মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ ছিল সত্য মিথ্যা এবং ন্যায় ও অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্যকারী যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর রিসালাত সম্পর্কে আরববাসীগণের মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কিংবা সন্দেহের আর কোন অবকাশই রইল না। এ কারণে, পরিস্থিতির মোড় সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে গেল। এবং মানুষ আল্লাহর দ্বীনে দলে দলে প্রবিষ্ট হতে থাকল। এ সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ ‘প্রতিনিধি প্রেরণ’ অধ্যায়ে উপস্থাপিত হবে এবং ‘বিদায় হজ্জ’ সম্পর্কিত আলোচনায়ও এ সম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা সম্ভব হবে। যাহোক, আলোচ্য সময়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা বলতে আর তেমন কিছুই ছিল না। ফলে মুসলিমগণ শরীয়তের শিক্ষা বিস্তার এবং ইসলামের প্রচার প্রসারে একনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ লাভ করেন।
ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এমনি এক পর্যায়ে মদীনার উপর এমন এক শক্তির দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল যা কোন কারণ ব্যতিরেকেই মুসলিমগণকে এখানে সেখানে ত্যক্ত বিরক্ত করে চলছিল। ইতিহাসে এরা রোমক বা রোমীয় নামে পরিচিত। তদানীন্তন পৃথিবীতে এরা ছিল সর্বাধিক সৈন্য সম্পদে সমৃদ্ধ। ইতোপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, এ বিরক্তিকর কাজ আরম্ভ করে শোরাহবীল বিন ‘আমর গাসসানী নাবী কারীম (ﷺ)-এর দূত হারিস বিন উমাইর আযদীকে (রাঃ) হত্যা করার মাধ্যমে। তাছাড়া এ হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যায়দ বিন হারিসাহ (রাঃ)-এর অধিনায়কত্বে যে সৈন্যদল প্রেরণ করেছিলেন এবং যাঁরা মুতাহ নামক স্থানে রোমক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন সে কথাও ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু এ সৈন্যদল সে আত্মগর্বী অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণে সক্ষম হন নি। অবশ্য এর ফলে দূরের ও নিকটের আরব অধিবাসীদের উপর মুসলিমগণের প্রভাব প্রতিপত্তির একটি অনুকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়।
বস্তুত আরব গোত্রসমূহের উপর মুসলিমগণের প্রভাব প্রতিফলিত হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে সৃষ্ট সচেতনতা এবং রোমকদের নাগপাশ থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য সৃষ্ট সংকল্পের ব্যাপারটিকে উপেক্ষা করা তাদের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব ছিল না। এ ব্যাপারে রোমকদলে যে ভয় ছিল তা ক্রমে ক্রমে সীমান্তের দিকে সম্প্রসারিত হচ্ছিল। বিশেষ করে আরব ভূখন্ডের সীমান্তবর্তী শাম রাজ্যের জন্য তারা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে শক্তি সঞ্চয়ের পূর্বেই ইসলামী শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে পিষ্ট করে দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করলেন রোমক সম্রাট যাতে রোম সাম্রাজ্যের সংলগ্ন আরব এলাকা থেকে ভবিষ্যতে কোন ফেতনা কিংবা হাঙ্গামার সম্ভাবনা না থাকে।
উপরোক্ত কারণসমূহের প্রেক্ষাপটে মুতাহ যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর একটি বছর পূর্ণ হতে না হতেই রোম সম্রাট রোম সাম্রাজ্যের অধিবাসীদের মধ্য থেকে এবং অধীনস্থ আরব গোত্রসমূহ অর্থাৎ গাসসান পরিবার ও অন্যান্য বিভিন্ন গোত্র থেকে সৈন্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে দিল এবং এক রক্তক্ষয়ী ও চূড়ান্ত ফয়সালাকারী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকল।
এদিকে মদীনায় ক্রমে ক্রমে খবর আসতে থাকে যে, মুসলিমগণের বিরুদ্ধে এক চূড়ান্ত ও মীমাংসাকারী যুদ্ধের জন্য রোমক সম্রাট অত্যন্ত ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে চলেছেন। রোমক সম্রাটের এহেন সমর প্রস্তুতির সংবাদে স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমগণের মনে কিছু অস্বস্তির ভাব সৃষ্টি হয়েছিল এবং কোন অস্বাভাবিক শব্দ শোনা মাত্র তাদের কান খাড়া হয়ে যাচ্ছিল। তাঁদের মনে এ রকম একটি ধারণারও সৃষ্টি হয়েছিল যে, না জানি কখন রোমক বাহিনীর স্রোত এসে আঘাত হানে। ৯ম হিজরীর ঠিক এমনি সময়েই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজ বিবিগণের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে এক মাসের ইলা[1] করেন এবং তাঁদের সঙ্গ পরিহার করে একটি ভিন্ন কক্ষে নির্জনতা অবলম্বন করেন।
প্রাথমিক অবস্থায় সাহাবায়ে কেরাম প্রকৃত সমস্যা অনুধাবন করতে সক্ষম হননি। তাঁরা ধারণা করেছিলেন যে, নাবী কারীম (ﷺ) তাঁর পত্নীদের তালাক দিয়েছেন এবং এ কারণে তাঁদের অন্তরে দারুণ দুঃখ বেদনার সৃষ্টি হয়েছিল। উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) এ ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন যে, ‘আমার একজন আনসারী বন্ধু ছিল, আমি যখন খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত না থাকতাম, তখন তিনি আমার নিকট সংবাদাদি পৌঁছে দিতেন এবং তিনি যখন উপস্থিত না থাকতেন তখন আমি তাঁর নিকট তা পৌঁছে দিতাম।’ তাঁরা উভয়েই মদীনার উপকণ্ঠে বাস করতেন। তাঁরা পরস্পর পরস্পরের প্রতিবেশী ছিলেন এবং পালাক্রমে খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত থাকতেন ঐ সময়ে আমরা গাসসানী সম্রাটকে ভয় করতাম। কারণ, আমাদের বলা হয়েছিল যে, তারা আমাদের আক্রমণ করবে এবং এ ভয়ে আমরা সব সময় ভীত থাকতাম।’
একদিন আমার এ আনসারী বন্ধু আকস্মিক দরজায় করাঘাত করতে করতে বলতে থাকলেন, ‘খুলুন, খুলুন’ আমি বললাম, ‘গাসসানীরা কি এসে গেল?’ তিনি বললেন, ‘না’ বরং এর চাইতেও কঠিন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর স্ত্রীদের থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছেন।[2]
ভিন্ন এক সূত্র থেকে বিষয়টি এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, উমার (রাঃ) বললেন, ‘আমাদের মাঝে সাধারণভাবে এ কথা প্রচারিত হয়েছিল যে, গাসসান গোত্রের লোকজনেরা আমাদের আক্রমণ করার জন্য ঘোড়ার পায়ে নাল লাগাচ্ছে। একদিন আমার বন্ধু তাঁর পালাক্রমে খিদমতে নাবাবীতে হাজির হন। অতঃপর বাদ এশা তিনি বাড়ি ফিরে এসে দরজায় জোরে জোরে আঘাত করতে করতে বলতে থাকেন, ‘এরা কি শুয়ে পড়েছেন? ’ আতঙ্কিত অবস্থায় আমি যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম তখন তিনি বললেন যে, একটি বড় ঘটনা ঘটেছে। আমি বললাম, ‘গাসসানীরা কি এসে গেছে?’ তিনি বললেন, ‘না’ বরং এর চাইতেও কঠিন সমস্যা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর বিবিদেরকে তালাক।’ শেষ পর্যন্ত[3]
উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) বর্ণিত ঘটনা থেকে সহজেই অনুমান ও অনুধাবন করা যায় যে, রোমকগণের যুদ্ধ প্রস্তুতি মুসলিমগণকে কতটা চিন্তিত এবং বিচলিত করে তুলেছিল। মদীনায় মুনাফিক্বদের শঠতা ও চক্রান্ত সমস্যাটিকে আরও প্রকট করে তুলেছিল। অথচ মুনাফিক্বরা এ কথাটি ভালভাবেই অবগত ছিল যে, উদ্ভূত সমস্যার প্রতিটি ক্ষেত্রেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বিজয়ী হয়েছেন এবং পৃথিবীর কোন শক্তিকেই তিনি কখনো ভয় করেন না। অধিকন্তু, এ কথাটিও তারা ভালভাবেই অবগত ছিল যে, যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরুদ্ধাচরণ করেছে তারা সকলেই পর্যুদস্ত এবং ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তবুও অন্তরে অন্তরে তারা একটি ক্ষীণ আশা পোষণ করে আসছিল যে, যুগের আবর্তনের গতিধারায় মুসলিমগণের বিরুদ্ধে তাদের লালিত প্রতিহিংসার অগ্নি একদিন না একদিন প্রজ্জ্বলিত হবেই এবং খুব সম্ভব এটাই হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত সময়। তাদের সেই কল্পিত সুযোগের প্রেক্ষাপটে তারা একটি মসজিদের আকার আকৃতিতে (যা মাসজিদে ‘যেরার’ ‘ক্ষতিকর নামে প্রসিদ্ধ ছিল) ষড়যন্ত্রের আড্ডাখানা তৈরি করল। এর উদ্দেশ্য ছিল মুসলিমগণের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর কুফরী করা ও মুসলিমগণের সঙ্গে লড়াইয়ের উদ্দেশে গোপনে তথ্য সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে তা ব্যবহার করা। তাদের এ অসদুদ্দেশ্যকে ঢেকে রাখার কৌশলস্বরূপ সেখানে সালাত আদায়ের জন্য তারা নাবী কারীম (ﷺ)-কে অনুরোধ জানায়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে সেখানে সালাত পড়ানোর অনুরোধ জানানোর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল যে, মুসলিমগণ কোনক্রমেই যেন চিন্তাভাবনা করার সুযোগ না পায় যে, সেখানে তাঁদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া এ মসজিদে যাতায়াতকারীদের ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও যেন কোন সন্দেহের সৃষ্টি না হয় এটাও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য। এমনিভাবে এ মসজিদটি মুনাফিক্ব ও তাদের দোসরদের নিরাপদ আড্ডা ও গোপন কার্যকলাপের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ মসজিদে সালাত আদায় করার ব্যাপারটি যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত বিলম্বিত করেন। কারণ, যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য তাঁকে অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকতে হচ্ছিল। এর ফলে তাদের দুরভিসন্ধির ব্যাপারে মুনাফিক্বগণ কৃতকার্য হতে সক্ষম হল না। অধিকন্তু, যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই আল্লাহ তাদের অসদুদ্দেশ্যের যবনিকা উন্মোচন করে দিলেন। কাজেই, যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ মসজিদে সালাত আদায় না করে তা বিধ্বস্ত করে দেন।
[2] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৭৩০ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৩৩৪ পৃঃ।
মুসলিমগণ যখন ক্রমাগতভাবে উপর্যুক্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েই চলেছিলেন এমন সময় শাম রাজ্য হতে আগমণকারী তৈল বাহক [1] দলের মাধ্যমে আকস্মিকভাবে জানা গেল যে, হিরাকল ৪০ হাজার সৈন্যের সমন্বয়ে এক যুদ্ধ প্রিয় বাহিনী গঠন করেছে এবং রোমের একজন প্রখ্যাত কমান্ডারের অধিনায়কত্বে এ বাহিনীকে ন্যস্ত করেছে। তাছাড়া, নিজ পতাকার আওতায় খ্রিষ্টান গোত্রসমূহের মধ্যে লাখম জোযাম ও অন্যান্য গোত্রগুলোও একত্রিত করেছে এবং তাদের বাহিনীর অগ্রবর্তী দলটি বালকা’ নামক স্থানে পৌঁছে গেছে। এমনিভাবে এক ভয়াবহ বিপদ মূর্তরূপে মুসলিমগণের সামনে আত্মপ্রকাশ করেছে।
এমনি এক নাজুক পরিস্থিতির মুখে আরও বিভিন্নমুখী সমস্যার ফলে অবস্থা অত্যন্ত জটিল এবং সঙ্গীন হয়ে উঠল। সময়টা ছিল অত্যন্ত গরম। মানুষ ছিল অসচ্ছলতা এবং দুর্ভিক্ষের কবলে। যান বাহনের সংখ্যাও ছিল খুব সীমিত। বাগ-বাগিচার ফলমূলে পরিপক্কতা এসে গিয়েছিল। ফলমূল সংগ্রহ এবং ছায়ার জন্য বাগ-বাগিচায় অবস্থান করাটা মানুষের অধিকতর পছন্দনীয় ছিল। এ সব কারণে তাৎক্ষণিক যুদ্ধ যাত্রার জন্য তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। তদুপরি, পথের দূরত্ব এবং সফরের ক্লেশকিষ্টতা তাদের মনকে দারুনভাবে প্রভাবিত করছিল।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) গভীর মনোনিবেশ সহকারে সমস্যা সংকুল পরিস্থিতির এবং বিভিন্নমুখী প্রতিকূলতা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলেন। তিনি এটা পরিস্কার ভাবে উপলব্ধি করছিলেন যে এ চরম সংকটময় মুহূর্তে যদি রুমীগণের সঙ্গে মোকাবেলা করার ব্যাপারে শৈথিল্য কিংবা গড়িমসি করা হয়, কিংবা আরও অগ্রসর হয়ে তারা যদি মদীনার দ্বার প্রান্তে এসে উপস্থিত হয় তাহলে ইসলামী দাওয়াত ও মুসলিমগণের জন্য তা হবে অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং অমবমাননাকর। এতে মুসলিমগণের সামরিক মর্যাদা দারুণভাবে ক্ষুণ্ণ হবে এবং যে অজ্ঞতার কারণে হুনাইন যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী প্রচন্ডভাবে আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। অধিকন্তু, যুগের আবর্তন-বিবর্তনের ধারায় মুনাফিক্বগণ যে সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে এবং ফাসেক আবূ ‘আমির ফাসেকের মাধ্যমে রোম সম্রাটের সংগে ঐক্যবন্ধন সৃষ্টি করেছে তা পিছন দিক থেকে পেটে খঞ্জর ঢুকিয়ে দেয়ার শামিল। আর সামনের দিক থেকে রুমীদের সৈনিক প্লাবন রক্ষক্ষয়ী আঘাত হানবে তাদের উপর। এমনিভাবে অর্থহীন হয়ে যাবে সে সকল অসাধারণ প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবাবৃন্দ ব্যয় করেছিলেন আল্লাহর দ্বীনের প্রচার ও প্রসার কার্যে, অকৃতকার্যতায় পর্যবসিত হয়ে যাবে সে সময় দুর্লভ সাফল্য যা অর্জন করা হয়েছিল অসামান্য ত্যাগ তিতিক্ষা, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে।
ইসলাম ও মুসলিমগণের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ আলোচনা পর্যালোচনা পর বিভিন্নমুখী সমস্যা সত্ত্বেও নাবী কারীম (ﷺ) সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, মুসলিম অধ্যূষিত অঞ্চলে রুমীদের প্রবেশের সুযোগ না দিয়ে বরং তাদের আঞ্চলিক সীমানার মধ্যেই তাদের সঙ্গে এক চূড়ান্ত ফয়সালাকারী সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন।
রোমকদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তম যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য সাহাবীগণকে নির্দেশ প্রদান করেন। তাছাড়া, মক্কার বিভিন্ন গোত্র এবং অধিবাসীদের নিকট সংবাদ প্রেরণ করেন যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার জন্য। এ সব ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর একটা নীতি ছিল তিনি যখনই কোন যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন তখন যুদ্ধের ব্যাপারে গোপনীয়তা অবলম্বন করতেন। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং প্রকট অভাব অনটনের কারণে এবার তিনি সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে দিলেন যে, রুমীগণের যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল যোদ্ধাগণ যেন উত্তম প্রস্তুতি সহকারে যুদ্ধ যাত্রা করেন। যুদ্ধের জন্য তিনি সাহাবীগণকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করতে থাকেন। এ সময়েই যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারেই সূরাহ তাওবার একটি অংশ অবতীর্ণ হয়। সঙ্গে সঙ্গে সাদকা খয়রাত করার ফযীলত বর্ণনা করা হয় এবং আল্লাহর পথে আপন আপন উত্তম সম্পদ ব্যয় করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়।
সাহাবীগণ (রাঃ) যখনই অবগত হলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রুমীগণের বিরুদ্ধে উত্তম যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন, তখনই তাঁরা পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। বিভিন্ন গোত্র এবং মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনেরা মদীনায় সমবেত হতে আরম্ভ করে দিলেন। যাদের অন্তরে কপটতা ছিল তারা ব্যতীত কোন মুসলিমই এ যুদ্ধের ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাকার কথাটা ঘুণাক্ষরেও মনে ঠাঁই দেন নি। তবে তিন জন মুসলিম এ নির্দেশের বাইরে ছিলেন। নিষ্ঠাবান ঈমানদার হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন নি।
পক্ষান্তরে অবস্থা এই ছিল যে, গরীব ও অসহায় ব্যক্তিবর্গ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে আরয করতেন যে, তাঁদের জন্য সওয়ারীর ব্যবস্থা করা হলে তাঁরাও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। নাবী কারীম (ﷺ) যখন তাঁদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতেন যে,
(لاَ أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّواْ وَّأَعْيُنُهُمْ تَفِيْضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلاَّ يَجِدُوْا مَا يُنفِقُوْنَ) [التوبة:92]
‘তাদের বিরুদ্ধেও কোন অভিযোগ নেই যারা তোমার কাছে যখন বাহন চাওয়ার জন্য এসেছিল তখন তুমি বলেছিলে, ‘আমি তো তোমাদের জন্য কোন বাহন পাচ্ছি না’। তখন তারা ফিরে গেল, আর সে সময় তাদের চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ছিল- এ দুঃখে যে, ব্যয় বহন করার মত কোন কিছু তাদের ছিল না।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ৯২]
যুদ্ধ প্রস্তুতির প্রয়োজনের প্রেক্ষাপটে মুসলিমগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। পরস্পর পরস্পরের তুলনায় সাদকা এবং দান-খয়রাত করতে পারে কে কত বেশী আল্লাহর রাহে। সেই সময় উসমান বিন আফফান শাম রাজ্যের উদ্দেশ্যে এমন একটি বাণিজ্য কাফেলা প্রস্তুত করছিলেন যার মধ্যে ছিল পালান ও গদিসহ দু’শ উট এবং দু’শ উকিয়া রৌপ্য (যার ওজন ছিল প্রায় ঊনত্রিশ কেজি)। এর সব কিছুই তিনি সাদকা করে দেন যুদ্ধের জন্য। এর পর তিনি হাওদাসহ আরও একশ উট দান করেন। এর পরও পুনরায় তিনি এক হাজার (আনুমানিক সাড়ে পাঁচ কেজি ওজনের) স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে এসে নাবী কারীম (ﷺ)-এর কোলের উপর ঢেলে দেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বর্ণমুদ্রাগুলো উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, ‘আজকের পর উসমান যা কিছু করবে তাতে তার কোনই ক্ষতি হবে না। এর পরও উসমান আবার দান করেন এবং আরও সাদকা করেন। এমন কি তাঁর দানকৃত জিনিসের পরিমাণ নগদ অর্থ বাদে নয়শ উট এবং একশ ঘোড়া পর্যন্ত পৌছেছিল।[1]
অন্যদিকে আব্দুর রহমান বিন আওফ (রাঃ) দু’শ উকিয়া রৌপ্য (যার ওজন ছিল প্রায় সাড়ে ঊনত্রিশ কেজি) নিয়ে এলেন এবং আবূ বাকর (রাঃ) তাঁর সমস্ত সম্পদ নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে এনে সমর্পণ করলেন। আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) ছাড়া তাঁর পরিবারবর্গের জন্য আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তাঁর দানের পরিমাণ ছিল চার হাজার দিরহাম এবং নাবী কারীম (ﷺ) সমীপে দান সামগ্রী আনার জন্য তিনিই ছিলেন প্রথম ব্যক্তি। উমার বিন খাত্তাব (রাঃ) দান করেন তাঁর অর্ধেক সম্পদ। আব্বাস (রাঃ) অনেক সম্পদ নিয়ে আসেন। ত্বালহাহ (রাঃ), সা‘দ বিন অবী ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ যথেষ্ট অর্থ নিয়ে আসেন। ‘আসিম বিন আদী নব্বই অসাক (অর্থাৎ সাড়ে তের হাজার কেজি) খেজুর নিয়ে হাজির হন। অন্যান্য সাহাবীগণও কম বেশী দান খয়রাতের বিভিন্ন দ্রব্য নিয়ে আসেন। এমনকি কেউ কেউ এক মুঠ দু’ মুঠ যার নিকট যা ছিল তাই দান করেন। কারণ, এর বেশী দান করার ক্ষমতা তাঁদের ছিল না। মহিলাগণ গলার মালা, হাতের চুড়ি, পায়ের অলংকার, কানের রিং, আংটি ইত্যাদি যার যা ছিল তা নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে কেউ কৃপণতা করেন নি এবং এমন কোন হাত ছিল না যে হাত কিছুই দান করে নি। শুধু মুনাফিক্বগণ দান খয়রাতে অংশ গ্রহণ করে নি। শুধু তাই নয়, যে সকল মুসলিম দান খয়রাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, কথাবার্তায় তাঁদের খোঁচা দিতে তারা ছাড়েনি। যাঁদের শ্রম ছাড়া অন্য কিছুই দেবার মতো ছিল না, তাঁদের ঠাট্টা বিদ্রূপ করে বলল, ‘একটা দু’টা খেজুর দিয়েই এরা রোমক সাম্রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখছে। (৯ : ৭৯)।
(الَّذِيْنَ يَلْمِزُوْنَ الْمُطَّوِّعِيْنَ مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ فِيْ الصَّدَقَاتِ وَالَّذِيْنَ لاَ يَجِدُوْنَ إِلاَّ جُهْدَهُمْ فَيَسْخَرُوْنَ مِنْهُمْ)[التوبة: 79]
‘মু’মিনদের মধ্যে যারা মুক্ত হস্তে দান করে, তাদেরকে যারা দোষারোপ করে আর সীমাহীন কষ্টে দানকারীদেরকে যারা বিদ্রূপ করে, আল্লাহ তাদেরকে বিদ্রূপ করেন আর তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি।’ আত্-তাওবাহ (৯) : ৭৯]
উল্লেখিত তৎপরতা, উৎসাহ-উদ্দীপনা দৌড় ঝাঁপের মধ্য দিয়ে মুসলিম বাহিনীর প্রস্তুতি সম্পন্ন হল। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুহাম্মাদ বিন মাসলামাকে (মতান্তরে সেবা বিন আরফাতকে) মদীনার গভর্ণর নিযু্ক্ত করেন এবং নিজ পরিবারের লোকজনদের দেখাশোনা করার জন্য আলী ইবনু আবি ত্বালিবকে নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু মুনাফিক্বগণ তাঁর প্রতি কটাক্ষ করে কিছু কথাবার্তা বলায় মদীনা হতে বাহির হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট চলে যান। কিন্তু নাবী কারীম (ﷺ) পুনরায় তাঁকে মদীনায় ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ প্রদান করলেন এবং বললেন :
(ألَا تَرْضٰى أَنْ تَكُوْنَ مِنِّيْ بِمَنْزِلَةِ هَارُوْنَ مِنْ مُوْسٰي، إِلَّا أَنَّهُ لَا نَبِيَ بَعْدِيْ).
‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, আমার সঙ্গে তোমার সে রূপই সম্পর্ক রয়েছে যেমনটি ছিল হারুন (আঃ)-এর সঙ্গে মুসা (আঃ)-এর তবে এটা জেনে রাখ যে আমার পরে কোন নাবী আসবে না।’
যাহোক, এ ব্যবস্থাদির পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উত্তর দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। (নাসায়ীর বর্ণনা মোতাবেক দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার)। গন্তব্যস্থল ছিল তাবুক ও সৈন্য সংখ্যা ছিল ত্রিশ হাজার। এর পূর্বে মুসলিমগণ আর কখনই এত বড় সেনাবাহিনীর সমাবেশ ঘটাতে সক্ষম হন নি। বিশাল এক বাহিনী এবং সাধ্যমতো অর্থসম্পদ ব্যয় করা সত্ত্বেও সৈন্যদের পুরোপুরি প্রস্তুত করে নেয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। খাদ্য সম্ভার এবং যান বাহনের যথেষ্ট অভাব ছিল। আঠার জনের প্রতিটি দলের জন্য ছিল মাত্র একটি করে উট যার উপর তাঁরা আরোহণ করতেন পালাক্রমে। অনুরূপভাবে খাওয়ার জন্য প্রায়ই গাছের পাতা ব্যবহার করতে হতো যার ফলে ওষ্ঠাধরে স্ফীতি সৃষ্টি হয়েছিল। অধিকন্তু, উটের অভাব থাকা সত্ত্বেও উট যবেহ করতে হতো যাতে পাকস্থলী এবং নাড়িভূড়ির মধ্যে সঞ্চিত পানি এবং তরল পদার্থ পান করা যেতে পারে। এ কারণে এ বাহিনীর নাম রাখা হয়েছিল ‘জায়শে উসরাত’ (অভাব অনটনের বাহিনী)।
তাবুকের পথে মুসলিম বাহিনীর গমনাগমন চলল হিজর অর্থাৎ সামুদ সম্প্রদায়ের অঞ্চলের মধ্য দিয়ে। সামুদ ছিল সেই সম্প্রদায় যারা ওয়াদিউল কোরা নামক উপত্যকায় পাথর কেটে কেটে ঘরবাড়ি তৈরি করেছিল। সাহাবীগণ (রাঃ) সেখানকার কূপসমূহ হতে পানি সংগ্রহ করার পর যখন যাত্রা করলেন তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(لَا تَشْرَبُوْا مِنْ مَائِهَا وَلَا تَتَوَضَّأُوْا مِنْهُ لِلصَّلَاةِ، وَمَا كَانَ مِنْ عَجِيْنٍ عَجَنْتُمُوْهُ فَاعْلِفُوْهُ الْإِبِلَ، وَلَا تَأْكُلُوْا مِنْهُ شَيْئاً)
‘তোমরা এখানকার পানি পান করনা, এ পানি দ্বারা অযু করোনা এবং এ পানির দ্বারা আটার যে তাল তৈরি করেছ তা পশুদের খাইয়ে দাও, নিজে খেও না।’
তিনি এ নির্দেশও প্রদান করেন যে, ‘সালেহ (আঃ)-এর উট যে কূপ থেকে পানি পান করেছিল তোমরা সে কূপ থেকে পানি সংগ্রহ করবে।’
বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীসে ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নাবী কারীম (ﷺ) যখন হিজর (সামুদ সম্প্রদায়ের অঞ্চল) দিয়ে গমন করছিলেন তখন বলেন,
(لَا تَدْخُلُوْا مَسَاكِنِ الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا أَنْفُسَهُمْ أَنْ يُّصِيْبَكُمْ مَا أَصَابَهُمْ إِلَّا أَنْ تَكُوْنُوْا بَاكِيْنَ)
‘সেই অত্যাচারী সামুদের আবাসভূমিতে প্রবেশ করো না যাতে তোমাদের উপর যেন সে মুসিবত নাযিল হয়ে না যায়, যা তাদের উপর নাযিল হয়েছিল। হ্যাঁ, তবে কাঁদতে কাঁদতে অতিক্রম করতে হবে। অতঃপর তিনি তাঁর মস্তক আবৃত করে নিয়ে দ্রুত গতিতে সেই উপত্যকা অতিক্রম করে গেলেন।[1]
পথের মধ্যে সৈন্যদের পানির তীব্র প্রয়োজন দেখা দিল। এমন কি লোকজনেরা পিপাসার কষ্ট সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট অভিযোগ পেশ করল। তিনি পানির জন্য দু‘আ করলে আল্লাহ তা‘আলা মেঘ সৃষ্টি করলেন এবং বৃষ্টিও হয়ে গেল। লোকেরা পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে পানি পান করলেন এবং প্রয়োজন মতো তা সংগ্রহ করে নিলেন।
অতঃপর যখন তাবুকের নিকট গিয়ে পৌঁছেন তখন নাবী কারীম (ﷺ) বললেন,
(إِنَّكُمْ سَتَأْتُوْنَ غَداً إِنْ شَاءَ اللهُ تَعَالٰى عَيْنَ تَبُوْكَ، وَإِنَّكُمْ لَنْ تَأْتُوْهَا حَتّٰى يَضْحَي النَّهَارَ، فَمَنْ جَاءَهَا فَلَا يَمُسُّ مِنْ مَائِهَا شَيْئاً حَتّٰى آتِيْ)
‘ইনশাআল্লাহ, আগামী কাল আমরা তাবুকের ঝর্ণার নিকট গিয়ে পৌঁছব। কিন্তু সূর্যোদয় ও দুপুরের মধ্যবর্তী সময়ের পূর্বে পৌঁছানো যাবে না। কিন্তু আমার পৌঁছানোর পূর্বে কেউ যদি সেখানে পৌঁছে তাহলে আমি যতক্ষণ সেখানে গিয়ে না পৌঁছি ততক্ষণ যেন তাঁরা সেখানকার পানিতে হাত না লাগায়।
মু‘আয (রাঃ) বলেছেন, ‘আমরা যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম, দেখলাম তার পূর্বেই দু’জন সেখানে গিয়ে পৌঁছেছেন। ঝর্ণা দিয়ে অল্প অল্প পানি আসছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, (هَلْ مَسَسْتُمَا مِنْ مَائِهَا شَيْئاً؟) ‘তোমরা কি এর পানিতে কেউ হাত লাগিয়েছ? তাঁরা উত্তর দিলেন, হ্যাঁ। নাবী কারীম (ﷺ) সে দু’ ব্যক্তিকে আল্লাহ যা ইচ্ছা করলেন তাই বললেন।
অতঃপর অঞ্জলির সাহায্যে ঝর্ণা থেকে অল্প অল্প পানি বের করলেন এবং এভাবে কিছুটা পানি সংগৃহীত হল। এ পানির দ্বারা তিনি মুখমণ্ডল ও হাত ধৌত করলেন এবং ঝর্ণার মধ্যে হাত ডুবালেন। এর পর ঝর্ণায় ভাল পানির প্রবাহ সৃষ্টি হল। সাহাবা কেরাম (রাঃ) পূর্ণ পরিতৃপ্তির সঙ্গে পানি পান করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(يُوْشِكُ يَا مُعَاذُ، إِنْ طَالَتْ بَكَ حَيَاةٌ أَنْ تَرٰي مَاهَاهُنَا قَدْ مُلِّئَ جَنَاناً)
‘হে মু’আয! যদি তোমার জীবন দীর্ঘ হয় তাহলে এ স্থান তুমি বাগানে পরিপূর্ণ ও শ্যামল দেখবে।[2]
পথের মধ্যে কিংবা তাঁবুকে পৌঁছার পর বর্ণনায় কিছুটা পার্থক্য রয়েছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(تَهِبُ عَلَيْكُمْ اللَّيْلَةَ رِيْحٌ شَدِيْدَةٌ، فَلَا يَقُمْ أَحَدٌ مِنْكُمْ، فَمَنْ كَانْ لَهُ بِعَيْرٍ فَلْيِشُدُّ عِقَالَهُ)
‘আজ রাতে তোমাদের উপর দিয়ে প্রবল ঘূর্ণি ধূলি ঝড় বয়ে যেতে পারে। কাজেই, কেউই উঠবে না। অধিকন্তু, যার নিকট উট আছে সে তাকে মজবুত রশি দ্বারা শক্তভাবে বেঁধে রাখবে।’ হলও ঠিক তাই, চলতে থাকল প্রবল থেকে প্রবলতর ধূলো বালি যুক্ত ঘূর্ণি বায়ু। এ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিল। ঘূর্ণি ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তাই গোত্রের দু’ পর্বতের নিকট নিক্ষেপ করল।[3]
পথ চলা কালে নাবী কারীম (ﷺ)-এর এটা ব্যবস্থা ছিল যে, তিনি যুহর ও আসর এবং মাগরিব ও এশার সালাত একত্রে আদায় করতেন। তাছাড়া, তিনি জমা তাকদীমও করতেন এবং জমা তাখীরও করতেন (জমা তাকদীমের অর্থ হচ্ছে যুহর ও আসর এ দু’ সালাতকে যুহরের সময় এবং মাগরিব ও এশা এ দু’ সালাতকে মাগরিবের সময় আদায় করা এবং জমা তাখিরের অর্থ হচ্ছে যুহর ও আসর এ দু’ সালাত আসরের সময় এবং মাগরিব ও এশা এ দু’ সালাতকে এশার সময়ে আদায় করা)।
[2] মুসলিম শরীফ মু’আয বিন জাবাল হতে বর্ণিত ২য় খন্ড পৃ: ২৪৬
[3] প্রাগুক্ত ।
ইসলামী সৈন্য তাবুকে অবতরণ করে শিবির স্থাপন করলেন। রোমকগণের সঙ্গে দুই দুই হাত করার জন্য তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সৈন্যদের উদ্দেশ্য করে জাওয়ামেউল কালাম দ্বারা (এক সারগর্ভ) ভাষণ প্রদান করেন। এ ভাষণে তিনি তাৎপর্যপূর্ণ নির্দেশাবলী প্রদান করেন, দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের প্রতি উৎসাহিত করেন, আল্লাহর শাস্তির ভয় প্রদর্শন এবং তাঁর রহমতের শুভ সংবাদ প্রদান করেন। নাবী কারীম (ﷺ)-এর এ ভাষণ সৈন্যদের মনোবল বৃদ্ধি করে। তাঁদের খাদ্য সম্ভার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ঘাটতি জনিত যে অসুবিধা ছিল এ ভাবে মনস্তাত্মিক স্বস্তিবোধ সৃষ্টির মাধ্যমে বহুলাংশে তা পূরণ করা সম্ভব হল।
অন্য দিকে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও মুসলিম বাহিনীর আগমনের সংবাদ অবগত হয়ে রুমী এবং তাদের মিত্র গোত্রসমূহের মধ্যে এমন ভয় ভীতির সঞ্চার করে যে, সামনে অগ্রসর হয়ে তাঁদের মোকাবেলা করার সাহস তারা হারিয়ে ফেলল এবং বিক্ষিপ্ত হয়ে দেশের অভ্যন্তরভাগে বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ল। রুমীদের এ ভয় ভীতিজনক নিষ্ক্রিয়তা আরব উপদ্বীপের ভিতরে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করল এবং মুসলিম বাহিনীর জন্য তা এমন সব রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা লাভের ক্ষেত্র তৈরি করে দিল যুদ্ধের মাধ্যমে যা অর্জন করা মোটেই সহজ সাধ্য ছিল না। এ সবের বিস্তারিত বিবরণ হচ্ছে যথাক্রমে নিম্নরূপ :
আয়লার প্রশাসক ইয়াহনাহ্ বিন রুবা নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে কর দানের স্বীকৃতি জ্ঞাপন করে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করল। জারবা এবং আজরুহর অধিবাসীগণও খিদমতে নাবাবীতে হাজির হয়ে কর দানের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের লিখিত প্রমাণ প্রত্র প্রদান করেন যা তাদের নিকট সংরক্ষিত ছিল। তিনি আয়লার প্রশাসকের নিকটও লিখিত একটি প্রমাণ পত্র প্রেরণ করেন যার বিষয়বস্তু হচ্ছে নিম্নরূপ:
(بِسْمِ اللهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ، هٰذِهِ أَمَنَةٌ مِّنْ اللهِ وَمُحَمَّدِ النَّبِيِّ رَسُوْلِ اللهِ لِيَحْنَةَ بْنِ رُؤْبَةَ وَأَهْلِ أَيْلَةِ، سفنِهِمْ وَسِيَارَاتِهِمْ فيِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ لَهُمْ ذِمَّةُ اللهِ وَذِمَّةُ مُحَمَّدِ النَّبِيِّ، وَمَنْ كَانَ مَعَهُ مِنْ أَهْلِ الشَّامِ وَأَهْلِ الْبَحْرِ، فَمَنْ أَحْدَثَ مِنْهُمْ حَدَثاً، فَإِنَّهُ لَا يَحُوْلُ مَالهُ دُوْنَ نَفْسِهِ، وَإِنَّهُ طِيْبٌ لِمَنْ أَخَذَهُ مِنْ النَّاسِ، وَأَنَّهُ لَا يَحِلُّ أَنْ يَّمْنَعُوْا مَاءً يُرَدُّوْنَهُ، وَلَا طَرِيْقاً يُرِيْدُوْنَهُ مِنْ بَرٍّ أَوْ بَحْرٍ)
‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম : এ হচ্ছে শান্তির আদেশ পত্র আল্লাহর এবং নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর পক্ষ হতে ইয়াহনাহ বিন রুবা এবং আয়লার অধিবাসীদের জন্য স্থল এবং সমুদ্র পথে তাদের নৌকা এবং ব্যবসায়ী দলের জিম্মা আল্লাহর এবং নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর উপর রইল। তাছাড়া, এ দায়িত্ব সিরিয়া এবং ঐ সকল সমুদ্র তীরবর্তী অধিবাসীদের জন্য রইল যারা ইয়াহনার সঙ্গে থাকে। হ্যাঁ, যদি তাদের কোন ব্যক্তি কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তবে তার অর্থ তার জীবন রক্ষা করবে না এবং যে ব্যক্তি তার অর্থ নিয়ে নেবে তার জন্য তা বৈধ হবে। তাদেরকে কোন ঝর্ণার নিকট অবতরণ করতে এবং স্থল কিংবা জলভাগের কোন পথ অতিক্রম করতে বাধা দেয়া যাবে না।
এছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) চারশ’ বিশ জন সৈন্যের সমন্বয়ে গঠিত এক বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ)-কে দুমাতুল জান্দালের শাসক উকায়দেরের নিকট প্রেরণ করেন। যাত্রাকালে তিনি তাঁকে বলেন, (إِنَّكَ سَتَجِدُهُ يَصِيْدُ الْبَقَرَ) ‘তোমরা তাকে নীল গাভী শিকার করার সময় দেখতে পাবে।’
রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ মোতাবেক খালিদ (রাঃ) তথায় গমন করলেন। মুসলিম বাহিনী যখন এতটুকু দূরত্বে অবস্থান করছিলেন যে দূর্গটি পরিস্কার চোখে পড়ছিল তখন হঠাৎ একটি নীল গাভী বেরিয়ে এসে দূর্গের দরজার উপর শিং দ্বারা গুঁতো দিতে থাকল। উকায়দের তাকে শিকার করার জন্য বাহির হলে খালিদ (রাঃ) এবং তাঁর ঘোড়সওয়ার দল তাকে বন্দী করে ফেললেন এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খিদমতে প্রেরণ করলেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে ক্ষমা করলেন এবং দুই হাজার উট, আটশ’ দাস, যুদ্ধের চারশ’ লৌহ বর্ম এবং চারশ’ বর্শা দেয়ার শর্ত সাপেক্ষে একটি সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন। এ সন্ধি চুক্তিতে কর প্রদানের শর্তও সংযোজিত হল। সুতরাং তিনি তার সাথে ইয়াহনাহ্সহ দুমাহ, তাবুক, আয়লাহ এবং তাইমার শর্তানুযায়ী চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন।
যে সকল গোত্র তখনো রোমকগণের পক্ষে কাজ করছিল, পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যখন তারা অনুধাবন করল যে, পুরাতন ব্যবস্থাধীনে থাকার দিন শেষ হয়েছে তখন তারা নিজেদের নিরাপত্তার স্বার্থে মুসলিমগণের সঙ্গে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেল। এভাবে ইসলামী সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তৃতি লাভ করে রোমক সাম্রাজ্যের প্রান্ত সীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। ফলে যে সকল গোত্র রোমকদের শক্তি জোগাত তারা একদম নিঃশেষ হয়ে গেল।
সংঘর্ষ এবং রক্তক্ষয় ছাড়াই মুসলিম বাহিনী বিজয়ী বেশে মদীনা প্রত্যাবর্তন করলেন। যুদ্ধের ব্যাপারে মু’মিনদের আল্লাহই যথেষ্ট হলেন। তবে পথের মধ্যে এক জায়গায় একটি গিরিপথের নিকট ১২ জন মুনাফেক নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যার এক ঘৃণ্য প্রচেষ্টা চালায়। সে সময় নাবী সে গিরিপথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শুধু আম্মার (রাঃ) যিনি উটের লাগাম ধরে ছিলেন এবং হুযায়ফা (রাঃ) ইয়ামান যিনি উটকে খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। অন্যান্য সাহাবীগণ (রাঃ) দূরবর্তী উপত্যকার নিম্নভূমির মধ্য দিয়ে পথ চলছিলেন। এ কারণে মুনাফিক্বগণ তাদের এ ঘৃণ্য চক্রান্তের জন্য এটিকে একটি মোক্ষম সুযোগ মনে করে নাবী কারীম (ﷺ)-এর দিকে অগ্রসর হতে থাকল।
এদিকে সঙ্গীদ্বয়সহ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যথারীতি সম্মুখ পানে অগ্রসর হচ্ছিলেন এমন সময় পশ্চাত দিকে থেকে অগ্রসরমান মুনাফিক্বদের পায়ের শব্দ তিনি শুনতে পান। এরা সকলেই মুখোশ পরিহিত ছিল। তাদের আক্রমণের উপক্রমমুখে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হুযায়ফাকে তাদের দিকে প্রেরণ করলেন। তিনি তাঁর ঢালের সাহায্যে মুনাফিক্বদের বাহনগুলোর মুখের উপর প্রবল ভাবে আঘাত করতে থাকলেন। এর ফলে আল্লাহর ইচ্ছায় তারা ভীত সন্ত্রস্ত্র অবস্থায় পলায়ন করতে করতে গিয়ে লোকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে গেল। এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের নাম বলে দেন এবং তাদের অসদুদ্দেশ্য সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন। এ জন্য হুযায়ফা (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ‘রাযদান’ রহস্যবিদ বলা হয়। এ ঘটনা উপলক্ষে আল্লাহর এ ইরশাদ অবতীর্ণ হয়
(وَهَمُّوْا بِمَا لَمْ يَنَالُوْا) [التوبة:74]
‘তারা ঐ কাজ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিল যা তারা পায় নি।’ [আত্-তাওবাহ (৯) : ৭৪]
সফর শেষে নাবী কারীম (ﷺ) যখন দূর হতে মদীনার দৃশ্য দেখতে পেলেন তখন তিনি বললেন, (তাবা) এবং (উহুদ), এগুলো হচ্ছে সেই পর্বত যা আমাদেরকে ভালবাসে এবং আমরাও যাকে ভালবাসি। এদিকে যখন মদীনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমন সংবাদ পৌঁছে গেল তখন মহিলা ও কিশোরেরা ঘর থেকে বের হয়ে এসে তাঁকে এবং তাঁর সাহাবীগণকে (রাঃ) খোশ আমদেদ জানিয়ে এ সঙ্গীতে গুঞ্জণধ্বনি উচ্চারণ করল।[1]
طلع البـدر علينا ** من ثنيات الوداع
وجب الشكر علينا ** ما دعا لله داع
অর্থ : সান্নায়াতুল ওয়াদা’ নামকস্থান হতে আমাদের উপর চৌদ্দ তারিখের চন্দ্র উদিত হল। আহবানকারীগণ যতক্ষণ আল্লাহকে আহবান করতে থাকবে ততক্ষণ আমাদের কর্তব্য হবে শোকর করা।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রজব মাসে তাবুকের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন এবং প্রত্যার্তন করেছিলেন রমযান মাসে। এ সফরে পূর্ণ পঞ্চাশ দিন অতিবাহিত হয়েছিল। বিশ দিন তাবুকে এবং ত্রিশ দিন পথে যাতায়াতে। তাবুকে অভিযান ছিল তাঁর জীবনের শেষ যুদ্ধাভিযান যাতে স্বশরীরে তিনি অংশ গ্রহণ করেছিলেন।