’’হারাম’’ শব্দের আভিধানিক অর্থ: অবৈধ বা নিষিদ্ধ (বস্ত্ত, কথা, কাজ, বিশ্বাস ও ধারণা)। শরীয়তের পরিভাষায় হারাম বলতে সে সকল গুনাহ্কে বুঝানো হয় যে সকল গুনাহ্গার শরীয়তের দৃষ্টিতে যে কোনভাবে নিন্দিত।
’’কবীরা’’ শব্দের আভিধানিক অর্থ: বড়। শরীয়তের পরিভাষায় কবীরা গুনাহ্ বলতে সে সকল গুনাহ্কে বুঝানো হয় যে সকল গুনাহ্’র ব্যাপারে কুর‘আন বা সহীহ হাদীসে নির্দিষ্ট ঐহিক বা পারলৌকিক শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে অথবা সে সকল গুনাহ্কে কুর‘আন, হাদীস কিংবা সকল আলিমের ঐকমত্যে কবীরা বা মারাত্মক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
কারো কারো মতে কবীরা গুনাহ্ বলতে সে সকল গুনাহ্কে বুঝানো হয় যে সকল গুনাহ্’র ব্যাপারে শাস্তি, ক্রোধ, ঈমানশূন্যতা বা অভিশাপের মারাত্মক হুমকি বা জাহান্নামের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।
আবার কারো কারো মতে কবীরা গুনাহ্ বলতে সে সকল গুনাহ্কে বুঝানো হয় যে সকল গুনাহ্গারকে আল্লাহ্ তা‘আলা বা তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অভিসম্পাত করেছেন অথবা যে সকল গুনাহ্গারকে কুর‘আন কিংবা সহীহ হাদীসে ফাসিক বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
কারো কারো মতে কবীরা গুনাহ্ বলতে সে সকল কাজকে বুঝানো হয় যে সকল কাজ হারাম হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সকল শরীয়ত একমত।
আবার কারো কারো মতে কবীরা গুনাহ্ বলতে সে সকল কাজকে বুঝানো হয় যে সকল কাজ হারাম হওয়ার ব্যাপারে কুর‘আনের সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
কারো কারো মতে কবীরা গুনাহ্ বলতে সে সকল গুনাহ্কে বুঝানো হয় যে সকল গুনাহ্’র বিস্তারিত বর্ণনা আল্লাহ্ তা‘আলা সূরাহ নিসা’র শুরু থেকে নিম্নোক্ত আয়াত পর্যন্ত দিয়েছেন।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«إِنْ تَجْتَنِبُوْا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ، وَنُدْخِلْكُمْ مُّدْخَلًا كَرِيْمًا»
‘‘তোমরা যদি সকল মহাপাপ থেকে বিরত থাকো যা হতে তোমাদেরকে (কঠিনভাবে) বারণ করা হয়েছে তাহলে আমি তোমাদের সকল ছোট পাপ ক্ষমা করে দেবো এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবো খুব সম্মানজনক স্থানে’’। (নিসা’ : ৩১)
অনুরূপভাবে কোন ফরয কাজ পরিত্যাগ করাও কবীরা গুনাহ্’র শামিল।
কবীরা গুনাহ্’র উক্ত সংজ্ঞাদাতারা উহার কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা বর্ণনা করেননি। বরং তাঁরা ওই সকল গুনাহ্কেই কবীরা গুনাহ্ বলে আখ্যায়িত করেন যে সকল গুনাহ্’র মধ্যে উক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান।
ঠিক এরই বিপরীতে কিছু সংখ্যক সাহাবা ও বিশিষ্ট আলিম কবীরা গুনাহ্’র নির্দিষ্ট সংখ্যা বর্ণনা করেন।
আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস্’ঊদ (রাঃ) বলেন: কবীরা গুনাহ্ সর্বমোট চারটি।
আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’উমর (রাযিয়াল্লাহু ‘আন্হুমা) বলেন: কবীরা গুনাহ্ সর্বমোট সাতটি।
আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আমর বিন্ ‘আস্ (রাযিয়াল্লাহু ‘আন্হুমা) বলেন: কবীরা গুনাহ্ সর্বমোট নয়টি।
কেউ কেউ বলেন: কবীরা গুনাহ্ সর্বমোট এগারোটি।
আবার কারো কারো মতে কবীরা গুনাহ্ সর্বমোট সত্তরটি।
আবূ ত্বালিব মাক্কী (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: কবীরা গুনাহ্ সংক্রান্ত সাহাবাদের সকল বাণী একত্রিত করলে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে:
অন্তরের সাথে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ চারটি: আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা, কোন গুনাহ্ বার বার করতে থাকার মানসিকতা, যদিও তা একেবারেই ছোট হোক না কেন, আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ এবং তাঁর পাকড়াও থেকে একেবারেই নিশ্চিন্ত হওয়া।
মুখের সাথে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ও চারটি: মিথ্যা সাক্ষী, কোন সতী-সাধ্বী মহিলাকে ব্যভিচারের অপবাধ দেয়া, মিথ্যা কসম ও যাদু।
পেটের সাথে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ তিনটি: মদ্য পান, ইয়াতীমের সম্পদ ভক্ষণ ও সুদ খাওয়া।
লজ্জাস্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ দু’টি: ব্যভিচার ও সমকাম।
হাতের সঙ্গে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ও দু’টি: হত্যা ও চুরি।
পায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ একটি। আর তা হচ্ছে কাফির ও মুশ্রিকের সাথে সম্মুখযুদ্ধ থেকে পলায়ন।
পুরো শরীরের সঙ্গে সম্পর্কিত কবীরা গুনাহ্ও একটি। আর তা হচ্ছে নিজ মাতা-পিতার অবাধ্য হওয়া।
আবার কোন কোন আলিমের মতে সকল পাপই মহাপাপ। কারণ, যে কোন গুনাহ্’র মানেই আল্লাহ্ তা‘আলার সঙ্গে চরম স্পর্ধা প্রদর্শন ও তাঁর একান্ত নাফরমানি।
তাদের ধারণা, কোন গুনাহ্ই তা যে পর্যায়েরই হোক না কেন তা আল্লাহ্ তা‘আলার এতটুকুও ক্ষতি করতে পারে না। সুতরাং সকল গুনাহ্ই আল্লাহ্ তা‘আলার দৃষ্টিতে সমান। সকল গুনাহ্ই তাঁর নাফরমানি বৈ কি?
তারা আরো বলেন: গুনাহ্’র ভয়ঙ্করতা নির্ভরশীল আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকার বিনষ্ট ও উহার প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শনের উপরই। তা না হলে যে ব্যক্তি শরীয়তের বিধান না জেনে হালাল মনে করে মদ পান বা ব্যভিচার করেছে তার শাস্তি অনেক বেশি হতো সে ব্যক্তির চাইতে যে ব্যক্তি তা হারাম জেনে সংঘটন করেছে। কারণ, প্রথম ব্যক্তির দোষ দু’টি: মূর্খতা ও হারাম কাজ সংঘটন এবং দ্বিতীয় ব্যক্তির দোষ শুধুমাত্র একটি। আর তা হচ্ছে হারাম কাজ সংঘটন। অথচ দ্বিতীয় ব্যক্তি নির্দিষ্ট শাস্তি পাচ্ছে এবং প্রথম ব্যক্তি তা পাচ্ছে না। আর তা হচ্ছে এ কারণেই যে, প্রথম ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকারের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করেনি। কারণ, সে জানেই না যে তা আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকার। ঠিক এরই বিপরীতে দ্বিতীয় ব্যক্তি তা আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকার জেনেই তার প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করেছে।
তারা আরো বলেন: গুনাহ্ মানেই আল্লাহ্ তা‘আলার আদেশ ও নিষেধকে তুচ্ছ মনে করা এবং তাঁর দেয়া নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করা। এ দৃষ্টিকোণ থেকে সকল গুনাহ্ই সমান। সবই বড়।
যেমন: জনৈক ব্যক্তি তার একটি গোলামকে ভারী কাজের আদেশ করেছেন আর অন্য জনকে হালকা কাজের। অথচ তাদের কেউই উক্ত আদেশ পালন করেনি। তখন সে ব্যক্তি উভয় গোলামকেই ঘৃণা করবে এবং তাদেরকে বিক্রি করে দিবে।
তারা আরো বলেন: উক্ত কারণেই যে ব্যক্তি মক্কায় অবস্থান করেও হজ্জ করেনি অথবা যে ব্যক্তি মসজিদের পাশে থেকেও নামায পড়েনি তার অপরাধ অনেক বেশি সে ব্যক্তির চাইতে যার ঘর মক্কা বা মসজিদ থেকে অনেক দূরে। ঠিক এরই বিপরীতে অপর দু’ ব্যক্তি সমান দোষী যাদের একজন পঞ্চাশ হাজার টাকার মালিক অথচ সে যাকাত আদায় করেনি। আর অন্য জন দু’ লক্ষ টাকার মালিক তবুও সে যাকাত আদায় করেনি। কারণ, উভয় জনই যাকাত দিচ্ছে না। চাই তাদের কারোর সম্পদ বেশি হোক বা কম। অন্য দিকে যাকাত দিতে তেমন কোন পরিশ্রমও নেই।
ইমাম ’ইয্যুদ্দীন বিন্ ‘আব্দুস্ সালাম (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: ওই সকল গুনাহ্গুলোকেও কবীরা গুনাহ্ বলে ধরে নিতে হবে যেগুলোর ক্ষতি কোন না কোন কবীরা গুনাহ্’র সমান অথবা তার চাইতেও অনেক বেশি। যদিও সেগুলোকে কুর‘আন বা সহীহ হাদীসে কবীরা গুনাহ্ বলে আখ্যায়িত করা হয়নি। যেমন: আল্লাহ্ তা‘আলা বা তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে গালি দেয়া। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে অসম্মান করা, কোন রাসূলকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করা, কা’বা শরীফকে ময়লাযুক্ত করা, কুর‘আন মাজীদকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা, কোন সতী মহিলাকে অন্য কারোর ব্যভিচার অথবা কোন মুসলিমকে অন্য কারোর হত্যার জন্য ধরে রাখা, কোন কাফির গোষ্ঠীকে মুসলিমদের ব্যাপারে তথ্য দেয়া অথচ সে জানে যে, তারা সুযোগ পেলে উক্ত মুসলিমদেরকে হত্যা করবে, তাদের স্ত্রী-সন্তানদেরকে ধরে নিয়ে যাবে অথবা তাদের ধন-সম্পদ লুট করবে কিংবা তাদের স্ত্রী-কন্যার সাথে ব্যভিচার করবে এমনকি তাদের ঘর-বাড়িও ভেঙ্গে দিবে, তেমনিভাবে মিথ্যা তথ্য দিয়ে কারোর জীবন নাশ করা ইত্যাদি ইত্যাদি।
আল্লাহ্ তা‘আলা যুগে যুগে রাসূল পাঠিয়েছেন, কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং ভূমন্ডল ও নভোমন্ডল সৃষ্টি করেছেন শুধুমাত্র একটি কারণে। আর তা হচ্ছে সঠিকভাবে তাঁকে চেনা ও এককভাবে তাঁরই ইবাদাত ও আনুগত্য করা। ডাকলে একমাত্র তাঁকেই ডাকা।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَمَا خَلَقْتُ الْـجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُوْنَ»
‘‘আমি জিন ও মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমারই ইবাদাত করার জন্যে’’। (যারিয়াত : ৫৬)
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:
«اللهُ الَّذِيْ خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَّمِنَ الْأَرْضِ مِثْلَهُنَّ، يَتَنَزَّلُ الْأَمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوْا أَنَّ اللهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيْرٌ، وَأَنَّ اللهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا»
‘‘আল্লাহ্ তা‘আলাই সৃষ্টি করেছেন সপ্তাকাশ এবং তদনুরূপ (সপ্ত) জমিনও। ওগুলোতে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ। যাতে তোমরা বুঝতে পারো যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা সর্ব বিষয়ে শক্তিমান এবং সব কিছুই নিশ্চিতভাবে তাঁর জ্ঞানাধীন’’। (ত্বালাক্ব : ১২)
সুতরাং আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টি এবং তাঁর আদেশের লক্ষ্যই হচ্ছে তাঁর নাম ও গুণাবলীর মাধ্যমে তাঁকে চেনা ও একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করা। তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা। বরং দুনিয়াতে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ، وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمْ الْكِتَابَ وَالْمِيْزَانَ لِيَقُوْمَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ»
‘‘নিশ্চয়ই আমি রাসূলদেরকে পাঠিয়েছি স্পষ্ট প্রমাণসহ এবং তাঁদের সঙ্গে নাযিল করেছি কিতাব ও তুলাদন্ড তথা ন্যায়-নীতি পরিমাপক জ্ঞান। যেন মানুষ ইন্সাফের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে’’। (হা’দীদ : ২৫)
মানবস্রষ্টার প্রতি তার বান্দাহ্’র একান্ত সুবিচার হচ্ছে একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করা ও তাঁর সাথে কাউকে শরীক না করা।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيْمٌ»
‘‘নিশ্চয়ই শির্ক বড় যুলুম’’। (লুক্বমান : ১৩)
সুতরাং যে কাজই উক্ত উদ্দেশ্যের চরম বিরোধী তাই মহাপাপ এবং যে কোন পাপই উক্ত বিরোধীতার মানানুসারে ছোট বা বড় বলে বিবেচিত হয়। ঠিক এরই বিপরীতে যে কাজই উক্ত উদ্দেশ্যকে দুনিয়ার বুকে বাস্তবায়ন করতে সত্যিকারার্থে সহযোগিতা করবে তাই হবে অবশ্য করণীয় অথবা ঈমান ও ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রুকন।
উক্ত সূত্র বুঝে আসলেই আপনি বুঝতে পারবেন সকল ইবাদাত ও গুনাহ্’র পরস্পর তারতম্য।
শির্ক যখন উক্ত উদ্দেশ্যের চরম বিরোধী অতএব তা বিনা বাক্যে সর্ববৃহৎ মহাপাপ। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা মুশ্রিকের উপর জান্নাত হারাম করে দেন এবং তার জান, মাল ও পরিবারবর্গ তাওহীদপন্থীদের জন্য হালাল করেন। কারণ, সে যখন আল্লাহ্ তা‘আলার একচ্ছত্র গোলামি ছেড়ে দিয়েছে তখন তিনি তাকে ও তার অনুগত পরিবারবর্গকে তাঁর তাওহীদপন্থী বান্দাহ্দের গোলামি করতে বাধ্য করেছেন। তেমনিভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা মুশ্রিকের কোন নেক আমল কবুল করবেন না এবং তার ব্যাপারে কিয়ামতের দিন কারোর কোন সুপারিশ গ্রহণ করা হবে না। আখিরাতে তার কোন ফরিয়াদ শুনা হবে না এবং সে দিন তার কোন গুনাহ্ ক্ষমা করা হবে না। কারণ, সে আল্লাহ্ তা‘আলার শানে নিতান্ত মূর্খতার পরিচয় দিয়েছে এবং তাঁর প্রতি চরম অবিচার করেছে।
কেউ বলতে পারেন: যারা আল্লাহ্ তা‘আলাকে পাওয়ার জন্য দুনিয়ার কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তকে মাধ্যম বানিয়েছে তারা তো সত্যিকারার্থে আল্লাহ্ তা‘আলাকে অধিক সম্মান করে। কারণ, তারা মনে করে, আল্লাহ্ তা‘আলা বড় মহীয়ান। সুতরাং কোন মাধ্যম ছাড়া সে মহীয়ানের নিকটবর্তী হওয়া যাবে না। তবুও আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের প্রতি এতো অসন্তুষ্ট কেন?
উত্তরে বলতে হয়: শির্ক প্রথমত: দু’ প্রকার:
১. যা আল্লাহ্ তা‘আলার মহান সত্তা, তাঁর নাম, কাম ও গুণাবলীর সাথে সম্পৃক্ত।
২. যা তাঁর ইবাদাত ও তাঁর সঙ্গে সঠিক আচার-আচরণের সাথে সম্পৃক্ত। যদিও উক্ত মুশ্রিক এমন মনে করে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা নিজ সত্তা, কর্ম ও গুণাবলীতে একক। তাঁর কোন শরীক নেই।
প্রথমোক্ত শির্ক আবার দু’ প্রকার:
উক্ত শির্ক অতি মারাত্মক ও অতিশয় ঘৃণ্য। যা ছিলো ফির‘আউনের শির্ক। কারণ, সে বলেছিলো:
«وَمَا رَبُّ الْعَالَمِيْنَ»
‘‘জগতগুলোর প্রভু আবার কে?’’ (শু‘আরা’ : ২৩)
সে আরো বলে:
«يٰهَامَانُ ابْنِ لِيْ صَرْحًا، لَعَلِّيْ أَبْلُغُ الْأَسْبَابَ، أَسْبَابَ السَّمَاوَاتِ فَأَطَّلِعَ إِلٰى إِلٰهِ مُوْسٰى وَإِنِّيْ لَأَظُنُّهُ كَاذِبًا»
‘‘হে হা’মান! তুমি আমার জন্য একটি সুউচ্চ প্রাসাদ তৈরি করো যাতে আমি আকাশের দরোজা পর্যন্ত পৌঁছুতে পারি এবং আমি স্বচক্ষে দেখতে পাই মূসা (আঃ) এর মা’বূদকে। আমার ধারণা, নিশ্চয়ই সে (মূসা (আঃ)) মিথ্যাবাদী’’। (গা’ফির/মু’মিন : ৩৬-৩৭)
শির্ক বলতেই অস্বীকার অথবা যে কোন ভাবে আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকার খর্ব করাকে বুঝায়। চাই তা সামান্যটুকুই হোক না কেন। সুতরাং প্রতিটি মুশ্রিকই অস্বীকারকারী বা আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকার খর্বকারী এবং প্রতিটি অস্বীকারকারী বা অধিকার খর্বকারীই মুশ্রিক।
অস্বীকার বা অধিকার খর্ব করণ আবার তিন প্রকার:
১. সৃষ্টিকুলের সব কিছুই আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টি করেননি। বরং কোন কোন জিনিস মানুষও সৃষ্টি করেছে বা এমনিতেই সৃষ্টি হয়েছে এমন মনে করা।
২. আল্লাহ্ তা‘আলার নাম, কাম বা গুণাবলীর কিয়দংশ বা সম্পূর্ণটুকুই অস্বীকার করা।
৩. মানুষ থেকে প্রাপ্য আল্লাহ্ তা‘আলার অধিকার তথা একচ্ছত্র আনুগত্য ও শির্ক অবিমিশ্র ইবাদাত আদায় না করা।
ওয়াহ্দাতুল্ উজূদ্ (সৃষ্টিই স্রষ্টা) মতবাদ, বিশ্ব অবিনশ্বর মতবাদ এবং আল্লাহ্ তা‘আলা নিজ নাম, কাম ও গুণাবলী শূন্য মতবাদ ইত্যাদি উক্ত শির্কেরই অন্তর্গত।
২. আল্লাহ্ তা‘আলার পাশাপাশি অন্য ইলাহ্ স্বীকার করার শির্ক:
উক্ত মুশ্রিকরা আল্লাহ্ তা‘আলার নাম, গুণাবলী ও প্রভুত্ব স্বীকার করে। তবে তারা তাঁরই পাশাপাশি অন্য ইলাহ্তেও বিশ্বাস করে।
যেমন: খ্রিস্টানদের শির্ক। তারা আল্লাহ্ তা‘আলার পাশাপাশি ’ঈসা (আঃ) ও তাঁর মাকে ইলাহ্ বলে স্বীকার করে।
অগ্নিপূজকদের শির্কও উক্ত শির্কের অন্তর্গত। কারণ, তারা সকল কল্যাণকর কর্মকান্ডকে আলো এবং সকল অকল্যাণকর কর্মকান্ডকে আঁধারের সৃষ্টি বলে মনে করে।
তাক্বদীর বা ভাগ্যে অবিশ্বাসীদের শির্কও উক্ত শির্কের অন্তর্গত। কারণ, তারা মনে করে, মানুষ বা যে কোন প্রাণী আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছা-অনুমতি ছাড়াও নিরেট নিজ ইচ্ছায় যে কোন কাজ করতে পারে। এরা বাস্তবে অগ্নিপূজকদেরই অনুরূপ।
ইব্রাহীম (আঃ) এর সঙ্গে তর্ককারী ‘‘নাম্রূদ্ বিন্ কিন্‘আন’’ এর শির্কও উক্ত শির্কের অন্তর্গত। কারণ, তার অন্যতম দাবি এটিও ছিলো যে, সে ইচ্ছে করলেই কাউকে মারতে বা জীবিত করতে পারে।
কবরপূজারীদের শির্কও উক্ত শির্কের অন্তর্গত। কারণ, তারা আল্লাহ্ তা‘আলার পাশাপাশি নিজ পীর-বুযুর্গদেরকেও রব্ ও ইলাহ্ বানিয়ে নিয়েছে।
রাশি-নক্ষত্রে বিশ্বাসী এবং সূর্যপূজারীদের শির্কও উক্ত শির্কের অধীন।
উক্ত মুশ্রিকদের কেউ কেউ আল্লাহ্ তা‘আলাকে বাস্তব মা’বূদ বলেও বিশ্বাস করে। আবার কেউ কেউ আল্লাহ্ তা‘আলাকে বড় মা’বূদ বা মা’বূদদের অন্যতম বলেও মনে করে। আবার কেউ কেউ এমনো মনে করে যে, তাদের ছোট মা’বূদগুলো অতি তাড়াতাড়ি তাদেরকে তাদের বড় মা’বূদের নিকটবর্তী করে দিবে।
ইবাদাতের শির্ক কিন্তু উপরোক্ত শির্ক অপেক্ষা সামান্যটুকু গৌণ। তম্মধ্যে কিছু রয়েছে ক্ষমার অযোগ্য। আবার কিছু কিছু রয়েছে ক্ষমাযোগ্য। কারণ, তা প্রকাশ পায় এমন ব্যক্তি থেকে যিনি বিশ্বাস করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া সত্যিকারের কোন মাবূদ নেই। তিনি ছাড়া কেউ কারোর কোন ক্ষতি বা লাভ করতে পারে না। কিছু দিতে বা বঞ্চিত করতে পারে না। তিনিই একমাত্র প্রভু। তিনি ভিন্ন অন্য কোন প্রতিপালক নেই। তবে তার সমস্যা এই যে, সে ব্যক্তি ইবাদাত করতে গেলে একনিষ্ঠার সাথে তা একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য করে না। বরং তা কখনো কখনো নিজের সুবিধার জন্যে, আবার কখনো কখনো দুনিয়া কামানোর জন্যে, আবার কখনো কখনো সমাজের নিকট নিজ পজিশন, সম্মান ও প্রতিপত্তি বাড়ানোর জন্য করে থাকে। সুতরাং তার ইবাদাতের কিয়দংশ আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য, আবার কিছু নিজ নফ্স ও প্রবৃত্তির জন্য, আবার কিছু অংশ শয়তানের জন্য, আবার কিছু মানুষের জন্যও হয়ে থাকে।
মুসলিমদের মধ্যকার অধিকাংশ মানুষই উক্ত শির্কে নিমগ্ন এবং এ শির্ক সম্পর্কেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
الشِّرْكُ فِيْ هَذِهِ الْأُمَّةِ أَخْفَى مِنْ دَبِيْبِ النَّمْلَةِ، قَالُوْا: كَيْفَ نَنْجُوْ مِنْهُ يَا رَسُوْلَ الله! قَالَ: قُلِ اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ وَأَنَا أَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا أَعْلَمُ.
‘‘শির্ক এ উম্মতের মধ্যে লুক্কায়িত বা অস্পষ্ট যেমন লুক্কায়িত বা অস্পষ্ট পিপীলিকার চলন। সাহাবারা বললেন: হে আল্লাহ্’র রাসূল! তবে আমরা কিভাবে তা থেকে বাঁচতে পারি? তিনি বললেন: তুমি বলবে: হে আল্লাহ্! আমি আপনার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি জেনেবুঝে শির্ক করা থেকে। তেমনিভাবে আমি আপনার নিকট ক্ষমা চাচ্ছি আমার অজানা শির্ক থেকে’’। (আহমাদ : ৪/৪০৩ সা’হী’হুল্ জা’মি’, হাদীস ৩৭৩১)
যেমন: কোন আমল কাউকে দেখানোর উদ্দেশ্যে করা শির্ক।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُوْحَى إِلَيَّ، أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ، فَمَنْ كَانَ يَرْجُوْ لِقَآءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا، وَلَا يُشْرِكُ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا»
‘‘হে নবী! তুমি বলে দাও: আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ মাত্র। আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, নিশ্চয়ই তোমাদের মা’বূদই একমাত্র মা’বূদ। সুতরাং যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদাতে কাউকেও শরীক না করে’’।
(কাহ্ফ : ১১০)
যখন আল্লাহ্ তা‘আলা একক। তাঁর কোন শরীক নেই। তখন সকল ইবাদাতও একমাত্র তাঁরই জন্য হতে হবে। আর নেক আমল বলতে এমন আমলকেই বুঝানো হয় যা সম্পাদন করা হবে একমাত্র সুন্নাত ভিত্তিক এবং যা কাউকে দেখানোর জন্য সংঘটিত হবে না।
’উমর (রাঃ) আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট নিম্নোক্ত দো‘আ করতেন:
اللَّهُمَّ اجْعَلْ عَمَلِيْ كُلَّهُ صَالِحًا، وَاجْعَلْهُ لِوَجْهِكَ خَالِصًا، وَلَا تَجْعَلْ لِأَحَدٍ فِيْهِ شَيْئًا.
‘‘হে আল্লাহ্! আমার সকল আমল যেন নেক আমল হয় এবং তা যেন একমাত্র আপনারই জন্য হয়। উহার কিয়দংশও যেন আপনি ভিন্ন অন্য কারোর জন্য না হয়’’।
উক্ত শির্ক যে কোন আমলের সাওয়াব বিনষ্টকারী। বরং কখনো কখনো এ জাতীয় আমলকারীকে এ জন্য শাস্তির সম্মুখীনও হতে হবে। বিশেষ করে সে আমল যখন তার উপর ওয়াজিব হয়ে থাকে এবং শির্কযুক্ত হওয়ার দরুন তা আদায় বলে গণ্য না হয়। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা মানব জাতিকে একমাত্র খাঁটি আমল করারই আদেশ করেছেন। শির্ক মিশ্রিত আমলের নয়।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَمَآ أُمِرُوْا إلاَّ لِيَعْبُدُوْا اللهَ مُخْلِصِيْنَ لَهُ الدِّيْنَ حُنَفَآءَ»
‘‘তাদেরকে তো আদেশই করা হয়েছে যে, তারা একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলারই ইবাদাত করবে নিষ্ঠা ও ঈমানের সাথে এবং শির্কমুক্তভাবে’’।
(বাইয়িনাহ্ : ৫)
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
أَنَا أَغْنَى الشُّرَكَاءِ عَنِ الشِّرْكِ، مَنْ عَمِلَ عَمَلًا أَشْرَكَ فِيْهِ مَعِيْ غَيْـرِيْ، تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ.
‘‘আমি শরীকদের শির্ক তথা অংশীদারিত্ব থেকে মুক্ত। যে ব্যক্তি কোন আমলের মধ্যে আমার সাথে অন্য কাউকে শরীক করলো তখন আমি তাকেও প্রত্যাখ্যান করি এবং তার শির্ককেও’’। (মুসলিম ২৯৮৫)
উক্ত শির্ক (ইবাদাতের শির্ক) আবার দু’ প্রকার:
১. ক্ষমার অযোগ্য শির্ক।
২. ক্ষমাযোগ্য শির্ক।
প্রথম প্রকার আবার বৃহৎ এবং সর্ববৃহৎও হয়ে থাকে। যা বিনা তাওবায় কখনো ক্ষমা করা হয় না। যেমন: ভালোবাসার শির্ক, ভয়ের শির্ক, একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কাউকে সিজ্দাহ্ করার শির্ক, কা’বা শরীফ ছাড়া অন্য কোন গৃহ তাওয়াফের শির্ক, হাজরে আস্ওয়াদ্ ছাড়া অন্য কোন পাথর চুম্বন করার শির্ক ইত্যাদি ইত্যাদি।
দ্বিতীয় প্রকার হচ্ছে ছোট শির্ক। যা ক্ষমাযোগ্য। যেমন: শব্দ ও নিয়্যাতের শির্ক।
শির্কের মূল রহস্য কথা দু’টি:
১. আল্লাহ্ তা‘আলার কোন সৃষ্টিকে তাঁর সাথে তুলনা করা।
২. কোন বান্দাহ্ নিজকে আল্লাহ্ তা‘আলার ন্যায় মনে করা।
একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলাই লাভ-ক্ষতির মালিক। একমাত্র তিনিই কাউকে কোন কিছু দেন বা তা থেকে বঞ্চিত করেন। সুতরাং একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার নিকটই কোন কিছু চাইতে হবে। তাঁকেই ভয় করতে হবে এবং তাঁর নিকটই কোন কিছু কামনা করতে হবে। তাঁরই উপর ভরসা করতে হবে। যদি কেউ আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করলো অথবা অন্য কারো উপর ভরসা করলো তাহলে সে অবশ্যই ওব্যক্তিকে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে তুলনা করেই তা করলো।
আল্লাহ্ তা‘আলাই সকল গুণের একচ্ছত্র মালিক। সুতরাং সকল ইবাদাত তাঁরই জন্য হতে হবে। একান্ত সম্মান, ভয়, আশা, ভালোবাসা, নম্রতা, অধীনতা, তাওবা, দো‘আ, ভরসা, সাহায্য প্রার্থনা ও শপথ করা ইত্যাদি শরীয়তের দৃষ্টিকোণানুযায়ী বাধ্যতামূলকভাবে তাঁরই জন্য হতে হবে। মানুষের বিবেক এবং তার সহজাত প্রকৃতিও তা সমর্থন করে।
যে ব্যক্তি নিজকে বড় মনে করে মানুষের প্রশংসা, সম্মান, অধীনতা কামনা করে এবং সে চায় সকল মানুষ তাকেই ভয় করুক, তারই নিকট আশ্রয় কামনা করুক, তারই নিকট কোন কিছু আশা করুক, তারই নিকট সাহায্য প্রার্থনা করুক তাহলে সে অবশ্যই নিজকে প্রভুত্ব ও উপাসনায় আল্লাহ্ তা‘আলার সমপর্যায়ের মনে করেই তা করছে।
যদি কোন ছবিকারকে শুধু ছবি তৈরির মধ্যেই আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে সাদৃশ্যতার দরুন কিয়ামতের দিন সর্ববৃহৎ শাস্তির অধিকারী হতে হয় তা হলে যে ব্যক্তি নিজকে প্রভুত্ব ও উপাসনায় আল্লাহ্ তা‘আলার সমপর্যায়ের মনে করে তার শাস্তি বাস্তবে কি হতে পারে তা আল্লাহ্ তা‘আলাই ভালো জানেন।
আব্দুল্লাহ্ বিন্ মাস’ঊদ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
إِنَّ أَشَدَّ النَّاسِ عَذَابًا يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْـمُصَوِّرُوْنَ.
‘‘নিশ্চয়ই কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তির অধিকারী হবে ছবিকাররা’’। (বুখারী ৫৯৫০; মুসলিম ২১০৯)
যদি কোন মানুষ শাহানশাহ্ নামী হওয়ার দরুন কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট সর্বনিকৃষ্ট এবং সে জন্য তাঁর কোপানলে পতিত হতে হয় তাহলে যে ব্যক্তি নিজকে প্রভুত্ব ও উপাসনায় আল্লাহ্ তা‘আলার সমপর্যায়ের মনে করে তার শাস্তি বাস্তবে কি হতে পারে তা আল্লাহ্ তা‘আলাই ভালো জানেন।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
أَغْيَظُ رَجُلٍ عَلَى اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَأَخْبَثُهُ وَأَغْيَظُهُ عَلَيْهِ رَجُلٌ كَانَ يُسَمَّى مَلِكَ الْأَمْلَاكِ، لَا مَلِكَ إِلاَّ اللهُ.
‘‘কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট সর্বনিকৃষ্ট এবং সে জন্য তাঁর কোপানলে পতিত সে ব্যক্তি যার নাম শাহেনশাহ্ বা রাজাধিরাজ। কারণ, সত্যিকারের রাজা বা সমরাট তো একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলাই’’। (মুসলিম ২১৪৩)
উক্ত আলোচনার পাশাপাশি আরেকটি গূঢ় রহস্যের কথা আমাদেরকে ভালোভাবে জানতে হবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট সর্ববৃহৎ গুনাহ্ হচ্ছে তাঁর সম্পর্কে খারাপ ধারণা করা।
আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর শানে খারাপ ধারণাকারীদের সম্পর্কে বলেন:
«عَلَيْهِمْ دَآئِرَةُ السَّوْءِ وَغَضِبَ اللهُ عَلَيْهِمْ وَلَعَنَهُمْ وَأَعَدَّ لَـهُمْ جَهَنَّمَ وَسَآءَتْ مَصِيْرًا»
‘‘অমঙ্গল চক্র তাদের জন্যই। আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের প্রতি রুষ্ট হয়েছেন এবং তাদেরকে অভিসম্পাত করেছেন। উপরন্তু তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন জাহান্নাম এবং ওটা কতইনা নিকৃষ্ট গন্তব্য’’। (ফাত্হ : ৬)
যারা আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করে এবং তিনি ও তাঁর বান্দাহ্’র মাঝে কাউকে মাধ্যম স্থির করে তারা নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলার শানে ভালো ধারণা রাখে না। সুতরাং ইসলামী শরীয়ত কখনো আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর বান্দাহ্’র মাঝে কোন মাধ্যম স্বীকার করতে পারে না। মানব প্রকৃতি এবং তার বিবেকও তা সম্ভব বলে মনে করতে পারে না।
ইব্রাহীম (আঃ) তাঁর উম্মতকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
«مَا ذَا تَعْبُدُوْنَ، أَئِفْكًا آلِهَةً دُوْنَ اللهِ تُرِيْدُوْنَ، فَمَا ظَنُّكُمْ بِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ»
‘‘তোমরা কিসের পূজা করছো? তোমরা কি আল্লাহ্ তা‘আলার পরিবর্তে কতক অলীক মা’বূদকেই চাচ্ছো? জগতপ্রতিপালক সম্পর্কে তোমাদের ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। তোমাদের ধারণা কি এই যে, তিনি তোমাদেরকে এমনিতেই ছেড়ে দিবেন? তা অবশ্যই নয়’’। (সা’ফ্ফাত : ৮৫-৮৭)
কোন মালিকই নিজ ভৃত্যকে তার কোন নিজস্ব অধিকারের অংশীদার মনে করতে কখনোই রাজি নয়। সুতরাং যারা কোন মানুষকে আল্লাহ্ তা‘আলার নিজস্ব অধিকারের অংশীদার মনে করে তার জন্য তা ব্যয় করে তারা কিছুতেই আল্লাহ্ তা‘আলার সঠিক সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখেনি।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«ضَرَبَ لَكُمْ مَّثَلًا مِّنْ أَنْفُسِكُمْ هَلْ لَكُمْ مِّنْ مَّا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ مِّنْ شُرَكَآءَ فِيْ مَا رَزَقْنَاكُمْ فَأَنْتُمْ فِيْهِ سَوَآءٌ، تَخَافُوْنَهُمْ كَخِيْفَتِكُمْ أَنْفُسَـكُمْ، كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَّعْقِلُوْنَ»
‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন, তোমাদেরকে আমি যে রিযিক দিয়েছি তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের কেউ কি তাতে তোমাদের সমান অংশীদার? ফলে তোমরা তাদেরকে সেরূপ ভয় করো যেরূপ তোমরা পরস্পরকে ভয় করো। আমি এভাবেই বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শনাবলী বিবৃত করি’’। (রূম : ২৮)
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:
«يَآ أَيُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوْا لَهُ، إِنَّ الَّذِيْنَ تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ لَنْ يَّخْلُقُوْا ذُبَابًا وَلَوِ اجْتَمَعُوْا لَهُ، وَإِنْ يَّسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئًا لاَّ يَسْتَنْقِذُوْهُ مِنْهُ، ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْـمَطْلُوْبُ، مَا قَدَرُوْا اللهَ حَقَّ قَدْرِهِ، إِنَّ اللهَ لَقَوِيٌّ عَزِيْزٌ»
‘‘হে মানব সকল! একটি উপমা দেয়া হচ্ছে। খুব মনোযোগ দিয়ে তোমরা তা শ্রবণ করো। তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার পরিবর্তে যাদেরকে ডাকছো তারা সবাই একত্রিত হয়েও একটি মাছি পর্যন্ত তৈরি করতে পারবে না। এমনকি কোন মাছি যদি তাদের সম্মুখ থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয় তারা তাও উদ্ধার করতে পারবে না। পূজারী ও দেবতা কতই না দূর্বল। বস্ত্তত: তারা আল্লাহ্ তা‘আলার যথোচিত সম্মান রক্ষা করেনি। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমতাবান ও পরাক্রমশালী’’। (হাজ্জ : ৭৩-৭৪)
যারা পীর-বুযুর্গ পূজা করে তাদের পীর-বুযুর্গ একটি মাছিও বানাতে সক্ষম নয়। সুতরাং তারা আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর বান্দাহ্’র মাঝে ওদেরকে মাধ্যম মেনে সত্যিকারার্থে আল্লাহ্ তা‘আলাকেই অসম্মান করেছে। কারণ, তিনিই হচ্ছেন ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলের একমাত্র মালিক। সুতরাং সবাইকে সরাসরি তাঁরই শরণাপন্ন হতে হবে। অন্য কারোর নয়।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«وَمَا قَدَرُوْا اللهَ حَقَّ قَدْرِهِ، وَالْأَرْضُ جَمِيْعًا قَبْضَتُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ، وَالسَّمَاوَاتُ مَطْوِيَّاتٌ بِيَمِيْنِهِ، سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُوْنَ»
‘‘তারা আল্লাহ্ তা‘আলার যথোচিত সম্মান করেনি; অথচ কিয়ামতের দিন সমস্ত পৃথিবী থাকবে তাঁরই মুষ্টিতে এবং আকাশমন্ডলও আবদ্ধ থাকবে তাঁরই ডান হাতে। তিনি পবিত্র ও সুমহান তাদের শির্ক থেকে’’। (যুমার : ৬৭)
যারা মনে করে, আল্লাহ্ তা‘আলা কোন রাসূল পাঠাননি এবং কোন কিতাবও অবতীর্ণ করেননি। প্রতিটি ব্যক্তিই স্বাধীন। সে যাচ্ছেতাই আচরণ করবে। তারা সত্যিই আল্লাহ্ তা‘আলাকে অসম্মান করেছে।
যারা আল্লাহ্ তা‘আলার সুন্দর গুণাবলীর সরাসরি অর্থে বিশ্বাসী নয় এবং যারা মনে করে, তিনি শুনেন না, দেখেন না, কোন কিছুর ইচ্ছেও করেন না, তাঁর কোন স্বাধীনতা নেই, তিনি সকল সৃষ্টির উপরে নন। বরং তিনি সর্বস্থানে বিরাজমান, তিনি যখন ইচ্ছে এবং যার সাথে ইচ্ছে কথা বলেন না এবং সকল মানব কর্মকান্ড তাঁর ইচ্ছে, ক্ষমতা ও সৃষ্টির বাইরে তারা সবাই নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলাকে অসম্মান করেছে।
যারা মনে করে, মানুষ যা করে তা সে একান্ত বাধ্য হয়েই করে। তাতে তার কোন স্বাধীনতা নেই। অতএব মানুষ যা করেছে তা পরোক্ষভাবে আল্লাহ্ই করেছেন। তবুও আল্লাহ্ তা‘আলা খারাপ কাজের জন্য পরকালে বান্দাহ্কে শাস্তি দিবেন তারাও সত্যিকারার্থে আল্লাহ্ তা‘আলাকে অসম্মান করেছে।
যারা আল্লাহ্ তা‘আলাকে সর্বস্থানে মনে করে। এমনকি টয়লেট এবং সকল অপবিত্র স্থানেও। যারা আল্লাহ্ তা‘আলাকে নিজ আর্শে ‘আযীমে সমাসীন বলে মনে করে না তারাও নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলাকে অসম্মান করেছে।
যারা মনে করে, বাস্তবার্থে আল্লাহ্ তা‘আলা কাউকে ভালোবাসেন না, কারো প্রতি দয়া করেন না, কারো উপর সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হন না, তাঁর কোন কাজের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকে না, তিনি সরাসরি কোন কাজ করেন না। অতএব তিনি আর্শে সমাসীন নন, রাত্রের শেষ তৃতীয়াংশে প্রথম আকাশে অবতরণ করেন না, মূসা (আঃ) এর সাথে তিনি ত্বূর পাহাড়ের দিক থেকে কথা বলেননি, কিয়ামতের দিন তিনি নিজ বান্দাহ্দের মধ্যে ফায়সালা করার জন্যে আসবেন না তারাও তাঁকে অসম্মান করেছে।
যারা মনে করে, আল্লাহ্ তা‘আলার স্ত্রী-সন্তান আছে, তিনি তাঁর খাছ বান্দাহ্দের মধ্যে ঢুকে পড়েন। যেমন: সূফী মান্সূর হাল্লাজ অথবা আল্লাহ্ তা‘আলা দুনিয়ার সকল বস্ত্তর মাঝে বিরাজমান তারাও আল্লাহ্ তা‘আলাকে অসম্মান করেছে।
যারা মনে করে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর রাসূল ও তদীয় পরিবারবর্গের শত্রুদেরকে সম্মান দিয়েছেন, তাদেরকে রাসূলের মৃত্যুর পরপরই মুসলিম বিশ্বের খিলাফত ও রাষ্ট্র দিয়েছেন এবং তাঁর রাসূল ও তদীয় পরিবারবর্গ প্রেমীদেরকে তথা শিয়াদেরকে অসম্মান ও লাঞ্ছিত করেছেন তারাও আল্লাহ্ তা‘আলাকে অসম্মান করেছে।
উক্ত বিশ্বাস ইহুদী ও খ্রিস্টান থেকে চয়িত। তারাও আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে মনে করতো, তিনি একদা এক যালিম রাষ্ট্রপতি তথা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে পাঠিয়েছেন। যে মিথ্যাভাবে নবী হওয়ার দাবি করেছে। এমনকি সে দীর্ঘদিন বেঁচেও ছিলো। সর্বদা মিথ্যা কথা বলতো। বলতো: আল্লাহ্ তা‘আলা এ কথা বলেছেন, এ কাজের আদেশ করেছেন, এ কাজ থেকে নিষেধ করেছেন, পূর্বের সকল নবী ও রাসূলদের শরীয়তকে রহিত করেছেন, আল্লাহ্ তা‘আলা সে ও তার অনুসারীদের জন্য পূর্বের সকল নবী ও রাসূলদের অনুসারী হওয়ার এ যুগের দাবিদারদের জান, মাল ও স্ত্রী-সন্তান হালাল করে দিয়েছেন, এতদসত্ত্বেও আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে সার্বিকভাবে সাহায্য করেছেন, তার সকল দো‘আ কবুল করেছেন, তার শত্রুদের উপর তাকে জয়ী করেছেন।
যারা মনে করে, পরকালে আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর খাঁটি ওলীদেরকে শাস্তি ও জাহান্নাম এবং তাঁর শত্রুদেরকে তিনি শান্তি ও জান্নাত দিতে পারেন। উভয়ই তাঁর নিকট সমান। কুর‘আন ও হাদীসে এ ব্যাপারে যা রয়েছে তা সংবাদ মাত্র। তিনি এর উল্টাও করতে পারেন। অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদের মধ্যে এ জাতীয় চিন্তা-চেতনার কঠোর নিন্দা করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«أَمْ نَجْعَلُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ كَالْـمُفْسِدِيْنَ فِيْ الْأَرْضِ، أَمْ نَجْعَلُ الْـمُتَّقِيْنَ كَالْفُجَّارِ»
‘‘কাফিররা কি এমন ধারণা করে যে, যারা আমার উপর ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে এবং যারা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, তেমনিভাবে যারা আমাকে কঠিন ভয় করে এবং যারা অপরাধী তাদের সকলকে আমি সমপর্যায়ের মনে করবো? কখনোই তা হতে পারে না’’। (সোয়াদ্ : ২৮)
তিনি আরো বলেন:
«أَمْ حَسِبَ الَّذِيْنَ اجْتَرَحُوْا السَّيِّئَاتِ أَنْ نَّجْعَلَهُمْ كَالَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ، سَوَآءً مَّحْيَاهُمْ وَمَمَاتُهُمْ، سَآءَ مَا يَحْكُمُوْنَ، وَخَلَقَ اللهُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ، وَلِتُجْزَى كُلُّ نَفْسٍ بِمَا كَسَبَتْ وَهُمْ لَا يُظْلَمُوْنَ»
‘‘দুষ্কৃতীরা কি মনে করে যে, আমি তাদেরকে জীবন ও মৃত্যুর দিক দিয়ে ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের ন্যায় মনে করবো। তা কখনোই হতে পারে না। বরং তাদের উক্ত সিদ্ধান্ত কতইনা মন্দ। আল্লাহ্ তা‘আলা আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবীকে তৈরি করেছেন যথার্থভাবে এবং (তাতে প্রত্যেককে কর্ম স্বাধীনতাও দিয়েছেন) যেন প্রত্যেককে তার কর্মানুযায়ী ফলাফল দেয়া যেতে পারে এবং তাদের প্রতি এতটুকুও যুলুম করা হবে না’’। (জা’সিয়াহ্ : ২১-২২)
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:
«أَفَنَجْعَلُ الْـمُسْلِمِيْنَ كَالْـمُجْرِمِيْنَ، مَا لَكُمْ كَيْفَ تَحْكُمُوْنَ»
‘‘আমি কি আত্মসমর্পণকারীদেরকে অপরাধীদের ন্যায় মনে করবো? তোমাদের কি হয়েছে? তোমাদের এ কেমন সিদ্ধান্ত’’। (ক্বালাম : ৩৫-৩৬)
যারা মনে করে, আল্লাহ্ তা‘আলা মৃতদেরকে পুনরুজ্জীবিত করবেন না। যে দিন আল্লাহ্ তা‘আলা সৎকর্মশীলদেরকে পুরস্কৃত করবেন এবং অপরাধীদেরকে শাস্তি দিবেন। অত্যাচারী থেকে অত্যাচারিতের অধিকার আদায় করবেন। যারা এ দুনিয়াতে তাঁর সন্তুষ্টির জন্য দু:সহ ক্লান্তি সহ্য করেছে তাদেরকে উপযুক্ত সম্মান করবেন। তারাও আল্লাহ্ তা‘আলাকে অসম্মান করেছে।
যারা আল্লাহ্ তা‘আলার আদেশ ও নিষেধ অমান্য করে, তাঁর অধিকার বিনষ্ট করে, তাঁর স্মরণ থেকে গাফিল থাকে, তাঁর সন্তুষ্টির পরিবর্তে নিজেদের প্রবৃত্তির সন্তুষ্টি কামনা করে, মানুষের আনুগত্য যাদের নিকট আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্যের চাইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ, যারা তাদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিকে অধিক মূল্যায়ন করে আল্লাহ্ তা‘আলার দৃষ্টির চাইতে, যারা মানুষকে লজ্জা করে; আল্লাহ্ তা‘আলাকে নয়, মানুষকে ভয় করে; নিজ প্রভুকে নয়, মানুষের সাথে সাধ্যমতো ভালো আচরণ করে; আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে নয়, যারা নিজ প্রয়োজনীয় কাজ বাদ দিয়েও খুব মনোযোগ সহকারে অন্য মানুষের পূজা করে; কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলার ইবাদাতে তাদের মন এতটুকুও বসে না তারাও আল্লাহ্ তা‘আলাকে অসম্মান করেছে।
যারা আল্লাহ্ তা‘আলার চরম অবাধ্য শয়তান ইবলিসকে তাঁর সাথে সম্মান, আনুগত্য, অধীনতা, ভয় ও আশায় শরীক করেছে তারাও আল্লাহ্ তা‘আলাকে অসম্মান করেছে। কারণ, মানুষ দুনিয়াতে আললাহ্ তা‘আলা ছাড়া যারই ইবাদাত করুক না কেন তা পরোক্ষভাবে শয়তানের ইবাদাত বলেই গণ্য। যেহেতু মূল পলিসিদাতা সেই।
তাই আল্লাহ্ তা‘আলা যথার্থই বলেছেন:
«أَلَمْ أَعْهَدْ إِلَيْكُمْ يَا بَنِيْ آدَمَ أَنْ لاَّ تَعْبُدُوْا الشَّيْطَانَ، إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِيْنٌ»
‘‘হে আদম সন্তান! আমি কি তোমাদেরকে নির্দেশ দেইনি যে, তোমরা শয়তানের পূজা করো না। কারণ, সে হচ্ছে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু’’। (ইয়াসীন : ৬০)
উক্ত দীর্ঘ আলোচনা থেকে আমরা সুস্পষ্টভাবে নিম্ন বিষয়গুলো জানতে পারলাম:
ক. কেনই বা শির্ক সর্ববৃহৎ গুনাহ্।
খ. কেনই বা আল্লাহ্ তা‘আলা তা তাওবা ব্যতীত কখনোই ক্ষমা করবেন না।
গ. মুশ্রিক ব্যক্তি কেনই বা জাহান্নামে চিরকাল থাকবে। কখনোই সে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে না।
ঘ. আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর বান্দাহ্’র মাঝে কেনই বা মাধ্যম গ্রহণ করা নিষিদ্ধ হবে। যা দুনিয়ার নীতিতে নিষিদ্ধ নয়।
উক্ত কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বনাশা বলে আখ্যায়িত সাতটি কবীরা গুনাহ্’র সর্বশীর্ষে শির্কের কথাই উল্লেখ করেছেন।
আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
اِجْتَنِبُوْا السَّبْعَ الْـمُوْبِقَاتِ، قَالُوْا: يَا رَسُوْلَ اللهِ! وَمَا هُنَّ؟ قَالَ: الشِّرْكُ بِاللهِ، وَالسِّحْرُ، وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْـحَقِّ، وَأَكْلُ الرِّبَا، وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيْمِ، وَالتَّوَلِّيْ يَوْمَ الزَّحْفِ، وَقَذْفُ الْـمُحْصَنَاتِ الْـمُؤْمِنَاتِ الْغَافِلَاتِ.
‘‘তোমরা বিধ্বংসী সাতটি গুনাহ্ থেকে বিরত থাকো। সাহাবারা বললেন: হে আলাহ্’র রাসূল! ওগুলো কি? তিনি বলেন: আলাহ্ তা‘আলার সাথে কাউকে অংশীদার করা, যাদু আদান-প্রদান, অবৈধভাবে কাউকে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতীম-অনাথের সম্পদ ভক্ষণ, সম্মুখযুদ্ধ থেকে পলায়ন এবং সতী-সাধ্বী মু’মিন মহিলাদের ব্যাপারে কুৎসা রটানো’’। (বুখারী ২৭৬৬, ৬৮৫৭; মুসলিম ৮৯)
নিম্নে উক্ত বিষয়সমূহের ধারাবাহিক বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করা হলো:
আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা। তা প্রতিপালন, উপাসনা, আল্লাহ’র নাম ও গুণাবলীর যে কোনটিরই ক্ষেত্রে হোক না কেন।
শির্ক নির্দ্বিধায় সকল গুনাহ্’র শীর্ষে অবস্থিত।
আবূ বাক্রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:
أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ؟ ثَلَاثًا، قَالُوْا: بَلَى يَا رَسُوْلَ اللهِ! قَالَ: الإِشْرَاكُ بِاللهِ..
‘‘আমি কি তোমাদেরকে বড় গুনাহ্’র কথা বলবো না? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত কথাটি সাহাবাদেরকে তিন বার জিজ্ঞাসা করেন। সাহাবারা বললেন: হ্যাঁ, বলুন হে আল্লাহ্’র রাসূল! তিনি বললেন: আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করা’’। (বুখারী ২৬৫৪, ৫৯৭৬; মুসলিম ৮৭)
শির্ক সকল ধরনের আমলকেই বিনষ্ট করে দেয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
«وَلَوْ أَشْرَكُوْا لَـحَبِطَ عَنْهُمْ مَّا كَانُوْا يَعْمَلُوْنَ»
‘‘তাঁরা (নবীগণ) যদি আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করতো তা হলে তাঁদের সকল আমল পন্ড হয়ে যেতো’’। (আন‘আম: ৮৮)
শির্ক আবার দু’ প্রকার: বড় শির্ক ও ছোট শির্ক। প্রকারদ্বয়ের বিস্তারিত আলোচনা আমাদেরই রচিত দু’ খন্ডে বিভক্ত ‘‘শির্ক: কি ও কত প্রকার’’ বইটিতে অচিরেই পাচ্ছেন। তবুও এ ব্যাপারে সর্ব সাধারণের কিঞ্চিত ধারণার জন্য তার ইঙ্গিতপূর্ণ সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে দেয়া হলো
উক্ত শির্ক এতে লিপ্ত যে কোন ব্যক্তিকে ইসলামের গন্ডী থেকেই বের করে দেয়। আল্লাহ্ তা‘আলা তাওবা ছাড়া এ ধরনের শির্ক কখনো ক্ষমা করবেন না।
তিনি বলেন:
«إِنَّ اللهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُّشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُوْنَ ذَلِكَ لِمَنْ يَّشَآءُ»
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা কখনো ক্ষমা করবেন না। তবে তিনি এ ছাড়া অন্যান্য সকল গুনাহ্ যাকে ইচ্ছে ক্ষমা করে দিবেন’’। (নিসা: ৪৮)
এ ধরনের শির্কে লিপ্ত ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম। জাহান্নামই হবে তার চিরস্থায়ী ঠিকানা।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
«إِنَّهُ مَنْ يُّشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ، وَمَا لِلظَّالِمِيْنَ مِنْ أَنْصَارٍ»
‘‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করে আল্লাহ তা‘আলা তার উপর জান্নাতকে হারাম করে দেন এবং জাহান্নামকে করেন তার চিরস্থায়ী ঠিকানা। আর এরূপ অত্যাচারীদের তখন আর কোন সাহায্যকারী থাকবে না’’। (মায়িদাহ: ৭২)
বড় শির্কগুলো সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নরূপ:
১. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কাউকে আহবান করার শির্ক।
২. বিপদের সময় একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর নিকট ফরিয়াদ করার শির্ক।
৩. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর নিকট আশ্রয় প্রার্থনার শির্ক।
৪. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর নিকট আশা ও বাসনার শির্ক।
৫. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর নিকট সাহায্য প্রার্থনার শির্ক।
৬. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য রুকু, সিজ্দাহ্, তার সামনে বিনম্রভাবে দাঁড়ানো, নামায ইত্যাদির শির্ক।
৭. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার ঘর কা’বাহ্ শরীফ ছাড়া অন্য কোন ঘর বা মাযারের তাওয়াফ করার শির্ক।
৮. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর নিকট তাওবাহ্ করার শির্ক।
৯. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য কোন পশু জবাইয়ের শির্ক।
১০. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য কোন কিছু মানত করার শির্ক।
১১. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর একচ্ছত্র আনুগত্য করার শির্ক।
১২. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কাউকে এককভাবে ভালোবাসার শির্ক।
১৩. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কাউকে এককভাবে ভয় করার শির্ক।
১৪. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরতা বা তাওয়াক্কুলের শির্ক।
১৫. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ কারোর জন্য কিয়ামতের দিন সুপারিশ করতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
১৬. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কেউ কাউকে হিদায়াত দিতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
১৭. কবর পূজার শির্ক।
১৮. আল্লাহ্ তা‘আলা নিজ সত্তা সহ সর্বস্থানে রয়েছেন এমন মনে করার শির্ক।
১৯. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়াও বিশ্ব পরিচালনায় অন্য কারোর হাত রয়েছে এমন মনে করার শির্ক।
২০. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়াও অন্য কোন ব্যক্তি বা দল শরীয়তের বিশুদ্ধ কোন প্রমাণ ছাড়া নিজ মেধা ও বুদ্ধির আলোকে কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের জন্য জীবন বিধান রচনা করতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
২১. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়াও কেউ কাউকে ধনী বা গরিব বানাতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
২২. কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা‘আলার কাছ থেকে কেউ কারোর গুনাহ্সমূহ ক্ষমা করিয়ে নিতে পারবে এমন মনে করার শির্ক।
২৩. কিয়ামতের দিন কেউ কাউকে আল্লাহ্ তা‘আলার কঠিন আযাব থেকে রক্ষা করতে পারবে এমন মনে করার শির্ক।
২৪. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়াও অন্য কোন গাউস-ক্বুতুব দুনিয়া, আখিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম, লাওহ্, ক্বলম, ‘আর্শ, কুর্সী তথা সর্ব স্থানের সর্ব কিছু দেখে বা শুনে এমন মনে করার শির্ক।
২৫. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়াও অন্য কেউ গায়েব জানে বা কখনো কখনো তার কাশ্ফ হয় এমন মনে করার শির্ক।
২৬. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়াও অন্য কেউ কারোর অন্তরের লুক্কায়িত কথা বলে দিতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
২৭. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়াও অন্য কেউ কাউকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
২৮. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়াও অন্য কেউ কারোর অন্তরের সামান্যটুকু পরিবর্তন ঘটাতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
২৯. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার ঘর মসজিদ ছাড়াও অন্য কোন মাজারের খাদিম হওয়া যায় এমন মনে করার শির্ক।
৩০. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছা ছাড়াও অন্য কারোর ইচ্ছা স্বকীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
৩১. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়াও কেউ কাউকে সন্তান-সন্ততি দিতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
৩২. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়াও কেউ কাউকে সুস্থতা দিতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
৩৩. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার তাওফীক ছাড়াও কেউ ইচ্ছে করলেই কোন নেক আমল করতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
৩৪. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছা ছাড়াও কেউ কারোর কোন লাভ বা ক্ষতি করতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
৩৫. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়াও কেউ কাউকে জীবন বা মৃত্যু দিতে পারে এমন মনে করার শির্ক।
৩৬. একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়াও অন্য কোন ব্যক্তি সর্বদা জীবিত রয়েছে বা থাকবে এমন মনে করার শির্ক।
ছোট শির্ক বলতে এমন কাজ ও কথাকে বুঝানো হয় যা তাতে লিপ্ত ব্যক্তিকে ইসলামের গন্ডী থেকে সম্পূর্ণরূপে বের করে দিবে না বটে। তবে তা কবীরা গুনাহ্ তথা মহা পাপ অপেক্ষা আরো জঘন্যতম।
আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
«فَلَا تَجْعَلُوْا لِلهِ أَنْدَادًا وَّأَنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ»
‘‘সুতরাং তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কাউকে শরীক করো না। অথচ তোমরা এ সম্পর্কে সম্যক অবগত রয়েছো’’। (বাক্বারাহ্ : ২২)
‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাস্ (রা.) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন:
الْأَنْدَادُ هُوَ الشِّرْكُ أَخْفَى مِنْ دَبِيْبِ النَّمْلِ عَلَى صَفَاةٍ سَوْدَاءَ فِيْ ظُلْمَةِ اللَّيْلِ، وَهُوَ أَنْ تَقُوْلَ: وَاللهِ وَحَيَاتِكِ يَا فُلَانَةَ! وَحَيَاتِيْ، وَتَقُوْلَ: لَوْلَا كَلْبَةٌ هَذِهِ لَأَتَانَا اللُّصُـوْصُ، وَلَوْلَا الْبَطُّ فِيْ الدَّارِ لَأَتَى اللُّصُوْصُ، وَقَوْلُ الرَّجُلِ لِصَاحِبِهِ: مَا شَاءَ اللهُ وَشِئْتَ، وَقَوْلُ الرَّجُلِ: لَوْلَا اللهُ وَفُلَانٌ، لَا تَجْعَلْ فِيْهَا فُلَانًا، هَذَا كُلُّهُ بِهِ شِرْكٌ.
‘‘‘আন্দাদ্’’ বলতে এমন শির্ককে বুঝানো হচ্ছে যা অন্ধকার রাতে কালো পাথরে পিঁপড়ার চলন চাইতেও সূক্ষ্ম। যা টের পাওয়া খুবই দুরূহ। যেমন: তোমার এ কথা বলা যে, হে অমুক! আল্লাহ্ তা‘আলা এবং তোমার ও আমার জীবনের কসম! অথবা এ কথা বলা যে, যদি এ কুকুরটা না হতো তা হলে (আজ রাত) চোর অবশ্যই আসতো। যদি ঘরে হাঁসগুলো না থাকতো তা হলে (আজ রাত) চোর অবশ্যই ঢুকতো অথবা কারোর নিজ সাথীকে এ কথা বলা যে, আল্লাহ্ তা‘আলা এবং তুমি না চাইলে কাজটা হতো না অথবা কারোর এ কথা বলা যে, আল্লাহ্ তা‘আলা এবং অমুক না থাকলে কাজটা হতো না। অমুক শব্দটি সাথে লাগাবে না। (বরং বলবে: আল্লাহ্ তা‘আলা যদি না চাইতেন কাজটা হতো না)। কারণ, এ সব কথা শির্কের অন্তর্গত’’।
ছোট শির্কগুলো সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নরূপ:
১. কোন বিপদাপদ থেকে বাঁচার জন্য সুতা বা রিং পরার শির্ক।
২. শির্ক মিশ্রিত মন্ত্র দ্বারা ঝাড়-ফুঁকের শির্ক।
৩. তাবিজ-কবচের শির্ক।
৪. শরীয়ত অসম্মত বস্ত্ত বা ব্যক্তি কর্তৃক বরকত গ্রহণের শির্ক।
৫. যাদুর শির্ক।
৬. ভাগ্য গণনার শির্ক।
৭. জ্যোতিষীর শির্ক।
৮. চন্দ্র বা অন্য কোন গ্রহের অবস্থানক্ষেত্রের পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টি হয় এমন মনে করার শির্ক।
৯. আল্লাহ্ তা‘আলার যে কোন নিয়ামত অস্বীকার করার শির্ক।
১০. কোন প্রাণীর বিশেষ কোন আচরণে অমঙ্গলের আশংকা রয়েছে এমন মনে করার শির্ক।
১১. শরীয়ত অসম্মত কোন বস্তু বা ব্যক্তির ওয়াসীলা ধরার শির্ক।
১২. নামায ত্যাগের শির্ক।
১৩. আল্লাহ্ তা‘আলা এবং তুমি না চাইলে কাজটা হতো না এমন বলার শির্ক।
১৪. আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি বা বস্ত্তর নামে কসম খাওয়ার শির্ক।
১৫. যুগ বা বাতাসকে গালি দেয়ার শির্ক।
১৬. কোন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ‘‘যদি এমন করতাম তা হলে এমন হতো না’’ বলার শির্ক।
১৭. কোন নেক আমল দুনিয়া কামানোর নিয়্যাতে করার শির্ক।
১৮. কোন নেক আমল আল্লাহ্ ভিন্ন অন্য কারোর সন্তুষ্টির জন্য করার শির্ক।
১৯. কোন নেক আমল কাউকে দেখানো বা শুনানোর জন্য করার শির্ক।
ছোট শির্ক ও বড় শিরকের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি পার্থক্য রয়েছে যা নিম্নরূপ:
১. বড় শির্ক তাতে লিপ্ত ব্যক্তিকে ইসলামের গন্ডী থেকেই সম্পূর্ণরূপে বের করে দেয়। ঠিক এরই বিপরীতে ছোট শির্ক এমন নয় বটে। তবে তা কবীরা গুনাহ্ তথা মহা পাপ অপেক্ষা আরো জঘন্যতম।
২. বড় শির্ক তাতে লিপ্ত ব্যক্তির সকল নেক আমলকে বিনষ্ট করে দেয়। ঠিক এরই বিপরীতে ছোট শির্ক শুধু সে আমলকেই বিনষ্ট করে যে আমলে এ জাতীয় শির্কের সংমিশ্রণ রয়েছে। অন্য আমলকে নয়।
৩. বড় শির্ক তাতে লিপ্ত ব্যক্তির জান ও মাল তথা সার্বিক নিরাপত্তা বিনষ্ট করে দেয়। ঠিক এরই বিপরীতে ছোট শির্ক এমন নয়।
৪. বড় শির্কে লিপ্ত ব্যক্তি চিরকালের জন্য জাহান্নামী হয়ে যায়। জান্নাত তার জন্য হারাম। তবে ছোট শির্কে লিপ্ত ব্যক্তি এমন নয়। বরং সে কিছু দিনের জন্য জাহান্নামে গেলেও পরবর্তীতে তাকে জাহান্নাম থেকে চিরতরে মুক্তি দেয়া হবে।
৫. বড় শির্কে লিপ্ত ব্যক্তির সাথে কোন ধরনের সম্পর্ক রাখা যাবে না। বরং তার সাথে সকল ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। যদিও সে নিকট আত্মীয় হোক না কেন। তবে ছোট শির্কে লিপ্ত ব্যক্তি এমন নয়। বরং তার সাথে সম্পর্ক ততটুকুই রাখা যাবে যতটুকু তার ঈমান রয়েছে। তেমনিভাবে তার সাথে ততটুকুই সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে যতটুকু তার মধ্যে শির্ক রয়েছে।