এ পর্যায় খুবই কঠিন। কারণ, মানুষের মনই হচ্ছে ন্যায়-অন্যায়ের একমাত্র উৎস। মানুষের ইচ্ছা, স্পৃহা, আশা ও প্রতিজ্ঞা মনেরই সৃষ্টি। সুতরাং যে ব্যক্তি নিজ মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে সে নিজ কুপ্রবৃত্তির উপর বিজয় লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি নিজ মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না নিশ্চিতভাবে সে কুপ্রবৃত্তির শিকার হবে। পরিশেষে তার ধ্বংস একেবারেই অনিবার্য।
মানুষের মনোভাবই পরিশেষে দুরাশার রূপ নেয়। মনের দিক থেকে সর্বনিকৃষ্ট ব্যক্তি সে যে দুরাশায় সন্তুষ্ট। কারণ, দুরাশাই হচ্ছে সকল ধরনের আলস্য ও বেকারত্বের পুঁজি। এটিই পরিশেষে লজ্জা ও আফসোসের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দুরাশাগ্রস্ত ব্যক্তি আলস্যের কারণে যখন বাস্তবতায় পৌঁছুতে পারে না তখনই তাকে শুধু আশার উপরই নির্ভর করতে হয়। মূলতঃ বাস্তববাদী হওয়াই একমাত্র সাহসীর পরিচয়।
মানুষের ভালো মনোভাব আবার চার প্রকার:
১. দুনিয়ার লাভার্জনের মনোভাব।
২. দুনিয়ার ক্ষতি থেকে বাঁচার মনোভাব।
৩. আখিরাতের লাভার্জনের মনোভাব।
৪. আখিরাতের ক্ষতি থেকে বাঁচার মনোভাব।
নিজ মনোভাবকে উক্ত চারের মধ্যে সীমিত রাখাই যে কোন মানুষের একান্ত কর্তব্য। এগুলোর যে কোনটিই মনে জাগ্রত হলে তা অতি তাড়াতাড়ি কাজে লাগানো উচিৎ। আর যখন এগুলোর সব কটিই মনের মাঝে একত্রে জাগ্রত হয় তখন সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণটিকেই প্রাধান্য দিতে হবে। যা এখনই না করলে পরে করা আর সম্ভবপর হবে না।
কখনো এমন হয় যে, অন্তরে একটি প্রয়োজনীয় কাজের মনোভাব জাগ্রত হলো যা পরে করলেও চলে; অথচ এরই পাশাপাশি আরেকটি এমন কাজের মনোভাবও অন্তরে জন্মালো যা এখনই করতে হবে। না করলে তা পরবর্তীতে কখনোই করা সম্ভবপর হবে না। তবে কাজটি এতো প্রয়োজনীয় নয়। এ ক্ষেত্রে আপনাকে প্রয়োজনীয় বস্ত্তটিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। কেউ কেউ অপরটিকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন যা শরীয়তের মৌলিক নীতি পরিপন্থী।
তবে সর্বোৎকৃষ্ট চিন্তা ও মনোভাব সেটিই যা একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টি কিংবা পরকালের জন্যই হবে। এ ছাড়া যত চিন্তা-ভাবনা রয়েছে তা হচ্ছে শয়তানের ওয়াস্ওয়াসা অথবা ভ্রান্ত আশা।
যে চিন্তা-ফিকির একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য তা আবার কয়েক প্রকার:
১. কুর‘আন মাজীদের আয়াতসমূহ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং তাতে নিহিত আল্লাহ্ তা‘আলার মূল উদ্দেশ্য বুঝতে চেষ্টা করা।
২. দুনিয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলার যে প্রকাশ্য নিদর্শনসমূহ রয়েছে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা। এরই মাধ্যমে আল্লাহ্ তা‘আলার নাম ও গুণাবলী, কৌশল ও প্রজ্ঞা, দান ও অনুগ্রহ বুঝতে চেষ্টা করবে। কুর‘আন মাজীদে আল্লাহ্ তা‘আলা এ ব্যাপারে মানুষকে মনোনিবেশ করার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন।
৩. মানুষের উপর আল্লাহ্ তা‘আলার যে অপার অনুগ্রহ রয়েছে তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। তাঁর দয়া, ক্ষমা ও ধৈর্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা।
উক্ত ভাবনাসমূহ মানুষের অন্তরে আল্লাহ্ তা‘আলার একান্ত পরিচয়, ভয়, আশা ও ভালোবাসার জন্ম দেয়।
৪. নিজ অন্তর ও আমলের দোষ-ত্রুটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। এতদ্ চিন্তা-চেতনা খুবই কল্যাণকর। বরং একে সকল কল্যাণের সোপানই বলা চলে।
৫. সময়ের প্রয়োজন ও নিজ দায়িত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। সত্যিকার ব্যক্তি তো সেই যে নিজ সময়ের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
ইমাম শাফি’য়ী (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: আমি সূফীদের নিকট মাত্র দু’টি ভালো কথাই পেয়েছি। যা হচ্ছে: তারা বলে থাকে, সময় তলোয়ারের ন্যায়। তুমি তাকে ভালো কাজে নি:শেষ করবে। নতুবা সে তোমাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করবে। তারা আরো বলে, তুমি অন্তরকে ভালো কাজে লাগাবে। নতুবা সে তোমাকে খারাপ কাজেই লাগাবে।
মনে কোন চিন্তা-ভাবনার উদ্রেক তা ভালো অথবা খারাপ যাই হোক না কেন দোষের নয়। বরং দোষ হচ্ছে খারাপ চিন্তা-চেতনাকে মনের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ স্থান দেয়া। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে দু’টি চেতনা তথা প্রবৃত্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যার একটি ভালো অপরটি খারাপ। একটি সর্বদা একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টিই কামনা করে। পক্ষান্তরে অন্যটি গায়রুল্লাহ্’র সন্তুষ্টিই কামনা করে। ভালোটি অন্তরের ডানে অবস্থিত যা ফেরেশতা কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। অপরটি অন্তরের বামে অবস্থিত যা শয়তান কর্তৃক নিয়ন্তিত। পরস্পরের মধ্যে সর্বদা যুদ্ধ ও সংঘর্ষ অব্যাহত। কখনো এর জয় আবার কখনো ওর জয়। তবে সত্যিকারের বিজয় ধারাবাহিক ধৈর্য, সতর্কতা ও আল্লাহ্ভীরুতার উপরই নির্ভরশীল।
অন্তরকে কখনো খালি রাখা যাবে না। ভালো চিন্তা-চেতনা দিয়ে ওকে ভর্তি রাখতেই হবে। নতুবা খারাপ চিন্তা-চেতনা তাতে অবস্থান নিবেই। সূফীবাদীরা অন্তরকে কাশ্ফের জন্য খালি রাখে বিধায় শয়তান সুযোগ পেয়ে তাতে ভালোর বেশে খারাপের বীজ বপন করে। সুতরাং অন্তরকে সর্বদা ধর্মীয় জ্ঞান ও হিদায়াতের উপকরণ দিয়ে ভর্তি রাখতেই হবে।