যে যে পরিমাণ আল্লাহর জিকির করে ও তার কিতাব কুরআন তিলাওয়াত করে সে সে পরিমাণ সুখী হবে। এ মূলনীতিকে ভেবে দেখার পরই কেউ এ দুনিয়াতে ও আখেরাতে তার মূল্য নির্ধারণ করতে পারে।
“যদি না (কুফুরিতে) মানুষদের একমত হওয়ার আশংকা থাকত তবে যারা পরম করুণাময়কে অস্বীকার করে তাদের ঘর-বাড়ির জন্য আমি রূপার ছাদ ও যার ওপরে চড়ে তার ওপরে উঠে সেই সিড়ি বানিয়ে দিতাম। এবং তাদের বাড়ি-ঘরের জন্য দরজা ও যাতে তারা হেলান দেয় সেই পালঙ্ক বানিয়ে দিতাম। এবং স্বর্ণ নির্মিত নানান সৌন্দর্যের উপকরণ ও অলংকারও বানিয়ে দিতাম। আর এসব কিছু তো দুনিয়ার ভোগের সামগ্ৰী মাত্র। অথচ আপনার প্রভুর নিকট রয়েছে মুত্তাকীদের জন্য আখেরাতের (অতি উত্তম) মহাপুরস্কার।” (৪৩-সূরা আয যুখরুফঃ আয়াত-৩৩-৩৫)
এসব আয়াত পরিষ্কারভাবে পর্থিব পদমর্যাদার ও সামাজিক মানের ক্ষণস্থায়ী (এবং সে কারণেই তুচ্ছ) মূল্যের ঘোষণা দেয়।
যখন আমরা দেখি যে কাফেরর প্রায়ই সমৃদ্ধ জীবন যাপন করে পক্ষান্তরে মু’মিনরা প্রায়ই পার্থিব আমোদ-নিষিদ্ধ জীবন যাপন করে তখন আমাদের একথা বুঝা উচিত নয় যে, এ জীবনই সফলতার মাপকাঠি। পার্থিব আমোদ তো এমন লক্ষণ যা কেবলমাত্র এ পৃথিবীর তুচ্ছ মূল্যেরই ইঙ্গিত করে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই-এর প্রসিদ্ধ সাহাবী উতবা ইবনে গাজওয়ান (রাঃ) এক জুমুআর দিন খুতবা দানকালে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে অতীতের দিনগুলি কী অবস্থায় কেটেছে তার স্মৃতিচারণ করে জোরে জোরে (উচ্চস্বরে) বলছিলেন, তিনি বলছিলেন কিভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করতেন, কিভাবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ক্ষুধার তাড়নায় খাদ্যের অভাবে গাছের পাতা খেয়েছেন। তবুও ঐ সাহাবী (রাঃ) সে সব দিনকে তার জীবনের সর্বাপেক্ষা সুখের দিন বলে ঘোষণা দিলেন। তারপর তিনি বর্ণনা দিলেন কিভাবে তিনি (রাঃ) একটি অঞ্চলের শাসক হয়ে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর থেকে বিদায় নিলেন। এবং পার্থিব অবস্থার (মানের) উন্নতি সত্ত্বেও তিনি (রাঃ) আশ্চর্যবোধ করলেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালের পর জীবনের সত্যিকার গুণ কতটা নিচে এসে গেছে!
সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) যখন কুফার গভর্নর ছিলেন তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইন্তেকালে তিনি পাগলপারা হয়ে গেলেন। তিনিও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনকালে (তার সাথে খাদ্যের অভাবে) গাছের পাতা ও মৃত পশুর চামড়া খেয়েছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহচর্যে থাকাকালে তার পুরাতন বাড়ির স্বাদ উপভোগ করার পর তিনি তার নতুন জীবনের প্রাসাদকে সহ্য করতে পারলেন না।
وَلَلْآخِرَةُ خَيْرٌ لَّكَ مِنَ الْأُولَىٰ
“এবং নিশ্চয় আখেরাত তোমার জন্য দুনিয়ার তুলনায় শ্রেষ্ঠ।” (৯৩-সূরা আদ দোহাঃ আয়াত-৪)
অতএব, আপনাকে সঠিক পথে পরিচালিত করার একটি গোপন রহস্য আছে- আর তাহলে এ পৃথিবীর তুচ্ছতা জানা। “তারা কি মনে করে যে আমি যে তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি বাড়াচ্ছি তাতে তাদের কল্যাণের ব্যাপারে ত্বরান্বিত করছি? তা নয়, বরং তারা তা বুঝে না।” (২৩-সূরা আল মু'মিনূনঃ আয়াত-৫৫-৫৬)
উমর (রাঃ) যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘরে প্রবেশ করলেন তখন তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পার্শ্ব দেশে খেজুরের চাটাইয়ের দাগ দেখতে পেলেন, যা চাটাইয়ে শোয়ার ফলে সৃষ্ট হয়েছে এবং তিনি ঘরের দৈন্যদশাও দেখলেন। এ হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু দরদর করে গড়িয়ে পড়তে লাগল। সকলের আদর্শ ও নেতা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন অবস্থায়!
“আর তারা বলে এ রাসূলের কী হলো যে সে আমাদের মতো বা মানুষের মত খায়-দায় ও বাজারে চলা-ফিরা করে।” (২৫-সূরা ফুরকানঃ আয়াত-৭)
উমর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তো জানেন যে খসরু ও জার কিভাবে জীবন যাপন করে!
(আপনি তো সেভাবে জাকজমকভাবে জীবন যাপন করতে পারেন। -অনুবাদক)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তর দিলেন-
أفي شكٍّ أنت يا ابن الخطَّاب اما ترضى ان تكون لنا الاخرة ولهم الدنيا
“হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি সন্দেহে ভুগছ? আমাদের জন্য আখেরাত আর তাদের জন্য দুনিয়া এতে কি তুমি সন্তুষ্ট নও?”
এটা হলো ন্যায়সঙ্গত ভারসাম্যতা ও সুন্দর বণ্টন। অতএব, তারা যদি ডলার, টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, দালান-কোঠা ও গাড়ি-ঘোড়ায় সুখ খুঁজে পায় তবে পাক। আল্লাহর কসম নিশ্চয় তারা কখনও সেসব জিনিসের মাঝে তা খুঁজে পাবে না।
“যারা দুনিয়ার জীবন ও তার সৌন্দর্য চায় আমি সেখানে তাদেরকে তাদের পুণ্যকর্মফল দিই আর সেখানে তাদেরকে কম দেয়া হয় না। তাদের জন্যই পরকালে (আখেরাতে) দোযখ ছাড়া অন্য কিছু নেই এবং সেখানে (দুনিয়াতে) তারা যা করেছে তা আখেরাতে বৃথা যাবে ও তারা যা (দুনিয়াতে) করত তা আখেরাতে বাতিল হয়ে যাবে।” (১১-সূরা হুদঃ আয়াত-১৫-১৬)