লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (لا إله إلا الله) এর ব্যাখ্যা

নাহু শাস্ত্রবিদদের মতে لاإله إلا هو ‘‘আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মাবুদ নেই’’ -এ বাক্যের মধ্যে খবর উহ্য রয়েছে। তারা বলেছেন, মূল বাক্যটি হলো এ রকম, لاإله في الوجود إلا الله ‘‘আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মাবুদের অস্তিত্ব নেই’’।[1]

কিন্তু নাহুবিদদের এ কথার উপর মুন্তাখাব গ্রন্থকার আপত্তি করেছেন। যে যুক্তিতে তিনি নাহুবিদদের প্রতিবাদ করেছেন তা হলো, তাদের কথা অনুসারে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য বাতিল ইলাহ্র অস্তিত্ব সম্পূর্ণরূপে নাকচ হয়ে যায়। আর এটি জানা কথা যে, আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদ সাব্যস্ত করতে গিয়ে বাতিল মাবুদের অস্তিত্ব নাকচ করার চেয়ে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো মাবুদের হাকীকত ও মাহিয়াত (প্রকৃতি, স্বরূপ ও স্বভাবের) নেই, এ কথা বলাই অধিক শক্তিশালী। সুতরাং এখানে বাক্যটিকে প্রকাশ্য অবস্থায় রেখে দেয়া এবং উহ্য কিছু নির্ধারণ না করাই উত্তম।

আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন আবীল ফযল আল-মুরসী ‘রাইয়্যুয যামআন’ নামক কিতাবে মুন্তাখাব গ্রন্থকারের জবাবে বলেছেন, যারা আরবদের ভাষা সম্পর্কে অবগত নয়, সে কেবল এখানে খবর উহ্য থাকার বিষয়টিকে অস্বীকার করতে পারে। কেননা নাহুবিদদের ইমাম সিবওয়াইয়ের মতে এখানে إله শব্দটি মুবতাদার স্থানে রয়েছে। অন্যদের মতে إله শব্দটি لا এর ইসম। উভয় অবস্থাতেই এখানে মুবতাদার খবর থাকা জরুরী। আর মুন্তাখাব গ্রন্থকার খবর উহ্য মানার প্রয়োজন নেই বলে যেই কথা বলেছেন, তা ভুল। আর মুন্তাখাব গ্রন্থকারের কথা, খবর উহ্য না মানলে স্রষ্টার মাহিয়াতের (প্রকৃতি, স্বরূপ ও স্বভাবের) নাকচ হয়, এর কোন ভিত্তি নেই। কেননা মাহিয়াতের নাকচ করা আর অস্তিত্বের নাকচ করা একই কথা। অস্তিত্ব ছাড়া কোন মাহিয়াতের কল্পনাই করা যায় না।

সুতরাং মাহিয়াত ও উজুদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এটিই আহলে সুন্নাতের মাযহাব। মুতাযেলারা এতে মতভেদ করেছে। তারা অস্তিত্ব ছাড়াই মাহিয়াত সাব্যস্ত করে থাকে।

إلا الله শব্দটি لاإله থেকে বদল হিসাবে মারফু হয়েছে। এটি لا এর খবর নয় এবং মুবতাদারও খবর নয়। আবু আব্দুল্লাহ আল-মুরসী এ কথার পক্ষে দলীল-প্রমাণও উল্লেখ করেছেন।

ইমাম ইবনে আবীল ইয্ রহিমাহুল্লাহ বলেন, এখানে لاإله إلاالله এর ইরাব বর্ণনা করা অর্থাৎ ব্যাকরণগত বিশেস্নষণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়; বরং উদ্দেশ্য হলো এখানে প্রকৃত তাওহীদ বর্ণনা করা এবং খবর উহ্য মানার ব্যাপারে নাহুবিদদের উপর আরোপিত অভিযোগের নিষ্পত্তি করা। সে সঙ্গে আরো সাব্যস্ত করা যে, যারা বলে মুতাযেলারাই নাহুবিদদের উপর অভিযোগটি উত্থাপন করেছে, তাদের কথা সম্পূর্ণ ভুল।[2]

মুন্তাখাব গ্রন্থকার বলেন, ইলাহর অস্তিত্ব নাকচ করার ক্ষেত্রে নাহুবিদগণের কথা শর্তযুক্ত নয়। কেননা অস্তিত্বহীনতা কোন জিনিসের বিশেষণ হতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা যাকারিয়া আলাইহিস সালামের ব্যাপারে বলেন,

وَقَدْ خَلَقْتُكَ مِن قَبْلُ وَلَمْ تَكُ شَيْئًا

‘‘এর আগে আমি তোমাকে সৃষ্টি করেছি যখন তুমি কিছুই ছিলে না’’। (সূরা মারইয়াম: ৯)

আর এ কথা বলা ঠিক হবে না যে, لَا إِلَهَ غَيْرُه বা لا إله غير الله বাক্যটি لاإله إلا الله এর মত নয়। বরং উভয় বাক্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কেননা إلا এর পরে ব্যবহৃত ইসমের যে ইরাব হয়, সে ইসমের স্থানে غير শব্দটি ব্যবহৃত হয় বলে ‘গাইরা’ এর ইরাবও তার অনুরূপ হয়। সুতরাং উভয় বাক্যেই একই খবর উহ্য থাকে। তাই এখানে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য হওয়ার সন্দেহ এবং তার জবাব উল্লেখ করা হলো। মূল কথা, কালেমাতুত তাওহীদ, لا إله إلا الله -এর মাধ্যমে যে তাওহীদে উলুহীয়া সাব্যস্ত হয়, لا إله غير الله বাক্য দ্বারা একই তাওহীদ সাব্যস্ত হয়।

[1]. শাইখ আব্দুল আযীয বিন বায রহিমাহুল্লাহ এ স্থানে সুন্দর একটি টিকা লিখেছেন। তিনি বলেন, এখানে لا إله এর পরে খবর উহ্য না থাকাই উত্তম বলে মুন্তাখাব গ্রন্থকার যে মন্তব্য করেছেন, তা ভালো মন্তব্য নয়। অনুরূপ এখানে নাহুবিদগণ যে موجود শব্দটিকে উহ্য খবর নির্ধারণ করেছেন তাও সঠিক নয়। কেননা আল্লাহ ব্যতীত উপাস্য মাবুদের সংখ্যা প্রচুর এবং সেগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে। موجود কিংবা উজুদ শব্দকে উহ্য খবর মানলে কালেমায়ে তাওহীদ দ্বারা একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাই ইবাদত সাব্যস্ত করা এবং তার ইবাদত ছাড়া অন্যসব মাবুদের ইবাদত বাতিল করার উদ্দেশ্য হাসিল হয় না। তখন কেউ এ আপত্তি করতে পারে যে, তোমরা কিভাবে এ কথা বলো যে, لاإله في الوجود إلا الله؟ ‘‘সৃষ্টিজগতের মধ্যে আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদের অস্তিত্ব নেই?’’ অথচ আল্লাহ তা‘আলা মুশরিকদের অনেক মাবুদ থাকার সংবাদ দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সূরা হুদের ১০১ নং আয়াতে বলেন,

وَمَا ظَلَمْنَاهُمْ وَلَكِنْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ فَمَا أَغْنَتْ عَنْهُمْ آَلِهَتُهُمُ الَّتِي يَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مِنْ شَيْءٍ لَمَّا جَاءَ أَمْرُ رَبِّكَ وَمَا زَادُوهُمْ غَيْرَ تَتْبِيبٍ

‘‘আমি তাদের প্রতি যুলুম করিনি, তারা নিজেরাই নিজেদের উপর যুলুম করেছে আর যখন আল্লাহর হুকুম এসে গেল তখন আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা নিজেদের যেসব মাবুদকে ডাকতো তারা তাদের কোনো কাজে লাগলো না এবং তারা ধ্বংস ছাড়া তাদের আর কোন উপকার করতে পারলো না’’। আল্লাহ তাআলা সূরা আহকাফের ২৮ নং আয়াতে আরো বলেন,

فَلَوْلَا نَصَرَهُمُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِ اللَّهِ قُرْبَانًا آَلِهَةً بَلْ ضَلُّوا عَنْهُمْ وَذَلِكَ إِفْكُهُمْ وَمَا كَانُوا يَفْتَرُونَ

‘আল্লাহকে বাদ দিয়ে তারা যেসব বস্তুকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম মনে করে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছিলো, তারা কেন তাদেরকে সাহায্য করলো না? বরং তারা তাদের থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে। এটা ছিল তাদের মিথ্যা এবং মনগড়া আকীদা-বিশ্বাসের পরিণাম, যা তারা গড়ে নিয়েছিল’। আর আমরা বাস্তবে আল্লাহ ছাড়া আরো অনেক মাবুদের ইবাদত হতে দেখেছি। এক শ্রেণীর মুসলিম আব্দুল কাদের জিলানী, সাইয়্যেদ বদবী, হুসাইন, আলী, যাইনাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুমসহ অন্যান্য অলী-আওলীয়ার ইবাদত করে যাচ্ছে। মিশর, সিরিয়া ইরাক, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের প্রত্যেকটি মাযারেই চলছে আল্লাহ ছাড়া অন্যের ইবাদত।

সুতরাং এ আপত্তি হতে নিস্কৃতি পাওয়ার জন্য, কালেমায়ে তাওহীদের মহত্ত্ব বর্ণনা করার জন্য এবং কালেমায়ে তাওহীদ দ্বারা মুশরিকদের সমস্ত মাবুদ ও আল্লাহর পরিবর্তে তাদের ইবাদতকে বাতিল করার জন্য لا إله এর পরে একটি উহ্য খবর নির্ধারণ করা জরুরী। আর নাহুবিদগণ যে موجود শব্দটিকে উহ্য খবর মেনেছেন, তাতে এ মহৎ উদ্দেশ্য পূরণ হয় না। তাই এখানে حق শব্দটি উহ্য খবর হিসাবে নির্ধারণ করে এভাবে বলতে হবে لا إله حق إلاالله ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য ইলাহ নেই’। এ হক শব্দটি উহ্য মানার মাধ্যমেই আল্লাহ ছাড়া বাকী সব মাবুদ এবং তাদের ইবাদত বাতিল হয় এবং সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয় যে, সত্য ইলাহ ও সত্য মাবুদ হলেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা। অনেক আলেম এটিই সাব্যস্ত করেছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আবুল আববাস শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া, তার ছাত্র ইবনুল কাইয়্যিম এবং আরো অনেকেই।

হক শব্দটি উহ্য মানার পক্ষে কুরআনেরও একাধিক দলীল রয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সূরা লুকমানের ৩০ নং আয়াতে বলেন,

ذَٰلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ

‘এসব কিছু এ কারণে যে, আল্লাহই হচ্ছেন সত্য এবং তাকে বাদ দিয়ে অন্যান্য যেসব জিনিসকে এরা ডাকে তা সবই মিথ্যা, আর আল্লাহই সুউচ্চ ও সুমহান’।

এ আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেন যে, তিনিই সত্য মাবুদ আর লোকেরা তাকে বাদ দিয়ে যেসব মাবুদকে আহবান করছে, তা সবই বাতিল। আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত যেসমস্ত মাবুদের উপাসনা করা হয়, তা সবই বাতিল। তারা মানুষদের মধ্য থেকে হোক, ফেরেশতাদের মধ্য থেকে হোক, জিনদের মধ্য থেকে হোক কিংবা অন্যসব সৃষ্টির মধ্য থেকে হোক।

সুতরাং لا إله -এর পরে যদি حق শব্দটি উহ্য মানা হয়, তাহলেই কালেমায়ে তাওহীদের মাধ্যমে পরিস্কার হয়ে যায় যে, আল্লাহই একমাত্র সত্য মাবুদ। কালেমায়ে তাওহীদের এ অর্থের কারণেই মক্কার মুশরেকরা কালেমাটি অপছন্দ করেছিল এবং তা পাঠ করতে অস্বীকার করেছিল। কেননা তারা অবগত হতে পেরেছিল যে, উহা তাদের মাবুদগুলোকে বাতিল করে দেয়। তারা আরো বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে, এ কালেমার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ব্যতীত বান্দার ইবাদতে অন্য কারো হক নেই। এ জন্যই নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাদেরকে বলেছিলেন, قُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ تُفْلِحُوا ‘‘হে লোক সকল! তোমরা বলো, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্। এতে তোমরা সফল হবে’’, তখন জবাব দিয়েছিল,

أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهاً وَاحِداً إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ

‘সে কি বহু মাবুদকে এক মাবুদে পরিণত করে দিয়েছে? নিশ্চয়ই এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার! (সূরা সোয়াদঃ ৫) তারা আরো বলেছিল, أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ ‘‘আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের মাবুদদেরকে পরিত্যাগ করবো? (সূরা সাফ্ফাত: ৩৬) এ অর্থে আরো অনেক আয়াত রয়েছে। আশা করি এই বর্ণনার মাধ্যমেই কালেমাতুত্ তাওহীদ لا إله إلاالله অর্থ সম্পর্কিত সমস্ত আপত্তির নিষ্পত্তি হলো এবং প্রকৃত্য সত্য পরিস্কার হলো। আল্লাহই তাওফীক দানকারী।

[2]. তাওহীদ সম্পর্কে মানুষের মতভেদ থেকেই কালেমাতুত তাওহীদ لا إله إلا الله -এর প্রথম অংশ لا إله -এর পরে উহ্য খবরের শব্দটি নির্ধারণের ব্যাপারে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। বাতেনী, দার্শনিক, এক শ্রেণীর সুফী এবং সীমালংঘনকারী কালামশাস্ত্রবিদরা বাক্যটির উহ্য রূপ নির্ধারণ করে থাকেন এভাবে لا إله موجود إلا الله ‘সৃষ্টিজগতে আল্লাহ ছাড়া অস্তিত্বশীল আর কোন ইলাই নেই’।

যারা এভাবে বাক্যটির উহ্য রূপ নির্ধারণ করে থাকেন, তাদের কথা দ্বারা বড়জোর আল্লাহর তাওহীদ থেকে শুধু তার অস্তিত্ব এবং উহার আনুসাঙ্গিক বিষয়াদিই সাব্যস্ত করা যাচ্ছে।

কালামশাস্ত্রবিদদের আরেকদল এবং সুন্নীদের কিছু লোক অন্য একটি উহ্য খবর মেনেছেন। তারা বলেছেন, এখানে উহ্য বাক্যটি হবে এরূপ, لا إله خالق إلا الله ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য স্রষ্টা নেই’’ অথবা তারা এরূপ বলেছেন, لا إله رب غير الله ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য প্রভু নেই।

কালাম শাস্ত্রবিদদের কেউ কেউ আবার এখানে কোন কিছু উহ্য মানতেই রাজী নয়। তারা বলেছেন, এখানে উহ্য কিছু মানার দরকার নেই। শুধু لا إله إلاالله-এর মাধ্যমেই তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য বস্তুর উলুহীয়াতকে নাকচ করে থাকেন। এ কথা সত্যের অতি নিকটে। তবে বাক্যটির ভাষাগত দিক মূল্যায়ন করলে দেখা যায় এর মাধ্যমে বাক্যের অর্থ পরিপূর্ণ হয় না। এজন্যই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অধিকাংশ লোক বাক্যটির উহ্য রূপ এভাবে নির্ধারণ করেছেন, لا إله بحق، أو لا إله حق، أو معبود بحق। সবগুলো বাক্যের অর্থই এক, অভিন্ন ও সঠিক। আর তা হলো আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মাবুদ নেই। এভাবে حق শব্দটি উহ্য মানার কারণ হলো, কালেমাতুত তাওহীদের মাধ্যমে শুধু আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য মাবুদসমূহের অস্বীকার করা উদ্দেশ্য নয়। কেননা বনী আদমের মধ্যে এমন লোকও রয়েছে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য বহু মাবুদের ইবাদত করে। যদিও তারা ইবাদত পাওয়ার হকদার নয়। কিন্তু বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব রয়েছে। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য মাবুদের অস্তিত্ব অস্বীকার করা বাস্তবতার পরিপন্থী। কেননা বহু মানুষ আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য বাতিল মাবুদের ইবাদত করে এবং বিশ্বাস করে যে, ঐগুলো তাদের মাবুদ। প্রত্যেকটি মাযারকেই আপনি মাবুদ বলতে পারেন।

এমনি যারা حق শব্দটি উহ্য না মেনে সাধারণভাবে অন্যান্য মাবুদের উলুহীয়াত সাব্যস্ত করার জন্য শুধু لا إله إلا الله কে যথেষ্ট মনে করে ভাষাগত দিক মূল্যায়নে তাদের কথাও সঠিক নয়। কেননা তা দ্বারা উদ্দিষ্ট অর্থ পূর্ণ হয়না। ঐদিকে কালামশাস্ত্রবিদদের ব্যাখ্যা, لا إله خالق أو رازق أو مدبر، أو لا إله يستحق الربوبية غير الله، ‘‘আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য, স্রষ্টা, রিযিকদাতা, পরিচালক-ব্যবস্থাপক অথবা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো প্রভু নেই’’ -এটিও ঠিক নয়। কারণ কালেমাতুত তাওহীদ দ্বারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রুবুবীয়াত নাকচ করা উদ্দেশ্য নয়। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো রুবুবীয়াত না থাকার কথা মুশরিকরাও স্বীকার করতো। তারা বলতো আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন রব অর্থাৎ স্রষ্টা ও রিযিক দাতা নেই। মুশরিকরা যে আল্লাহর রুবুবীয়াত মানতো, কুরআন মজীদে এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেন,

وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ

‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তবে অবশ্যই তারা বলবে, আল্লাহ্। (সূরা লুকমান: ২৫) আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنْ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنْ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنْ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ

‘তুমি জিজ্ঞেস করো, কে রিযিক দান করে তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তা ছাড়া কে জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ্! তখন তুমি বলো, তারপরও কি ভয় করবে না?’ (সূরা ইউনুস: ৩১)

সুতরাং মুশরিকরা আল্লাহ ছাড়াও অন্যান্য যেসব মাবুদের ইবাদত করতো, কালেমাতুত তাওহীদের মাধ্যমে তা নাকচ করা উদ্দেশ্য। এ জন্যই কুরআন নাযিল করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ রসূলগণকে প্রেরণ করেছেন। তাদের দাওয়াতের প্রথম মূলনীতি ছিল এককভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার ইবাদতের প্রতি আহবান জানানো। এ বিষয়েই নাবী-রসূলদের সাথে তাদের কাওমের লোকদের দ্বন্দ হয়েছিল। আমাদের নাবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মূল বিরোধটিও এ বিষয়কে কেন্দ্র করেই সৃষ্টি হয়েছিল। কুরআন কঠোর ভাষায় তাদের প্রতিবাদ করেছে এবং কালেমাতুত তাওহীদের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার ইবাদত সাব্যস্ত করেছে। সুতরাং لا إله إلا الله এ বাক্যের মধ্যে لا إله এর পরে حق শব্দ উহ্য না মানলে তা দ্বারা প্রকৃত তাওহীদ সাব্যস্ত হয় না এবং যে তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য নাবী-রসূল পাঠিয়েছেন, তাও সাব্যস্ত হয় না।