আগের অধ্যায়সমূহে আমি বিনয়, নম্রতা ও ভদ্রতার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য কুরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছি। এখানে আমি কিছু উদাহরণ পেশ করার মাধ্যমে একই বিষয়কে কিছুটা বাড়াচ্ছি। মনে করুন, উভয় পাশে দেয়াল দিয়ে ঘেরা অতি সংকীর্ণ এক রাস্তা দিয়ে আপনি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। অত্যন্ত যত্ন, শান্তভাব ও সতর্কতা ছাড়া সেখান দিয়ে গাড়ি পার হয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। যাহোক যদি কোন ড্রাইভার এ রাস্তা দিয়ে খুব জোরে গাড়ি চালিয়ে যেতে চায় তবে সে অনবরত একবার ডান পাশের দেয়ালে আরেকবার বাম পাশের দেয়ালে ধাক্কা খাবে। অবশেষে তার গাড়িকে ভেঙ্গে ফেলবে। সতর্কতার সাথে গাড়ি চালানো এবং খুব জোরে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো এই উভয় ক্ষেত্রেই রাস্তা একটিই এবং গাড়িও একটিই, কিন্তু গাড়ি চালানোর পদ্ধতি ভিন্ন।
আমরা যে ছোট চারাকে যত্ন করি এটাকে বিভিন্নভাবে পানি দেয়া যায়। আপনি যদি এটার উপর আস্তে আস্তে পানি ঢালেন তবে এটা পানি শোষণ করে নিবে এবং পুষ্টি পাবে। কিন্তু আপনি যদি জগের পানি একবারেই ঢেলে দেন তাহলে আপনি এটাকে সমূলে উঠিয়ে ফেলবেন। ব্যবহৃত পানির পরিমাণ একই কিন্তু পদ্ধতি ভিন্ন। কেউ একজন ধীরস্থিরতার সাথে তার পোশাকাদি নাড়াচাড়া করে, সেগুলোকে পরিধান করে ও খোলে, সে এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে যে, তার পোশাকাদি দীর্ঘদিন টিকবে। যে লোক বিপরীতভাবে (অর্থাৎ বেপরোয়াভাবে) তার পোশাকাদিকে ব্যবহার করে সে সর্বদাই (তার পোশাকাদি) ছিড়া ফাটার অভিযোগ করে (অর্থাৎ তার পোশাক ঘনঘন ছিড়ে ফেটে যায়)। আমাদের প্রয়োজন আমাদের জীবনে ও আমাদের নিজেদের সাথে বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, ধীরস্থিরতা ও শান্তভাব প্রতিষ্ঠা করা।
وَإِنَّ لنَفْسِكَ عَلَيْكَ حَقًّا
অর্থাৎ “তোমার উপর তোমার আত্মার অবশ্যই অধিকার আছে।”
(অর্থাৎ অভদ্র, উত্তেজিত, অস্থির ও ব্যস্ত হয়ে নিজের আত্মাকে কষ্ট দেয়া যাবে না বরং ভদ্রতা, শান্তভাব, সৌম্যতা, স্থিরতা, বিনয়, নম্রতা ও ধীর-স্থিরতার সাথে কাজ-কারবার ও আচার আচরণ করে নিজের আত্মাকে শান্তি দিতে হবে। -অনুবাদক) আপনাদের ভাইদের সাথে এবং স্ত্রীগণের সাথেও (এক কথায় সকলের সাথেই -অনুবাদক) ভদ্রতা, নম্রতা ও বিনয়ের সাথে আচরণ করতে হবে।
তুর্কীরা বিভিন্ন নদীর উপর দিয়ে অনেক কাঠের পুল (সেতু) নির্মাণ করেছিল। এগুলোর উভয় পাশে তারা (ফলকে) খোদাই করে লিখে রাখত “ধীরে চলুন” যে ব্যক্তি ধীরে ধীরে পুল বা সেতু পার হয় সে ঐ ব্যক্তির মতো পড়ে যায় না যে নাকি দ্রুতবেগে পার হয়।
কিছু কিছু ফুলবাগানের প্রবেশ পথে (গেইটে) লিখা থাকে “শান্ত থাকুন (বা ধীরে চলুন)।” যে ব্যক্তি বাগানের ভিতর দিয়ে বেপরোয়াভাবে দৌড়ায় সে অনেক ফুল দেখতে পারবে না- শুধুমাত্র এ-ই নয়, বরং সে ফুলের ব্যাপক ধ্বংস সাধন করবে।
প্রবাদ আছে যে, “চড়ুই পাখি মৌমাছির মতো উদার ও অমায়িক নয়।”
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
المؤمن كالنحلة تأكل طيبا وتضع طيبا واذا وقعت على عود لم تكسره
“মু’মিন ব্যক্তি মৌমাছির মতো, যা পবিত্র তা সে খায়। সে পবিত্র জিনিস উৎপন্ন করে এবং যে ছোট্ট ডালখানিতে সে বসে ওটাকে সে নষ্ট করে না।”
ফুলের উপর বসে যখন মৌমাছি মধু খায় ফুল তখন মৌমাছির উপস্থিতি টের পায় না। এভাবে শান্তভাবের মাধ্যমে সে তার লক্ষ্য অর্জন করে। পক্ষান্তরে, চড়ুই পাখি যখন কোন কিছুর উপর বসে তখন এটা (কিচির-মিচির ও লাফালাফি করে) মানুষের নিকট এর উপস্থিতির ঘোষণা দেয়।
আমাদের একজন ধৰ্মিক পূর্বসূরী বলেছেন- “ধর্ম সম্বন্ধে কারো জ্ঞান উপলব্ধির প্রমাণ হলো- যদি সে বিনয়ের সাথে প্রবেশ করে, বিনয়ের সাথে বাহির হয়। বিনয়ের সাথে পোশাক পরিধান করে ও জুতা খোলে এবং বাহনে চড়ে।”
আপনি যখন ব্যস্ত ও বেখাপ্পা হবেন তখন সাধারণত আপনি ক্ষতিই করবেন; কেননা, ধীরস্থিরতা ও অমায়িকতার মাঝেই কল্যাণ নিহিত।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَا كَانَ الرِّفْقُ فِي شَيْءٍ إِلَّا زَانَهُ وَلَا نُزِعَ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا شَانَهُ
ভাবাৰ্থঃ “যতক্ষণ পর্যন্ত কোন কিছুতে বিনয়, নম্রতা, কোমলতা, ধীরতা, উদারতা, অমায়িকাতা ও ভদ্রতা থাকে ততক্ষণ সেটা সুন্দর আর যখন ওসবগুণ তা থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয় তখন তা দোষী।”
যার বিনয়, নম্রতা, ভদ্রতা, কোমলতা, উদারতা ইতাদি গুণ আছে তার প্রতি মানুষের অন্তর আকৃষ্ট থাকে।
“কেননা, আপনি আল্লাহর রহমতে তাদের প্রতি সদয় আচরণ করেছিলেন, আর যদি আপনি কর্কশ ও কঠোর হৃদয়ের অধিকারী হতেন তবে তারা আপনার চারপাশ থেকে সরে পড়ত।” (৩-সূরা আলে ইমরাঃ আয়াত-১৫৯)