মাযারী (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ (বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত উল্লেখিত যাদুর) এই হাদীসটি বিদআতীরা এই বলে অস্বীকার করে থাকে যে, ঘটনাটি নবুয়ত ও রিসালাতের মর্যাদার অপলাপ ও পরিপন্থি। নবুয়তে সন্দেহ সৃষ্টিকারী। এ ধরণের ঘটনা সাব্যস্ত হওয়া শরীয়তের বিশ্বাস যোগ্যতার পরিপন্থী ইত্যাদি। মাযারী (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ তারা যা বলে তা তাদের নিছক ভ্রান্তির বহিঃপ্রকাশ। কেননা রিসালাতের দলীল প্রমাণ হলো মু'জিযা। যা তার আল্লাহর পক্ষ হতে শ্রেষ্ঠ মর্যাদায় উন্নীত হওয়ার ও তার নিষ্কলুষতার সত্যতার প্রমাণ বহন করে। আর দলীল প্রমাণবিহীন কোন কিছু দাবী বা সাব্যস্ত করা ভ্রান্ততা ছাড়া কিছু নয়। (যাদুল মুসলিমঃ ৪/২২১)
আবু জাকনী ইউসুফী (রাহেমাহুল্লাহ) বলেনঃ নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যাদুর কারণে অসুস্থ হয়ে যাওয়া নবুওয়াতের মর্যাদার পরিপন্থী নয়। কেননা নবীদের অসুস্থ হওয়া পৃথিবীতে তাদের কোন অসম্পূর্ণতা নয়; বরং পরকালে তাদের মর্যাদাই বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এমতাবস্থায় যাদুর রোগের কারণে তার এমন ধারণা জন্ম হওয়া যে, তিনি ইহকালীন বিষয়ে কিছু করেছেন অথচ প্রকৃতপক্ষে তা করেননি; এরপর তো আল্লাহ তায়ালা যাদুর বিষয় ও স্থান সম্পর্কে তাকে জানানোর এবং তা নিজে বের করে ফেলার ফলে তা সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়ে যায়। সুতরাং এতে নবুওয়াতের ক্ষেত্রে কোনরূপ অসম্পূর্ণতা আসতে পারে না, কেননা তা অন্যান্য রোগের মতই এক রোগ ছিল।
উক্ত যাদু ক্রিয়ায় তার জ্ঞানে কোন প্রভাব পড়েনি; বরং তার শরীরের বাহ্যিকভাবেই ছিল যেমনঃ দৃষ্টিতে কখনও ধারণা হতো, কোন স্ত্রীকে স্পর্শ করার অথচ তা তিনি করেননি। আর এটা অসুস্থ অবস্থায় কোন দোষনীয় নয় ।
তিনি আরো বলেনঃ আশ্চর্যজনক বিষয়, যারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর যাদুর কারণে রোগ হওয়াকে রিসালাতের অসম্পূর্ণতার দৃষ্টিতে দেখে, অথচ কুরআনে মূসা (আলাইহিস সালাম)ও মূসা (আলাইহিস সালাম) তাদের যাদু ও লাঠির দৌড়া-দৌড়ি দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছিলেন ও নিজেকে তাদের সামনে তুচ্ছ মনে করেছিলেন; কিন্তু আল্লাহ তাকে দৃঢ় করেন। যেমন আল্লাহ তার প্রতিই ইঙ্গিত করে বলেনঃ
قُلْنَا لَا تَخَفْ إِنَّكَ أَنْتَ الْأَعْلَىٰ وَأَلْقِ مَا فِي يَمِينِكَ تَلْقَفْ مَا صَنَعُوا إِنَّمَا صَنَعُوا كَيْدُ سَاحِرٍ وَلَا يُفْلِحُ السَّاحِرُ حَيْثُ أَتَىٰ فَأُلْقِيَ السَّحَرَةُ سُجَّدًا قَالُوا آمَنَّا بِرَبِّ هَارُونَ وَمُوسَىٰ
অর্থঃ “আমি বললামঃ ভয় করো না, তুমিই প্রবল। তোমার ডান হাতে যা আছে তা নিক্ষেপ করো, এটা তারা যা করেছে তা গ্রাস করে ফেলবে, তারা যা করেছে তা তো শুধু যাদুকরের কৌশল; যাদুকর যেখানেই আসুক সফল হবে না। অতঃপর যাদুকররা সিজদাবনত হলো ও বললোঃ আমরা হারূন (আঃ) ও মূসার (আঃ) প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনলাম।" (সূরা তো-হাঃ ৬৮-৭০)
এর ফলে কোন বিজ্ঞ ও পন্ডিত বলেননি যে, যাদুর লাঠির দৌড়াদৌড়ির ফলে মূসার (আলাইহিস সালাম) ভীতসন্ত্রস্ত হওয়া তার নবুওয়াত ও রিসালাতের পরিপন্থী। বরং এসব বিষয় নবীদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আরো ঈমান মজবুত ও বৃদ্ধি পায়। কেননা আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে শক্রদের বিরুদ্ধে সাহায্য করে থাকেন এবং শক্রদের কর্মকান্ডকে অকাট্য মু'জিযা দ্বারা নষ্ট করে দেন। যাদুকর কাফেরদেরকে লাঞ্ছিত করেন এবং শেষ শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য সাব্যস্ত করেন। যেমনভাবে তা স্পষ্ট রয়েছে, তার স্পষ্ট কিতাবের আয়াতসমূহে। (যাদুল মুসলিমঃ ৪/২২)
দ্বিতীয় হাদীসঃ আবু হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বর্ণনা নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী বস্তু হতে বেঁচে থাক। সাহাবাগণ বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! সেগুলি কি? তিনি উত্তরে বলেনঃ (১) আল্লাহর সাথে শরীক করা, (২) যাদু করা (৩) হক পন্থা ব্যতীত কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা, (৪) সুদ খাওয়া, (৫) ইয়াতীমের মাল খাওয়া, (৬) যুদ্ধের ময়দান হতে পলায়ন করা ও (৭) স্বতী-স্বাধবী, সরলা মুমিন নারীর প্রতি মিথ্যা অপবাদ দেয়া। (বুখারীঃ ৫/৩৯৩ ফাতহ সহ ও মুসলিমঃ ২/৮৩)
সাব্যস্ত বিষয়ঃ হাদীসটি দ্বারা সাব্যস্ত হচ্ছে যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আমাদেরকে যাদু হতে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেন এবং বর্ণনা করেন যে, এটি ধ্বংসাত্মক কবীরা গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। এ দ্বারা প্রমাণিত হয়, যাদুর বাস্তবতা রয়েছে। এটি একটি উদ্ভট কিছু নয়।
তৃতীয় হাদীসঃ ইবনে আব্বাস (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) তার বর্ণনায় বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ জ্যোতিষী বিদ্যা শিক্ষা করল সে যাদু বিদ্যার একটি অংশ শিক্ষা গ্রহণ করল, যে যত বেশি জ্যোতিষী বিদ্যায় অগ্রসর হলো সে যাদু বিদ্যায় যেন ততই অগ্রসর হলো। (আবু দাউদঃ ৩৯০৫, ইবনে মাজাহঃ ৩৭২৬)
সাব্যস্ত বিষয়ঃ হাদীসটি থেকে সাব্যস্ত হয় যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বর্ণনা দেন যে জ্যোতিষী বিদ্যা একটি এমন বিদ্যা যা যাদু শিক্ষার পর্যায়ে পৌছিয়ে দেয়। যার কারণে তিনি তা হতে মুসলমানদেরকে সতর্ক করেন। তাই এটি প্রমাণ বহন করে যে, নিশ্চয় যাদু একটি বাস্তব বিদ্যা যা শিক্ষা করা হয়ে থাকে। যা কুরআনের আয়াতেও প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ
فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ
অর্থঃ “অনন্তর যাতে স্বামী ও তদীয় স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ সংঘটিত হয়, তারা উভয়ের নিকট তা শিক্ষা করতো।" (সূরা বাকারাঃ ১০২)
এ থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, নিশ্চয় যাদু একটি বিদ্যা, অন্যান্য বিদ্যার মতই। যার মূলনীতি রয়েছে যার ভিত্তিতে তা বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। আর আয়াত ও হাদীস এ যাদু শিক্ষারই বিরুদ্ধে উপস্থাপিত হয়েছে।
চতুর্থ হাদীসঃ ইমরান বিন হুসাইন (রাযিয়াল্লাহু আনহু) তার বর্ণনায় বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি কুলক্ষণ নির্ণয় করল আর যার জন্য তা নির্ণয় করা হলো, যে গণকগিরি করল আর যার জন্য করা হলো এবং যে যাদু করল আর যার জন্য যাদু করা হলো সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়। আর যে গণকের নিকট এলো অতঃপর সে যা বলল তা বিশ্বাস করল, সে যা কিছু মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে তার প্রতি কুফরী করল।”
সাব্যস্ত বিষয়ঃ হাদীসটি থেকে সাব্যস্ত হয় যে, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যাদু থেকে ও যাদুকরের নিকট যাওয়া থেকে নিষেধ করেন। আর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এমন কোন জিনিস থেকে নিষেধ করেননি যার কোন অস্তিত্ব নেই বা ভিত্তি নেই।
পঞ্চম হাদীসঃ আবু মূসা আশআরী (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ “সর্বদা মদ পানকারী, যাদুতে বিশ্বাসী (অর্থাৎ বিশ্বাস করে যে, যাদুই সরাসরি প্রভাব ফেলে, আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর বা ভাগ্য ও তার ইচ্ছার কারণে নয় ) ও আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী কখনো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।" এই হাদীসটিকে সহীহ ইবনে হিব্বান বর্ণনা করেন, শায়খ আলবানী হাসান বলেছেন।
সাব্যস্ত বিষয়ঃ যাদু নিজেই প্রভাব ফেলে থাকে এমন বিশ্বাস করা হতে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিষেধ করেন। মুমিনদের বিশ্বাস রাখতে হবে যে, যাদু বা অন্য কিছুতে কোন ক্ষতি করতে পারেনা; বরং তা আল্লাহর ইচ্ছায় ও তা তার লিখে রাখার কারণে হয়ে থাকে। যেমনঃ আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ
وَمَا هُمْ بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ
অর্থাৎ “আর তারা তার দ্বারা কোন ক্ষতি করতে পারে না আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত।" (তবে যাদু বা অন্য কিছু আল্লাহর লিখনীর ফলে কারণ সাব্যস্ত হয়ে থাকে) (সূরা বাকারাঃ ১০২)
ষষ্ঠ হাদীসঃ “যে ব্যক্তি জ্যোতিষী, যাদুকর বা গণকের নিকট আসল তারপর সে যা বলে তা বিশ্বাস করল, তবে অবশ্যই সে মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তার কুফুরী করল।” (তারগীবঃ ৪/৫৩)