মুসলিমগণের মক্কা বিজয় এক আকস্মিক অভিযানের ফলশ্রুতি। যার ফলে আরব গোত্রসমূহ প্রায় হতভম্ব এবং কিংকর্তব্যবিমৃঢ় হয়ে পড়েছিল। তাদের এবং পার্শ্ববর্তী গোত্রসমূহের এতটুকু ক্ষমতা ছিল না যে, তারা এ আকস্মিক অভিযানকে প্রতিহত করতে পারে। এ কারণে কিছু সংখ্যক জেদী অপরিণামদর্শী ও আত্মগর্বী গোত্র ছাড়া আর সব গোত্রই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আত্মসমর্পণ করেছিল। এই জেদী ও আত্মগর্বী গোত্রগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল হাওয়াযিন এবং সাকাফ গোত্র। এদের সঙ্গে মুযার জোশাম এবং সা’দ বিন বকরের গোত্রসমূহ এবং বনু হেলালের কিছু সংখ্যক লোক। এ সব গোত্রের সম্পর্ক ছিল কাইসে আইলানের সঙ্গে। পরাজয় স্বীকার ক’রে মুসলিমগণের নিকট আত্মসমর্পণ করাকে তারা অত্যন্ত অপমানজনক বলে মনে করছিল। এ কারণে ঐ সকল গোত্র মালিক বিন আওফ নাসরীর নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যে, তারা মুসলিমগণকে আক্রমণ করবে।
এ সিদ্ধান্তের পর মুসলিমগণের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ ক’রে মালিক বিন আওফের নেতৃত্বে তারা যাত্রা করল। সম্পদাদি, গবাদি, শিশু সন্তানেরাও ছিল তাদের সঙ্গে। সম্মুখ ভাগে অগ্রসর হয়ে তারা আওতাস উপত্যকায় শিবির স্থাপন করল। এটি হুনাইনের নিকটে বনু হাওয়াযিন গোত্রের অঞ্চলভুক্ত একটি উপত্যকা। কিন্তু এ উপত্যকাটি হুনাইন হতে পৃথক। হুনাইন হচ্ছে অন্য একটি উপত্যকা যা যুল মাজায নামক স্থানের সন্নিকটে অবস্থিত। সেখান থেকে আরাফাতের পথ দিয়ে মক্কার দূরত্ব দশ মাইলেরও বেশী।[1]
আওতাসে অবতরণের পর লোকজনেরা তাদের নেতার নিকট একত্রিত হল। তাদের মধ্যে দোরাইদ বিন সেম্মাও ছিল। এ ব্যক্তি অত্যন্ত বার্ধক্য ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। কাজেই, যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পর্কিত তথ্যাদি অবগত হয়ে পরামর্শ দান ছাড়া আর কোন কিছুই করার উপযুক্ততা তার ছিল না। কিন্তু প্রকৃতই সে ছিল একজন বাহাদুর দাঙ্গাবাজ ও বিজ্ঞ যোদ্ধা। সে জিজ্ঞেস করল তোমরা কোন্ উপত্যকায় অবস্থান করছ?’ উত্তর দেয়া হল, ‘আওতাস উপত্যকায়।’ সে বলল, ‘ঘোড়সওয়ারদের জন্য উত্তম ভ্রমণ স্থান বটে। না, কঙ্করময়, না খানা খন্দক বিশিষ্ট, না খারাপ নিম্নভূমি। কিন্তু ব্যাপারটি কি যে, আমি উটের উচ্ছ্বাস ধ্বনি, গাধার চিৎকার, শিশুদের ক্রন্দন এবং বকরীর ব্যা ব্যা ধ্বনি শুনতে পাচ্ছি?’
লোকজনেরা বলল, ‘মালিক বিন আওফ সৈন্যদের সঙ্গে তাদের মহিলাদের, শিশুদের, গবাদি এবং সম্পদাদি নিয়ে এসেছেন। এ প্রেক্ষিতে দোরাইদ মালিক ইবনু আওফাকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘তুমি কি ভেবে এমন কাজ করেছ?’
সে বলল, ‘আমি চিন্তা করেছি যে, প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিবার এবং সম্পদাদি থাকবে, যাতে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের উত্তেজনা নিয়ে তারা যুদ্ধ করে।’
দুরাইদ বলল, ‘আল্লাহর কসম! তুমি ভেড়ার রাখাল বটে, যুদ্ধে যদি পরাজিত হও তাহলে কোন বস্তু কি তোমাকে রক্ষা করতে পারবে? দেখ! আর যদি তুমি যুদ্ধে বিজয়ী হও তাহলে তলোয়ার এবং বর্শা দ্বারাই তো তুমি উপকৃত হতে। আর যদি পরাজয় বরণ কর তাহলে তোমাদের পরিবার পরিজন এবং সহায় সম্পদ সর্ব ব্যাপারেই অপমানের শিকার হতে হবে।
অতঃপর কতগুলো গোত্র এবং নেতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদের পর দোরাইদ বলল, ‘হে মালিক! তুমি বনু হাওয়াযিন গোত্রের মহিলা এবং শিশুদেরকে ঘোড়সওয়ারদের গলায় ঝুলিয়ে নিয়ে এসে খুব একটা ভাল কাজ কর নি। তাদেরকে তাদের অঞ্চলে উচ্চ ও সংরক্ষিত স্থানে পাঠিয়ে দাও। এরপর ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে বিধর্মীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হও। যদি তোমরা জয়ী হও তাহলে পিছনের নারী শিশুরা তোমাদের সংগে এসে মিলিত হবে, আর যদি তোমরা পরাজিত হও তাহলেও তোমাদের পরিবারবর্গ ধন সম্পদ এবং গবাদিগুলো সংরক্ষিত থাকবে।’
কিন্তু জেনারেল কমান্ডার মালিক এ পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করে বলল, ‘আল্লাহর কসম! আমি এমনটি করব না। তুমি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছ এবং তোমার বিচার বুদ্ধিও লোপ পেয়েছে। আল্লাহর শপথ! হয় হাওয়াযিন আমার আনুগত্য করবে, নতুবা আমি এই তলোয়ারের উপর নির্ভর করব এবং তা আমার পিঠের এক দিক হতে অপর দিকে বেরিয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে মালিক এটা সহ্য করতে পারল না যে, এ যুদ্ধে দোরাইদের সুনাম হবে কিংবা ওর পরামর্শ মতো কাজ করতে হবে। হাওয়াযিন বলল, ‘আমরা তোমার আনুগত্য করছি।’ এর প্রেক্ষিতে দোরাইদ বলল, ‘এ এমন যুদ্ধ যাতে আমি অংশ গ্রহণ তো করবই না, বরং মনে করব যে, আমার নাগালের বাইরে চলে গেছে।’
يا ليتنـي فيها جـَذَعْ ** أخُبُّ فيها وأضَعْ
أقود وطْفَاءَ الزَّمَــعْ ** كأنها شـاة صَدَعْ
দুঃখ আমি যদি এ সময় যুবক হতাম, পূর্ণ উদ্যমের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করতাম। পায়ের লম্বা চুল বিশিষ্ট এবং মধ্যম প্রকারের বকরীর মতো ঘোড়ার পরিচালনা করতাম।
এরপর মালিকের ঐ গোয়েন্দা আসলে যাদের প্রেরণ করা হয়েছিল মুসলিমগণের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ খবর সংগ্রহের উদ্দেশ্য তারা প্রত্যাবর্তন করল। তাদের এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, তাদের হাত,পা এবং দেহের বিভিন্ন অঙ্গের সন্ধিস্থলেও চিড় ধরে গিয়েছিল। তাদের এ অবস্থা দেখে মালিক বলল, ‘তোমরা ধ্বংস হও, তোমাদের এ কী অবস্থা হয়েছে? তারা বলল, ‘আমরা যখন কিছু সংখ্যক সাদা-কালো মিশ্রিত ঘোড়ার উপর সাদা মানুষ দেখেছি, আল্লাহর কসম! তখন থেকে আমাদের এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যা তুমি প্রত্যক্ষ করছ।’
এদিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-ও শত্রুদের অবস্থানের খবর প্রাপ্ত হয়ে আবূ হাদরাদ আসলামী (রাঃ)-কে এ নির্দেশ প্রদান করে প্রেরণ করলেন যে, মানুষের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে অবস্থান করবে এবং তাদের সঠিক খোঁজ খবর নিয়ে প্রত্যাবর্তনের পর তা তাঁকে অবহিত করবে।’ প্রাপ্ত নির্দেশ মোতাবেক তিনি তাই করলেন।
৮ম হিজরীর ৬ই শাওয়াল দিবস রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কা হতে রওয়ানা হলেন। এটি ছিল মক্কা আগমনের ঊনিশতম দিবস। নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে ছিল বার হাজার সৈন্য। মক্কা বিজয়ের সময় তিনি সঙ্গে এনেছিলেন দশ হাজার সৈন্য এবং মক্কার নও মুসলিমগণের মধ্য হতে সংগ্রহ করেছিলেন আরও দু’ হাজার সৈন্য। এ যুদ্ধের জন্য নাবী কারীম (ﷺ) সফওয়ান বিন উমায়েরের নিকট হতে একশ লৌহ বর্ম নিয়েছিলেন এবং আত্তাব বিন উসাইদকে মক্কার গভর্ণর নিযুক্ত করেছিলেন।
দুপুরের পর এক ঘোড়সওয়ার এসে খবর দিলেন যে, ‘আমি অমূক অমূক পর্বতের উপর আরোহণ করে প্রত্যক্ষ করলাম যে, বনু হাওয়াযিন গোত্র গাট্টি বোচকাসহ যুদ্ধের ময়দানে আগমন করেছে। মহিলা, শিশু, গবাদি সব কিছুই তাদের সঙ্গে রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মৃদু হাসির সঙ্গে বললেন, (تِلْكَ غَنِيْمَةُ الْمُسْلِمِيْنَ غَدًا إِنْ شَاءَ اللهُ) ‘আল্লাহ চায় তো এর সব কিছুই গণীমত হিসেবে কাল মুসলিমগণের হাতে এসে যাবে।’ দিন শেষে রাতের বেলা আনাস বিন আবি মারসাদ গানাভী (রাঃ) স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নৈশ্য প্রহরীর দায়িত্ব পালন করেন।[1]
হুনাইন যাওয়ার পথে লোকজনেরা একটি বেশ বড় বড় আকারের সতেজ কুলের গাছ দেখতে পেল। তৎকালে এ গাছকে যাতো আনওয়াত বলা হত। আরবের মুশরিকগণ এর উপর নিজেদের অস্ত্র শস্ত্র ঝুলিয়ে রাখত, ওর নিকট পশু যবেহ করত, মন্দির তৈরি করত, এবং মেলা বসাত। মুসলিম বাহিনীর মধ্য থেকে কিছু সংখ্যক সৈন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বললেন, ‘আমাদের জন্য আপনি যাতো আনওয়াত তৈরি করে দিন যেমনটি তাদের জন্য রয়েছে।’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন,
(اللهُ أَكْبَرُ، قُلْتُمْ وَالَّذِيْ نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ كَمَا قَالَ قَوْمُ مُوْسٰي: اِجْعَلْ لَنَا إِلٰهًا كَمَا لَهُمْ آلِهَةٌ، قَالَ: إِنَّكُمْ قَوْمٌ تَجْهَلُوْنَ، إِنَّهَا السَّنَنُ، لَتَرْكَبُنَّ سَنَنَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ).
‘আল্লাহ আকবার! সে সত্তার শপথ! যাঁর হাতে রয়েছে আমার জীবন তোমরা ঠিক সেরূপ কথা বলেছ, যেমন বলেছিল মুসা (আঃ)-এর কওম, ‘ইজ্আল লানা ইলা হান, কামা লাহুম আ লিহাহ’ (আমাদের জন্য উপাস্য তৈরি করে দিন যেমন তাদের জন্য উপাস্য রয়েছে :) এটাই রীতিনীতি। তোমরাও পূর্বের রীতিনীতির উপর অবশ্যই আরোহণ করে বসবে।[2]
[2] তিরমিযী বাবুল ফিতান, তোমরা পুর্বপুরুষদের নিয়ম মেনে চলবৈ, প্রসঙ্গ ২য় খন্ড ৪১ পৃঃ।
মঙ্গলবার ও বুধবার পথ চলার পর ১০ই শাওয়াল মধ্য রাত্রি মুসলিম বাহিনী হোনাইনে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু মালিক বিন আওফ পূর্বেই তার বাহিনী নিয়ে সেখানে অবতরণ করে এবং রাতের অন্ধকারে অত্যন্ত সঙ্গোপনে তারা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটকে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে মোতায়েন করে দেয়। অধিকন্তু, তাদের এ নির্দেশও প্রদান করা হয় যে, মুসলিম বাহিনী উপত্যকায় অবতরণ করা মাত্রই যেন প্রবলভাবে তাদের উপর তীর নিক্ষেপ করে তাদের ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলা হয় এবং একযোগে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হয়।
এদিকে সাহরীর সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সৈন্যদের শ্রেণী বিন্যাস করে নিলেন এবং পতাকা বেঁধে লোকজনের মধ্যে বিতরণ করলেন। অতঃপর সকালে মুসলিম বাহিনী দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হয়ে হুনাইন উপত্যকায় উপস্থিত হলেন। শত্রুদের অবস্থান সম্পর্কে তাঁদের জানা ছিল না। তাঁরা জানতেন না যে, শত্রুপক্ষের সাক্বীফ ও হাওয়াযিন গোত্রের বীর সৈনিকগণ এ উপত্যকায় সংকীর্ণ গিরিপথে অবস্থান গ্রহণ করেছে অগ্রসরমান মুসলিম বাহিনীর উপর অতর্কিতভাবে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে। এ কারণে সম্পূর্ণ নিরুদ্বিগ্ন চিত্তেই তাঁরা সেখানে অবতরণ করছিলেন। এমন সময় আকস্মিকভাবে তাঁদের তীর বর্ষণ শুরু হয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রু দলে দলে তাঁদের উপর এক যোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আকস্মিক এ আক্রমণের প্রচন্ডতা সামলাতে না পেরে মুসলিম বাহিনী ছত্রভঙ্গ অবস্থায় এমনভাবে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে থাকল যে কেউ কারো প্রতি লক্ষ্য করল না। এ ছিল এক পর্যুদস্ত অবস্থা এবং অবমাননাকর পরাজয়। এমন কি আবূ সুফইয়ান বিন হারব (যিনি নতুন মুসলিম হয়েছিলেন) বললেন, ‘এখন তাদের দৌড়াদৌড়ি সমুদ্রের আগে থামবে না। জাবালাহ অথবা কালাদাহ বিন হাম্বাল চিৎকার করে বললেন, ‘দেখ, জাদু বাতিল হয়ে গেল।’
যাহোক, যখন দৌড় ঝাঁপ অরম্ভ হয়ে গেল তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ডান দিক থেকে উচ্চৈঃস্বরে ডাক দিলেন, ‘ওহে লোকজনেরা! আমার দিকে এসো, আমি মুহাম্মাদ (ﷺ) বিন আব্দুল্লাহ। ঐ সময় কিছু সংখ্যক মুহাজির এবং পরিবারের লোকজন ছাড়া অন্য কেউ তাঁর সঙ্গে ছিলেন না।[1]
ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনামতে তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র নয় জন। আর ইমাম নাবাবী মতানুসারে তাদের সংখ্যা ছিল বার জন। বিশুদ্ধ কথা সেটাই যা ইমাম আহমাদ ও হাকিম তাঁর মুসতাদরাকে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ হতে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, হুনাইন যুদ্ধে আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে ছিলাম। লোকেরা সব পালিয়ে গেল এমতাবস্থায় তাঁর সাথে আনসার ও মুহাজির মিলে মাত্র আশি জন্য অবশিষ্ট ছিল। আমরা সবাই দৃঢ়পদে যুদ্ধ করলাম এবং আমাদের কেউ পলায়ন করেনি’।
ইমাম তিরমিযী হাসান সূত্রে ইবনু ‘উমার হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, আমরা দেখলাম যে, লোকেরা হুনাইন ছেড়ে পলায়ন করছে। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে রয়েছেন তিনশত সাহাবা (রাঃ)।
উল্লেখিত সংকটপূর্ণ সময়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে তেজোদীপ্ততা ও বীরত্ব প্রদর্শন করেন তার কোন তুলনা ছিল না। মুসলিম বাহিনীর ইতস্তত বিক্ষিপ্ততা এবং দৌঁড় ঝাঁপের মুখেও তিনি ছিলেন অচল অটল ও শত্রু অভিমুখী এবং সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার জন্য তাঁর খচ্চরকে উত্তেজিত করতে থাকেন। এ সময় তিনি বলতেছিলেন
(أنــا النبي لا كَذِبْ ** أنا ابن عبد المطلب)
অর্থ : আমি সত্যই নাবী, মিথ্যা নই, আমি আব্দুল মুত্তালিবের পৌপুত্র।
কিন্তু সে সময় আবূ সুফইয়ান বিন হারিস (রাঃ) নাবী কারীম (ﷺ)-এর খচ্চরকে রেকাব ধরে টেনে রেখেছিলেন এবং আব্বাস (রাঃ) খচ্চরের রিক্বা’ব ধরে তাকে থামিয়ে রেখেছিলেন। তাঁরা উভয়েই এ কারণে খচ্চরকে থামিয়ে রেখেছিলেন যেন সে দ্রুতগতিতে এগিয়ে না যায়।
এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আপন চাচা আব্বাস (রাঃ)-কে নির্দেশ প্রদান করলেন সাহাবীগণ (রাঃ)-কে উচ্চৈঃস্বরে আহবান জানাতে। (তিনি ছিলেন দরাজ কণ্ঠ বিশিষ্ট)। আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, ‘আমি অত্যন্ত উচ্চ কণ্ঠে আহবান জানালাম, ‘ওহে বৃক্ষ-তলের ব্যক্তিবর্গ। (বাইয়াত রিযওয়ানে অংশ গ্রহণকারীবৃন্দ) কোথায় আছ? আল্লাহর কসম! আমার কণ্ঠ শ্রবণ করা মাত্র তারা এমনভাবে ফিরে এল বাচ্চার ডাক শুনে গাভী যেমনটি ফিরে আসে এবং উত্তরে বলল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা আসছি’। এ সময় এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে কোন ব্যক্তি যদি তাঁর উটকে ফিরানোর চেষ্টা করেও ফিরাতে সক্ষম না হলে তিনি নিজ লৌহ বর্ম তার গলায় নিক্ষেপ করে নিজ ঢাল ও তলোয়ার সামলিয়ে নিয়ে উটের পিঠ থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ত এবং উটকে ছেড়ে দিয়ে এ শব্দের দৌড় দিতে থাকত। এভাবে সমবেত হয়ে যখন নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট একশ লোকের সমাবেশ ঘটল তখন তাঁরা শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করে দিলেন।
এরপর শুরু হল আনসারদের প্রতি আহবান, ‘এসো, এসো আনসারের দল দ্রুত এগিয়ে এসো।’ আনসারদের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত এ আহবান বনু হারিস বিন খাযরাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। এ দিকে মুসলিম সৈন্যগণ যে গতিতে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে গিয়েছিলেন[1] ঠিক সে গতিতেই পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন করতে থাকলেন। দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের মধ্যে উভয় পক্ষের মধ্যে কালো ধোঁয়ার স্রোতের ন্যায় তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যুদ্ধের ময়দানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘এখন চুলা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।’ প্রকৃত পক্ষে যুদ্ধক্ষেত্রে তখন চরম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। অতঃপর তিনি জমিন থেকে এক মুষ্টি মাটি নিয়ে তা শত্রুদের প্রতি নিক্ষেপ করে দিয়ে বললেন, ‘শাহাতিল উজুহ’ ‘মুখমণ্ডল বিকৃত হোক’। এ এক মুষ্টি মাটি এমনভাবে বিস্তার লাভ করল যে, শত্রুপক্ষের এমন কোন লোক ছিল না যার চক্ষু এ মাটি দ্বারা পরিপূর্ণ হয়নি। এরপর থেকে তাদের যুদ্ধোন্মাদনা ক্রমে ক্রমে স্তিমিত হতে থাকে এবং তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যায়।
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাটি নিক্ষেপের কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুদের পরাজয়ের ধারা সূচিত হয়ে গেল এবং আরও কিছুক্ষণ অতিবাহিত হতে না হতেই তারা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হল। সাক্বীফের সত্তর জন লোক নিহত হল এবং তাদের সঙ্গে যা কিছু সম্পদ অস্ত্র-শস্ত্র, মহিলা, শিশু এবং গবাদি ছিল সবই মুসলিমগণের হস্তগত হল। এটাই হচ্ছে সে পরিবর্তন, যে সম্পর্কে আল্লাহ সুবাহানাহু তা‘আলা কুরআনে ইঙ্গিত করেছেন,
(وَيَوْمَ حُنَيْنٍ إِذْ أَعْجَبَتْكُمْ كَثْرَتُكُمْ فَلَمْ تُغْنِ عَنكُمْ شَيْئًا وَضَاقَتْ عَلَيْكُمُ الأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ ثُمَّ وَلَّيْتُم مُّدْبِرِيْنَ ثُمَّ أَنَزلَ اللهُ سَكِيْنَتَهُ عَلٰى رَسُوْلِهِ وَعَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ وَأَنزَلَ جُنُوْدًا لَّمْ تَرَوْهَا وَعذَّبَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَذَلِكَ جَزَاء الْكَافِرِيْنَ) [التوبة:25، 26]
‘হুনায়নের যুদ্ধের দিন, তোমাদের সংখ্যার আধিক্য তোমাদেরকে গর্বে মাতোয়ারা করে দিয়েছিল, কিন্তু তা তোমাদের কোন কাজে আসেনি, যমীন তার বিশালতা নিয়ে তোমাদের কাছে সংকীর্ণই হয়ে গিয়েছিল, আর তোমরা পিছন ফিরে পালিয়ে গিয়েছিলে। তারপর আল্লাহ তাঁর রসূলের উপর, আর মু’মিনদের উপর তাঁর প্রশান্তির অমিয়ধারা বর্ষণ করলেন, আর পাঠালেন এমন এক সেনাবাহিনী যা তোমরা দেখতে পাওনি, আর তিনি কাফিরদেরকে শাস্তি প্রদান করলেন। এভাবেই আল্লাহ কাফিরদেরকে প্রতিফল দিয়ে থাকেন।’ [আত তাওবাহ (৯) : ২৫-২৬]
পরাজিত হওয়ার পর শত্রুদের একটি দল ত্বায়িফ অভিমুখে চলে যায়। অন্য একটি দল নাখলার দিকে পলায়ন করে, অধিকন্তু অন্য একটি দল আওতাসের পথ ধরে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবূ ‘আমর আশ’আরী (রাঃ)-এর নেতৃত্বে একটি পশ্চাদ্ধাবনকারী দল আওতাসের দিকে প্রেরণ করেন। উভয় দলের মধ্যে সামান্য সংঘর্ষের পর মুশরিক দল পলায়নে উদ্যত হল। তবে এ সংঘর্ষে দলনেতা আবূ ‘আমির আশ’আরী (রাঃ) শহীদ হয়ে যান।
মুসলিম ঘোড়সওয়ারদের একটি দল নাখলার দিকে প্রত্যাবর্তনকারী মুশরিকদের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং দোরাইদ বিন মিম্মাহকে পাকড়াও করেন যাকে রাবী’আহ বিন রাফী হত্যা করেন।
পরাজিত মুশরিকগণের তৃতীয় এবং সব চাইতে বড় দলটির পশ্চাদ্ধাবন ক’রে যাঁরা ত্বায়িফের পথে গমন করেন যুদ্ধ লব্ধ সম্পদ একত্রিত করার পর স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-ও তাঁদের সঙ্গে যাত্রা করেন।
গণীমতের মধ্যে ছিল যুদ্ধ বন্দী ছয় হাজার উট চবিবশ হাজার, বকরি, চল্লিশ হাজারেও বেশী ছিল এবং রৌপ্য চার হাজার উকিয়া (অর্থাৎ এক লক্ষ ষাট হাজার দিরহাম যার পরিমাণ ছয় কুইন্টালের কয়েক কেজি কম হয়)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সকল সম্পদ একত্রিত করার নির্দেশ প্রদান করেন। অতঃপর সেগুলো জেয়েররানা নামক স্থানে জমা রেখে মাসউদ বিন ‘আমর গিফারীকে তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন। ত্বায়িফ যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন এবং অবসর না হওয়া পর্যন্ত তিনি গণীমত বন্টন করেন নি।
যুদ্ধ বন্দীদের মধ্যে ছিল রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দুধ বোন শায়মা বিনতে হারিস। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আনীত হয়ে সে নিজ পরিচয় পেশ করলে তিনি তার একটি পরিচিত চিহ্নের মাধ্যমে তাকে সহজেই চিনতে পারলেন এবং নিজ চাদর বিছিয়ে তার উপর সসম্মানে বসালেন। অতঃপর তাকে তার কওমের নিকট ফেরত পাঠালেন।