এ প্রতিনিধিদল মদীনায় আগমন করেছিলেন ৯ম হিজরী সনে। মুসায়লামা কাযযাবসহ এ দলের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৭ জন।[1]
মুসায়লামার বংশ পরিচয় : মুসায়লামা বিন সুমামাহ বিন কাবীর হাবীব বিন হারিস।
এ দলটি একজন আনসারী সাহাবীর বাড়িতে আশ্রিত হন। অতঃপর খিদমতে নাবাবীতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তবে মুসায়লামা কাযযাব সম্পর্কে ভিন্নমুখী বর্ণনা রয়েছে। সকল বর্ণনার সারসংক্ষেপ সূত্রে বুঝা যায় যে, অধিনায়কত্বের বাসনা ও উৎকট অহংবোধের কারণে সে নাবী কারীম (ﷺ)-এর খিদমতে হাজির হয় নি। নাবী কারীম (ﷺ) প্রথমাবস্থায় অত্যন্ত নম্র ও ভদ্রোচিত আচরণের মাধ্যমে তাঁর মনোতুষ্টির চেষ্টা করেন। কিন্তু যখন তিনি অনুধাবন করেন যে ভদ্রোচিত আচরণ ফলোৎপাদক হবে না, তখন তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, এর মধ্যে অনিষ্টতার সম্ভাবনা রয়েছে।
এর পূর্বে নাবী কারীম (ﷺ) স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, পৃথিবীর ধনভান্ডার তাঁর নিকট এনে রাখা হয়েছে তার মধ্যে দুটি সোনার তৈরি বালা এসে তাঁর হাতে পড়েছে। এ দেখে নাবী কারীম (ﷺ) অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়লেন। কাজেই, ওহীর মাধ্যমে তাঁকে ঐ দু’টিতে ফুঁক দেয়ার কথা বলা হল। তিনি সে মোতাবেক তাতে ফুঁক দিলেন এবং তৎক্ষনাত তা উড়ে গেল। নাবী কারীম এভাবে এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করলেন যে, তাঁর পরে দুই মিথ্যুকের (নিম্ন শ্রেণীর মিথ্যুক) আবির্ভাব ঘটবে। কাজেই মুসায়লামা যখন আত্মম্ভরিতার সঙ্গে বললেন যে, ‘মুহাম্মাদ যদি তাঁর পরে আমার উপর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব হাওয়ালা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তাহলে আমি তাঁর অনুসরণ করব।’
এ কথা শ্রবণের পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর নিকট গেলেন। তখন তাঁর হাতে ছিল একটি খেজুরের শাখা এবং তাঁর মুখপাত্র হিসেবে সঙ্গী ছিলেন সাবিত বিন ক্বায়স বিন শাম্মাস (রাঃ)। মুসায়লামাহ নিজ সঙ্গীগণের মধ্যে অবস্থান করছিলেন। নাবী (ﷺ) তাঁর মাথার উপর গিয়ে দাঁড়ালেন এবং কথা বললেন।
মুসায়লামা বললেন, ‘আপনি যদি চান তাহলে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে আপনাকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিব। কিন্তু আপনার পরবর্তী অবস্থায় আমাদের জন্য আপনাকে নেতৃত্বে দানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। নাবী কারীম (খেজুরের শাখাটির প্রতি ইঙ্গিত করে)বললেন,
(لَوْ سَأَلْتَنِيْ هٰذِهِ الْقِطْعَةَ مَا أَعْطَيْتُكَهَا، وَلَنْ تَعْدُوْ أَمْرَ اللهِ فِيْكَ، وَلَئِنْ أَدْبَرْتَ لَيَعْقِرَنَّكَ اللهُ، وَاللهِ إِنِّيْ لَأَرَاكَ الَّذِيْ أُرِيْتُ فِيْهِ مَا رَأَيْتُ، وَهٰذَا ثَابِتٌ يُجِيْبُكَ عَنِّيْ)،
‘যদি তুমি আমার নিকট হতে এর অংশটুকুও চাও তবুও আমি তোমাকে তা দেব না। অথচ তুমি নিজের ব্যাপারে আল্লাহর নির্ধারিত অংশের একটুও ব্যতিক্রম করতে পারবে না। যদি তুমি পশ্চাদমুখী হও তবুও আল্লাহ তোমাকে ধ্বংস করে ছাড়বেন। আল্লাহর কসম! আমি তোমাকে সে ব্যক্তিই মনে করছি যার ব্যাপারে আমাকে স্বপ্ন দেখানো হয়েছে। আমাকে স্বপ্নে যা দেখানো হয়েছে আমার পক্ষ থেকে সাবিত বিন ক্বায়স তার বিবরণ দেবেন।’
অতঃপর তিনি সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন।[2]
তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা অনুধাবন করেছিলেন ঠিক তাই হল। মুসায়লামা কাযযাব ইয়ামামা ফিরে গিয়ে প্রথমে নিজ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করতে থাকেন। অতঃপর দাবী করেন যে, তাঁকে নাবী কারীম (ﷺ)-এর সঙ্গে নবুওয়াতের কাজে শরীক করা হয়েছে। কাজেই, সে নবুওয়াতের দাবী করতে থাকে এবং অমিল ছন্দের কবিতা রচনা করতে থাকে। নিজ সম্প্রদায়ের জন্য ব্যভিচার এবং মদ্যপান বৈধ করে দেয় এবং এসব কিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে এ সাক্ষ্যও দিতে থাকে যে, নাবী মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর নাবী। এ ব্যক্তির প্রচারণার কারণে তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁকে অনুসরণ করতে থাকে। তাঁর সম্প্রদায়ের লোকজনদের মধ্যে তাঁর প্রভাব প্রতিপত্তি ও মর্যাদা এত বেশী বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে যে, তাকে ইয়ামামাহর রহমান বলা হতে থাকে।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট তিনি এ মর্মে একটি পত্র লিখেন যে, ‘আপনি যে কাজে রত আছেন আমাকে সে কাজে আপনার শরীক করা হয়েছে, রাষ্ট্রের অর্ধেক আমাদের জন্য এবং অর্ধেক কুরাইশদের জন্য।’ উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, (إِنَّ الْأَرْضَ لِلهِ يُوَرِّثُهَا مَنْ يَّشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ، وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِيْنَ) ‘পৃথিবী আল্লাহর! নিজ বান্দাগণের মধ্যে যাকে ইচ্ছা তিনি তার তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করেন এবং এর শেষ ফলাফল সমীহকারীদের জন্যই।[3]
ইবনু মাসউদ হতে বর্ণিত আছে যে, ইবনু নাওওয়াহাহ এবং ইবনু উসাল মুসায়লামাহর পত্র বাহক হিসেবে নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট আগমন করে। নাবী কারীম (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, (أَتَشْهَدَانِ أَنِّيْ رَسُوْلُ اللهِ؟) ‘তোমরা কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আমি আল্লাহর রাসূল?’ তারা বলল, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুসায়লামা আল্লাহর রাসূল’। নাবী কারীম (ﷺ) বললেন, (آمَنْتُ بِاللهِ وَرَسُوْلِهِ، لَوْ كَنْتُ قَاتِلاً رَسُوْلاً لَقَتَلْتُكُمَا) ‘আমি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করলাম। যদি কোন পত্র বাহককে হত্যা করা আমার নীতি হতো তাহলে তোমাদের দু’জনকে হত্যা করতাম।’[4]
মুসায়লামাহ কাযযাব ১০ম হিজরীতে নুবওয়াতের দাবী করেন। আবূ বাকর (রাঃ)-এর খিলাফত আমলে ইয়ামামাহ যুদ্ধে দ্বাদশ হিজরী রবিউল আওয়ালে তাকে হত্যা করা হয়। তার হত্যাকারী ছিল ওয়াহশী যে হামযাহ (রাঃ)-কে হত্যা করেছিল। নুবওয়াতের দাবীদার মুসায়লামা কাযযাবে পরিণতি হয়েছিল এই ।
নবুওয়াতের দ্বিতীয় দাবীদার ছিল আসওয়াদ ‘আনসী যে ইয়ামানে বিবাদ সৃষ্টি করে রেখেছিল। রাসূলে কারীম (ﷺ)-এর ওফাত প্রাপ্তির মাত্র ২৪ ঘন্টা পূর্বে ফাইরুয (রাঃ) তাকে হত্যা করেন। অতঃপর তার সম্পর্কে নাবী কারীম (ﷺ)-এর নিকট ওহী নাজিল হয় এবং তিনি সাহাবীগণ (রাঃ)-কে তা অবহিত করেন। এরপর ইয়ামান হতে আবূ বাকর (রাঃ)-এর নিকট নিয়মিত সংবাদ আসতে থাকে।[5]
[2] সহীহুল বুখারী বনু হানীফা এবং আসওয়াদ আনাসীর অধ্যায় ২য় খন্ড ৬২৭-৬২৮ পৃঃ, এবং ফতুহুল বারী ৮ম খন্ড ৮৭-৯৩ পৃঃ।
[3] যাদুল মা‘আদ ৩য় খন্ড ৩১-৩২ পৃঃ।
[4] মুসনাদে আহমাদ, মিশকাত ২য় খন্ড ৩৪৭ পৃঃ।
[5] ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড ৯৩ পৃঃ।