আল-ফিকহুল আকবর মহান আল্লাহর বিশেষণ, তাকদীর ইত্যাদি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১ টি
১১. ৩. ওহীর প্রকাশ্য অর্থ গ্রহণ তুলনা কি না

এ সকল বিশেষণের অর্থ অজ্ঞাত এবং এর প্রকাশ্য অর্থ পরিত্যক্ত- এ দুটি দাবির ভিত্তিতে কোনো কোনো আলিম তুলনামুক্তভাবে প্রকাশ্য অর্থে আল্লাহর বিশেষণ বিশ্বাসকারীকে মুজাস্সিমা (দেহে বিশ্বাসী) বা মুশাবিবহা (তুলনাকারী) বলে অভিযুক্ত করেন। অর্থাৎ যদি কেউ বলেন: ‘‘মহান আল্লাহর হস্ত আছে, মুখমণ্ডল আছে, তিনি আরশের উপর অধিষ্ঠান করেছেন, শেষ রাত্রে অবতরণ করেন; স্বরূপ ছাড়া, সৃষ্টির মত নয়’’ তবে তাঁরা তাকে বিভ্রান্ত বলে গণ্য করেন। বিষয়টি দুর্ভাগ্যজনক। কেউ নিজ মুখে তুলনার দাবি না করলে তাকে তুলনাকারী বলা সঠিক নয়; বিশেষত কুরআন-হাদীসের বক্তব্য হুবহু বিশ্বাসের পাশাপাশি যে ব্যক্তি মহান আল্লাহর অতুলনীয়ত্বের স্বীকৃতি প্রদান করছেন। এছাড়া কুরআন বা হাদীস যা বলেছে হুবহু তা নিজের ভাষায় বললে বা বিশ্বাস করলে কোনো মুমিন অপরাধী হন বলে চিন্তা করাও মুমিনের জন্য কঠিন। এখানে প্রসঙ্গত ইমাম তিরমিযীর একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন:


... قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ إِنَّ اللَّهَ يَقْبَلُ الصَّدَقَةَ وَيَأْخُذُهَا بِيَمِينِهِ .... قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ. ... وَقَدْ قَالَ غَيْرُ وَاحِدٍ مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ فِى هَذَا الْحَدِيثِ وَمَا يُشْبِهُ هَذَا مِنَ الرِّوَايَاتِ مِنَ الصِّفَاتِ وَنُزُولِ الرَّبِّ تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا قَالُوا قَدْ تَثْبُتُ الرِّوَايَاتُ فِى هَذَا وَيُؤْمَنُ بِهَا وَلاَ يُتَوَهَّمُ وَلاَ يُقَالُ كَيْفَ هَكَذَا رُوِىَ عَنْ مَالِكٍ وَسُفْيَانَ بْنِ عُيَيْنَةَ وَعَبْدِ اللَّهِ بْنِ الْمُبَارَكِ أَنَّهُمْ قَالُوا فِى هَذِهِ الأَحَادِيثِ أَمِرُّوهَا بِلاَ كَيْفٍ. وَهَكَذَا قَوْلُ أَهْلِ الْعِلْمِ مِنْ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ. وَأَمَّا الْجَهْمِيَّةُ فَأَنْكَرَتْ هَذِهِ الرِّوَايَاتِ وَقَالُوا هَذَا تَشْبِيهٌ. وَقَدْ ذَكَرَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ فِى غَيْرِ مَوْضِعٍ مِنْ كِتَابِهِ الْيَدَ وَالسَّمْعَ وَالْبَصَرَ فَتَأَوَّلَتِ الْجَهْمِيَّةُ هَذِهِ الآيَاتِ فَفَسَّرُوهَا عَلَى غَيْرِ مَا فَسَّرَ أَهْلُ الْعِلْمِ وَقَالُوا إِنَّ اللَّهَ لَمْ يَخْلُقْ آدَمَ بِيَدِهِ. وَقَالُوا إِنَّ مَعْنَى الْيَدِ هَا هُنَا الْقُوَّةُ. وَقَالَ إِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ إِنَّمَا يَكُونُ التَّشْبِيهُ إِذَا قَالَ يَدٌ كَيَدٍ أَوْ مِثْلُ يَدٍ أَوْ سَمْعٌ كَسَمْعٍ أَوْ مِثْلُ سَمْعٍ. فَإِذَا قَالَ سَمْعٌ كَسَمْعٍ أَوْ مِثْلُ سَمْعٍ فَهَذَا التَّشْبِيهُ وَأَمَّا إِذَا قَالَ كَمَا قَالَ اللَّهُ تَعَالَى يَدٌ وَسَمْعٌ وَبَصَرٌ وَلاَ يَقُولُ كَيْفَ وَلاَ يَقُولُ مِثْلُ سَمْعٍ وَلاَ كَسَمْعٍ فَهَذَا لاَ يَكُونُ تَشْبِيهًا وَهُوَ كَمَا قَالَ اللَّهُ تَعَالَى فِى كِتَابِهِ (لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَىْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ ).


‘‘... রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: আল্লাহ দান কবুল করেন এবং তা তাঁর ডান হাত দ্বারা গ্রহণ করেন। .... আবূ ঈসা (তিরমিযী) বলেন: এটি হাসান সহীহ হাদীস। .... এ হাদীস এবং এ ধরনের যে সকল হাদীসে আল্লাহর বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে, মহান মহাপবিত্র প্রতিপালকের প্রথম আসমানে অবতরণের কথা বর্ণিত হয়েছে সে সকল হাদীস বিষয়ে আলিমগণ বলেছেন যে, হাদীস দ্বারা এগুলো প্রমাণিত এবং এগুলো বিশ্বাস করতে হবে, তবে কোনো কল্পনা করা যাবে না এবং ‘কিভাবে’ বলা যাবে না। মালিক, সুফিয়ান ইবন উআইনা, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারাক থেকে এ সকল হাদীসের বিষয়ে বর্ণিত যে, তোমরা এগুলোকে ‘কিভাবে’ (স্বরূপ সন্ধান) ব্যতিরেকে চালিয়ে নেও। আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলিমদের এটিই মত। কিন্তু জাহমীগণ এ সকল হাদীস অস্বীকার করেছে। তারা বলে, এগুলো তুলনা। মহান আল্লাহ কুরআনের অনেক স্থানে হাত, শ্রবণ, দর্শন ইত্যাদি বিশেষণ উল্লেখ করেছেন। জাহমীগণ এ সকল আয়াতের ব্যাখ্যা করে। আলিমগণ এগুলোর যে ব্যাখ্যা করেছেন (স্বরূপ বিহীন বিশ্বাস করা) জাহমীদের ব্যাখ্যা তার বিপরীত। তারা বলে: আল্লাহ আদমকে তাঁর হাত দিয়ে সৃষ্টি করেন নি। তারা বলে: এখানে হাত অর্থ ক্ষমতা। ইসহাক ইবন ইবরাহীম (ইবন রাহওয়াইহি) বলেন: তুলনা তো তখনই হয় যখন কেউ বলে: হাতের মত হাত, অথবা হাতের সাথে তুলনীয় হাত, শ্রবণের মত শ্রবণ অথবা শ্রবণের তুলনীয় শ্রবণ। কাজেই যদি কেউ বলে শ্রবণের মত শ্রবণ বা শ্রবণের সাথে তুলনীয় শ্রবণ তবে তা ‘তুলনা’। আর যখন কেউ আল্লাহ যেভাবে বলেছেন সেভাবে বলে: হাত, শ্রবণ, দর্শন, কিন্তু ‘কিভাবে’ বলে না এবং ‘শ্রবণের মত’ বা ‘শ্রবণের সাথে তুলনীয়’ও বলে না তখন তা তুলনা নয়। আল্লাহ কুরআনে এভাবেই বলেছেন: ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয় এবং তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা।’’[1]

এখানে ইসহাক ইবন রাহওয়াইহি বলেছেন যে, জাহমীগণের মতে আল্লাহর হাত, আল্লাহর শ্রবণ ইত্যাদি বলা বা বিশ্বাস করার অর্থই মহান আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা। পক্ষান্তরে আহলুস সুন্নাত বলেন, তুলনা করলেই তো তুলনা হয়। কেউ যদি বলে মহান আল্লাহর হাত সৃষ্টির হাতের মত, তাঁর শ্রবণ সৃষ্টির শ্রবণের মত, তাঁর দর্শন সৃষ্টির দর্শনের সাথে তুলনীয়... তবেই তা তুলনা বলে গণ্য হবে। আর যদি কেউ আল্লাহ যেভাবে বলেছেন সেভাবেই বলে তাহলে তা কখনোই তুলনা হতে পারে না।

[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৫০।