দো‘আ বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদাপূর্ণ একটি আমল। আল্লাহর মুখাপেক্ষিতা ও অনুনয়-বিনয় প্রকাশের মাধ্যম হলো দো‘আ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আকেই সর্বোচ্চ ইবাদত হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। তিনি বলেন,
«الدُّعَاءُ هُوَ الْعِبَادَةُ»
‘দো‘আই ইবাদত।’[1] তিনি আরো বলেন,
«لَيْسَ شَيْء أَكرَمَ عَلى الله سُبْحَانَه ِمنَ الدعَاء.»
‘দো‘আর চেয়ে অধিক প্রিয় আল্লাহর কাছে অন্য কিছু নেই।’[2] আবূ সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَدْعُو، لَيْسَ بِإِثْمٍ وَلاَ بِقَطِيعَةِ رَحِمٍ ، إِلاَّ أَعْطَاهُ إِحْدَى ثَلاَثٍ : إِمَّا أَنْ يُعَجِّلَ لَهُ دَعْوَتَهُ، وَإِمَّا أَنْ يَدَّخِرَهَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ ، وَإِمَّا أَنْ يَدْفَعَ عَنْهُ مِنَ السُّوءِ مِثْلَهَا ، قَالَ : إِذًا نُكْثِرُ ، قَالَ : اللَّهُ أَكْثَرُ».
‘একজন মুসলমান যখন কোনো দো‘আ করে, আর সে দো‘আয় গুনাহের বিষয় থাকে না এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার কথাও থাকে না, তখন আল্লাহ তাকে তিনটি বিষয়ের একটি দিয়েই থাকেন : হয়তো তার দো‘আর ফলাফল তাকে দুনিয়াতে নগদ দিয়ে দেন। অথবা সেটা তার জন্য আখিরাতে জমা করে রাখেন। নতুবা দো‘আর সমপরিমাণ গুনাহ তার থেকে দূর করে দেন।’ সাহাবী বললেন, তাহলে আমরা বেশি বেশি দো‘আ করব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আল্লাহও বেশি বেশি দেবেন।’[3]
হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দো‘আর ছিল নিবিড় সম্পর্ক। তিনি তাওয়াফের সময় তাঁর রবের নিকট দো‘আ করেছেন।[4] সাফা ও মারওয়ার ওপর দাঁড়িয়ে দো‘আ করেছেন; আরাফায় উটের ওপর বসে হাত সিনা পর্যন্ত উঠিয়ে মিসকীন যেভাবে খাবার চায় সেভাবে দীর্ঘ দো‘আ ও কান্নাকাটি করেছেন; আরাফার যে জায়গায় তিনি অবস্থান করেছেন সেখানে স্থির হয়ে সূর্য হেলে গেলে সালাত আদায় করার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দো‘আ করেছেন। মুযদালিফার মাশ‘আরুল হারামে ফজরের সালাতের পর আকাশ ফর্সা হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ আকুতি-মিনতি ও মুনাজাতে রত থেকেছেন।[5] তাশরীকের দিনগুলোতে প্রথম দুই জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপের পর দাঁড়িয়ে হাত উঠিয়ে দীর্ঘক্ষণ দো‘আ করেছেন।[6]
ইবনুল কায়্যিম রহ. বলেন,
فَقَدْ تَضَمّنَتْ حَجّتُهُ صلى الله عليه وسلم سِتّ وَقَفَاتٍ لِلدّعَاءِ. الْمَوْقِفُ الْأَوّلُ عَلَى الصّفَا ، وَالثّانِي : عَلَى الْمَرْوَةِ ، وَالثّالِثُ بِعَرَفَةَ ، وَالرّابِعُ بِمُزْدَلِفَةَ ، وَالْخَامِسُ عِنْدَ الْجَمْرَةِ الْأُولَى ، وَالسّادِسُ عِنْدَ الْجَمْرَةِ الثّانِيَةِ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর হজ ছিল ছয়টি স্থানে বিশেষভাবে দো‘আয় পূর্ণ। প্রথম সাফায়, দ্বিতীয় মারওয়ায়, তৃতীয় আরাফায়, চতুর্থ মুযদালিফায়, পঞ্চম প্রথম জামরায় এবং ষষ্ঠ দ্বিতীয় জামরায়।’[7]
এ হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত দো‘আর আংশিক বর্ণনামাত্র। অথচ তিনি মদীনা থেকে বের হওয়ার সময় থেকে সেখানে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত কখনো আল্লাহর প্রশংসা ও যিকর থেকে বিরত থাকেননি। এ সময়ে তাঁর যবান ছিল আল্লাহর যিকিরে সদা সিক্ত। আল্লাহর মর্যাদার উপযোগী প্রশংসা তিনি বেশি বেশি করে করেছেন। যেমন- তালবিয়ায়, তাকবীরে, তাহলীলে, তাসবীহ ও আল্লাহর হামদ বর্ণনায়; কখনো বসে, কখনো দাঁড়িয়ে, আবার কখনো চলন্ত অবস্থায়, তথা সর্বক্ষেত্রে তিনি আল্লাহর প্রশংসা বর্ণনায় লিপ্ত থেকেছেন। হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিভিন্ন অবস্থা পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টিই আমাদের কাছে সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হবে।
উল্লেখ্য, হজে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দো‘আ ও তাঁর প্রভুর প্রশংসার যতটুকু বর্ণনা পাওয়া যায় তা অবর্ণিত অংশের তুলনায় অতি সামান্য। কেননা দো‘আ হলো বান্দা ও তাঁর প্রভুর মাঝে এক গোপন রহস্য। প্রত্যেক ব্যক্তি সংগোপনে তার প্রভুর সামনে যা কিছু তার প্রয়োজন সে বিষয়ে নিবিড় আকুতি ও মুনাজাত পেশ করে। রাসূলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে অংশটুকু প্রকাশ করেছেন তা ছিল কেবল উম্মতের জন্য আদর্শ প্রতিষ্ঠার খাতিরে যাতে তারা তাঁর অনুসরণ করতে পারে।
দো‘আ ও যিকর হজের উদ্দেশ্য ও বড় মকসূদসমূহের অন্যতম। নিম্নে বর্ণিত আয়াতে একথারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় :
﴿فَإِذَا قَضَيۡتُم مَّنَٰسِكَكُمۡ فَٱذۡكُرُواْ ٱللَّهَ كَذِكۡرِكُمۡ ءَابَآءَكُمۡ أَوۡ أَشَدَّ ذِكۡرٗاۗ﴾ [البقرة: ٢٠٠]
‘তারপর যখন তোমরা তোমাদের হজের কাজসমূহ শেষ করবে, তখন আল্লাহকে স্মরণ কর, যেভাবে তোমরা স্মরণ করতে তোমাদের বাপ-দাদাদেরকে, এমনকি তার চেয়ে অধিক স্মরণ।’[8]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ لِّيَشۡهَدُواْ مَنَٰفِعَ لَهُمۡ وَيَذۡكُرُواْ ٱسۡمَ ٱللَّهِ ﴾ [الحج: ٢٨]
‘যাতে তারা তাদের পক্ষে কল্যাণকর বিষয়ের স্পর্শে আসতে পারে এবং আল্লাহর নাম স্মরণ করতে পারে।’[9] শুধু তাই নয় বরং হজের সকল আমল আল্লাহর যিকরের উদ্দেশ্যেই বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِنَّمَا جُعِلَ الطَّوَافُ بِالْبَيْتِ وَبَيْنَ الصَّفَا وَالْمَرْوَةِ وَرَمْىُ الْجِمَارِ لإِقَامَةِ ذِكْرِ اللَّهِ».
‘বাইতুল্লাহ্র তাওয়াফ, সাফা-মারওয়ার সা‘ঈ এবং কঙ্কর নিক্ষেপ আল্লাহর যিকর কায়েমের লক্ষ্যেই বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।’[10]
এজন্য সে ব্যক্তিই সফল, যে এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এবং বেশি বেশি দো‘আ-যিকর ও কান্নাকাটি করে; আল্লাহর সামনে নিজের মুখাপেক্ষিতা প্রকাশ করে; প্রয়োজন তুলে ধরে; স্বীয় মাওলার জন্য নত হয় এবং নিজকে হীন করে উপস্থিত করে। সচেতন হৃদয়ে একাগ্র চিত্তে ব্যাপক অর্থবোধক দো‘আর মাধ্যমে তাঁর কাছে প্রার্থনা করে।
দো‘আর আদব :
দো‘আর বেশ কিছু আদব রয়েছে, যেগুলো অনুসরণ করলে দো‘আ কবুলের আশা করা যায়। নিম্নে দো‘আর কয়েকটি আদব উল্লেখ করা হল : কবুল কবুল
১. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার কাছে দো‘আ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ ﴾ [غافر: ٦٠]
‘তোমরা আমার কাছে দো‘আ কর, আমি তোমাদের দো‘আয় সাড়া দেব।[11]
২. উযু অবস্থায় দো‘আ করা। যেহেতু দো‘আ একটি ইবাদত তাই উযু অবস্থায় করাই উত্তম।
হাতের তালু চেহারার দিকে ফিরিয়ে দো‘আ করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا سَأَلْتُمُ اللهَ فَاسْأَلُوهُ بِبُطُونِ أَكُفِّكُمْ وَلاَ تَسْأَلُوهُ بِظُهُورِهَا».
‘তোমরা যখন আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে তখন হাতের তালু দিয়ে প্রার্থনা করবে। হাতের পিঠ দিয়ে নয়।[12] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে,
«كَانَ إِذَا دَعا جَعَلَ بَاطنَ كَفِّهِ إِلَى وَجْهِهِ».
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আ করার সময় হাতের তালু তাঁর চেহারার দিকে রাখতেন।’[13] এটিই প্রয়োজন ও বিনয় প্রকাশের সর্বোত্তম পন্থা, যাতে একজন অভাবী কিছু পাবার আশায় দাতার দিকে বিনয়াবনত হয়ে হাত বাড়িয়ে দেয়।
৩. হাত তোলা। প্রয়োজনে এতটুকু উঁচুতে তোলা যাতে বগলের নিচ দেখা যায়। রাসূলুল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا مِنْ عَبْدٍ يَرْفَعُ يَدَيْهِ يَسْأَلُ اللهَ مَسْأَلَةً إِلاَّ أتَاهَا إِيَّاهُ».
‘যে ব্যক্তি তার উভয় হাত উঠায় এবং আল্লাহর কাছে কোন কিছু চায়, আল্লাহ তাকে তা দিয়েই দেন।’[14]
৪. আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর ওপর সালাত ও সালাম পাঠ করা।
ফুযালা ইবন উবায়েদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাতের মধ্যে এক ব্যক্তিকে এভাবে দো‘আ করতে শুনলেন যে, সে আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করল না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর সালাত ও সালাম পাঠ করল না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন, ‘এ লোকটি তাড়াহুড়া করল।’ এরপর তিনি বললেন,
«إِذَا صَلَّى أَحَدُكُمْ فَلْيَبْدَأْ بِتَحْمِيدِ رَبِّهِ جَلَّ وَعَزَّ وَالثَّنَاءِ عَلَيْهِ ثُمَّ يُصَلِّى عَلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ يَدْعُو بَعْدُ بِمَا شَاءَ»
‘তোমাদের কেউ যখন দো‘আ করবে, তখন সে যেন প্রথমে তার রবের প্রশংসা করে এবং তার স্তুতি জ্ঞাপন করে। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর সালাত ও সালাম পাঠ করে। অতঃপর যা ইচ্ছে প্রার্থনা করে।’[15] অন্য হাদীসে এসেছে,
«كُلُّ دُعاءٍ مَحْجُوبٌ حَتَّى يُصَلَّى عَلَى النَّبِيِّ».
‘প্রত্যেক দো‘আ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি সালাত না পড়া পর্যন্ত বাধাপ্রাপ্ত অবস্থায় থাকে।’[16]
নিজের জন্য ও নিজের আপনজনদের জন্য কল্যাণের দো‘আ করা, মন্দ বা অকল্যাণের দো‘আ না করা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ يَزَالُ يُسْتَجَابُ لِلْعَبْدِ مَا لَمْ يَدْعُ بِإِثْمٍ أَوْ قَطِيعَةِ رَحِمٍ».
‘বান্দার দো‘আ কবুল হয়, যতক্ষণ না সে কোনো পাপ কাজের বা আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করার দো‘আ করে।’[17] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
«لاَ تَدْعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ وَلاَ تَدْعُوا عَلَى أَوْلاَدِكُمْ وَلاَ تَدْعُوا عَلَى أَمْوَالِكُمْ».
‘তোমরা তোমাদের নিজদের, তোমাদের সন্তান-সন্তুতির এবং তোমাদের সম্পদের ব্যাপারে বদদো‘আ করো না।’[18]
৫. দো‘আ কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে আল্লাহর কাছে দো‘আ করা।
«اُدْعُوا اللهَ وَأَنْتُمْ مُوقِنُونَ بِالإِجَابَةِ، وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ لا يَسْتَجِيبُ دُعَاءً مِنْ قَلْبٍ غَافِلٍ لاهٍ».
‘কবুল হবার দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে তোমরা আল্লাহর কাছে দো‘আ কর। জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ গাফেল ও উদাসীন হৃদয় থেকে বের হওয়া দো‘আ কবুল করেন না।’[19]
দো‘আর সময় সীমা লঙ্ঘন না করা। সা‘দ রা. বলেন, হে বৎস! আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি :
«سَيَكُونُ قَوْمٌ يَعْتَدُونَ فِى الدُّعَاءِ».
‘অচিরেই এমন এক সম্প্রদায় আসবে যারা দো‘আয় সীমা-লঙ্ঘন করবে।’[20]
আর সে সীমালঙ্ঘন হচ্ছে, এমন কিছু চাওয়া যা হওয়া অসম্ভব। যেমন, নবী বা ফেরেশতা হবার দো‘আ করা। অথবা জান্নাতের কোন সুনির্দিষ্ট অংশ লাভের জন্য দো‘আ করা।
৬. বিনয় প্রকাশ ও কাকুতি-মিনতি করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَٱذۡكُر رَّبَّكَ فِي نَفۡسِكَ تَضَرُّعٗا وَخِيفَةٗ وَدُونَ ٱلۡجَهۡرِ مِنَ ٱلۡقَوۡلِ بِٱلۡغُدُوِّ وَٱلۡأٓصَالِ ﴾ [الاعراف: ٢٠٥]
‘আর তুমি নিজ মনে আপন রবকে স্মরণ কর সকাল-সন্ধ্যায় অনুনয়-বিনয় ও ভীতি সহকারে এবং অনুচ্চ স্বরে।’[21]
৭. ব্যাপক অর্থবোধক ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেছেন তা জামে‘ তথা পূর্ণাঙ্গ ও ব্যাপক। এক বর্ণনায় এসেছে,
كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَسْتَحِبُّ الْجَوَامِعَ مِنَ الدُّعَاءِ وَيَدَعُ مَا سِوَى ذَلِكَ.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যাপক অর্থবোধক দো‘আ পছন্দ করতেন এবং অন্যগুলো ত্যাগ করতেন।’[22]
৮. আল্লাহ তা‘আলার সুন্দর নামসমূহ ও তাঁর সুমহান গুণাবলির উসীলা দিয়ে দো‘আ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ ﴾ [الاعراف: ١٨٠]
‘আল্লাহর রয়েছে সুন্দর নামসমূহ, সেগুলোর মাধ্যমে তোমরা তাঁর নিকট দো‘আ কর।’[23]
৯. ঈমান ও আমলে সালেহ তথা নেক কাজের উসীলা দিয়ে দো‘আ করা।
ক. ঈমানের উসীলা দিয়ে দো‘আ করার উদাহরণ কুরআনুল কারীমে উল্লিখিত হয়েছে,
﴿ رَّبَّنَآ إِنَّنَا سَمِعۡنَا مُنَادِيٗا يُنَادِي لِلۡإِيمَٰنِ أَنۡ ءَامِنُواْ بِرَبِّكُمۡ فََٔامَنَّاۚ رَبَّنَا فَٱغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرۡ عَنَّا سَئَِّاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ ٱلۡأَبۡرَارِ ١٩٣ ﴾ [ال عمران: ١٩٣]
‘হে আমাদের রব, নিশ্চয় আমরা শুনেছিলাম একজন আহবানকারীকে, যে ঈমানের দিকে আহবান করে যে, ‘তোমরা তোমাদের রবের প্রতি ঈমান আন’। তাই আমরা ঈমান এনেছি। হে আমাদের রব আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করুন এবং বিদূরিত করুন আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি, আর আমাদেরকে মৃত্যু দিন নেককারদের সাথে।’[24]
খ. আমলে সালেহ তথা নেক কাজের উসীলা দিয়ে দো‘আ করার উদাহরণ হাদীসে উল্লিখিত হয়েছে,
‘তিন ব্যক্তি যাত্রাপথে রাত যাপনের জন্য একটি গুহায় আশ্রয় নেয়। হঠাৎ পাহাড় থেকে একটি পাথর খসে পড়ে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এমন অসহায় অবস্থায় তাদের প্রত্যেকে নিজ নিজ নেক আমলের উসীলা দিয়ে দো‘আ করে। একজন বৃদ্ধ পিতা-মাতার খেদমত, অপরজন অবৈধ যৌনাচার থেকে নিজকে রক্ষা এবং তৃতীয়জন আমানতের যথাযথ হেফাযতের উসীলা দিয়ে পাথরের এই মহা বিপদ থেকে মুক্তির জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করলেন। তাদের দো‘আর ফলে পাথর সরে গেল। তারা সকলেই নিরাপদে গুহা থেকে বের হয়ে এলেন।’[25]
১০. নিজের গুনাহের কথা স্বীকার করে দো‘আ করা। উদাহরণস্বরূপ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মাছের পেটে থাকাবস্থায় ইউনুস আলাইহিস সালাম যে দো‘আর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলাকে ডেকেছিলেন (অর্থাৎ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ سُبْحَانَكَ إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِين লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায যালিমীন। ‘আপনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র মহান। নিশ্চয় আমি ছিলাম যালিম।’) যেকোনো মুসলমান ব্যক্তি তা দিয়ে দো‘আ করলে আল্লাহ তা‘আলা তার দো‘আ কবুল করে নেবেন।’[26]
১১. উচ্চ স্বরে দো‘আ না করা; অনুচ্চ স্বরে দো‘আ করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ٱدۡعُواْ رَبَّكُمۡ تَضَرُّعٗا وَخُفۡيَةًۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُعۡتَدِينَ ٥٥ ﴾ [الاعراف: ٥٥]
‘তোমরা তোমাদের রবকে ডাক অনুনয় বিনয় করে ও চুপিসারে। নিশ্চয় তিনি পছন্দ করেন না সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে।’[27] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«يَا أَيُّهَا النَّاسُ ، ارْبَعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ ، فَإِنَّكُمْ لاَ تَدْعُونَ أَصَمَّ وَلاَ غَائِبًا ، إِنَّهُ مَعَكُمْ ، إِنَّهُ سَمِيعٌ قَرِيبٌ».
‘হে লোক সকল, তোমরা নিজদের প্রতি সদয় হও এবং নিচু স্বরে দো‘আ করো। কারণ তোমরা বধির বা অনুপস্থিত কাউকে ডাকছো না। নিশ্চয় তিনি (তাঁর জ্ঞান) তোমাদের সাথেই আছেন। তিনি অতিশয় শ্রবণকারী, নিকটবর্তী।’[28]
১২. আল্লাহর কাছে বারবার চাওয়া। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাই করতেন। ইবন মাসঊদ রা. বলেন,
كَانَ رسول الله صلى الله عليه وسلم يُعْجِبُهُ أَنْ يَدْعُوَ ثَلَاثًا، وَيَسْتَغْفِرَ ثَلَاثًا.
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দো‘আর বাক্যগুলো তিনবার করে বলতে এবং তিনি তিনবার করে ইস্তেগফার করতে পছন্দ করতেন।’[29]
১৩. কিবলামুখী হয়ে দো‘আ করা। আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
اسْتَقْبَلَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم الْكَعْبَةَ فَدَعَا عَلَى نَفَرٍ مِنْ قُرَيْشٍ ، عَلَى شَيْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ ، وَعُتْبَةَ بْنِ رَبِيعَةَ وَالْوَلِيدِ بْنِ عُتْبَةَ ، وَأَبِى جَهْلِ بْنِ هِشَامٍ . فَأَشْهَدُ بِاللَّهِ لَقَدْ رَأَيْتُهُمْ صَرْعَى ، قَدْ غَيَّرَتْهُمُ الشَّمْسُ ، وَكَانَ يَوْمًا حَارًّا .
‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘বামুখী হলেন। অতপর কুরাইশদের কয়েকজনের জন্য বদ-দো‘আ করলেন, তারা হল, শাইবা ইবন রবী‘আ, উতবা ইবন রবী‘আ, ওয়ালীদ ইবন উতবা এবং আবূ জাহল ইবন হিশাম। আল্লাহর কসম, আমি তাদেরকে মৃত অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখলাম। রোদ তাদেরকে বদলে দিয়েছিল। তখন ছিল গরমের দিন।’[30]
[2]. সহীহ ইবনে হিববান : ৮৭০।
[3]. আল-আদাবুল মুফরাদ : ৭১০।
[4]. আবূ দাউদ : ১৮৯২।
[5]. মুসলিম : ১২১৮।
[6]. বুখারী : ১৭৫১।
[7]. যাদুল মা‘আদ : ২/২৬৩।
[8]. বাকরা : ২০০।
[9]. হজ : ২৮।
[10]. আবূ দাউদ : ১৮৯০।
[11]. গাফির : ৬০।
[12]. আবূ দাউদ : ১৪৮৬।
[13]. তাবারানী : ১১/১২২-৩৪।
[14]. তিরমিযী : ৩৬০৩।
[15]. আবূ দাউদ : ১৪৮৩।
[16]. দায়লামী : ৩/৪৭৯১; সহীহুল জামে’ : ৪৫২৩।
[17]. মুসলিম : ৭১১২।
[18]. মুসলিম : ৩০০৯।
[19]. তিরমিযী : ৩৪৭৯।
[20]. আহমদ : ১/১৭২।
[21]. আ‘রাফ : ২০৫।
[22]. আবূ দাউদ : ১৪৮২।
[23]. আ‘রাফ : ১৮০।
[24]. আলে-ইমরান : ১৯৩।
[25]. বুখারী : ২১১১।
[26]. তিরমিযী : ৫০৫৩; মুস্তাদরাক হাকেম : ৪৪৪৩।
[27]. আ‘রাফ : ৫৫।
[28]. বুখারী : ৯২২৯; মুসলিম : ২৭০৪।
[29]. মুসনাদ আহমদ : ১/৩৯৪।
[30]. বুখারী : ৩৯৬০; মুসলিম : ১৭৯৪।