রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাপেক্ষা উত্তম চরিত্র ও সুউচ্চ সম্মানের অধিকারী ছিলেন, কুরআনের শিক্ষাই ছিল তাঁর আদর্শ, যেমন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন: «كان خلقه القرآن» তাঁর আদর্শ ছিল কুরআন।[1]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
«إنما بعثت لأتمم مكارم الأخلاق».
উত্তম আদর্শের পূর্ণতা দান করার জন্যই আমাকে রাসূল করে পাঠানো হয়েছে।[2]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রশংসায় অতিরঞ্জন করা পছন্দ করেতন না, যা তাঁর বিনয়ী হওয়ারই প্রমাণ।
ওমার রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:
«لا تطروني كما أطرت النصارى عيسى ابن مريم، إنما أنا عبد، فقولوا: عبد الله ورسوله».
তোমরা আমার মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করো না, যেমন মরিয়মের পুত্রর খৃষ্টানরা মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা করেছে। আমি তো আল্লাহর একজন বান্দা মাত্র, তোমরা আমাকে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূলই বলবে।[3]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: কতিপয় লোক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্দেশ্যে বলল:
أن ناسًا قالوا: يا رسول الله يا خيرنا وابن خيرنا، وسيدنا وابن سيدنا، فقال: «يا أيها الناس، قولوا بقولكم، ولا يستهوينكم الشيطان، أنا محمد عبد الله ورسوله، ما أحب أن ترفعوني فوق منزلتي التي أنزلني الله عز وجل».
হে আমাদের মাঝের উত্তম ব্যক্তি ও উত্তম ব্যক্তির পুত্র, আমাদের সর্দার ও সর্দারের পুত্র। এ কথাগুলি শুনে তিনি বললেন: ওহে লোক সকল! তোমরা তোমাদের কথা বল, কিন্তু শয়তান যেন তোমাদের উপর বিজয়ী হতে না পারে। আমি তো আল্লাহর বান্দা মুহাম্মাদ ও তাঁর রাসূল। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে সম্মান দান করেছেন সে সম্মান থেকে বাড়িয়ে কেউ আমাকে বেশী সম্মান করবে তা আমি কখনো পছন্দ করি না।[4]
আমাদের সমাজে এমন অনেক লোক আছে যারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এমন প্রশংসা করে থাকে যা তাঁর ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় এমন কি অনেকে এমন ধারণা করে যে তিনি গায়েব বা অদৃশ্যের সংবাদ জানতেন এবং তার হাতে রয়েছে উপকার ও অপকারের চাবি-কাঠি এবং অভাব অনটন, ও সবার প্রয়োজন মিটানো ও রোগ মুক্তিও তাঁর হাতেই। তাদের সেই আক্বিদা বা বিশ্বাসকে অলীক ঘোষণা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ قُل لَّآ أَمۡلِكُ لِنَفۡسِي نَفۡعٗا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَآءَ ٱللَّهُۚ وَلَوۡ كُنتُ أَعۡلَمُ ٱلۡغَيۡبَ لَٱسۡتَكۡثَرۡتُ مِنَ ٱلۡخَيۡرِ وَمَا مَسَّنِيَ ٱلسُّوٓءُۚ ١٨٨ ﴾ [الاعراف: ١٨٧]
অর্থাৎ বলুন! আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ব্যতীত আমার নিজের উপকার-অপকারের উপরও অধিকার নেই। আমি যদি অদৃশ্যের খবর জানতাম তবে তো আমি অধিকাংশ কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোন অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করত না।[5]
এই সেই নবী যিনি এ ধুলির ধরায় আশ্রিত সবুজ-শ্যামলের ছায়া প্রাপ্ত সমস্ত সত্ত্বার শ্রেষ্ঠতম। সর্বদায় তিনি আল্লাহর নির্দেশ পালনে সচেষ্ট ও সদা স্বীয় রবের প্রতি প্রত্যাবর্তিত। যিনি কখনো অহঙ্কারকে আশ্রয় দেননি বরং তিনি ছিলেন বিনয়ীর মূর্ত প্রতীক এবং আল্লাহর সমীপে আত্মসমর্পণকারীদের অগ্রনায়ক।
আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
«لم يكن شخص أحب إليهم من رسول الله - صلى الله عليه وسلم - قال: وكانوا إذا رأوه لم يقوموا لما يعلمون من كراهته لذلك».
সাহাবাদের নিকট রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চেয়ে কোন ব্যক্তি অধিক ভালবাসার পাত্র ছিল না। তিনি আরো বলেন: সাহাবারা বসে থাকা অবস্থায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগমন করলে তার সম্মানার্থে উঠে কখনো দাঁড়াত না। কেননা তারা জানতেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা পছন্দ করতেন না।[6]
মুসলিম উম্মার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আশ্চার্যজনক নম্রতা এবং অতুলনীয় উত্তম চরিত্রের দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন। তিনি কিভাবে এক অসহায় রমণীর প্রতি বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করেন ও শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও তার জন্য তাঁর মূল্যবান সময় প্রদান করেন।
আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
إن امرأة جاءت إلى النبي - صلى الله عليه وسلم - فقالت له: إن لي إليك حاجة، فقال: «اجلسي في أي طريق المدينة شئت أجلس إليك».
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট জনৈক মহিলা এসে বলল, আপনার নিকট আমার কিছু আবেদন রয়েছে। একথা শুনে তিনি বললেন: তুমি মদীনার যে কোন রাস্তায় বসতে চাও আমি তোমার আবেদন শুনার জন্য সেই রাস্তায় বসতে রাজি।[7]
আরবী কবি সত্যই বলেছেন:
يروحُ بأرواح المحامِدِ حُسنها فيرقي بها في ساميات المفاخرِ
وإن فُضَّ في الأكوانِ مسك ختامها تَعطَّر منها كلُّ نجدٍ وغائرِ
প্রশংসাময় ব্যক্তিত্বের সাথে তার সৌন্দর্য বিকশিত হয়।
সুতরাং, তিনি তারই দ্বারা গর্বের উচ্চ শিখরে সমাসীন।
যখন তাঁর পরিসমাপ্তির মিসক ছড়িয়ে যায়, যার ফলে আরব অনারব সবই সুগন্ধময় হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিনয়ীদের শিরোমনি ও মূর্ত প্রতীক। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
«لو دعيت إلى ذراع أو كراع لأجبت، ولو أهدي إلي ذراع أو كراع لقبلت».
যদি ছাগলের একটি খুর খাওয়ার জন্যও আমন্ত্রিত হই, তা আমি সাদরে গ্রহণ করব, আর আমাকে ছাগলের খুর উপহার দেয়া হলেও আমি তা সাদরে গ্রহণ করব।[8]
সর্ব কালের অহঙ্কারীদের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী এক প্রতিবন্ধক হয়ে থাকবে এবং তাদের অহংকার ও বড়ত্বের জন্য থাকবে দাঁত ভাঙ্গা জবাব।
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন:
«لا يدخل الجنة من كان في قلبه مثقال ذرة من كبر».
যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।[9]
অহঙ্কার হল জাহান্নামের পথ -আল্লাহ তা‘আলা এত্থেকে আমাদেরকে রক্ষা করুন- যদিও তা অণু পরিমাণ হয়!
প্রিয় পাঠক! অহঙ্কার করে বিচরণকারীর কি ভয়াবহ পরিণতি হয়েছিল! এবং তার প্রতি আল্লাহ তা‘আলা রাগান্বিত হয়ে কেমন যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি দিয়েছিলেন! একটু ভেবে দেখুন!
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন:
«بينما رجل يمشي في حلة تعجبه نفسه، مرجل رأسه يختال في مشيته، إذ خسف الله به، فهو يتجلجل في الأرض إلى يوم القيامة».
এক ব্যক্তি দামী পোষাক পরে আত্মঅহমিকতা নিয়ে ও মাথা আঁচড়িয়ে ফ্যাশন করে চলছিল, এ অবস্থায় আল্লাহ তাকে জমিনের ভিতর দাবিয়ে দিলেন। সে কিয়ামত পর্যন্ত নিচের দিকে দাবতেই থাকবে।[10]
[2] আহমাদ, হাদিস: ৮৯৫২
[3] বুখারি, হাদিস: ৩৪৪৫; আহমদ: ১৫৪
[4] মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ১৩৫৯৬
[5] আল- আরাফ, আয়াত: ১৮৮
[6] তিরমিয, হাদিস: ২৭৫৪
[7] আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮১৮
[8] বুখারী, হাদিস: ২৫৬৮
[9] মুসলিম, হাদিস: ৯১
[10] বুখারী, হাদিস: ৫৭৮৯: মুসলিম, হাদিস: ৬২২