ব্যাখ্যাপন্থী আলিমগণ বলেন যে, বিশেষণগুলোর ব্যাখ্যার মাধ্যমে মহান আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের বিশ্বাস রক্ষা করা যায়। এক্ষেত্রে দুটি বিষয় লক্ষণীয়:
প্রথমত: আশআরী-মাতুরিদীগণ ৮টি বিশেষণ স্বীকার এবং অন্যান্য বিশেষণ অস্বীকার করেছেন। যে যুক্তিতে তাঁরা অন্যান্য বিশেষণ অস্বীকার করেছেন সে যুক্তিতেই এ ৮ টি বিশেষণও অস্বীকার করেছেন জাহমী-মুতাযিলীগণ। জাহমীগণ বলেন: কর্ণ ছাড়া শ্রবণ, চক্ষু ছাড়া দেখা, বাগযন্ত্র ছাড়া কথা বলা, মানসিক পরিবর্তন ছাড়া ইচ্ছা ইত্যাদি কল্পনা করা যায় না। কর্ণ, চক্ষু, বাগযন্ত্র, মানসিক পরিবর্তন ইত্যাদি আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের সাথে সাংঘর্ষিক। জীবন, ক্ষমতা, ইলম, ইচ্ছা ইত্যাদি বিশেষণেরও একই অবস্থা। এগুলো সৃষ্টির বিশেষণ। মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে এগুলো বিশ্বাস করার অর্থই মহান আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনীয় ও দেহধারী বলে বিশ্বাস করা। এছাড়া আশআরী-মাতুরিদী আকিদাবিদগণ আখিরাতে আল্লাহর দর্শনে বিশ্বাসী। মুতাযিলীগণ তাদেরকে এজন্য মুজাস্সিমা-মুশাব্বিহা বলেন। কারণ অবয়ব ও কোনো স্থানে অবস্থান ছাড়া কাউকে দেখা সম্ভব নয়। তাদের মতে মহান আল্লাহকে আখিরাতে দেখা যাবে বলে বিশ্বাস করার অর্থই তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনীয় ও দেহধারী বলে বিশ্বাস করা।
আশআরী-মাতুরিদী আলিমগণ বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বলেন যে, মহান আল্লাহর শ্রবণ, দর্শন, জীবন ইত্যাদি কোনো বিশেষণই সৃষ্টির মত নয়। আখিরাতে আল্লাহকে দেখা আর দুনিয়াতে কোনো সৃষ্টিকে দেখা এক নয়। বাস্তবে এ যুক্তিগুলোই অবশিষ্ট যাতী ও ফি’লী সকল বিশেষণ স্বীকার ও বিশ্বাস করার ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযোজ্য।
দ্বিতীয়ত: ব্যাখ্যার মাধ্যমে মহান আল্লাহর অতুলনীয়ত্ব রক্ষা করার দাবিও সঠিক নয়। যেমন, আরশের উপর অধিষ্ঠান বলতে ‘দখল’ বা ‘ক্ষমতা গ্রহণ’ বললেও একই সমস্যা থাকে। কারণ দখল বা ক্ষমতা গ্রহণও অধিষ্ঠানের মতই মানবীয় কর্ম। এ প্রসঙ্গে প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস, মুফাস্সির ও হানাফী ফকীহ আল্লামা মাহমূদ ইবন আব্দুল্লাহ হুসাইনী আলূসী (১২৭০হি/১৮৫৪খৃ) বলেন: ‘‘জেনে রাখুন, অনেক মানুষ নকলী দলীল বা কুরআন-হাদীসের বক্তব্য থেকে প্রমাণিত বিশেষণগুলো মুতাশাবিহ বা অস্পষ্ট অর্থবোধক বলে গণ্য করেন। যেমন আরশের উপর অধিষ্ঠান, হস্ত, পদ, প্রথম আসমানে অবতরণ, হাস্য, অবাক হওয়া ইত্যাদি বিশেষণ। সালফ সালিহীন বা প্রথম যুগের বুজুর্গদের মতানুসারে এগুলো সবই প্রমাণিত বিশেষণ, তবে এগুলোর প্রকৃতি মানবীয় জ্ঞানের অগম্য। এগুলোর অসিত্মত্বে বিশ্বাস করা ছাড়া আমাদেরকে অন্য কোনো (ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা প্রকৃতি উন্মোচনের) দায়িত্ব দেওয়া হয় নি। এগুলোর অসিত্মত্বে বিশ্বাসের সাথে সাথে বিশ্বাস করতে হবে যে এগুলো দেহ নয় এবং সৃষ্টির সাথে তুলনীয় নয়। এভাবেই কুরআন-হাদীসের বক্তব্য ও জ্ঞানবৃত্তিক যুক্তির মধ্যে বৈপরীত্য দূরীভূত হয়।
পরবর্তী যুগের আলিমগণ এগুলো ব্যাখ্যা করার এবং এগুলো দ্বারা মহান আল্লাহ কি বুঝিয়েছেন তা নির্ধারণ করার মত গ্রহণ করেছেন। যেমন তারা বলেন: আরশের উপর অধিষ্ঠান অর্থ দখল গ্রহণ ও বিজয় লাভ। তাঁদের মতে মহান আল্লাহর আটটি বিশেষণ ছাড়া আর কোনো বিশেষণ নেই। আর দখল করা বা বিজয় লাভ করা আটটি বিশেষণের কোনো একটি বিশেষণের প্রকাশ মাত্র। .... শা’রানী (৯৭৩ হি) আদ-দুরারুল মানসূরাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, সালফ সালিহীনের মাযহাবই অধিক নিরাপদ ও অধিক শক্তিশালী। কারণ ব্যাখাকারীগণ আরশের উপর অধিষ্ঠানের অর্থ করেছেন রাজ্য দখল করা। এভাবে দেহ ও স্থান থেকে পবিত্র করতে যেয়ে তারা অন্য একটি মানবীয় ও স্থান নির্ভর কর্মের সাথে তাঁকে সম্পৃক্ত করেছেন। বস্ত্তত তাদের জ্ঞান মহান আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনায় শরীয়তের পূর্ণতায় পৌঁছাতে পারে নি। মহান আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনায় শরীয়তের পূর্ণতা প্রকাশিত হয় কুরআনের বক্তব্যে: ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়’’। আরশের উপরে অধিষ্ঠানের ব্যাখ্যায় আরশের উপর ক্ষমতাবান বা দখলদার হওয়ার কথা বললেও সাথে সাথে এ কথা বলতেই হবে যে, মহান আল্লাহর আরশ দখল মানুষদের দেশ দখলের সাথে তুলনীয় নয়। বরং মহান আল্লাহ তাঁর মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো পদ্ধতিতে আরশের উপর ক্ষমতাবান হন। আর ‘অধিষ্ঠান’-কে ‘দখল গ্রহণ’ বলে ব্যাখ্যা করার পরেও যেহেতু এরূপ কিছু বলতে হচ্ছে, সেহেতু ব্যাখ্যার কষ্ট বহনের পূর্বেই তাদের বলা উচিত যে, মহান আল্লাহ আরশের উপরে অধিষ্ঠান গ্রহণ করেছেন, তবে তা মানবীয় অধিষ্ঠানের সাথে তুলনীয় নয়। তাঁর মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো পদ্ধতিতে তিনি তা করেছেন। মানবীয় জ্ঞান তাঁর ক্ষমতার প্রকৃতি জানতে অক্ষম। এরূপ বলাই আদবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ...।[1]