যিলহজ মাসের প্রথম দশদিন অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ। ইবন আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْ أَيَّامٍ الْعَمَلُ الصَّالِحُ فِيهَا أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ. يَعْنِى أَيَّامَ الْعَشْرِ. قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ وَلاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ قَالَ وَلاَ الْجِهَادُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ إِلاَّ رَجُلٌ خَرَجَ بِنَفْسِهِ وَمَالِهِ فَلَمْ يَرْجِعْ مِنْ ذَلِكَ بِشَىْءٍ»
‘এমন কোন দিন নেই যার আমল যিলহজ মাসের এই দশ দিনের আমল থেকে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর পথে জিহাদও নয়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে যে ব্যক্তি তার জান-মাল নিয়ে আল্লাহর পথে যুদ্ধে বের হল এবং এর কোন কিছু নিয়েই ফেরত এলো না (তার কথা ভিন্ন)।’[1]
আবদুল্লাহ ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْ أَيَّامٍ أَعْظَمُ عِنْدَ اللَّهِ وَلا الْعَمَلُ فِيهِنَّ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنْ هَذِهِ الأَيَّامِ، فَأَكْثِرُوا فِيهَا مِنَ التَّهْلِيلِ، وَالتكبير والتَّحْمِيدِ، يَعْنِي: أَيَّامَ الْعَشْرِ.»
‘এ দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তাই তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ), তাকবীর (আল্লাহু আকবার) ও তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি বেশি করে পড়।’[2]
অন্য বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْ أَيَّامٍ أَفْضَلُ عِنْدَ اللَّهِ مِنْ أَيَّامِ عَشَرِ ذِي الْحِجَّةِ قَالُوا: يَا رَسُولَ اللَّهِ، وَلا مِثْلُهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ؟ قَالَ: إِلا مَنْ عَفَّرَ وَجْهَهُ فِي التُّرَابِ.»
‘যিলহজের (প্রথম) দশদিনের মতো আল্লাহর কাছে উত্তম কোন দিন নেই। সাহাবীরা বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আল্লাহর পথে জিহাদেও কি এর চেয়ে উত্তম দিন নেই? তিনি বললেন, হ্যা, কেবল সে-ই যে (জিহাদে) তার চেহারাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে।’[3]
এ হাদীসগুলোর মর্ম হল, বছরে যতগুলো মর্যাদাপূর্ণ দিন আছে তার মধ্যে এ দশ দিনের প্রতিটি দিনই সর্বোত্তম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনসমূহে নেক আমল করার জন্য তাঁর উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন। তাঁর এ উৎসাহ প্রদান এ সময়টার ফযীলত প্রমাণ করে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দিনগুলোতে বেশি বেশি করে তাহলীল ও তাকবীর পাঠ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন ওপরে ইবন আব্বাস রা.-এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।
যিলহজ মাসের প্রথম দশকে রয়েছে আরাফা ও কুরবানীর দিন। আর এ দুটো দিনেরই রয়েছে অনেক মর্যাদা। যিলহজ মাসের প্রথম দশকের দিনগুলো মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার আরেকটি কারণ এ দিনগুলোয় সালাত, সিয়াম, সদাকা, হজ ও কুরবানীর মত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতগুলো একত্রিত হয়েছে যার অন্য কোন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায় না।[4]
যিলহজের প্রথম দশকে নেক আমলের ফযীলত
ইবন রজব রহ. বলেন, উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে বুঝা যায়, নেক আমলের মৌসুম হিসেবে যিলহজ মাসের প্রথম দশক হল সর্বোত্তম, এ দিবসগুলোয় সম্পাদিত নেক আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। হাদীসের কোন কোন বর্ণনায় أَحَبُّ (‘আহাববু’ তথা সর্বাধিক প্রিয়) শব্দ এসেছে আবার কোন কোন বর্ণনায় أَفْضَلُ (‘আফযালু’ তথা সর্বোত্তম) শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
অতএব এ সময়ে নেক আমল করা বছরের অন্য যে কোন সময়ে নেক আমল করার থেকে বেশি মর্যাদা ও ফযীলতপূর্ণ।
যিলহজের প্রথম দশকে যেসব আমল করা যেতে পারে
১. খাঁটি তওবা করা
তওবার অর্থ প্রত্যাবর্তন করা বা ফিরে আসা। যে সব কথা ও কাজ আল্লাহ রাববুল আলামীন অপছন্দ করেন তা বর্জন করে যেসব কথা ও কাজ তিনি পছন্দ করেন তার দিকে ফিরে আসা। সাথে সাথে অতীতে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হওয়ার কারণে অন্তর থেকে অনুতাপ ও অনুশোচনা ব্যক্ত করা।
২. হজ ও উমরা পালন করা
হজ ও উমরা পালনের ফযীলত বিষয়ে পূর্বে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
৩. সিয়াম পালন করা ও বেশি বেশি নেক আমল করা
নেক আমলের সময়ই আল্লাহ রাববুল আলামীনের কাছে প্রিয়। তবে এই বরকতময় দিনগুলোতে নেক আমলের মর্যাদা ও সওয়াব অনেক বেশি। যারা এ দিনগুলোতে হজ আদায়ের সুযোগ পেয়েছেন তারা যে অনেক ভাগ্যবান তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাদের উচিত হবে যিলহজ মাসের এই মুবারক দিনগুলোতে যত বেশি সম্ভব সিয়াম পালন করা এবং নেক আমল করা।
৪. কুরআন তিলাওয়াত ও যিকর-আযকারে নিমগ্ন থাকা
এ দিনগুলোয় যিকর-আযকারের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছেু, হাদীসে এসেছে :
আবদুল্লাহ ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এ দশ দিনে নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহ রাববুল আলামীনের কাছে প্রিয় ও মহান কোন আমল নেই। তোমরা এ সময়ে তাহলীল (লাইলাহা ইল্লাল্লাহ) তাকবীর (আল্লাহু আকবার) তাহমীদ (আল-হামদুলিল্লাহ) বেশি করে আদায় কর।’[5] এছাড়া কুরআন তেলাওয়াত যেহেতু সর্বোত্তম যিকর তাই বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত।
৫. উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করা
এ দিনগুলোতে আল্লাহ রাববুল আলামীনের মহত্ত্ব ঘোষণার উদ্দেশ্যে তাকবীর পাঠ করা সুন্নত। এ তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে মসজিদে, বাড়ি-ঘরে, রাস্তা-ঘাট, বাজারসহ সর্বত্র উচ্চ আওয়াজে পাঠ করা বাঞ্ছনীয়। তবে মহিলাদের তাকবীর হবে নিম্ন স্বরে। তাকবীরের শব্দগুলো নিম্নরূপ :
اَللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أكْبَرُ، لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، وَاللهُ أَكْبَرُ، اَللهُ أَكْبَرُ وَلِله الحَمْدُ.
(আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হাম্দ)
তাকবীর বর্তমানে হয়ে পড়েছে একটি পরিত্যাক্ত ও বিলুপ্তপ্রায় সুন্নত। আমাদের সকলের কর্তব্য এ সুন্নতের পুনর্জীবনের লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত ব্যাপক প্রচারণা চালানো। হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে,
مَنْ أَحْيَا سُنَّةً مِنْ سُنَّتِيْ، قَدْ أُمِيْتَتْ بَعْدِيْ، فَإِنَّ لَهُ مِنَ الأَجْرِ مِثْلَ مَا عَمِلَ بِهَا، مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَيْئاً
‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নতসমূহ থেকে একটি সুন্নত পুনর্জীবিত করল, যা আমার পর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে, তাকে সে পরিমাণ সওয়াব দেয়া হবে, যে পরিমাণ তার ওপর (সে সুন্নতের ওপর) আমল করা হয়েছে। এতে (আমলকারীদের) সওয়াব হতে বিন্দুমাত্র কমানো হবে না।’[6]
যিলহজ মাসের সূচনা হতে আইয়ামে তাশরীক শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ তাকবীর পাঠ করা সকলের জন্য ব্যাপকভাবে মুস্তাহাব। তবে বিশেষভাবে আরাফা দিবসের ফজরের পর থেকে মিনার দিনগুলোর শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ যেদিন মিনায় পাথর নিক্ষেপ শেষ করবে সেদিন আসর পর্যন্ত প্রত্যেক সালাতের পর উক্ত তাকবীর পাঠ করার জন্য বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে। আবদুল্লাহ বিন মাসঊদ ও আলী রা. হতে এ মতটি বর্ণিত। ইবন তাইমিয়া রহ. একে সবচেয়ে বিশুদ্ধ মত বলেছেন। উল্লেখ্য, যদি কোন ব্যক্তি ইহরাম বাঁধে, তবে সে তালবিয়ার সাথে মাঝে মাঝে তকবীরও পাঠ করবে। হাদীস দ্বারা এ বিষয়টি প্রমাণিত।[7]
[2]. মুসনাদ আহমদ : ২/৭৫।
[3]. সহীহুত-তারগীব ওয়াত-তারহীব : ২/১৫।
[4]. দুরূসু আশরি যিলহজ্জ : ২২-২৩।
[5]. মুসনাদ আহমদ : ২/৭৫।
[6]. তিরমিযী : ৬৭৭।
[7]. ইবন তাইমিয়া, মজমু‘ ফাতাওয়া : ২৪/২২০।
দো‘আ বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদাপূর্ণ একটি আমল। আল্লাহর মুখাপেক্ষিতা ও অনুনয়-বিনয় প্রকাশের মাধ্যম হলো দো‘আ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আকেই সর্বোচ্চ ইবাদত হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলেন,
«الدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ»
‘দো‘আই ইবাদত।’[1] তিনি আরো বলেন,
«لَيْسَ شَيْء أَكرَمَ عَلى الله سُبْحَانَه ِمنَ الدعَاء.»
‘দো‘আর চেয়ে অধিক প্রিয় আল্লাহর কাছে অন্য কিছু নেই।’[2] আবূ সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَدْعُو، لَيْسَ بِإِثْمٍ وَلاَ بِقَطِيعَةِ رَحِمٍ ، إِلاَّ أَعْطَاهُ إِحْدَى ثَلاَثٍ : إِمَّا أَنْ يُعَجِّلَ لَهُ دَعْوَتَهُ، وَإِمَّا أَنْ يَدَّخِرَهَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ ، وَإِمَّا أَنْ يَدْفَعَ عَنْهُ مِنَ السُّوءِ مِثْلَهَا ، قَالَ : إِذًا نُكْثِرُ ، قَالَ : اللَّهُ أَكْثَرُ».
‘একজন মুসলমান যখন কোনো দো‘আ করে, আর সে দো‘আয় গুনাহের বিষয় থাকে না এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার কথাও থাকে না, তখন আল্লাহ তাকে তিনটি বিষয়ের একটি দিয়েই থাকেন : হয়তো তার দো‘আর ফলাফল তাকে দুনিয়াতে নগদ দিয়ে দেন। অথবা সেটা তার জন্য আখিরাতে জমা করে রাখেন। নতুবা দো‘আর সমপরিমাণ গুনাহ তার থেকে দূর করে দেন।’ সাহাবী বললেন, তাহলে আমরা বেশি বেশি দো‘আ করব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহও বেশি বেশি দেবেন।’[3]
হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দো‘আর ছিল নিবিড় সম্পর্ক। তিনি তাওয়াফের সময় তাঁর রবের নিকট দো‘আ করেছেন।[4] সাফা ও মারওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে দো‘আ করেছেন; আরাফায় উটের ওপর বসে হাত সিনা পর্যন্ত উঠিয়ে মিসকীন যেভাবে খাবার চায় সেভাবে দীর্ঘ দো‘আ ও কান্নাকাটি করেছেন; আরাফার যে জায়গায় তিনি অবস্থান করেছেন সেখানে স্থির হয়ে সূর্য হেলে গেলে সালাত আদায় করার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দো‘আ করেছেন। মুযদালিফার মাশ‘আরুল হারামে ফজরের সালাতের পর আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ আকুতি-মিনতি ও মুনাজাতে রত থেকেছেন।[5] তাশরীকের দিনগুলোতে প্রথম দুই জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপের পর দাঁড়িয়ে হাত উঠিয়ে দীর্ঘক্ষণ দো‘আ করেছেন।[6]
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন,
فَقَدْ تَضَمّنَتْ حَجّتُهُ صلى الله عليه وسلم سِتّ وَقَفَاتٍ لِلدّعَاءِ. الْمَوْقِفُ الْأَوّلُ عَلَى الصّفَا ، وَالثّانِي : عَلَى الْمَرْوَةِ ، وَالثّالِثُ بِعَرَفَةَ ، وَالرّابِعُ بِمُزْدَلِفَةَ ، وَالْخَامِسُ عِنْدَ الْجَمْرَةِ الْأُولَى ، وَالسّادِسُ عِنْدَ الْجَمْرَةِ الثّانِيَةِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর হজ ছিল ছয়টি স্থানে বিশেষভাবে দো‘আয় পূর্ণ। প্রথম সাফায়, দ্বিতীয় মারওয়ায়, তৃতীয় আরাফায়, চতুর্থ মুযদালিফায়, পঞ্চম প্রথম জামরায় এবং ষষ্ঠ দ্বিতীয় জামরায়।’[7]
এ হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত দো‘আর আংশিক বর্ণনামাত্র। অথচ তিনি মদীনা থেকে বের হওয়ার সময় থেকে সেখানে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত কখনো আল্লাহর প্রশংসা ও যিকর থেকে বিরত থাকেননি। এ সময়ে তাঁর যবান ছিল আল্লাহর যিকিরে সদা সিক্ত। আল্লাহর মর্যাদার উপযোগী প্রশংসা তিনি বেশি বেশি করে করেছেন। যেমন- তালবিয়ায়, তাকবীরে, তাহলীলে, তাসবীহ ও আল্লাহর হামদ বর্ণনায়; কখনো বসে, কখনো দাঁড়িয়ে, আবার কখনো চলন্ত অবস্থায়, তথা সর্বক্ষেত্রে তিনি আল্লাহর প্রশংসা বর্ণনায় লিপ্ত থেকেছেন। হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিভিন্ন অবস্থা পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টিই আমাদের কাছে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হবে।
উল্লেখ্য, হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দো‘আ ও তাঁর প্রভুর প্রশংসার যতটুকু বর্ণনা পাওয়া যায় তা অবর্ণিত অংশের তুলনায় অতি সামান্য। কেননা দো‘আ হলো বান্দা ও তাঁর প্রভুর মাঝে এক গোপন রহস্য। প্রত্যেক ব্যক্তি সংগোপনে তার প্রভুর সামনে যা কিছু তার প্রয়োজন সে বিষয়ে নিবিড় আকুতি ও মুনাজাত পেশ করে। রাসূলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অংশটুকু প্রকাশ করেছেন তা ছিল কেবল উম্মতের জন্য আদর্শ প্রতিষ্ঠার খাতিরে যাতে তারা তাঁর অনুসরণ করতে পারে।
দো‘আ ও যিকর হজের উদ্দেশ্য ও বড় মকসূদসমূহের অন্যতম। নিম্নে বর্ণিত আয়াতে একথারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় :
﴿فَإِذَا قَضَيۡتُم مَّنَٰسِكَكُمۡ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَذِكۡرِكُمۡ ءَابَآءَكُمۡ أَوۡ أَشَدَّ ذِكۡرٗاۗ﴾ [البقرة: ٢٠٠]
‘তারপর যখন তোমরা তোমাদের হজের কাজসমূহ শেষ করবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ কর, যেভাবে তোমরা স্মরণ করতে তোমাদের বাপ-দাদাদেরকে, এমনকি তার চেয়ে অধিক স্মরণ।’[8]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ لِّيَشۡهَدُواْ مَنَٰفِعَ لَهُمۡ وَيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ ﴾ [الحج: ٢٨]
‘যাতে তারা তাদের পক্ষে কল্যাণকর বিষয়ের স্পর্শে আসতে পারে এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।’[9] শুধু তাই নয় বরং হজের সকল আমল আল্লাহর যিকরের উদ্দেশ্যেই বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّمَا جُعِلَ الطَّوَافُ بِالْبَيْتِ وَبَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ وَرَمْىُ الْجِمَارِ لإِقَامَةِ ذِكْرِ اللَّهِ».
‘বাইতুল্লাহ্র তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার সা‘ঈ এবং কঙ্কর নিক্ষেপ আল্লাহর যিকর কায়েমের লক্ষ্যেই বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।’[10]
এজন্য সে ব্যক্তিই সফল, যে এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এবং বেশি বেশি দো‘আ-যিকর ও কান্নাকাটি করে; আল্লাহর সামনে নিজের মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করে; প্রয়োজন তুলে ধরে; স্বীয় মাওলার জন্য নত হয় এবং নিজকে হীন করে উপস্থিত করে। সচেতন হৃদয়ে একাগ্র চিত্তে ব্যাপক অর্থবোধক দো‘আর মাধ্যমে তাঁর কাছে প্রার্থনা করে।
দো‘আর আদব :
দো‘আর বেশ কিছু আদব রয়েছে, যেগুলো অনুসরণ করলে দো‘আ কবুলের আশা করা যায়। নিম্নে দো‘আর কয়েকটি আদব উল্লেখ করা হল : কবুল কবুল
১. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার কাছে দো‘আ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ ﴾ [غافر: ٦٠]
‘তোমরা আমার কাছে দো‘আ কর, আমি তোমাদের দো‘আয় সাড়া দেব।[11]
২. উযু অবস্থায় দো‘আ করা। যেহেতু দো‘আ একটি ইবাদত তাই উযু অবস্থায় করাই উত্তম।
হাতের তালু চেহারার দিকে ফিরিয়ে দো‘আ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا سَأَلْتُمُ اللهَ فَاسْأَلُوهُ بِبُطُونِ أَكُفِّكُمْ وَلاَ تَسْأَلُوهُ بِظُهُورِهَا».
‘তোমরা যখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে তখন হাতের তালু দিয়ে প্রার্থনা করবে। হাতের পিঠ দিয়ে নয়।[12] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে,
«كَانَ إِذَا دَعا جَعَلَ بَاطنَ كَفِّهِ إِلَى وَجْهِهِ».
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আ করার সময় হাতের তালু তাঁর চেহারার দিকে রাখতেন।’[13] এটিই প্রয়োজন ও বিনয় প্রকাশের সর্বোত্তম পন্থা, যাতে একজন অভাবী কিছু পাবার আশায় দাতার দিকে বিনয়াবনত হয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়।
৩. হাত তোলা। প্রয়োজনে এতটুকু উঁচুতে তোলা যাতে বগলের নিচ দেখা যায়। রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْ عَبْدٍ يَرْفَعُ يَدَيْهِ يَسْأَلُ اللهَ مَسْأَلَةً إِلاَّ أتَاهَا إِيَّاهُ».
‘যে ব্যক্তি তার উভয় হাত উঠায় এবং আল্লাহর কাছে কোন কিছু চায়, আল্লাহ তাকে তা দিয়েই দেন।’[14]
৪. আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর ওপর সালাত ও সালাম পাঠ করা।
ফুযালা ইবন উবায়েদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের মধ্যে এক ব্যক্তিকে এভাবে দো‘আ করতে শুনলেন যে, সে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করল না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর সালাত ও সালাম পাঠ করল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, ‘এ লোকটি তাড়াহুড়া করল।’ এরপর তিনি বললেন,
«إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ فَلْيَبْدَأْ بِتَحْمِيدِ رَبِّهِ جَلَّ وَعَزَّ وَالثَّنَاءِ عَلَيْهِ ثُمَّ يُصَلِّى عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ يَدْعُو بَعْدُ بِمَا شَاءَ»
‘তোমাদের কেউ যখন দো‘আ করবে, তখন সে যেন প্রথমে তার রবের প্রশংসা করে এবং তার স্তুতি জ্ঞাপন করে। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর সালাত ও সালাম পাঠ করে। অতঃপর যা ইচ্ছে প্রার্থনা করে।’[15] অন্য হাদীসে এসেছে,
«كُلُّ دُعاءٍ مَحْجُوبٌ حَتَّى يُصَلَّى عَلَى النَّبِيِّ».
‘প্রত্যেক দো‘আ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি সালাত না পড়া পর্যন্ত বাধাপ্রাপ্ত অবস্থায় থাকে।’[16]
নিজের জন্য ও নিজের আপনজনদের জন্য কল্যাণের দো‘আ করা, মন্দ বা অকল্যাণের দো‘আ না করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ يَزَالُ يُسْتَجَابُ لِلْعَبْدِ مَا لَمْ يَدْعُ بِإِثْمٍ أَوْ قَطِيعَةِ رَحِمٍ».
‘বান্দার দো‘আ কবুল হয়, যতক্ষণ না সে কোনো পাপ কাজের বা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার দো‘আ করে।’[17] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
«لاَ تَدْعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ وَلاَ تَدْعُوا عَلَى أَوْلاَدِكُمْ وَلاَ تَدْعُوا عَلَى أَمْوَالِكُمْ».
‘তোমরা তোমাদের নিজদের, তোমাদের সন্তান-সন্তুতির এবং তোমাদের সম্পদের ব্যাপারে বদদো‘আ করো না।’[18]
৫. দো‘আ কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর কাছে দো‘আ করা।
«اُدْعُوا اللهَ وَأَنْتُمْ مُوقِنُونَ بِالإِجَابَةِ، وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ لا يَسْتَجِيبُ دُعَاءً مِنْ قَلْبٍ غَافِلٍ لاهٍ».
‘কবুল হবার দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে তোমরা আল্লাহর কাছে দো‘আ কর। জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ গাফেল ও উদাসীন হৃদয় থেকে বের হওয়া দো‘আ কবুল করেন না।’[19]
দো‘আর সময় সীমা লঙ্ঘন না করা। সা‘দ রা. বলেন, হে বৎস! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি :
«سَيَكُونُ قَوْمٌ يَعْتَدُونَ فِى الدُّعَاءِ».
‘অচিরেই এমন এক সম্প্রদায় আসবে যারা দো‘আয় সীমা-লঙ্ঘন করবে।’[20]
আর সে সীমালঙ্ঘন হচ্ছে, এমন কিছু চাওয়া যা হওয়া অসম্ভব। যেমন, নবী বা ফেরেশতা হবার দো‘আ করা। অথবা জান্নাতের কোন সুনির্দিষ্ট অংশ লাভের জন্য দো‘আ করা।
৬. বিনয় প্রকাশ ও কাকুতি-মিনতি করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَٱذۡكُر رَّبَّكَ فِي نَفۡسِكَ تَضَرُّعٗا وَخِيفَةٗ وَدُونَ ٱلۡجَهۡرِ مِنَ ٱلۡقَوۡلِ بِٱلۡغُدُوِّ وَٱلۡأٓصَالِ ﴾ [الاعراف: ٢٠٥]
‘আর তুমি নিজ মনে আপন রবকে স্মরণ কর সকাল-সন্ধ্যায় অনুনয়-বিনয় ও ভীতি সহকারে এবং অনুচ্চ স্বরে।’[21]
৭. ব্যাপক অর্থবোধক ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেছেন তা জামে‘ তথা পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপক। এক বর্ণনায় এসেছে,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَسْتَحِبُّ الْجَوَامِعَ مِنَ الدُّعَاءِ وَيَدَعُ مَا سِوَى ذَلِكَ.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যাপক অর্থবোধক দো‘আ পছন্দ করতেন এবং অন্যগুলো ত্যাগ করতেন।’[22]
৮. আল্লাহ তা‘আলার সুন্দর নামসমূহ ও তাঁর সুমহান গুণাবলির উসীলা দিয়ে দো‘আ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ ﴾ [الاعراف: ١٨٠]
‘আল্লাহর রয়েছে সুন্দর নামসমূহ, সেগুলোর মাধ্যমে তোমরা তাঁর নিকট দো‘আ কর।’[23]
৯. ঈমান ও আমলে সালেহ তথা নেক কাজের উসীলা দিয়ে দো‘আ করা।
ক. ঈমানের উসীলা দিয়ে দো‘আ করার উদাহরণ কুরআনুল কারীমে উল্লিখিত হয়েছে,
﴿ رَّبَّنَآ إِنَّنَا سَمِعۡنَا مُنَادِيٗا يُنَادِي لِلۡإِيمَٰنِ أَنۡ ءَامِنُواْ بِرَبِّكُمۡ فََٔامَنَّاۚ رَبَّنَا فَٱغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرۡ عَنَّا سَئَِّاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ ٱلۡأَبۡرَارِ ١٩٣ ﴾ [ال عمران: ١٩٣]
‘হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমরা শুনেছিলাম একজন আহবানকারীকে, যে ঈমানের দিকে আহবান করে যে, ‘তোমরা তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আন’। তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করুন এবং বিদূরিত করুন আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি, আর আমাদেরকে মৃত্যু দিন নেককারদের সাথে।’[24]
খ. আমলে সালেহ তথা নেক কাজের উসীলা দিয়ে দো‘আ করার উদাহরণ হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে,
‘তিন ব্যক্তি যাত্রাপথে রাত যাপনের জন্য একটি গুহায় আশ্রয় নেয়। হঠাৎ পাহাড় থেকে একটি পাথর খসে পড়ে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এমন অসহায় অবস্থায় তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ নেক আমলের উসীলা দিয়ে দো‘আ করে। একজন বৃদ্ধ পিতা-মাতার খেদমত, অপরজন অবৈধ যৌনাচার থেকে নিজকে রক্ষা এবং তৃতীয়জন আমানতের যথাযথ হেফাযতের উসীলা দিয়ে পাথরের এই মহা বিপদ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করলেন। তাদের দো‘আর ফলে পাথর সরে গেল। তারা সকলেই নিরাপদে গুহা থেকে বের হয়ে এলেন।’[25]
১০. নিজের গুনাহের কথা স্বীকার করে দো‘আ করা। উদাহরণস্বরূপ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মাছের পেটে থাকাবস্থায় ইউনুস আলাইহিস সালাম যে দো‘আর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে ডেকেছিলেন (অর্থাৎ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِين লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায যালিমীন। ‘আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র মহান। নিশ্চয় আমি ছিলাম যালিম।’) যেকোনো মুসলমান ব্যক্তি তা দিয়ে দো‘আ করলে আল্লাহ তা‘আলা তার দো‘আ কবুল করে নেবেন।’[26]
১১. উচ্চ স্বরে দো‘আ না করা; অনুচ্চ স্বরে দো‘আ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ٱدۡعُواْ رَبَّكُمۡ تَضَرُّعٗا وَخُفۡيَةًۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُعۡتَدِينَ ٥٥ ﴾ [الاعراف: ٥٥]
‘তোমরা তোমাদের রবকে ডাক অনুনয় বিনয় করে ও চুপিসারে। নিশ্চয় তিনি পছন্দ করেন না সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে।’[27] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«يَا أَيُّهَا النَّاسُ ، ارْبَعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ ، فَإِنَّكُمْ لاَ تَدْعُونَ أَصَمَّ وَلاَ غَائِبًا ، إِنَّهُ مَعَكُمْ ، إِنَّهُ سَمِيعٌ قَرِيبٌ».
‘হে লোক সকল, তোমরা নিজদের প্রতি সদয় হও এবং নিচু স্বরে দো‘আ করো। কারণ তোমরা বধির বা অনুপস্থিত কাউকে ডাকছো না। নিশ্চয় তিনি (তাঁর জ্ঞান) তোমাদের সাথেই আছেন। তিনি অতিশয় শ্রবণকারী, নিকটবর্তী।’[28]
১২. আল্লাহর কাছে বারবার চাওয়া। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই করতেন। ইবন মাসঊদ রা. বলেন,
كَانَ رسول الله صلى الله عليه وسلم يُعْجِبُهُ أَنْ يَدْعُوَ ثَلَاثًا، وَيَسْتَغْفِرَ ثَلَاثًا.
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আর বাক্যগুলো তিনবার করে বলতে এবং তিনি তিনবার করে ইস্তেগফার করতে পছন্দ করতেন।’[29]
১৩. কিবলামুখী হয়ে দো‘আ করা। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
اسْتَقْبَلَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم الْكَعْبَةَ فَدَعَا عَلَى نَفَرٍ مِنْ قُرَيْشٍ ، عَلَى شَيْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ ، وَعُتْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ وَالْوَلِيدِ بْنِ عُتْبَةَ ، وَأَبِى جَهْلِ بْنِ هِشَامٍ . فَأَشْهَدُ بِاللَّهِ لَقَدْ رَأَيْتُهُمْ صَرْعَى ، قَدْ غَيَّرَتْهُمُ الشَّمْسُ ، وَكَانَ يَوْمًا حَارًّا .
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বামুখী হলেন। অতপর কুরাইশদের কয়েকজনের জন্য বদ-দো‘আ করলেন, তারা হল, শাইবা ইবন রবী‘আ, উতবা ইবন রবী‘আ, ওয়ালীদ ইবন উতবা এবং আবূ জাহল ইবন হিশাম। আল্লাহর কসম, আমি তাদেরকে মৃত অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখলাম। রোদ তাদেরকে বদলে দিয়েছিল। তখন ছিল গরমের দিন।’[30]
[2]. সহীহ ইবনে হিববান : ৮৭০।
[3]. আল-আদাবুল মুফরাদ : ৭১০।
[4]. আবূ দাউদ : ১৮৯২।
[5]. মুসলিম : ১২১৮।
[6]. বুখারী : ১৭৫১।
[7]. যাদুল মা‘আদ : ২/২৬৩।
[8]. বাকরা : ২০০।
[9]. হজ : ২৮।
[10]. আবূ দাউদ : ১৮৯০।
[11]. গাফির : ৬০।
[12]. আবূ দাউদ : ১৪৮৬।
[13]. তাবারানী : ১১/১২২-৩৪।
[14]. তিরমিযী : ৩৬০৩।
[15]. আবূ দাউদ : ১৪৮৩।
[16]. দায়লামী : ৩/৪৭৯১; সহীহুল জামে’ : ৪৫২৩।
[17]. মুসলিম : ৭১১২।
[18]. মুসলিম : ৩০০৯।
[19]. তিরমিযী : ৩৪৭৯।
[20]. আহমদ : ১/১৭২।
[21]. আ‘রাফ : ২০৫।
[22]. আবূ দাউদ : ১৪৮২।
[23]. আ‘রাফ : ১৮০।
[24]. আলে-ইমরান : ১৯৩।
[25]. বুখারী : ২১১১।
[26]. তিরমিযী : ৫০৫৩; মুস্তাদরাক হাকেম : ৪৪৪৩।
[27]. আ‘রাফ : ৫৫।
[28]. বুখারী : ৯২২৯; মুসলিম : ২৭০৪।
[29]. মুসনাদ আহমদ : ১/৩৯৪।
[30]. বুখারী : ৩৯৬০; মুসলিম : ১৭৯৪।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনাকারীর কিছু কিছু অন্যায় ও ত্রুটি এমন রয়েছে, যার ফলে তার দো‘আ কবুল করা হয় না। যেমন,
১. পানীয় হারাম, খাদ্যবস্তু হারাম অথবা পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম হলে। অর্থাৎ প্রার্থনাকারী যদি তার খাদ্য ও পান সামগ্রী এবং পোশাক-আশাক হারাম উপার্জন দিয়ে ক্রয় করে থাকে, তাহলে তার দো‘আ কবুল হবে না।
আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হে লোক সকল, নিশ্চয়ই আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র বিষয়ই গ্রহণ করেন। আল্লাহ তা‘আলা রাসূলগণকে যে নির্দেশ প্রদান করেছেন, মুমিনদেরকেও সে নির্দেশই প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلرُّسُلُ كُلُواْ مِنَ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَٱعۡمَلُواْ صَٰلِحًاۖ إِنِّي بِمَا تَعۡمَلُونَ عَلِيمٞ ٥١ ﴾ [المؤمنون: ٥١]
‘হে রাসূলগণ, তোমরা পবিত্র ও ভাল বস্তু থেকে খাও এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে সর্ম্পকে আমি সম্যক জ্ঞাত।’[1] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُلُواْ مِن طَيِّبَٰتِ مَا رَزَقۡنَٰكُمۡ وَٱشۡكُرُواْ لِلَّهِ إِن كُنتُمۡ إِيَّاهُ تَعۡبُدُونَ ١٧٢ ﴾ [البقرة: ١٧٢]
‘হে মুমিনগণ, আহার কর আমি তোমাদেরকে যে হালাল রিযক দিয়েছি তা থেকে।’[2] এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে ব্যক্তির কথা উল্লেখ করলেন, যে দীর্ঘ সফরে উস্কোখুস্কো ও ধূলিমলিন অবস্থায় আকাশের দিকে দু’হাত প্রসারিত করে দো‘আ করে : হে আমার রব! হে আমার রব! অথচ তার পানাহার হারাম, পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম এবং হারাম মাল দিয়েই সে খাবার গ্রহণ করেছে, কীভাবে তার দো‘আ কবুল করা হবে!’[3]
২. দো‘আ কবুল হওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করা।
৩. আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার জন্য দো‘আ করা। আবূ হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَا يَزَالُ يُسْتَجَابُ لِلْعَبْدِ مَا لَمْ يَدْعُ بِإِثْمٍ أَوْ قَطِيعَةِ رَحِمٍ مَا لَمْ يَسْتَعْجِلْ قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا الِاسْتِعْجَالُ قَالَ يَقُولُ قَدْ دَعَوْتُ وَقَدْ دَعَوْتُ فَلَمْ أَرَ يَسْتَجِيبُ لِي فَيَسْتَحْسِرُ عِنْدَ ذَلِكَ وَيَدَعُ الدُّعَاءَ».
‘বান্দার দো‘আ ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল হতে থাকে, যতক্ষণ না সে কোনো গুনাহ বা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার দো‘আ করে অথবা যতক্ষণ না সে তাড়াহুড়া করে। বলা হলো, তাড়াহুড়া কী ইয়া রাসূলাল্লাহ! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, একথা বলা যে, আমি দো‘আ করেছি, কিন্তু কবুল হতে দেখছি না। অতপর আক্ষেপ করতে থাকে এবং দো‘আ করা ছেড়ে দেয়।’[4]
[2]. বাকারা : ১৭২।
[3]. মুসলিম : ১৫১০।
[4]. বুখারী : ৪০৬৩; মুসলিম : ৩৫২৭।
১. আযানের সময় এবং আল্লাহর পথে যুদ্ধে একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ثِنْتَانِ لاَتُرَدَّانِ أَوْ قَلَّمَا تُرَدَّانِ الدُّعَاءُ عِنْدَ النِّدَاءِ وَعِنْدَ الْبَأسِ حِيْنَ يُلْحِمُ بَعْضُهُمْ بَعْضًا».
‘দু’টি সময়ের দো‘আ প্রত্যাখ্যাত হয় না বা খুব কমই প্রত্যাখ্যাত হয় : আযানের সময়ের দো‘আ এবং যুদ্ধের সময় যখন একে অপরকে আঘাত করতে থাকে।’[1]
২. আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَلاَ إِنَّ الدُّعَاءَ لاَ يُرَدُّ بَيْنَ الأَذَانِ وَالإِقَامَةِ فَادْعُوا».
‘জেনে রাখো, আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়ের দো‘আ ফিরিয়ে দেয়া হয় না। অতএব তোমরা দো‘আ কর।’[2]
৩. সিজদারত অবস্থায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ سَاجِدٌ فَأَكْثِرُوا الدُّعَاءَ».
‘বান্দা তার প্রতিপালকের সবচে’ বেশি নিকটবর্তী হয় সিজদারত অবস্থায়। সুতরাং তোমরা অধিক পরিমাণে দো‘আ কর।’[3]
৪. জুমার দিনের শেষ সময়ে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«يَوْمُ الْجُمُعَةِ ثِنْتَا عَشْرَةَ يُرِيدُ سَاعَةً لاَ يُوجَدُ مُسْلِمٌ يَسْأَلُ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ شَيْئًا إِلاَّ آتَاهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فَالْتَمِسُوهَا آخِرَ سَاعَةٍ بَعْدَ الْعَصْرِ».
‘জুমআর দিনের সময়গুলো বারটি ভাগে বিভক্ত। তন্মধ্যে একটি সময় এমন যে, ঐ সময়ে কোন মুসলিম আল্লাহ তা‘আলার কাছে যা চায়, আল্লাহ তা‘আলা তাকে তা দিয়েই দেন। অতএব তোমরা আসরের পরের শেষ সময়ে তা তালাশ কর।’[4]
৫. রাতের শেষভাগে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«يَنْزِلُ رَبُّنَا كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى سَمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرِ فَيَقُولُ مَنْ يَدْعُونِى فَأَسْتَجِيبَ لَهُ مَنْ يَسْأَلُنِى فَأُعْطِيَهُ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِى فَأَغْفِرَ لَهُ».
‘আমাদের রব প্রতি রাতে যখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে তখন দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। এরপর বলতে থাকেন, কেউ কি আমার নিকট দো‘আ করবে, আমি তার দো‘আ কবুল করব? কেউ কি আমার কাছে চাইবে, আমি তাকে তা দান করবো? কেউ কি আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করবো?’[5]
৬. সিয়াম পালনকারী, মুসাফির, মাযলুম, সন্তানের জন্য পিতার দো‘আ এবং সন্তানের জন্য পিতার বদদো‘আ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«ثَلاَثُ دَعَوَاتٍ مُسْتَجَابَاتٌ لاَ شَكَّ فِيهِنَّ دَعْوَةُ الْوَالِدِ وَدَعْوَةُ الْمُسَافِرِ وَدَعْوَةُ الْمَظْلُومِ».
‘তিনটি দো‘আ এমন যে, তা কবুল হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই : সন্তানের জন্য পিতার দো‘আ; মুসাফির ব্যক্তির দো‘আ এবং মাযলুমের দো‘আ।[6] অন্য বর্ণনায় রয়েছে,ِ ‘সিয়াম পালনকারীর দো‘আ।’[7] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মু‘আয রা. কে ইয়ামানের উদ্দেশ্যে প্রেরণের সময় বলেছিলেন,
«اتَّقِ دَعْوَةَ الْمَظْلُومِ فَإِنَّهَا لَيْسَ بَيْنَهَا وَبَيْنَ اللهِ حِجَابٌ».
‘মাযলুমের (বদ) দো‘আ থেকে বেঁচে থাক। কারণ মাযলুমের দো‘আ এবং আললাহর মাঝে কোনো অন্তরায় নেই।’[8]
৭. অসহায় ও বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির দো‘আ। আল্লাহ তা‘আলা অসহায় ও বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির দো‘আ কবুল করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ أَمَّن يُجِيبُ ٱلۡمُضۡطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكۡشِفُ ٱلسُّوٓءَ ﴾ [النمل: ٦٢]
‘বরং তিনি, যিনি নিরুপায়ের আহবানে সাড়া দেন এবং বিপদ দূরীভূত করেন।’[9]
৮. আরাফার দিবসের দো‘আ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«خَيْرُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ وَخَيْرُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّونَ مِنْ قَبْلِى. لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِير»
‘উত্তম দো‘আ হচ্ছে আরাফার দিনের দো‘আ, আর সেই বাক্য যা আমি ও আমার পূর্ববতী নবীগণ বলেছি, (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়াহুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদীর।) ‘আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই, রাজত্ব ও সমস্ত প্রশংসা তাঁর জন্য। তিনি সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।’[10]
৯. হজ ও উমরাকারী এবং আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় জিহাদকারির দো‘আ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«الْغَازِي فِي سَبِيلِ اللهِ ، وَالْحَاجُّ وَالْمُعْتَمِرُ ، وَفْدُ اللهِ ، دَعَاهُمْ ، فَأَجَابُوهُ ، وَسَأَلُوهُ ، فَأَعْطَاهُمْ».
‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী, হজ ও উমরাকারী আল্লাহর দূত। তিনি তাদেরকে ডেকেছেন, তারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছে। তারা তাঁর কাছে প্রার্থনা করেছে, তাই তিনি তাদেরকে তা দান করেছেন।’[11]
[2]. আহমদ : ২১২২১; তিরমিযী : ২১২।
[3]. মুসলিম : ২৮৪।
[4]. আবূ দাউদ : ৪৮১০; নাসাঈ : ৯০১৩।
[5]. মুসলিম : ৭৫৭।
[6]. আল-আদাবুল মুফরিদ : ৩২; আবূ দাউদ : ৩৬১৫।
[7]. আবূ দাউদ : ৩৬১৫; তিরমিযী : ৫০১৯।
[8]. বুখারী : ৪৮২৪।
[9]. নামল : ২৬।
[10]. তিরমিযী : ৩৫৭৫।
[11]. তিরমিযী : ৩৫৮৫।
‘মাবরূর অর্থ মকবুল। মাবরূর হজ অর্থ মকবুল হজ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وَالْحَجُّ الْمَبْرُورُ لَيْسَ لَهُ جَزَاءٌ إِلاَّ الْجَنَّةُ».
‘আর মাবরূর হজের প্রতিদান জান্নাত ভিন্ন অন্য কিছু নয়।’[1] তাই আমাদের হজ মাবরূর বা মকবুল হওয়ার জন্য নিম্নের বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখা উচিত।
বৈধ উপার্জন
হজের সফর দো‘আ কবুলের সফর। তারপরও যদি হারাম মাল দিয়ে তা করে তবে তা কবুল না হওয়ার বিষয়টি এসেই যায়। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,
«أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ طَيِّبٌ لَا يَقْبَلُ إِلَّا طَيِّبًا، وَإِنَّ اللهَ أَمَرَ الْمُؤْمِنِينَ بِمَا أَمَرَ بِهِ الْمُرْسَلِينَ، فَقَالَ: (يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا، إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ) [المؤمنون: 51] وَقَالَ: (يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُلُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا رَزَقْنَاكُمْ) [البقرة: 172] ثُمَّ ذَكَرَ الرَّجُلَ يُطِيلُ السَّفَرَ أَشْعَثَ أَغْبَرَ، يَمُدُّ يَدَيْهِ إِلَى السَّمَاءِ، يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ، وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ، فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لِذَلِكَ؟»
‘হে মানুষগণ, নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র বস্তু ছাড়া আর কিছু গ্রহণ করেন না। আর আল্লাহ মুমিনদেরকে সেই কাজের নির্দেশ দিয়েছেন, যার নির্দেশ পয়গম্বরদেরকে দিয়েছেন। সুতরাং মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তু হতে আহার কর এবং সৎকর্ম কর।’ (সূরা মু’মিনূন ৫১ আয়াত) তিনি আরও বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুযী দিয়েছি তা থেকে পবিত্র বস্তু আহার কর এবং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; যদি তোমরা শুধু তাঁরই উপাসনা করে থাক।’’ (সূরা বাকারাহ ১৭২ আয়াত)
অতঃপর তিনি সেই লোকের কথা উল্লেখ করে বললেন, যে এলোমেলো চুলে, ধূলামলিন পায়ে সুদীর্ঘ সফরে থেকে আকাশ পানে দু’ হাত তুলে ‘ইয়া রবব্! ‘ইয়া রবব্!’ বলে দো‘আ করে। অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম এবং হারাম বস্তু দিয়েই তার শরীর পুষ্ট হয়েছে। তবে তার দো‘আ কিভাবে কবুল করা হবে?’’ ’[2]
লোক দেখানো কিংবা সুনাম কুড়ানোর মানসিকতা বর্জন
আনাস ইবন মালেক রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«اَللّهُمَّ حَجَّةً لاَ رِيَاءَ فِيْهَا وَلاَ سُمْعَةَ».
‘হে আল্লাহ, এমন হজের তাওফীক দান করুন, যা হবে লোক দেখানো ও সুনাম কুড়ানোর মানসিকতা মুক্ত।’[3]
আহার করানো ও ভালো কথা বলা
জাবের ইবন আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, কোন্ কাজ হজকে মাবরূর করে? তিনি বললেন,
«إِطْعَامُ الطَّعَامِ وَطِيبُ الْكَلاَمِ».
‘আহার করানো এবং ভালো ও সুন্দর কথা বলা।’[4] খাল্লাদ ইবন আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি সাঈদ ইবন যুবাইরকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন্ হাজী উত্তম? তিনি বললেন, যে আহার করায় এবং তার জিহবাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি বলেন, আমাকে ছাওরী বলেছেন, আমরা শুনেছি, এটিই মাবরূর হজ।’[5]
সালাম বিনিময়
জাবের ইবন আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সা. কে জিজ্ঞেস করা হল, কোন্ কাজের দ্বারা হজ মাবরূর হয়? তিনি বললেন,
«إِطْعَامُ الطَّعَامِ، وَإِفْشَاءُ السَّلَامِ».
‘খাবার খাওয়ানো এবং বেশি বেশি সালাম বিনিময়ের দ্বারা।’[6]
তালবিয়া পাঠ ও কুরবানী করা
আবূ বকর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হল, হজে কোন্ কাজে সওয়াব বেশি? তিনি বললেন, الْعَجُّ وَالثَّجُّ ‘উচ্চস্বরে তালবিয়া পড়া এবং জন্তুর রক্ত প্রবাহিত করা।’[7]
সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করা
আবদুল্লাহ ইবন উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘হজের মধ্যে সবচে’ পুণ্যময় কাজ খাবার খাওয়ানো এবং সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণ করা।’[8]
ধৈর্য, তাকওয়া ও সদাচার
ছাওর ইবন ইয়াযীদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘যে এই কা‘বা ঘরের ইচ্ছা করল অথচ তার মধ্যে তিনটি বৈশিষ্ট্য নেই, তার হজ নিরাপদ নয়। ধৈর্য, যা দিয়ে সে তার মূর্খতাকে নিয়ন্ত্রণ করবে; তাকওয়া, যা তাকে আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং সঙ্গী-সাথির সাথে সদাচার।’[9]
দুনিয়ার প্রতি অনাগ্রহ এবং আখিরাতে আগ্রহ
এক ব্যক্তি হাসান বসরীকে বললেন, হে আবূ সাঈদ, মাবরূর হজ কোন্টি? তিনি বললেন, ‘যে হজ দুনিয়ার প্রতি অনাগ্রহী এবং আখিরাতে আগ্রহী বানায়।’[10]
হজের আগের অবস্থা থেকে পরের অবস্থার উন্নতি
একজন হাজী যখন হজের সফরে বের হবেন। পবিত্র ভূমিতে পদার্পণ করবেন। তারপর হজ সম্পন্ন করে নিজ দেশে ফিরে আসবেন, তখন আমরা তাকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারব তার অবস্থার উন্নতি হয়েছ কি-না? যদি অন্যের সাথে আচার-আচরণ, লেনদেন, আমানতদারী, অন্যের হক আদায় এবং ইবাদতের ওপর অবিচলতায় তার অবস্থার উন্নতি হয়, তবে বুঝতে হবে, তার হজ মাবরূর হয়েছে।’
মোটকথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মাবরূর হজের বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। এর কারণ, মাবরূর হজ দুই পন্থায় হয়। এক. মানুষের সাথে সদাচার। দুই. হজের বিধি-বিধান পরিপূর্ণরূপে পালন।
মানুষের সাথে সদাচারের বিষয়টি ব্যাপক। যেমন এর ব্যাপকতা প্রকাশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أَنْ تُعِيْنَ الرَّجُلُ عَلَى دَابَّتِهِ، تَحْمِلُهُ عَلَيْهَا وَتَدُلُّهُ عَلَى الطَّرِيْقِ، كُلُّ ذَلِكَ صَدَقَةٌ»
‘তুমি মানুষকে তার বাহনে চড়তে সাহায্য করবে, তাকে তাতে উঠিয়ে দেবে এবং পথ দেখিয়ে দেবে- এসবই সাদাকা।’[11] ইবন উমর রা. বলতেন,
«البرُّ شيءٌ هيِّنٌ : وجهٌ طليقٌ وكلامٌ ليِّنٌ.
‘নেক কাজ অনেক সহজ : হাস্যোজ্জ্বল চেহারা আর নরম বাক্য।’[12]
হজ মৌসুমে যেহেতু পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বিচিত্র স্বভাব ও বিভিন্ন পরিবেশের লোক সমবেত হয়। তাই কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা এসব বৈচিত্র্য ও ব্যবধান ঘুচিয়ে, সব ধরনের বিবাদ-ঝগড়া এড়িয়ে পরস্পরে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যের চেতনায় একাকার হবার শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ٱلۡحَجُّ أَشۡهُرٞ مَّعۡلُومَٰتٞۚ فَمَن فَرَضَ فِيهِنَّ ٱلۡحَجَّ فَلَا رَفَثَ وَلَا فُسُوقَ وَلَا جِدَالَ فِي ٱلۡحَجِّۗ ﴾ [البقرة: ١٩٧]
‘হজের সময় নির্দিষ্ট মাসসমূহ। অতএব এ মাসসমূহে যে নিজের ওপর হজ আরোপ করে নিল, তার জন্য হজে অশ্লীল ও পাপ কাজ এবং ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়।’[13]
সারকথা, সেটিই মাবরূর হজ, যাতে কল্যাণের পূর্ণ সমাহার ঘটে। পূর্ণ মাত্রায় যাতে আদায় করা হয় হজের সব রুকন, ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব। উপরন্তু তাতে বিরত থাকা হয় সব ধরনের গুনাহ ও পাপাচার থেকে। বস্তুত যে ব্যক্তি সকল ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাবসহ হজ পুরোপুরিভাবে আদায় করবে, অবশ্যই সে এই পুণ্য সফরে পাপাচার থেকে বিরত থাকবে।’
আর একমাত্র জান্নাতই যেহেতু মাবরূর হজের প্রতিদান। তাই এ সফরে বের হয়ে যে এর সকল বিধি-বিধান সুচারুরূপে পালন করে হজ সম্পন্ন করে, সে প্রকৃতপক্ষে জান্নাত নিয়েই ফিরে আসে। মৃত্যুর পর জান্নাতই তার ঠিকানা। অতএব আল্লাহ তা‘আলা যে সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকে এ নিয়ামত ও অনুগ্রহে ভূষিত করেন তার জন্য কিছুতেই সমীচীন নয় হেলায় এ নিয়ামত হাতছাড়া করা; হজের শিক্ষা বিরোধী কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিজকে এ মহা পুরস্কার থেকে বঞ্চিত করা; বরং তার উচিত, যেকোনো মূল্যে এ নিয়ামত ধরে রাখা।
মুসলিম মাত্রেরই জানা উচিত, হজের জন্য মক্কা গমন আল্লাহর এক বিশেষ দান ও অনুগ্রহ। কেউ তার সম্পদগুণে, শরীরের শক্তিবলে, নিজের ক্ষমতা বা পদ বলে সেখানে গমন করতে পারে না। এ জন্যই তাফসীরকারগণ বলেছেন, ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন এর প্রথম ভিত রাখেন; কা‘বা ঘর নির্মাণ করেন; তখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কাছে ওহী পাঠান, ‘হে ইবরাহীম, তুমি মানবজাতিকে কা‘বায় আসতে আহবান জানাও। তিনি বললেন, হে আমার রব, আমার আওয়াজ আর কতদূর পৌঁছবে? তাদের সবার কাছে আমার দাওয়াত কীভাবে পৌঁছবে? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, তোমার দায়িত্ব আহবান জানানো আর আমার দায়িত্ব তা পৌঁছে দেয়া। অতপর ইবরাহীম আলাইহিস সালাম মাকামে ইবরাহীমে দাঁড়িয়ে উদাত্ত কণ্ঠে আহবান জানান, ‘হে মানব সম্প্রদায়, আল্লাহ তোমাদের জন্য একটি ঘর নির্মাণ করেছেন, অতএব তোমরা এর উদ্দেশ্যে আগমন করো।’ এ কথায় অনাগতকালে যারা হজ করবে তারা সবাই লাব্বাইক বলেছে। এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত যত মানুষ আসবে তারা সবাই তাদের বাপ-দাদার পিঠ থেকে সাড়া দিয়েছে। যে একবার লাব্বাইক বলেছে, সে একবার হজ করবে। যে দু’বার লাব্বাইক বলেছে সে দু’বার হজ করবে। যে যতবার বলেছে তার ততবার হজ নসীব হবে।[14]
এজন্যই হাজী সাহেব যখন হজের কার্যাদির সূচনা করেন তখন তার শ্লোগান হয়, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’। আভিধানিকভাবে লাব্বাইক অর্থ আহবানে সাড়া দেয়া, উত্তর দেয়া। কেউ যখন কাউকে ডাকে, তার উত্তরে বলে, লাব্বাইক, তাহলে তার অর্থ দাঁড়ায়, আমি এখানে আছি। আমি আপনার নির্দেশ পালনে প্রস্তুত। আমি আপনার ডাকে সাড়া দিচ্ছি ইত্যাদি। সুতরাং হাজী সাহেব যখন লাব্বাইক বলে হজের কার্যক্রম শুরু করেন, তখন তিনি মূলত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সে আহবানেই সাড়া দেন।
মোটকথা হজে যেতে পারা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার অনুগ্রহ। প্রতিটি মানুষই জানে তার স্বগোত্রের বহু লোকের এ সৌভাগ্য হয়নি। অথচ তারা ধনে, জনে, শক্তিতে ও পদবিতে তার চেয়ে অনেক বড়। যদি তার ওপর আল্লাহর দয়া না হত তাহলে সে হজ করতে পারত না। কাউকে যদি এ সৌভাগ্যে ভূষিত করা হয়, তবে বুঝতে হবে তা কেবলই আল্লাহর দয়া। সুবহানাল্লাহ্! ‘জান্নাতই মাবরূর হজের প্রতিদান!’
[2]. মুসলিম: ১০১৫।
[3]. সুনানে ইবন মাজাহ্: ২৮৯০।
[4]. মুস্তাদরাক : ১/১৭৭৮।
[5]. মুসান্নাফে আবদুর-রাযযাক : ৫/৮৮১৬।
[6]. মুসনাদে আহমদ: ৩/৩২৫, ৩৩৪।
[7]. সুনানে তিরমিযী : ৩/১৮৯।
[8]. আল-ইসতিযকার : ৪/১০৪।
[9]. আল-ইসতিযকার : ৪/১০৪।
[10]. আল-ইসতিযকার : ৪/১০৪।
[11]. ইবন খুযাইমাহ : ১৪৯৩।
[12]. ইবন রজব, জামেউল উলূম ওয়াল-হিকাম : ৩৯/৮।
[13]. বাকারা : ১৮৭।
[14]. নসবুর-রাআ : ৩/২৩।