পাঠক আরো লক্ষ্য করে থাকবেন যে, ছালাতের শব্দাবলীর কোনটিতে السيادة বা সাইয়িদ (যার অর্থ সরদার) উল্লেখ করা হয়নি। তাই পরবর্তীর্ণ বিদ্বানগণ ছালাতে ইবরাহীমিয়াহর ভিতর উক্ত শব্দ বৃদ্ধির শরীয়ত সম্মত হওয়ার ব্যাপারে মতানৈক্য করেছেন। এখানে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নেই। আর তাদের নামও উল্লেখ করার অবকাশ নেই যারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক উম্মতকে শিক্ষা দেয়া পদ্ধতির অনুসরণ করতে যেয়ে উক্ত বৃদ্ধিকে শরীয়ত গৰ্হিত বলার পক্ষে গেছেন।
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ করতঃ এ কথার মাধ্যমে জবাব দিয়েছিলেনঃ “তোমরা বল হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদ এর প্রতি ছালাত দান কর... ”
তবে আমি এ সম্পর্কে সম্মানিত পাঠকদের সমীপে হাফিয ইবনু হাজার (রহঃ)-এর মত সংকলন করছি এজন্য যে, তিনি শাফিঈ মাযহাবের ঐ সকল বড় আলিমদের একজন যারা হাদীছ ও ফিকহ উভয় শাস্ত্রে পারদর্শী। কেননা পরবর্তী শাফিঈ আলিমদের নিকট নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই পূত শিক্ষার বিপরীত বিষয় প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
হাফিয মুহাম্মদ বিন মুহাম্মাদ বিন মুহাম্মাদ আল-গারাবিলী (৭৯০-৮৩৫) যিনি ইবনু হাজার (রহঃ)-এর সংস্পর্শে থাকতেন। তিনি বলেছেন এবং আমি তার হস্তলিখনী থেকে সংকলন করেছিঃ ইবনু হাজারকে (রহঃ) (আল্লাহ তাকে তার হায়াত দ্বারা উপকৃত করুন) ছালাতের ভিতরে ও ছালাতের বাইরে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ছালাত পাঠের পদ্ধতির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল- এতে কি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সরদার গুণে গুনান্বিত করা শর্ত; চাই তাকে ওয়াজিব বলা হোক আর চাই মুস্তাহাব বলা হোক, যথা এরূপ বলা যে, “হে আল্লাহ! ছালাত প্ৰদান কর আমাদের সরদার (নেতা) মুহাম্মাদের প্রতি অথবা সৃষ্টির সরদারের প্রতি অথবা আদম সন্তানের নেতার প্রতি?” নাকি তাঁর বাণী “হে আল্লাহ! মুহাম্মাদের প্রতি ছালাত প্রেরণ করুন” এর উপর ক্ষান্ত থাকতে হবে। কোনটি অধিক উত্তম- সরদার বা সাইয়িদ শব্দ উল্লেখ করে যেহেতু তা হচ্ছে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্থায়ী গুণ অথবা তা উল্লেখ না করে এই জন্য যে, হাদীছে তার উল্লেখ নেই?
ইবনু হাজার (রহঃ) উত্তরে বলেছিলেনঃ হ্যাঁ, হাদীছে বর্ণিত শব্দের অনুসরণ করাই প্রাধান্যযোগ্য। এমনটিও বলা যাবে না যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটা নমনীয়তার খাতিরে ছেড়ে দিয়েছেন। যেমনভাবে তিনি নিজের নাম উল্লেখ করার সময় ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ বলতেন না।”
অথচ উম্মাতকে তা বলতে বলা হয়েছে- যখনই তার নাম উল্লেখ করা হবে। আমরা এজন্য এটা বলছি যে, সাইয়িদ গুণের উল্লেখ যদি প্রাধান্যযোগ্য হতো তাহলে ছাহাবায়ে কিরাম অতঃপর তাবিঈদের থেকে তার অস্তিত্ব পাওয়া যেতো, কিন্তু ছাহাবাহ ও তাবিঈগণের একজনেরও বর্ণিত কোন হাদীছ থেকে এটা জানতে পারিনি। অথচ তাদের থেকে এবিষয়ে অনেক হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এই তো ইমাম শাফিঈ (রহঃ) আল্লাহ তাঁর মর্যাদা উচু করুন। তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অধিক সম্মান দান কারীদের একজন ছিলেন। তিনি তাঁর প্রণীত কিতাবের ভূমিকায় লিখেছেন- যে কিতাব তার মাযহাবের অনুসারীদের প্রামাণ্য গ্ৰন্থরূপে পরিগৃহীত। ‘আল্লাহুম্মা ছল্লি আলা মুহাম্মাদ’ দিয়ে শুরু করে তার ইজতিহাদ নিঃসৃত শব্দাবলীর শেষ পর্যন্ত। আর তা হচ্ছে- كلما ذكره الذاكرين وكلما غفل عن ذكره الغافلون যখনই স্মরণকারীরা তাকে স্মরণ করে এবং উদাসীনারা তাকে উল্লেখ করা থেকে উদাসীন থাকে। যেন তিনি এসব শব্দাবলী এই ছহীহ হাদীছ থেকে নিঃসরণ করেছেন যার ভিতর রয়েছে- سبحان الله عدد خلقه - আল্লাহর পবিত্রতা জ্ঞাপন করছি তার সৃষ্টির সংখ্যা পরিমাণ। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, কোন উম্মুল মুমিনীনকে বেশী পরিমাণ ও দীর্ঘক্ষণ তাসবীহ পাঠ করতে দেখে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন। “তোমার পরে আমি কিছু শব্দ বলেছি সেগুলোকে যদি তুমি (এ যাবৎ) যা বলেছ তার সাথে ওজন করা হয় তবে সেগুলোই ভারী হবে”। অতঃপর উক্ত শব্দের দু'আটি বললেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যাপক অৰ্থবোধক দুআ বলা পছন্দ করতেন।
কাযী ইয়ায তাঁর “আশশিফা” নামক কিতাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি ছালাত পাঠ প্রসঙ্গে অধ্যায় রচনা করেছেন এবং এর ভিতর ছাহাবা ও তাবিঈগণের এক গোষ্ঠী থেকে মারফুভাবে (সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে) হাদীছ সংকলন করেছেন। উক্ত হাদীছের কোনটিতেই ছাহাবা ও অন্যান্য কারো থেকেই ‘সাইয়িদিনা’ বা আমাদের সরদার শব্দ পাওয়া যায় না।
উপরোক্ত শব্দাবলীর অনুরূপ কিছু আলী (রাযিঃ)-এর হাদীছে আছে। তিনি লোকদেরকে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এ প্রতি ছালাতের পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন এই বলেঃ
اللهم داحي المدحوات وباري المسموكات اجعل سوابق صلواتك ونوامي بركاتك وزائد تحيتك على محمد عبدك ورسولك الفاتح لما أغلق
হে আল্লাহ! সমস্ত বস্তুর প্রশস্তদানকারী, উঁচু বস্তুসমূহের সৃষ্টিকর্তা তোমার সম্মান ও রহমতের অগ্রাংশ, ক্রমবর্ধমান বরকত, বাড়তি সংবর্ধনা ও অভ্যর্থনা মুহাম্মাদের প্রতি দান কর যিনি তোমার বান্দা ও রাসূল- যা কিছু রুদ্ধ ছিল তিনি তার উন্মোচনকারী।
আলী (রাযিঃ) থেকে আরো এসেছে তিনি বলতেনঃ
صلوات الله البر الرحيم والملائكة المقربين والنبيين والصديقين والشهداء والصالحين وما سبح لك من شيء يا رب العالمين على محمد بن عبد الله خاتم النبيين وإمام المتقين. . الحديث
সদাচার পরায়ন অতি দয়ালু আল্লাহর রহমত ও সম্মান, নৈকট্যশীল ফেরেশতামণ্ডলী, নাবীকুল, অধিক সত্যবাদী, শহীদগণ, সৎকর্মশীল বান্দাগণ ও যা কিছু আপনার পবিত্ৰতা জ্ঞাপন করে তাদের সকলের পক্ষ থেকে উচ্ছসিত ছালাত বর্ষণ কর সর্বশেষ নাবী ও আল্লাহভীরু (মুত্তাকী) বান্দাগণের নেতা মুহাম্মদ বিন আব্দুল্লাহর প্রতি- হে সমগ্র জগতের পালনকর্তা ... হাদীছের শেষ পর্যন্ত।
আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলতেনঃ
اللهم اجعل صلواتك وبركاتك ورحمتك على محمد عبدك ورسولك إمام الخير ورسول الرحمة. . . الحديث
হে আল্লাহ! তোমার সম্মান, বরকত ও রহমত দান কর তোমার বান্দা ও রাসূল মুহাম্মাদের প্রতি যিনি রহমতের রাসূল এবং কল্যাণের নেতা, হাদীছের শেষ পর্যন্ত ..। হাসান বাছারী থেকে বর্ণিত; তিনি বলতেনঃ যে ব্যক্তি মুছতফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাউযে কাউছারে তুষ্টিপ্ৰদ সুধার গ্লাস পান করতে চায় সে যেন বলেঃ
اللهم صل على محمد وعلى آله وأصحابه وأزواجه وأولاده وذريته وأهل بيته وأصهاره وأنصاره وأشياعه ومحبيه
হে আল্লাহ! তুমি ছালাত প্ৰদান কর মুহাম্মাদের প্রতি এবং তার বংশধর, সহচরবৃন্দ, পত্নীকুল, পুত্র-পুত্রী, সন্তান-সন্ততি, বাটিস্থ পরিবার পরিজন, আত্মীয়স্বজন, সাহায্যকারী, স্বদলীয় ও মুহাব্বাতকারীদের প্রতি।
এগুলো হলো ছাহাবা ও তৎপরবর্তীগণ থেকে বর্ণিত, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ছালাত পাঠের বিভিন্ন রূপ সংক্রান্ত শব্দাবলী যা আমি “আশশিফা” নামক গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করছি যার- ভিতর উক্ত শব্দ সাইয়েদ নেই।
হ্যাঁ। তবে ইবনু মাসউদ থেকে বর্ণিত একটি হাদীছে এসেছে যে, তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ছালাত পাঠ করতেন এ ভাষায়ঃ
اللهم اجعل فضائل صلواتك ورحمتك وبركاتك على سيد المرسلين. . .
হে আল্লাহ! তোমার বাড়তি সম্মান-প্রতিপত্তি, রহমত ও বরকতসমূহ দান কর নাবীকুলের সরদারের প্রতি ... হাদীছের শেষ পর্যন্ত। হাদীছটি ইবনু মাজাহ বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এর সনদ দুর্বল।
পূর্বোল্লিখিত আলী (রাযিঃ)-এর হাদীছটি তবারানী বর্ণনা করেছেন যার সনদে কোন অসুবিধা নেই। তাতে কিছু অপরিচিত শব্দ এসেছে যার ব্যাখ্যা সহ বর্ণনা করেছি। আবুল হাসান ইবনুল ফারিস প্রণীত “ফাযলুন্নানাবী” নামক গ্রন্থে।
শাফিঈগণ উল্লেখ করেছেন যে, কোন ব্যক্তি যদি এই শপথ করে যে, আমি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সর্বোত্তম ছালাত পাঠ করবো তাহলে তার মুক্ত হওয়ার পথ হলো নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি এই ছালাত পাঠ করাঃ
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ
হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ছালাত (সম্মান প্রতিপত্তি) দান কর যখনই স্মরণকারীরা তাকে স্মরণ করে এবং যখনই উদাসীনারা তাঁর স্মরণ থেকে উদাসীন থাকে। ইমাম নববী বলেন, দৃঢ়তার সাথে যে শব্দে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি ছালাত পাঠকে সঠিক বলা যায় তা হচ্ছে
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ، كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ
হে আল্লাহ! মুহাম্মাদের প্রতি ও তাঁর বংশধরের প্রতি ছালাত প্ৰদান কর যেমনভাবে ইবরাহীমের প্রতি ছালাত প্ৰদান করেছেন ... হাদীছের শেষ পর্যন্ত।
পরবর্তীদের একটি দল তাঁর বিরূপ মন্তব্য করেছে এই বলে যে, সংকলনগত দিক দিয়ে উক্ত পদ্ধতিদ্বয়ের ভিতর উত্তম হওয়ার প্রতি নির্দেশকারী কিছু নেই। তবে অর্থগত দিক দিয়ে প্রথম পদ্ধতির উত্তম হওয়াটা পরিস্ফুটিত।
মাসআলাটি ফিকহের কিতাবাদির ভিতর একটি প্রসিদ্ধ মাসআলাহ। মুখ্য উদ্দেশ্য এই যে, যে সকল ফিকহবিদগণ এই মাসআলাটি উল্লেখ করেছেন তাদের একজনেরও বক্তব্যে (সাইয়িদিনা) শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায় না। যদি এ বর্ধিত শব্দ পছন্দনীয় হতো তাহলে সেটা তাদের সকলের নিকটে গোপন থাকতো না এবং তারা বেখেয়ালও হতেন না। যাবতীয় কল্যাণ রয়েছে ইত্তিবা তথা দলীল ভিত্তিক অনুসরণের ভিতর (এটাই আমাদের কথা)। আল্লাহই সৰ্বজ্ঞ।
আমি বলেছি হাফিয ইবনু হাজার (রহঃ) যে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সরদার গুণে গুণান্বিত করা শরীয়ত সম্মত না হওয়ার মতালম্বী হয়েছেন তা মহান নির্দেশের অনুসরণার্থে, এ মতের উপরে রয়েছে (প্রকৃত) হানাফীগণ। আর এমতই অবলম্বন করা উচিত। কারণ এটাই হচ্ছে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মুহাব্বাত করার সত্যিকার প্রমাণ।
قُلْ إِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ
বলুন হে রাসূল! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবেসে থাক তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন- (আলে ইমরান ৩১)।
এজন্যেই ইমাম নববী “আররাওযাহ” গ্রন্থে (১/২৬৫) বলেছেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি সবচেয়ে পরিপূর্ণ ছালাত পাঠ এই (اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ) হে আল্লাহ! মুহাম্মাদের প্রতি ছালাত প্ৰদান করুন।
পূর্বোক্ত তৃতীয় প্রকার ছালাত অনুযায়ী, তাতে ‘সাইয়িদ’ বা সরদার শব্দের উল্লেখ নেই।