আপনি যখন অত্যাচারের শিকার হন তখন আপনার জীবনে অবশ্যই তাওহীদের সুফল দেখা দেয়। একথা মনে রাখবেন যে, অন্যেরা যখন আপনাকে আঘাত করে তখন আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আপনাকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করবে।
১. আল্লাহর প্রতি আপনার পাকা ঈমান থাকলে আপনার প্রতি যে ব্যক্তি জুলুম করেছে আপনি তাকে ক্ষমা করে দিবেন। এর চেয়ে আরো ভালো তার জন্য শুভ কামনা করা। শুধুমাত্র ক্ষমা করে দেয়া বা শুধুমাত্র শুভ কামনা করার চেয়েও আরো ভালো, উচ্চতম ও সর্বোত্তম স্তর হলো তার কোন উপকার করা বা তাকে কোনভাবে সাহায্য করা। ক্ষমার প্রথম পর্যায় হলো স্বীয় ক্রোধ দমন করা, এর অর্থ হলো আপনি আঘাতের বদলে আঘাত দিচ্ছেন না। তারপর আসছে সত্যিকার ক্ষমা- যার অর্থ হলো ক্ষমা করা, কোনরূপ অশুভ ইচ্ছা বা কামনা পরিত্যাগ করা। এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে আসছে কল্যাণ করা তথা আপনার যে ক্ষতি করা হয়েছে কোন ভালো কাজের মাধ্যমে বা (অত্যাচারীকে) দয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে তার ক্ষতি পূরণ করা।
এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللَّهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ
“যারা ক্রোধ দমন করে এবং অন্যদেরকে ক্ষমা করে; আল্লাহ সৎকর্মশীলদেরকে ভালোবাসেন।” (৩-সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত-১৩৪)
“আর যে নাকি ক্ষমা করে দেয় এবং আপোস মীমাংসা করে তার পুরস্কার আল্লাহর নিকটই আছে।” (৪২-সূরা আশ শুরাঃ আয়াত-৪০)
“তারা যেন (তাদেরকে) ক্ষমা করে ও (তাদের) দোষ উপেক্ষা করে।” (২৪-সূরা আন নূরঃ আয়াত-২২)
বর্ণিত আছে যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
ان الله امرني ان اصل من وان اعفوا عمن ظلمنى وان اعطى من حرمنى
“যে ব্যক্তি আমার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করেছে তার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক করতে, যে আমার সাথে অন্যায় আচরণ করেছে তাকে ক্ষমা করে দিতে এবং যে আমাকে বঞ্চিত করেছে তাকে দান করতে আল্লাহ অবশ্যই আমাকে আদেশ করেছেন।”
২. তকদীরের প্রতি আপনার ঈমান পাকা হবে। অন্য কথায় আপনি বুঝতে পারবেন যে, যে ব্যক্তি আপনার সাথে অন্যায় আচরণ করেছে সে তা আল্লাহর পূর্ব নির্ধারণী ও বিধান অনুসারেই করেছে।
মানুষ তো উপায় মাত্র, কিন্তু যিনি বিধান করেন ও সিদ্ধান্ত নেন তিনি হলেন আল্লাহ। সুতরাং আপনার ইচ্ছাকে তার সমীপে সমর্পণ করুন।
৩. আপনি বুঝতে পারবেন যে, আপনার যে ক্ষতি হয়েছে তাতে আপনার পাপ ক্ষমা হয়েছে এবং এর ফলে আল্লাহর দরবারে আপনার মর্যাদা বৃদ্ধি পেতে পারে।
এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
فَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَأُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِمْ وَأُوذُوا فِي سَبِيلِي وَقَاتَلُوا وَقُتِلُوا لَأُكَفِّرَنَّ عَنْهُمْ سَيِّئَاتِهِمْ
অতএব যারা হিজরত করেছে এবং নিজেদের ঘর-বাড়ি হতে বিতাড়িত হয়েছে ও আমার পথে নির্যাতিত হয়েছে এবং যুদ্ধ করেছে ও নিহত হয়েছে আমি অবশ্যই তাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিব।” (৩-সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত-১৯৫)
মু’মিনগণ একথা বুঝতে পারে যে, জীবনে শক্রতার আগুন নিভানো এক বুদ্ধিমত্তার কাজ।
কুরআনের ভাষায়-
ادْفَعْ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ فَإِذَا الَّذِي بَيْنَكَ وَبَيْنَهُ عَدَاوَةٌ كَأَنَّهُ وَلِيٌّ حَمِيمٌ
উত্তম জিনিস দ্বারা মন্দকে দূর কর, যাতে তোমার মাঝে ও যে তোমার সাথে শক্রতা করে তার মাঝে এমন সম্পর্ক হয়ে যায় যেন সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু।” (৪১-সূরা হা-মীম-আস-সাজদাহঃ আয়াত-৩৪) অর্থাৎ আল্লাহ মু’মিনদেরকে ক্রোধের সময় ধৈর্য ধরতে এবং যারা তাদের সাথে মন্দ আচরণ করেছে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার আদেশ দিয়েছেন।
“যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্যান্য মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে সেই প্রকৃত মুসলমান।”
পূর্বোক্ত আয়াতের অর্থ হলো, যে ব্যক্তি আপনার ক্ষতি করে বিনিময়ে আপনার উচিত তার সাথে হাসি মুখে সাক্ষাৎ করা ও কোমল কথা বলা। এভাবে আপনি তার অন্তর থেকে ঘৃণার আগুন নিভিয়ে দিতে পারবেন।
কুরআনের ভাষায়-
“আমার বান্দাদেরকে যা উত্তম তা বলতে বলুন, নিশ্চয় শয়তান তাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে।” (১৭-সূরা বনী ইসরাঈলঃ আয়াত-৫৩)
৪. আপনি আপনার ক্রটি-বিচ্যুতি সম্বন্ধে জানতে পারবেন। অন্য কথায় আপনি একথা বুঝতে পারবেন যে, আপনার পাপের কারণেই একজন লোক আপনার ক্ষতি করার সুযোগ গ্রহণ করতে পেরেছে।
“কি ব্যাপার! যখন তোমাদের নিকট একটি বিপদ আসল তখন তোমরা বললে, “এটা কোথা হতে আসল? অথচ পূর্বে তোমরা (তোমাদের শক্রদের) দ্বিগুণ বিপদ ঘটিয়ে ছিলে।” আপনি (হে মুহাম্মদ!) (তাদেরকে) বলে দিন যে, এটা (তোমাদের পাপের কারণে) তোমাদের নিজেদের থেকেই এসেছে।” (৩-সূরা আলে ইমরানঃ আয়াত-১৬৫)
“আর তোমাদের যে বিপদাপদ ঘটে তা তোমাদের নিজ কৃত কর্মের ফলেই ঘটে।” (৪২-সূরা আশ শূরাঃ আয়াত-৩০)
৫. আপনি যখন অত্যাচারিত হন তখন আপনাকে অত্যাচারী না বানিয়ে অত্যাচারিত বানানোর কারণে আল্লাহর প্রশংসা করুন ও তার শোকরিয়া আদায় করুন। আমাদের কতিপয় ধাৰ্মিক পূর্বসূরী বলতেন
اللهم اجعلني مظلوما لا ظالماً
“হে আল্লাহ! আমাকে অত্যাচারী না বানিয়ে বরং অত্যাচারিত বানান।”
আদম (আঃ)-এর দু'ছেলের একজন অপরজনকে যা বলেছিল একথা সে কথার মতো। (আর তা হলো)
لَئِن بَسَطتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللَّهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ
যদি তুমি আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াও তবে আমি তোমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হাত বাড়াবো না; নিশ্চয় আমি সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করি। (৫-সূরা মায়িদাঃ আয়াত ২৮)
৬. যে আপনাকে আঘাত করেছে তার প্রতি আপনার করুনা প্রদর্শন করা উচিত। সে আপনার অনুকম্পা ও করুণার পাত্র। মন্দ কাজে তার গোঁ ও মুসলমানকে আঘাত না করার জন্য আল্লাহর যে আদেশ তা প্রকাশ্যে অমান্য করার কারণে সে আপনার কোমলাচরণ ও অনুকম্পার পাত্র। সম্ভবত আপনি (এরূপ আচরণ করে) তাকে পতন বা ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে পারবেন। (আর তাকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করাই তার প্রতি প্রকৃত অনুকম্পা প্রদর্শন। -অনুবাদক)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “অত্যাচারী বা অত্যাচারিত যাই হোক না কেন তোমার ভাইকে সাহায্য কর।” (অত্যাচারিতকে সাহায্য করার অর্থ আশা করি সকলেই বুঝি । কিন্তু অত্যাচারীকে সাহায্য করার অর্থ হলো সদাচারণের মাধ্যমে তাকে অত্যাচার করা থেকে বিরত রাখা ও ফলে তাকে আল্লাহর গযব ও ধ্বংস থেকে বাচতে সাহায্য করা। -অনুবাদক)
যখন মিসত্বাহ আবু বকর (রাঃ)-এর মেয়ে আয়েশা (রাঃ)-এর সম্মানে কলঙ্ক আরোপ করেছিল তখন আবু বকর (রাঃ) মিসত্বাহকে আর কোনরূপ সাহায্য না করার অঙ্গীকার করেছিলেন। মিসত্বাহ গরীব থাকার কারণে আবু বকর (রাঃ) তার জন্য খরচ করতেন ও তাকে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তৎক্ষণাৎ নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল করলেন-
وَلَا يَأْتَلِ أُولُو الْفَضْلِ مِنكُمْ وَالسَّعَةِ أَن يُؤْتُوا أُولِي الْقُرْبَىٰ وَالْمَسَاكِينَ وَالْمُهَاجِرِينَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَلْيَعْفُوا وَلْيَصْفَحُوا أَلَا تُحِبُّونَ أَن يَغْفِرَ اللَّهُ لَكُمْ
তোমাদের মধ্যে যারা অনুগ্রহ ধন্য ও অবস্থা সম্পন্ন তারা যেন নিকটাত্মীয় দরীদ্রদেরকে ও আল্লাহর রাস্তায় হিযরতকারীদেরকে দান ও সাহায্য সহযোগিতা না করার শপথ না করে। তারা যেন (তাদেরকে) ক্ষমা করে দেয় ও (তাদের সাথে) আপোষ-মিমাংসা করে নেয়। তোমরা কি এটা ভালোবাসনা যে আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন?” (২৪-সূরা আন নূরঃ আয়াত-২২)
আবু বকর (রাঃ) বললেনঃ হ্যাঁ, আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করে দিবেন- এটাই আমি ভালোবাসি। এরপর তিনি মিসত্বাহের জন্য খরচ করা শুরু করে দিলেন এবং তিনি তাকে ক্ষমাও করে দিলেন।
উয়াইনাহ ইবনে হিস্ন উমরকে (রাঃ) বলেছিল, “হে উমর! একি ব্যাপার! আল্লাহর কসম, তুমি আমাদেরকে উদারভাবে দিচ্ছ না ও তুমি আমাদের মাঝে ন্যায়সঙ্গতভাবে ফয়সালা করছ না।”
একথা শুনে উমর (রাঃ) তার প্রতি রুষ্ট হয়ে তাকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত নিলেন (তার দিকে তেড়ে গেলেন), এমন সময় হুর্র ইবনে কায়স বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন, আল্লাহ বলেন-
“ক্ষমা প্রদর্শন কর, সৎকাজের আদেশ দাও এবং অজ্ঞদেরকে এড়িয়ে চল (অর্থাৎ তাদের শাস্তি দিওনা)” (৭-সূরা আল আ'রাফঃ আয়াত-১৯৯)
পরবর্তীতে হুর্র ইবনে কায়স বলেছেন- “আল্লাহর কসম, উমর (রাঃ) এ আয়াত অমান্য করেনি এবং সর্বদাই (আল্লাহর সীমলঙ্ঘন করা থেকে) বিরত থেকেছেন ও আল্লাহর কিতাবে যা আছে তার অনুসরণ করেছেন।
নবী ইউসুফ (আঃ) তার ভাইদেরকে বলেছিলেন- “আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই; আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।” (১২-সূরা ইউসুফঃ আয়াত-৯২)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বিজয়ী বেশে মক্কাতে ফিরে এলেন তখন তিনি কুরাইশ গোত্রের কাফেরদের সেসব মুখ দেখতে পেলেন যারা তাকে আঘাত দিয়েছিল, তাকে স্বীয় মাতৃভূমি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল এবং তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিল। (কিন্তু তিনি তাদের প্রতিশোধ গ্রহণ না করে বরং) তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বললেনঃ যাও। কেননা, তোমরা স্বাধীন।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “কুস্তিতে বিজয়ী ব্যক্তি শক্তিশালী নয় বরং যে ব্যক্তি ক্রোধের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ (আত্মসংবরণ) করতে পারে সেই শক্তিশালী।”
এক আরব কবি বলেছেন- “যদি তুমি প্রিয়জনদের সঙ্গে থাক তবে তাদের সাথে আত্মীয়ের মতো কোমল আচরণ করিও।”
আর কারো সকল ভুল-ত্রুটি ধরিও না, যদি ধর তবে তুমি বন্ধুহীন জীবন কাটাবে।” কেউ কেউ বলেছেন যে ইঞ্জীল শরীফে লিখা আছে—
اغفر لمن اخطا عليك مرة سبع مرات
“Forgive seven times the one, who wronged you once.”
“যে তোমার সাথে একবার অন্যায় আচরণ করেছে তাকে সাতবার ক্ষমা কর।” অর্থাৎ যে তোমার সাথে একবার অন্যায় আচরণ করেছে, তুমি ধর্ম রক্ষার্থে ও তোমার আত্মাকে নির্মল রাখতে তাকে সাতবার ক্ষমা করে দাও। প্রতিশোধ গ্রহণেচ্ছা শুধুমাত্র মনের শক্তি, নিদ্রা, মনের স্থিরতা ও শান্তিই দূর করতে পারে, কিন্তু অন্যের কোন কিছু ছিনিয়ে নিতে পারে না।
“কিন্তু যে ব্যক্তি ক্ষমা করে ও আপোষ মীমাংসা করে আল্লাহর নিকট তার পুরস্কার রয়েছে।” (৪২-সূরা আশ শুরাঃ আয়াত-৪০)
ভারতীয় প্রবাদে আছে— “যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সে ঐ ব্যক্তির চেয়েও অধিক বীর যে নাকি একটি নগরকে জয় করে।”
“অবশ্যই মানব মন মন্দকৰ্ম (বা অপরাধ) প্রবণ।” (১২-সূরা ইউসুফঃ আয়াত-৫৩)