জ্বিন ও শয়তানের অস্তিত্বের প্রমাণঃ জ্বিন ও যাদুর মাঝে গভীর সম্পর্ক রয়েছে; বরং জ্বিন ও শয়তানই হল মূলতঃ যাদুর প্রধান চালিকা শক্তি। কতিপয় লোক জ্বিনের অস্তিত্বের বিষয়টি অস্বীকার করেছে এবং যাদুও অস্বীকার করেছে। তাই আমি এখানে এসবের অস্তিত্বের প্রমাণসমূহ উপস্থাপন করবঃ

প্রথমঃ কুরআন দ্বারা প্রমাণঃ

১। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَإِذْ صَرَفْنَا إِلَيْكَ نَفَرًا مِنَ الْجِنِّ يَسْتَمِعُونَ الْقُرْآنَ

অর্থ “স্মরণ কর, আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট করেছিলাম একদল জিনকে, যারা কুরআন পাঠ শুনছিল। (সূরা আহকাফঃ ২৯)

২। আল্লাহ তায়ালার বাণীঃ

يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ أَلَمْ يَأْتِكُمْ رُسُلٌ مِنْكُمْ يَقُصُّونَ عَلَيْكُمْ آيَاتِي وَيُنْذِرُونَكُمْ لِقَاءَ يَوْمِكُمْ هَٰذَا

অর্থঃ “হে জ্বিন ও মানব জাতি! তোমাদের কাছে কি তোমাদের মধ্য হতেই নবী রাসূল আসেনি, যারা তোমাদের কাছে আমার আয়াতসমূহ বর্ণনা করতো এবং আজকের দিনের সাথে তোমাদের সাক্ষাত হওয়ার ভীতি প্রদর্শন করতো?” (সূরা আনআমঃ ১৩০)

৩। অন্যত্র আল্লাহ বলেনঃ

يَا مَعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ إِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ تَنْفُذُوا مِنْ أَقْطَارِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ فَانْفُذُوا لَا تَنْفُذُونَ إِلَّا بِسُلْطَانٍ

অর্থঃ “হে জিন ও মানুষ সম্প্রদায় আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সীমা তোমরা যদি অতিক্রম করতে পার, অতিক্রম কর; কিন্তু তোমরা তা পারবে না, শক্তি ব্যতিরেকে।" (সূরা রহমানঃ ৩৩)

৪। আল্লাহ বলেনঃ

قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِنَ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا

অর্থঃ “বলঃ আমার প্রতি অহী প্রেরিত হয়েছে যে, জীনদের একটি দল

মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে এবং বলেছেঃ আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি।" (সূরা জিনঃ ১)

৫ । মহান আল্লাহ বলেনঃ

وَأَنَّهُ كَانَ رِجَالٌ مِنَ الْإِنْسِ يَعُوذُونَ بِرِجَالٍ مِنَ الْجِنِّ فَزَادُوهُمْ رَهَقًا

অর্থঃ “আর কতিপয় মানুষ কতক জিনের আশ্রয় প্রার্থনা করতো, ফলে তারা জিনদের আত্ম গৌরব বাড়িয়ে দিতো।” (সূরা জিনঃ ৬)

৬। আল্লাহ বলেনঃ

إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلَاةِ فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ

অর্থঃ "শয়তান তো এটাই চায় যে, মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শক্রতা ও হিংসা সৃষ্টি করে এবং আল্লাহর স্মরণ হতে ও নামায হতে তোমাদেরকে বিরত রাখে, সুতরাং এখনও কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না?" (সূরা আল মায়েদাঃ ৯১)

৭। আল্লাহ বলেনঃ

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ وَمَنْ يَتَّبِعْ خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ فَإِنَّهُ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ

অর্থঃ “হে মুমিনগণ! তোমরা শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না; কেউ শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করলে শয়তান তো অশ্লীলতা ও মন্দ কাজের নির্দেশ দেয়।" (সূরা নূরঃ ২১)

কুরআনে এ সম্পর্কে অনেক প্রমাণাদি রয়েছে। আর একথা সকলেই জানে যে, কুরআনে কারীমে একটি সূরাই জ্বিন সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। আর প্রমাণের জন্য এটাই যথেষ্ট যে, জ্বিন একবচন শব্দটি কুরআনে কারীমে ২২ বার উল্লেখ করা হয়েছে। আর الجان “আল-জান” বহুবচন শব্দটি সাতবার এবং الشيطان শব্দটি ৬৮ বার আর (الشياطين) বহুবচন শব্দটি সতের বার বর্ণিত হয়েছে। মূলকথা জ্বিন ও শয়তান সম্পর্কে কুরআনে বহু আয়াত রয়েছে।

১। ইবনে মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ এক রাতে আমরা রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সাথে ছিলাম। অতঃপর আমরা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে হারিয়ে ফেললাম। এ ব্যাপারে আমরা উপত্যকায় এবং বিভিন্ন গোত্রে খোজতে লাগলাম; কিন্তু না পেয়ে আমরা ধারণা করলাম যে, হয়ত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে উধাও বা অপহরণ করা হয়েছে। এরপর সেই রাত খুব খারাপ রাত হিসেবে কাটালাম। যখন সকাল হল হঠাৎ দেখি হেরা গুহার দিক থেকে আসছেন। আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে আমরা না পেয়ে অনেক খোঁজা-খুঁজি করেছি তবুও আপনাকে পাইনি? এরপর রাতটি খুব খারাপ কাটিয়েছি।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ “জ্বিনের এক আহবায়ক আমার কাছে আসে এরপর আমি তার সাথে চলে গেলাম এবং তাদেরকে আমি কুরআনে কারম পড়ে শুনিয়েছি।”

বর্ণনাকারী বলেনঃ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে নিয়ে চললেন সেই স্থানে এবং সেখানে আমাদেরকে তিনি জ্বিন সম্প্রদায়ের নিদর্শনসমূহ ও তাদের আগুন জ্বালানোর চিহ্নসমূহ দেখালেন। তারা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-কে জিজ্ঞাসা করেন তাদের খাদ্য সম্পর্কে। তিনি উত্তরে বলেনঃ তোমাদের জন্য প্রত্যেক সেই হাড় যার উপর (যবাই করার সময়) আল্লাহর নাম নেয়া হয়েছে, তোমাদের হাতের কাছে থাকে যাতে মাংস না হয় এবং তোমাদের পশুর গোবর তা তোমাদের জন্যে খাদ্য।

অতঃপর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ “সুতরাং তোমরা তা দিয়ে এস্তেঞ্জা করো না। নিশ্চয় তা হলো তোমাদের ভাই জ্বিনদের খাদ্য।" (মুসলিমঃ ৪/১৭০)

২। আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেনঃ আমাকে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ “আমি লক্ষ্য করেছি যে, তুমি ছাগল এবং মরুভূমিকে পছন্দ কর। সুতরাং তুমি যখন ছাগলের সাথে মরুভূমিতে থাকবে তখন তুমি নামাযের জন্য আযান দিবে তখন আযানের ধ্বনি খুব উঁচু করবে। কেননা নিশ্চয়ই মুয়াজ্জিনের ধ্বনি জ্বিন, মানুষ এবং অন্য যারাই শুনবে কিয়ামতের দিন তার জন্যে সাক্ষ্য দিবে।" (মুয়াত্তা ইমাম মালেকঃ ১৬৮, বুখারীঃ ২/৩৪৩ ফাতহ, নাসায়ীঃ ২/১২ ও ইবনে মাজাহঃ ১২৩৯)

৩। ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) নিজ বর্ণনায় বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবাদের এক দলের সাথে উকাজ বাজারের দিকে রওয়ানা হন। ইতিমধ্যে শয়তানদের ও আকাশের খবরের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়, তাদের উপর তারকা অগ্নিশিখা বর্ষিত হয়। যার ফলে তারা স্বীয় জাতির নিকট ফিরে আসে। উপস্থিত শয়তানরা জিজ্ঞেস করেঃ তোমাদের কি হয়েছে? তারা উত্তর দেয়ঃ আমাদের ও আকাশের সংবাদের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের প্রতি তারকা অগ্নিশিখা বর্ষণ করা হয়েছে। তারা শুনে বলেঃ তোমাদের ও আকাশ সংবাদের মাঝে স্বাভাবিক কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি; বরং বড় ধরণের কিছু ঘটে গেছে। সুতরাং তোমরা বিশ্বের পূর্ব হতে পশ্চিম পর্যন্ত বিচরণ করে দেখ কি সে প্রতিবন্ধকতা যা তোমাদের ও আকাশ সংবাদের মাঝে ঘটে গেছে। অতএব তারা প্রস্থান করে তেহামা অভিমূখে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দিকে। এমতাবস্থায় তিনি উকাজ বাজার অভিমূখে যাত্রাকালে নাখলা উপত্যকায় সাহাবাদেরকে নিয়ে ফজর নামায আদায় করছেন। যখন শয়তানরা (ফজরের) কুরআন তেলাওয়াত শুনল, তখন তারা তা আরো মনযোগ দিয়ে শ্রবণ করা শুরু করল। অতঃপর তারা বললঃ আল্লাহর শপথ এটিই আমাদের ও আকাশ সংবাদের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সুতরাং তারা তখন সেখান হতে স্বীয় জাতির নিকট প্রত্যাবর্তন করে বলেঃ হে আমাদের জাতি আমরা নিশ্চয়ই এমন এক আশ্চর্য কুরআন শ্রবণ করেছি, যা সরল পথের দিশারী। সুতরাং তার প্রতি আমরা ঈমান এনে ফেলেছি। আর আমরা কখনও আমাদের প্রতিপালকের সাথে কাউকে শরীক করব না। এরপর আল্লাহ তার নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি অবতীর্ণ করেনঃ

قُلْ أُوحِيَ إِلَيَّ أَنَّهُ اسْتَمَعَ نَفَرٌ مِنَ الْجِنِّ فَقَالُوا إِنَّا سَمِعْنَا قُرْآنًا عَجَبًا

অর্থঃ “বলঃ আমার প্রতি অহী প্রেরিত হয়েছে যে, জীনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করেছে এবং বলেছেঃ আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি।" (সূরা জিনঃ ১)

নিশ্চয়ই তার প্রতি অবতীর্ণ হয় জিনের কথা । (বুখারীঃ ২/২৫৩ ফাতহ সহ ও মুসলিমঃ ৪/১৬৮ নববীসহ শব্দগুলি বুখারীর)

৪ । আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) স্বীয় বর্ণনায় বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ “ফেরেশতা জাতি সৃষ্টি হয় নূর হতে, আর জিনকে সৃষ্টি করা হয় অগ্নিশিখা হতে এবং আদমকে সৃষ্টি করা হয় তাই দিয়ে যা তোমাদেরকে বর্ণনা দেয়া হয়েছে।" (মুসনাদে আহমদঃ ৬/১৫৩, ১৬৮ ও মুসলিমঃ ১৮/১২৩ নববীসহ)

৫। সাফিয়া বিনতে হুয়াই (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বর্ণনা করেন যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ “নিশ্চয়ই শয়তান মানুষের শরীরে রক্তের মত চলাচল করে।" (বুখারীঃ ৪/২৮২ ফাতহ সহ, মুসলিমঃ ১৪/১৫৫ নববীসহ)

৬। আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ “যখন তোমাদের কেউ খাবার খাবে সে যেন ডান হাতে খায় এবং যখন পান করে তখন যেন ডান হাতেই

পান করে। কেননা নিশ্চয়ই শয়তান বাম হাতে খায় এবং বাম হাতেই পান করে।" (মুসলিমঃ ১৩/১৯১ নববীসহ)

৭। আবু হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তার বর্ণনায় বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ এমন কোন সন্তান জন্ম গ্রহণ করে না যাকে শয়তান আঘাত করে না। সুতরাং শয়তানের আঘাতের ফলে সে সন্তান জন্মের সময় চীৎকার করে। তবে ঈসা ও তার মাতা ব্যতীত।" (বুখারীঃ ৮/২১২ ফাতহসহ ও মুসলিমঃ ১৫/১২০ নববীসহ)

৮। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) তার বর্ণনায় বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নিকট এমন এক ব্যক্তির বর্ণনা দেয়া হল যে পূর্ণ রাত্রি সকাল পর্যন্ত ঘুমায়। তিনি বলেনঃ সে এমন ব্যক্তি যার উভয় কানে বা তার কানে শয়তান পেশাব করে ফেলে। (বুখারীঃ ৩/২৮ ফাতহসহ ও মুসলিমঃ ৬/৬৪ নববীসহ)

৯। আবু কাতাদা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ সৎ স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ হতে, আর মন্দ স্বপ্ন শয়তানের পক্ষ হতে। সুতরাং যে ব্যক্তি এমন কিছু দেখে যা তার অপছন্দ হয়, সে যেন তার বাম দিকে তিনবার আউযুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্ত্বোনির রাজীম বলে ফুক দেয়, তবে তাকে অবশ্যই তা কোন ক্ষতি করতে পারবে না। (বুখারীঃ ১২/২৮৩ ফাতহসহ ও মুসলিমঃ ১৫/১৬ নববীসহ)

১০। আবু সাঈদ খুদরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ তোমাদের মধ্য হতে যখন কেউ হাই তোলে, তখন সে যেন স্বীয় হাত দ্বারা মুখ বন্ধ করে। কেননা শয়তান তাতে প্রবেশ করে। (মুসলিমঃ ১৮/১২২ নববীসহ ও দারমীঃ ১/৩২১)

এই বিষয়ে আরও অনেক হাদীস রয়েছে। সুতরাং এখান থেকে প্রমাণিত হল যে, জ্বিন এবং শয়তানের অস্তিত্ব বাস্তব সত্য। এর মধ্যে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।

কুরআন দ্বারা প্রমাণঃ

১। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَىٰ مُلْكِ سُلَيْمَانَ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَٰكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنْزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوتَ وَمَارُوتَ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّىٰ يَقُولَا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْ ۖ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ وَمَا هُمْ بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَلَقَدْ عَلِمُوا لَمَنِ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ وَلَبِئْسَ مَا شَرَوْا بِهِ أَنْفُسَهُمْ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ

অর্থঃ “এবং সুলাইমানের রাজত্বকালে শয়তানরা যা আবৃত্তি করতো, তারা তারই অনুসরণ করছে এবং সুলাইমান কুফুরী করেননি কিন্তু শয়তানরাই কুফুরী করেছিল। তারা লোকদেরকে যাদু বিদ্যা এবং যা বাবেল শহরে হারূত-মারত ফেরেশতাদ্বয়ের প্রতি অবতীর্ণ হয়েছিল তা শিক্ষা দিতো, এবং তারা উভয়ে কাউকেও ওটা শিক্ষা দিতো না, যে পর্যন্ত তারা না বলতো যে, আমরা পরীক্ষা স্বরূপ, অতএব তুমি কুফরী করো না; অনন্তর যাতে স্বামী ও তদীয় স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়, তারা উভয়ের নিকট তা শিক্ষা করতো এবং তারা আল্লাহর হুকুম ব্যতীত তদ্বারা কারও অনিষ্ট সাধন করতে পারতো না এবং তারা ওটাই শিক্ষা করছে যাতে তাদের ক্ষতি হয় এবং তাদের কোন উপকার সাধিত হয় না এবং নিশ্চয় তারা জ্ঞাত আছে যে, অবশ্য যে কেউ ওটা ক্রয় করেছে, তার জন্যে পরকালে কোনই অংশ নেই এবং যার বিনিময়ে তারা যে আত্ম-বিক্রয় করেছে তা নিকৃষ্ট, যদি তারা তা জানতো!" (সূরা বাকারাঃ ১০২)

২। মহান আল্লাহ বলেনঃ

قَالَ مُوسَىٰ أَتَقُولُونَ لِلْحَقِّ لَمَّا جَاءَكُمْ أَسِحْرٌ هَٰذَا وَلَا يُفْلِحُ السَّاحِرُونَ

অর্থঃ “মূসা বললেনঃ তোমরা কি এ হক সম্পর্কে এমন কথা বলছো, যখন ওটা তোমাদের নিকট পৌছলো? এটা কি যাদু? অথচ যাদুকররা তো সফলকাম হয় না!" (সূরা ইউনুসঃ ৭৭)

৩। মহান আল্লাহ বলেনঃ

فَلَمَّا أَلْقَوْا قَالَ مُوسَىٰ مَا جِئْتُمْ بِهِ السِّحْرُ إِنَّ اللَّهَ سَيُبْطِلُهُ إِنَّ اللَّهَ لَا يُصْلِحُ عَمَلَ الْمُفْسِدِينَ وَيُحِقُّ اللَّهُ الْحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُونَ

অর্থঃ “অতঃপর যখন তারা নিক্ষেপ করলো, তখন মূসা (আলাইহিস সালাম) বললেনঃ যাদু এটাই; নিশ্চয়ই আল্লাহ এখনই এটাকে বানচাল করে দিবেন; (কেননা) আল্লাহ এমন বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কাজ সম্পন্ন হতে দেন না। আর আল্লাহ স্বীয় অঙ্গীকার অনুযায়ী হক প্রতিষ্ঠিত করে দেন, যদিও পাপাচারীরা তা অপ্রীতিকর মনে করে " (সূরা ইউনুসঃ ৮১-৮২)

৪ । তিনি আরো বলেনঃ

فَأَوْجَسَ فِي نَفْسِهِ خِيفَةً مُوسَىٰ قُلْنَا لَا تَخَفْ إِنَّكَ أَنْتَ الْأَعْلَىٰ وَأَلْقِ مَا فِي يَمِينِكَ تَلْقَفْ مَا صَنَعُوا إِنَّمَا صَنَعُوا كَيْدُ سَاحِرٍ وَلَا يُفْلِحُ السَّاحِرُ حَيْثُ أَتَىٰ

অর্থঃ “মূসা (আলাইহিস সালাম) তার অন্তরে কিছু ভীতি অনুভব করলো। আমি বললামঃ ভয় করো না, তুমিই প্রবল। তোমার ডান হাতে যা আছে তা নিক্ষেপ করো, এটা তারা যা করেছে তা গ্রাস করে ফেলবে, তারা যা করেছে তা তো শুধু যাদুকরের কৌশল; যাদুকর যেখানেই আসুক সফল হবে না।" (সূরা ত্ত্বো-হাঃ ৬৭-৬৯)

৫ । মহান আল্লাহ বলেনঃ

وَأَوْحَيْنَا إِلَىٰ مُوسَىٰ أَنْ أَلْقِ عَصَاكَ فَإِذَا هِيَ تَلْقَفُ مَا يَأْفِكُونَ فَوَقَعَ الْحَقُّ وَبَطَلَ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ فَغُلِبُوا هُنَالِكَ وَانْقَلَبُوا صَاغِرِينَ وَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سَاجِدِينَ قَالُوا آمَنَّا بِرَبِّ الْعَالَمِينَ رَبِّ مُوسَىٰ وَهَارُونَ

অর্থঃ “তখন আমি মূসা-এর নিকট এই প্রত্যাদেশ পাঠালামঃ তুমি তোমার লাঠিখানা নিক্ষেপ কর, মূসা (আলাইহিস সালাম) তা নিক্ষেপ করলে ওটা একটা বিরাট সাপ হয়ে সহসা ওদের অলীক (মিথ্যা) সৃষ্টিগুলোকে গিলে ফেলল। পরিশেষে যা হক ছিল তা সত্য প্রমাণিত হলো, আর যা কিছু বানানো হয়েছিল তা বাতিল প্রমাণিত হলো। আর ফিরাউন ও তার দলবলের লোকেরা মুকাবিলার ময়দানে পরাজিত হলো এবং লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে গেল। যাদুকরগণ তখন সিজদায় পড়ে গেল। তারা পরিস্কার ভাষায় বললোঃ আমরা বিশ্ব প্রতিপালকের প্রতি অকপটে ঈমান আনলাম। (জিজ্ঞেস করা হলো— কোন বিশ্ব প্রতিপালকের প্রতি? তারা উত্তরে বললো) মূসা ও হারূনের প্রতিপালকের প্রতি।” (সূরা আরাফঃ ১১৭-১২২)

৬। মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الْفَلَقِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ وَمِنْ شَرِّ غَاسِقٍ إِذَا وَقَبَ وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ وَمِنْ شَرِّ حَاسِدٍ إِذَا حَسَدَ

অর্থঃ “বলঃ আমি আশ্রয় নিচ্ছি উষার স্রষ্টার, তিনি যা সৃষ্টি করেছেন তার অনিষ্ট হতে, অনিষ্ট হতে অন্ধকার রাত্রির যখন তা’ আচ্ছন্ন হয় এবং গিরায় ফুকদান কারিণীর এবং হিংসুকের অনিষ্ট হতেও যখন সে হিংসা করে।" (সূরা ফালাকঃ ১-৫)

ইমাম কুরতুবী (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ অর্থাৎ ঐ সমস্ত যাদুকারিনীর যারা সুতার গ্রন্থীতে ফুৎকার দেয় যখন তারা মন্ত্র পড়ে তাতে। (তাফসীর কুরতুবীঃ ২০/২৫৭)

হাফেজ ইবনে কাসীর (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ এর তাফসীরে মুজাহিদ, ইকরিমাহ, হাসান, কার্তাদাহ ও জাহহাক বলেনঃ যাদুকারিনীদের। (তাফসীর ইবনে কাসীরঃ ৪/৫৭৩)

ইবনে জারীর আততাবারী বলেনঃ অর্থাৎ ঐ সমস্ত যাদুকারিনীর অনিষ্ট হতে যারা সুতার গ্রন্থীতে ফুৎকার দেয় তখন তারা তার উপর মন্ত্র পড়ে। (তাফসীর আল-কাসেমীঃ ১০/৩০২)

কুরআনের অনেক আয়াতসমূহ যাদুর বর্ণনা এসেছে যা যাদুর অস্তিত্বের প্রমাণ

হাদীস দ্বারা প্রমাণঃ

আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত তিনি বলেনঃ যুৱাইক বংশের লাবীদ ইবনে আ'সাম নামে এক ব্যক্তি রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কে যাদু করে যার পরিণামে আল্লাহ রাসূলের কাছে মনে হয় যে, কোন কাজ করেছেন অথচ তিনি সেটি করেননি। অতঃপর একদিন অথবা এক রাতে তিনি আমার কাছে ছিলেন তিনি প্রার্থনার পর প্রার্থনা করলেন অতঃপর তিনি বললেনঃ হে আয়েশা! তুমি কি জান যে, আল্লাহ তায়ালা আমার সেই বিষয় সমস্যার সমাধান করেছেন যে বিষয়ে আমি সমাধান চেয়েছিলাম? আমার কাছে দুই ব্যক্তি আসলেন তাদের একজন আমার মাথার কাছে এবং অপরজন পায়ের কাছে বসলেন। অতঃপর তাদের একজন অপর জনকে জিজ্ঞাসা করলেনঃ

লোকটির কিসের ব্যাথা?

দ্বিতীয়জন উত্তরে বললেনঃ লোকটিকে যাদু করা হয়েছে।

প্রথম ব্যক্তি বললেনঃ কে যাদু করেছে?

দ্বিতীয়জন বললেনঃ লাবীদ বিন আসাম।

প্রথমজন জিজ্ঞাসা করলেনঃ কি দিয়ে যাদু করেছে?

দ্বিতীয়জন বললেনঃ চিরুনী, মাথা বা দাড়ির চুল ও পুরুষ খেজুর গাছের মোচার খোসা দ্বারা।

প্রথমজন বলেনঃ তা কোথায়? দ্বিতীয়জন বলেনঃ জারওয়ান কূপে।

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উক্ত কূপে সাহাবাদের কতিপয়কে নিয়ে হাজির হন। তিনি বলেনঃ হে আয়েশা কূপের পানি যেন মেহদী মিশ্রিত এবং কূপের পার্শ্বের খেজুর গাছের মাথাগুলি যেন শয়তানদের মাথা। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেনঃ হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কেন আপনি তা বের করে ফেললেন না? তিনি বলেনঃ আল্লাহ আমাকে আরোগ্য দিয়েছেন, তাই আমি অপছন্দ করি যে খারাপ বিষয়টি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিব। পরিশেষে উক্ত যাদুকে ঢেকে ফেলার আদেশ হয়। (বুখারীঃ ১০/২২২ ফাতহসহ ও মুসলিমঃ ১৪/১৭৪ নববীসহ)

হাদীসের ব্যাখ্যাঃ ইয়াহুদী জাতি (আল্লাহ তাদের প্রতি লা'নত করুন) তাদের সর্বশেষ যাদুকর লাবীদ ইবনে আসামের সাথে একমত হয় যে, সে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রতি যাদু করবে আর তারা তাকে তিন দিনার প্রদান করবে। যার ফলে এই বদবখত নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কতিপয় চুলের উপর যাদু করে। বলা হয়ে থাকে একজন ছোট বালিকা যার নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ঘরে যাতায়াত ছিল তার মাধ্যমে সে উক্ত চুল অর্জন করে এবং সে চুলগুলিতে তার জন্য যাদু করতঃ গিরা দেয় আর এ যাদু রেখে দেয় জারওয়ান নামক কূপে।

হাদীসের সকল বর্ণনা অনুপাতে বুঝা যায় যে, এ যাদু স্বামী-স্ত্রী কেন্দ্রিক যাদু ছিল, যার ফলে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর এমন ধারণা হতে যে, তিনি তার কোন স্ত্রীর সাথে সহবাসে লিপ্ত হবেন; কিন্তু যখন তার নিকটবতী হতেন তখন তা আর সম্ভব হতো না। এ যাদু তার জ্ঞান, আচার-আচরণ বা তার কার্যক্রমে কোন প্রভাব বিস্তার করেনি; বরং যা উল্লেখ করা হয়েছে সে ক্ষেত্রেই ক্রিয়াশীল ছিল ।

এ যাদু কতদিন ক্রিয়াশীল ছিল তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন ৪০ দিন কেউ অন্যমত পোষণ করেন। (আল্লাহ তায়ালাই অধিক জ্ঞাত)। এ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) স্বীয় রবের নিকট কাকুতি মিনতি করে দু'আ করতে থাকেন। যার ফলে আল্লাহ তায়ালা তার দু'আ কবুল করে দু'জন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। একজন তার শিয়রে বসেন, অন্যজন বসেন তার পায়ের পার্শ্বে। অতঃপর একজন অপরজনকে বলেনঃ তার কি হয়েছে? অপরজন উত্তর দেন তিনি যাদুগ্রস্ত। প্রথমজন বলেনঃ কে যাদু করেছে? দ্বিতীয়জন বলেনঃ লাবীদ ইবনে আ'সাম ইয়াহুদী। অতঃপর তিনি (ফেরেশতা) বর্ণনা দিলেন যে, সে চিরনী ও নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কতিপয চুলে যাদু করে, তা পুরুষ খেজুর গাছের মোচার খোলে রাখে, যেন তা কঠিনভাবে ক্রিয়াশীল হয়। অতঃপর সে তা জারওয়ান নামক কূপে পাথরের নিচে পুতে দেয়। এরপর যখন উভয় ফেরেশতা দ্বারা নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অবস্থার রহস্যের

উদঘাটন হয়ে গেল নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন তা বের করে পুতে ফেলার নির্দেশ দেন। কোন কোন বর্ণনায় রয়েছে তা জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন।

হাদীসের সমস্ত বর্ণনার ভিত্তিতে ফুটে ওঠে যে, উক্ত ইয়াহুদী নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বিরুদ্ধে মারাত্মক আকারের যাদুর আশ্রয় নিয়েছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল তাকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হত্যা করা। আর সর্বজন বিদিত যে, হত্যা করারও যাদু হয়ে থাকে; কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাকে তাদের চক্রান্ত হতে রক্ষা করেন। যার ফলে তাকে সর্ব নিম্নস্তরের যাদুতে পরিণত করে দেন। আর এটিই হলো আল্লাহর

হেফাযত।

মাযারী (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ (বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত উল্লেখিত যাদুর) এই হাদীসটি বিদআতীরা এই বলে অস্বীকার করে থাকে যে, ঘটনাটি নবুয়ত ও রিসালাতের মর্যাদার অপলাপ ও পরিপন্থি। নবুয়তে সন্দেহ সৃষ্টিকারী। এ ধরণের ঘটনা সাব্যস্ত হওয়া শরীয়তের বিশ্বাস যোগ্যতার পরিপন্থী ইত্যাদি। মাযারী (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ তারা যা বলে তা তাদের নিছক ভ্রান্তির বহিঃপ্রকাশ। কেননা রিসালাতের দলীল প্রমাণ হলো মু'জিযা। যা তার আল্লাহর পক্ষ হতে শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার ও তার নিষ্কলুষতার সত্যতার প্রমাণ বহন করে। আর দলীল প্রমাণবিহীন কোন কিছু দাবী বা সাব্যস্ত করা ভ্রান্ততা ছাড়া কিছু নয়। (যাদুল মুসলিমঃ ৪/২২১)

আবু জাকনী ইউসুফী (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যাদুর কারণে অসুস্থ হয়ে যাওয়া নবুওয়াতের মর্যাদার পরিপন্থী নয়। কেননা নবীদের অসুস্থ হওয়া পৃথিবীতে তাদের কোন অসম্পূর্ণতা নয়; বরং পরকালে তাদের মর্যাদাই বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এমতাবস্থায় যাদুর রোগের কারণে তার এমন ধারণা জন্ম হওয়া যে, তিনি ইহকালীন বিষয়ে কিছু করেছেন অথচ প্রকৃতপক্ষে তা করেননি; এরপর তো আল্লাহ তায়ালা যাদুর বিষয় ও স্থান সম্পর্কে তাকে জানানোর এবং তা নিজে বের করে ফেলার ফলে তা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়ে যায়। সুতরাং এতে নবুওয়াতের ক্ষেত্রে কোনরূপ অসম্পূর্ণতা আসতে পারে না, কেননা তা অন্যান্য রোগের মতই এক রোগ ছিল।

উক্ত যাদু ক্রিয়ায় তার জ্ঞানে কোন প্রভাব পড়েনি; বরং তার শরীরের বাহ্যিকভাবেই ছিল যেমনঃ দৃষ্টিতে কখনও ধারণা হতো, কোন স্ত্রীকে স্পর্শ করার অথচ তা তিনি করেননি। আর এটা অসুস্থ অবস্থায় কোন দোষনীয় নয় ।

তিনি আরো বলেনঃ আশ্চর্যজনক বিষয়, যারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যাদুর কারণে রোগ হওয়াকে রিসালাতের অসম্পূর্ণতার দৃষ্টিতে দেখে, অথচ কুরআনে মূসা (আলাইহিস সালাম)ও মূসা (আলাইহিস সালাম) তাদের যাদু ও লাঠির দৌড়া-দৌড়ি দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছিলেন ও নিজেকে তাদের সামনে তুচ্ছ মনে করেছিলেন; কিন্তু আল্লাহ তাকে দৃঢ় করেন। যেমন আল্লাহ তার প্রতিই ইঙ্গিত করে বলেনঃ

قُلْنَا لَا تَخَفْ إِنَّكَ أَنْتَ الْأَعْلَىٰ وَأَلْقِ مَا فِي يَمِينِكَ تَلْقَفْ مَا صَنَعُوا إِنَّمَا صَنَعُوا كَيْدُ سَاحِرٍ وَلَا يُفْلِحُ السَّاحِرُ حَيْثُ أَتَىٰ فَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سُجَّدًا قَالُوا آمَنَّا بِرَبِّ هَارُونَ وَمُوسَىٰ

অর্থঃ “আমি বললামঃ ভয় করো না, তুমিই প্রবল। তোমার ডান হাতে যা আছে তা নিক্ষেপ করো, এটা তারা যা করেছে তা গ্রাস করে ফেলবে, তারা যা করেছে তা তো শুধু যাদুকরের কৌশল; যাদুকর যেখানেই আসুক সফল হবে না। অতঃপর যাদুকররা সিজদাবনত হলো ও বললোঃ আমরা হারূন (আঃ) ও মূসার (আঃ) প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনলাম।" (সূরা তো-হাঃ ৬৮-৭০)

এর ফলে কোন বিজ্ঞ ও পন্ডিত বলেননি যে, যাদুর লাঠির দৌড়াদৌড়ির ফলে মূসার (আলাইহিস সালাম) ভীতসন্ত্রস্ত হওয়া তার নবুওয়াত ও রিসালাতের পরিপন্থী। বরং এসব বিষয় নবীদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো ঈমান মজবুত ও বৃদ্ধি পায়। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে শক্রদের বিরুদ্ধে সাহায্য করে থাকেন এবং শক্রদের কর্মকান্ডকে অকাট্য মু'জিযা দ্বারা নষ্ট করে দেন। যাদুকর কাফেরদেরকে লাঞ্ছিত করেন এবং শেষ শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য সাব্যস্ত করেন। যেমনভাবে তা স্পষ্ট রয়েছে, তার স্পষ্ট কিতাবের আয়াতসমূহে। (যাদুল মুসলিমঃ ৪/২২)

দ্বিতীয় হাদীসঃ আবু হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী বস্তু হতে বেঁচে থাক। সাহাবাগণ বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেগুলি কি? তিনি উত্তরে বলেনঃ (১) আল্লাহর সাথে শরীক করা, (২) যাদু করা (৩) হক পন্থা ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা, (৪) সুদ খাওয়া, (৫) ইয়াতীমের মাল খাওয়া, (৬) যুদ্ধের ময়দান হতে পলায়ন করা ও (৭) স্বতী-স্বাধবী, সরলা মুমিন নারীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়া। (বুখারীঃ ৫/৩৯৩ ফাতহ সহ ও মুসলিমঃ ২/৮৩)

সাব্যস্ত বিষয়ঃ হাদীসটি দ্বারা সাব্যস্ত হচ্ছে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে যাদু হতে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেন এবং বর্ণনা করেন যে, এটি ধ্বংসাত্মক কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এ দ্বারা প্রমাণিত হয়, যাদুর বাস্তবতা রয়েছে। এটি একটি উদ্ভট কিছু নয়।

তৃতীয় হাদীসঃ ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) তার বর্ণনায় বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ জ্যোতিষী বিদ্যা শিক্ষা করল সে যাদু বিদ্যার একটি অংশ শিক্ষা গ্রহণ করল, যে যত বেশি জ্যোতিষী বিদ্যায় অগ্রসর হলো সে যাদু বিদ্যায় যেন ততই অগ্রসর হলো। (আবু দাউদঃ ৩৯০৫, ইবনে মাজাহঃ ৩৭২৬)

সাব্যস্ত বিষয়ঃ হাদীসটি থেকে সাব্যস্ত হয় যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বর্ণনা দেন যে জ্যোতিষী বিদ্যা একটি এমন বিদ্যা যা যাদু শিক্ষার পর্যায়ে পৌছিয়ে দেয়। যার কারণে তিনি তা হতে মুসলমানদেরকে সতর্ক করেন। তাই এটি প্রমাণ বহন করে যে, নিশ্চয় যাদু একটি বাস্তব বিদ্যা যা শিক্ষা করা হয়ে থাকে। যা কুরআনের আয়াতেও প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ

فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ

অর্থঃ “অনন্তর যাতে স্বামী ও তদীয় স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়, তারা উভয়ের নিকট তা শিক্ষা করতো।" (সূরা বাকারাঃ ১০২)

এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নিশ্চয় যাদু একটি বিদ্যা, অন্যান্য বিদ্যার মতই। যার মূলনীতি রয়েছে যার ভিত্তিতে তা বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। আর আয়াত ও হাদীস এ যাদু শিক্ষারই বিরুদ্ধে উপস্থাপিত হয়েছে।

চতুর্থ হাদীসঃ ইমরান বিন হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তার বর্ণনায় বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কুলক্ষণ নির্ণয় করল আর যার জন্য তা নির্ণয় করা হলো, যে গণকগিরি করল আর যার জন্য করা হলো এবং যে যাদু করল আর যার জন্য যাদু করা হলো সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যে গণকের নিকট এলো অতঃপর সে যা বলল তা বিশ্বাস করল, সে যা কিছু মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি কুফরী করল।”

সাব্যস্ত বিষয়ঃ হাদীসটি থেকে সাব্যস্ত হয় যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যাদু থেকে ও যাদুকরের নিকট যাওয়া থেকে নিষেধ করেন। আর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এমন কোন জিনিস থেকে নিষেধ করেননি যার কোন অস্তিত্ব নেই বা ভিত্তি নেই।

পঞ্চম হাদীসঃ আবু মূসা আশআরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ “সর্বদা মদ পানকারী, যাদুতে বিশ্বাসী (অর্থাৎ বিশ্বাস করে যে, যাদুই সরাসরি প্রভাব ফেলে, আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর বা ভাগ্য ও তার ইচ্ছার কারণে নয় ) ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী কখনো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।" এই হাদীসটিকে সহীহ ইবনে হিব্বান বর্ণনা করেন, শায়খ আলবানী হাসান বলেছেন।

সাব্যস্ত বিষয়ঃ যাদু নিজেই প্রভাব ফেলে থাকে এমন বিশ্বাস করা হতে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিষেধ করেন। মুমিনদের বিশ্বাস রাখতে হবে যে, যাদু বা অন্য কিছুতে কোন ক্ষতি করতে পারেনা; বরং তা আল্লাহর ইচ্ছায় ও তা তার লিখে রাখার কারণে হয়ে থাকে। যেমনঃ আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

وَمَا هُمْ بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ

অর্থাৎ “আর তারা তার দ্বারা কোন ক্ষতি করতে পারে না আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত।" (তবে যাদু বা অন্য কিছু আল্লাহর লিখনীর ফলে কারণ সাব্যস্ত হয়ে থাকে) (সূরা বাকারাঃ ১০২)

ষষ্ঠ হাদীসঃ “যে ব্যক্তি জ্যোতিষী, যাদুকর বা গণকের নিকট আসল তারপর সে যা বলে তা বিশ্বাস করল, তবে অবশ্যই সে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার কুফুরী করল।” (তারগীবঃ ৪/৫৩)

তৃতীয়তঃ যাদুর অস্তিত্ব সম্পর্কে মনীষীদের উক্তি ও মতামতঃ

১। খাত্তাবী (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ প্রকৃতিবাদীদের একদল যাদুকে অস্বীকার করে ও তার বাস্তবতাকে খন্ডন করে।

এর উত্তরঃ নিশ্চয় যাদু প্রমাণিত ও তার বাস্তবতা রয়েছে। আরব অনারব তথা পারস, ভারত উপমহাদেশীয় দেশসমূহ, রোমানও এরূপ অধিকাংশ জাতিই একমত যে, যাদু প্রমাণিত। অথচ এরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক দিয়ে সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতির অন্তর্ভুক্ত।

আর আল্লাহ্‌ তায়ালা বলেনঃ

يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ

অর্থঃ “তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দেয়।” (বাকারঃ ১০২)

অনুরূপ আল্লাহ তায়ালা যাদু হতে আশ্রয় প্রার্থনার হুকুম দিয়ে বলেনঃ

وَمِنْ شَرِّ النَّفَّاثَاتِ فِي الْعُقَدِ

অর্থঃ “গ্রন্থিতে ফুৎকার কারিনীদের অনিষ্ট হতে (আশ্রয় চাই)। (সুরা ফালাকঃ ৪)

তিনি আরোও বলেনঃ এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হতে আরো এমন অনেক খবর এসেছে, যা কেউ অস্বীকার করে না একমাত্র যারা বাস্তবতাকে অস্বীকার করে তারা ব্যতীত। আর ইসলামী ফেকাহবিদগণও যাদুকরের কি শাস্তি সে ব্যাপারেও আলোকপাত করেছেন। আর যার ভিত্তি নেই তার এত চর্চা ও প্রসিদ্ধি হওয়ার কথা নয়। সুতরাং যাদুকে (অস্তিত্বকে) অস্বীকার করা একটি অজ্ঞতা ও যাদু অস্বীকার কারীদের প্রতিবাদ একটি অনার্থক বিষয়।” (শারহুস সুন্নাহঃ ১২/১৮৮)

২। ইমাম নববী বলেনঃ বিশুদ্ধ মত হলো নিশ্চয় যাদুর বাস্তব অস্তিত্ব রয়েছে। এটিই জমহুর উলামা ও সাধারণ উলামার মত। এ মত প্রমাণিত হয় কুরআন ও প্রসিদ্ধ বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা। (ফতহুল বারী হতে সংকলিতঃ ১০/২২২)

৩। আবুল ইযয হানাফী (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ যাদুর বাস্তবতা ও প্রকারের ক্ষেত্রে অনেকেই মতভেদ করেন; কিন্তু অধিকাংশই বলেনঃ নিশ্চয়ই যাদুগ্রস্তের মৃত্যু ও তার অসুস্থতায় প্রভাব বিস্তার করে থাকে। কোন কিছুর প্রকাশ্য ক্রিয়া ব্যতীতই------ (শরহুল আকীদা আততাহাবিয়াঃ ৫০৫)

৪ । ইবনে কুদামা (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ যাদুর প্রভাবে মানুষ শারিরীক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করে এবং স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছিন্নতা ঘটে। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ

অর্থঃ “তারা তাদের কাছ থেকে এমন যাদু শিক্ষা নিত যার দ্বারা তারা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করত।” (ফতহুল মজিদ হতে সংকলিতঃ ৩১৪) অতএব যাদু সম্পর্কে অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় যে, এর অস্তিত্ব অবশ্যই আছে এবং রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যাদুকরের কাছে যেতে নিষেধ করেছেন। আর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এমন কোন বস্তু থেকে নিষেধ করতে পারেন না যার অস্তিত্ব নেই। সুতরাং এতে বুঝা যায় যে যাদুর অস্তিত্ব আছে।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৫ পর্যন্ত, সর্বমোট ৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে