উপর্যুক্ত প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে সম্ভাব্য উত্তরমালার মধ্যে সর্বপ্রথম এবং সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব জাহানের অনাদি অনন্ত অদ্বিতীয়, সর্বশক্তিমান স্রষ্টা প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলার প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস এবং তাঁর অস্তিত্ব, হিকমত এবং কুদরত সম্পর্কে সঠিক এবং সুস্পষ্ট ধারণা বা জ্ঞান। কারণ, তাওহীদের সুস্পষ্ট ধারণা এবং তাওহিদী নূরে যখন মু’মিনের অন্তর আলোকিত, উদ্বেলিত ও পুলকিত হয়ে ওঠে, পর্বত-প্রমাণ প্রতিবন্ধকতাও তখন তাঁর সামনে শুষ্ক তৃণখন্ডের মতো তুচ্ছ মনে হয়। যে মু’মিন পরিপক্ক ও সুদৃঢ় ঈমান এবং মজবুত ইয়াকীনের অধিকারী হওয়ার দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করেন, তাঁর সম্মুখে পৃথিবীর যত প্রকট সমস্যাই আসুক না কেন, তা যতই ভয়ংকর এবং ভীতিপ্রদই হোক না কেন, তাঁর অটল বিশ্বাসে বলীয়ান চেতনা এবং তাওহীদের অলৌকিক আস্বাদে পরিতৃপ্ত মন এ সব কিছুকে স্যাঁতসেঁতে এদো পরিবেশে ভগ্ন ইষ্টকখন্ডের উপর জমে উঠা শেওলার চাইতে অধিক কিছুই মনে করেন না। এ কারণেই ঈমানী সুরার অলৌকিক আস্বাদে পরিতৃপ্ত কোন ঈমানদারের প্রাণের সজীবতা এবং উদার উন্মুক্ত চিত্তের আনন্দানুভূতি মূর্খ ও নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানব সৃষ্ট দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণাকে কখনো পরোয়া করে না। কুরআন মাজীদে যেমনটি ইরশাদ হয়েছে,
(فَأَمَّا الزَّبَدُ فَيَذْهَبُ جُفَاء وَأَمَّا مَا يَنفَعُ النَّاسَ فَيَمْكُثُ فِي الأَرْضِ) [الرعد:17]
‘‘ফেনা খড়কুটোর মত উড়ে যায়, আর যা মানুষের জন্য উপকারী তা যমীনে স্থিতিশীল হয়।’ (আর-রা‘আদ : ১৩ : ১৭)
তারপর এ কারণের সূত্র ধরেই অস্তিত্ব লাভ করে অজস্র কারণ যা সেই ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও দৃঢ়তাকে আরও মজবুত করে তোলে।
এটা সর্বজনতবিদিত এবং সর্ববাদী সম্মত সত্য যে, নাবী কারীম (ﷺ) ছিলেন বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ এবং সাধারণভাবে বিশ্বমানবের জন্য মহিমান্বিত পরিচালক ও প্রাজ্ঞ পথপ্রদর্শক। দেহে, মন-মানসিকতায়, নেতৃত্বে, সৌজন্যে, সদাচারে তিনি ছিলেন সর্ব প্রজন্মের সকলের জন্য আদর্শ, অপরূপ দৈহিক সুষমা, আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতা, মহোত্তম চরিত্র, বিনম্র স্বভাব, উদার-উন্মুক্ত আচরণ, ন্যায়নিষ্ঠ কার্যকলাপ, অসাধারণ পান্ডিত্য বুদ্ধিমত্তা ও বাগ্মিতা সব কিছুর সমন্বয়ে তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যাঁর সান্নিধ্য কিংবা সাহচর্যে মানুষ একবার এলে বার বার ফিরে ফিরে আসার জন্য আপনা থেকেই প্রলুব্ধ হতো এবং তাঁর (ﷺ) খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়ার জন্য ব্যকুল হয়ে উঠল। তাঁর বিনয় নম্র আচরণ, সত্যবাদিতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতা, আমানতদারী, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি সদগুণাবলীর জন্য বন্ধু-বান্ধব দূরের কথা, শত্রুরাও তাঁকে শ্রদ্ধা না করে পারতেন না। তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত। তাঁর শত্রুরাও তাঁর কোন উক্তি কিংবা অঙ্গীকারকে যে অবিশ্বাস্য বলে মনে করতে পারতেন না তার বহু প্রমাণ রয়েছে। এখানে কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করা হলঃ
এক দফা কুরাইশগণের এমন তিন ব্যক্তি একত্রিত হয় যারা পৃথক পৃথকভাবে একজন অন্যজনের অগোচরে কুরআন পাঠ শ্রবণ করেছিল। কিন্তু পরে তাদের প্রত্যেকের এ গোপন তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়ে। সেই তিন জনের মধ্যে একজন ছিল আবূ জাহল। তিন জন যখন একত্রিত হল তখন একজন আবূ জাহলকে বলল, ‘তুমি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর নিকট যা শ্রবণ করেছ সে সম্পর্কে তোমার মতামত কী তা বল।’
আবূ জাহল বলল, ‘আমি কি আর এমন শুনেছি। প্রকৃত কথা হচ্ছে আমরা এবং বনু আবদে মানাফ মান-মর্যাদার ব্যাপারে একে অন্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আসছি। তারা যেমন গরীব-মিসকীনদের খানা খাওয়ায়, আমরাও তেমনি তাদের খানা খাওয়াই। তারা দান-খয়রাত করে, আমারও তা করি। তারা জনগণকে বাহন প্রদান করে আমরাও তা করি। এখন আমরা এবং তারা উভয় পক্ষই সর্বক্ষেত্রে একে অন্যের সমকক্ষ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতারত দুটো ঘোড়ার ন্যায় উর্ধ্বশ্বাসে অবিরাম ছুটে চলেছি। এখন তারা নতুনভাবে বলতে শুরু করেছে যে, তাদের মাঝে একজন নাবী আছেন যাঁর নিকট আকাশ থেকে আল্লাহর বাণী অবতীর্ণ হয়। আচ্ছা, বলত আমরা তাহলে কিভাবে তাদের নাগাল পেতে পারি? আল্লাহর কসম! আমরা ঐ ব্যক্তির প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করব না এবং তাঁকে কখনই সত্যবাদী বলনা না[1] যেমনটি আবূ জাহল বলত, হে মুহাম্মাদ (ﷺ)! আমরা তোমাকে ‘মিথ্যুক’ বলছিনা কিন্তু তুমি যা নিয়ে এসেছ তা মিথ্যা মনে করছি এবং এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেন,
(فَإِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُوْنَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِآيَاتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ) [الأنعام:33].
‘কেননা তারা তো তোমাকে মিথ্যে মনে করে না, প্রকৃতপক্ষে যালিমরা আল্লাহর আয়াতকেই প্রত্যাখ্যান করে।’ (আল-আন‘আম ৬ : ৩৩)
এ ঘটনা পূর্বে সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে যে, একদিন কাফেরগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে তিনবার অভিশাপ দেন। তৃতীয় দফায় নাবী কারীম (ﷺ) ইরশাদ করলেন,
(يَا مَعْشَرُ قُرَيْشٍ، جِئْتُكُمْ بِالذَّبْحِ)
‘‘হে কুরাইশগণ! আমি কুরবাণীর পশু নিয়ে তোমাদের নিকট আগমন করছি।’’
এ কথা তখন তাদের উপর এমনভাবে প্রভাব সৃষ্টি করল যে, যে ব্যক্তি শত্রুতায় সকলের চাইতে অগ্রগামী ছিল সে-ই সর্বোৎকৃষ্ট কথাবার্তা দ্বারা নাবী (ﷺ)-কে সন্তুষ্ট করতে সচেষ্ট হল।
অনুরূপভাবে একটি ঘটনারও বিস্তারিত বিবরণ ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনাটি ছিল সিজদারত অবস্থায় যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর উপর নাড়িভূঁড়ি নিক্ষেপ করা হয় এবং তারপর মাথা উত্তোলন করেন তখন তিনি নিক্ষেপকারীর বিরুদ্ধে বদদোয়া করতে থাকেন তখন তারা একদম অস্থির হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে ভয়-ভীতি ও দুশ্চিন্তার ঢেউ প্রবাহিত হতে থাকে। তারা আর বাঁচতে পারবে না বলে তাদের মনে স্থির বিশ্বাসের সৃষ্টি হয়।
অন্য একটি ঘটনায় এটা উল্লেখিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন আবূ লাহাবের পুত্র উতায়বার বিরুদ্ধে বদ দু‘আ করলেন, তখন তার স্থির বিশ্বাস হয়ে গেল যে, সে নাবী কারীম (ﷺ)-এর বদ দু‘আ থেকে কিছুতেই মুক্তি পাবে না। যেমনটি শাম রাজ্য সফর অবস্থায় ব্যাঘ্র দেখেই বলেছিল, ‘আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ (ﷺ) মক্কা থেকেই আমাকে হত্যা করল।’
অন্য একটি ঘটনায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, উবাই বিন খালফ নাবী কারীম (ﷺ)-কে হত্যা করার জন্য বারবার হুমকি দিতেছিল। এক দফা নাবী কারীম (ﷺ) উত্তরে বললেন যে, ‘(তোমরা নয়) বরং আল্লাহ চানতো আমিই তোমাদের হত্যা করব, ইনশা-আল্লাহ।’ এর পর উহুদের যুদ্ধে নাবী কারীম (ﷺ) যখন উবাইয়ের গলদেশ বর্শার দ্বারা আঘাত করলেন, তখন যদিও সে আঘাত খুবই সামান্য ছিল তবুও উবাই বারবার এ কথাই বলছিল যে, ‘মুহাম্মাদ আমাকে মক্কায় বলেছিলেন যে, আমি তোমাকে হত্যা করব। কাজেই, সে যদি আমার গায়ে থুথুও দিত তাতেও আমার মৃত্যু হয়ে যেত।[2]
এমনভাবে এক দফা সা’দ বিন মা’আয মক্কায় উমাইয়া বিন খালফকে বলেছিল, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি যে, মুসলিমগণ তোমাদের হত্যা করবে তখন থেকে উমাইয়া ভীষণভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং ভয়-ভীতি তার অন্তরে সর্বক্ষণ বিরাজমান থাকে। তাই সে মনে মনে স্থির করেছিল যে, সে কখনই মক্কার বাইরে যাবে না। কিন্তু বদর যুদ্ধের সময় আবূ জাহলের পীড়াপীড়ি এবং চাপের মুখে বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য মক্কার বাইরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনবোধে যাতে দ্রুত পশ্চাদপসরণ সম্ভব হয় সে উদ্দেশ্যে সে মক্কার সব চাইতে দ্রুতগামী উটটি ক্রয় করে নিয়ে তার উপর সওয়ার হয়ে যুদ্ধে যায়।
এ দিকে যুদ্ধে যাবার প্রস্তুতি প্রত্যক্ষ করে তার স্ত্রীও তাকে এ ব’লে বাধা দেয় যে, ‘আবূ সাফওয়ান! আপনার ইয়াসরিবী ভাই যা বলেছিলেন আপনি কি তা ভুলে গেছেন?’ সে উত্তর দিল ‘না ভুলি নি, তবে আল্লাহর শপথ, তাদের সঙ্গে আমি অল্প দূরই যাব।[3]
এইত ছিল নাবী (ﷺ) শত্রুদের অবস্থা, অন্যদিকে তাঁর সাহাবীগণ (রাঃ), সঙ্গী-সাথী ও বন্ধু-বান্ধবগণের সকলের কাছে তিনি ছিলেন প্রাণের চাইতেও প্রিয়। তিনি ছিলেন সকলের চিন্তা-চেতনা ও অন্তরের চিকিৎসক। তাঁদের অন্তর থেকে উৎসারিত ভক্তি ও ভালবাসার ধারা ঠিক সেভাবে নাবী (ﷺ)-এর দিকে প্রবাহিত হতো যেমনটি জলের ধারা উচ্চ থেকে নিম্নভূমির দিকে প্রবলবেগে প্রবাহিত হতে থাকে এবং তাঁদের সকলের প্রাণ ঠিক সেইভাবে নাবী (ﷺ)-এর প্রাণের দিকে আকর্ষিত হতে থাকত, যেমনটি সাধারণ লৌহখন্ড আকর্ষিত হতে থাকে চুম্বুক লৌহের আকর্ষণে।
فصورته هيولى كل جسم ** ومغناطيس أفئـدة الرجــال
অর্থঃ ‘মুহাম্মাদের ছবি প্রতিটি মানবদেহের জন্য মূল অস্তিত্ব স্বরূপ ছিল এবং তাঁর বাস্তব অস্তিত্ব প্রতিটি অন্তরের জন্য চুম্বকের মতো ছিল।’
রাসূলুল্লাহ (ﷺ)’র জন্য সাহাবীগণ (রাঃ)-এর অন্তরে প্রেম, প্রীতি, শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালবাসার যে বেহেশতী ধারা সর্বক্ষণ প্রবাহিত হতো, অখন্ড মানব জাতির ইতিহাসে কোথাও তার কোন তুলনা মেলে না। সাহাবীগণ (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জন্য কখনো কোন ত্যাগ স্বীকারকেই বড় বলে মনে করতেন না। এমন কি এ কথাও পছন্দ করতেন না যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নখে সামান্যতম আঘাত লাগুক অথবা তাঁর পায়ে কাঁটার আঁচড় লাগুক। তাঁর জন্য তাঁদের নিজেদের জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করতে তাঁরা সর্বক্ষণ প্রস্তুত থাকতেন।
একদিন আবূ বাকর সিদ্দীক (রাঃ) অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে প্রহৃত হলেন। উতবাহ বিন রাবীআহ তাঁর নিকটে এসে তালিযুক্ত জুতো দ্বারা প্রহার করতে লাগল। বিশেষ করে চেহারা লক্ষ করে মারতে মারতে তাঁর পিঠের উপর চড়ে বসল। এ অবস্থায় তাঁর গোত্র বনু তাইমের লোকজন তাঁকে কাপড়ে জড়িয়ে বাড়ি আনে। তাদের বিশ্বাস ছিল যে, তিনি আর বাঁচবেন না। কিন্তু দিনের শেষ ভাগে তাঁর কথা বের হল। আর সব কিছুর আগে প্রশ্ন করলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অবস্থা কী? এর জন্য বনু তাইমের লোকেরা তাঁকে বকাঝকা করল। তাঁর মা উম্মুল খায়েরকে এ কথা বলে তারা ফিরে গেল যে, তাঁকে কিছু পানাহার করাবে। একেবারে একাকী অবস্থায় তিনি আবূ বাকর (রাঃ)-কে কিছু পানাহারের জন্য অনুরোধ করলেন। কিন্তু তিনি এ কথাই বলতে থাকলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কী অবস্থায়?’ পরিশেষে উম্মুল খায়ের বললেন, ‘আমি তোমার সাথীর সংবাদ জানি না।’ আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘উম্মু জামীল বিনতে খাত্তাবের নিকট যাও এবং তাকে জিজ্ঞেস করো।’ তিনি উম্মু জামীলের নিকটে গিয়ে বললেন, ‘আবূ বাকর (রাঃ), তোমার নিকট মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছে। উম্মু জামিল বললেন, আমি না চিনি মুহাম্মাদ সাঃ-কে আর না চিনি আবূ বাকর (রাঃ)-কে। তবে তুমি যদি চাও তাহলে তোমার সাথে তোমার পুত্রের নিকট যেতে পারি।’
উম্মুল খায়ের বললেন, ‘খু-উ-ব ভালো’’।
এরপর উম্মু জামীল তার সঙ্গে এসে দেখলেন আবূ বাকর (রাঃ) চরম শ্রান্ত, ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত অবস্থান পড়ে রয়েছেন। তারপর তাঁর নিকটবর্তী হয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘যারা আপনাকে এই দুরবস্থার মধ্যে নিপতিত করেছে তারা অবশ্যই জঘন্য প্রকৃতির লোক এবং অমানুষ কাফের। আমি আশা করি যে, আল্লাহ আপনার এ অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন।
আবূ বাকর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কী হয়েছে?
তিনি বললেন, ‘আপনার মা তো শুনছেন’’।
বললেন, ‘কোন অসুবিধা নেই’
তিনি বললেন, ‘সহীহুল সালামতে আছেন।’
‘‘কোথায় আছেন তিনি?’
‘‘ইবনে আরকামের বাড়িতে।’
আবূ বাকর (রাঃ) বললেন, ‘যতক্ষণ আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দরবারে উপস্থিত না হব ততক্ষণ আমি খাদ্য কিংবা পানীয় কোন কিছুই গ্রহণ করব না। এটাই হচ্ছে আল্লাহর জন্য আমার অঙ্গীকার।’
তারপর উম্মুল খায়ের এবং উম্মু জামীল সেখানেই অবস্থান করলেন। লোকদের আগমন এবং প্রত্যাগমন বন্ধ হয়ে যাবার পর যখন নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে থাকল তখন মহিলাদ্বয় আবূ বাকর (রাঃ)-কে সঙ্গে নিয়ে বাহির হলেন। তিনি তাদের উপর ভর দিয়ে চলতে থাকলেন এবং এভাবে তাঁরা তাঁকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর খেদমতে পৌঁছে দিলেন।[4]
নাবী (ﷺ)-এর জন্য শ্রদ্ধা, মহববত, উৎসর্গীকরণ ও ত্যাগ তিতিক্ষার বিরল ঘটনাবলী এ গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্ন প্রসঙ্গে বর্ণিত হবে। বিশেষ করে উহুদ যুদ্ধের ঘটনাবলী এবং খুবায়েবের প্রসঙ্গে সেগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করা হবে।
[2] ইবনে হিশাম ২য় খন্ড ৮৪ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড ৫৬৩ পৃঃ।
[4] আলবেদায়া ওয়ান্নেহাযা ৩য় খন্ড ৩০ পৃঃ।
সাহাবীগণ (রাঃ) এটা সুস্পষ্টভাবে অবগত ছিলেন যে, এ একমুষ্টি মাটি যাকে ‘মানুষ’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে আল্লাহর তরফ থেকে তার উপর যে বিশাল এবং দুর্বহ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে কোন অবস্থাতেই তা থেকে বিমুখ হওয়া কিংবা তাকে এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। কারণ, দায়িত্ববিমুখ হলে কিংবা দায়-দায়িত্ব এড়িয়ে গেলে তার ফল যা হবে তা কাফির মুশরিকগণের অন্যায়, অত্যাচার এবং নির্যাতন নিপীড়নের তুলনায় সাত সহস্র গুণ বেশী ভয়াবহ এবং বিধ্বংসকারী হবে। অধিকাংশ কর্তব্যবিমুখ হলে কিংবা কর্তব্য এড়িয়ে গেলে নিজের এবং সমগ্র মানবতার যে ক্ষতি হবে এবং এমন সব সমস্যার উদ্ভব হবে যার তুলনায় এ সব দুঃখ কষ্ট এবং ক্ষয়ক্ষতি তেমন কিছুই নয়।
আল্লাহর জমীনে দ্বীন কায়েম করার ব্যাপারে আল্লাহর তরফ থেকে মানুষের উপর যে দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তৎসম্পর্কিত বোধকে শক্তিশালী এবং কর্মমুখী করার অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম হচ্ছে পরকালীন জীবনে বিশ্বাস। সাহাব কিরাম (রাঃ) এ কথার উপর অটল বিশ্বাস স্থাপন করেছিলেন যে, পরকালীন জীবনে বিচার দিবসে তাদিগকে অবশ্যই রাববুল আলামীনের নিকট নিজেদের কার্যকলাপের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ হিসাব দিতে হবে। পুণ্যবানগণ অনন্ত সুখশান্তির চিরস্থায়ী আবাস জান্নাতে চিরকাল মহাসুখে বসবাস করতে থাকবেন। পক্ষান্তরে, পাপীতাপীগণ দুঃখ কষ্ট ও যন্ত্রণার আবাসস্থল জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হয়ে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকবে। তাই তারা সর্বক্ষণ কল্যাণমুখী কাজকর্মে লিপ্ত থাকার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা জান্নাত লাভের আশায় উন্মুখ হয়ে থাকতেন। অন্যদিকে তেমনি মহান আল্লাহর অসন্তুষ্টি জাহান্নামের আযাবের ভয়ে অস্থির হয়ে থাকতেন। যেমনটি নিম্নোক্ত আয়াতে কারীমায় বর্ণিত হয়েছে।
(يُؤْتُوْنَ مَا آتَوْا وَّقُلُوْبُهُمْ وَجِلَةٌ أَنَّهُمْ إِلٰى رَبِّهِمْ رَاجِعُوْنَ) [المؤمنون:60]
‘‘যারা তাদের দানের বস্তু দান করে আর তাদের অন্তর ভীত শংকিত থাকে এ জন্যে যে, তাদেরকে তাদের প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে।’ (আল-মু’মিনূন ২৩ : ৬০)
এ বিষয়েও তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ, বিত্তবৈভব ও ভোগবিলাস, পরলৌকিক জীবনের সে সবের তুলনায় মশার একটি পাখার সমতুল্যও নয়। তাঁদের এ বিশ্বাস এতই দৃঢ়মূল ছিল যে, এর সামনে পৃথিবীর যাবতীয় সমস্যা দুঃখ কষ্ট জুলম নির্যাতন সব ছিল অত্যন্ত তুচ্ছ ব্যাপার। কাজেই জুলম নির্যাতনের মাত্রা যতই বৃদ্ধি পেয়েছে তাঁদের ইয়াকীন (বিশ্বাস) এবং সহনশীলতাও ততোধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে যা কাফির মুশরিক বিরোধীপক্ষকে হতভম্ব ও হতবাক করে দিয়েছে।
কাফির মুশরিকসৃষ্ট ভয়ঙ্কর বিপদ আপদ ও ঘোর সামাজিক অনাচার এবং অবক্ষয় জনিত অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থায় এমন সব সূরাহ ও আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হয়েছিল যার মধ্যে নিবিড় অথচ আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে ইসলামের মৌলিক নিয়মকানুনের উপর প্রমাণাদি ও দালায়েল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেই সময় উল্লেখিত নিয়ম কানুনের পাশাপাশি দাওয়াত এবং তাবলীগের কাজও পূর্ণোদ্যমে চলছিল। এ আয়াত সমূহে ইসলামের অনুসারীগণকে এমন সব মৌলিক কাজ কর্ম করতে বলা হচ্ছিল যার উপর ভিত্তি করে আল্লাহ তা‘আলা মানবগোষ্ঠির সবচাইতে উন্নত সমাজ অর্থাৎ ইসলামী সমাজের নির্মাণ ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। উল্লেখিত আয়াতসমূহের মাধ্যমে মুসলিমগণের আবেগ ও অনুভূতিকে স্থায়িত্ব ও দৃঢ়তা দান কল্পে করা হচ্ছিল। আয়াতে কারীমাঃ
(أَمْ حَسِبْتُمْ أَن تَدْخُلُوْا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُم مَّثَلُ الَّذِيْنَ خَلَوْاْ مِن قَبْلِكُم مَّسَّتْهُمُ الْبَأْسَاء وَالضَّرَّاء وَزُلْزِلُوْا حَتّٰى يَقُوْلَ الرَّسُوْلُ وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللهِ أَلا إِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيْبٌ) [البقرة:214 ]
‘‘তোমরা কি এমন ধারণা পোষণ কর যে, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ লাভ করবে, অথচ এখনও পর্যন্ত তোমাদের আগের লোকেদের মত অবস্থা তোমাদের সামনে আসেনি? তাদেরকে অভাবের তীব্র তাড়না এবং মসীবত স্পর্শ করেছিল এবং তারা এতদূর বিকম্পিত হয়েছিল যে, নাবী ও তার সঙ্গের মু’মিনগণ চিৎকার করে বলেছিল- আল্লাহর সাহায্য কখন আসবে? জেনে রেখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য নিকটবর্তী।’ (আল-বাক্বারাহ ২ : ২১৪)
(الم أَحَسِبَ النَّاسُ أَن يُتْرَكُوْا أَن يَقُوْلُوْا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُوْنَ وَلَقَدْ فَتَنَّا الَّذِيْنَ مِن قَبْلِهِمْ فَلَيَعْلَمَنَّ اللهُ الَّذِيْنَ صَدَقُوْا وَلَيَعْلَمَنَّ الْكَاذِبِيْنَ) [العنكبوت:1- 3]
‘আলিফ-লাম-মীম। লোকেরা কি মনে করে যে, ‘আমরা ঈমান এনেছি’ বললেই তাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে দেয়া হবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? তাদের পূর্বে যারা ছিল আমি তাদেরকে পরীক্ষা করেছিলাম; তারপর আল্লাহ অবশ্য অবশ্যই জেনে নেবেন কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যেবাদী।’ [আল-‘আনকাবূত (২৯) : ১-৩]
আর তাদেরই পাশে পাশে এমনও আয়াতসমূহ অবতীর্ণ হচ্ছিল যার মধ্যে কাফির ও বিরুদ্ধাচরণকারীদের প্রশ্নের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেয়া হয়েছে। তাদের জন্য কোন প্রকার সুযোগ সুবিধার অবকাশই দেয়া হয় নি। অধিকন্তু, তাদেরকে অত্যন্ত সহজ এবং সুস্পষ্টভাবে এটা বলে দেয়া হয়েছে যে, যদি কেউ আপন ভ্রষ্টতা ও অবাধ্যতায় একগুঁয়েমী ভাব পোষণ করে থাকে তাহলে এর পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। এর প্রমাণ স্বরূপ বিগত জাতিগুলোর এমন সব ঘটনা এবং ঐতিহাসিক সাক্ষ্য প্রমাণাদি উপস্থাপন করা হয়েছে যদ্দ্বারা এটা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, নিজের বন্ধু এবং শত্রুদের ক্ষেত্রে আল্লাহর রীতিনীতি এবং ব্যবস্থাদি কি রয়েছে? তারপর ভয় প্রদর্শনের পাশাপাশি করুণা এবং অনুগ্রহের কথাও বলা হয়েছে। তাছাড়া উপদেশ প্রদান ও গ্রহণ এবং আদেশ ও পথ প্রদর্শনের দায়িত্বও আদায় করা হয়েছে যেন প্রকাশ্য ভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত ব্যক্তিগণ বিরত হতে চাইলে বিরত হতে পারে।
প্রকৃতই কুরআন মাজীদ মুসলিমগণকে অন্য এক জগতে পরিভ্রমণে রত রেখেছিল এবং তাদিগকে সৃষ্টির বিভিন্ন দৃশ্যপট, প্রভূত্বের পরিপাট্য, লিল্লাহিয়াতের চরমোৎকর্ষ এবং অনুকম্পা অনুগ্রহ, দয়াদাক্ষিণ্য, সন্তুষ্টি ইত্যাদি সম্পর্কিত এমন সব দ্বীপ্তিময় দৃশ্য প্রদর্শন করা হচ্ছিল যে, সেগুলোর আকর্ষণ ও মোহের সামনে কোন প্রতিবন্ধকতাই টিকে থাকতে পারে নি।
উপরন্তু, সে সকল আয়াতে মুসলিমগণকে যে সব সম্বোধন করা হচ্ছিল তা হলো-
يُبَشِّرُهُمْ رَبُّهُمْ بِرَحْمَةٍ مِنْهُ وَرِضْوَانٍ وَجَنَّاتٍ لَهُمْ فِيهَا نَعِيمٌ مُقِيمٌ
“তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছেন তাঁর দয়া ও সন্তুষ্টির, আর জান্নাতের যেখানে তাদের জন্য আছে স্থায়ী সুখ-সামগ্রী”। (তাওবাহ : ২১ আয়াত)
তার মধ্যে এমনও আয়াত রয়েছে যাতে সীমালংঘনকারী কাফিরদের বিরোধীতার পরিণতির চিত্র অংকন করা হয়েছে-আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَوْمَ يُسْحَبُونَ فِي النَّارِ عَلَىٰ وُجُوهِهِمْ ذُوقُوا مَسَّ سَقَرَ
“যেদিন তাদেরকে মুখের ভরে আগুনের মধ্যে হিঁচড়ে টেনে আনা হবে (তখন বলা হবে) ‘জাহান্নামের স্পর্শ আস্বাদন কর”। (ক্বামার : ৪৮ আয়াত)
উপর্যুক্ত বিষয়গুলো ছাড়াও মুসলিমগণ নিপীড়িত নির্যাতিত হওয়ার পূর্ব থেকে বরং বলা যায় যে, বহু পূর্ব থেকেই অবহিত ছিলেন যে, ইসলাম গ্রহণ করার অর্থ স্থায়ী বিবাদে জড়িয়ে পড়া কিংবা বিবাদ-বিসম্বাদের কারণে ক্ষয়-ক্ষতির শিকারে পরিণত হওয়া নয়, বরং এর প্রকৃত অর্থ ও উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামী দাওয়াত পেশ করার প্রথম দিন থেকেই অজ্ঞদের অজ্ঞতা এবং তাদের অনুসৃত যাবতীয় ভ্রান্ত পথ ও পদ্ধতির অবসান কল্পে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নির্দেশিত পথে অচল অটল থাকা। এ দাওয়াতের আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হচ্ছে পৃথিবীর রাজনৈতিক অঙ্গণে ইসলামী ভাবধারা ও ইসলামী বিধি-বিধানের বিস্তরণে বিশ্ব রাজনীতিকে এমনভাবে প্রভাবিত করা যাতে বিশ্বের জাতিসমূহকে আল্লাহর রেযামন্দি বা সন্তুষ্টির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে বান্দার দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে প্রতিষ্ঠিত করা।
কুরআন মাজীদে এ শুভ সংবাদ কখনো আকার ইঙ্গিতে কখনো বা সুস্পষ্ট ভাষায় নাজিল করা হয়েছে। অথচ গোটা পৃথিবীর উপর মুসলিমগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আভাষ ইঙ্গিত সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল তারা যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। মুসলিমগণ যখন এমন এক অবস্থায় নৈরাশ্যের অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন তখন অন্য দিকে আবার এমন সব আয়াত অবতীর্ণ হচ্ছিল যার মধ্যে বিগত নাবীগণের ঘটনাবলী এবং তাঁদের মিথ্যাপ্রতিপন্ন কারীগণের বিস্তারিত বিবরণের উল্লেখ ছিল। সে সব আয়াতে যে চিত্র অংকণ করা হচ্ছিল তার সঙ্গে মক্কার মুসলিম ও কাফিরগণের অবস্থার হুবহু সাদৃশ্য ছিল। এ সকল ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমে এ ইঙ্গিতও প্রদান করা হচ্ছিল যে, সেই সকল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অন্যায়-অত্যাচারীগণ কিভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং আল্লাহর সৎ বান্দাগণ কিভাবে পৃথিবীর উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ আয়াতসমূহের মধ্যে এমন আয়াতও অবতীর্ণ হয়েছিল যার মধ্যে মুসলিমগণের বিজয়ী হওয়ার শুভ সংবাদ বিদ্যমান ছিল। যেমনটি কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
(وَلَقَدْ سَبَقَتْ كَلِمَتُنَا لِعِبَادِنَا الْمُرْسَلِيْنَ إِنَّهُمْ لَهُمُ الْمَنصُوْرُوْنَ وَإِنَّ جُندَنَا لَهُمُ الْغَالِبُوْنَ فَتَوَلَّ عَنْهُمْ حَتّٰى حِيْنٍ وَأَبْصِرْهُمْ فَسَوْفَ يُبْصِرُوْنَ أَفَبِعَذَابِنَا يَسْتَعْجِلُوْنَ فَإِذَا نَزَلَ بِسَاحَتِهِمْ فَسَاء صَبَاحُ الْمُنذَرِيْنَ) [الصافات:171: 177]
‘আমার প্রেরিত বান্দাহদের সম্পর্কে আমার এ কথা আগেই বলা আছে যে, তাদেরকে অবশ্যই সাহায্য করা হবে। আর আমার সৈন্যরাই বিজয়ী হবে। কাজেই কিছু সময়ের জন্য তুমি তাদেরকে উপেক্ষা কর। আর তাদেরকে দেখতে থাক, তারা শীঘ্রই দেখতে পাবে (ঈমান ও কুফুরীর পরিণাম)। তারা কি আমার শাস্তি তরান্বিত করতে চায়? শাস্তি যখন তাদের উঠানে নেমে আসবে, তখন কতই না মন্দ হবে ঐ লোকেদের সকালটি যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল!।’ [আস-স-ফফাত (৩৭) : ১৭১-১৭৭]
(سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ) [القمر:45]
‘এ সংঘবদ্ধ দল শীঘ্রই পরাজিত হবে আর পিছন ফিরে পালাবে।’ (আল-ক্বামার ৫৪ : ৪৫)
(جُندٌ مَّا هُنَالِكَ مَهْزُوْمٌ مِّنَ الأَحْزَابِ) [ص:11]
‘(আরবের কাফিরদের) সম্মিলিত বাহিনীর এই দলটি এখানেই (অর্থাৎ এই মাক্কাহ নগরীতেই একদিন) পরাজিত হবে।’ [স-দ (৩৮): ১১]
যারা হাবাশায় হিজরত করেছিলেন তাদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হলো :
(وَالَّذِيْنَ هَاجَرُوْا فِي اللهِ مِن بَعْدِ مَا ظُلِمُوْا لَنُبَوِّئَنَّهُمْ فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَلَأَجْرُ الآخِرَةِ أَكْبَرُ لَوْ كَانُوْا يَعْلَمُوْنَ) [النحل:41]
‘যারা অত্যাচারিত হওয়ার পরও আল্লাহর পথে হিজরাত করেছে, আমি তাদেরকে অবশ্য অবশ্যই এ দুনিয়াতে উত্তম আবাস দান করব, আর আখিরাতের পুরস্কার তো অবশ্যই সবচেয়ে বড়। হায়, তারা যদি জানত!’ [আন-নাহল (১৬): ৪১]
এভাবে কাফিরগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট ইউসুফ (আঃ)-এর ঘটনা জিজ্ঞেস করল, তার উত্তরে আনুষঙ্গিক আয়াতে কারীমা অবতীর্ণ হলঃ
(لَّقَدْ كَانَ فِيْ يُوْسُفَ وَإِخْوَتِهِ آيَاتٌ لِّلسَّائِلِيْنَ) [يوسف:7]
‘‘ ইউসুফ আর তার ভাইদের ঘটনায় সত্য সন্ধানীদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন আছে।’ (ইউসুফ ১২ : ৭)
অর্থাৎ মক্কাবাসী মুশরিকগণ আজ ইউসুফ (আঃ)-এর যে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করছে এরা নিজেরাও অনুরূপভাবে অকৃতকার্য হবে যেমন ইউসুফ (আঃ)-এর ভাইগণ অকৃতকার্য হয়েছিল এবং তাদেরও রক্ষণাবেক্ষণের অবস্থা তাই হবে যা তাদের ভাইগণের হয়েছিল। তাদের ইউসুফ (আঃ) এবং তাঁর ভাইদের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা একান্ত উচিত যে, অত্যাচারীদের হার কিভাবে হয়।
পয়গম্বরের কথা উল্লেখ করে কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে,
(وَقَالَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا لِرُسُلِهِمْ لَنُخْرِجَنَّـكُم مِّنْ أَرْضِنَآ أَوْ لَتَعُوْدُنَّ فِيْ مِلَّتِنَا فَأَوْحٰى إِلَيْهِمْ رَبُّهُمْ لَنُهْلِكَنَّ الظَّالِمِيْنَ وَلَنُسْكِنَنَّـكُمُ الأَرْضَ مِن بَعْدِهِمْ ذٰلِكَ لِمَنْ خَافَ مَقَامِيْ وَخَافَ وَعِيْدِ) [إبراهيم:13، 14].
‘কাফিরগণ তাদের রসূলদের বলেছিল, ‘আমরা তোমাদেরকে আমাদের দেশ থেকে অবশ্য অবশ্যই বের করে দেব, অন্যথায় তোমাদেরকে অবশ্য অবশ্যই আমাদের ধর্মমতে ফিরে আসতে হবে। এ অবস্থায় রসূলদের প্রতি তাদের প্রতিপালক এ মর্মে ওয়াহী করলেন যে, ‘আমি যালিমদেরকে অবশ্য অবশ্যই ধ্বংস করব। আর তাদের পরে তোমাদেরকে অবশ্য অবশ্যই যমীনে পুনর্বাসিত করব। এ (শুভ) সংবাদ তাদের জন্য যারা আমার সামনে এসে দাঁড়ানোর ব্যাপারে ভয় রাখে আর আমার শাস্তির ভয় দেখানোতে শংকিত হয়।’ [ইবরাহীম (১৪) : ১৩-১৪]
অনুরূপভাবে যে সময় পারস্য এবং রোমে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল তখন মক্কার কাফেরগণ চাইল যে পারসিকরা জয়ী হোক, কেননা তারাও ছিল কাফের। আর মুসলিমগণ চাইল যে রোমীয়গণ জয়ী হোক, কারণ আর যা হোক না কেন, রোমীয়গণ আল্লাহর উপর, পয়গম্বর, ওহী, আসমানী কিতাবসমূহ এবং বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস করার দাবীদার ছিলেন। কিন্তু পারস্যবাসীগণ যখণ জয়লাভের পথে অনেকটা অগ্রসর হল তখন আল্লাহ তা‘আলা এ শুভ সংবাদকে যথেষ্ট মনে না করে তার পাশাপাশি এ শুভ সংবাদটিও প্রদান করেন যে, রোমীয়গণের বিজয়ী হওয়ার প্রাক্কালে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমগণকে বিশেষ সাহায্য প্রদান করবেন যাতে তারা সন্তোষ লাভ করবে। যেমনটি ইরশাদ হয়েছে,
(وَيَوْمَئِذٍ يَفْرَحُ الْمُؤْمِنُوْنَ بِنَصْرِ الله ) [الروم: 4، 5]
‘সেদিন মু’মিনরা আনন্দ করবে। (সে বিজয় অর্জিত হবে) আল্লাহর সাহায্যে।’ [আর-রূম (৩০) : ৪-৫]
পরবর্তী পর্যায়ে আল্লাহ তা‘আলার এ সাহায্যই বদর যুদ্ধে অর্জিত মহা সাফল্য এবং বিজয়ের মধ্য দিয়ে রূপ লাভ করে। অধিকন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজেও অনুরূপ শুভ সংবাদ পরিবেশন করে মুসলিমগণকে উৎসাহিত করতেন। যেমন হজ্জের জনগণের মধ্যে প্রচারের জন্য গমন করতেন তখন শুধুমাত্র জান্নাতেরই শুভসংবাদ দিতেন না বরং পরিস্কার ভাষায় ঘোষণাও করতেন,
(يَأَيُّهَا النَّاسُ، قُوْلُوْا: لاَ إِلٰهَ إِلاَّ اللهُ تُفْلِحُوْا، وَتَمْلِكُوْا بِهَا الْعَرَبَ، وَتَدِيْنُ لَكُمْ بِهَا الْعَجَمُ، فَإِذَا مِتُّمْ كُنْتُمْ مُلُوْكًا فِيْ الْجَنَّةِ)
অর্থঃ ‘ওগো জনগণ! কালিমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করো তাহলে সফলকাম হবে এবং এর ফলে আরবের সম্রাট হতে পারবে ও আজম তোমাদের অধীনস্থ হয়ে যাবে। আবার তোমরা যখন মৃত্যুর পরে জান্নাতে প্রবেশ করবে তখনো তোমরা সেখানে উচ্চ মর্যাদা ও প্রাধান্য লাভ করবে।[1]
এ ঘটনা ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। ব্যাপারটি হচ্ছে যখন উতবাহ বিন রাবী’আহ নাবী (ﷺ)-এর নিকট পার্থিব জগতের পণ্য দ্রব্যের প্রস্তাব দিয়ে বিনিময় বা লেনদেন করতে চাইল এবং তদুত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হামীম সিজদার আয়াতসমূহ পাঠ করে শোনালেন তখন উতবাহর এ বিশ্বাস হয়ে গেল যে, শেষ পর্যন্ত মুহাম্মাদ (ﷺ)-ই জয়ী হবেন।
অনুরূপভাবে আবূ ত্বালিবের নিকট আগমনকারী কুরাইশগণের শেষ প্রতিনিধিদের সাথে নাবী (ﷺ)-এর যে কথোপকথন হয়েছিল তারও বিস্তারিত বিবরণ ইতোপূর্বে দেয়া হয়েছে। সে সময়ও নাবী কারীম (ﷺ) মুশরিকগণকে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন যে, তারা যদি তাঁর শুধু একটি কথা মেনে নেয় তাহলে গোটা আরবজাহানে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। এবং আজম তাদের অধীনস্থ হয়ে যাবে।
খাব্বাব বিন আরাত বলেছেন যে, ‘এক দফা আমি নাবী কারীম (ﷺ)-এর খেদমতে হাযির ছিলাম। তিনি ক্বাবা’হ ঘরের ছায়ায় একটি চাদরকে বালিশ করে শুয়েছিলেন। সে সময় আমরা মুশরিকগণণের হাতে দারুণভাবে নির্যাতিত হচ্ছিলাম। আমি বললাম, আল্লাহর সমীপে প্রার্থনা করছেন না কেন? এ কথা শ্রবণ করে নাবী কারীম (ﷺ)-এর মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ ধারণ করল। তিনি উষ্মার সঙ্গে বললেন,
(لَقَدْ كَانَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَيَمْشُطُ بِمُشَاطِ الْحَدِيْدِ مَا دُوْنَ عِظَامِهِ مِنْ لَحْمٍ وَعَصَبَ مَا يَصْرِفُهُ ذٰلِكَ عَنْ دِيْنِهِ،
‘‘যাঁরা তোমাদের পূর্বে গত হয়ে গেছেন তাঁদের শরীরের হাড়ে মাংস পর্যন্ত ছিল না। যাঁদের শরীরে মাংস ছিল তাঁদের মাংসপেশীতে লোহার চিরুনী দ্বারা আঁচড়ানো হতো। কিন্তু নির্যাতিত এবং নিপীড়িত হয়েও তাঁরা কোনদিন ধৈর্যচ্যুত হন নাই।
তারপর তিনি বললেন,
وَلَيَتَمَنَّ اللهُ هٰذَا الْأَمْرَ حَتّٰى يَسِيْرُ الرَّاكِبُ مِنْ صَنْعَاءَ إِلٰى حَضْرَمَوْتَ مَا يَخَافُ إِلَّا اللهُ ـ زاد بيان الراوى ـ وَالذِّئْبُ عَلٰى غَنَمِهِ)
‘আল্লাহ এ বিষয়কে অর্থাৎ দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দেবেন ইনশা-আল্লাহ। এমনকি সানআ হতে হাজারা মাওত পর্যন্ত একজন আরোহীর যাতায়াত কালে আল্লাহ ছাড়া কারোই ভয় থাকবে না। তবে ছাগলের জন্য বাঘের ভয় থাকবে।[2] অন্য এক বর্ণনায় এটাও আছে যে, (وَلٰكِنَّكُمْ تَسْتَعْجِلُوْنَ) কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়ো করছ।[3]
এটা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য যে, এ শুভ সংবাদের কোন কিছুই গোপন ছিল না। মুসলিমগণের মতো কাফিরগণও এ সব ব্যাপারে সুবিদিত ছিল। তাদের এ সব কিছু অবগতির কারণে যখন আসওয়াদ বিন মুত্তালিব এবং তার বন্ধুগণ সাহাবীগণ (রাঃ)-কে দেখতে পেত তখন বিদ্রূপ করে একজন অপরজনকে বলত, ‘দেখ দেখ ঐ যে, পৃথিবীর সম্রাট এসে গেছে, এরা শীঘ্রই কায়সার ও কিসরা বাদশাহকে পরাজিত করবে। এ সব কথা বলে তারা করতালি দিত এবং মুখে বিদ্রূপাত্মক শিস্ দিত।[4]
সে সময় সাহাবীগণের (রাঃ) বিরুদ্ধে অন্যায় অত্যাচার, উৎপীড়ন নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা সবকিছুর ব্যাপ্তি এবং মাত্রা উভয় দিক দিয়েই চরমে পৌঁছেছিল কিন্তু তা সত্ত্বেও জান্নাত লাভের নিশ্চিত আশা, ভরসা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের শুভসংবাদ ঝড়ো হাওয়ার ঝাপটায় নিক্ষিপ্ত ও বিতাড়িত মেঘমালার মতো মুসলিমগণের মানস আকাশ থেকে যাবতীয় দুঃখ বিপদকে বিদূরিত করে দিত।
এ ছাড়া রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিমগণের ঈমানী তালীমের মাধ্যমে অবিরামভাবে আধ্যাত্মিক খোরাক যোগাতেন, কিতাব ও হিকমতের শিক্ষা দিয়ে আত্মার পরিশুদ্ধির ব্যবস্থা করতেন এবং অত্যন্ত সূক্ষ্ণ ও সময়োচিত উপদেশ ও নির্দ্দেশনা প্রদান করতেন। তাছাড়া আত্মসম্মানবোধ, দৈহিক ও মানসিক পরিচ্ছন্নতা, চরিত্র মাধুর্য ও চারিত্রিক পবিত্রতা, সহিষ্ণুতা, সংযম, সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা, অসত্য, অন্যায় ও অবিচারের প্রতি ঘৃণা ও আপোষহীন সংগ্রাম ইত্যাদি গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে সাহাবীগণ (রাঃ)-কে এমনভাবে তৈরি করে নিয়েছিলেন যেন, তাঁরা প্রয়োজনের মুহূর্তে এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠতে পারেন।
সর্বোপরি অজ্ঞানের অন্ধকার থেকে বাহির করে হেদায়েতের আলোকজ্জ্বল প্রান্তরে এনে যখন তিনি সাঃ তাঁদেরকে দাঁড় করিয়ে দিলেন তখন তাঁদের পূর্বের জীবন ও নতুন জীবনের মধ্যে রাতের অন্ধকার ও দিনের আলোর মতই পার্থক্য সূচিত হয়ে গেল। তাঁদের অন্তর্দৃষ্টির সামনে প্রতিভাত হয়ে উঠল স্রষ্টার অনন্ত মহিমা ও সৃষ্টি দর্শন, সীমাহীন বিশ্বের অন্তহীন বিস্তার ও বৈচিত্র, মানবজীবনের অনন্ত সম্ভাবনা পথ ও পাথেয় এবং পরলৌকিক জীবনের সফলতা-সাফল্য সম্পর্কিত মহাসত্যের উপলব্ধি।
উপর্যুক্ত বিষয়াদির আলোকে প্রত্যেক সাহাবীর মধ্যে এমন একটি সমন্বিত চেতনার সৃষ্টি হল যার মাধ্যমে বিপদ-আপদে ধৈর্য ধারণের অলৌকিক ক্ষমতা অর্জন, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, প্রবনতার মোড় পরিবর্তন, আত্মশক্তির উৎকর্ষ সাধন, নিবেদিত নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভকে জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে তাঁরা এমন এক জীবন গঠনে ব্রতী হয়ে গেলেন কোথাও তার কোন তুলনা মিলে না।
[2] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫৪৩ পৃঃ।
[3] সহীহুল বুখারী ১ম খন্ড ৫১০ পৃঃ।
[4] ফিক্বহুস সীরাহ ৮৪ পৃঃ।