্রথম) নামটি ইঙ্গিত করে যে, তার পরের সকলেই তার দিকে ধাবিত হয়, তিনিই সবকিছুর আশ্রয়স্থল এবং সকলেই তার অনুসরণ করে। কিন্তু কাদীম শব্দের মধ্যে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। আল্লাহ তা‘আলার জন্য রয়েছে অতি সুন্দর নামসমূহ। তার নামগুলো শুধু সুন্দর নয়; বরং অতি সুন্দর, সর্বাধিক সুন্দর ও সুন্দরতম।
[2]. সহীহ মুসলিম, অধ্যায়: কিতাবুয্ যিকর ওয়াদ্ দু’আ। শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উছাইমীন বলেছেন, الباطن অর্থ হচ্ছে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সমস্ত সৃষ্টির উপরে হওয়ার সাথে সাথে তিনি তাদের অতি নিকটে। মূলতঃ আল্লাহ তা‘আলার উপরে হওয়া মাখলুকের নিকটবর্তী হওয়ার বিরোধী নয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলা মাখলুকের নিকটবর্তী হওয়াকে আল্লাহর ইলম ও ক্ষমতা তাদের নিকটবর্তী হওয়ার দ্বারা ব্যাখ্যা করা হলেও মূলতঃ আল্লাহর জন্য কোন কিছুই অসম্ভব নয়। আল্লাহর সিফাত ও কর্মকে মাখলুকের সিফাত ও কর্ম দ্বারা বুঝা অসম্ভব। কোন সৃষ্টির জন্য একই সময় ছাদের উপরে ও ছাদের নীচে সশরীরে থাকা এবং একই সময় সিংহাসনের উপরে থাকা ও সিংহাসনের নীচে থাকা অসম্ভব। কোন রাজা (মানুষ) যখন তার সিংহাসন ছেড়ে বাইরে যায়, তখন তার সিংহাসন খালি হয়ে থাকে। কারণ তার জন্য একই সময় ও একই সাথে সিংহাসনে থাকা এবং দেশের বাইরে থাকার ধারণা অকল্পনীয়। কিন্তু সুমহান ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ তাআলার জন্য একই সময় ও একই সাথে আরশের উপরে সমুন্নত হওয়া এবং রাতের শেষাংশে দুনিয়ার আসমানে নেমে আসা অসম্ভব কিছু নয়। মাখলুকের নিকটবর্তী হলে আরশ খালি হওয়া জরুরী নয়। যারা আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করেছে, তারা তাদের ক্ষুদ্র ক্ষমতা দ্বারা আল্লাহর বিশাল সিফাত ও ক্ষমতাকে বুঝতে চেষ্টা করেছে বলেই বিভ্রান্ত হয়েছে এবং আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করেছে।
এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়। তা এই যে, কুরআন মাজীদে জান্নাত ও জাহান্নামবাসীদের জন্য যে চিরস্থায়ী জীবনের কথা বলা হয়েছে, তা কি ‘আল্লাহ তা‘আলাই সর্বশেষ’ এই কথার সাথে সাংঘর্ষিক নয়?
এ প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে যে, কোনো সৃষ্টিরই নিজস্ব স্থায়িত্ব নেই। যদি কোন জিনিস স্থায়ী হয় বা স্থায়ী থাকে তাহলে আল্লাহ তাআলা স্থায়ী রাখার কারণেই তা স্থায়ী হয় এবং থাকতে পারে। অন্যথায় আল্লাহ ছাড়া স্ব স্ব ক্ষেত্রে সবাই নশ্বর ও ধ্বংসশীল। আখেরাতে আপন ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্যে কেউ জান্নাত বা জাহান্নামে চিরস্থায়িত্ব লাভ করবে- এমনটি নয়। বরং সেখানে তার স্থায়িত্ব লাভ করার কারণ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা যাকে চিরস্থায়ী জীবন দান করবেন। ফেরেশতাদের ব্যাপারটাও ঠিক তাই। তারা আপন ক্ষমতা ও বৈশিষ্ট্যে অবিনশ্বর নয়। আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেছেন তখন তারা অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং যত সময় পর্যন্ত তিনি চাইবেন তত সময় পর্যন্তই তারা বেঁচে থাকবে। পরিশেষে ফেরেশতারাও ধ্বংস হবে।
কিন্তু জান্নাতবাসীগণ ও জান্নাতের নেয়ামতসমূহে এবং জাহান্নামী কাফেররা ও জাহান্নামের আযাবে চিরকাল থাকার বিষয়টি কুরআন ও হাদীছের অনেক দলীল দ্বারা প্রমাণিত।
[3]. এখানে সূচনাহীন যেই সৃষ্টি থাকার ধারণাকে বাতিল করা হয়েছে, তা দ্বারা সম্ভবত দৃশ্যমান এ বর্তমান সৃষ্টিজগৎ অথবা নাবী-রসূলদের মধ্যে যেসব সৃষ্টি থাকার কথা জানা গেছে, তা উদ্দেশ্য। তবে আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু কাদীম বা অনাদি ও সূচনাহীন, তাই তার সমস্ত পূর্ণ গুণ ও কাদীম বা অনাদি ও সূচনাহীন। সেই হিসাবে তার সাথে সাথে কাদীম বা সূচনাহীন সৃষ্টি থাকা অসম্ভব নয়। তবে কুরআন-হাদীছ ও বোধশক্তির দ্বারা সাব্যস্ত যে, আল্লাহর পূর্বে আর কিছুই ছিল না, তিনিই প্রথম, তার থেকেই সবকিছুর সূচনা এবং তার সমকক্ষও কেউ নেই। চন্দ্র, সূর্য বা অন্য কোনো গ্রহ-নক্ষত্র অথবা উর্ধ্ব ও নিমণ জগতের কোনো কিছুই অনাদি, চিরন্তন ও চিরস্থায়ী নয়। প্রত্যেকের একটি সূচনাকাল আছে। তার পূর্বে তার অস্তিত্ব ছিল না। আবার প্রত্যেকের আছে একটি সমাপ্তিকাল। তারপর আর তার অস্তিত্ব থাকবে না।
[4]. শুধু তাই নয়, তাদের কাছে এটিই আল্লাহ তা‘আলার সর্বাধিক খাস নাম। এ জন্যই তাদের কিতাবসমূহে ঘুরেফিরে বার বার এ নামটিই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তারা আল্লাহ তাআলার জন্য এ নামটি ব্যবহার করেই সমস্ত গুণাবলী অস্বীকার করে। তারা বলে থাকেإثبات الصفات يلزم منه تعدد القدماء অর্থাৎ আল্লাহর জন্য একাধিক গুণাবলী সাব্যস্ত করতে গেলে একাধিক قديم (অনাদি, চিরন্তন, প্রাক্তন, অবিনশ্বর) সত্তা সাব্যস্ত করা আবশ্যক হয়। আল্লাহ তা‘আলা তাদের বাতিল ধারণার বহু উর্ধ্বে।
[5]. সুতরাং আল্লাহ তাআলার জন্য قديم ব্যবহার না করে الأول নামটিই ব্যবহার করা উচিত। কেননা (১) الأول নামের মধ্যে যে সৌন্দর্য রয়েছে, قديم শব্দের মধ্যে তা নেই। আর কুরআন হলো সাহিত্যের সৌন্দর্য সীমা-রেখার উর্ধ্বে। তাতে সুন্দরতম অর্থবহ শব্দই স্থান পাওয়ার যোগ্য। তাই আল্লাহ তাআলার নাম হিসাবে الأول শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। قديم ব্যবহার হয়নি। (২) الأول শব্দটিতে قديم -এর অর্থ রয়েছে। কিন্তু قديم শব্দে الأول -এর অর্থ নেই। (২) কুরআন ও সুন্নাহ্য় আল্লাহর নাম হিসাবে الأول শব্দটি এসেছে। তাই কুরআন ও হাদীছের বাইরে থেকে এ অর্থে আল্লাহ তা‘আলার নাম নির্বাচন করা থেকে বিরত থাকা উচিত। (৪) الأول শব্দটি قديم এর অর্থ প্রদান করার সাথে সাথে আরো বুঝায় যে, সবকিছুর আশ্রয়স্থল একমাত্র আল্লাহ।
[6]. القديم শব্দের উপরোক্ত বিশেস্নষণ থেকে বুঝা যাচ্ছে একই শ্রেণীর একাধিক জিনিসের মধ্য থেকে যেটি অন্যের তুলনায় অগ্রবর্তী হয়, তার জন্য قديم বা متقدم শব্দটি ব্যবহৃত হয়। সুতরাং আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্ব যেহেতু শুধু অন্যান্য জিনিস সমূহের অস্তিত্বের তুলনায় প্রাক্তন নয়, তাই তার জন্য কাদীম নামটি প্রযোজ্য হতে পারে না। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু সৃষ্টির মধ্যে গণ্য নন, তাই তাদের তুলনায় তার অস্তিত্ব পূর্বে হওয়ার ধারণা ঠিক নয় এবং সে অর্থে তার জন্য কাদীম নাম বের করাও অশোভনীয়। মোট কথা ইমাম তাহাবী সম্ভবত দার্শনিক ও কালাম শাস্ত্রবিদদের অনুসরণ করে কাদীম শব্দটি আল্লাহর নাম হিসাবে ব্যবহার করেননি; বরং তিনি আল্লাহ তা‘আলার সূচনাহীন অনাদি সত্তা বুঝানোর জন্যই শব্দটি ব্যবহার করেছেন। قديم শব্দের পরে সরাসরি بلا ابتداء (সূচনাহীন) বাক্যাংশ যোগ করা থেকেই বুঝা যাচ্ছে ইমাম তাহাবী রহিমাহুল্লাহ কাদীম শব্দের ভাষাগত উদ্দেশ্য করেননি। বরং তিনি এর দ্বারা সাব্যস্ত করেছেন যে, সবকিছুর পূর্বেই রয়েছেন মহান স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্ব, তার অস্তিত্বের কোনো শুরু নেই, শেষও নেই এবং তার দ্বারাই সকল মাখলুক সৃষ্টি হয়েছে, হচ্ছে এবং হবে।