সম্মানিত পাঠক! আপনি দেখে থাকবেন যে ছালাত এর বিভিন্ন প্রকার শব্দের প্রত্যেকটির ভিতর নাবীর সাথে তাঁর বংশধর, তাঁর পত্নীকুল ও সন্তান সন্ততির উপর ছালাত প্রেরণের কথা উল্লেখ আছে। সুতরাং যে ব্যক্তি শুধু اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ হে আল্লাহ্! মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ছালাত দান কর বলে ক্ষান্ত হবে সে নাবীর নির্দেশ পালনকারী হবেনা ও তার এরূপ বলা সুন্নাহ সম্মত হবে না। বরং অবশ্যই এ সমস্ত শব্দের যে কোন একটি পরিপূর্ণভাবে আনতে হবে যেভাবে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এসেছে। এক্ষেত্রে প্রথম তাশাহহুদ ও দ্বিতীয় তাশাহহুদের মাঝে কোন তফাত নেই। আর এটাই ইমাম শাফিঈর স্বীয় “আল-উম” গ্রন্থের (১/১০২) স্পষ্ট উক্তি। তিনি বলেছেনঃ
প্রথম ও দ্বিতীয় বৈঠকের তাশাহহুদের শব্দ এক ও অভিন্ন। আর আমার কথায় ‘তাশাহহুদ’ বলতে তাশাহহুদ ও নাবীর প্রতি ছালাত পাঠ উভয়ই উদ্দেশ্য, একটি অন্যটি ছাড়া যথেষ্ট নয়।
আর হাদীছে যে এসেছেঃ
کان لایزید فی الرکعتین علی التشهد
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’রাকাআতের বৈঠকে তাশাহহুদের অতিরিক্ত কিছু পাঠ করতেন না- এটি মুনকার বা পরিত্যাজ্য হাদীছ- যেমনটি সিলসিলাহ যঈফাহ। গ্রন্থে তদন্ত করে দেখিয়েছি— হাদীছ নং ৫৮১৬
এযুগের আশ্চর্যজনক বিষয় এবং ইলমী বিপর্যয় ও বিশৃংখলার নমুনাসমূহের একটি নমুনা হচ্ছে এই যে, জনৈক ব্যক্তি- যিনি হচ্ছেন উস্তায মুহাম্মাদ ইসআফ আন নাশশীবী। তিনি তার “আল-ইসলামুছছহীহ” নামক গ্রন্থে নাবীর উপর ছালাত পাঠ করতে যেয়ে বংশধরের প্রতি ছালাত পাঠ করা অস্বীকার করার ধৃষ্টতা পোষণ করেছেন। অথচ ছহীহ বুখারী, মুসলিম ও অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে একদল ছাহাবাহ থেকে তা সাব্যস্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন কা'ব বিন উজরাহ, তলহাহ বিন উবাইদুল্লাহ প্রমুখগণ। তাদের বর্ণিত হাদীছগুলোতে এসেছে যে, তাঁরা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, کيف نصلى عليك আমরা কিভাবে আপনার প্রতি ছালাত পাঠ করব? তখন তিনি তাদেরকে এসব শব্দ শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর অস্বীকার করার পিছনে যুক্তি এই যে, আল্লাহ তা’আলা তার এই বাণীঃ صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيماً তোমরা তার প্রতি ছালাত পাঠ কর ও যথারীতি সালাম প্রদান কর— এতে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে আর কাউকেই উল্লেখ করেননি।
অতঃপর তিনি ছাহাবাগণ কর্তৃক নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে উক্ত প্রশ্ন করাকে দারুণভাবে অস্বীকার করেছেন- এই যুক্তিতে যে, ছালাত অৰ্থ তাদের জানা ছিল আর তা হচ্ছে দুআ। তাহলে কিভাবে তারা তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারেন? এটা তার (নাশশীবীর) অত্যন্ত স্পষ্ট একটা ভুল ধারণা। কারণ তাদের প্রশ্ন ছালাতের অর্থ জানার ব্যাপারে ছিলনা- যাতে উক্ত যুক্তি আসতে পারে। বরং তাদের প্রশ্ন ছিল তাঁর প্রতি ছালাত পাঠের পদ্ধতি সম্পর্কে যেমনটি উল্লিখিত সমস্ত বর্ণনাতে এসেছে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, তারা তাঁকে শরঈ পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যা সেই প্রজ্ঞাপূর্ণ ও অতি জ্ঞানী শারি’ (শরীয়ত প্রবর্তক মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে জানা ছাড়া সম্ভব নয়।
আর তাদের এ প্রশ্নটি হচ্ছে আল্লাহর বাণী وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ আর তোমরা ছালাত কায়িম কর এর মাধ্যমে ফরয কৃত ছালাতের পদ্ধতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করার সমতুল্য। কারণ তাদের ছালাত-এর আভিধানিক মূল অর্থ জানাটা এর শরঈ পদ্ধতি জানার ব্যাপারে তাদেরকে জিজ্ঞাসা মুক্ত করতে পারে না। আর এটা অত্যন্ত স্পষ্ট কথা যাতে অস্পষ্টতার কিছু নেই।
আর তার উল্লেখিত যুক্তিটি মোটেও ধর্তব্যের বিষয় নয়, কারণ সকল মুসলিমের জানা আছে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ রাব্ববুল আলামীনের বাণীর বর্ণনাকারী ও ব্যাখ্যাদাতা। যেমনটি আল্লাহ বলেছেনঃ
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ
“আর আপনার উপর যিকর (কুরআন) নাযিল করেছি। যাতে লোকদেরকে বর্ণনা করে দেন যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে”। (সূরা আন-নাহালঃ ৪৪ আয়াত)
তাইতো নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রতি ছালাত পাঠের পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেছেন যার ভিতর তার বংশধরের উল্লেখ এসেছে। অতএব তাঁর থেকে এটা গ্রহণ করা অনিবাৰ্য। কারণ আল্লাহ বলেছেনঃ
وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا
আর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদেরকে যা প্ৰদান করেন তা তোমরা গ্ৰহণ করা আর যা থেকে নিষেধ করেন। তা থেকে বিরত হও— (সূরাঃ আল-হাশর- ৭ আয়াত)
আর প্রসিদ্ধ ছহীহ হাদীছেও নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী রয়েছেঃ
ألا إنى أوتيت القرآن ومثله معه
জেনে রেখ আমাকে আল-কুরআন প্ৰদান করা হয়েছে এবং তার সাথে তারই অনুরূপ একটি জিনিস প্রদান করা হয়েছে। মিশকাতের তাখরীজ গ্রন্থে উদ্ধৃত করা হয়েছে- (হাদীছ নং ১৬৩ ও ৪২৪৭)।
আমার জানতে ইচ্ছে হয় যে, নাশশীবী ও যারা তার চাকচিক্যপূর্ণ কথায় প্ৰবঞ্চিত হতে পারেন তারা কী বলবেন ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে যে অচিরেই ছালাতের ভিতর তাশাহহুদ পাঠ অস্বীকার করবে অথবা ঋতু অবস্থায় ঋতুবতীর ছলাত ও ছওম ত্যাগ করা অস্বীকার করবে। এই যুক্তিতে যে, আল্লাহ তা’আলা কুরআনে তাশাহহুদ উল্লেখ করেননি। বরং শুধু কিয়াম, রুকু ও সাজদাহ উল্লেখ করেছেন। আর যেহেতু আল্লাহ তা’আলা ঋতুবতীর জন্য কুরআনে ছালাত ও ছওম মাফ করেননি, অতএব তার উপর তা পালন করা ওয়াজিব। তারা কি এই অস্বীকারকারীর অস্বীকৃতির উপর একমত হবেন- নাকি তার প্রতিবাদ করবেন। যদি প্রথম অবস্থা (একমত) হয় যা- আমাদের কাম্য নয় তাহলে তো তারা অনেক দূরবতী ভ্ৰষ্টতায় নিমজ্জিত হলো এবং মুসলিম জামা'আত থেকে বহিষ্কৃত হলো। আর যদি অন্য অবস্থা (প্রতিবাদ) হয় তাহলে তারা তাওফীক প্রাপ্ত হলো ও সঠিক করলো। তারা উপরোক্ত অস্বীকারকারীর যার মাধ্যমে প্রতিবাদ করবেন। নাশশীবীর বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদও তাই। হে পাঠক আপনার নিকট এর কারণও তুলে ধরলাম।
অতএব হে মুসলিম আপনি সাবধান হোন! সুন্নাত থেকে স্বাধীন হয়ে কুরআন বুঝার চেষ্টা করা থেকে। কারণ আপনি কস্মিনকালেও তা পারবেন না যদিও আপনি ভাষা-জ্ঞানে নিজের যুগের সীবওয়াহও (একজন মহান আরবী ভাষাবিদ) হোন না কেন আর তার দৃষ্টান্ত এইতো আপনার সামনেই।
এই নাশশীবী বর্তমান যুগের বড় ভাষাবিদদের অন্যতম একজন অথচ আপনি দেখছেন- তিনি তার ভাষা জ্ঞান নিয়ে ধোকায় পড়েছেন, পথভ্রষ্ট হয়ে গেছেন। তিনি কুরআন বুঝার জন্য সুন্নাহর সাহায্য নেননি। বরং তিনি তা অস্বীকার করেছেন যেমনটি আপনি জানলেন। আমরা যা বলছি এর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে এই পরিসরে তা উল্লেখ করে সংকুলান করা যাবে না। ইতিপূর্বে যা উল্লেখ করা হয়েছে এতেই যথেষ্ট। আর আল্লাহই তাওফীকদাতা।